১.
তক্ষশিলা মহাবিদ্যালয়। সুনাভ উত্তেজিত হয়ে অপেক্ষা করছে। জানলার বাইরে বার বার চেয়ে আকাশের তারার স্থিতি দেখে সময়ের আভাস পাচ্ছে। রাত তৃতীয় প্রহর শুরু হতে আর দেরি নেই। এতক্ষণে তো ছিত্রবানের এসে যাওয়া উচিত। কই সে? অধৈর্য হয়ে ঘরময় পায়চারি করতে থাকে সে। তখনই ঘরের দরজায় তিন বার মৃদু টোকার আওয়াজ শোনা যায়। দ্রুত গিয়ে দরজা খোলে সুনাভ। একটা কালো কাপড় গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছিত্রবান। তাকে দেখে একটু বিরক্ত হয়েই সুনাভ বলে,
—ওহে, তুমি বড়োই দেরি করো কাজে। তুমি কি জানো না যে ঠিক তৃতীয় প্রহরের শুরুতে আমাদের কাজ করতে না পারলে লাভ নেই!
—বন্ধু, বৃথাই তুমি অস্থির হও। এখনও ঢের সময় আছে হাতে। তা, তোমায় যা যা জিনিস আনতে বলেছিল তা জোগাড় করেছ?
—হ্যাঁ, করেছি। আর তুমি?
—আমিও আমার ভাগের সব এনেছি সঙ্গেই। চলো, চলো। কুমার আমাদের জন্যে অপেক্ষায় আছে।
নিজের আশ্রমের ঘর থেকে বেরিয়ে এল সুনাভ। তার সঙ্গে ছিত্রবান। আজ অমাবস্যা, তাই গভীর অন্ধকার আজকের রাত। মশালের আলোয় পথ দেখে এগিয়ে চলে দু-জনে। খোলা দালানে বেরিয়ে এসে দু-জনেই আশেপাশে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। নাহ্, কেউ নেই আশেপাশে। থাকার কথাও নয় কারুর এই অসময়ে। শুধু নিস্তব্ধ রাতের মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ‘জ্ঞান স্তূপ’। পাথরের এই বিরাট স্তূপটা জ্ঞানের প্রতীক। তার বিশাল উচ্চতা বার বার মনে করায় যে জ্ঞান-ই হল এই সৃষ্টির সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বস্তু। জ্ঞানী কোনোদিন মাথা নত করে না। ঠিক এই স্তূপের মতোই সেও সবসময় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সেইদিকে তাকিয়ে সুনাভর হৃদয়ে সামান্য ভয় লাগে। তারা যা করেছে সেটা তো অপরাধ। ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। তার মনে হয় বিশাল স্তূপ যেন তাদের দিকে চেয়ে অসন্তোষের দৃষ্টি হেনে আছে। সুপ্ত অনুশোচনা হয় তার। পুষ্পলের কথায় রাজি না হলেই মনে হয় ভালো হত। আচার্য মহিষাম্ব বরাবরই বলেন যে, ‘যা তোমার বুদ্ধি তথা বিচারের বাইরে, সেই জিনিসকে বিরক্ত না করাই বুদ্ধিমানের কাজ।’ কিন্তু আজ তারা ঠিক সেটাই করতে চলেছে।
দ্রুত কিন্তু নিঃশব্দে তারা লাল পাথরের মেঝে পার হতে থাকে। পায়ের তলার পাথর ঠান্ডা। অথচ সূর্যের তাপে দিনের বেশিরভাগ সময়েই তা তেতে থাকে। চলাই মুশকিল হয়ে যায় এর ওপর দিয়ে। আকাশ এতক্ষণ পরিষ্কার ছিল। কিন্তু এখন ঈশান কোণে একটা কালো মেঘ দেখা দিচ্ছে। ঠিক যেন কোনো মহাদানব জেগে উঠছে ওদিক থেকে। যেন আসন্ন সর্বনাশের অশুভ ইঙ্গিতবাহী হয়ে জমাট বাঁধছে এই কালো মেঘ।
দু-মাস আগের কথা মনে পড়ছে সুনাভর। পুষ্পল তাদের কাছে প্রথম কথাটা বলেছিল। সুনাভ, ছিত্রবান, পুষ্পল এবং রাজকুমার সুভাষ, এই চার জন পরম বন্ধু। প্রত্যেকে আলাদা আলাদা বর্ষের ছাত্র হলেও, নিজেদের সামাজিক এবং আর্থিক বিভেদ উপেক্ষা করেও এই কিশোরদের মধ্যে সখ্যতা গড়ে উঠতে অসুবিধা হয়নি। চার জনই আচার্য মহিষাম্বর আশ্রমে ‘ইন্দ্রজাল বিদ্যা’-র ছাত্র। গুপ্তবিদ্যা, অলৌকিক এবং তন্ত্রমন্ত্রে এই চার জনেরই প্রবল বিশ্বাস। কিন্তু তক্ষশিলা এসে তারা কিছুটা হতাশ হয়েছে। কারণ এখানে এসে তারা জেনেছে ইন্দ্রজাল আসলে বৈজ্ঞানিক ব্যাপার। বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে মানুষের মনে মায়া বা ভ্রম সৃষ্টি করাই ইন্দ্রজাল।
