কনক-শাস্ত্র – ১০

১০.

সকাল থেকে কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত সেই বইটা খুঁজে পেয়েছে জীবসিদ্ধি ও বাসব। গ্রন্থাগারের কোন অংশে সেটা রাখা আছে, তা না জানা থাকলে এটা খুঁজে বের করাটা খড়ের গাদায় সুচ খোঁজা’র মতোই কঠিন হত। সেটা নিয়ে চাণক্যর ঘরে এসে জীবসিদ্ধি আচার্যকে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় পেল। পদ্মাসনে, চোখ বুজে গভীরভাবে ধ্যানে বসে আছেন তিনি। জীবসিদ্ধি জানে এই সময়ে ওঁকে বিরক্ত করা যাবে না। তাই সে অপেক্ষা করে বসে থাকল।

বেশ কিছুক্ষণ পরে চাণক্য চোখ খুললেন এবং জীবসিদ্ধিকে দেখে মৃদু হাসলেন। জীবসিদ্ধি তার সামনে রাখা পুথিটার দিকে নির্দেশ করে বলল:

—এই সেই বই, আচার্য।

—আহা। বেশ, বেশ। এটা আমি আজকেই একবার পড়ে দেখব। কাল সৈনিকদের দিয়ে ভালো খেজুরের রস আনিয়েছি। খুব সুন্দর। একবার স্বাদ নিয়ে দেখো হে, জীবসিদ্ধি।

উত্তর না দিয়ে জীবসিদ্ধি চুপচাপ বসে আছে দেখে চাণক্য প্রশ্ন করলেন,

—কী প্রশ্ন করতে চাও সেটা করে ফেলো।

—আচার্য, পুরো বিষয়টা নিয়ে আপনি কি কোনো ধারণা করতে পেরেছেন? নিজের টিকির চুলে হাত বোলালেন চাণক্য। বললেন,

—সত্যি বলতে আমার মনে হয় এখনও পুরো রহস্যটাই আমাদের সামনে আসেনি। বিষয়টা অনেক বেশি গভীর। তবে গত তিনদিনে ছাত্রদের, বাসব এবং প্রধানাচার্যর বক্তব্য থেকে কয়েকটা বিষয় উঠে এসেছে।

—যেমন?

—যেমন, প্রত্যেকে আলাদা আলাদা দৃশ্য দেখেছে। চার ছাত্রর মধ্যে তিন ছাত্র সম্পূর্ণ আলাদা বর্ণনা দিয়েছে। আমার মনে হয় চতুর্থজনও আলাদা কিছুই বলত। এই বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। এরপর আসি একটা মূল প্রশ্নে যার উত্তর আমার অজানা।

—কোন বিষয়?

—চার ছাত্রর মধ্যে কুমার কেন সবচেয়ে কম প্রভাবিত হল? সেইদিন চার জন একসঙ্গে সব কাজ করল। অথচ শুধু কুমার সুস্থ রইল। সে-ই একমাত্র ওই রাতে আর্তনাদ করতে পেরেছিল। বাকিরা তা করতে পারেনি। কেন?

—আপনি কি কুমারকে সন্দেহ করছেন?

—আমি সবাইকেই সন্দেহ করছি। কুমার যে সত্যি কথা বলছে তার কোনো প্রমাণ নেই। এদিকে, এই দু-জন ছাত্র যে অভিনয় করছে না তারই- বা প্রমাণ কই? যদিও এত নিখুঁত অভিনয় করা তাদের পক্ষে সম্ভব বলে আমার মনে হয় না।

—আপনি কি সন্দেহ করছেন এরা মাদক সেবন করেছিল?

—লক্ষণ তো তাই বলছে। মাত্রাতিরিক্ত সেবনের ফলে তাদের এই অবস্থা হয়ে থাকতে পারে।

—কিন্তু সেক্ষেত্রে বাকি প্রত্যেকের এই ভয়ের আর অদ্ভুত দৃশ্য দেখার কারণ কী?

—সেটাই সবচেয়ে বড়ো রহস্য। যদি না সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই পুরোপুরি মানুষের রটনা হয়ে থাকে। আদিকাল থেকেই মানুষ অতিপ্রাকৃত নিয়ে উৎসাহিত। তাদের মস্তিষ্ক অলৌকিকের সংস্পর্শে এলে অত্যন্ত প্রীত হয়।

—কিন্তু তাই বলে স্বয়ং প্রধানাচার্য?

—হুম। দেখো, ওঁর বয়স হয়েছে। বার্ধক্য মানুষকে বদলে দেয়। হতে পারে পুরোটাই তাঁর বার্ধক্যর কারণে ঘটেছে। তাঁর অনিদ্রা আর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়া, সবই স্বাভাবিক কারণে হতে পারে। আর ওঁর দেখা ওই দৃশ্যটা যে ওঁর অন্তরের পুরোনো ব্যথার কারণে দেখেছেন তা আমি নিশ্চিত। ওই দৃশ্য ওঁর অতীতের সঙ্গে যুক্ত।

—কীরকম?

চাণক্য উঠে দু-পাত্র খেজুরের রস ঢেলে, এক পাত্র শিষ্যর দিকে এগিয়ে দিয়ে অন্য পাত্র নিজে নিয়ে বসলেন। বললেন,

—ওঁর অতীতের কিছু ঘটনা আছে যা তুমি জানো না। আমি জানি। যৌবনকালে তিনি পড়াশোনা করতে নিজের পরিবার ছেড়ে এখানে চলে আসেন। পরিবারের আপত্তি তিনি শোনেননি। কিন্তু ওঁর অবর্তমানে ওঁর দেশের গ্রামে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। তাতে ওঁর স্ত্রী এবং মেয়ের মৃত্যু হয়। এরপর থেকে সারাজীবন তিনি নিজেকে এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করে এসেছেন। আচার্যপ্রমুখ বিশ্বাস করেন যে তিনি যদি নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষার তাগিদে পরিবারকে ত্যাগ করে না আসতেন, তবে হয়তো তাদের মৃত্যু থেকে বাঁচাতে সক্ষম হতেন। ওঁর দেখা দৃশ্যে, ওঁরই হাতের প্রদীপের আগুন থেকে তাঁর পরিবারের শরীরে আগুন লাগে। এটা বৃদ্ধর মনের গভীরে লুকোনো গভীর অনুতাপের নিদর্শন। আমার মতে এটাই তাঁর দেখা ভয়ানক সেই দৃশ্যর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা।

—বেশ। আপনার যুক্তি আমি মানছি। কিন্তু তক্ষশিলায় ঘটে চলা সমস্ত বিষয়টাই শুধুমাত্র রটনা আর জনশ্রুতি এটা আমি মানতে পারছি না।

দু-চুমুক রস পান করে তৃপ্তির স্বরে আচার্য বললেন,

—আমি একবারও বলছি না যে সেটাই ঠিক ব্যাখ্যা। আমি শুধুমাত্র সম্ভাবনার কথা বলছি। তা ছাড়া, আমারও ধারণা বিষয়টা এতটা সরল নয়। বললাম না? আমার মনে হয় সম্পূর্ণ রহস্য এখনও আমাদের সামনে আসা বাকি।

—আপনার এরকম মনে হওয়ার কারণ?

—বিশেষ কারণ নেই। এটা আমার স্বজ্ঞা বা একটা অনুভূতি। আরও একটা সম্ভাবনা আছে। প্রবল সম্ভাবনা আছে।

—কী সম্ভাবনা?

—হতে পারে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকের ওপরেই মাদকের প্রভাব পড়েছে। এবং সেটা করা সম্ভব একমাত্র খাবার অথবা পানীয় জলের মাধ্যমে।

—সেটা নিশ্চিত করার উপায়?

—তোমায় কষ্ট করে আবার গুপ্তচরবৃত্তি করতে হবে।

—কোথায়?

—প্রধান পাকশালায়। কালকেই আমি আচার্য প্রমুখর সুপারিশে তোমায় সেখানকার কর্মী হিসেবে নিযুক্ত করব। তোমার কাজ হবে কয়েক দিন নজরদারি করা। কোনো সন্দেহজনক ব্যক্তি খাবারে কোনো অজানা কিছু জিনিস মিশিয়ে দিচ্ছে কি না তার ওপর নজর রাখা।

—বেশ। আর জলের বিষয়টা?

