কনক-শাস্ত্র – ২০

২০.

—আচার্য প্রমুখ, আসতে পারি?

আসনে বসে, চারপাইয়ের ওপর একটা ভূর্জপত্রতে কিছু লিখছিলেন বৃদ্ধ। চাণক্যর কথা শুনে তিনি দরজার দিকে মুখ তুলে চাইলেন। হাসিমুখে বললেন,

—আরে, এসো বিষ্ণুগুপ্ত। এসো, এসো।

ঘরে ঢুকে প্রথমেই চাণক্য এবং জীবসিদ্ধি প্রণাম করলেন প্রধানাচার্য ভদ্রভট্টকে। তারপর তাঁর সামনে আসন গ্রহণ করলেন দু-জন। বৃদ্ধ জীবসিদ্ধির উদ্দেশে প্রশ্ন করলেন,

—তোমার স্বাস্থ্য ঠিক আছে এখন? বাসবের কাছে কয়েক দিন আগে শুনছিলাম তোমার স্বাস্থ্য নাকি ভালো নেই?

—এখন সুস্থ আছি, আচার্য।

—উত্তম। আর বিষ্ণুগুপ্ত, তুমি বলো, এত বছর বাদে আবার বিদ্যার্থীদের মাঝে আচার্য রূপে ফিরে যেতে কেমন লাগছে?

—খুবই ভালো লাগছে, আচার্যশ্রেষ্ঠ।

—শুনে প্রসন্ন হলাম। দাঁড়াও, তোমাদের দুধ আর মধু দিই।

বৃদ্ধ একজন ভৃত্যকে ডাকতে যাচ্ছিলেন। চাণক্য বাধা দিলেন।

—না, আচার্যপ্রমুখ। দয়া করে আপনি ব্যস্ত হবেন না। আপনার বেশি সময় আমরা নেব না। আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে এসেছি আমি। এগুলোর উত্তর জানা জরুরি।

—বলো, কী প্রশ্ন?

—আচার্যশ্রেষ্ঠ, আপনি কয়েক মাস আগে আমায় যে চিঠিটা লিখেছিলেন, সেটার বক্তব্য আপনার মনে আছে?

মৃদু হেসে উনি বললেন,

—আমার স্মৃতিশক্তিতে বার্ধক্য বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারেনি, বিষ্ণুগুপ্ত। মনে আছে আমার। কিন্তু কেন বলো তো?

—আমি যতদূর মনে করতে পারছি, তাতে আপনি তিনটে মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেছিলেন। অথচ আমরা এখানে আসার পর আপনি যখন সব ঘটনা আমাদের বলেন, তখন মাত্র দুটো মৃত্যুর কথা বলেন। একটা হল বৃদ্ধ আচার্য ভীমরজের, ভয় পেয়ে মৃত্যু। এবং দ্বিতীয়টা ছিত্রবানের আত্মহত্যা। আমি জানতে চাই, তাহলে চিঠিতে আপনি তিনটে মৃত্যুর কথা কেন লিখেছিলেন?

একটু অবাক হলেন প্রধানাচার্য। খানিক ভেবে বললেন,

—হ্যাঁ। চিঠিতে আমি তিন জনের কথা উল্লেখ করেছিলাম বটে। তবে তাদের মধ্যে প্রথম জনের মৃত্যুর সঙ্গে এখানে ঘটে চলা অতিপ্রাকৃত ঘটনাক্রমের কোনো সম্বন্ধ নেই বলে, সেটার কথা উহ্য রাখি।

—সেই মৃত্যুর ঘটনাটাকে আপনার অপ্রয়োজনীয় মনে করার কারণ কী, আচার্য?

—কারণ এইসব ঘটনা শুরু হওয়ার অনেক আগেই সেই ছাত্র আত্মহত্যা করেছিল। অর্থাৎ, আমি বলতে চাইছি যে, সেই বিশেষ রাতে চার ছাত্র তন্ত্রক্রিয়া করার আগেই একজন ছাত্র আত্মহত্যা করেছিল। এই ঘটনার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই বলেই আমি আর সেটা বলিনি।

—আমি প্রার্থনা করি, আপনি ওই ছাত্রর আত্মহত্যার ঘটনাটা আমায় বিশদে বলুন। দয়া করে কোনো তুচ্ছ কথাও বাদ দেবেন না। সে-তথ্যটা যতই অপ্রয়োজনীয় মনে হোক, তবুও বাদ দেবেন না।

বৃদ্ধ মনের ভেতরে ঘটনাগুলো গুছিয়ে নিয়ে, বলতে শুরু করলেন,

—এখানকার কঠোর নিয়মকানুনের কথা তুমি তো জানোই। আচার্য যদি কোনো ছাত্রকে যোগ্য মনে না করেন, তবে তাকে বহিষ্কার করা হয়। প্রতি বছর বহু ছাত্র তক্ষশিলায় আসে উচ্চশিক্ষার আশায়। ছাত্রদের এক বছর সময়সীমা দেয়া হয়, তার ভেতর কোনো ছাত্র চাইলে তার অধ্যয়নের আশ্রম পরিবর্তন করে নিতে পারে। যেমন জীবসিদ্ধি নিজে একসময় আয়ুর্বেদের অধ্যয়ন ছেড়ে তোমার আশ্রমে এসেছিল। অনেক ছাত্রই এটা করে থাকে।

এক বছর আগে, মনীন্দ্রনাথ নামে এক ছাত্র প্রথমে ইন্দ্রজাল বিদ্যার আশ্রমে যোগ দেয়। কিন্তু বিষয়টা কঠিন মনে হওয়ায় সে ছ-মাসের পরেই কলা বিভাগে যোগ দেয়। কিন্তু অচিরেই তার আচার্য উপলব্ধি করেন যে কলা বিষয়েও তার কোনো গুণ নেই। আচার্যরা তাকে পরামর্শ দেন যে সে যেন নিজের জীবনের সময় নষ্ট না করে উচ্চশিক্ষার আশা ত্যাগ করে। কারণ তার মধ্যে শিক্ষালাভের কোনোরকম সদিচ্ছা বা প্রচেষ্টা ছিল না। সেই অনুযায়ী, তার আচার্য আমার কাছে তার জন্যে একটা অব্যাহতি আবেদন লেখেন। আমি ছাত্রটিকে ডেকে প্রশ্নও করেছিলাম যে সে কি বিদ্যালয় ছাড়তে ইচ্ছুক? নাকি অন্য কোনো বিষয় নিয়ে চেষ্টা করতে চায়? তার কথা শুনে আমার মনে হয়েছিল তার কোনোদিনই শিক্ষালাভের সত্যিকারের কোনো ইচ্ছে ছিল না। সে সম্ভবত বাবার কথায় এসেছিল। অতএব, আমিও তার আচার্যর লেখা, তার নামের অব্যাহতি আবেদন মঞ্জুর করে দিই। কিন্তু আমি ভুল করেছিলাম। কারণ এর দু-দিন পরেই সেই ছাত্র পশ্চিমের অব্যবহৃত প্রাঙ্গণের একটা মিনার থেকে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করে। সম্ভবত তার পরিবারের পক্ষ থেকে প্রবল চাপ ছিল তার ওপর। তাই বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তাদের কাছে ফেরার চেয়ে, মৃত্যু তার কাছে সহজ পথ মনে হয়েছিল।

—সে যে আত্মহত্যাই করেছিল সে-বিষয়ে কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন?

একটু চিন্তিত দেখায় প্রধানাচার্যকে। তিনি বলেন,

—দেখো বিষ্ণুগুপ্ত, এই ঘটনাটা ঘটেছিল, তক্ষশিলায় সমস্যা শুরু হওয়ার প্রায় এক মাস আগে। তাই আমাদের কারুর পক্ষেই বিষয়টা সন্দেহজনক মনে করার কোনো কারণ ছিল না। ছাত্রটির পরিবার শোকার্ত হলেও বিষয়টা মেনে নিয়েছিল। তাই এই বিষয়টা যে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রথম দিন তোমায় বলা উচিত ছিল, তা আমার একবারও মনে হয়নি। আমি ভেবেছিলাম যে এই মৃত্যুর সঙ্গে পরবর্তী ঘটনাক্রমের কোনো সম্পর্ক নেই।

—আপনার দোষ নয়। এখানে প্রতিটা মানুষেরই মনে বিশ্বাস জন্মেছে যে সমস্ত সমস্যার মূল হল সেই রাতের তন্ত্রক্রিয়া। সবাই মনে করে সেই রাতের পর থেকেই সমস্যার শুরু হয়েছে। তাই কেউই সেই ঘটনার এক মাস আগে ঘটে যাওয়া মৃত্যুর সঙ্গে পরবর্তী ঘটনাক্রমের যোগ খুঁজে পাবে না।

—ঠিক বলেছ। তবু চিঠিতে আমি মৃত্যুর সংখ্যাটা তিন লিখেছিলাম। যদিও পরবর্তী সময়ে আর সেটার উল্লেখ করিনি। তুমি কি সন্দেহ করছ যে বাকি ঘটনাক্রমের সঙ্গে এই ঘটনাটার যোগ আছে?