কিন্তু তাদের মনে দৃঢ় বিশ্বাস যে এর বাইরেও কিছু আছে। সবটাই আয়না আর ধোঁয়া নয়। তাই পুষ্পল যেদিন তাদের কাছে এসে সেই নামহীন পুথির কথা বলে, তারা প্রত্যেকেই যারপরনাই রোমাঞ্চিত হয়। পুষ্পল এসে তাদের জানায় যে আজ গ্রন্থাগারে তার কাজের দায়িত্ব ছিল আর সেইসময়েই সে গ্রন্থাগারের একটা গোপন অংশে একটা নামহীন পুথি পেয়েছে। পুথিটা বেশ প্রাচীন, প্রথমদিকে কয়েকটা পাতা না থাকায় সেটার নাম বা লেখকের নাম আর জানা সম্ভব নয়। কিন্তু যেটুকু সে পড়েছে তাতে বোঝা যায় যে এই পুথিতে প্রেতদের নিজের বশে আনার উপায় লেখা রয়েছে! ব্যাপারটা শুনে কেউই প্রথমে বিশ্বাস করেনি। তারা ভেবেছিল তাদের বন্ধু তাদের সঙ্গে কৌতুক করছে। কিন্তু চার জনেই যখন গ্রন্থাগারে গিয়ে সেই পুথিটা দেখল তখন তাদের মনে আর সংশয় রইল না। সত্যিই এই বইয়ের পাতায় তন্ত্রক্রিয়ার বর্ণনা আছে যার দ্বারা প্রেতলোকের দরজা খুলে যায় এবং সেই প্রেতদের বশ করে যেকোনো মানুষ হয়ে উঠতে পারে অপার শক্তির মালিক 1
এরপর তারা লুকিয়ে এই বইটা নিয়ে আসে নিজেদের সঙ্গে। সেটা কোনো সমস্যার বিষয় ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থগারে কোনোদিন পাহারা থাকে না। এখানে একটা প্রচলিত কথা আছে – ‘যারা চুরি করে, তারা কখনো বই পড়ে না। আর যারা বই পড়ে, তারা কখনোই চুরি করে না।’ বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানভাণ্ডারের দরজা তার ছাত্রদের জন্যে সবসময় খোলা রাখাই এখানকার নিয়ম।
তারা গত দু-মাস এই পুথি পড়েছে। কিন্তু তার আচার ছিল বড়োই ভয়ংকর। তারা বহুবার ভেবেছে যে এই কাজ তারা করবে না। কিন্তু এই বিষয়ে কাজটা করে দেখতে সবচেয়ে উৎসাহী ছিল কুমার সুভাষ নিজেই। বয়সে চার জনের মধ্যে সে-ই কনিষ্ঠ। তাই তার মধ্যে বালকের মতো উৎসাহও বেশি। তার উৎসাহেই সমস্ত পূর্ব আচার তারা তিথি এবং সময় মেনে সম্পন্ন করেছে। আর আজ সেই দিন। আজ প্রধান কাজ সম্পন্ন করার উৎকৃষ্ট সময়। সব ব্যবস্থা করেছে তারা। কুমার নিজেই বেশিরভাগ জিনিস জোগাড় করেছে বেশ কিছু রুপোর মুদ্রা খরচ করে। বাকি সাধারণ জিনিসপত্র তারা নিজেরাই এনেছে। সেই বই অনুযায়ী এই ক্রিয়া করতে যে নক্ষত্রের অবস্থান প্রয়োজন, আজ রাত তৃতীয় প্রহরের শুরুতে অনেকটা সে রকমই থাকবে। তাই তারা সবাই ঠিক করেছে আজ রাতেই তারা গোপনে এই তন্ত্রক্রিয়া করে দেখবে।
নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দেখল কুমার আর পুষ্পল তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তারা আয়োজন প্রায় করে ফেলেছে। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণের এইদিকে এমনিতেই লোক চলাচল কম, তার ওপর এই অসময়ে কারুর আসার প্রশ্নই ওঠে না। তাই অনেক ভেবে তারা এই জায়গাটাকেই বেছে নিয়েছে তাদের আজকের কাজের জন্যে। কুমার তাদের দেখেই তাড়া দিল,
—তোমরা সবেতেই বড্ড দেরি কর। দেখো, আমি আর পুষ্পল কিন্তু সব সাজিয়ে ফেলেছি। শুধু তোমাদের আনা জিনিসগুলো বাকি।
পুষ্পল বলে,
—সময় প্রায় আসন্ন। দেখি, দেখি। কী কী আনলে দেখি। কিছু বাকি থেকে যায়নি তো?
