১৫.
তক্ষশিলার এইটাই প্রধান গবেষণাগার। তাই এটা সুবৃহৎ। এটা যে শুধুই গবেষণার কাজে লাগে তা নয়। এইখানে উৎপাদন করা অনেক জিনিস সারা দেশে এবং বিদেশে রফতানি করা হয়। এগুলোর আয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বড়ো অংশের ব্যয়ভার বহন করা হয়। ভেষজ তেল, ফুল থেকে উৎপাদিত সুগন্ধি, কর্পূর, ধুনো এবং আয়ুর্বেদিক ওষুধ রফতানি করা পণ্যের মধ্যে মুখ্য। বিশেষ করে ওষুধ।
আপাতত এখানে কয়েকজন কর্মচারী কাজ করছে। দু-জন ব্রাহ্মণকে ঢুকতে দেখে অবাক হল না। ভাবল বোধ হয় কেউ প্রদর্শনে এসেছে। জীবসিদ্ধি একজনকে প্রশ্ন করে উদ্ভিদবিদ্যার অংশটা কোথায় তা জেনে নিল। এই অংশটা বিভিন্ন ধরনের গাছে ভরতি যার বেশিরভাগই মাটির পাত্রে গজিয়ে উঠেছে। চাণক্য একটা অদ্ভুত কাজ করলেন। নিজের কাপড়ের ঝোলা থেকে একটা লাল খড়ি বের করে কয়েকটা গাছের পাত্রে চিহ্ন দিতে লাগলেন। জীবসিদ্ধি অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,
আরে, আচার্য! করছেন কী?
—সাহায্য করো আমায়। অপরিচিত গাছগুলো চিহ্নিত করো। আমরা দু-জনই উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ না হলেও, আশা করছি খুব বেশি অপরিচিত গাছ পাব না।
—কিন্তু তাতে কী লাভ হবে?
—আহা। আপাতত গুরুর ওপর একটু ভরসা রাখো। চলো… শুরু করা যাক।
.
বেশ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে দু-জন মিলে কয়েকটা অপরিচিত গাছ চিহ্নিত করতে পারলেন। কাজ শেষ করে জীবসিদ্ধি প্রশ্ন করল,
—এইবার? কী করবেন এই গাছগুলো নিয়ে?
—ক-টা গাছে চিহ্ন পড়েছে?
—বারোটা।
—হুমম। এইবার কয়েকজন সৈনিককে পাঠাব যেন সন্ধ্যার দিকে চিহ্নিত গাছের পাত্রগুলো তুলে নিয়ে আসে। আর কালকেই এগুলোকে তাদের সঙ্গে পাটলিপুত্র পাঠাব।
—সেখানে কী হবে?
—সেখানকার বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে এই অপরিচিত প্রতিটা গাছের পরীক্ষা করানো হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার ফলাফল আমার জানা প্রয়োজন। সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু তবু এটা জরুরি।
—উত্তম প্রস্তাব।
নিজের টিকির বাঁধনে হাত চালিয়ে চাণক্য বললেন,
—হুমম। এইবার তবে চলো, বিন্দাচলের বাড়িটা একবার দেখে আসি 1 শুনলাম তো গত এক বছর ধরে সেটা খালি পড়ে আছে। আর সেটা এখান থেকে কাছেই।
.
একজন কর্মচারীকে প্রশ্ন করতেই সে আচার্য বিন্দাচলের বাসভবনের পথ বলে দিল। তবে সঙ্গে এও বলল যে সেখানে কেউ থাকে না। লোকটা কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাদের দেখছে তা খেয়াল করে চাণক্য বললেন,
—আসলে এই আমার সঙ্গী, শিল্পকলা বিভাগের নতুন নিযুক্ত আচার্য। সে উপযুক্ত বাসভবনের সন্ধান করছিল। তা, আমিই বললাম যে আচার্য বিন্দাচলের বাড়িটা তো ফাঁকা আছে। যদি মহাশয়ের পছন্দ হয়, তবে আচার্য প্রমুখর সঙ্গে কথা বলব।
এত সুন্দর গুছিয়ে বলা মিথ্যা কাহিনিটা লোকটা বিশ্বাস করল সহজেই। তার মুখে ফুটে ওঠা কৌতূহলী ভাবটা মিলিয়ে গেল। চাণক্য শুধু একবার জীবসিদ্ধির চোখে চোখ রেখে মৃদু হাসলেন। জীবসিদ্ধি মনে মনে আরও একবার আচার্যর উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারল না। এই লোকটা উত্তর না পেলে আরও দশজনকে বলত যে দু-জন বিন্দাচলের বাড়ির খোঁজ করছে। সন্দেহ করত। তাতে বিষয়টা পাঁচকান হত। কিন্তু যে মুহূর্তে মানুষ তার কৌতূহলী প্রশ্নের একটা নীরস উত্তর পেয়ে যায়, তার উৎসাহ দূর হয়ে যায়। সেটা নিয়ে আর সে জল্পনা করবে না। কারুর সঙ্গে কথাও বলবে না আর এটা নিয়ে।
.
গবেষণাগার থেকে বের হয়ে বেশিক্ষণ পথ চলতে হল না। একটু চলার পরেই বিন্দাচলের বাড়িতে এসে পড়ল দু-জনে। দেখেই বোঝা যায় যে এই বাড়িটা এক বছর মতো পরিত্যক্ত হয়ে আছে। বাড়ির দরজা শুধুই আলগা লাগানো, অতএব ভেতরে ঢুকতে কোনো অসুবিধে হল না। ভেতরে এখনও কিছু সামান্য আসবাবপত্র ছড়িয়ে আছে। কিছু ধুতি ও গায়ের জামা, কিছু ভূর্জপত্র, এক জোড়া পাদুকা, প্রদীপ ইত্যাদি। সবই ধুলো পড়ে মলিন।
চাণক্য ঝুঁকে পড়ে একটা খড়ম তুলে নিলেন। জীবসিদ্ধিকে বললেন,
—ওহে জীবসিদ্ধি, দেখছ? এটা কিন্তু বেশ নতুন। অথচ আমাদের ঘরে রাখা পেটিতে যে দুটো আছে, তা বেশ পুরোনো নয় কি?
—হ্যাঁ। তাতে কী প্রমাণিত হয়, আচার্য?
চাণক্য উত্তর দিলেন না। কাঠের অন্যান্য দেরাজগুলো খুঁজতে লাগলেন। একগাদা ভূর্জপত্র বের করে পরীক্ষা করতে লাগলেন। জীবসিদ্ধি পাশ থেকে উঁকি দিয়ে দেখল বিদেশ থেকে আনানো কোনো জিনিসের বিনিময় রসিদ, ছাত্রদের জন্যে কিছু হাতে-লেখা প্রশ্নপত্র, গবেষণাপত্র ইত্যাদি। অতি সামান্য সব জিনিস।
—আরব দেশ থেকে বেশ কিছু অজানা গাছ আনিয়েছিলেন বিন্দাচল। প্রায় দু-বছর আগে। এই গবেষণাপত্রগুলো সবই দেখি দু-বছর আগের। আশ্চর্য! তিনি এখান থেকে চলে যাওয়ার আগের এক বছরের কোনো নথি নেই।
—আর ওই পেটিতে যে নথিপত্র আছে, সেগুলো?