প্রশ্নটা চাণক্য শুনতে পেলেন বলে মনে হল না। অন্যদিকে চেয়ে কিছু একটা ভাবছেন তিনি। হঠাৎ বললেন,

—এই ঘটনার ঠিক তারিখটা কী ছিল সেটা জানা প্রয়োজন।

আচার্যপ্রমুখ একজন ভৃত্যকে ডেকে কিছু আনার নির্দেশ দিলেন। ভৃত্যটি কিছুক্ষণ বাদেই একটা সেলাই করা ভূর্জপত্রর দিস্তা এনে হাজির করল। সেটা প্রধানাচার্যর সামনে চারপাইয়ের ওপর নামিয়ে রাখল। সেটা খুঁজে বৃদ্ধ বললেন,

এই যে, এই হল মনীন্দ্রনাথের মৃত্যুর তারিখ।

চাণক্য এগিয়ে গিয়ে সেই ভূর্জপত্রটা দেখলেন। বললেন,

—হুম। তন্ত্রক্রিয়া করার ঠিক এক মাস আগের তারিখ।

চিন্তিতভাবে উঠে দাঁড়ালেন চাণক্য। তাঁর আর কোনো প্রশ্ন নেই। বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলেন প্রধানাচার্যর কার্যালয় থেকে। মাটির দিকে চেয়ে পথ চলতে লাগলেন। জীবসিদ্ধি তাঁর পাশেই চলছিল। সে এতক্ষণ কোনো প্রশ্ন করেনি। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পর আর থাকতে না পেরে প্রশ্ন করল,

—কী ভাবছেন, আচার্য?

—চার ছাত্র যে রাতে তন্ত্রক্রিয়া করেছিল, সেটা অমাবস্যার রাত ছিল বলেই আমরা জানি। তাই না?

—হ্যাঁ। অমাবস্যার রাতকেই সমস্ত অশুভ তান্ত্রিক কার্যকলাপের যোগ্য সময় বলা হয় বলে শুনেছি।

—হুম। তার ঠিক একমাস আগের দিনটাও অমাবস্যা ছিল। তাই নয় কি?

—সেটাই স্বাভাবিক। কেন আচার্য? এই দুটো ঘটনার মধ্যে সম্পর্ক আছে বলে আপনি সন্দেহ করছেন?

—অবশ্যই, জীবসিদ্ধি। গভীর সম্পর্ক আছে। এবং এর থেকেই রহস্যর একটা অমীমাংসিত অংশের সমাধান হবে।

জীবসিদ্ধি অবাক হয়ে চেয়ে রইল তার আচার্যর দিকে। চাণক্য তার দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বললেন,

—তোমার কথাই সত্যি হল তবে। খোলা বাতাসে ভ্রমণ করতে বেরিয়েই সমাধানের সূত্র পেলাম। ঘরে বসে আরও কয়েক দিন ভাবলেও এই অজানা তথ্যটা জানতে পারতাম না কখনোই। তোমায় ধন্যবাদ। তুমি অজান্তেই আমার বড়ো উপকার করলে হে, জীবসিদ্ধি।

হেসে উঠলেন চাণক্য।

২১.

গতকাল অতিথিনিবাসে ফেরার পর থেকে চাণক্য একান্তেই থেকেছেন। বেশিরভাগ সময়েই কাটিয়েছেন পদ্মাসনে বসে, ধ্যানমগ্ন অবস্থায়। জীবসিদ্ধি ওঁকে প্রশ্ন করে বিরক্ত করেনি। সে একটা কথা বুঝতে পেরেছে যে চাণক্য রহস্যের সমাধান করে ফেলেছেন। কালকেই তিনি সমাধানের শেষ সূত্র পেয়েছেন।

জীবসিদ্ধি নিজের ঘরেই থেকেছে। সেও সারাদিন ভেবেছে। ভেবে যতবারই তার মনে হয়েছে যে একটু হলেও কিছু রহস্যের জট সে নিজে খুলতে পেরেছে, ততবারই আবার জড়িয়ে গেছে জট। বিকেলে আবার একাই একটু হাঁটতে বের হয় জীবসিদ্ধি। খোলা হাওয়ায় মস্তিষ্কের দরজা খুলে যাবে সেই আশায়। প্রাঙ্গণে চলতে চলতে আজ অবধি ঘটা প্রতিটা ঘটনা প্রথম থেকে সাজানোর চেষ্টা করে সে।

সবার প্রথমেই আসে এক বছর আগে, আচার্য বিন্দাচলের হত্যা। আচার্য বিন্দাচলকে কেউ তাঁর বাড়িতেই, পেছন থেকে মাথায় আঘাত করে হত্যা করে। হত্যাকারী নিশ্চয়ই আগে থেকে ভেবে রেখেছিল যে সে হত্যা করবে। কারণ হত্যা করার জন্যে একটা ভারী ধাতব ডান্ডা সে নিজের সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। হত্যা করে সেই অস্ত্র এবং মৃতদেহ টেনে নিয়ে গিয়ে বাড়ির পেছনে, একটা পরিত্যক্ত কুয়োয় ফেলে দেয়। তারপর সে ফিরে আসে এবং বেশ কিছু সমসাময়িক নথি আগুনে নিক্ষেপ করে। হত্যাকারী চায়নি যে কেউ তার নতুন গবেষণার বিষয়ে অবগত হোক।

এরপরে সে বিন্দাচলের কিছু জিনিস একটা কাঠের পেটিতে ভরে নিয়ে গিয়ে দূরে, একটা জঙ্গল ঘেরা খাদে ফেলে দেয়, যাতে সবাই ভাবে যে জিনিসপত্র নিয়ে আচার্য বিন্দাচল প্রাঙ্গণ ত্যাগ করেছেন।

এর পরের ঘটনা প্রায় মাস ছয়েক পরের। একজন ছাত্র, নাম মনীন্দ্ৰনাথ, আত্মহত্যা করে। যদিও গতকাল আচার্যর প্রতিক্রিয়া দেখে সন্দেহ হয় যে এটা হয়তো আত্মহত্যা নয়। এই ঘটনার সঙ্গে বাকি সব কিছুর কোনো মিলই ভেবে পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু একটা বিষয় ছাড়া। এই আত্মহত্যা বা হত্যাটা যেদিন হয়েছিল, সেইদিন ছিল অমাবস্যা। আর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটা এর পরবর্তী অমাবস্যার রাতেই ঘটে। চার জন ছাত্র গোপনে একটা অজানা তন্ত্রক্রিয়া সম্পন্ন করার চেষ্টা করে। কিন্তু তাতে ব্যর্থ হয়। সেই রাতে তারা প্রচণ্ড ভয়ংকর কিছু দৃশ্যও দেখতে পায়। এর ফলে চার জনের মধ্যে তিন জন উন্মাদ হয়ে গেছে। আর চতুর্থজন ভীত হলেও, এখন অনেকটা সুস্থ। এখানেও আরও একটা প্রশ্ন থেকে যায় জীবসিদ্ধির মনে। চার জনের মধ্যে একজন শুধু কীভাবে সুস্থ হল?

এই ঘটনার পরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর অজানা ভয়ের ছায়া নেমে আসে। একে একে অনেকেই তাদের ভয় পাওয়ার এবং ভয়ংকর দৃশ্য দেখার কাহিনি নিয়ে এগিয়ে আসে। সকলের ধারণা হয় যে ওই রাতেই অসফল তন্ত্রসাধনার ফলে অভিশাপ নেমে এসেছে সকলের ওপর। যদিও, এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আচার্যর তদন্তে অন্য তথ্য উঠে এসেছে। তিনি জেনেছেন যে অনেকেই এই ঘটনার আগে থেকেই অবসাদ, অনিদ্রা এবং অজানা আতঙ্কে ভুগছিলেন। এটার কারণ কী? জানা নেই।

এরপর আরও একজন আচার্যর মৃত্যু ঘটে। আচার্য ভীমরজ। বৃদ্ধ মানুষটি, নিজের বাড়িতে কিছু একটা দেখে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলেন। আর এর ফলেই ওঁর হৃদয়ের গতি থেমে যায়। কিন্তু ইনি মৃত্যুর আগের মুহূর্তে অভিশাপের কথা বলে যান। এটার কারণ কী হতে পারে? তিনি কি কিছু জানতেন? নাকি অন্য কিছু বলতে চেয়েছিলেন? এমনও তো হতে পারে, যে পুরোটাই শুনতে ভুল হয়েছে। হয়তো অত্যন্ত সাধারণ কিছু বলতে চেয়েছিলেন তিনি। ওঁর স্ত্রী ভুল শুনেছিল। সেটা হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল।

.

হাঁটতে হাঁটতে জীবসিদ্ধি অনেকটা দূর এসে গেছিল। সূর্য অস্ত যেতে শুরু করেছে দেখে, এইবার সে অতিথিনিবাসে ফেরার পথ ধরল। যেখানে তার চিন্তার জালে ছেদ পড়েছিল, সেখান থেকেই আবার ভাবতে শুরু করল জীবসিদ্ধি।

.

