কনক-শাস্ত্র – ২৫

২৫.

কুমার সুভাষ হিংস্র দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল চাণক্যর দিকে। পরমুহূর্তে পেছন ঘুরে হাঁটা দিতে গেল। কিন্তু ততক্ষণে প্রায় দশ জন মৌর্য সৈনিক তাদের পথ আটকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। কুমারের দেহরক্ষী বল্লভের ডান হাত তলোয়ারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। চাণক্যর কথায় তা মাঝপথেই আটকে গেল।

—লাভ নেই। সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত তাঁর সেরাদেরই বেছে আমাদের সঙ্গে পাঠিয়েছেন। অতএব, অসি যুদ্ধে সবাইকে পরাস্ত করতে পারবে না কেউই। শান্তভাবে অস্ত্র সমর্পণ করলেই তোমার মঙ্গল। তক্ষশিলার আসামি তুমি। এখানেই বিচার হবে। তবে দোষ স্বীকার করলে তোমার সাজা যাতে কম হয়, সে-বিষয়ে আমি খেয়াল রাখার প্রতিশ্রুতি দিতে পারি।

কয়েক মুহূর্ত দ্বিধায় থাকল বল্লভ। নিজের পরিস্থিতি বিচার করল কয়েক মুহূর্ত। কোমর থেকে তলোয়ারের বাঁধনটা খুলে সশব্দে সেটা সামনে দাঁড়ানো সৈনিকের দিকে ছুড়ে দিল সে।

চাণক্য বললেন,

—হুম। ঠিক সিদ্ধান্ত। আর কুমার, তোমার অবগতির জন্যে জানিয়ে রাখি। তোমার কুকর্মর কথা বিশদে লিখে একটা চিঠি আমি আজ সকালেই তোমার বাবা, মহারাজ চক্রভামের কাছে দূত মারফত পাঠিয়ে দিয়েছি। তাতে অবিলম্বে তোমায় যুবরাজ পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার নির্দেশও দিয়েছি।

দু-চোখ জ্বলে উঠল কুমারের।

—সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার আপনি কে? আপনি এটা করতে পারেন না!

—অবশ্যই পারি। কারণ আমি বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্য! তোমার বয়স এবং রাজবংশর কথা মাথায় রেখে তোমায় কারাগারে নিক্ষেপ করছি না এটাই যথেষ্ট। তোমায় আজীবন, তোমার প্রদেশে গৃহবন্দি রাখা হবে, কুমার। তোমার বহিষ্কার পত্র আজই প্রধানাচার্যর থেকে পেয়ে যাবে। আর তোমার দেহরক্ষীকে গ্রেফতার করা হল।

কথা শেষ করে চাণক্য সবার উদ্দেশে বললেন,

—তক্ষশিলা আবার ফিরে যাক তার আগের গরিমাময় দিনে। আতঙ্কর অভিশাপ শেষ হল আজ থেকে। সব বাসিন্দাকে বলছি, আপনারা আজকেই নিজেদের বাড়ির সমস্ত বিষাক্ত কর্পূর মাটিতে পুঁতে ফেলুন। খেয়াল রাখবেন পুরোনো সমস্ত কর্পূর যেন নষ্ট করা হয়। আপনাদের রক্তে বিষাক্ত ধোঁয়া মিশে থাকায় এর প্রভাব আরও কয়েক মাস হয়তো থাকবে। কিন্তু ধীরে ধীরে সকলে সুস্থ, স্বাভাবিক হয়ে উঠবেন। আরও একবার আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ। আমি আজকের আলোচনা শেষ করতে চাই আচার্য বিন্দাচলের উদ্দেশে শোক জ্ঞাপন করে। তিনি সত্যিই একজন উৎকৃষ্ট শিক্ষক ছিলেন। নিজের আবিষ্কারের অপব্যবহার তিনি মেনে নেননি। আর সেই কারণেই প্রাণ হারিয়েছেন নিজের সহকারী রূপে থাকা হত্যাকারী বাসবের হাতে। এই বিশ্ববিদ্যালয়তে আমার শেষ কাজ শুধু বাকি আছে। আচার্য বিন্দাচলের মরদেহর অন্তিম সৎকার আমায় করতে হবে। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি। ওম শান্তি। ওম শান্তি। ওম শান্তি।

.

একে একে প্রত্যেকে বিদায় নিলেন। কুমার সুভাষ মাথা নীচু করে স্থানত্যাগ করল। আর তার দেহরক্ষীকে নিয়ে চার জন সৈনিক অন্যদিকে চলে গেল। বাসবকে দু-দিকে দু-জন সৈনিক ধরে রেখেছে। তাকেও নিয়ে যাচ্ছিল। চাণক্য বাধা দিলেন।

—দাঁড়াও। একে আমার কিছু প্রশ্ন আছে।

বাসবের ঠোঁটের কোণে হাসি লেগে আছে। তাকে যে চাণক্য প্রশ্ন করবেন সেটা যেন তার কাছে প্রত্যাশিতই ছিল। এই মুহূর্তে উপস্থিত শুধু কয়েকজন সৈনিক, তাদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা বাসব, প্রধানাচার্য, জীবসিদ্ধি এবং চাণক্য নিজে। চুলের বাঁধনটা একবার ঠিক করে বেঁধে নিয়ে চাণক্য এগিয়ে গেলেন বাসবের দিকে। মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালেন বাসবের। চাণক্যর চোখে চোখ রেখে বাসব শান্ত কণ্ঠে বলল,

—আপনার বুদ্ধির আরও একবার প্রশংসা না করে পারছি না, আচার্য। আমি কিন্তু সত্যি এতটা ভেবে পাইনি। সুনাভর হত্যাটা আমাকেও ভাবিত করেছিল। বইটা আমি খুঁজে পেয়েছিলাম একটা সাধারণ দোকানে। পুরোটা পড়ে দেখিনি। আমি শুধু মূল উপকরণগুলো দেখেছিলাম আর তাতেই বুঝেছিলাম যে এতে যথেষ্ট মাত্রায় কর্পূর ব্যবহার হবে। তাই ওটা উঠিয়ে এনেছিলাম। ওটাতে যে কোনো মানুষের প্রাণ উৎসর্গ করার উল্লেখ আছে তা জানতাম না আমিও। ধন্য আপনি

চাণক্য কথাগুলো শুনলেন বলে মনে হল না। বুকের ওপর হাত ভাঁজ করে দাঁড়ালেন। বললেন,

—যেকোনো রহস্যর সম্পূর্ণ সমাধান করতে হলে তিনটে প্রশ্নর উত্তর অনুধাবন করার প্রয়োজন পড়ে। কে? কীভাবে? এবং কেন? আমার কাছে প্রথম দুটোর উত্তর থাকলেও, শেষ প্রশ্নের উত্তর নেই। আমি এখনও বুঝতে পারছি না যে এই পুরো ষড়যন্ত্র তুমি কেন রচনা করলে? দু-বছরেরও বেশি সময় ধরে চেষ্টা করে এই কাজ করার উদ্দেশ্য কী তোমার? কী লাভ হত তোমার সবাইকে ভয় দেখিয়ে?

উত্তর না দিয়ে উন্মাদের মতো অট্টহাস্য করল বাসব। চাণক্য আবার প্রশ্ন করলেন,

—যদি এই কাজ কারুর নির্দেশে করে থাকো, তবে কে সে? চুপ করে থেকো না। উত্তর দাও!