—ওগুলোও পুরোনো। দরকারি কিছুই না।
—কিন্তু সেটাই কি স্বাভাবিক না? জরুরি নথি তিনি এখানে ছেড়ে যাবেন কেন? বা, ফেলেই-বা দেবেন কেন? সেগুলো নিশ্চয়ই নিজের সঙ্গেই নিয়ে গেছেন।
—তাও ঠিক যুক্তি বটে।
চাণক্য আরও একবার পুরো বাড়িটা খুঁজে দেখলেন। একটা মাটির মালসার কাছে গিয়ে আটকে গেলেন। তাতে কিছু ভূর্জপত্র জ্বালানো হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে কিছু কিছু আধ পোড়া ভূর্জপত্র পরীক্ষা করলেন। একটা টুকরো জীবসিদ্ধির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
—বিন্দাচল বেশিরভাগ নথির ওপরেই তারিখ উল্লেখ করতেন। অন্যান্য লেখাগুলো দেখলেই বুঝবে। এইটা দেখো। এই টুকরোটায় তারিখ দেখা যাচ্ছে। যদিও অস্পষ্ট।
চাণক্যর থেকে কাগজের টুকরোটা নিয়ে চোখের কাছে আলোয় এনে দেখল জীবসিদ্ধি।
—দেড় বছর আগের কোনো একটা তারিখ।
—হুমম।
দু-জনে সেখান থেকে বেরিয়ে এল। নিজেদের অতিথি-নিবাসের পথ ধরল। বেলা অনেক হয়ে গেছে। সূর্য মধ্য গগন থেকে পশ্চিমে ঢলে পড়া শুরু করেছে। জীবসিদ্ধি উপলব্ধি করল সে ক্ষুধার্ত। চাণক্যকে চিন্তিত লাগল। তিনি কিছু একটা ভাবছেন। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ প্রশ্ন করলেন,
—আচ্ছা জীবসিদ্ধি, তোমার ক-টা পাদুকা আছে?
এরকম অদ্ভুত প্রশ্নর অর্থ জীবসিদ্ধি বুঝল না। উত্তর দিল,
—একটাই।
—হুম। আমারও। মানুষের একটা বা বড়োজোর দুটো খড়ম থাকে সাধারণত। তাই নয় কি?
—হ্যাঁ। সাধারণত। কাঠের খড়ম অনেকদিন চলে। একটা পুরোনো হলে নতুন নেয়া হয়।
—হুম। আশা করা যায় বিন্দাচলেরও দুটোই পাদুকা ছিল। একটা নতুন, অন্যটা পুরোনো। অথচ, তিনি নতুন পাদুকাটা বাড়িতে ছেড়ে, পুরোনোটাকে সযত্নে সঙ্গে নিলেন। তারপর আবার পাদুকা সমেত নিজের পেটিটা ফেলে দিলেন নির্জন জঙ্গলে।
জীবসিদ্ধি কোনো কথা বলল না। সে এইভাবে ভেবে দেখেনি। চাণক্য আবার কথার রেশ ধরে বলতে থাকলেন,
—অর্থাৎ, বিন্দাচল খালি পায়ে তক্ষশিলা ছেড়ে চলে গেলেন? বিষয়টা আশ্চর্য নয় কি? এটা বিশ্বাসযোগ্য?
—তা বটে। এই কাজের কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।
.
আরও কিছু একটা বলতেন, তখনই সামনে আসতে থাকা একজনকে দেখে কথা শেষ করলেন না। সাধারণ পোশাক পরা হলেও লোকটা বলিষ্ঠ। একটু এগিয়ে এসে লোকটা প্রণাম করতে দু-জনে চিনতে পারলেন লোকটাকে। এ তাদেরই সঙ্গে আসা, মগধের একজন সৈনিক।
—প্রণাম, আচার্য। প্রণাম, জীবসিদ্ধি মহাশয়।
জীবসিদ্ধি প্রতিনমস্কার জানিয়ে প্রশ্ন করল,
—উৎপল, তাই তো? তা, তুমি এদিকে কী করছ?
—আজ্ঞে, আমি এইদিকের পানীয় জলের কুয়োটার ওপর গোপনে নজরদারি করি। তাই তো সাধারণ বেশে।
—ওহো।
তা, সন্দেহজনক কিছুই তো দেখিনি গত দেড় মাসে। আর কি নজরদারি চালানোর প্রয়োজন আছে, আচার্য?
শেষ প্রশ্নটার উদ্দেশ্য অবশ্যই চাণক্য। তিনি ঘাড় নেড়ে বললেন,
—নাহ্। আমার মনে হয় আর প্রয়োজন নেই। তা তুমি ক-টা কুয়োর ওপর নজরদারি চালাও এদিকে?
—এদিকে দুটো কুয়ো আছে। তবে তার মধ্যে একটা পরিত্যক্ত। ব্যবহার হয় মাত্র একটা কুয়ো। তাই শুধু একটার ওপরেই আমি নজর রাখতাম, আচার্য।
জীবসিদ্ধি বলল:
—বেশ। আর কাল থেকে প্রয়োজন নেই। কাল একটা কাজ করবে তোমরা। গবেষণাগারটা চেনো তো? তোমাদের কয়েকজন গিয়ে সেখানে উদ্ভিদবিদ্যার অংশ থেকে কয়েকটা গাছ নিয়ে আসবে। দেখবে বারোটা পাত্রে আমরা…
কথা থেমে গেল জীবসিদ্ধির। তার চোখ পড়েছে চাণক্যর দিকে। চাণক্য কপালে তীব্র ভ্রূকুটি। দৃষ্টি উজ্জ্বল।
—কী ব্যাপার, আচার্য?
চাণক্য জীবসিদ্ধির প্রশ্নর উত্তর না দিয়ে, সৈনিক উৎপলকে প্রশ্ন করলেন,
—পরিত্যক্ত কুয়োটা কোথায়?
—এই তো। এইখানেই। ওই পরিত্যক্ত বাড়িটার পেছনেই। কয়েক পা গেলেই পাবেন।
আর কোনো কথা না বলে চাণক্য পেছন ফিরে হাঁটা লাগালেন। জীবসিদ্ধি আর উৎপল একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে, চাণক্যর পিছু নিল।
আচার্য বিন্দাচলের বাড়ি থেকে কয়েক পা দূরেই পুরোনো কুয়োটা। সেটার মুখ একটা কাঠের পুরোনো ঢাকনা দিয়ে বন্ধ। কুয়োর চারিদিকে আগাছা আর জঙ্গল ভরে গেছে। চাণক্য গিয়ে ভারী ঢাকনাটা সরাতে শুরু করলেন। সৈনিক আর জীবসিদ্ধি এগিয়ে এসে তাঁকে সাহায্য করতে যেতেই, চাণক্য হাত তুলে তাদের বাধা দিলেন।
—আমি পরীক্ষা করে দেখতে চাই এটা একজনের পক্ষে সরানো সম্ভব কি না।
সামান্য ভারী হলেও, একটু চেষ্টা করতেই চাণক্য সেটা সরিয়ে ফেললেন। ঝুঁকে নীচে দেখার চেষ্টা করলেন। তাঁর দেখাদেখি, বাকি দু-জনও ধারে এসে উঁকি দিল। সূর্যর আলো নীচ অবধি পৌঁছোতে পারছে না। তবে নীচে পরিত্যক্ত কালো জল দেখা যাচ্ছে। চাণক্য আবার ঢাকনাটা জায়গামতো বসিয়ে দিলেন। সৈনিক উৎপলের দিকে ফিরে বললেন,
—তোমাদের মধ্যে একটা দল, আজ সন্ধ্যায়, গবেষণাগারের উদ্ভিদের অংশে গিয়ে লাল চিহ্ন দেয়া গাছগুলো নিয়ে আসবে। আশা করি সেই সময়ে কেউ দেখবে না তোমাদের। একই প্রজাতির অনেক গাছ আছে, একটা করে কেউ সরিয়ে ফেললে সেটা কেউ লক্ষ করবে না। বুঝেছ? সেগুলো নিজেদের সেনা শিবিরে নিয়ে রাখবে। পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষা করবে।
—যথা আজ্ঞা, আচার্য।
—অন্য একটা দল, কাল সকালে এইখানে আসবে। এই কুয়োটাতে কেউ একজন নেমে পরীক্ষা করবে।
অবাক হয়ে উৎপল বলল:
—কিন্তু আচার্য, এই জল পানীয় হিসেবে ব্যবহার হয় না।
—জল পরীক্ষা করতে বলিনি। একজন নেমে কুয়োর তলাটা পরীক্ষা করবে। ঠিক আছে?