বৃদ্ধ আচার্যর মৃত্যুর পর অভিশাপের কথাটা আরও ছড়িয়ে যায়। অশুভ অভিশাপে সবাই বিশ্বাস করে। এর পরেই চার জন ছাত্রর এক জনের মৃত্যু ঘটে। তীব্র আতঙ্কে ছিত্রবান, আয়ুরালয়ের দ্বিতীয় তলার জানলা থেকে নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অন্তত তাই বলা হয়েছে। যদিও পরবর্তী সময়ে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনার বিচারে, এটাও হত্যা হওয়া বিন্দুমাত্র অসম্ভব নয়। কারণ কেউ একজন যে এই ছাত্রদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে তা প্রমাণিত।

এর পরেই তক্ষশিলায় আসে সে এবং আচার্য চাণক্য। পরবর্তী সমস্ত ঘটনার সাক্ষী তারা নিজেরাই থেকেছে। আর তার মধ্যে প্রথম বড়ো ঘটনা হল, দ্বিতীয় ছাত্র, সুনাভর হত্যা এবং তৃতীয় ছাত্র, পুষ্পলের প্রাণহানির চেষ্টা। পুষ্পলকে এই মুহূর্তে সুরক্ষিত রাখা হয়েছে, কিন্তু সে পুরোপুরি উন্মাদনার গ্রাসে চলে গেছে। এই মুহূর্তে কোনো প্রয়োজনীয় তথ্য তার থেকে পাওয়ার আশা অতি ক্ষীণ। সেই রাতেই চাণক্যর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে তাঁর ঘর থেকে তন্ত্র বইটা চুরি যায়। কেউ একজন চাইছে না যে সেই বই পুরোটা অন্য কেউ পড়ুক। কেন? কী আছে তাতে? সেটা না পাওয়া গেলে কীভাবে সেই তথ্য অনুধাবন করবেন আচার্য?

এর পরেই চতুর্থ ছাত্রর, অর্থাৎ কুমার সুভাষের ওপর প্রাণঘাতী আক্রমণের চেষ্টা হয়। সেও সতর্ক থাকার কারণে রক্ষা পেয়েছে। যদিও সেও কোনো জরুরি তথ্য দিতে পারেনি আচার্য চাণক্যকে। তবে সে একটা সম্ভাবনার কথা বলেছে, যেটা জীবসিদ্ধির কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। সেটা হল, এই তক্ষশিলার বাসিন্দারাই হয়তো তাদের হত্যা করতে গোপন হত্যাকারী নিযুক্ত করেছে। তাদের কেউ হয়তো এই ধারণা দিয়েছে যে এই চার ছাত্রর মৃত্যু ঘটলে তবেই শাপমুক্তি ঘটবে সকলের। এই হত্যাকারী যে একজন প্রশিক্ষিত মানুষ, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। সুনাভকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তার গলার তরুণ-অস্থি ভেঙে, সেটা একজন যুদ্ধকলায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব। আর ভুলে গেলে চলবে না যে সেই হত্যাকারী, কুমারের দেহরক্ষীর সঙ্গে লড়াইও করেছে। অর্থাৎ সে যথেষ্ট ভালোরকম প্রশিক্ষিত।

.

এইবার থেকে যায় আরও অনেক প্রশ্ন। কে এই হত্যাকারী? আচার্য বিন্দাচল কী নিয়ে গবেষণা করছিলেন? যদি ধরে নেয়া যায় যে তিনি মাদক জাতীয় কোনো উদ্ভিদ বিষয়ে গবেষণারত ছিলেন, তাহলেও প্রশ্ন আসে যে তার সঙ্গে বাকি ঘটনাগুলো কীভাবে যুক্ত? তাঁকে হত্যা করা হল কেন? কে করল?

সেইদিন রাতে কী এমন ঘটেছিল যে চার জন ছাত্র এত ভয় পেল?

যদি ধরে নেয়া যায় যে আচার্য বিন্দাচলের আবিষ্কৃত কোনো বিশেষ মাদকের প্রভাবে এইখানে মানুষদের মনে এই ভয় তৈরি হয়েছিল, তবে প্রশ্ন আসে, সেই মাদক কোন অলৌকিক উপায়ে এত জন মানুষের শরীরে প্রবেশ করানো হল? কেউ বেশি ভয় পেয়েছে, কেউ কম। কিন্তু মাদকের প্রভাবের লক্ষণ বেশিরভাগ বাসিন্দার মধ্যেই বর্তমান। তাঁর নিজের শরীরেও তা প্রভাব ফেলেছে। কীভাবে? খাবার আর জল? তার তো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আর যদি-বা তাই হয়, তবে আচার্য চাণক্যর শরীরে সেই লক্ষণ বিন্দুমাত্র প্রকাশ পেল না কেন? তাঁরা দু-জন তো একই খাবার এবং পানীয় জল গ্রহণ করছেন সেই প্রথম দিন থেকেই। তবে?

কে? কে আছে এই গভীর ষড়যন্ত্রর নেপথ্যে? কেন সে হত্যা করতে চায় এই ছাত্রদের? কী তার উদ্দেশ্য? কীভাবে সে এতজন মানুষকে ভয় দেখাতে সক্ষম হচ্ছে? পুরোটাই কি যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যাযোগ্য? নাকি এর পেছনে সত্যিই আছে অতিপ্রাকৃতর অবদান?

.

এইসব এলোমেলো চিন্তার মাঝে ডুবে থাকতে থাকতেই নিজের ঘরের সামনে এসে পৌঁছে গেছে জীবসিদ্ধি। আচার্যর ঘরের দরজা খোলা। সেখানে এখন প্রবেশ করা সমীচীন কি না ভাবতে থাকে জীবসিদ্ধি। তখনই ঘরের ভেতর থেকে তার নাম ধরে ডাক দেন চাণক্য,

—জীবসিদ্ধি? এলে?

আর দেরি না করে আচার্যর ঘরে ঢোকে জীবসিদ্ধি। চাণক্য বসে আছেন তাঁর আসনে। নিজের লম্বা টিকির চুল বাঁধছেন। জীবসিদ্ধিকে দেখে মৃদু হাসলেন আচার্য। তাঁর চোখের তারা উজ্জ্বল। বিজয়ীর দৃষ্টি তাতে। এই দৃষ্টির সঙ্গে জীবসিদ্ধির পরিচয় আছে। রহস্যর সমাধান করতে সক্ষম হয়েছেন আচার্য চাণক্য! কোনো সন্দেহ নেই। এ সেই দৃষ্টি। উত্তেজিত হয়ে জীবসিদ্ধি প্রশ্ন করল,

—রহস্যর সমাধান হয়ে গেছে?!

—হুম। কিছু জায়গা এখনও পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও, বলা চলে যে সমাধান হয়েছে।

—সাধু! সাধু!

—আরও একটা সুসংবাদ আছে।

—কী সুসংবাদ, আচার্য?

—মগধ থেকে চিঠি এসেছে। ওই উদ্ভিদের বিষয়ে আমার সন্দেহই ঠিক। চাণক্য জীবসিদ্ধির দিকে হাত বাড়িয়ে একটা ছোট্ট কাগজের চিরকুট দিলেন। সেটা নিতে নিতে জীবসিদ্ধি প্রশ্ন করল,

—যাক। বেশি দেরি হয়নি তবে।

—নাহ্। ওই কারণেই নির্দেশ দিয়েছিলাম যে এই চিঠি যেন পায়রার গলায় বেঁধে পাঠানো হয়। চারদিন আগেই মগধ থেকে প্রশিক্ষিত পায়রা উড়িয়ে দেয়া হয়েছে, তারিখ দেখলেই বুঝবে। আজই বিকেলে তা তক্ষশিলার পায়রা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এসে পৌঁছোয়। সেখান থেকেই এক দূত খানিক আগে এটা আমায় এনে দিল।

চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করল জীবসিদ্ধি।

মহামতি চাণক্য,

প্রণাম গ্রহণ করবেন। আপনার নির্দেশমতো সবকটা উদ্ভিদ পরীক্ষা করেছি। কিন্তু এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটামাত্র গাছ। সীমিত এই চিঠিতে আমি শুধু সেটার বিষয়েই লিখে পাঠালাম।

উদ্ভিদটা আরবদেশের কুখ্যাত একটা মাদক জাতীয় গাছ। স্থানীয় নাম ‘কাৎ’ বা ‘খাৎ’। এই পাতা সেখানকার স্থানীয়রা নেশার উদ্দেশ্যে খেয়ে থাকে। এর অত্যধিক এবং টানা বহু বছরের সেবনে অনিদ্রা, উচ্চ রক্তচাপ, বিষণ্ণতা, দুর্বল হৃদয় এবং আত্মহননের প্রবণতা বাড়ে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহারকারী বিভ্রান্তিকর দৃশ্য দেখে, অমূলপ্রত্যক্ষ* এবং অহেতুক ভয়ের শিকার হয়।

আশা রাখি এই তথ্য আপনার উপকারে লাগবে।

ইতি,
সাম্বপাল।

পড়া শেষ করে জীবসিদ্ধি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাণক্যর দিকে চাইল। চাণক্য উত্তর দিলেন,

—মগধের মাদক ও উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ এই সাম্বপাল। মাদক বিষয়ে তার মতো জ্ঞান খুব কম পণ্ডিতের আছে।

—এর নাম শুনিনি আগে।

—শোনোনি কারণ এ রাজপণ্ডিত নয়। সত্যি বলতে এ একজন মাদকের কালোবাজারির সর্দার।

—সেকী? এরকম একজনের কাছে আপনি গাছগুলো পরীক্ষা করতে পাঠিয়েছিলেন?