হাসি থামিয়ে কৌতুকের ভঙ্গিতে বাসব বলল:

—সেকী! বিশ্বের সবচেয়ে বুদ্ধিমান ব্যক্তি, স্বয়ং কৌটিল্য বুঝতে পারছে না আমার উদ্দেশ্য? হা হা হা হা! তবে শুনে রাখুন, আচার্য। আপনি হেরে যাবেন। আপনি হেরে গেছেন।

একজন সৈনিক বাসবের দিকে এগিয়ে আসছিল তাকে প্রহার করতে। চাণক্য হাত তুলে বাধা দিলেন। আবার শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,

—কী বলতে চাইছ তুমি, বাসব?

ধক করে জ্বলে উঠল বাসবের চোখের তারা।

—চিনতে পারছেন না, আচার্য? চিনতে পারছেন না আমায়? অবশ্য আপনারই-বা দোষ কী? মুখ তো আগুনে পুড়ে আর চেনার যোগ্য নেই। আর গলার স্বর বয়ঃসন্ধিতে পালটে গেছে। দাঁড়ান, একটা জিনিস দেখাই। এটা দেখলে আমায় নিশ্চয়ই চিনতে পারবেন।

পরনের ধুতির কোমরের কাছ থেকে একটা ধাতব গোলাকার জিনিস বের করে আনল বাসব। চাণক্যর সামনে সেটা তুলে ধরে বাসব বলল :

—দেখুন তো, গুরুদেব। চিনতে পারেন কি না।

সেটা দেখেই চাণক্য চমকে উঠলেন। জীবসিদ্ধিও কম চমকিত হয়নি। কারণ জিনিসটা তার পরিচিত। বিশেষ ধরনের একটা লোহার হাত-বালা। এটার ঠিক সমরূপ একটা বালা আছে জীবসিদ্ধির নিজের ডান হাতের কবজিতে। এই বালা আছে সম্রাট চন্দ্রগুপ্তর হাতে এবং তাঁর অন্যান্য গুরুভাইদের হাতে। এই বালা চাণক্যর ছ-জন প্রিয় ছাত্রর প্রত্যেকের কাছে একটা করে আছে।

অস্ফুটভাবে চাণক্য উচ্চারণ করলেন একটা নাম,

—ইন্দ্ৰজিৎ!

২৬.

প্রধানাচার্য এবং জীবসিদ্ধি অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন চাণক্যর দিকে। অবাক হয়েছে উপস্থিত সৈনিকরাও। তবে সবচেয়ে বেশি যিনি হতবাক হয়েছেন, তিনি আচার্য চাণক্য স্বয়ং। নিষ্পলক দৃষ্টিতে তিনি বাসবের বিকৃত মুখের দিকে চেয়ে আছেন। একসঙ্গে অনেকগুলো স্মৃতি ভিড় করে আসছে ওঁর মনে বাসবের চামড়া কুঁচকে যাওয়া মুখটা আক্রোশের অভিব্যক্তিতে আরও বীভৎস মনে হল জীবসিদ্ধির। তার মনেও প্রচুর প্রশ্ন ভিড় করছে। কে এই ব্যক্তি?? আচার্যর সঙ্গে এর কী সম্পর্ক? সবথেকে বড়ো কথা, এই বালা তার কাছে কীভাবে এল? এই বালা চাণক্য শুধুমাত্র তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছ-জন ছাত্রকে দিয়েছিলেন। অভিজ্ঞান স্বরূপ। তবে? সেটা এই শয়তানটার কাছে কী করছে?

বাসব দাঁতে দাঁত চেপে বলল:

—যাক! চিনতে পেরেছেন তবে, গুরুদেব। আমি তো ভাবলাম নিজের প্রথম শিষ্যকে ভুলেই গেছেন। ভুলেই গেছেন সেই কিশোরকে, যাকে আপনি সারা আর্যাবর্তের সম্রাট হওয়ার মিথ্যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। আমায় এই তক্ষশিলায় নিয়ে এসে শিক্ষা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আর তারপর নিজের কার্যসিদ্ধি হয়ে যেতেই যাকে অবাঞ্ছিতর মতো ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। হ্যাঁ। আমিই ইন্দ্ৰজিৎ!

নিজেকে সামলে নিতে চাণক্যর কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল। চোখের তারা থেকে বিহ্বল ভাব কেটে গিয়ে তাতে আবার তার সাধারণ শান্তভাব ফিরে এল। বললেন,

—হুম। আমার আগেই অনুমান করা উচিত ছিল। বাসবজিৎ হল মেঘনাদ ইন্দ্রজিতেরই অন্য নাম। এত ষড়যন্ত্রর নেপথ্যে তোমার তবে উদ্দেশ্য ছিল আমায় এখানে এনে বুদ্ধির খেলায় পরাস্ত করা। আর শুধুমাত্র আমার ওপর নিজের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে তুমি হত্যা পর্যন্ত করলে। তুমি সেই মানুষটাকে হত্যা করেছ যে বিশ্বাস করে তোমায় এখানে কাজ দিয়েছিল। আচার্য বিন্দাচল তোমায় বিশ্বাস করেছিল! ধিক্কার তোমায়, ইন্দ্রজিৎ। ধিক্কার আমায়, যে, একসময় তোমায় নিজের শিষ্য বানানোর মতো ভুল করেছিলাম।

আবার জ্বলে উঠল বাসবের দৃষ্টি,

—আপনি! হ্যাঁ, আপনি আমার জীবন ধ্বংস করেছেন। আমি এই দেশের সম্রাট হতে পারতাম। আপনি জানতেন আমার মধ্যে সেই শৌর্য, সাহস আর বুদ্ধি ছিল। কিন্তু আপনি আত্ম অহংকারের কারণে আমায় সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছিলেন। যোগ্য ছিলাম আমি! যোগ্য ছিলাম আমি সম্রাট হওয়ার! আমার জায়গায় আপনি এক হীনকুলকে সিংহাসন দিলেন।

কঠোর হয়ে উঠল চাণক্যর কণ্ঠ,

—মহাকাল প্রমাণ করেছে যে আমি ঠিক বিচার করেছিলাম। নিজের হীন কৃতকার্যর দ্বারা তুমি প্রমাণ করেছ যে তুমি কোনোকালেই যোগ্য ছিলে না। শুনে রাখো, ইন্দ্রজিৎ! শুনে রাখো চাণক পুত্র চাণক্যর কথা! তুমি অযোগ্য ছিলে সেদিনও এবং আজও তাই আছ।

সৈনিকদের উদ্দেশে বললেন,

—বন্দি করো একে। আজই বন্দিকে সঙ্গে নিয়ে চার জন সৈনিক রওনা হয়ে যাও মগধের উদ্দেশে। পাটলিপুত্রর কারাগারে একে আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।

সৈনিকরা টেনে নিয়ে যাওয়ার সময়ে বাসব চিৎকার করতে থাকল,

—নিপাত যাবে তোমার রাষ্ট্র! ধ্বংস হবে মগধ। হা হা হা হা হা! তোমার সর্বনাশের পালা শুরু হয়ে গেছে, বিষ্ণুগুপ্ত। তুমি যদি ভেবে থাকো যে আমায় পরাস্ত করলেই সব শেষ, তুমি ভুল ভাবছ। ভুল ভাবছ তুমি!! হা হা হা! ধ্বংস হোক তোমার সাজানো এই স্বপ্ন!