—বেশ, আচার্য। যথা আজ্ঞা।
১৬.
বাকি দিনটা চাণক্য গম্ভীর থাকলেন। জীবসিদ্ধি কয়েকবার তাঁকে কথা বলানোর চেষ্টা করল বটে, কিন্তু কোনো লাভ হল না। বিকেলে শুধু জনৈক সৈনিক এসে জানিয়ে দিয়ে গেল যে, নির্দেশ মতোই বারোটা গাছ সমেত মাটির পাত্রগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। চাণক্য একটা চিঠি লিখে তার হাতে দিলেন।
—কাল সকালেই তোমাদের কয়েকজন গাছগুলো নিয়ে রওনা হয়ে যাবে। সাবধানে যাবে, সেগুলো যেন নষ্ট না হয়ে যায়। নিয়মিত জল দিয়ে পরিচর্যা করবে। পাটলিপুত্র পৌঁছে প্রধান অমাত্যর সঙ্গে দেখা করবে এবং তাঁকে এই চিঠিটা দেবে। বাকি ব্যবস্থা তিনি করবেন।
নির্দেশ বুঝে নিয়ে সৈনিক চলে গেল।
.
বরাবরই চাণক্যর অনেক ভোর বেলা শয্যাত্যাগ করা অভ্যাস। সকালে উঠে স্নান সেরে সূর্যপ্রণাম করে তিনি প্রভাতী প্রার্থনা শুরু করেন। কিন্তু আজ তাঁর কাজে বাধা পড়ল।
সবে সূর্যপ্রণাম সেরেছেন, তখনই এক ব্যক্তিকে অতিথি-নিবাসের প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করতে দেখলেন। এই মুহূর্তে অতিথি-নিবাসে তাঁরা দু- জন ছাড়া আর কেউ নেই, অতএব, লোকটা যে তাঁর কাছেই এসেছে সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। সে এসে চাণক্যকে প্রণাম জানাল,
—প্রণাম, আচার্য।
—প্ৰণাম।
—আপনার সকালের পুজোয় বিঘ্ন ঘটানোর জন্যে দুঃখিত। আমায় যুবরাজ সুভাষ পাঠিয়েছেন
চাণক্যর মনে আশঙ্কা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। তিনি উদগ্রীব হয়ে প্রশ্ন করলেন,
—কুমার? কোনো বিপদ হয়নি তো?
—বিপদ হত, আচার্য। তবে তা এড়ানো গেছে। গতরাতে কেউ কুমারের ঘরে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাঁর দেহরক্ষীর তৎপরতায় কুমার রক্ষা পেয়েছেন।
—যাক। একটু নিশ্চিন্ত হলাম। আমি এরকম একটা আশঙ্কা করেছিলাম।
—গতকাল সতর্ক করে দেয়ার জন্যে আপনাকে কুমার ধন্যবাদ জানিয়েছেন, আচার্য। আপনি কি একবার কষ্ট করে আসবেন কুমারের বাড়িতে?
—হ্যাঁ। অবশ্যই যাব। আপনি কুমারকে গিয়ে বলুন সকালের প্রার্থনা শেষ করেই আমি আসছি।
—ধন্যবাদ, আচার্য।
লোকটা বিদায় নিতে চাণক্য প্রথমেই গিয়ে জীবসিদ্ধিকে তুললেন। তাকে সংক্ষেপে ঘটনাটা বলে তাকেও তৈরি হয়ে নিতে বললেন। এরপর নিজে আবার প্রার্থনায় মগ্ন হলেন।
কয়েক ঘণ্টা পর চাণক্য ও জীবসিদ্ধি কুমারের ছাত্রাবাসে এসে হাজির হলেন। দ্বাররক্ষী প্রথমে তাদের বাধা দিতে যাচ্ছিল, তখনই ভেতর থেকে কুমার বেরিয়ে এসে রক্ষীকে নিরস্ত করে তাঁদের ভেতরে আমন্ত্রণ জানালেন। চাণক্য ঢুকতে প্রথমেই কুমার চাণক্যর সামনে নতজানু হয়ে প্রণাম করলেন।
—আচার্য! আচার্য! আপনি মহান। কাল শুধুমাত্র আপনার কারণেই আমার প্রাণ রক্ষা পেয়েছে। আপনি যদি সতর্ক করে না দিতেন তবে কাল নির্ঘাত আততায়ীর হাতে আমার মৃত্যু হত।
—আততায়ীই যে প্রবেশ করেছিল তা নিশ্চিত হচ্ছ কীভাবে, কুমার? চোরও তো হতে পারে। যদিও তক্ষশিলার সুরক্ষিত প্রাঙ্গণে তা বিরল ঘটনা।
—না না, আচার্য। অনুপ্রবেশকারী আমায় হত্যার চেষ্টা করতেই এসেছিল। আসুন, নিজেই দেখুন।
—কুমারের সঙ্গে দু-জন তার ঘরে ঢুকতে, কুমার মেঝের ওপর রাখা লোহার একটা বড়ো কৃপাণ তাঁদের দেখাল। ওটার ধারে এখনও শুকনো রক্ত লেগে আছে।
—এই দেখুন। অনুপ্রবেশকারী এইটা ফেলে গেছে।
—হুম। অনুমান করতে পারি, এই রক্ত তোমার দেহরক্ষীর?
—হ্যাঁ। এই যে… এই বল্লভ, আমার নিজস্ব অনুগত দেহরক্ষী। এর তৎপরতাতেই কাল রক্ষা পেয়েছি। যদিও সেটা করতে গিয়ে বল্লভ হাতে চোট পেয়েছে।
ঘরে দাঁড়িয়ে থাকা এক সুবিশাল দেহধারী, বলিষ্ঠ পুরুষ তাঁদের প্রণাম জানাল। তার বাঁ-হাতে, কাঁধের কাছে মলম পট্টি করা। যদিও লাল রক্তের ছাপ তার ওপর দিয়েও ফুটে উঠছে। চাণক্য বললেন,
—কী ঘটেছিল বিশদে বলবে?
কুমার বলল,
—তবে বল্লভই বলুক রাতের ঘটনা।
বাকি তিন জন বল্লভের দিকে ফিরতে সে বলা শুরু করল,
—আমি কুমারের ঘরেই গতকাল রাতে ঘুমিয়েছিলাম। আমি আগে সৈনিক হিসেবে অনেক যুদ্ধ করেছি, তাই ঘুমের মধ্যেও সতর্ক থাকার প্রশিক্ষণ আমার আছে। শেষরাতের দিকে একটা শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। বুঝতে পারি জানলার কাঠের পাল্লা খুলে কেউ ঢোকার চেষ্টা করছে। আমি হাতে তলোয়ার নিয়ে সতর্ক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি জানলার ধারে। একটু বাদেই জানলা খুলে একজন ভেতরে মাথা বাড়ায়। আমি তলোয়ারের আঘাত করি, কিন্তু ঠিক মুহূর্তে সে সরে গিয়ে বেঁচে যায়। সে ঢোকার চেষ্টা ছেড়ে, এবার পেছন ফিরে পালানোর চেষ্টা করে। আমি প্রথমেই কুমারকে চেঁচিয়ে সতর্ক করি এবং জানলা দিয়ে নিজেও বাইরে লাফিয়ে পড়ি। উদ্দেশ্য সেই আততায়ীকে ধাওয়া করা।
ওই যে দেখুন, ওই পুষ্করিণীর কাছে গিয়ে তাকে ধরতে পারি। কিন্তু অন্ধকারে আমি খেয়াল করিনি তার হাতে এই ছুরিটা ছিল। তখনই সে আমায় আঘাত করে। কিন্তু আমিও পালটা প্যাঁচে তার হাত মুড়ে দিতেই ছুরিটা পড়ে যায়। কিন্তু এরপর সে আমায় ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায়। অন্ধকারের মধ্যে আর তাকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ছিল I
চাণক্য সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বললেন,
—হুম। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আরও সচেতন হতে হবে। প্রাঙ্গণে একজন হত্যাকারী ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে কুমার যে সুরক্ষিত আছে এটাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর্য বল্লভ, তুমি কি লোকটির মুখ দেখেছ?