—হুম। ফুলের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি জ্ঞান মৌমাছিরই থাকে।

কিছুক্ষণ ভেবে জীবসিদ্ধি আবার প্রশ্ন করল,

—কিন্তু আচার্য, এতে তো বলা হয়েছে এইসব লক্ষণ, শুধুমাত্র বেশি মাত্রায় এই জিনিস শরীরে প্রবেশ করলে, বা বহুদিনের ব্যবহারেই দেখা দেয়। এক্ষেত্রে তবে কেন দেখা দিল?

—অনুমান করতে পারি, আচার্য বিন্দাচল এই ‘কাৎ’ পাতার ওপর গবেষণা করে এর প্রভাব অনেক গুণ বাড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেটারই প্রভাব আমরা দেখতে পাচ্ছি এই তক্ষশিলায়।

—কিন্তু তিনি তো মৃত। তবে কে রয়েছে এই হত্যা, এই ষড়যন্ত্রর নেপথ্যে? আপনি তা জানেন?

মৃদু হেসে চাণক্য উত্তর দিলেন,

হুম। আমি জানি।

*অমূলপ্রত্যক্ষ – হ্যালুসিনেসন

২২.

তক্ষশিলা মহাবিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ ঝলমল করছে প্রভাতসূর্যর কিরণে। মৃদু বাতাস নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে আশপাশের দেবদারুর পাতাগুলো। শুকনো পাতা দুটো একটা ঝরে পড়ছে লাল পাথরের প্রাঙ্গণে। স্থান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন সভাস্থল। স্বয়ং মহামতি পাণিনি এই মুক্ত প্রাঙ্গণে ছাত্রদের বিদ্যাদান করতেন একসময়ে। আজ সেখানেই জড়ো হয়েছে বেশ কিছু মানুষ। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই তক্ষশিলার আচার্য। আচার্য বুধাদিত্য এবং আচার্য দধীচ তাঁদের মধ্যেই প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে। চাণক্য তাঁদেরকেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের আজকে এখানে ডেকে আনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। চাণক্যর ডাকে সাড়া দিয়ে প্রায় প্রত্যেকেই এসেছেন।

এঁদের মাঝে স্বর্গীয় আচার্য ভীমরজের স্ত্রীও আছেন। চাণক্য ওঁকে আজকে এখানে উপস্থিত থাকতে বিশেষভাবে অনুরোধ করেছেন। এ ছাড়াও দেখা যাচ্ছে আরও কয়েকটা পরিচিত মুখ। বাসব, আয়ুরালয়ের কয়েকজন চিকিৎসক তথা কর্মী, এবং অন্যান্য কিছু দাস-দাসী যারা নিজেরাই কৌতূহলী হয়ে এসেছে। একদিকে দাঁড়িয়ে আছে কুমার সুভাষ এবং তার দেহরক্ষী বল্লভ। দূরে বেশ কয়েকজন ছাত্র এসে ভিড় করেছে, যদিও ছাত্রদের মধ্যে শুধু সত্যকাম আমন্ত্রিত এবং তাকে এখানে থাকতে নির্দেশ দিয়েছিলেন চাণক্য। চাণক্য এই মুক্ত সভাস্থলে সবার আগে এসেছেন। তিনি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন ঋজু ভঙ্গিতে। কেউ এলে তিনি করজোড়ে তাঁদের অভিবাদন জানাচ্ছেন। জীবসিদ্ধি ওঁর পাশেই দাঁড়িয়ে সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁদের কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে অনুরোধ করছে। এখন সকলেই প্রধানাচার্য ভদ্রভট্টর অপেক্ষায় আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনিও এসে উপস্থিত হলেন, সকলের উদ্দেশে প্রণাম জানিয়ে তিনি অশ্বত্থ গাছের ছায়ায় আসন গ্রহণ করলেন। চাণক্যর দিকে চেয়ে একবার সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন।

চাণক্য এইবার উপস্থিত ব্যক্তিদের দিকে ঘুরে বলতে শুরু করলেন,

—সত্যেন ধার্যতে পৃথিবী, সত্যেন তপতে রবিঃ। সত্যেন বাতি বায়ুচ্চঃ সর্ব সত্য প্রতিষ্ঠিতম্।।*

উপস্থিত প্রত্যেকে নিশ্চুপ হয়ে চাইল বক্তার দিকে।

—সত্যই এই পৃথিবীর আধার, সত্যই সূর্যের তেজ এবং বায়ুর গতি। সত্য প্রতিষ্ঠার ওপরেই এই সারা জগৎসংসার টিকে আছে। আমরা আজ সেই সত্যর সন্ধানেই এখানে সকলে একত্রিত হয়েছি। প্রথমেই আপনাদের এখানে আনার জন্যে আমি এখানে উপস্থিত প্রতিটি মানুষের থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে চাই। আপনাদের ব্যস্ততার মাঝেও আমার অনুরোধ রাখার জন্যে ধন্যবাদ। সময় বড়ো মূল্যবান। তাই আপনাদের বেশি সময় আমি নেব না। যাদের সঙ্গে আমার পূর্বপরিচয় নেই, সেই নবীন সদস্যদের কাছে নিজেদের পরিচয় দিয়ে রাখি। আমি বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্য, তক্ষশিলা মহাবিদ্যালয়ের প্রাক্তন আচার্য। আমার সঙ্গী জীবসিদ্ধি আমার শিষ্য এবং সে নিজেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে, গত কয়েক মাস ধরে ঘটতে থাকা ঘটনার ব্যাপারে আপনারা সকলেই অবগত। প্রায় দু-মাস আগে মাননীয় প্রধানাচার্য আমায় চিঠি দিয়ে এখানকার অবস্থা জানান এবং আমায় এখানে আসতে অনুরোধ করেন। তিনি আমার ওপর একটা গুরুদায়িত্ব দেন। এই মহাবিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে ঘটতে থাকা আপাতদৃষ্টিতে অতিপ্রাকৃত এবং রহস্যজনক ঘটনার সমাধানের দায়িত্ব আমার ওপর বর্তান। রহস্যর নিভৃতে লুকিয়ে থাকা সত্য খুঁজে বের করতে বলেন আমায়। গত দেড় মাসে সেই প্রচেষ্টা কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে আজ আমি আপনাদের তা জানাতে চাই।

শুরু করা যাক গোড়া থেকে। মাস ছয়েক আগে, ইন্দ্রজাল বিদ্যা বিভাগের চার জন ছাত্র, গ্রন্থালয় থেকে একটা অজানা পুঁথি খুঁজে পায়। তাতে তন্ত্রমন্ত্রের দ্বারা পিশাচসিদ্ধ হওয়ার পদ্ধতি লেখা ছিল। কৌতূহলবশত তারা এক অমাবস্যার রাতে, গোপনে সেই তন্ত্রক্রিয়া করে দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু তার ফলাফল হয় ভয়াবহ, যা আপনারা সকলেই জানেন। দুর্ভাগ্য যে, আমি আসার আগেই

সন্তুষ্টভাবে চাণক্য মাথা নেড়ে উত্তর দিলেন,

—আপনার স্বামীই বলেছেন। মৃত্যুর আগেই বলেছেন। তিনি যে শব্দটা বলেছিলেন তা ‘শাপ’ অর্থাৎ অভিশাপ নয়। কথাটা ‘সাপ’ মানে নাগ! ওঁকে তাঁর অবচেতন মন বিষধর সাপ দেখিয়েছিল সেই রাতে। সেই দৃশ্য দেখেই ভয় পেয়ে ওঁর মৃত্যু হয়। এতে অভিশাপ বা পিশাচের কোনো সম্পর্ক নেই।

.