—প্রতিটা পানীয় জলের জন্যে ব্যবহৃত কুয়োর ওপর গোপনে নজর রাখবে আমাদের সঙ্গে আসা মগধের সৈনিকরা। সাধারণ কর্মীদের বেশে তারা এই কাজ করবে।

—উত্তম প্রস্তাব।

—হ্যাঁ, এতে আমরা…

কথার মাঝপথে বাধা পড়ল কারণ বাইরে থেকে একজনের ডাক শোনা গেল,

—আচার্য চাণক্য?

হাসিমুখে চাণক্য উত্তর দিলেন,

—আচাৰ্য দধিচ! আসুন, আসুন। আমি জানতাম আপনি আসবেন নিশ্চয়ই। ঘরে ঢুকলেন চাণক্যরই সমবয়সি একজন মানুষ। ভারী চেহারা, উঁচু নাক। ওঁর সঙ্গেই ভেতরে ঢুকলেন আরও একজন। ইনিও স্থূলকায়, দীর্ঘাঙ্গি, প্রসন্নচিত্ত মুখাবয়ব। দু-জনেরই বেশ এবং ন্যাড়া মাথা—টিকি থেকে বোঝা যায় এঁরা দু-জনেই ব্রাহ্মণ এবং এখানকার আচার্য।

চাণক্য দ্বিতীয় ব্যক্তিকে দেখে বললেন,

আচার্য বুধাদিত্য! স্বাগতম। আসুন আসুন, আচার্যগণ। এত বছর পর আপনাদের সাক্ষাৎ পেয়ে আমি আপ্লুত।

দু-জনে আসন গ্রহণ করলেন। আচার্য বুধাদিত্য কপট ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন,

—আমরা মোটেই আপনার ওপর প্রসন্ন নই, আচার্য চাণক্য। আপনি এসেছেন তিন দিন হয়ে গেল। অথচ এই পুরোনো সহকর্মীদের সঙ্গে একবারও দেখা করতে এলেন না।

—বন্ধুরা, আমায় ক্ষমা করবেন। আমি আসার পর থেকে একদিনও অবসর পাইনি। আমি আপনাদের সঙ্গে প্রথম সুযোগেই দেখা করতে অবশ্যই যেতাম। আমি সত্যি ক্ষমাপ্রার্থী। আপনারা কি এক পাত্র করে খেজুরের রস পান করতে ইচ্ছুক? খুব সুস্বাদু এই রস।

আচার্য দধিচ বললেন,

—আহা। হয়েছে, হয়েছে। আপনার এই অত্যধিক মধু-দ্রব্য প্রীতি এত বছরেও ক্ষীণ হয়নি দেখছি। আগে বলুন এই তরুণ ব্রাহ্মণটি কে?

কৌতুক মিশ্রিত স্বরে চাণক্য বললেন,

—ভালো করে দেখুন তো কে? চিনতে পারছেন না?

—না তো।

জীবসিদ্ধি এগিয়ে তাঁদের প্রণাম করে বলল,

—আচার্যগণ, আমি জীবসিদ্ধি।

—জীবসিদ্ধি! সে কী? এ কী বেশ? তুমি তো ব্রাহ্মণবেশ ধরেছ দেখেছি।

—আজকাল এইটাই আমার বেশ, আচার্য।

—ভালো, ভালো। আয়ুষ্মান ভবঃ। এত বছর বাদে তোমাদের দেখা পেয়ে খুবই ভালো লাগল।

আচার্য বুধাদিত্য বললেন,

—আচার্য চাণক্য, আমরা কিন্তু একটা বিশেষ নিবেদন নিয়ে এসেছি।

—বলুন কী করতে পারি আমি আপনাদের জন্যে?

—আপনাকে অন্তত সপ্তাহে এক বা দু-দিন আমাদের ছাত্রদের সময় দিতে হবে।

এই কথার সমর্থন করলেন আচার্য দধিচ,

—হ্যাঁ, আচার্য চাণক্য। আমরা ছাত্রদের আপনার কাহিনি বহুবার শুনিয়েছি। তারা আপনাকে চাক্ষুষ করতে এবং আপনার থেকে জ্ঞান লাভ করতে অত্যন্ত উদগ্রীব। আমি চাই না তারা এমন সুবর্ণ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হোক। আমরা চাই আপনার জ্ঞান, আপনার জীবনদর্শন এবং যুগান্তকারী ভাবনা আপনি ছাত্রদের সঙ্গে ভাগ করে নিন।

প্রণাম জানিয়ে চাণক্য বললেন,

—আমায় এই সুযোগ করে দেয়ার জন্যে আপনাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আশা করি আগামী কয়েক দিনে সেই অবসর আমি পাব। আগামী কয়েক দিন আমার বিশেষ কাজ নেই। কাজ প্রধানত জীবসিদ্ধির।

১১.

পরের কয়েকটা দিন উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটল না। জীবসিদ্ধি পাকশালায় নজরদারি করে আর বাকি সৈনিকরা ব্যবহৃত জলের কুয়োগুলোর রাতের বেলা এসে তারা শুধু চাণক্যকে খবর দিয়ে যায়। কিন্তু এখনও অবধি উল্লেখযোগ্য কিছুই তাদের কারুরই নজরে পড়েনি। চাণক্য তাদের আরও দিন পনেরো নজরদারি চালিয়ে যেতে বলেছেন। চাণক্য সেই বইটা পড়া শুরু করেছেন। মূল ক্রিয়া অবধি পৌঁছোতে এখনও সময় লাগবে। অনেক পাতা সেই পুথিটাতে। তবে এর থেকে বিশেষ কিছু খুঁজে পাওয়ার আশা চাণক্য রাখেন না। তিনি যতদূর বুঝতে পারছেন এগুলো সমস্ত অদ্ভুত উন্মাদের প্রলাপ লেখা। বিশ্বাসযোগ্য বা বিজ্ঞানসম্মত কোনো তথ্য এখানে লেখক দেননি। এইসব লেখা কিশোরদের আকৃষ্ট করে নিঃসন্দেহে, কিন্তু তাঁকে নয়। তিনি বার বার পড়তে গিয়ে ধৈর্য হারাচ্ছেন।

এর মাঝে শুধু মগধ থেকে একটা চিঠি এসেছে। চিঠির বক্তব্য এইরকম,

প্রিয় জীবসিদ্ধি,

তোমাদের কুশল সংবাদ পেয়ে নিশ্চিন্ত হলাম। তোমার চিঠিতে তক্ষশিলার এরকম আশ্চর্যজনক পরিস্থিতির কথা শুনে হতবাক হয়েছি। আমার ধারণা এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে দুর্নাম ছড়িয়ে দেয়ার চক্রান্ত। আমি বিশ্বাস রাখি আচার্য এবং তুমি খুব তাড়াতাড়িই এই সমস্যার সমাধান খুঁজে পাবে।

এদিকেও সব কুশল আছে। আচার্যকে জানিয়ে দিয়ো যে আমরা লুণ্ঠিত হওয়া স্বর্ণমুদ্রা ফিরে পেয়েছি। যদিও দস্যুরা ধরা পড়েনি। যেরকম ভেবেছিলাম তাই ঘটেছে, সেই স্বর্ণমুদ্রা রাজকীয় সম্পত্তি বুঝতে পেরে তারা আর সেটা ব্যবহার করতে পারেনি। পুরোটাই কয়েক দিন আগে, লুকিয়ে এক সৈনিক শিবিরের দরজায় রেখে দিয়ে গেছিল। অতএব, আচার্যকে এই নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করা থেকে বিরত থাকতে বোলো। ওদিকের খবর দূত মারফত দিতে থেকো।

শুভেচ্ছা রইল।

ইতি,
চন্দ্ৰগুপ্ত।

এদিকে আচার্য চাণক্য ছাত্রদের মধ্যে সময় কাটাতে শুরু করেছেন। অনেক বছর পর নিজেকে আবার আগের মতো শিক্ষকের ভূমিকায় ফিরে পেয়ে তিনি নিজেও প্রফুল্ল। চাণক্য এই মুহূর্তে বসে আছেন আচার্য বুধাদিত্যর আশ্রমের প্রাঙ্গণের একটা বটগাছের তলায়, বাঁধানো বেদিতে। তাঁর সামনে বসে আছে এক ঝাঁক তরুণ ছাত্র।

—বিদ্যা। বিদ্যা কী? প্রয়োজনই-বা কী বিদ্যালাভ করার?