—তার মুখ কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল, আচার্য।
—বেশ। আর কুমার? তুমি কিছু দেখেছ কি?
কুমার মাথা নাড়ল,
—না, আচার্য। আমার ঘুম ভাঙে তলোয়ার চালানোর আওয়াজে। বল্লভের তলোয়ার, অনুপ্রবেশকারীকে না ছুঁয়ে, জানলার গায়ে লাগে। আর সেই শব্দেই আমি জেগে যাই। তারপরেই বল্লভ আমায় সতর্ক করে চেঁচিয়ে এবং জানলা দিয়ে বাইরে ঝাঁপ দেয়। আমি একটু হতভম্ব হয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ। উঠে যখন জানলার কাছে যাই তখন পুষ্করিণীর ধারে দু-জনকে লড়াই করতে দেখতে পাই শুধু। এরপর আমি বাকি লোকদের ডাকি এবং তাদের বলি বাইরে গিয়ে বল্লভকে সাহায্য করতে। আলো নিয়ে এরপর বহুক্ষণ আমার লোকেরা তল্লাশি করে ভোর অবধি। কিন্তু তাকে আর খুঁজে পায়নি।
চাণক্য কয়েক মুহূর্ত ভাবনায় ডুবে থাকলেন। জানলার কাছে গিয়ে পরীক্ষা করলেন। জানলার গায়ে তলোয়ারের আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট। যথেষ্ট বল প্রয়োগ করেই আঘাত করা হয়েছিল, ঠিক সময়ে অনুপ্রবেশকারী সরে না গেলে, সে খুবই বড়ো রকমের আঘাত পেত। বেশ কিছুটা দূরে পুষ্করিণীর পাড় দেখা যাচ্ছে।
মাঝের জমিটুকুর দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন চাণক্য। কারণটা জীবসিদ্ধি বুঝতে পারল। গতকাল রাতে কুমারের লোকেরা পুরো জায়গাটা হাঁটাচলা করে এলোমেলো করে দিয়েছে। আততায়ীর পায়ের ছাপ বা অন্য কোনো সূত্র যদি থেকেও থাকত, তা এখন আর খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। কুমারের লোকেরা তল্লাশি করতে গিয়ে উপকারের থেকে অপকার বেশি করেছে। তবে তাদের দোষ দেয়া যায় না।
চাণক্য কুমারের দিকে ফিরে প্রশ্ন করলেন,
—কুমার, দু-দিন আগের রাতে তোমার বন্ধু সুনাভকে হত্যা করা হল। আর গতকাল রাতে তোমায় হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। আশা করছি ইঙ্গিতটা বুঝতে পারছ?
চিন্তিতভাবে কুমার উত্তর দিল,
—বুঝতে পারছি, আচার্য। সেই রাতের তন্ত্রাচার করার জন্যে কেউ আমাদের মৃত্যু চাইছে।
—কুমার, এইবার আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করব। আগেও প্রশ্নটা করেছি, আবার করছি। আমি চাই তুমি ভেবে-চিন্তে আমার প্রশ্নর উত্তর দাও।
—বলুন, আচার্য।
—তন্ত্র বইতে কি এমন কোনো গোপন তথ্য ছিল যা লুকিয়ে রাখতে সেই বই পড়েছে এমন চার জনকেই কেউ হত্যা করতে চাইতে পারে?
কিছুক্ষণ ভেবে কুমার উত্তর দিল,
—না, আচার্য। আমার তো সেইরকম কিছুই মনে পড়ছে না। এমন কোনো গোপন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমরা চার জন জানতাম না বলেই আমার ধারণা সেই কারণে কেউ আমাদের প্রাণনাশ করতে চাইবে। তা ছাড়া ওই পুথি তো শুনেছি আপনার কাছেই আছে। বাসবের থেকেই শুনলাম। আপনি নিজেই সেটা পড়ে দেখুন না। আমার অন্তত সেরকম কিছু মনে পড়ছে না।
চাণক্য শুধু নিজের টিকিতে হাত বুলিয়ে বললেন,
—হুম।
কুমার একটু ইতস্তত করে বললেন:
—তবে আমার মনে একটা আশঙ্কা আছে। হয়তো তক্ষশিলার বাসিন্দাদের ধারণা হয়েছে যে যেহেতু আমাদের দোষেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর অভিশাপ নেমে এসেছে, তাই হয়তো আমাদের মৃত্যু হলেই তাদের শাপমুক্তি হবে।
—কুমার, তুমি নিজে কি তাই বিশ্বাস কর? সেই রাতে তোমরা অপশক্তিকে মুক্তি দিয়েছিলে?
চাণক্যর চোখের দিকে চাইল কুমার সুভাষ। তার চোখে সত্যিই ভয় ফুটে উঠেছে। কাঁপা স্বরে উত্তর দিল,
—হ্যাঁ। সেইদিন যা ঘটেছে তা স্বাভাবিক নয়। আমি এতটা ভয় কোনোদিন পাইনি। সেই দৃশ্য… উফ! কী ভয়ংকর!
চাণক্য আর কথা বাড়ালেন না। কয়েকজন কর্মচারীকে এরপর তিনি দু-একটা প্রশ্ন করলেন। কোনো তথ্য পাওয়া গেল না। তারা কুমারের ডাকেই ঘুম থেকে উঠে এসেছিল। অতএব, তারা কিছুই দেখেনি বা কিছুই শোনেনি।
চাণক্য তাদের সতর্ক থাকতে উপদেশ দিলেন। কুমারের সুরক্ষার যেন কোনোরকম ত্রুটি না রাখা হয় বল্লভকে সেটার দিকে নজর রাখতে বললেন।
এরপর কুমারের থেকে বিদায় নিতে গেলে কুমার বলল:
—আচার্য, আমি আর এখানে থাকতে চাই না। আমার বাবারও তাই মত। এই অশুভ পরিবেশে আমি এতদিন থেকেছি সুস্থ হওয়ার আশায় এবং প্রধানাচার্যর অনুরোধে। কিন্তু কালকের ঘটনার পর আর নয়। আমি আমার রাজ্যে ফিরে যেতে চাই।
চাণক্য কুমারের কাঁধে হাত রেখে আশ্বাস দেয়ার ভঙ্গিতে বললেন,
—আমি তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি, কুমার। কিন্তু আমার অনুরোধ, তুমি আর কয়েকটা সপ্তাহ ধৈর্য ধরো। তার মধ্যে যদি আমি রহস্যর সমাধান করতে না পারি, তবে আমি আর বাধা দেব না।
—বেশ, আচার্য। আপনি কাল আমার প্রাণ রক্ষা করেছেন। আপনার কথা আমি রাখব। প্রণাম, আচার্য।
.
নিজেদের বাড়িতে ফেরার পুরো পথে চাণক্য একটাও কথা বললেন না। তাঁকে চিন্তিত লাগল। বাড়ির কাছে আসতেই জীবসিদ্ধি আর চাণক্যর চোখে পড়ল তাঁদের বন্ধ দরজার সামনে উৎপল দাঁড়িয়ে। সে বোধ হয় বেশ কিছুক্ষণ তাঁদের ফেরার অপেক্ষা করছিল। তাদের দু-জনকে দেখেই এগিয়ে এল উৎপল। তার চোখে-মুখে চাপা উত্তেজনা। এতটাই উত্তেজিত সে, যে প্রণাম জানানোর কথাও তার মনে নেই। প্রায় ছুটে এসে উত্তেজিতভাবে বলল:
আচার্য! কুয়োর তলায় একটা মৃতদেহ পাওয়া গেছে!
১৭.