ভুরু কুঁচকে চাণক্য অন্যদিকে চেয়ে থাকলেন। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে, বুকের ওপর থাকা নিজের লম্বা টিকির চুলে হাত বোলালেন কয়েক বার। চিন্তা ভঙ্গ হতেই, করজোড়ে প্রধানাচার্য ভদ্রভট্টকে প্রণাম জানিয়ে, বিনা বাক্যব্যয়ে অতিথি- নিবাসের দিকে পা চালালেন। জীবসিদ্ধিও গুরুর দেখাদেখি, বৃদ্ধকে বিদায় জানিয়ে, পিছু নিল চাণক্যর। তার মনে এখন বহু প্রশ্ন ঘুরছে। একটা ব্যাপার সে অনুমান করতে পারছে যে বাসব ছদ্মনামের মানুষটা, তাদের সকলের আগে, চাণক্যর শিষ্য ছিল কোনো এক সময়ে। কিন্তু এর উল্লেখ কখনো চাণক্যর মুখে সে শোনেনি। তার বাকি গুরুভাইরা, এমনকী চন্দ্রগুপ্তও এর বিষয়ে সম্ভবত অবগত নয়। আশ্চর্য মানুষ তার আচার্য! আরও কত গোপন রহস্য যে ওঁর মনে আছে, তার অনুমানও জীবসিদ্ধি কোনোদিন করতে পারবে না।

অতিথি-নিবাস পৌঁছে চাণক্য নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন। তার আগে শুধু একটা কথাই বললেন,

জীবসিদ্ধি, আচার্য বিন্দাচলের মৃতদেহ সৎকারের ব্যবস্থা করো। আজকের মধ্যে এই কাজটা সম্পন্ন হওয়া প্রয়োজন। অনেক অপেক্ষা করেছেন তিনি।

—বেশ, আচার্য।

.

তৃতীয় প্রহর নাগাদ সব ব্যবস্থা করে জীবসিদ্ধি ডেকে নিয়ে গেল চাণক্যকে। প্রধানাচার্য সহ প্রত্যেক আচার্যর উপস্থিতিতে, চাণক্য নিজে আচার্য বিন্দাচলের শেষকৃত্য সম্পন্ন করলেন। সব কাজ শেষ করে চাণক্য এবং জীবসিদ্ধি অতিথি-নিবাসের পথ ধরলেন। নিবাসের কয়েক পা দূরে ওঁরা লক্ষ করলেন যে দু-জন সৈনিক তাঁদের দিকে এগিয়ে আসছে। কাছে আসতে একজন সৈনিক উদগ্রীব হয়ে বলল:

—আচার্য, আমায় ক্ষমা করুন। দুঃসংবাদ আছে।

—কী দুঃসংবাদ, বীর?

—আচার্য। বাসবজিৎ নামে লোকটার মৃত্যু হয়েছে। তাকে হত্যা করেছে আততায়ী!

—কী? এর অর্থ কী, সৈনিক? কে হত্যা করল তাকে?

—ক্ষমা করুন, আচার্য। আমরা জানি না। বন্দিকে আমরা সঙ্গে নিয়ে সবে বিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে বেরিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে তুলতে উদ্যত হয়েছিলাম। ঠিক সেইসময়ে আচমকা ধনুর্ধারী একজন ঘোড়সওয়ার চলে আসে দ্রুতবেগে। সম্ভবত আমাদেরই অপেক্ষায় ছিল। দ্রুতগতিতে চলমান ঘোড়ার পিঠ থেকেই লোকটা একটা তির ছোড়ে। আমরা সতর্ক হওয়ার আগেই সেটা বন্দিকে বিদ্ধ করে। ঘটনাটা এতটাই আকস্মিক ছিল যে আমরা কিছু করার আগেই সব কিছু ঘটে যায়। পিছু নেয়ার চেষ্টা করেছিলাম আমরা, কিন্তু বিফল হয়েছি। ঘোড়া মাঝপথে ফেলে হত্যাকারী লোকালয়ে মিশে গেছে। মুখ ঢাকা থাকায় তাকে চিহ্নিত করারও কোনো উপায় ছিল না।

—তোমরা চার জন সৈনিক থাকতে এ কীভাবে হয়? কীভাবে এই ভুল ঘটতে দিলে তোমরা?

মাথা নীচু করে দু-জনে বলল:

—ক্ষমা করবেন, আচার্য।

।চোখ বুজে নিজের টিকিতে একবার হাত চালিয়ে শান্ত হলেন চাণক্য চোখ খুলে বললেন,

—আমায় মৃতদেহর কাছে নিয়ে চলো।

.

মাটিতে শুয়ে আছে বাসবজিতের মৃতদেহ। হাত দুটো বুকের ওপর রাখা। ডান চোখের কোটরে একটা তির বিদ্ধ হয়ে আছে। এখনও রক্তপাত হয়ে চলেছে চোখ থেকে। মুখ যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে গেছে মৃত্যুর আগের মুহূর্তে।

মৃতদেহর ওপর ঝুঁকে পড়লেন চাণক্য। তিরটার ওপর আঙুল বোলালেন বার কয়েক। জীবসিদ্ধি লক্ষ করল, আচার্যর কপালে ভ্রূকুটি। জীবসিদ্ধির নিজেরও সব যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। বাসবকে কে হত্যা করল? মূল অপরাধী তো বাসব নিজেই। তবে তাকে আবার হত্যা করল কে?

চাণক্য ডাকলেন,

—জীবসিদ্ধি।

—হ্যাঁ, আচার্য।

—তিরটা লক্ষ করো।

চাণক্যর পাশেই বসে ঝুঁকে পড়ল জীবসিদ্ধি। হাত দিয়ে পরীক্ষা করল তিরটা। তার কপালেও চিন্তার ছাপ ফুটে উঠেছে। চাণক্য প্রশ্ন করলেন,

—কিছু মনে পড়ছে?

—হ্যাঁ। কয়েক মাস আগে এই একই ধরনের তির আমি দেখেছি।

—হুম। আমি তবে ভুল করিনি। আমিও চিনতে পেরেছি এই তির দেখেই। কোথায় দেখেছ মনে করতে পারছ আশা করি?

গম্ভীর গলায় উত্তর দিল জীবসিদ্ধি,

—হ্যাঁ। আমাদের কয়েকজন সৈনিককে এই বিষাক্ত তির দিয়েই হত্যা করা হয়েছিল সেইবার। রাজকোষের স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে চলা ঘোড়ার গাড়িতে একদল দস্যু হামলা করেছিল। সোনা ভরা একটা সিন্দুক তারা লুঠ করে। সেইবার মৃত সৈনিকদের শরীরে এই একই তির দেখেছিলাম।

—হুমম। ঠিক বলেছ। এইবার প্রশ্ন হচ্ছে যে এই একই তির, তক্ষশিলায় কী করছে?

২৭.

চিন্তিতভাবে কাঠের চারপায়া আসনে বসে আছেন চাণক্য। স্থিরদৃষ্টিতে সামনে রাখা প্রদীপের শিখার দিকে চেয়ে আছেন। সেটার প্রতিফলন ওঁর চোখের তারায় পড়ছে। তার সামনেই মেঝের আসনে শুয়ে আছে জীবসিদ্ধি। জীবসিদ্ধি লক্ষ করছে যে বহুক্ষণ হল আচার্যর চোখের পাতা পড়েনি। ঘরে ফিরে আসার পর থেকেই এরকমভাবে বসে আছেন চাণক্য।

চিন্তিত জীবসিদ্ধি নিজেও। যখন তার মনে হয়েছে সব রহস্যর সমাধান হয়েছে, তখনই আবার একটা নতুন রহস্য তাদের সামনে চলে এসেছে। সৈনিকদের থেকে জানা গেছে যে তিরটা বিদ্ধ হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে মৃত্যু হয়েছে বাসবজিতের। চোখে তির লাগলে তক্ষুনি মৃত্যু হওয়ার কথা নয়। অতএব, তিরের ফলায় নিঃসন্দেহে বিষ ছিল। ঠিক যেমন মগধের সৈনিকদের বিষাক্ত তির দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এই একই ধরনের তির। কিন্তু বাসবকে হত্যা করা হল কেন? কেই-বা হত্যা করল তাকে?