ছাত্রদের দিকে চোখ বুলিয়ে নিজেই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ভঙ্গিতে বললেন চাণক্য,

—নির্ধনের একমাত্র ধন হল বিদ্যা। বিদ্যা হল এ যুগের কামধেনুস্বরূপ।* যে সম্পদ, তোমার থেকে কোনোদিন চোরও চুরি করতে সক্ষম হবে না, সেই সম্পদ হল বিদ্যা। সংকটের সময় যদি সব বন্ধু তোমার সঙ্গ ত্যাগ করে, তবু যে চিরসঙ্গী কখনো তোমায় ছেড়ে যাবে না, সেই বন্ধু হল বিদ্যা। একজন মূর্খর জন্যে একটা বইয়ের ততটাই উপযোগিতা আছে, যতটা একজন অন্ধর কাছে আয়নার। পৃথিবীতে একমাত্র মূর্খ ব্যক্তিই বিদ্যার মূল্য বোঝে না।

মনে রাখবে, ঠিক যেভাবে একটা ফুল তার চারপাশে সুগন্ধ ছড়িয়ে দেয়, সেভাবেই একজন জ্ঞানী ব্যক্তি তার আশেপাশের মানুষের মধ্যেও জ্ঞানের জ্যোতির সঞ্চার করে। শিক্ষা বিনা উচ্চকুল, যৌবন, সৌন্দর্য সবই বৃথা অনেকটা পলাশ ফুলের মতো, তা দেখতে তো সুন্দর কিন্তু সুগন্ধ ছড়িয়ে দিতে অক্ষম।** তাই মূর্খর সঙ্গ ত্যাগ করো এবং জ্ঞানীর সঙ্গ নাও। এতেই উন্নতি। এই জগতে জ্ঞান হল সবথেকে শ্রেষ্ঠ সম্পদ এবং ঠিক মুহূর্তে, ঠিক ব্যবহারে সেটাই সর্বশ্রেষ্ঠ অস্ত্র।

এর পরের দিনের জন্যে তোমাদের আমি একটা বিষয় ভাবতে বলব। সাফল্যর মূলমন্ত্র কী? আমি চাই আগামী কয়েক দিন তোমরা এই বিষয় নিয়ে ভাবনাচিন্তা করো। পরের সাক্ষাতে আমি তোমাদের প্রত্যেকের মতামত শুনব। ঠিক আছে?

ছাত্ররা উঠে দাঁড়িয়ে চাণক্যেকে প্রণাম জানিয়ে একে একে চলে যেতে থাকল। তখনই আশ্রমের দিক থেকে আচার্য বুধাদিত্যর আওয়াজ শোনা গেল,

—সাধু সাধু! আমি নিশ্চিত যে ইতিহাসের পাতায় আপনার এই বচনগুলো লেখা থাকবে এবং যুগ যুগ ধরে মানুষকে পথ নির্দেশ করবে।

মৃদু হেসে চাণক্য বললেন,

অনেক ধন্যবাদ, আচার্য।

হঠাৎ কিছু একটা যেন মনে পড়ে যাওয়ায় আচার্য বুধাদিত্য বেরোতে থাকা ছাত্রদের উদ্দেশে ডাক দিলেন,

—ওহে! সত্যকাম।

একজন ছাত্র পেছন ফিরে চাইল। তাকে বুধাদিত্য বললেন,

—তুমি অপেক্ষা করো। তোমার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে। বাকিরা যেতে পারো।

‘কঠোর গুরু’ হিসেবে আচার্য বুধাদিত্যর খ্যাতি আছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাই তাঁর তলব পেয়ে ছাত্রটি যারপরনাই আতঙ্কিত হয়েছে। তার মুখের অভিব্যক্তি এবং দৃষ্টি দেখলেই তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ছাত্রটি এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল,

—আজ্ঞে, আচার্য?

—তোমার ঘরে সুগন্ধি তেল এল কোথা থেকে?

চমকে উঠল ছাত্রটি। বিদ্যার্থীদের এইখানে প্রায় সন্ন্যাস জীবন কাটাতে হয়। এটাই নিয়ম। অতএব, কোনোরকম প্রসাধনী বা অপ্রয়োজনীয় জিনিস তাদের সঙ্গে রাখা নিষেধ।

আচার্য বুধাদিত্য আবার প্রশ্ন করলেন,

—বলো! চুপ করে থেকো না। উত্তর দাও। এই তেল তোমায় কে এনে দিয়েছে? তুমি জানো না যে শৃঙ্গার সামগ্রী ছাত্রদের জন্যে নিষিদ্ধ?

ভয়ে চোখ না তুলেই ছাত্রটি বলল:

—আমায় ক্ষমা করবেন, আচার্য। ওই সুগন্ধি আমি ফেলে দেব।

—কে এনে দিয়েছে আগে সেটা বলো। কাউকে আড়াল করার চেষ্টা কোরো না।

—কেউ এনে দেয়নি, আচার্য। ওটা… ওটা আমি নিজেই খুঁজে পেয়েছি।

—অসত্য বলছ তুমি! এই তেল মূল্যবান। খুঁজে পেয়েছ মানে কী?

—আমি সত্যি বলছি, আচার্য। আমি ওটা বাইরে থেকে আনাইনি।

—কোথা থেকে পেয়েছ তবে? তবে কি তুমি চুরি করেছ? কোনো আচার্য বা কর্মীর জিনিস চুরি করেছ? শেষে চৌর্যবৃত্তি?

ছাত্রটি এইবার কেঁদে ফেলল,

—না, আচার্য! আপনি বিশ্বাস করুন, আমি দোষ করিনি। ওটা আমি উত্তরের জঙ্গলে একটা খাদের থেকে পেয়েছি।

—কোথা থেকে?

—আমরা কয়েক সপ্তাহ আগে ওদিকে খেলছিলাম। তখনই সুশীল খাদের ভেতর জঙ্গলে একটা পেটি পড়ে থাকতে দেখে। আমরা কৌতূহলী হয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে সেটা তুলে আনি। তাতেই এই সুগন্ধি তেলটা পাই।

—সে কী? একথা আগে তো বলোনি। আমায় বলা উচিত ছিল। তার থেকে আর কী কী নিয়েছিলে তোমরা?

—আচার্য, আমি শুধু ওটাই নিয়েছিলাম। ওতে কিছু ভালো পোশাকও ছিল। কিন্তু সেগুলো সবই কোনো বড়ো মানুষের। তাই সেগুলো আমরা আর নিইনি। কয়েকটা বই, আতর, আরও কিছু সামান্য জিনিস ছিল, সেগুলো আমরা নিজেরা রেখে দিই।

—খুব অন্যায় করেছ। চুরি করনি বলে এবারের মতো ছেড়ে দিলাম কিন্তু সেই পেটি থেকে নেয়া প্রতিটা জিনিস আমায় দিয়ে যাবে। তোমার বন্ধুদেরও তাই করতে বলবে। বুঝেছ?

—তাই হবে, আচার্য। আমি ক্ষমাপ্রার্থী। বেশ।

—এবার তুমি আসতে পারো।

ছাত্রটি চলে যাচ্ছিল। কিন্তু আবার বাধা পেল।

—দাঁড়াও।

এইবার তাকে আটকেছেন আচার্য চাণক্য। চাণক্যর কপালে ভ্রূকুটি। বললেন,

—ওই পেটি কি তোমার কাছে আছে?

—না, আচার্য। আমরা তো ওটা ওখানেই ফেলে এসেছি।

—আমায় সেই জায়গাটা দেখাতে পারো?

কিশোরটি বেশ অবাক হয়েছে। আচার্য বুধাদিত্যও অবাক হয়েছেন বটে। হঠাৎ

একটা পরিত্যক্ত পেটি নিয়ে চাণক্যর এরকম কৌতূহলের ব্যাখ্যা তিনি পাচ্ছেন না।

চাণক্য আবার প্রশ্ন করলেন,

—বলো? আমায় নিয়ে যেতে পারবে সেখানে?