কথাগুলো উপস্থিত প্রত্যেকের মস্তিষ্কে স্থিত হতে একটু সময় দিলেন চাণক্য। তারপর আবার শুরু করলেন,

—অতএব, এই সমস্তটাকেই যদি অজানা মাদকের প্রভাব বলে ধরে নিই, তাহলে পরবর্তী প্রশ্ন আসে, সেই মাদকটা কী? এর উত্তর জানানোর আগে আপনাদের আমি আরও একটা ঘটনার কথা জানাতে চাই। এক বছর আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ছেড়ে একজন আচার্য কাউকে কিছু না বলে চলে গিয়েছিলেন। সেই ব্যক্তি উদ্ভিদবিদ্যা এবং রসায়নশাস্ত্রের অধ্যাপক, আচার্য বিন্দাচল। কেউ জানত না তিনি কোথায় গেছেন বা কবে ফিরবেন একদিন সকালে দেখা যায় তাঁর বাসভবন খালি। একটা পেটি এবং সমস্ত আবশ্যিক জিনিসপত্র নিয়ে তিনি আগের দিন কোনো এক সময়ে বিদ্যালয় পরিত্যাগ করেছেন। বিষয়টায় কেউই গুরুত্ব দেয়নি। সবাই ধরে নিয়েছিল যে তিনি ফিরে আসবেন কিছুকাল পর। কিন্তু তিনি আর কোনোদিন ফিরলেন না। প্রত্যেকে ধরেই নিল যে তিনি অধ্যাপনা ছেড়ে চলে গেছেন।

একটু বিরতি নিয়ে চাণক্য বললেন,

একমাস আগে কয়েকজন ছাত্র উত্তরের জঙ্গলের খাদ থেকে কাঠের একটা পরিত্যক্ত পেটি খুঁজে পায়। সেই পেটির মধ্যে থাকা জিনিসপত্র থেকে আমার সন্দেহ হয় যে সেটা আচার্য বিন্দাচলের। আমি বিন্দাচলের পরিত্যক্ত বাসভবনটা তল্লাশি করি এবং কয়েকটা সন্দেহজনক সূত্র পাই। তাঁর কিছু গবেষণাপত্র কেউ আগুনে পুড়িয়ে ফেলেছে। হয় তিনি নিজে অথবা অন্য কেউ এই কাজ করেছে। আরও কিছু সূত্র থেকে আমার সন্দেহ দৃঢ় হয় যে বিন্দাচল এই প্রাঙ্গণ ছেড়ে যাননি। তাঁকে কেউ-বা কারা হত্যা করে তাঁর মৃতদেহ লুকিয়ে ফেলেছে এবং তাঁর জিনিসপত্র একটা পেটিতে ভরে নির্জন জঙ্গলে ফেলে দেয়া হয়, যাতে সকলের প্রাথমিক ধারণা হয় যে তিনি নিজেই স্থান ত্যাগ করেছেন। কিন্তু আবার প্রশ্ন থেকে যায়। ওঁর মৃতদেহ কোথায়? মালপত্র সমেত পেটি তাঁর বাসভবন থেকে নিয়ে যাওয়া সহজ, কিন্তু তাঁর মৃতদেহ নয়। দিনের বেলাতেও একজন ব্যক্তিকে একটা পেটি নিয়ে যেতে দেখলে কেউ কিছু সন্দেহ করবে না। কিন্তু মৃতদেহ? সেটা নিশ্চয়ই হত্যার জায়গা থেকে বেশি দূর নিয়ে যাওয়া হয়নি। তাহলে সেই মৃতদেহ কোথায়?

চাণক্য এইবার ফিরলেন আচার্য প্রমুখ ভদ্রভট্টর দিকে। বললেন,

—আমায় ক্ষমা করবেন, আচার্যশ্রেষ্ঠ। আরও একটা দুঃসংবাদ আমি আপনার থেকে গোপন করেছি। আচার্য বিন্দাচলের বাড়ি থেকে ফেরার পথে দৈবাৎ আমি জানতে পারি যে তাঁর বাসভবনের কাছেই একটা পরিত্যক্ত কুয়ো আছে। মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে সময় লাগেনি। আপনার অনুমতি ছাড়াই আমি সেই কুয়ো পরীক্ষা করিয়েছি। তাতে এক বছর পুরোনো, আচার্য বিন্দাচলের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। এখনও সেই মৃতদেহ সেখানেই আছে।

এই তথ্য জানতে পেরে প্রত্যেকে উত্তেজিতভাবে কোলাহল শুরু করল। বজ্রাহতর মতো হতবাক বসে আছেন বৃদ্ধ প্ৰধানাচার্য। চাণক্য আরও একবার করজোড়ে ক্ষমা চাইলেন তাঁর কাছে।

* চাণক্যনীতি – ৫.১৯

২৩.

চাণক্য আবার সামনে ফিরে সকলের উদ্দেশে বলতে শুরু করলেন,

—আমার সন্দেহ হয়েছিল যে আচার্য বিন্দাচলের হত্যার সঙ্গে নিশ্চয় পরবর্তী ঘটনাক্রমের কোনো যোগাযোগ আছে। আর সেই কারণেই আমি তাঁর গবেষণাগার থেকে কয়েকটা অজানা উদ্ভিদ, পরীক্ষা করতে মগধে পাঠাই। সেই পরীক্ষায় আমার সামনে আরও একটা তথ্য উঠে আসে। সেইসব উদ্ভিদের মধ্যে একটা বিশেষ গাছের পাতা মাদক হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। এই গাছের নাম ‘কাৎ’ এবং তা পাওয়া যায় আরব দেশে। এখানে উল্লেখ করতে চাই যে আমরা বিন্দাচলের বাড়িতে কিছু আরব দেশ থেকে আনা গাছের বিনিময় রসিদ আগেই পেয়েছিলাম। অতএব, আমি সহজেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে এই বিশেষ উদ্ভিদের ওপর গবেষণা করেই আচার্য বিন্দাচল এক ধরনের মাদক বানিয়ে ফেলেছিলেন। এর প্রভাব, সাধারণ মাদকের চেয়ে বেশি এবং অত্যধিক মাত্রায় একবার ব্যবহারে তা মানুষকে উন্মাদ পর্যন্ত করতে সক্ষম। এই ভয়ানক আবিষ্কারের ব্যবহার আচার্য বিন্দাচল সম্ভবত কোনো দ্বিতীয় ব্যক্তিকে জানিয়েছিলেন। তক্ষশিলার বুকে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে সেই ব্যক্তি এই আবিষ্কারটা ব্যবহার করতে চায়। কিন্তু বিন্দাচল এই ষড়যন্ত্রে রাজি না হওয়ায় তাঁকে হত্যা করা হয়।

একটু বিরতি নিয়ে সবার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন চাণক্য। প্রত্যেকে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছে তাঁর কথা। আবার তিনি কথা শুরু করলেন,

—এই জিনিসটাই গত কয়েক মাস ধরে এখানকার বাসিন্দাদের শরীরে একটু একটু করে প্রবেশ করানো হয়েছে। তিল তিল করে প্রতিটা মানুষ এই মাদকের প্রভাবে ভয় পেয়েছে, অতিপ্রাকৃত ভয়ংকর দৃশ্য দেখেছে এবং ভয়ে একজন মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে। এইবার আসি সবচেয়ে জরুরি প্রশ্নে। কীভাবে? কীভাবে এই মাদক সবার শরীরে কম বেশি প্রবেশ করানো সম্ভব হল, অথচ কেউ জানতেও পারল না?

খাবার আর জলে কোনোরকম সমস্যা নেই তা আমি নজরদারি রেখে নিশ্চিত হয়েছি। অতএব, আমি ভাবতে থাকলাম যে আর কোন উপায়ে এই কাজ করা সম্ভব। কুমার সুভাষ নিশ্চিত করে আমাদের বলে যে তন্ত্রক্রিয়া করার প্রয়োজনে সে বা তার বন্ধুরা কোনোরকম মাদক জাতীয় খাবার বা পানীয় সেই রাতে গ্রহণ করেনি। এবং প্রথমদিকে সব স্বাভাবিক থাকলেও, যতই তাদের উপাচার এগিয়েছে, ততই তাদের মনে ভয় বাড়তে থাকে। তাদের হৃদয়গতি বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তাদের মনে ভয়ের লক্ষণ দেখা দেয়। আমি ঠিক বলেছি তো কুমার?

শেষ প্রশ্নটা যাকে উদ্দেশ করে করা, একাধারে দাঁড়িয়ে থাকা সেই কুমার সুভাষ সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায়। চাণক্য আবার শুরু করলেন,

—এর থেকে অনুমান করা যায় যে মাদক মিশ্রিত জিনিসটা নিঃসন্দেহে সেই রাতে যজ্ঞে আহুতি দেয়া কোনো জিনিসের মধ্যে ছিল। সেটা এমন কোনো জিনিস যা সবাই রোজ ব্যবহার করে এবং সেটা সেই রাতে প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করা হয়েছিল।

আরও একটা বিষয় এখানে আমায় ভাবিত করেছিল। চার ছাত্র একইসঙ্গে সমস্ত কাজ করলেও, তাদের মধ্যে কুমারের ওপর এর প্রভাব পড়েছিল সবথেকে কম। কুমারের বক্তব্য থেকে জানতে পারি তিন জন তার অনেক আগে থেকেই ভীত এবং আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। তারা চিৎকার করার অবস্থাতে পর্যন্ত ছিল না, শুধু কুমার নিজে আর্তনাদ করতে পেরেছিল। প্রশ্ন জাগে যে কুমার সুভাষের মধ্যে কী এমন বিশেষত্ব আছে যা অন্যদের নেই? কেন তার ওপর এই মাদকের প্রভাব কম?