দু-জনেই মাটিতে বসে পড়ে তাদের কাঁধের কাপড়ের ঝোলা থেকে একটা একটা করে জিনিস সাজিয়ে রাখতে থাকে।
চারটে প্রদীপ, সলতে, তেল, কুমকুম, কর্পূর, ধুনি, ভোরের জমা করা শিশির, মাথার চুল, কাকের মৃতদেহ, কয়েকটা মাটির সরা, তামার পাত্র, মোরগের পা, ধানের কুশ ইত্যাদি। এ ছাড়াও যেসব অদ্ভুত জিনিসের কথা লেখা ছিল সেগুলো মুদ্রা খরচা করে বাইরে থেকে আনতে হয়েছে। কুমিরের দাঁত থেকে শেয়ালের রক্ত পর্যন্ত বহু অদ্ভুত জিনিসের কথা এই পুথিতে লেখা আছে। সবই কুমার সুভাষ তার প্রতিপত্তি খাটিয়ে জোগাড় করেছে। এইবার শুধু শুরু করার অপেক্ষা। একটা বড়ো পাত্রে আগুন জ্বালতে জ্বালতে ছিত্রবান বলে উঠল, – তোমার আজ একটু অসুবিধা হবে বটে কুমার। এই কারণেই তোমায় বলেছিলাম যে তুমি এর ভেতর থেকো না।
—বলো কী হে, ছিত্রবান? এই সামান্য কারণে এমন সুযোগ আমি হেলায় হারাব? কখনো নয়। এত বড়ো আচার সম্পন্ন করে শেষে এসে পিছিয়ে যাব? তা হয় না।
এই কথাটা কুমারকে বলার কারণ হল তার ধোঁয়া এবং ধুলো সহ্য হয় না। ধুলো আর ধোঁয়া তার নাকে ঢুকলেই তার কাশি শুরু হয় আর চোখ নাক দিয়ে জল বেরোতে থাকে। তবু আজ তার উৎসাহে ভাটা নেই। সে আজ একটু কষ্ট সয়ে নেবে না-হয়। তবে এই কাজে ঝুঁকি তো বাকি তিন জনেরও আছে। আজ যদি তারা ধরা পড়ে, তবে কুমারের কথা বলা যায় না, হয়তো সে তার বাবার সুনামে বহিষ্কৃত হওয়া থেকে বেঁচে যাবে। কিন্তু বাকি তিন জন মোটেই রাজবংশর সন্তান নয়। অতএব, তাদের কপালে নিশ্চিত বহিষ্কার লেখা আছে। এত কিছুর পরেও তারা কাজ শুরু করল ঠিক যখন মেঘলা আকাশে নক্ষত্রর অধিষ্ঠান জানান দিল তৃতীয় প্রহর শুরু হওয়ার। ঠিক সেই মুহূর্তে কাছেই কোথাও প্রবল জোরে বজ্রপাত হল। কালো মেঘ ধীরে ধীরে সারা আকাশকে নিজের গ্রাসে এনেছে।
একটা বড়ো পাত্রে চন্দন কাঠের আগুন জ্বালিয়ে চার জন বসেছে চারদিকে। ধুনুচিতে ধুনি আর কর্পূর জ্বালা হয়েছে। প্রদীপের হালকা আলোয় আর মিষ্টি ধোঁয়ায় এক অদ্ভুত আধিভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। চার জন নিয়মমতো মন্ত্রপাঠ করছে আর মাঝে মাঝেই কিছু কিছু জিনিস বড়ো চন্দন কাঠের আগুনে আহুতি দিচ্ছে। বৃষ্টি শুরু হয়নি কিন্তু ঘন ঘন বজ্রপাত হচ্ছে। তন্ত্রক্রিয়া যতই এগোতে থাকে ততই, কেমন যেন ভয় ভয় করতে থাকে সুনাভর। তার মনে হতে থাকে যে আশেপাশে কিছু একটা অশুভ বলয় যেন তাদের ঘিরে ধরছে। প্রতিটা উচ্চারিত মন্ত্র এবং অগ্নিতে নিক্ষেপ করা প্রতিটা আহুতির সঙ্গেসঙ্গেই তার মনে হল সেই অশুভ বলয়টা ছোটো হয়ে আসছে। মাঝে বন্দি হয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে তারা চার জন।