—হ্যাঁ। অবশ্যই, আচার্য।

—তবে এখনই নিয়ে চলো দেখি।

ছেলেটা আরও হতভম্ব হল। আচার্য বুধাদিত্য কিছু একটা বলতে গিয়েও বললেন না। কারণ চাণক্যর মুখের ভাব গম্ভীর। ছাত্রটি বলল:

—বেশ, আসুন আমার সঙ্গে, আচার্য।

.

বেশ কিছুটা পথ হাঁটার পর চাণক্য এবং বুধাদিত্য ছাত্রটির সঙ্গে নির্দিষ্ট জায়গায় এসে পৌঁছোলেন। খাদের একটু নীচে একটা কাঠের পেটি দেখা যাচ্ছে। সঙ্গে আনা দড়ির মাথায় পাথর বেঁধে, দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় নীচের ওই পেটির হাতলে ফাঁস লাগল। সেটা টেনে তুলতে তিনজনের খুব বেশি অসুবিধে হল না। ছাত্রটির কথা মতোই, সেটা খুলে বিশেষ কিছু পাওয়া গেল না। পোশাক, এক জোড়া পুরোনো জুতো, কয়েকটা নথি ইত্যাদি পোশাকগুলো আর পেটির অবস্থা দেখে অনুমান করা যায় যে বেশ অনেক মাস ধরে এগুলো এখানে পড়ে। যদিও কাপড়ের ভাঁজ এখনও স্পষ্ট। অর্থাৎ, এগুলো মোটেই পুরোনো বা ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র নয়। কিছু ভূর্জপত্র তাতে আছে। যদিও লেখা অস্পষ্ট। কিন্তু এইটুকু বোঝা যায় এগুলো জীববিদ্যা ও রসায়নের ওপর লেখা কোনো নথিপত্র। পেটির ঢাকনা বন্ধ করে চাণক্য উঠে দাঁড়ালেন। দু-হাত থেকে ধুলো ঝাড়লেন। ওঁর কপালে গভীর ভ্রূকুটি। মুখে চিন্তিত ভাব স্পষ্ট। বুধাদিত্য প্রশ্ন করলেন,

—কী হয়েছে, আচার্য চাণক্য? এই ফেলে দেওয়া পেটিটাকে নিয়ে আপনি এত চিন্তিত কেন?

চাণক্য প্রশ্নটা শুনতে পেয়েছেন বলে মনে হল না। শুধু নিজের মনেই বললেন,

—আচার্য বিন্দাচল মনে হয় তক্ষশিলা ছেড়ে যাননি।

*চাণক্যনীতি- ৪.৫, **চাণক্যনীতি- ৩.৮

১২.

সেইদিন রাতের দিকে, চাণক্যর ঘরে চাণক্য জীবসিদ্ধির সঙ্গে আলোচনারত।

—এই জিনিসপত্র যে আচার্য বিন্দাচলেরই, সেই বিষয়ে আপনি নিশ্চিত হচ্ছেন কীভাবে, আচার্য?

—ইঙ্গিত তাই পাওয়া যাচ্ছে না কি?

—কিন্তু তাঁর পেটি হঠাৎ তিনি ফেলে দিয়ে উধাও হবেন কেন? সেগুলো নিজের বাড়িতে রেখে না গিয়ে, সঙ্গে নিলেন। তারপর আবার ফেলে দিলেন?

—হুমম। সম্ভবত এই কাজটা করা হয়েছে, সবাইকে এই ধারণা দিতে যে তিনি এখানকার অধ্যাপনা ছেড়ে জিনিসপত্র নিয়ে চলে গেছেন। সব ছেড়ে তিনি উধাও হলে লোকের সন্দেহ হত।

—কিন্তু তারপর সেগুলো ফেলে দেবেন কেন? আপনি কি সন্দেহ করছেন তিনি এখানকার এইসব ঘটনার সঙ্গে যুক্ত?

—সবই সম্ভাবনা। হয়তো তিনি আচার্যর বেশ ছেড়ে, অন্য কোনো ছদ্মনাম ও ছদ্মপরিচয়ে গত এক বছর ধরে লুকিয়ে আছেন। আবার অন্য একটা সম্ভাবনাও আছে।

—কী সম্ভাবনা?

—নিজেই ভেবে দেখো। আমি বলব না।

জীবসিদ্ধিকে কিছুটা বিমর্ষ দেখাল। চাণক্য তাকে প্রশ্ন করলেন,

—ওহে জীবসিদ্ধি, তোমার শরীর সুস্থ আছে তো? পাকশালায় গুপ্তচরের কাজে কি খুব বেশি পরিশ্রম হচ্ছে নাকি?

—না, আচার্য। তা নয়। তবে সামান্য মাথাব্যথা আছে। সম্ভবত কাল বৃষ্টিতে ভেজার ফল।

—হুমম। তুমি এইবার ওই পাকশালার কাজটা বন্ধ করতে পারো। খাবারে যে কিছু সমস্যা নেই তা তো প্রায় নিশ্চিত। আর লাভ নেই নজরদারি চালিয়ে।

—বেশ। তাই হোক। তাহলে আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী?

—একবার আচার্য বিন্দাচলের বাড়ি আর গবেষণাগারটা পরীক্ষা করে দেখতে চাই। ওটার তত্ত্বাবধান তো এখন জীববিদ্যার নতুন আচার্য এবং বাসব করছে। তাই না?

—বাসব তো তাই বলল।

—তবে তো সহজেই একবার পরীক্ষা করা যায়। বাসবকে কালকেই সেখানে একবার নিয়ে যেতে বলব।

.

তখনই বাইরে থেকে কেউ দরজায় করাঘাত করল। চাণক্য দরজার দিকে চেয়ে বললেন,

—এত রাত্রে আবার কে এল?

.

জীবসিদ্ধি গিয়ে দরজা খুলে দিতে একজন অপরিচিত ব্যক্তিকে দেখা গেল। হাতে মশাল। দৌড়ে আসার কারণে হাঁফাচ্ছে। লোকটা বলল:

—আচার্য চাণক্য?

ভেতর থেকে চাণক্য উঁকি দিলেন,

—বলুন?

—আচার্য, আমি আয়ুরালয় থেকে আসছি। প্রধানাচার্য আপনাকে খবর দিতে বললেন। এক ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে।

—সেকী? কাকে? কখন ঘটল?

—কিছুক্ষণ আগেই। ছাত্রর নাম সুনাভ। আপনারা কি অনুগ্রহ করে আসবেন একটিবার?

—হ্যাঁ। অবশ্যই।

.

ভৃত্যর সঙ্গে দু-জনে এসে পৌঁছেছে আয়ুরালয়ে। সর্বক্ষণ শান্ত থাকা আয়ুরালয়তে এই মুহূর্তে কোলাহল চলছে। ভেতরে ঢুকে সুনাভর ঘরে পৌঁছে চাণক্য দেখলেন স্বয়ং প্রধানাচার্য ভদ্রভট্ট দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁদের দিকে করুণ দৃষ্টিতে চাইলেন। ভেঙে পড়েছেন বৃদ্ধ। সামনে পড়ে আছে সুনাভর দেহ। চোখ খোলা, হাত-পা বাঁধা, মুখে আতঙ্কিত দৃষ্টি। প্রথম দৃষ্টিতে শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখা যায় না, তবে চাণক্য সামনে গিয়ে দেখলেন তার শ্বাসনালির জায়গায় নীলচে আঘাতের চিহ্ন। কেউ প্রচণ্ড আঘাত করেছে তার গলায়। আর তাতেই গলার তরুণ-অস্থি* ভেঙে কিশোরটির মৃত্যু হয়েছে। আচমকা চাণক্য ঘর থেকে বেরিয়ে দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। চারটে ঘর পরেই পুষ্পলের ঘরে ঢুকলেন।

তারও হাত-পা বাঁধা। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। মুহূর্তের আশঙ্কায় চাণক্যর হৃদয়ের গতি বেড়ে গেছিল, কিন্তু পরক্ষণেই পুষ্পলের বুক ওঠা-নামা করতে দেখে ওঁর বুক থেকে একটা পাথর নেমে গেল। বেরিয়ে এসে ডাক দিলেন আয়ুরালয়ের কর্মীদের। তিন জন এগিয়ে এল। তাদের উদ্দেশে বললেন,

—এই ঘরে সর্বক্ষণ অন্তত দু-জন পাহারায় থাকবে। এই মুহূর্ত থেকে কোনো অজানা মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হল। মনে রেখো, এই ছাত্রর প্রাণ বিপন্ন

তাদের পাহারায় রেখে তিনি ফিরে এলেন সুনাভর ঘরে। চাণক্য মৃতদেহর দিকে এগিয়ে গিয়ে তার খোলা চোখ বন্ধ করে দিলেন। সেখানে উপস্থিত আয়ুরালয়ের দুই কর্মীর উদ্দেশে বললেন,

অনুমান করতে পারি, রাতে এই ছাত্রদের মধ্যে চাঞ্চল্য বাড়ে বলে প্রতি রাতে আপনারাই তাদের হাত-পা বেঁধে রাখেন। কিশোরটি মৃত্যুর আগে, তার হত্যাকারীকে দেখে আর্তনাদ করেছিল। কিন্তু আপনারা সেটাকে রোজকার উন্মাদনা ভেবে কেউ দেখতে আসেননি। তাই না?