এর উত্তর কুমার নিজেই আমাদের বলেছিল। আমরা কথায় কথায় জানতে পেরেছিলাম যে কুমারের ধোঁয়া সহ্য হয় না! ধোঁয়া! হ্যাঁ, এটাই উত্তর! এই মাদক সবার শরীরে প্রশ্বাসের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। সেই কারণেই তার ওপর এতদিনেও মাদকের কোনো প্রভাব পড়েনি। কারণ বিদ্যালয় থেকে সকল বাসিন্দাকে যে জিনিস দেওয়া হয়, তা সে নেয়নি। সে তার নিজের সঙ্গে আনা প্রদীপের তেল, ধুনো এবং কর্পূর ব্যবহার করে এসেছে। আর এই তিনটে জিনিসই সেই রাতে অতিরিক্ত মাত্রায় আগুনে আহুতি দেয়া হয়েছিল।

কিন্তু কোন বস্তু? তেল? না, তেল হওয়া সম্ভব নয়। প্রথমত, তেলের সঙ্গে কোনো জিনিস সহজে মিশিয়ে দেয়া যায় না। দ্বিতীয়ত, তেল তো এত বছর ধরে কুমার সুভাষ ও ব্যবহার করে এসেছে। অতএর, তেল হতে পারে না। ধুনো? হতে পারে। কিন্তু অনেক সময়েই সাধারণ পুজোর কাজে ধুনো বেশিমাত্রায় ব্যবহার হয়। এই মাদক এমন কিছুতে মেশানো হয়েছে যা রোজ ব্যবহার হয়, কিন্তু স্বল্প পরিমাণে। অতএব, উত্তরটা সহজেই আন্দাজ করা যায়। কপূর! এই তক্ষশিলায় যা রোজকার ব্যবহারের জিনিস। প্রতিটা বাড়িতে সন্ধ্যা বেলায় কপূরের আগুন জ্বালা হয়। এর থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া আক্রান্ত করেছে মানুষদের। কর্পূরে মাদক মেশানোর আরও একটা বড়ো সুবিধা আছে। ‘কাৎ’ পাতা থেকে নির্মিত মাদকে যদি-বা কোনো গন্ধ থেকে থাকে, তা কপূরের সুবাসে ঢেকে যায়। নিখুঁত পরিকল্পনা!

.

প্রতিটা মানুষ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। গুঞ্জন নয়, জোর গলায় লোকেরা নিজেদের বিস্ময় প্রকাশ করছে। আচার্য দধীচ প্রশ্ন করলেন,

—কিন্তু কে? কে এই নীচ ষড়যন্ত্রর কাণ্ডারি? কে এই অপরাধী, আচার্য?

—মাদকের উৎস এবং তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করানোর পদ্ধতিটা বুঝতে পারলেই, অপরাধী কে চিহ্নিত করা আর কঠিন থাকে না। আচার্য বিন্দাচলের গবেষণার কথা কে জানতে পারে? অবশ্যই সেই ব্যক্তি যে তাঁর সহকারী ছিল এক সময়ে। কর্পূরে মাদক সে-ই মেশাতে পারে যার সে- সুযোগ ছিল। যে নিয়মিত এই প্রাঙ্গণের প্রতিটা বাড়িতে তেল, কর্পূর ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পৌঁছে দেয়।

উপস্থিত প্রতিটা মানুষের দৃষ্টি একজনের ওপর নিবদ্ধ হয়েছে। দূরে এক কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির দিকে। প্রধানাচার্যর মুখ থেকে অস্ফুটে নামটা বেরিয়ে এল,

—বাসব!

সে কিন্তু অন্যদের দিকে দেখছে না। সে চেয়ে আছে চাণক্যর দিকে 1 জীবসিদ্ধির যেন মনে হল তার পোড়া ঠোঁটের কোনায় হাসি খেলছে। এইবার মুখ খুলল বাসব। স্বরে তার কোনোরকম উত্তেজনার চিহ্ন নেই। শীতল কণ্ঠে বলল:

—আমায় আপনার সন্দেহ প্রথম কবে হল, আচার্য?

মৃদু হেসে চাণক্য উত্তর দিলেন,

—অনেক আগেই সন্দেহ হয়েছিল তোমায়, বাসব। তুমি অত্যন্ত বুদ্ধিমান হলেও একটা ভুল করে ফেলেছিলে। তোমায় যখন আমি প্রশ্ন করেছিলাম যে এই প্রাঙ্গণে তুমি কোনো ভয়াবহ দৃশ্য দেখেছ কি না, তখন তুমি আমায় একটা মনগড়া কাহিনি শুনিয়েছিলে। তুমি বলেছিলে যে একদিন রাতে জলাশয় থেকে তুমি পিশাচমূর্তিদের উঠে আসতে দেখেছিলে। আর সেটাতেই তোমার মিথ্যা ধরা পড়ে যায়। কারণ একটু ভাবলেই বোঝা যায় যে, চার জন ছাত্র বাদে, বাকি সবাই ভয়াবহ দৃশ্যগুলো দেখেছে নিজেদের বাড়িতে। বন্ধ ঘরে! চার ছাত্রর কথা আলাদা। তারা বেশিমাত্রায় বিষাক্ত কপূরের ধোঁয়া, প্রশ্বাসের সঙ্গে প্রবেশ করিয়েছিল। কিন্তু তোমার তো সেইরকম কিছু ঘটেনি। তুমিই একমাত্র ব্যক্তি যে বলেছিলে খোলা আকাশের নীচে তুমি ভয় পেয়েছ। আমার সেইদিনই সন্দেহ হয় যে তুমি মিথ্যা বলছ।

হেসে উঠল বাসব।

—আপনি সত্যি বুদ্ধিমান, আচার্য। আপনি যেদিন এসেছিলেন সেইদিনই আমি জানতাম যে আপনি আমায় ধরে ফেলবেন।

চাণক্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

—আমার আরও ধারণা, ছাত্রর এই দুর্গতির জন্যেও তুমিই পরোক্ষভাবে দায়ী। তুমি গত অনেক মাস ধরে বাসিন্দাদের শরীরে ধীরে ধীরে বিষাক্ত মাদক প্রবেশ করিয়েছ। ছ-মাস আগে যখন কয়েকজনের মধ্যে তার লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করল তখন তুমি আরও একটা ষড়যন্ত্র করলে। গ্রন্থাগারে তোমার কাজের দায়িত্ব থাকত তা আমরা আগেই শুনেছি। আমার অনুমান, সেই সময়েই তুমি লক্ষ কর যে চার জন ছাত্র বেশ কয়েকদিন ধরে গুপ্তবিদ্যার বই খুঁজছে। তোমার মাথায় কুবুদ্ধি আসে। তুমি একটা অতি সাধারণ তন্ত্র পুথি খুঁজে বের কর। তার সামনের পৃষ্ঠা সরিয়ে ফেলো, যাতে কেউ বুঝতে না পারে যে এই পুথি আসলে বিশ্বাসযোগ্য নয়। তারপর সেটা এমন জায়গায় রেখে দাও যাতে পরের দিন চার জনের মধ্যে কেউ একজন এলেই সেটা খুঁজে পাবে। সামনের পাতায় সেটার নাম বা লেখকের নাম না থাকায়, স্বাভাবিকভাবেই তাদের কিশোর মন সেটাকে প্রাচীন, প্রামাণিক পুথি ধরে নেবে। পরবর্তী ঘটনা একেবারে তোমার পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটে। তারা সেই বই দেখে একটা সম্পূর্ণ অবাস্তব তন্ত্রক্রিয়া করতে যায়। অতিমাত্রায় কর্পূর ব্যবহারে তারা ভয় পায়। সবাই ধরে নেয় যে তাদের মনের ভয়ের উৎস এই তন্ত্রক্রিয়ার ফলে মুক্ত হওয়া পৈশাচিক, অলৌকিক শক্তি।

একটু বিরতি নিয়ে আবার বললেন,

—এই ঘটনার আগেই অনেক মাস ধরে তিন জন ছাত্রর শরীরে মাদক ছিল। বহুদিন ধরে রক্তে এই বিষ মিশে যাওয়ার ফলে তাদের শরীর আগে থেকেই দুর্বল ছিল। তাই সেই রাতে অত্যধিক বিষাক্ত ধোঁয়া প্রবেশ করার ফলে তারা উন্মাদ হয়ে যায়। কিন্তু কুমার সারাজীবন কোনো ধোঁয়া সৃষ্টিকারী জিনিস ব্যবহার করেনি। সেই কারণে তার রক্তে, সেই রাতের আগে অবধি কোনোরকম মাদক ছিল না। তার ওপর শুধুই আহুতি দেয়া অতিরিক্ত কর্পূরের ধোঁয়া প্রভাব ফেলে। সেই কারণেই তার ওপর এর প্রভাব ছিল অনেকটা কম। তাই বাকি তিন ছাত্র, মানসিকভাবে আক্রান্ত হলেও, কুমার সুস্থ হতে পেরেছে।

তা এরপর যখন জানতে পারলে যে আমরা এখানে আসছি, বিশ্বাসযোগ্যতার সুযোগ নিয়ে তুমি আচার্য প্রমুখর কাছে আর্জি জানালে যে তোমায় যেন আমাদের সাহায্যের জন্যে নিযুক্ত করা হয়। প্রধানাচার্য তাতে রাজি হলেন। তোমার উদ্দেশ্য ছিল আমাদের কার্যকলাপের ওপর নজর রাখা। কিন্তু তোমার ওপর আমার সন্দেহ হতেই, আমি তোমায় এড়িয়ে গিয়ে অনুসন্ধান শুরু করি। তুমি যে ভয়ংকর খেলা গত এক বছর ধরে খেলে এসেছ, তা আজকে শেষ হল।

চাণক্য থামতেই সবাই একসঙ্গে বলে উঠল,

—সাধু! সাধু!