দড়ি ফেলে তুলে আনা হচ্ছে ভারী কিছু একটা। যতই দড়ি গোটানো হচ্ছে, ততই দুর্গন্ধে ভরে উঠছে চারপাশ। দু-জন সৈনিক মৃতদেহ তুলে আনছে এবং বাকি সৈনিকেরা দূরে দাঁড়িয়ে আশেপাশে নজর রাখছে। চাণক্য তাদের কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন, যেন একজনও এইদিকে আসতে না পারে।
নাকে গায়ের কাপড় চেপে দাঁড়িয়ে আছেন চাণক্য এবং জীবসিদ্ধি। কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃতদেহটা উঠে এল। পচনশীল, বিকৃত, কঙ্কালসার মৃতদেহ। সৈনিকরা দড়ি ধরে দেহটা মাটিতে নামিয়ে রাখল। চাণক্য নাকে গায়ের কাপড় চাপা দেয়া অবস্থাতেই এগিয়ে গেলেন দেহটার দিকে। ঝুঁকে পড়ে দেখতে লাগলেন। মুখ দেখে শনাক্ত করার উপায় নেই। মাথার খুলি ব্রহ্মতালুর কাছে দুই ফাঁক হয়ে আছে। দেহটা থেকে প্রচণ্ড পচা গন্ধ বেরোচ্ছে। মৃতদেহর শরীরে দড়ির দাগ স্পষ্ট। ভারী পাথর বাঁধা ছিল শরীরের সঙ্গে যাতে মৃতদেহ ডুবে থাকে। মৃতদেহর পাশেই একটা ভারী লোহার ছোটো ডান্ডা পড়ে আছে। এটা আগেই তোলা হয়েছে। বেশ কয়েকদিন জলের সংস্পর্শে থেকে সেটা ক্ষয়ে গেছে।
সব কিছু দেখে নিয়ে চাণক্য উঠে সরে এসে জীবসিদ্ধির পাশে দাঁড়ালেন।
—কী বুঝছ, জীবসিদ্ধি?
—দেহের পচন থেকে অনুমান করা যায় প্রায় এক বছরের পুরোনো লাশ।
—হুম।
—মাথায় আঘাতে মৃত্যু হয়েছে। হত্যাকারী মৃতদেহর সঙ্গে হত্যার শস্ত্রটাও কুয়োয় ফেলে দিয়েছে।
—হুম। আর এই হতভাগ্য মানুষটা কে তা আশা করি অনুমান করতেই পারছ?
—আচার্য বিন্দাচল।
কিছুক্ষণ দু-জনের কেউই কোনো কথা বললেন না। নিশ্চুপভাবে বিকৃত মৃতদেহটার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। দিনের আলো ফুরিয়ে আসছে। অস্তগামী সূর্য দিগন্তরেখার দিকে ঢলে পড়েছে। পাখিরা বাড়ি ফিরছে।
জীবসিদ্ধি প্রশ্ন করল,
—আচার্য, এইবার? মৃতদেহ কোথায় নিয়ে যাব?
চাণক্য কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলেন জীবসিদ্ধির দিকে। তার প্রশ্নর উত্তর না দিয়ে তিনি, আদেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা দুই সৈনিকের দিকে ফিরলেন। বললেন,
—মৃতদেহ আবার কুয়োর ভেতর নামিয়ে দাও।
জীবসিদ্ধি এবং সৈনিক দু-জন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে চাণক্যর দিকে। জীবসিদ্ধি সম্পূর্ণ বজ্রাহতের মতো চেয়ে আছে তার গুরুর দিকে।
—আচার্য! এ আপনি কী বলছেন?
চাণক্যর দৃষ্টিতে কাঠিন্য ফুটে উঠেছে। তিনি দৃঢ় স্বরে আবার বললেন,
—মৃতদেহ জলে নামিয়ে দিয়ে, কুয়োর ওপরের ঢাকনাটা দিয়ে মুখটা ঢেকে, আবার আগের মতো করে দাও।
জীবসিদ্ধি আবার চাপাস্বরে বলে উঠল,
—আচার্য!
চাণক্য এইবার জীবসিদ্ধির চোখে চোখ রাখলেন। বললেন,
—জীবসিদ্ধি, নিজে একজন আচার্য ব্রাহ্মণ হয়ে, নিজেরই এক সহকর্মী শিক্ষকের মৃতদেহর সঙ্গে এইরকম ব্যবহার করতে, আমারও হৃদয়ে ততটাই যন্ত্রণা হচ্ছে যতটা তোমার। বিশ্বাস করো আমার কথা। কিন্তু এই মুহূর্তে হৃদয়ের থেকে, মস্তিষ্কের নির্দেশ মেনে চলাটা বেশি আবশ্যক। আমরা এই মুহূর্তে একটা আপৎকালীন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে। আর এই সময়ে আবেগের বশবর্তী হয়ে কোনো কাজ করা আমাদের সাজে না।
—আপনি কী বলতে চাইছেন, আচার্য?
—ভেবে দেখো। এই মৃতদেহ তুলে নিয়ে সৎকারের ব্যবস্থা করতে গেলে, এই তক্ষশিলার প্রতিটা মানুষ জেনে যাবে ঘটনাটা। আর তাদের মধ্যেই হত্যাকারীও জানতে পারবে সেটা। সে সতর্ক হয়ে যাবে। আমরা তাকে ধরার আগেই পালিয়ে যেতেও পারে। তাই নয় কি?
জীবসিদ্ধি কোনো উত্তর দিতে পারল না। চাণক্য আবার বললেন,
—এই মুহূর্তে এই খবর কাউকে জানতে দেয়া যাবে না, জীবসিদ্ধি। আমি নিরুপায়। আচার্য বিন্দাচলের আত্মা তবেই শান্তি পাবে, যদি তার হত্যাকারী শাস্তি পায়। আর সেই কারণে আজ এই কঠিন সিদ্ধান্ত আমায় নিতেই হবে।
জীবসিদ্ধির কাঁধে হাত রাখলেন চাণক্য। তারপর মৃতদেহর দিকে ঘুরে এগিয়ে গেলেন। মৃতদেহর সামনে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করলেন চাণক্য। মৃতদেহর উদ্দেশে বললেন,
—হে আচার্য বিন্দাচল, আমায় ক্ষমা করবেন। আপনার মরদেহের সঙ্গে এই অবিচার করার জন্যে আমি অত্যন্ত ব্যথিত। কিন্তু অনুগ্রহ করে আরও কয়েকটা দিন অপেক্ষা করুন। আমি কথা দিলাম, বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্য খুব তাড়াতাড়িই আপনার মৃতদেহ সৎকারের ব্যবস্থা করবে। কিন্তু আজ আমায় ক্ষমা করবেন।
.
সরে এসে চাণক্য সৈনিকদের কাজ শুরু করতে ইশারা করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার আগের মতো কুয়ো ঢাকা দিয়ে দেয়া হল। সৈনিকদের বিদায় দিয়ে নিজেরাও পথ ধরলেন দু-জনে।
.
রাতে দু-জনের কেউই খেতে পারলেন না। কর্পূরের সুগন্ধের মাঝেও পচা দুর্গন্ধটা যেন এখনও তাঁদের নাকে লাগছিল। দু-জনের মধ্যে আজ খুব সামান্য কথাবার্তা হল। ঘুমোতে যাওয়ার আগে চাণক্য প্রশ্ন করলেন,
—ওহে জীবসিদ্ধি, এই ঘরে থেকে তোমার মনের সেই ভয়ের ভাবটা কিছুটা কমেছে কি?