দু-জন মাথা নীচু করল। চাণক্য আবার তাদের উদ্দেশে বললেন,

—ওপরের তলায়, কয়েক দিন আগে পর্যন্ত পুষ্পল ছিল। বর্তমানে সেই ঘরে কেউ আছে?

একজন না জানলেও অন্যজন বলল:

—না, আচার্য। বর্তমানে সেই ঘরে কেউ নেই।

—হুমম। যাক।

চাণক্য আরও একবার ঝুঁকে পড়লেন মৃতদেহর ওপর। গলার আঘাতটা ভালোভাবে পরীক্ষা করলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। এগিয়ে গিয়ে প্রধানাচার্যকে বললেন,

—চলুন, আচার্য প্রমুখ। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই।

—এ কোন অভিশাপ লাগল এই বিদ্যামন্দিরে? কোন অপদেবতার অশুভ দৃষ্টি পড়ল আমাদের ওপর?

—অভিশাপের বিষয়ে আমি বলতে পারব না। তবে এই কাণ্ডটা কোনো অপদেবতার কাণ্ড নয়, এ ব্যাপারে নিশ্চিত। আমি আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী আচার্য-জ্যেষ্ঠ। আমি সত্যি এই হত্যাকাণ্ডর কোনো পূর্ব আশঙ্কা করিনি। এটা আমার দোষ।

.

বেরিয়ে এসে জীবসিদ্ধি প্রত্যেককে করণীয় কী, তা বুঝিয়ে দিল। কাল সকালে এখানকার ন্যায়রক্ষী শিবিরে খবর দিতে হবে। এটা হত্যা, সরকারি পক্ষ থেকে তদন্ত হবে।

সেই রাতের মতো কর্তব্য মিটিয়ে, বৃদ্ধ প্রধানাচার্যকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ফেরত পাঠিয়ে নিজেদের পথ ধরলেন চাণক্য এবং জীবসিদ্ধি। কিছুক্ষণ দু- জনেই কিছু বললেন না। চুপচাপ পথ চললেন। অন্ধকার পথ, দূরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে স্থাপত্য এবং স্তূপ। আজকে আকাশে মেঘ, তাই অন্ধকার চারিদিক। একটা মশাল হাতে জীবসিদ্ধি সামনের পথ কিছুটা আলোকিত করে চলছে চাণক্যর পাশাপাশি। একটা গাছে কোনো এক রাতপাখি করুণ স্বরে ডেকে উঠল। অকারণে যেন সেই শব্দে চমকে উঠল জীবসিদ্ধি। বহু বছরের চেনা এই পথ, এই গাছ, এই পরিবেশ। তবু এই পরিস্থিতিতে সব কেমন যেন অচেনা লাগছে তার। এই নিস্তব্ধতা অসহ্য লাগছে জীবসিদ্ধির। নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করতেই প্রশ্ন করল জীবসিদ্ধি,

—আচার্য, কী ভাবছেন?

সঙ্গেসঙ্গে উত্তর দিলেন না চাণক্য। একটু দেরি করে উত্তর দিলেন,

—একটা রহস্যর রেশ কাটতে-না-কাটতেই আরও একটা রহস্য এসে হাজির হচ্ছে। এই ছাত্রদের ওপর কে হামলা করতে পারে এই মুহূর্তে আমি ভেবে পাচ্ছি না।

—ছাত্রদের?

—পুষ্পলকেও আজ হত্যা করা হত আমি নিশ্চিত। তার ঘর পরিবর্তন হওয়াতে সে বেঁচে গেল।

—তার মানে তৃতীয় ছাত্র, অর্থাৎ কুমারেরও প্রাণহানির আশঙ্কা আছে?

—অবশ্যই। আগামীকাল সর্বপ্রথম তাকে জানিয়ে সতর্ক করতে হবে। অতিথি-নিবাস এসে গেছে। চাণক্য জীবসিদ্ধিকে বললেন,

—ঘুমিয়ে পড়ো হে, জীবসিদ্ধি। তোমার চোখে অনিদ্রার চিহ্ন দেখছি। কাল থেকে আর পাকশালায় যেতে হবে না। তুমি বোধ হয় একটু বেশিই দুশ্চিন্তা করছ।

জীবসিদ্ধি একটু ইতস্তত করে বলল:

—রাতে ঘুম আসতে সামান্য অসুবিধা হচ্ছে বটে

—বেশ। দুশ্চিন্তা বাদ দাও। ওটা গুরুর ওপর ছাড়ো হে। শুভরাত্রি।

—শুভরাত্রি, আচার্য।

দু-জন নিজের নিজের দরজার তালা খুলে ভেতরে ঢুকলেন। ঢুকেই চাণক্য ডাক দিলেন,

—জীবসিদ্ধি!

জীবসিদ্ধি নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আবার চাণক্যর দরজায় ফিরে এল,

—বলুন, আচার্য।

চাণক্য দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছেন। ঘরে একটা প্রদীপ জ্বলছে। তাতেই আলো হয়ে আছে কিছুটা। চাণক্য তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঘরের চারিদিকে দেখছেন। জীবসিদ্ধি আবার প্রশ্ন করল,

—কী হয়েছে, আচার্য?

তার দিকে না তাকিয়েই চাণক্য বললেন,

—আমার ঘরে কেউ ঢুকেছিল। জানলা খোলা, দেখো।

—সে কী? আপনি নিশ্চিত?

—হুমম।

—চোর? কিছু তো নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। সব জায়গামতো আছে।

—নিয়েছে। একটা জিনিস তার জায়গায় নেই।

—কোন জিনিস?

শান্ত স্বরে জবাব দিলেন চাণক্য,

—ওই তন্ত্র বইটা!

* গ্রীবা neck region, তরুণঅস্থি – cartilage [ref. 14]

১৩.

চাণক্য প্রথমেই ঘরের কোনায় গিয়ে বিন্ধ্যাচলের পুরোনো কাঠের পেটিটা খুলে দেখলেন। কিছুক্ষণ ভালো করে প্রতিটা জিনিস দেখে উঠে দাঁড়ালেন।

—আমার প্রথমেই সন্দেহ হয়েছিল এইটা থেকে হয়তো কোনো জিনিস চুরি যাবে। কিন্তু এটা যেমন রেখে গেছিলাম সেরকমই আছে। চুরি গেছে শুধু ওই পুথিটা। ওই চারপায়ার ওপরেই রেখেছিলাম। এখন নেই সেটা।

—ওই বই আপনি কতটা পড়েছিলেন?