—ওহে, জীবসিদ্ধি।

চিন্তায় ছেদ পড়ল। উঠে বসল জীবসিদ্ধি

—বলুন, আচার্য।

—পাটলিপুত্র থেকে আসা চিঠিগুলো তোমার কাছে আছে না?

—হ্যাঁ। আমার ঘরে। নিয়ে আসব?

—হুম। সবকটা চিঠি একবার আমায় এনে দাও। দুশ্চিন্তা হচ্ছে, জীবসিদ্ধি। খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে।

জীবসিদ্ধি উঠে গেল নিজের ঘরে। খানিকক্ষণ বাদেই চিঠিগুলো নিয়ে ফিরে এল। চাণক্য এক-একটা চিঠি খুলে, তারিখ অনুযায়ী কোলের ওপর সাজালেন। পাশে দাঁড়িয়ে জীবসিদ্ধি তার গুরুর কার্যকলাপ লক্ষ করছে। চাণক্য চিঠিগুলো আবার পড়তে শুরু করলেন। প্রথমবার পড়া শেষ করে আবার পড়লেন। অন্যমনস্কভাবে আরও কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন প্রদীপের শিখার দিকে। হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন।

—সর্বনাশ হতে চলেছে। অথবা ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। সব আমার ভুল। দৃষ্টির সামনে থাকা সত্ত্বেও আমি মূল সমস্যাটা দেখতে পাইনি।

জীবসিদ্ধি বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করল,

—এইসব কী বলছেন, গুরুদেব? কার সর্বনাশ হতে চলেছে?

—দেশের!

—আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, আচার্য।

পায়চারি করতে শুরু করেছেন চাণক্য। দু-হাত পেছনে দিয়ে ঘরময় হেঁটে চলেছেন। নিজের মনেই কিছু কথা বলে চলেছেন। কয়েকটা ভাঙা ভাঙা কথা কানে এল জীবসিদ্ধির।

—ফিরতে হবে… নজর রাখছে… কে হতে পারে….. হ্যাঁ… নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই… আমি নিশ্চিত… খবর পাঠাতে হবে… এক্ষুনি।

হঠাৎ হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন চাণক্য। জীবসিদ্ধির দিকে ফিরে বললেন,

—জীবসিদ্ধি, কালকে সকালে পাখিশালায় যাবে। সেখানকার পাখি প্রশিক্ষকের থেকে তার সবচেয়ে দ্রুতগামী তিনটে পায়রা চাইবে। আমার দেয়া চিঠিটা প্রথমটার গলায় বেঁধে নিজে উড়িয়ে দেবে পাটলিপুত্রের উদ্দেশে। এরপর তুমি ফিরে আসবে। তুমি ফিরে আসার কিছুক্ষণ পর যেন প্রশিক্ষক দ্বিতীয় পায়রাটা উড়িয়ে দেয়। আরও কিছুক্ষণ পর, তৃতীয়টা।

—সে করব। কিন্তু দ্বিতীয় আর তৃতীয় পাখির গলায় কোন চিঠি থাকবে?

—প্রথম চিঠিতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু থাকবে না। আমার আসল নির্দেশ থাকবে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় চিঠিতে। আমার চিঠি চন্দ্রগুপ্তর হাত অবধি পৌঁছোনোটা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের ওপর নজর রাখা হচ্ছে। সম্ভাবনা আছে যে তোমায় চিঠি পাঠাতে দেখে সেই চিঠি মাঝপথেই আটকে দেয়ার চেষ্টা হতে পারে। পায়রাটাকে তির মেরে মাটিতে এনে ফেলতে পারে আমাদের শত্রুরা। সেই কারণেই দ্বিতীয় ও তৃতীয় পায়রার ব্যবস্থা করতে বললাম।

অবাক হয়েছে জীবসিদ্ধি। প্রশ্ন করল,

—এইসব ব্যবস্থা তো যুদ্ধ চলাকালীন ব্যবহার হয়, আচার্য। এখন এই অতিরিক্ত সাবধানতার কারণ কী?

—সাবধানতা কখনো অতিরিক্ত হয় না, জীবসিদ্ধি। আর যুদ্ধর কথা বলছ? তবে শুনে রাখো, মগধের ওপর হামলা করা হয়েছে! দু-মাস আগেই মগধের ওপর হামলা করেছে তার সবথেকে বড়ো শত্রু।

—কী বলছেন আপনি, আচার্য? সম্রাট তো আমাদের কিছুই বলেননি! যুদ্ধর সম্ভাবনা থাকলে কি আমরা জানতাম না সেটা?

চোখ বুজে কিছুক্ষণ ভাবলেন আচার্য। একটা বড়ো ভূর্জপত্র তুলে তাকে তিনটে ছোটো টুকরো করলেন। দোয়াত থেকে কলম তুলে প্রথমটাতে লিখলেন,

‘এখানে সব কুশল মিটেছে। কয়েক সপ্তাহ বিশ্রাম নিয়ে মগধের উদ্দেশে রওনা হব।’

এরপর পরের দুটো ভূর্জপত্রতে লিখলেন,

‘এই মুহূর্ত থেকে, রাজকোষ থেকে সমস্ত বড়ো অঙ্কের আর্থিক লেনদেন স্থগিত করা হোক। শীঘ্রই ফিরছি।’

নীচে নিজের অঙ্গুরিমুদ্রা দিয়ে সিলমোহর দিলেন। তিনটে ভূর্জপত্র ভাঁজ করে ছোটো করে সেগুলো জীবসিদ্ধির হাতে দিলেন। বললেন,

—মন দিয়ে শোনো। আমাদের হাতে সময় নেই। আজ রাতে পরিপূর্ণ বিশ্রাম নাও। কারণ কাল তুমি এই চিঠি পাঠিয়ে ফিরে এলেই আমরা তক্ষশিলা ত্যাগ করব।

—বেশ। সৈনিকদের তাহলে আজকেই সেই খবর দেয়া প্রয়োজন।

—না! একদম না। আমাদের তক্ষশিলা ত্যাগ করতে হবে গোপনে। প্রধানাচার্য ছাড়া কোনো তৃতীয় ব্যক্তি আমাদের গুরুকুল ত্যাগ করার খবর যেন জানতে না পারে। সৈনিকদেরও জানানো যাবে না। তাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে গেলে সবার নজরে আসবেই। খবর গোপন থাকবে না। আমি শুধু প্রধানাচার্যকে বলে দেব, তিনি যেন সবাইকে জানিয়ে দেন যে, আমরা আরও কয়েক দিন বিশ্রাম নিয়ে তারপর রওনা হব। কিন্তু বাস্তবে আমরা কালকেই দক্ষিণ দরজা দিয়ে দু-জনে মগধের উদ্দেশে ঘোড়া ছুটিয়ে দেব। আশা করি প্রধান ফটক বাদে অন্য দরজা দিয়ে আমরা বেরিয়ে গেলে গুপ্তচরের নজর এড়ানো সম্ভব হবে।

—গুপ্তচর?