—হ্যাঁ, আচার্য। তবে আজ রাতে সম্ভবত আমি খুব ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখতে চলেছি। এবং তাতে আচার্য বিন্দাচলের বিকৃত মৃতদেহর একটা বড়ো ভূমিকা থাকবে বলে আশঙ্কা করছি।
শয্যায় শুয়ে, চোখ বন্ধ অবস্থাতেই মৃদু হাসলেন চাণক্য। প্রদীপের আগুন নিভিয়ে জীবসিদ্ধি নিজেও শয্যা নিল। কিছুক্ষণ জেগে রাতের কীটপতঙ্গের এক সুরে ডেকে চলার শব্দ শুনল জীবসিদ্ধি। তারপর বলল,
—আচার্য।
অন্ধকারের ভেতর থেকেই উত্তর এল,
—বলে ফেলো।
—আপনি কি কিছু ভেবে পেয়েছেন? কোনো সূত্র?
—অনেক সূত্র পেয়েছি। একটা ঘটনা আলো দেখাচ্ছে। কিন্তু অন্য ঘটনাগুলো সেটার সঙ্গে মেলাতে পারছি না। কিছু একটা আমার নজর এড়িয়ে যাচ্ছে, জীবসিদ্ধি। কিছু একটা সূত্র এখনও আমার অধরা। মন বলছে সেটা খুব তাড়াতাড়িই পাব। কিন্তু তার আগে অপেক্ষা করতে হবে।
—কীসের অপেক্ষা?
—মগধ থেকে চিঠি আসার অপেক্ষা করতে হবে। যদিও আমি অনুমান করতেই পারছি যে ওই গাছগুলো পরীক্ষা করার ফল কী আসবে। তবুও আমি নিশ্চিত হতে চাই। ধৈর্য রাখো কয়েকটা দিন।
—আর ততদিন আপনি কী করবেন, আচার্য?
—ভাবব। শুধুই ভাবব।
১৮.
বেশ কয়েকটা দিন উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটল না। যদিও মাঝে আরও একজন আচার্য এবং এক ছাত্রর রাতে ভয় পাওয়ার খবর পেয়েছেন চাণক্য এবং জীবসিদ্ধি। চাণক্য নিয়মিত ছাত্রদের মাঝে সময় দিচ্ছেন। কয়েক দিন অন্তর একবার করে বাসব আসে। চারিদিকে ঘটে চলা ঘটনার খবর দিয়ে যায় তাঁদের। জীবসিদ্ধি এখন খানিকটা সুস্থ, ঘুমের সমস্যাও দূর হয়েছে কিছুটা। তবুও চাণক্য জীবসিদ্ধিকে একা নিজের ঘরে রাতে থাকতে দিতে রাজি হননি।
জীবসিদ্ধি বেশ অশান্ত হয়ে উঠছে। তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে। কিন্তু চাণক্যর মধ্যে সেই রকম কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। রোজকার নিয়মমতো দিন কাটিয়ে চলেছেন। নিজের বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেনও খুবই কম। যে কেউ তাঁর জীবনযাপন দেখলে মনে করবে যে মানুষটা চরম আলস্যে দিন কাটিয়ে চলেছেন। কিন্তু জীবসিদ্ধি তার গুরুদেবকে বহু বছর ধরে চেনে। এই শান্তি হল আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস। জীবসিদ্ধির মনে আছে, নন্দ সাম্রাজ্যর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহর দিনগুলোর কথা। মাঝে মাঝেই চাণক্য এরকম নিষ্ক্রিয়ভাবে দিন কাটাতেন। কিন্তু এই সময়টা তাঁর মনের মধ্যে ঝড় চলে। তিনি গভীর চিন্তায় ডুবে থাকেন সর্বক্ষণ। আর তাই বাহ্যিক কাজকর্ম থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে ফেলেন। এই কয়েক দিনের নিষ্ক্রিয়তার পরেই তিনি ফিরে আসতেন রাজশক্তির ওপর আঘাত হানার নতুন কোনো দুর্দান্ত পরিকল্পনা নিয়ে। এইবারও তাই হবে। জীবসিদ্ধি নিশ্চিত। নিজের গুরুর প্রতি তার অসীম আস্থা। আঁধার যতই নিরবচ্ছিন্ন হোক, চাণক্য আলো দেখাবেন। আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব মনে হয়েছিল এমন বহু সমস্যার সমাধান সে এই মানুষটিকে করতে দেখেছে।
কিন্তু এই নিষ্ক্রিয় জীবন জীবসিদ্ধির কাছে এবার অসহনীয় লাগতে শুরু করেছে। মাঝে একবার সে চন্দ্রগুপ্তকে চিঠি লিখেছে। কিন্তু তার প্রত্যুত্তর আসতে দেরি আছে। এদিকে সেই গাছগুলোর পরীক্ষার ফলাফলও আসছে না। ধৈর্য আর রাখতে না পেরে সে চাণক্যকে প্রশ্ন করেই ফেলল,
—আচার্য, আর কতদিন এভাবে থাকব?
চাণক্য ফাঁকা দেয়ালের দিকে চেয়ে বসে ছিলেন বেশ কিছুক্ষণ। শিষ্যর প্রশ্নে তার দিকে মুখ ফিরিয়ে মৃদু হাসলেন।
—আহা! ধৈর্য হারাও কেন? বেশিদিন আর লাগবে না। আমি আমার চিঠিতে নির্দেশ দিয়েছি যে গাছগুলো পরীক্ষা করে তার খবর যেন ঘোড়সওয়ার দূত মারফত না পাঠানো হয়। তাতে সময় বেশি লাগবে। উত্তর যেন দ্রুতগামী পত্রবাহী পায়রার মাধ্যমে পাঠানো হয়। অতএব, বেশি দেরি হবে না। আশা করা যায় আর কয়েক দিনের মধ্যেই চিঠি এসে পড়বে।
সেই চিঠি এলেই সব রহস্যের সমাধান হবে?
দু-দিকে ঘাড় নাড়েন চাণক্য।
—না। ওটা শুধুমাত্র আমার একটা অনুমানের সত্যতা প্রমাণ। এর বেশি কিছু নয়।
—তার মানে রহস্যর সমাধান আপনি পেয়েছেন?
—পুরোটা সমাধান করে ফেলেছি বললে ভুল হবে। আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে কোথাও একটা কিছু আমি ভুলে যাচ্ছি। আর সেইটা মনে পড়লেই শেষ সূত্রটা মিলে যাবে।
—দয়া করে আলোকপাত করুন, আচার্য।
—বেশ। আমি তোমার সামনে কয়েকটা প্রশ্ন রাখছি। তুমি সেগুলোর উত্তর ভাবো। প্রথম প্রশ্ন, সবার মনে এই ভয়ের উৎস কী বলে মনে হয়?
—অনুমান করতে পারি, আচার্য বিন্দাচলের তৈরি করা কোনো মাদক। সেটার প্রমাণ আসবে মগধ থেকে আসা চিঠিতে।
—হুম। ঠিক। এর পরের প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই আসছে, সেই মাদক সারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানুষের শরীরে কীভাবে প্রবেশ করছে? তাও আবার তাদেরই অজান্তে?
—আমি বলতে পারি না। ভেবে পাইনি।
উত্তর না দিয়ে চাণক্য পরের প্রশ্নে চলে গেলেন,
—এই ঘটনার সঙ্গে চার ছাত্রর করা সেই তন্ত্রক্রিয়ার সম্পর্ক কী? সেই বইয়ে কী লেখা ছিল?
—বিষয়টা কাকতালীয় হতে পারে।
—তাই যদি হবে, তাহলে সেই বই আমার ঘর থেকে কেন চুরি করা হল? উত্তর দিতে পারল না জীবসিদ্ধি। চাণক্য আবার পরবর্তী প্রশ্ন করলেন,
—আমরা আসার পর থেকে অনেকের কাছেই তাদের দেখা ভয়ানক দৃশ্যর কথা জানতে পেরেছি। উল্লেখযোগ্য বিষয়, যে, প্রত্যেকে আলাদা আলাদা দৃশ্য দেখেছে। তুমি কি অনুমান করতে পারো এর কারণ কী?