—বেশিটা নয়। সামান্যই। আশ্চর্য লাগছে আমার। ওই বইয়ে যে গুরুতর কিছু থাকতে পারে আমার একবারও সেটা মনে হয়নি। ওটা অতি নিম্নমানের অলৌকিক মনগড়া তন্ত্র-মন্ত্র লেখা বই বলেই আমার ধারণা হয়েছিল। এই পুরো ঘটনায় ওটার যে কোনো বিশেষ কার্যকারিতা নেই, সেটা আমি প্রায় নিশ্চিত ছিলাম।

—কিন্তু সেই বই চুরি হয়েছে যখন, তার নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।

চাণক্য নিজের আসনে বসলেন। প্রদীপের শিখার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলেন। ভাবছেন কিছু। তারপর ঘাড় নেড়ে বললেন,

—আজকে রাতে সব কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটছে। প্রথমে ওই ছাত্রটিকে হত্যা করা হল, আর তারপর আমার নিজের ঘর থেকে বইটা চুরি গেল। আমার ভাবনায় কোথাও ভুল হয়ে গেছে, জীবসিদ্ধি। নিজেকে খুব মূর্খ মনে হচ্ছে

জীবসিদ্ধি কী উত্তর দেবে ভেবে পেল না। সে নিজেও একটা আসনে বসল। বলল:

—সুনাভ নামের ছাত্রটির জন্যে সত্যি হৃদয় ব্যথিত হচ্ছে।

—হুমম। কতটা ভয়ংকর, ভাবো জীবসিদ্ধি। তাকে এবং পুষ্পলকে রাতে আয়ুরালয়ের কর্মীরাই হাত-পা বেঁধে রাখছে, যাতে তারা নিজেদের শরীরে কোনো আঘাত করতে না পারে। ব্যাপারটা যতই নির্মম মনে হোক, এই পরিস্থিতিতে এইটাই একমাত্র উপায়। তাদেরই মঙ্গলের জন্যে এটা করা হচ্ছিল। এদিকে সেই সুযোগ নিয়েই হত্যাকারী অতি সহজে তাকে হত্যা করল। বেচারা নিজের চোখে বিপদ আসতে দেখেও বাধা পর্যন্ত দিতে পারল না। হত্যাকারীকে দেখে আর্তনাদ করল, সেটাও কর্মীরা রোজকার চিৎকার ভেবে কেউ আর সাহায্যর জন্যে এগিয়ে এল না।

—সেটাই। ভাবলেই মন ভারাক্রান্ত হয়ে আসছে। আচ্ছা আচার্য, আপনার কি বাসবকে সন্দেহ হয়?

উত্তরে চাণক্য পালটা প্রশ্ন করলেন,

—তোমার কি তাকে সন্দেহ হয়?

—হ্যাঁ, হয়। সে-ই তো জানত যে এই বই আপনার কাছে আছে।

—বাসব যে অন্য কাউকে একথা এতদিনে বলে দেয়নি সে-বিষয়ে নিশ্চিত হচ্ছ কীভাবে? আমার তো মনে হয় এতদিনে অর্ধেক তক্ষশিলা জেনে গেছে যে আমরা অনুসন্ধান করতে এসেছি এবং সেই বই আমার কাছে আছে। তা ছাড়া গ্রন্থাগারে কেউ তোমাদের নজর করেনি, সে-বিষয়ের নিশ্চয়তা কী?

—আপনি বাসবকে সন্দেহ করেন না তার মানে?

—না। তার কারণ, যদি তার এই বইটা আমাদের থেকে লুকানোরই হত, তবে সে প্রথমে আমাদের সেটা খুঁজে পেতে সাহায্য করত না।

—আর এই হত্যার ব্যাপারে? যদিও তার হত্যা করার কোনো কারণ থাকতে পারে বলে আমার মনে হয় না।

—না। হত্যাকারী হিসেবে বাসবকে কখনোই সন্দেহ করা যায় না। আমি নিশ্চিত যে হত্যাকারী আর যে-ই হোক, বাসব নয়। তার কারণ সহজেই অনুমান করা যায়। তুমি কি অনুমান করতে পারছ?

—না। আপনিই বলুন যে আপনি কীভাবে এত নিশ্চিত হচ্ছেন?

—তার কারণ এই ক্ষেত্রে পুষ্পলকে হত্যা করা হয়নি। হত্যাকারী জানত না যে পুষ্পলকে মাত্র কয়েক দিন আগেই দোতলার ঘর থেকে নীচে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। কিন্তু আমরা জানি যে বাসব সেটা জানত। বাসব নিজে আমাদের সুনাভ এবং পুষ্পলের ঘরে নিয়ে গেছিল। অতএব, বাসব হত্যাকারী হলে আজ শুধু সুনাভ নয়, পুষ্পলকেও হত্যা করা হত।

—অকাট্য যুক্তি, আচার্য।

—হুমম। কিন্তু আমার বড়োই অনুশোচনা হচ্ছে, জীবসিদ্ধি। ওই বইটা… ওটা যদি আমি আলস্য না করে এতদিনে পড়ে ফেলতাম, তবে হয়তো রহস্যর সমাধানের একটা সূত্র সহজেই পেতাম। কিন্তু এখন সেই সম্ভাবনা কম।

জীবসিদ্ধি কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। সেটা লক্ষ করে চাণক্য বললেন,

—কী বলতে চাও, বলো।

অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে জীবসিদ্ধি ধীরে ধীরে বলল,

—আচার্য, অশুভ বলে কি সত্যি কিছু নেই? আমাদের জানার বাইরে কি কিছুই নেই?

কী বলতে চাইছ স্পষ্ট করে বলো।

—আচার্য, এই তক্ষশিলায় আমার একটা অশুভ অনুভূতি হচ্ছে। আমার কেন জানি না নিজের ঘরে একা থাকলে মন ভারাক্রান্ত লাগে।

চাণক্যর কপালে ভ্রূকুটি দৃশ্যমান। প্রদীপের হলুদ আলোয় ওঁর জ্বলজ্বলে চোখ শিষ্যকে পর্যবেক্ষণ করছে। প্রশ্ন করলেন,

—জীবসিদ্ধি, আমায় সত্য বলো। গোপন করবে না। তুমি কি কিছু দেখেছ?

‘না’ সূচক ঘাড় নাড়ে জীবসিদ্ধি,

—না, আচার্য। আমি কিছুই দেখিনি। কিন্তু আমার ঘরে একা থাকলে সর্বক্ষণ মনে হয় কেউ যেন আমায় দেখছে। গোপনে আমার ওপর নজর রাখছে।

—ভয় লাগে?

—ভয় নয় ঠিক। কিছুটা বিষণ্ণ লাগে। একটা অশুভ অনুভূতিতে হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে আজকাল।

চকিতে উঠে দাঁড়ালেন চাণক্য। এগিয়ে গিয়ে বসলেন ঠিক জীবসিদ্ধির সামনে। নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,

—তোমার হাতটা দাও।

—হাত? কেন?

—দাও।

জীবসিদ্ধি চাণক্যর বাড়িয়ে দেয়া হাতে নিজের ডান হাতটা রাখল। চাণক্য জীবসিদ্ধির বুড়ো আঙুলের গোড়ায় আঙুল চেপে মনে মনে গুনতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পর হাত ছেড়ে বললেন,

নাড়ির গতি ও রক্তচাপ সামান্য বেশি। কাল সকালে আরও একবার দেখব। তবেই নিশ্চিতভাবে বোঝা যাবে।

আচার্য! আপনি কি সন্দেহ করছেন আমার শরীরেও মাদক জাতীয় কিছু প্রবেশ করানো হয়েছে? কিন্তু এ যে অসম্ভব!

—তুমি নিশ্চিত যে তুমি স্বপাক ছাড়া অন্য কোনো খাবার খাওনি?

—আমি নিশ্চিত! এই বিষয়ে আপনি আশঙ্কা প্রকাশ করার পর থেকেই আমি খুব সাবধান থেকেছি। খাবারের মাধ্যমে আমার শরীরে কিছুই ঢুকতে পারবে না। তবে হ্যাঁ… জল পান করেছি।

—না। জলে কিছু থাকলে, আমার শরীরেও তার লক্ষণ দেখা যেত। একই জল আমিও পান করছি। সৈনিকরাও সন্দেহজনক কিছুই দেখেনি এতদিনে।

—আচার্য, আপনার কোনোরকম অনুভূতি হচ্ছে না?

—না।

—তার মানে আপনি অভিশাপ, অপদেবতার বিষয়টা বিশ্বাস করছেন না?

—না। তার কারণ আছে, জীবসিদ্ধি।

—কী কারণ?

—এই কয়েক দিন আমি যে ছাত্রদের মাঝে সময় কাটিয়েছি, সেটা শুধুই তাদের নীতিকথা আর বাণী শোনাতে নয়। সময় সুযোগ মতো আমি তাদের থেকে এই ভয় পাওয়ার বিষয়টা জেনেছি। আর তার থেকেই একটা চমৎকৃত তথ্য উঠে এসেছে।

—কী তথ্য, আচার্য?