—অবশ্যই! তা না হলে ইন্দ্রজিৎকে আমরা বন্দি করার পর পরই তাকে হত্যা করা হয় কীভাবে? নিশ্চয়ই আমাদের ওপর কেউ-বা কারা নজর রেখে চলছিল।

—বেশ। কিন্তু আচার্য, আপনি বলছেন যে মগধের ওপর শত্রুর আক্রমণ হয়েছে। এটা আমি বুঝলাম না।

—সব যুদ্ধই যুদ্ধক্ষেত্রে লড়া হয় না, জীবসিদ্ধি। সব হামলা শুধু সীমান্তে করা হয় না। কাল সব বুঝিয়ে বলব। বিশ্রাম নাও আজ। কাল থেকে আমাদের দু-জনের সুদীর্ঘ পথযাত্রা শুরু হবে।

২৮.

গান্ধারের সীমান্তে একটা গ্রামে আজকে রাতের মতো আশ্রয় নিয়েছেন চাণক্য এবং জীবসিদ্ধি। ব্রাহ্মণদের জন্যে যেকোনো গৃহস্থ বাড়িতেই আশ্রয় পাওয়ার কোনো সমস্যা হয় না। এখানেও এই গরিব পরিবারটা আপ্যায়ন করে তাদের রাত কাটানোর ব্যবস্থা করেছেন। যৎসামান্য আয়োজন সত্ত্বেও ব্রাহ্মণ দু-জনকে খাইয়ে বিশ্রামের ব্যবস্থা করেছেন।

পূর্ব পরিকল্পনা মতোই আজ সকালে, পাখির মাধ্যমে চিঠি পাঠিয়েই দু-জনে দক্ষিণ ফটক দিয়ে বিদ্যালয় ত্যাগ করেছেন। সারাদিন ঘোড়া ছুটিয়ে দু-জনেই ক্লান্ত। সারাদিনের মধ্যে শুধু একবার তারা ঘোড়া থামিয়েছে। ঘোড়া দুটোকে হ্রদের জল পান করিয়ে বিশ্রাম দিতে। সূর্যাস্তের পরে তারা আশ্রয় নিয়েছে একটা গ্রামে। কাল সকালে এখান থেকেই আগামী কয়েক দিনের মতো খাবার সংগ্রহ করে আবার রওনা হতে হবে। বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন। তাই জীবসিদ্ধির প্রবল ইচ্ছে থাকলেও সে এই মুহূর্তে প্রশ্ন করতে পারছে না চাণক্যকে।

চাণক্য চোখ বুজে শুয়ে পড়েছেন। কিন্তু জীবসিদ্ধির চোখে ঘুম নেই। চাণক্যের পাশেই, মেঝের ওপর সেও শুয়ে। চোখ বোজা অবস্থাতেই চাণক্য বললেন,

—কৌতূহল না মেটা অবধি কি ঘুমও আসে না তোমার, জীবসিদ্ধি? হেসে উঠল জীবসিদ্ধি। বলল :

—সেটাই কি স্বাভাবিক নয়, আচার্য? গতকাল থেকেই আমি মনে অনেকগুলো প্রশ্ন চেপে রেখেছি।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাণক্য বললেন,

—কী জানতে চাও বলে ফেলো।

—সব কিছু! তবে আপনি খুব ক্লান্ত হয়ে থাকলে আজ থাক।

এইবার চোখ খুলে তার দিকে তাকালেন চাণক্য,

—হুম। অবশ্যই আমি পরিশ্রান্ত। কিন্তু পাশে তুমি যতক্ষণ জেগে বসে থাকবে ততক্ষণ আমার ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটবে। অতএব, তোমায় কিছু উত্তর আমায় দিতেই হবে মনে হচ্ছে।

মুচকি হেসে ফেলল জীবসিদ্ধি। চাণক্য এক হাতে মাথা ভর দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় প্রশ্ন করলেন,

—কোথা থেকে শুরু করব?

—বাসবজিৎ।

—হুম।

আবার নিজের জায়গায় সোজা হয়ে শুয়ে কথা শুরু করলেন চাণক্য।

.

কয়েক বছর আগের কথা। ম্যাসিডোনিয়ার যবন সম্রাট সিকন্দর* তার বিশ্বজয় যাত্রা শুরু করেছে। একের পর এক দেশকে পর্যুদস্ত করে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে, দেশের সমস্ত রাজ্যের শাসকদের এক করার উদ্দেশ্যে আমি গেলাম মগধে। সুরা এবং আমোদে ডুবে থাকা সম্রাট ধনানন্দ আমায় অপমান করে রাজপ্রাসাদ থেকে বের করে দেয়। আমি সেই মুহূর্তে প্রতিজ্ঞা করি যে আমি এই দুরাচারীকে উৎখাত করবই। এর জায়গায় আমি যোগ্য ব্যক্তিকে সিংহাসনে বসাব। এবং যতদিন না তা করতে সক্ষম হচ্ছি ততদিন নিজের টিকি খোলা রাখব।

এই ঘটনা তোমাদের সবারই জানা। কিন্তু এর পরের ঘটনা তোমরা কেউই জানো না। মগধ থেকে যখন বেরিয়ে আসি তখন আমার মনে ঝড় চলছে। দেশের সবথেকে শক্তিশালী সাম্রাজ্যের পতন ঘটানো সহজ নয়। এরজন্যে প্রয়োজন বিশাল সৈন্যবল এবং বিপুল পরিমাণ অর্থ। আর সবথেকে আগে প্রয়োজন একজন যোগ্য ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা যে ভবিষ্যতে সম্রাট হবে। আমি সেই সময়ে শুধুই রাজ্যের পর রাজ্য আর প্রতিটা রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছি, পথে দেখা প্রতিটা মানুষের মধ্যে খুঁজে চলেছিলাম সেই রকম কারুকে।

চেদি রাজ্যে শুনতে পেলাম সেখানকার রাজা বীর যোদ্ধাদের মল্লযুদ্ধ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছেন। আমি উৎসাহ নিয়ে সেখানে পৌঁছে গেলাম। মনে আশা ছিল যে হয়তো এই যুদ্ধে জয়ী হওয়া বীর যোদ্ধাই আমার কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি হবে। যুদ্ধ শুরু হল। ছ-জন যোদ্ধার যুদ্ধের কলা দেখেই আমি অনুমান করতে পারছিলাম কে জিততে চলেছে। সেখানেই দর্শকদের মধ্যে, আমার পাশেই দাঁড়িয়ে খেলা দেখা একদল উৎসাহী বালকের কথাবার্তা আমার কানে এল।

—এই তৃতীয় যোদ্ধা জিতবে নিঃসন্দেহে।

—হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়। দেখো না, কেমন শক্তিশালী বাহু তার।

—না, না। আমার তো মনে হয় প্রথম যোদ্ধা জিতবে। কারণ ওর হাতে সবচেয়ে বড়ো অস্ত্র আছে। আর বর্মটাও খুব মজবুত।

—না। পঞ্চম প্রতিযোগী জিতবে।

শেষের জনের কথাটা আমার কানে যেতেই আমি বক্তার দিকে দৃষ্টি ফেরালাম। তার কারণ হল, আমার নিজেরও অভিমত যে পঞ্চম যোদ্ধাই জিততে চলেছে। কৌতূহলী হয়ে দেখলাম সেদিকে। দেখলাম একজন বালক কথাটা বলছে। সম্ভবত উপস্থিত বালকদের দলপতি। কারণ তার কথা সকলে মনোযোগ দিয়ে শুনছে,