—বোধ হয় পারি। প্রত্যেকে যে যে বিশেষ জিনিসে ভয় পায়, তারা সেটাই দেখতে পেয়েছে। অর্থাৎ প্রত্যেকের মনের ভয় তাদের সামনে মূর্তিমান হয়ে দেখা দিয়েছে।
—উত্তম! যথার্থ যুক্তিনির্ভর বিশ্লেষণ। ঠিক যেমন আচার্য প্রমুখর দেখা ভয়ানক দৃশ্যের ব্যাখ্যা আমি আগেই করেছি। সেভাবেই তোমার মনে সৃষ্টি হওয়া ভয়েরও ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
—কীরকম?
—তুমি গুপ্তচর ছিলে। অত্যন্ত সাহসী একজন গুপ্তচর। খোদ মগধের হৃদয়ে, পাটলিপুত্রতে থেকে তুমি আমায় গোপন তথ্য দিতে। কিন্তু সেই দিনগুলোয় সর্বক্ষণ তোমার মনে এই আশঙ্কা থাকত যে কেউ হয়তো তোমায় দেখে নিল, কেউ তোমার ওপর নজর রাখছে। পথ চলতে বহুবার পেছনে চেয়ে দেখার স্বভাব তোমার আজও রয়ে গেছে।
সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে জীবসিদ্ধি। চাণক্য ব্যাখ্যা করতে থাকেন আবার,
—অতএব, তোমার অবচেতন মনে একটা ভয় ঢুকে গেছে যে কেউ বুঝি গোপনে তোমার ওপর নজর রাখছে। আর এই কারণেই তোমার নিজের মনে হতে থাকে যে তুমি ঘরে একা নও। তোমার ওপর অদৃশ্য কোনো শক্তি নজর রাখছে। আমার এই ব্যাখ্যা কি তোমার কাছে সন্তোষজনক মনে হচ্ছে, জীবসিদ্ধি?
—হ্যাঁ। মনে হচ্ছে। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে, প্রথম যে বৃদ্ধ আচার্যর মৃত্যু হয়েছিল, তিনি অভিশাপের উল্লেখ করলেন কেন?
চাণক্য উত্তর না দিয়ে মৃদু হাসলেন। ওঁর চোখের তারায় কৌতুকের আভাস। বললেন,
—আমি তোমায় প্রশ্ন করব বলেছি। উত্তর দেব তো বলিনি হে জীবসিদ্ধি। আমি বরং পরের প্রশ্নটা তোমার সামনে রাখি। পরের প্রশ্ন, সেদিনের তন্ত্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছাত্রদের কে হত্যা করছে বা হত্যা করার চেষ্টা করছে? এর সঙ্গে এই পুরো ঘটনাক্রমের কী সম্পর্ক?
—আমি সত্যি আর কিছু অনুমান করতে পারছি না। আপনি কি এর উত্তর ভেবে পেয়েছেন?
—নাহ্। পাইনি। এবং এটাই আমায় ভাবিয়ে চলেছে। সব ঘটনার মধ্যে কোনো একটা সূত্র আছে যা এখনও আমার অধরা। সেই সূত্রটা না পেলে এই রহস্যর সম্পূর্ণ সমাধান করা যাচ্ছে না।
—বুঝলাম। তবে আমার মনে হয় অল্প সময়ের বিরতি নিয়ে একটু মুক্ত বাতাস এবং নীল আকাশে বেরোলে লাভ হয়।
—তুমি ভ্রমণের সঙ্গী খুঁজছ সেটা সোজাসুজি বলতে দ্বিধা কোরো না। সেটাই আসল কারণ। এর সঙ্গে রহস্যর সমাধানকে যুক্ত করে অজুহাত দেয়া অহেতুক।
সশব্দে হেসে উঠল জীবসিদ্ধি। চাণক্য নিজেও হেসে উঠলেন। বললেন,
—বেশ। ঘর থেকে কাল বেরোব। একটু প্রাঙ্গণে ঘুরে আসব তোমার সঙ্গে। তবে আজকে নয়।
—আজ নয় কেন? আজকের সকালটা কিন্তু বেশ সুন্দর। গতকাল রাতে বৃষ্টি হয়ে বেশ ঠান্ডা করে দিয়েছে। আজ কিন্তু একটু হাঁটতে বেরোনোর আদর্শ দিন ছিল, আচার্য।
—নাহ্। আজ নয়। আজ একটা চিন্তাসূত্র আমার মাথায় এসেছে। সেটা এই মুহূর্তে ছেড়ে দিতে চাই না। কাল যাব। আশা করি কালও ভালোই থাকবে আবহাওয়া। তুমি বরং আজ একটা কাজ করো।
—কী আচার্য?
—একাই ঘুরে এসো। আর সঙ্গী করো চিন্তাকে। এই যে প্রশ্নগুলো করলাম, সেগুলোর উত্তর ভাবো।
১৯.
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছেন চাণক্য এবং জীবসিদ্ধি। উদ্দেশ্যহীনভাবে, ধীরে-সুস্থে হেঁটে চলেছেন দু-জনে। জ্ঞান স্তূপ, বিভিন্ন আশ্রম, গ্রন্থাগার পেরিয়ে আরও এগিয়ে চলেছেন। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দু- জনে কথা বলছেন। বেশিরভাগই পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করছেন গুরু- শিষ্য। মাঝে মাঝেই মৃদু কৌতুকের কথাতে দু-জনে হেসেও উঠছিলেন। চাণক্য একটা সংস্কৃত শ্লোকের অপব্যাখ্যা নিয়ে একটা মজাদার কাহিনি শেষ করতেই হেসে ওঠে জীবসিদ্ধি। কিছুক্ষণ হেসে বলে,
—আচার্য, সত্যি বলছি, এই তক্ষশিলায় থাকার সময়ে কোনোদিন ভাবতেও পারিনি যে একদিন এইভাবে আপনার সঙ্গে কথা বলব, কৌতুক করব। আপনি কিন্তু সেই সময়ে আমাদের কঠিন শাসনে রেখেছিলেন।
—হুম। সেটা আমি অস্বীকার করছি না। তোমাদের ছ-জন ছাত্রকে আমি অন্যদের তুলনায় বেশিই কঠিনভাবে শাসন করতাম। তার কারণ তোমাদের ওপর নির্ভর করছিল গোটা আর্যাবর্তর ভবিষ্যৎ। তাই তোমাদেরকে পরখ করে নেয়ার বিশেষ প্রয়োজন ছিল।
—আচ্ছা আচার্য, আমরা ছাড়াও আপনার কি অন্য কোনো ছাত্র ছিল?
একটু যেন গম্ভীর হয়ে গেলেন চাণক্য। বললেন,
—ছিল। এই দেশের যোগ্য ভাবী শাসক ও তার সহযোদ্ধাদের খুঁজে পেতে আমি বেশ কিছু বছর সন্ধান করেছিলাম। আমি বিভিন্ন মানসিক এবং চারিত্রিক পরীক্ষা রাখতাম ছাত্রদের সামনে। চন্দ্রগুপ্তকে আমি বহুবার কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলেছি। তার বিচারবোধ, বুদ্ধি এবং মানসিক দৃঢ়তার যথাযথ প্রমাণ পেয়েই তাকে আমি এই গুরুদায়িত্ব দিয়েছি। এই পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হতে পারেনি, তাদের আমি বাদ দিয়েছি।
—স্বাভাবিক। তবে আপনার সঙ্গে কৌতুক করার স্পর্ধা কোনোকালে হবে বলে আমরা কেউই কোনোদিন অনুমান করিনি।
মৃদু হেসে চাণক্য বললেন,
—মা-বাবার আচরণ তার সন্তানের প্রতি কীরকম হওয়া উচিত জানো? বাল্যকালে তাকে শুধুই স্নেহ দিতে হয়। কৈশোরে তাকে শাসন করা প্রয়োজন। এবং যৌবনে তার সঙ্গে বন্ধুর মতো সম্পর্ক রাখা উচিত। একজন গুরু তার ছাত্রর কাছে মা-বাবার সমকক্ষ হয়। অতএব, এখন আমি এবং তুমি বন্ধুর পর্যায়ে পড়ি।
—ধন্য আপনার জীবনদর্শন! খেয়াল করেছেন কি? কথা বলতে বলতে বহুদূর এসে গেছি। এইদিকে আর এগিয়ে লাভ নেই। সামনে স্মৃতিসৌধর প্রাঙ্গণ। তারপর আর কিছু নেই।
.