—এই ভয় আর বিষণ্নতার অনুভূতি অনেকের মধ্যেই, অনেক আগে থেকেই দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ কয়েক মাস আগে, সেই রাতে ওই চার জনের তন্ত্রক্রিয়া করার আগে থেকেই বেশ কয়েকজনের মধ্যে এই লক্ষণগুলো দেখা দিয়েছিল। কিন্তু বিষয়টা তারা নেহাতই মনের ভুল মনে করে চিন্তিত হয়নি। ওই রাতের ঘটনার পর ব্যাপারটা লোকমুখে বেশি ছড়িয়ে গেছে। মানবমন তাদের মনের সুপ্ত ভয়কে সেই কাণ্ডর সঙ্গে জুড়েছে মাত্র। নিজেদের মনে বাসা বেঁধে থাকা সুপ্ত ভয়কে অবলম্বন দিয়েছে মাত্র, চার ছাত্রর সেই তন্ত্রক্রিয়া।

—আপনি বলতে চাইছেন যে সেইদিন রাতের ঘটনার সঙ্গে, রোজকার এই ঘটনাগুলোর সম্পর্ক নেই?

—সেরকমই মনে হয়েছিল আমার। অন্তত সেই রাতের তন্ত্রক্রিয়াকে কখনোই এখানকার বাসিন্দাদের মনের ভয়ের, বা ভয়ানক দৃশ্য দেখার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। কিছু কিছু বাসিন্দা অনেক আগে থেকেই এই অনুভূতির শিকার হয়েছে।

—কিন্তু তাই যদি হবে আচার্য, তাহলে সুনাভকে কেন হত্যা করা হল? আর এই বইটাই-বা কী কারণে চুরি হল?

—ঠিক এই বিষয়টাই আমায় সবথেকে বেশি ভাবিত করছে। আমিও প্রায় নিশ্চিত ছিলাম যে ওই রাতের ঘটনাটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেই কারণেই আমার কাছে ছাত্রদের হত্যার চেষ্টা এবং এই বই চুরি হওয়াটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। এখন আমারও মনে হচ্ছে যে এই তন্ত্রক্রিয়ায় কিছু একটা রহস্য আছে। এবং সেটাই ভেবে বের করতে হবে।

—জটিল।

—হুমম। অত্যন্ত জটিল। তবে আমি তোমায় নিশ্চিত করে বলতে পারি জীবসিদ্ধি, যে, এটা কোনো অশুভ অপশক্তির কাজ নয়। এখানে যা ঘটেছে এবং যা ঘটছে তা অত্যন্ত সুকুশল কোনো মানব মস্তিষ্কের ষড়যন্ত্র। তাই মনে জোর রাখো, জীবসিদ্ধি।

—কিন্তু… কিন্তু আমার শরীরে মাদক কীভাবে প্রবেশ করল?? আমি তো কিছুতেই সেটা অনুমান করতে পারছি না।

—আমিও পারছি না। আর আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, যে মুহূর্তে এই প্রশ্নর উত্তরটা আন্দাজ করতে পারব, সেই মুহূর্তে সব রহস্যজাল থেকে পর্দা উঠে যাবে।

জীবসিদ্ধি উঠে দাঁড়াল। বলল:

—অনেক রাত হয়েছে, আচার্য। এবার আপনি বিশ্রাম নিন। আমি আসি।

—শোনো। তুমি আমার ঘরে এসে ঘুমোও।

এই কথায় জীবসিদ্ধি লজ্জিত হল। মৃদু হেসে জীবসিদ্ধি বলল,

—না, না। তার প্রয়োজন নেই। আমি অতটাও দুর্বল নই।

—না। এটা আমার আদেশ। তুমি এই ঘরেই রাতে ঘুমোনোর ব্যবস্থা করো। আমি কোনো দ্বিরুক্তি শুনতে চাই না।

—বেশ। তবে এতে আপনারই অসুবিধে, আচার্য।

—কোনো অসুবিধে নয়। তোমার ভালো ঘুম হওয়া প্রয়োজন।

.

ঘরের একদিকে চাণক্যর শয্যা, আর উলটো দিকে জীবসিদ্ধি মেঝেতে শয্যা পাতল। রাতে প্রদীপ নিভিয়ে শয্যা নেয়ার আগে চাণক্য বললেন,

—আমার ওপর বিশ্বাস রাখো, জীবসিদ্ধি। চাণক পুত্র, বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্য কথা দিচ্ছে, আমি এই রহস্যর সমাধান করবই।

১৪.

পরের দিন সকালে প্রথমেই চাণক্য কুমার সুভাষের কাছে খবর পাঠালেন যেন সে আরও অতিরিক্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা করে। তার জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা আছে। আজকে একবার আচার্য বিন্দাচলের গবেষণাগারটা তল্লাশি চালাবেন বলে ঠিক করেছেন চাণক্য। জীবসিদ্ধি বলল:

—তবে বাসবকে তলব করি?

—নাহ্। আমরা যে আচার্য বিন্দাচলকে সন্দেহ করছি সেটা তাকে না জানানোই শ্রেয়। সে নিজে একসময়ে বিন্দাচলের অনুগত ছিল। বাসব নিজেই বলেছে সেকথা। আর তা ছাড়া আমাদের সন্দেহর বিষয়টা আমি কাউকেই জানাতে চাইছি না। বিন্দাচলের পেটিটা যে আমি খুঁজে পেয়েছি সেই তথ্য এই মুহূর্তে কাউকে না জানানোই বুদ্ধিমানের কাজ। বাসবকে জানানো মানেই সবাই জেনে যাবে।

—বেশ। তবে সামান্য ফলাহার করে চলুন আমরা রওনা হই।

দু-জনে সবে প্রাতঃভোজ শেষ করেছে, তখনই বাইরে থেকে কারুর আসার শব্দ পাওয়া গেল। মগধ থেকে দূত এসেছে। তার হাতে একটা রাজমোহর লাগানো চিঠি। চাণক্যর ইশারায়, জীবসিদ্ধি সেটা নিয়ে, খুলে পড়তে শুরু করল। এইবারের চিঠি চাণক্যকেই লেখা।

.

প্রিয় আচার্য,

প্রণাম নেবেন। আশা করছি আপনারা কুশল আছেন। তক্ষশিলার এখন অবস্থা কী তা চিঠি দিয়ে জানাবেন। জীবসিদ্ধির চিঠি থেকে আপনার সন্দেহর কথা জেনেছি। আশা করি সমস্যার সমাধান খুব তাড়াতাড়িই হবে।

এইদিকে সব ঠিক চলেছে। তবে আপনার অবর্তমানে, রাজ্যে কর ও অর্থনৈতিক হিসেব-নিকেশে আমাদের রাজকোষের হিসেবরক্ষকরা কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। কয়েকটা হিসেবে গরমিল দেখা দিচ্ছে। তারা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছিল, আমি তাদের বিরত রেখেছি। কারণ এই মুহূর্তে, তক্ষশিলার রহস্যর সমাধান হওয়াটাকে অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন।

আশা করছি আপনি ফিরে এলে, তাদের এইসব সামান্য সমস্যার সমাধান হবে।

শুভেচ্ছা রইল।

ইতি,
আপনার শিষ্য,
চন্দ্ৰগুপ্ত।

চিঠি পড়া শেষ করে জীবসিদ্ধি বলল :

—এরা আবার কী সমস্যা বাধাল? কীসের হিসেবে সমস্যা তাদের?

—অনুমান করতে পারছি না। তবে আশা করি সমস্যা গম্ভীর কিছু নয়। তাহলে সম্রাট অবশ্যই জানাতেন। আসলে প্রথম থেকেই অর্থনীতির দিকটা তো আমারই তত্ত্বাবধানে থেকে এসেছে, তাই এই বিষয়ে সম্রাট নিজে বা প্রধান অমাত্য কৃষ্ণনাথ, কেউই বিশেষ অবগত নন। আর এই প্রথম আমি দীর্ঘদিনের জন্যে মগধের বাইরে। তাই তাদের সমস্যার সম্মুখীন হওয়াই স্বাভাবিক।

—তা তো নিঃসন্দেহে। আচার্য, ওই যে দেখুন বাসব আসছে।

.