—অস্ত্র, কবচ আর বল দিয়ে যুদ্ধ জেতা যায় না। জিততে গেলে প্রয়োজন বুদ্ধি। আর এই পঞ্চম প্রতিযোগীর যুদ্ধকৌশল দেখেই বোঝা যায় যে সে বুদ্ধি দিয়ে লড়াই করছে।

অবিকল নিজের চিন্তা অন্যের মুখে শুনে আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। আমার মনে হল যে হয়তো এই বালকই, হ্যাঁ, এই বালকই হতে পারে আর্যাবর্তের ভাবী সম্রাট। এই বালকই ছিল ইন্দ্ৰজিৎ।

আমি তার সঙ্গে পরিচিত হই। তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়ে তাকে আমার শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে বলি। তার বাবা-মা দু-জনই মৃত ছিল। অতএব কোনো পিছুটান ছাড়াই সে আমার সঙ্গে আসে। পরবর্তী সময়ে তাকে আমি বিবিধ পরীক্ষার সামনে ফেলি। তার সাহস এবং মানুষের মন জয় করার ক্ষমতা দেখে আমিও মুগ্ধ হই। তাকে আমি নিজের স্বপ্নের পরিকল্পনা বলি। তাকে জানাই যে আমি তাকে তক্ষশিলায় শিক্ষা দেব, মগধের পরবর্তী সম্রাট করব। কিন্তু সেই সময়ে আমি প্রতিশোধের আগুনে ভেতরে ভেতরে জ্বলছিলাম আর অধৈর্য হয়ে পড়েছিলাম। তাই নিজের বিচারে ভুল করে ফেলি। আমি ইন্দ্ৰজিতের স্বরূপ দেখতে পাইনি।

তাকে নিয়ে আমি আশাবাদী হয়ে পড়েছিলাম। তাকে নিজের বিশেষ হাত- বালাও দিই। কিন্তু একজন সম্রাট হতে গেলে শুধু বল, বুদ্ধি আর সাহসই পর্যাপ্ত নয়। প্রয়োজন নৈতিক দৃঢ়তা। উপযুক্ত সম্রাট সে-ই, যে অন্যের জন্যে জীবন দিতে প্রস্তুত থাকবে। সাধারণ মানুষের কষ্টে তারও প্রাণ কাঁদবে। বছর ঘুরতে-না-ঘুরতেই আমি বুঝতে পারি যে ইন্দ্রজিতের মধ্যে সেই গুণ নেই। তার চোখে আমি ক্ষমতার লোভ এবং শঠতার কালো ছায়া দেখতে পাই। আমি বুঝতে পারি যে আমি ভুল করেছি। ভাবী সম্রাটকে খুঁজে পেতে, অধৈর্য হয়ে আমি অত্যধিক তাড়াহুড়ো করে ফেলেছি। ইন্দ্রজিৎ আমার দেখানো স্বপ্নে, আমার চেয়েও বেশি বিভোর হয়ে পড়েছে। সে এখনই নিজেকে সম্রাট ভাবতে শুরু করেছে। অতএব, আমি তাকে ত্যাগ করি।

স্বাভাবিকভাবেই সে বিষয়টা সহজে মেনে নিতে পারেনি। আমায় বার বার বলতে থাকে যে আমি ভুল করছি, সে-ই যোগ্য সম্রাট। কিন্তু আমি নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকি। আমি সেই সময়ে অবন্তি রাজ্যে। ইন্দ্রকে চেদি ফিরে যেতে বলি। কিন্তু সে শোনে না আমার কথা। একদিন রাতে আমি তাকে ঘুমের মধ্যেই ত্যাগ করি। রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে বেরোনোর সময়ে শুনতে পাই, যে গ্রামে আমরা রাতে ছিলাম, সেখানে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে শেষরাতের দিকে। বহু গ্রামবাসী প্রাণ হারিয়েছে। আমি চিন্তিত হয়ে ফিরে যাই ইন্দ্রজিতের খোঁজে। কিন্তু তাকে খুঁজে পাইনি। আমি ধরে নিই যে সেও হয়তো হতভাগ্য গ্রামবাসীদের মতোই আগুনে পুড়ে প্রাণ দিয়েছে।

.

চুপ করলেন চাণক্য। তাঁর ভাসা ভাসা চোখের দৃষ্টি দেখে অনুমান করা যায় যে তিনি অতীতের স্মৃতিতে হারিয়ে গেছেন। কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে ডুবে থাকলেন নিজের চিন্তায়। তারপর আবার বর্তমানে ফিরে এলেন। বললেন,

গতকালই জানতে পারলাম যে তার মৃত্যু হয়নি। সম্ভবত সেই রাতেই আগুনে তার মুখ পুড়ে গেছিল। কিন্তু তার চেয়েও বেশি যেটা পুড়ে গেছিল সেটা হল তার হৃদয়। প্রতিহিংসার আগুন সবচেয়ে বেশি দগ্ধ করে মানুষকে। আমাকে ইন্দ্ৰজিৎ তার নিজের স্বপ্নভঙ্গের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং এত বছর অপেক্ষায় থেকেছে প্রতিহিংসার।

জীবসিদ্ধি মনোযোগ দিয়ে শুনছিল এতক্ষণ। এইবার প্রশ্ন করল,

—এই ঘটনা আমাদের সঙ্গে আপনার সাক্ষাতের কত বছর আগের?

—দু-বছর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই আমি উপলব্ধি করতে পারি যে এই জগতে কোনো পরিবর্তনই বাইরে থেকে আনা সম্ভব নয়। পরিবর্তন আসে ভেতর থেকেই। মগধের ভাবী সম্রাট, যে মানুষের দুরবস্থার পরিবর্তন আনবে, তাকে মগধেরই কেউ হতে হবে। যে নন্দদের অত্যাচার স্বচক্ষে দেখেছে, সে-ই প্রথম প্রতিবাদ করতে পারে। আর তাকেই তার নিজের মাতৃভূমির মানুষ অনুসরণ করবে। অতএব, এর দু-বছর পর আমি মগধেই খুঁজে পাই আমার ভাবী সম্রাটকে। মুরা পুত্র চন্দ্রগুপ্তকে। তাকে নিয়ে আসি তক্ষশিলায়। সেখানেই তোমাদের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ।

কিছুক্ষণ দু-জনই কোনো কথা বলল না। চাণক্য বললেন,

—অনেক রাত হল। আজকের মতো এখানেই ইতি দাও। সামনে দীর্ঘ পথ। অনেক সময় আছে বাকি কথা বলার। আজ বিশ্রাম নাও, জীবসিদ্ধি। শুভরাত্রি।

ফুঁ দিয়ে মাথার ওপরের দিকে রাখা প্রদীপটা নিভিয়ে দিলেন চাণক্য।

*সিকন্দর – আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট।

২৯.

বেশ কয়েক দিনের যাত্রার পর মগধের সীমান্ত প্রদেশে এসে পৌঁছেছেন চাণক্য এবং জীবসিদ্ধি। সব কুশল থাকলে এবং আগামীকাল সূর্যোদয়ের সময়ে যাত্রা শুরু করতে পারলে, সূর্যাস্তর সময়েই পাটলিপুত্র পৌঁছে যাওয়া সম্ভব হবে। এই গ্রামের এক চাষির বাড়িতে, একটা রাতের জন্যে আশ্রয় নিয়েছেন দু-জনে। মাঝের কয়েকটা রাত হয় খোলা আকাশের নীচে, অথবা কোনো গৃহস্থ বাড়িতে কাটাতে হয়েছে তাদের। তবে চাণক্য এবং জীবসিদ্ধি, দু-জনেরই অতীতে এভাবে রাত কাটানোর অভ্যাস আছে।

আজ বহুদিন পর জীবসিদ্ধি আবার প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়েছে। এই কয়েকটা রাতে হয় গোপন কথা আলোচনা করার পরিস্থিতি ছিল না, অথবা ক্লান্ত থাকায় তা আর করা হয়নি।

—আচার্য?