দু-জন সৈনিক এসে বাসবকে ধরেছে ইতিমধ্যে। যদিও সে নির্বিকার। প্রধানাচার্য উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানানোর ভঙ্গিতে বললেন,

বিষ্ণুগুপ্ত, তুমি আরও একবার প্রমাণ করলে যে তুমিই শ্রেষ্ঠ। প্রমাণ করলে যে, তোমার সাহায্য চেয়ে আমি ভুল করিনি। তক্ষশিলা তোমার প্রতি আজীবন ঋণী থাকবে।

চাণক্য তাঁকে থামালেন,

একটু অপেক্ষা করুন, আচার্যশ্রেষ্ঠ। সম্পূর্ণ রহস্যর সমাধান এখনও হয়নি। এখনও অনেক বাকি রয়ে গেছে যে।

২৪.

প্রতিটা দৃষ্টি আবার চাণক্যর ওপর নিবদ্ধ হয়েছে। আরও রহস্য আছে? আর কোন রহস্যর কথা বলছেন আচার্য? অন্যেরা না বুঝলেও জীবসিদ্ধি বুঝতে পেরেছে তার গুরুর কথার তাৎপর্য। এখনও অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর যে তিনি দেননি।

চাণক্য হাত উঠিয়ে সবাইকে অপেক্ষা করতে ইশারা করে বললেন,

আমি তক্ষশিলায় এসেছিলাম যে রহস্য সমাধানের উদ্দেশ্য নিয়ে, সেটার সমাধান আপনাদের বলেছি। কিন্তু এখানে সমান্তরালভাবে একটা নয়, দুটো অপরাধ ঘটে চলছিল গত কয়েক মাসে। সেগুলোর নেপথ্যে থাকা সত্য এখনও আপনাদের জানানো বাকি আছে।

আমি এখানে থাকাকালীন, আয়ুরালয়ে সুনাভ নামে এক ছাত্রকে হত্যা করা হয়। সেই রাতেই, আমি যখন আয়ুরালয়তে গেছিলাম, আমার অনুপস্থিতির সুযোগে আমার ঘর থেকে একটা জিনিস চুরি হয়। তদন্তের স্বার্থে আমি গ্রন্থাগার থেকে সেই তন্ত্র বইটা এনেছিলাম, যেটা সেই রাতে ব্যবহার করা হয়েছিল। সত্যি বলতে, এই ঘটনা আমায় সবথেকে বেশি চিন্তিত করে তুলেছিল। কারণ আমি যে তত্ত্ব নিজের মস্তিষ্কে সাজিয়ে তুলেছিলাম, তার সঙ্গে ছাত্রর হত্যা এবং এই পুথির কী সম্পর্ক থাকতে পারে সেটা আমি আন্দাজ করতে পারিনি। ওই পুথি কিছুটা পড়েই আমি নিঃসন্দেহ হয়েছিলাম যে এটা অত্যন্ত সাধারণ আজগুবি প্রক্রিয়া লেখা একটা বই। তন্ত্রক্রিয়ার সঙ্গে আসল সমস্যার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু তাহলে আমার কাছ থেকে বই চুরি হবে কেন? কী এমন তথ্য ওই অবাস্তব পুথির পাতায় আছে যা আমার থেকে লুকোতে চাইছে? আর কেনই-বা বাকি তিন ছাত্রকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলতে চায় অপরাধী?

আমি বাসবকে ষড়যন্ত্রের মূল কুচক্রী হিসেবে চিহ্নিত করার পরেও এই ঘটনাগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছিলাম না। চার ছাত্রকে পথ থেকে সরিয়ে ফেলার কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে তার? বই খুঁজতে বাসব নিজেই আমায় সাহায্য করেছিল। তাহলে সে-ই আবার ওটা চুরি কেন করবে? তা ছাড়া কয়েকটা সূত্র থেকে আমি নিঃসন্দেহ ছিলাম যে আর যাই হোক, আয়ুরালয়ের হত্যাকারী সে হতে পারে না। তাহলে?

হত্যাকাণ্ডর এক দিন পরের রাতে কুমার সুভাষের নিজস্ব ছাত্রাবাসেও আততায়ী হানা দেয়। পরের দিন সেখানে পৌঁছে তার এবং তার দেহরক্ষীর বক্তব্য শুনি। দু-জনেই প্রায় একই কাহিনি শোনায়। কিন্তু দু-জনের বর্ণনায় একটা জায়গায় অসংগতি আমার কাছে ধরা পড়ে। তার দেহরক্ষী বল্লভের বক্তব্য ছিল যে পুষ্করিণীর ধারে গভীর অন্ধকার থাকায় সে আগন্তুকের হাতের অস্ত্র দেখতে পায়নি। আর তার ফলেই তার হাতে আঘাত করতে পেরেছিল আগন্তুক। ঠিক আছে। কথাটা মেনে নেয়া যায়। কিন্তু এর পরেই কুমার বলে, সে নিজের ঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে পুষ্করিণীর ঘাটে দু-জনকে লড়াই করতে দেখেছে। আমি তার ঘরের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বুঝতে পারি যে পুষ্করিণীর ঘাট বেশ কয়েক গজ দূরে। মেঘলা আকাশ, অন্ধকার রাতে এত দূরের দৃশ্য একমাত্র নিশাচর পাখি বা শ্বাপদ প্রাণী দেখতে পায়। যেখানে তার দেহরক্ষী বল্লভের বক্তব্য যে, সে আঁধারে তার এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিপক্ষর হাতের অস্ত্র দেখতে পায়নি, সেখানে কুমার বলছে যে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে জানলা দিয়ে সে দু-জনকে দেখতে পাচ্ছিল। এটা কীভাবে সম্ভব? অতএব, হয় কুমার মিথ্যে বলছে, বা, বল্লভ মিথ্যে বলছে। অথবা দু-জনেই মিথ্যে বলছে!

চাণক্যসহ সবার দৃষ্টি ঘুরে গেছে কুমার সুভাষ ও তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা বিশালকায় বল্লভের দিকে। কুমার অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। জীবসিদ্ধির মনে হল সে কাঁপছে। তার দেহরক্ষী পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে চোখ কুঁচকে। তাদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে চাণক্য ফের বললেন,

—আমার মনে সন্দেহ হয় যে কুমার আর তার দেহরক্ষী মিলে একটা মনগড়া কাহিনি আমাদের শোনাচ্ছে। সম্ভবত তার দেহরক্ষী বল্লভকে দিয়েই কুমার হত্যা করিয়েছে তার সহপাঠী সুনাভকে। সেই রাতেই আয়ুরালয়তে পুষ্পলকেও হত্যা করা হত, কিন্তু সৌভাগ্যবশত সে বেঁচে যায়। সুনাভর হত্যার পদ্ধতি থেকেই বোঝা যায়, তাকে যে হত্যা করেছে সেই ব্যক্তি বলিষ্ঠ এবং যুদ্ধকলায় পারদর্শী। কুমার কিছু একটা তথ্য আমাদের থেকে গোপন করতে চাইছে।

কী সেই তথ্য, তা আমি কিছুতেই বুঝাতে পারছিলাম না। পুরো ঘটনার মধ্যে কোথাও একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছিল। আমার মন বলছিল যে কিছু একটা সূত্র আমি দেখেও দেখতে পাচ্ছিলাম না। এই সূত্রটা হঠাৎই, একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে পেয়ে গেলাম দু-দিন আগে ভ্রমণে বেরিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অবস্থিত স্মৃতিসৌধ-ক্ষেত্রে গিয়ে আমি বেশ কয়েকটা তুলনামূলক নতুন পাথরের সৌধ দেখতে পাই। তার ভেতর প্রথম ফলকটাতে মনীন্দ্রনাথ নামে এক ছাত্রর নাম দেখি। সেই নামটা পড়েই আমার মনে একটা অদ্ভুত অস্পষ্ট স্মৃতি জেগে ওঠে। আমার মনে হয় এই নামটা আমি কোথাও যেন শুনেছি। প্রধানাচার্যর কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি এই ছাত্রর বিষয়ে। তন্ত্রক্রিয়ার সেই রাতের একমাস আগে, মনীন্দ্রনাথ নামের এই ছাত্র আত্মহত্যা করেছে। স্বভাবতই কেউ তার মৃত্যুর সঙ্গে অন্যান্য ঘটনার কোনো সম্পর্ক পায়নি। কিন্তু দুটো তথ্য এখানে উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, এই ছাত্রটিও আগে ‘ইন্দ্রজাল বিদ্যা’ বিভাগের বিদ্যার্থী ছিল দ্বিতীয়ত, তার মৃত্যু ঘটেছে অমাবস্যায়। যে অমাবস্যার রাতে চার জন ইন্দ্রজাল বিদ্যার ছাত্র তন্ত্র হবন করেছিল, তার ঠিক আগের অমাবস্যায়। এই দুটো সূত্ৰ কি শুধুমাত্র সংযোগ বা কাকতালীয়? আমার তা মনে হয়নি।