বাসব হন্তদন্ত হয়ে অতিথি-নিবাসে ঢুকল। তাদের কাছে এসে বলল :

—আচার্য! আপনারা সংবাদ পেয়েছেন? কাল রাতে সুনাভকে কেউ হত্যা করেছে! আমি তো ভাবতেই পারছি না।

—হুম। শুনেছি বাসব। আমরা কাল আয়ুরালয়তে গেছিলাম। তদন্ত দল এসেছে?

—শুনলাম তারা এসেছে। আপনি কি সেখানেই যাবেন?

—না, বাসব। আজ কোথাও যাব না। জীবসিদ্ধি ক্লান্ত। তার স্বাস্থ্য ভালো নেই। আমারও বিশ্রামের প্রয়োজন।

কথাটা শুনে বাসব বেশ অবাক হয়েছে মনে হল। কিছুটা আশাহতও। সে বোধ হয় ভেবেছিল যে চাণক্য নিশ্চয়ই আয়ুরালয়তে যেতে চাইবেন। বাসব খানিকটা থতোমতো খেয়ে বলল:

—আচ্ছা, বেশ। আচার্য এ কী ঘটছে? একের পর এক মৃত্যু!

.

কিছুক্ষণ রাতের ঘটনা নিয়েই কথাবার্তা হল। জীবসিদ্ধি ও চাণক্য গতকাল কী কী ঘটেছে তা বলল। তবে বই চুরি যাওয়ার ঘটনাটা চাণক্য বললেন না। অকারণে অন্যকে কোনো তথ্যই দেয়া উচিত নয় বলে তিনি বিশ্বাস করেন। শুধু কথার মাঝেই একবার প্রশ্ন করলেন,

—আচ্ছা বাসব, তোমরা যে সেইদিন পুথিটা খুঁজে পেয়েছ সেটা কি কাউকে জানিয়েছিলে?

—’হ্যাঁ, আচার্য। সে তো অনেককেই জানিয়েছি। প্রধানাচার্য মহাশয় তো রোজই খবর নেন যে নতুন কোনো অগ্রগতি হল কি না। তা ছাড়া অন্যান্য বাসিন্দারাও আপনাদেরকে নিয়ে যথেষ্ট কৌতূহলী। তাদেরকেও বলেছি যে বইটা আপনি নিয়েছেন। কেন? এটা কি জানানো উচিত হয়নি আমার?

—না, না। সেইরকম কিছু নয়। এমনি জানতে চাইলাম যে এখানকার মানুষজন কতটা কৌতূহলী।

—সবাই কৌতূহলী, আচার্য। কারণ কম-বেশি সকলেই ভয়ে আছে। এতগুলো মৃত্যু পর পর ঘটল। তার ওপর আবার কালকের ঘটনা।

—হুম। স্বাভাবিক।

—আমি তবে আজ আসি, আচার্য। আপনারা বিশ্রাম নিন। কোনো প্রয়োজন হলে আমায় তলব করবেন।

—তা তো করবই।

দু-জনকে প্রণাম জানিয়ে বাসব বিদায় নিল। তাকে যতক্ষণ চলে যেতে দেখা গেল, ততক্ষণ অবধি অপেক্ষা করলেন চাণক্য। বাসব দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যেতেই তিনি বললেন,

—চলো, জীবসিদ্ধি। এইবার যাওয়া যাক।

পথ চলতে চলতে জীবসিদ্ধি প্রশ্ন করল,

—আচার্য, আপনি কী অনুমান করছেন আচার্য বিন্দাচলের বিষয়ে? আপনার কি মনে হয় যে তিনিই সব ষড়যন্ত্রের মূল নায়ক?

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন চাণক্য। তাঁর মনের মধ্যে অনেক বছর আগে দেখা বিন্দাচলের স্মৃতি ভেসে উঠছে। বললেন,

—তোমার প্রশ্নর উত্তর দেয়ার আগে তোমায় কয়েকটা বিষয় বুঝতে হবে। প্রথমত আচার্য বিন্দাচলকে যে খুব বেশি চিনেছিলাম তা নয়। শুধু জানতাম যে তিনি উদ্ভিদবিদ্যা এবং রসায়নশাস্ত্রের, অন্যতম পণ্ডিত ব্যক্তি। আচার্য হিসেবে তক্ষশিলায় আমার যোগ দেয়ার অনেক বছর আগে থেকেই তিনি এখানকার আচার্য ছিলেন। ঠিক যেমনভাবে আমি সবসময়ই চেয়ে এসেছি যে গুণী ব্যক্তিরা যেন আমাদের মিত্রপক্ষে থাকেন, একইভাবে আচার্য শকুনিও তাই চাইতেন। অতএব, অনেক আগে থেকেই শকুনি, বিন্দাচলকে নিজের পক্ষে টেনে নিয়েছিলেন।

শকুনি নিজেও যে অসম্ভব বুদ্ধিমান ব্যক্তি সে-বিষয়ে আলাদা করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। তিনিও নিজের প্রতিপত্তি বিস্তার করেছিলেন। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, আচার্য শকুনি সেই সময় থেকেই গান্ধারের রাজকুমার অম্বিকে নিজের ছত্রছায়ায় নিয়েছিলেন, যাতে গান্ধার রাজের হৃদয়ে, এই তক্ষশিলায় বসে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বিস্তার হতে থাকে। কিন্তু এই ব্যক্তি কোনোদিনই নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু দেখেননি। তিনি শুধুই নিজে ক্ষমতাবান হতে চেয়েছেন। দেশের কথা তিনি ভাবেননি।

এরপর আমি আসি তক্ষশিলায়। তার আগে অবধি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর প্রচুর প্রভাব ছিল। নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে অনেক সময়ে তিনি নিয়ম ভেঙেই, একাধিক রাজকুমারকে নিজের আশ্রমে যুক্ত করতেন। বেশ কিছু আচার্যর ওপর তিনি নিজের কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিলেন। আমি আসার পর তাঁর এই কাজগুলোর বিরোধিতা করি। আমি তক্ষশিলার উন্নতির স্বার্থে নিবেদিত ছিলাম, আর তিনি শুধুই নিজের উন্নতির স্বার্থে কাজ করতেন। অতএব সংঘর্ষ অনিবার্য ছিল। তারপর এই তক্ষশিলায় আচার্যদের মধ্যে দুটো আলাদা শিবির হতে বেশি সময় লাগেনি। বিন্দাচল ছিলেন আমার বিরোধী শিবিরের সদস্য।

কী কারণে যে তিনি আচার্য শকুনির ভক্ত হয়েছিলেন তা বলা কঠিন। তবে তিনি নিজে অত্যন্ত গুণী এবং শান্ত স্বভাবের মানুষ ছিলেন। আমি ওঁর প্রিয়পাত্র আচার্য শকুনির বিরোধিতা করতাম বলে আমায় তিনি সুনজরে দেখতেন না বটে, তবে তিনি যে আমায় কখনো অসম্মান করেছেন তা বলতে পারি না। বরং তিনি আমার জ্ঞান এবং আদর্শর সম্মান করতেন। আমিও তাঁকে একজন অগ্রজ আচার্য হিসেবে সম্মান দিতাম। ব্যস, এই অবধিই আমাদের সম্পর্ক সীমাবদ্ধ ছিল।

—হ্যাঁ। আমার মনে আছে।

চাণক্য আবার বললেন,

—আচার্য বিন্দাচলের সঙ্গে আচার্য শকুনির একটা বিরাট পার্থক্য ছিল। শকুনি ছিলেন একজন শঠ, স্বার্থপর এবং ক্ষমতালোভী মানুষ। কিন্তু বিন্দাচল একজন সৎ এবং আদর্শবাদী শিক্ষক। অতএব তোমার প্রশ্নের উত্তরে আমি বলব, না। আমার মনে হয় না যে আচার্য বিন্দাচল এই ষড়যন্ত্রে কাণ্ডারি। কারণ তিনি একজন আদর্শবাদী শিক্ষক। আমি তাঁকে যতদূর চিনেছি, তার ওপর ভিত্তি করে বলতে পারি যে, তিনি আর যাই করুন, কখনোই এই মহাবিদ্যালয়ের নাম কলুষিত হয় এমন কোনো কাজ করতে পারেন না।