পদ্মাসনের ধ্যান মুদ্রায় বসে আছেন চাণক্য। চোখ না খুলেই সাড়া দিলেন,

—হুম।

—আমি আজ এখানে এসেই প্রথমে গ্রামের কিছু মানুষের কাছে খোঁজ নিয়েছি যে মগধে বা পাটলিপুত্রতে কোনো বিপদ ঘটেছে কি না। প্রত্যেকেই জানিয়েছে যে সেই রকম কোনো খবর এখনও পর্যন্ত তাদের কাছে নেই। সব স্বাভাবিক আছে। তবে আপনি কোন বিপদের আশঙ্কায় এভাবে ছুটে এলেন এখানে?

তিনি জীবসিদ্ধির দিকে চোখ খুলে চাইলেন। বললেন,

—জগতের সবচেয়ে ভয়ানক আপদ সেটাই, যার অস্তিত্ব সম্পর্কে কেউ অবগত থাকে না এবং সেই কারণেই সেই আক্রমণ প্রতিহত করারও কেউ প্রয়োজন বোধ করে না। সবার দৃষ্টির সামনে থেকেও, সবার অলক্ষে তা শত্রুকে ধ্বংস করে। মগধ আক্রান্ত। মগধ একটা ভয়ানক ষড়যন্ত্রর শিকার হয়েছে।

—কার ষড়যন্ত্র?

—আমার!

চাণক্যর কথার মর্ম উপলব্ধি করতে পারল না জীবসিদ্ধি। চাণক্যর ষড়যন্ত্রর শিকার হয়েছে মগধ? একথার অর্থ কী? আবার প্রশ্ন করল জীবসিদ্ধি,

—কী বলছেন, আচার্য? আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না আপনার কথা চাণক্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

—আমার অতীতের এই অধ্যায় বেশ বড়ো হে, জীবসিদ্ধি। বুঝিয়ে বলতে সময় লাগবে। শুনতে চাও তুমি?

—অবশ্যই!

—হুম। বেশ। এটা সেই সময়কার কথা যখন নন্দদের সাম্রাজ্য পতনের পরিকল্পনার বীজ আমার মস্তিষ্কে সবে উপ্ত হয়েছে। সেই সময়ে আমার সঙ্গী ছিল ইন্দ্রজিৎ। আমি বুঝতে পারছিলাম যে আমার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে গেলে বিপুল পরিমাণ অর্থর প্রয়োজন পড়বে। আমি অনেক চেষ্টায়, বন্ধু, পরিচিতদের সাহায্য নিয়ে এবং নিজের পুঁজির সর্বস্ব ব্যবহার করেও দশ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রার বেশি একত্রিত করতে পারলাম না। সৈন্যবল গড়ে তুলতে অন্তত আরও পাঁচগুণ অর্থের প্রয়োজন। কোন উপায়ে আরও অর্থ একত্রিত করা যায় সেই নিয়ে খুবই চিন্তিত ছিলাম। অর্থসাহায্য পাওয়ার মতো আর কোনো উপায় আমার জানা ছিল না।

এই সময়ে একদিন আমি এবং ইন্দ্রজিৎ উজ্জয়িনীর কাছে, বিন্ধ্যাচল পার্বত্য প্রদেশে একদল দস্যুর মাঝে পড়ি। প্রথমে ভেবেছিলাম তারা আমাদের লুঠ করতে চায়, কিন্তু পরে বুঝি তাদের উদ্দেশ্য অন্য। তাদের এক বৃদ্ধ সর্দার অসুস্থ। তার আরোগ্যর জন্যে প্রয়োজন একটা বিশেষ জড়িবুটি ওষধির। সেই ওষধি বানানোর উপায় একটা ভূর্জপত্রে লেখা আছে। কিন্তু তাদের দলে একজনও শিক্ষিত না হওয়ার কারণে তা পড়তে পারছে না কেউ। তাদের মধ্যে যে একজন শিক্ষিত সদস্য ছিল, সে কয়েক মাস আগেই সৈনিকের তিরে প্রাণ দিয়েছে। অতএব, তাদের এমন একজন শিক্ষিত মানুষের প্রয়োজন যে সেই লেখা পড়ে, উপযুক্ত জড়িবুটি জোগাড় করে, ওষুধ বানাতে পারবে। সেই কারণেই তারা ব্রাহ্মণ আচার্য দেখে আমাদের পথ রোধ করেছে।

আমায় তারা এও প্রতিশ্রুতি দেয় যে আমি তাদের সাহায্য করলে তারা আমায় প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা দেবে এবং অস্বীকার করলে আমায় হত্যা করতে তারা দ্বিধা করবে না। নিতান্ত নিরুপায় হয়েই আমায় তাদের সঙ্গে যেতে হল।

দস্যুরা আমায় নিয়ে বিঞ্জা অরণ্যের গভীরে প্রবেশ করল। গভীর অরণ্যেই তাদের প্রায় পঞ্চাশ জনের দলটার বসবাস। অসুস্থ সর্দারের কাছে আমায় নিয়ে যাওয়া হল। ওষুধ বানানোর উপকরণ দেখে বুঝলাম, নিতান্তই সামান্য কিছু পরিচিত বুটি দিয়ে তা সহজে বানানো সম্ভব। কিন্তু তা খেতে হবে সেটা বানানোর সঙ্গেসঙ্গেই। বানিয়ে রেখে দিলে তার গুণ নষ্ট হয়ে যাবে, এমন লেখা আছে। অতএব সর্দার নির্দেশ দিল যে আমায় তাদের সঙ্গেই অরণ্যে থাকতে হবে যতদিন না সে আরোগ্য লাভ করে। প্রতিদিন নিয়ম করে দু- বেলা তাকে ওষুধ বানিয়ে দিতে হবে।

এদের মাঝে থাকাকালীন আমি একটা ব্যাপার দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। সেটা হল তাদের কাছে মজুত অর্থের পরিমাণ। তারা আমায় মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়নি। তাদের কাছে সত্যিই স্বর্ণমুদ্রার যেন অভাব নেই। অথচ তাদের কথা থেকেই জানতে পারি যে তারা বড়োজোর দু-এক মাস অন্তর একবার করে লুঠপাট করতে বেরোয়। তাতে কীভাবে এদের কাছে এত অর্থ আসে তা আমি অনুমান করতে পারিনি প্রথমে। এখানে থাকাকালীন অরণ্যের মধ্যে আমার সর্বত্র অবাধ বিচরণ ছিল। শুধু অরণ্য ছেড়ে আমার বা বাসবের বেরোনো বারণ ছিল। কিন্তু অরণ্যের মধ্যে একটা কুটিরে আমাদের দু-জনের প্রবেশ ছিল নিষেধ। সেই কুটিরে এমন কিছু গুপ্ত রহস্য ছিল যা আমাদের থেকে গোপন রাখা হচ্ছিল। আমি কিন্তু কয়েকদিন পর অনুমান করতে পেরেছিলাম কিছুটা আর তাতেই আমার কৌতূহল আরও বেড়ে যায়। আমি ঠিক করে নিই, যে আমি ধীরে ধীরে এদের সর্দারের বিশ্বাস অর্জন করব। এক মাসের মধ্যেই সর্দার বেশ সুস্থ হয়ে উঠল। আমার প্রতি তার এক ধরনের ভক্তি আর বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে ততদিনে। একদিন সেই কাঙ্ক্ষিত দিন এল। সর্দার নিজেই আমায় তার সঙ্গে করে সেই গুপ্ত কুটিরে ঢুকল।

ভেতরে ঢুকে, একদৃষ্টিতেই বুঝতে পারলাম আমার অনুমান ঠিক ছিল। এটা একটা নকল মুদ্রা বানানোর মুদ্রাঘর। এটাই হল এই দলটার এত সচ্ছলতার রহস্য। তারা নকল স্বর্ণমুদ্রা বানায় এই কুটিরে!