একটু থেমে বিরতি নিলেন চাণক্য। সকলে নিশ্চুপ তাকিয়ে আছে ওঁর দিকে। বাতাসে গাছের পাতার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। সবার মুখের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে আবার কথা শুরু করলেন,

—এখানে আসার পরে, প্রথমেই আমি তিন ছাত্রকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গেছিলাম। সেইদিন সুনাভ এবং পুষ্পল কিছুই গুছিয়ে বলে উঠতে পারেনি। শুধু তারা সেই রাতে যে বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করেছে, বা রোজ করছে সেগুলো এলোমেলোভাবে বর্ণনা করেছিল। সুনাভ সেদিন বার বার একটা শব্দ উচ্চারণ করেছিল। মণি! আমি ধরে নিয়েছিলাম সে তার দেখা পিশাচ-মূর্তির লাল চোখের মণি বোঝাতে চাইছে। আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম সে-বিষয়ে। সে বোঝানোর চেষ্টাও করেছিল আমায় যে এই ‘মণি’ চোখের মণি নয়। কিন্তু আমি সেদিন তার কথার তাৎপর্য বুঝতে পারিনি।

সে বোঝাতে চেয়েছিল যে তাকে ভয় দেখাতে রোজ ভয়াবহ পিশাচদের সঙ্গে, ‘মণি’ নামের অন্য একজনও আসে। এই ‘মণি’ যে আসলে ‘মনীন্দ্রনাথ’- এর সংক্ষেপিত নাম, তা আশা করি এখন সকলেই অনুমান করতে পারছেন। এই কারণেই আমার সেইদিন ‘মনীন্দ্রনাথ’ নামটা স্মৃতিসৌধতে পড়ে মনে হয়েছিল এই নামটা আমি আগে কোথাও শুনেছি। এইবার তবে ঘটনাটা সাজানো যাক। আমার যুক্তিনির্ভর বিশ্লেষণে কোনো জায়গায় ভুল হলে কুমার সুভাষ সংশোধন করে দিতে পারবে আশা করি। কি কুমার? পারবে না?

শেষ প্রশ্নটা করে সুভাষের দিকে চাইলেন চাণক্য। কুমার সুভাষের কিশোর মুখে একটা হিংস্র ভাব ফুটে উঠেছে। তাতে কোথায় যেন ভয়ও মিশে আছে। তার দিকে তাচ্ছিল্য মেশানো একটা শব্দ ছুড়ে দিয়ে চাণক্য নিজের কথায় ফিরলেন।

—তন্ত্রক্রিয়া। বিশেষ করে পিশাচসিদ্ধি মতে কালো জাদুর একটা প্রধান অঙ্গ হল নরবলি। এই বিশেষ তন্ত্রক্রিয়ারও একটা প্রয়োজন ছিল একজন মানুষের প্রাণ। কিন্তু তাকে বলি হিসেবে উৎসর্গ করতে গেলে, তাকে হত্যা করতে হবে একটা নির্দিষ্ট দিনে। তন্ত্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে যে অমাবস্যার রাতে, তার ঠিক আগের অমাবস্যায় নরহত্যা করার বিধান দেয়া ছিল সেই বইয়ে।

চার জন ছাত্র এই বিষয়ে এতটাই মগ্ন হয়ে পড়ে যে নরহত্যা করতেও তারা পিছপা হল না। শিকার হিসেবে বেছে নেয়, তাদেরই একজন প্রাক্তন সহপাঠীকে। এই তন্ত্রমন্ত্র নিয়ে সবচেয়ে উৎসাহী ছিল কুমার সুভাষ। অনুমান করতে পারি এই পুরোটাই তার মস্তিষ্কপ্রসূত পরিকল্পনা ছিল। তারা এমন একজনকে নিজেদের বলি হিসেবে বেছে নেয় যার মৃত্যু হলে সকলেই আত্মহত্যা বলে সন্দেহ করবে। সবাই ধরেই নেবে যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত হওয়ার শোকে ‘মণি’ বা মনীন্দ্রনাথ আত্মহত্যা করেছে।

বিশেষ দিনটাতে চার জন মিলে মনীন্দ্রনাথকে পশ্চিমের প্রাঙ্গণের জনশূন্য ভগ্নস্তূপে নিয়ে যায়। সম্ভবত মনীন্দ্রনাথ ভেবেছিল যে বিদ্যালয় ছাড়ার আগে তার পুরোনো সহপাঠীরা তাকে বিদায় জানাতে চায়। সেই হতভাগ্য কল্পনাও করতে পারেনি যে কী ভয়ানক ফাঁদে সে পা দিয়েছিল সেদিন। কুমার এবং তার তিন বন্ধু মিলে তাকে ধাক্কা দিয়ে একটা মিনার থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করে। চার জনেই এই অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকায়, কেউই মুখ খুলবে না, সে-বিষয়ে তারা নিশ্চিত ছিল।

কিন্তু সমস্যা হল যখন তিন জন তাদের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল। মাদকের প্রভাবে সুনাভ তার সামনে মনীন্দ্রনাথকে দেখতে শুরু করেছিল। মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অপরাধবোধ, তাকে মনীন্দ্রনাথের প্রেতাত্মা দেখাতে থাকল রোজ। এর মধ্যেই সুস্থ হয়ে ওঠা কুমার বুঝতে পারল যে প্রলাপের মধ্যে তার বন্ধুরা অপরাধের কথা বলে ফেলতে পারে। কুমারের মনে আশঙ্কা দেখা দিল। অসুস্থতার অজুহাতে কুমার নিজের লোকলশকর ডেকে নিল তক্ষশিলায়। এদের মধ্যে তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত দেহরক্ষী বল্লভকে তার বিপদের কথা বলল। তার এই অপরাধের কথা যদি প্রকাশ হয়ে যায় তবে তাকে যুবরাজ পদ খোয়াতে হবে। তাই আর কোনো উপায় নেই। মুখ বন্ধ করতে সরিয়ে ফেলতে হবে তার তিন সঙ্গীকে। আমরা এখানে এসে যাওয়ায় কুমারের আশঙ্কা আরও বাড়ল। কুমার সুভাষ জানত যে সেই রাতে ঝড়বৃষ্টিতে অন্যান্য জিনিসের মতোই তন্ত্র বইটাও নষ্ট হয়ে গেছে। তাই সে নিশ্চিন্ত ছিল। কিন্তু এ তথ্য তার অজানা ছিল যে বইটা সেই রাতে উদ্ধার করা হয়েছিল। এরপর যখন বাসবের থেকে জানতে পারল যে আমি সেই তন্ত্র বই খুঁজে পেয়েছি, তখন তার মাথায় বজ্ৰপাত হল। কারণ সেটা পড়লেই আমি জানতে পেরে যাব যে এই ক্রিয়া সম্পন্ন করতে গেলে এক অমাবস্যা আগে নরহত্যা করতে হয়।

অতএব, এক রাতে, কুমারের আদেশে বল্লভ হত্যা করল সুনাভকে। সে জানত যে খবরটা পেয়ে আমি নিশ্চয়ই ওই রাতে আয়ুরালয়তে যাব। সেই সুযোগে আমার ঘর থেকে বই চুরি করল কুমার সুভাষ। এই চুরি সে নিজে করেছিল নাকি অন্য কোনো অনুচর দিয়ে করিয়েছিল তা বলতে পারি না। তবে অনুমান করতে পারি সেটাও এই বল্লভই করেছিল। কারণ গোপন কথা বল্লভ ছাড়া আর কাউকে কুমার জানিয়েছিল বলে মনে হয় না। আমার তো এও সন্দেহ যে ছিত্রবানের মৃত্যুও দুর্ঘটনা নয়। সেটাও কুমার সুভাষের সুপরিকল্পিত হত্যা।

উত্তেজিতভাবে চেঁচিয়ে উঠল কুমার,

—না, না, না! মিথ্যে কথা। ছিত্রবান সত্যিই আত্মহত্যা করেছিল!

.

শিকার ফাঁদে পা দিলে, শিকারির মুখের ভাবে যেমন সন্তুষ্টি জাগে, সেই সন্তুষ্টির ভাব ফুটে ওঠে চাণক্যর মুখে। বললেন,

—হুম। যাক! অন্য দুটো হত্যার কথা তাহলে সর্বসমক্ষে স্বীকার করলে, কুমার।