তক্ষশিলা মহাবিদ্যালয়ের নিজস্ব একটা প্রাঙ্গণ আছে যেখানে স্বৰ্গত ছাত্র, কর্মী ও শিক্ষকের স্মৃতির উদ্দেশে একটা করে স্তূপ বা স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে মৃত্যু হলে তাদের স্মরণে ছোটো আকারের এই সৌধ এইখানে স্থাপন করে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
সামনের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন চাণক্য এবং জীবসিদ্ধি। তাঁদের সামনে অনেকগুলো এরকম পাথরের স্মৃতিসৌধ। এত বছরের ইতিহাসে, প্রাঙ্গণে বহু মানুষেরই মৃত্যু হয়েছে। সাধারণ কর্মচারীদের থেকে শুরু করে পণ্ডিত আচার্য। সবার নামেই শিলা স্থাপন করা হয় যদি তার মৃত্যু কার্যকালে হয়ে থাকে। সমস্ত কর্মীকে সমান সম্মান দেয়াই এই রীতির উদ্দেশ্য। প্রাচীন শিলাগুলোর দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন চাণক্য। খানিকটা নিজের মনেই বলেন,
—সম্ভবত গত কয়েক মাসে অনেকগুলো নতুন স্মৃতিসৌধ যোগ হয়েছে। কয়েক দিন পর আরও একটা নতুন যোগ হবে। আচার্য বিন্দাচলের, যা কিনা এক বছর আগেই স্থাপিত হওয়ার কথা ছিল।
বিষণ্ণ দেখায় চাণক্যকে। জীবনের একমাত্র সত্য হল মৃত্যু। সেটা চাণক্য জানেন এবং মানেন। তবুও মৃত্যু তাঁর কাছে বরাবরই খুব দুঃখের জিনিস সম্ভবত বাল্যকালে মা-বাবাকে হারানোর ফলেই আরও বেশি করে তাঁর এরকম মনে হয়। জীবসিদ্ধি বলল:
—একজন মানুষ দেখছি নতুন একটা সৌধ নির্মাণ করছে ওইদিকে। ওই যে দেখুন।
আঙুল দিয়ে দেখাল জীবসিদ্ধি। অনতিদূরে এক ব্যক্তি একটা শিলাখণ্ড কেটে ঘাসের ওপর বসে তাতে নাম খোদাই করছে। চাণক্য বললেন,
—নিশ্চয়ই সুনাভর জন্যে বানানো হচ্ছে এটা।
দু-জনেই ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন সেইদিকে। কাছে গিয়ে বুঝলেন তাঁদের অনুমানই ঠিক। সুনাভর নাম খোদাই করছে লোকটা। তাঁদের দেখে প্রণাম জানিয়ে, আবার ছেনি আর হাতুড়ি তুলে নিজের কাজে লেগে গেল লোকটা। জীবসিদ্ধি খেয়াল করল যে এইদিকটাতে বেশ কয়েকটা নতুন স্মৃতিসৌধ দেখা যাচ্ছে। আগেরগুলোও সে-ই নির্মাণ করেছে কি না জানতে চাওয়ায় লোকটা জানাল যে, সে-ই এগুলো বানিয়েছে।
তাঁরা আসায় লোকটা বোধ হয় খুব একটা প্রসন্ন হয়নি। কাজের মাঝে অহেতুক কৌতূহলী দুই ব্রাহ্মণের প্রশ্নে সে কিছুটা বিরক্তই হয়েছে। সেটা বুঝেই জীবসিদ্ধি ফেরার জন্যে প্রস্তুত হল। চাণক্যকে ডাকতে গিয়েই দাঁড়িয়ে গেল সে।
জীবসিদ্ধি লক্ষ করল, চাণক্যর মুখের ভাবের পরিবর্তন হয়েছে। তাঁর কপালে গভীর ভ্রূকুটি। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন নতুন স্মৃতিফলকগুলোর দিকে। কী হয়েছে সে-প্রশ্ন করার আগেই চাণক্য জীবসিদ্ধির উদ্দেশে প্রশ্ন করলেন,
—জীবসিদ্ধি, গত কয়েক মাসে কার কার মৃত্যু হয়েছে একবার আমায় মনে করিয়ে দাও তো।
একটু ভেবে জীবসিদ্ধি বলল:
—আচার্য ভীমরজ, ছিত্রবান এবং সবশেষে সুনাভ।
—অর্থাৎ, তিন জন। তাই তো?
—হ্যাঁ।
—তাহলে চতুর্থ স্মৃতিসৌধটা কার?
এই কথায় জীবসিদ্ধি লক্ষ করে বিষয়টা। এতক্ষণ সে খেয়াল করেনি। সত্যি তো, নির্মীয়মাণ ফলকটা বাদেও আরও তিনটে নতুন প্রস্তরফলক দেখা যাচ্ছে পর পর। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন চাণক্য এবং তাঁর পিছু নিল জীবসিদ্ধি। উলটো দিক থেকে প্রথম সৌধয় নজরে পড়ল ছাত্র ছিত্রবানের নাম, পরেরটাতে আচার্য ভীমরজ। তার পরেরটাতে অপরিচিত একটা নাম দেখতে পেলেন দু-জনে।
‘মনীন্দ্ৰনাথ’।
নামটা বেশ কয়েক বার মনে মনে পড়লেন চাণক্য। যেন কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করছেন তিনি। যদিও জীবসিদ্ধি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারে যে এই নাম আগে কখনোই সে শোনেনি। কিন্তু কে এটা? ফলকটা দেখে তো মনে হচ্ছে এটা কয়েক মাসের বেশি পুরোনো নয়। আচার্য ভীমরজের ফলকটার প্রায় সমসাময়িকই এটা। ছেনি-হাতুড়ি নিয়ে কাজে নিমগ্ন ব্যক্তির উদ্দেশে প্রশ্ন করলেন আচার্য,
—ওহে, মহাশয়। হ্যাঁ, আপনাকেই বলছি। আপনি কি বলতে পারেন যে এই স্মৃতিফলকটা যাঁর উদ্দেশে বানিয়েছিলেন, কে সেই মানুষটি?
এইরকম অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নে লোকটা বেশ বিরক্ত হয়েছে বোঝা যায়। তবু একজন ব্রাহ্মণ আচার্যকে সম্মান দিতেই হয়। তাই স্বরে যতটা সম্ভব বিরক্তি চাপা দিয়ে উত্তর দিল,
—একজন ছাত্রর।
—কীভাবে মারা গিয়েছিল জানেন?
—শুনেছিলাম আত্মহত্যা। এর বেশি কিছু আমার জানা নেই।
—ধন্যবাদ।
আর কোনো কথা না বলে চাণক্য ফেরার পথ ধরলেন। তাঁর কপালের ভ্রূ জোড়া এখনও কুঁচকে আছে। কিছুদূর এগিয়ে তিনি, অতিথি-নিবাসে যাওয়ার রাস্তাটা ছেড়ে ডান দিকে মোড় ঘুরে গেলেন। জীবসিদ্ধি বুঝল যে তারা এখনই বাড়ি ফিরছে না। চাণক্য অন্য কোথাও চলেছেন। তাঁর পাশাপাশি চলতে চলতে জীবসিদ্ধি প্রশ্ন করল,
—আমরা কোথায় চলেছি, আচার্য?
তার দিকে না তাকিয়েই সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন চাণক্য,
—প্রধানাচার্যর কাছে।