কিন্তু আমার মনে যে প্রশ্নটা এতদিন ধাঁধা সৃষ্টি করেছিল সেটা হল, সোনার বিকল্প হিসেবে কোন উপাদান ব্যবহার হয়? আমি তাদের ব্যবহৃত পণ হাতে নিয়ে দেখেছি। তার সঙ্গে আসল সোনার কোনো পার্থক্য বুঝতে পারিনি। সর্দার আমায় দেখাল সেই জিনিস। এক বিশেষ ধরনের খনিজ ধাতু। এই ধাতু তারা আনে বিদর্ভ রাজ্যের কাছে, সাকোলি নদীর পার থেকে। খয়েরি রঙের কারণে তারা এই ধাতুকে ‘ভূরি ধাতু’* বলত। এই ধাতুর বিশেষত্ব হল এর ওজন, ঘনত্ব সব কিছুই অবিকল সোনার সমান। এক পাও সোনা আর এক পাও ভূরি ধাতুর মধ্যে কেউ পার্থক্য করতে পারবে না।

নকল কাহাপণ* বানানোর পদ্ধতি অবিকল আসল মুদ্রা বানানোর মতোই। শুধু সোনার জায়গায় অন্য ধাতুর ব্যবহার হবে। সর্বপ্রথম, মুষায় ধাতু গলিয়ে তাতে কাসরা দিয়ে শুদ্ধ করতে হবে। তারপর তা মুগুরাঘাতে পাতলা পাতার মতো করে তার থেকে মুদ্রা কেটে বের করতে হবে। এরপর এই নকল মুদ্ৰাকে, আসলের রূপ দিতে সোনার প্রয়োজন পড়বে। এই মুদ্রা গলিত সোনায় একবার ডুবিয়ে তার ওপর যথাযথ রাজ সিলমোহর লাগিয়ে দিলেই কাহাপণ তৈরি। ওপরে সোনার প্রলেপ, ভেতরে অন্য ধাতু। ওজন আসল স্বর্ণমুদ্রার সমান। এই পদ্ধতি দেখে আমি অভিভূত হয়ে গেছিলাম। মাত্র একটা আসল স্বর্ণমুদ্রা গলিয়ে,

সেই সম পরিমাণ সোনা দিয়ে আটটা নকল মুদ্রা বানানো সম্ভব।

‘চতুর্ভি কনক পরীক্ষ্যতে,
নিঘর্ষণচ্যছেদনতাপতাডনৈঃ।’**

অর্থাৎ সোনা পরীক্ষার চারটে উপায় আছে। কষ্টিপাথরে ঘষা, কেটে দেখা, তাপে গলানো এবং আঘাত করে পাতলা করা। এর মধ্যে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পদ্ধতি মুদ্রার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা সম্ভব নয়, কারণ এতে মুদ্ৰাটা নষ্ট হয়। অতএব, একটা মুদ্রা পরীক্ষা করার উপায় রয়ে যায় বাকি দুটো এবং সঙ্গে ওজন মিলিয়ে দেখা। সোনার প্রলেপ যুক্ত এই বিশেষ ধাতুর মুদ্রা এই তিনটে পরীক্ষাই অতি সহজে উত্তীর্ণ হয়। খুবই সাধারণ, অথচ আশ্চর্য রকমের ত্রুটিবিহীন পদ্ধতি।

আমি তখনই দস্যু সর্দারকে বলি, যে, সে যদি সত্যিই আমার উপকারের প্রতিদান দিতে চায় তবে যেন সে আমায় সাহায্য করে। আমি তার থেকে কোনো অর্থসাহায্য চাই না। কিন্তু সে যেন আমার দশ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রাকে আশি লক্ষ মুদ্রায় রূপান্তরিত করে দেয়। তারা রাজি হয়। আমি পরবর্তী এক মাসের মধ্যেই নিজের সব স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে বিঞ্জা অরণ্যে ফিরে আসি এবং সেই অরণ্যের বাসিন্দাদের সাহায্যে তা আটগুণ করি। এরপর এই মুদ্রা আমি সেই অরণ্যেই লুকিয়ে রাখি, এই দস্যুদেরই পাহারায়। তাদের কাছে আমার সঞ্চয় সুরক্ষিত আমি জানতাম। কারণ তাদের সেই অর্থর প্রয়োজন নেই।

এই বিপুল পরিমাণ নকল মুদ্রা আমি পরবর্তীকালে সৈন্যদল তৈরি করতে, অস্ত্র, বর্ম, ঘোড়া ইত্যাদি কিনতে ব্যবহার করি। আর এই সমস্ত জিনিস আমি ইচ্ছে করেই মগধের থেকে কিনেছিলাম। কারণ এতে আমার জোড়া লাভ। কেন বলতে পারো?

জীবসিদ্ধি এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধর মতো এই আশ্চর্য কাহিনি শুনছিল। চাণক্য প্রশ্নর উত্তরে সে ‘না’ সূচক ঘাড় নাড়ে। চাণক্যই নিজের প্রশ্নর উত্তর দেন,

—কারণ এই বিপুল নকল মুদ্রা যে দেশেই ঢুকবে, সেই দেশের অর্থনীতি ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়তে বাধ্য! আমি এইভাবে নন্দ সাম্রাজ্যর অর্থনীতিকে ধীরে ধীরে ধ্বস্ত করেছিলাম। এর ফলে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই নন্দ অর্ধেক হেরেই বসে ছিল। তার বিখ্যাত অর্থনীতিজ্ঞ অমাত্য রাক্ষসও এই অর্থনীতির ধস থামাতে ব্যর্থ হয়েছিল। ভেতর থেকে দুর্বল হয়ে পড়া মগধ বেশিদিন চন্দ্রগুপ্তর আক্রমণ প্রতিহত করতে পারেনি। আর তাতেই একদিন পতন হয় নন্দ সাম্রাজ্যর।

কথা থামালেন চাণক্য। কিছুক্ষণ দু-জনেই কোনো কথা বললেন না। জীবসিদ্ধি পরবর্তী অবশ্যম্ভাবী প্রশ্নটা করল,

—সবই বুঝলাম, আচার্য। কিন্তু এই কাহিনির সঙ্গে এখনকার কী সম্পর্ক?

*1. বিঞ্জা অরণ্য- বিন্ধ্যাচল পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত অরণ্য।

2. পণ/কাহাপণ- স্বর্ণমুদ্রা

3. ভূরা ধাতু – টাংস্টেন (Tungsten)

4. মুষা – গলন পাত্র / crucible

5. কাসরা – ক্ষারক/ alkali

মুদ্রা নির্মাণের এই সম্পূর্ণ পদ্ধতির উল্লেখ কৌটিল্যর ‘অর্থশাস্ত্র’-তে পাওয়া যায়।

**শ্লোকসূত্র: চাণক্যনীতি- ৫.২