একবার সকলের মুখের দিকে তাকাল সুনাভ। আগুনের আলোয় তার মনে হল যে ছিত্রবান আর পুষ্পলের মুখেও ভয়ের কালো ছায়া দেখছে। তারাও ঠিক সুনাভর মতোই ভীত। তবে কুমার সুভাষের চোখে ভয় নেই। তাতে এখনও কৌতূহল। তবে ধোঁয়াতে মাঝে মাঝেই তার কাশি উঠছে আর চোখ মুছছে। সুনাভ হঠাৎই একটা ‘ধুক-পুক’ শব্দ শুনতে পেল। বুঝতে পারল যে এটা তার নিজের হৃদয়ের শব্দ, যা এখন প্রবল জোরে চলছে। অস্থির, অস্বস্তি হচ্ছে তার। তবে এইসবের ওপর যেটা হচ্ছে, সেটা হল ভয়! এরকম ভয় কোনোদিন আগে পায়নি সুনাভ। বুকের ভেতর চেপে বসছে কোনো একটা অজানা ভয়। এইবার কিন্তু সকলেরই কম-বেশি অস্বস্তি হতে শুরু করেছে। ভয় করছে সকলের!
হঠাৎই সুনাভ টের পেল তার ঘাড়ে কেউ নিশ্বাস ফেলছে। কেউ একজন তার ঠিক পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। পেছনে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না সুনাভ। সে বুঝতে পারছে না ঘুরে কাকে দেখবে। ভয়ংকর বিকৃত মুখটা। কিন্তু এরপরই তার চোখ গেল বাকিদের দিকে। স্পষ্ট দেখতে পেল তাদের প্রত্যেকের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কালো, দীর্ঘ কয়েকটা ছায়ামূর্তি। তাদের চোখ গরম কয়লার মতো লাল হয়ে জ্বলছে ধিকিধিকি। তাদের ঘিরে দাঁড়িয়েছে অনেকগুলো প্রেতমূর্তি, এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। শুধু সে একা নয়, বাকিরাও দেখতে পেয়েছে এই প্রেতদের! তাদের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। সুনাভর হৃদয় প্রায় ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আতঙ্ক! প্রচণ্ড আতঙ্ক তাদের সকলকে চেপে ধরছে। চিৎকার করতে যায় সুনাভ, কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারে না। কেউ যেন তার গলা চেপে ধরছে। বাকিরাও মুখ খুলে রয়েছে কিন্তু আওয়াজ বের হচ্ছে না। শুধু চিৎকার করতে পারে কুমার! তার গলা থেকে তীব্র আতঙ্ক মাখা আর্তনাদ খানখান করে দেয় রাতের পরিবেশ। আর তখনই একদম কাছেই কোথাও আরও একবার বজ্রপাত হয়।
২.
মগধ। সম্রাট চন্দ্রগুপ্তর রাজসভা। বিশাল বড়ো এই ঘরে একসঙ্গে প্রায় এক-শো মানুষ একত্র হতে পারে। যদিও এই মুহূর্তে জনা বিশ পঁচিশ মানুষ উপস্থিত। লাল গালিচা এবং বেশ কিছু শ্বেতপাথরের অপূর্ব মূর্তি সভাঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করছে। ছাদের মাঝে আছে একটা সুবিশাল ঝাড়বাতি। যদিও এখন দিনের আলো থাকায় তা জ্বলছে না। সভার একদম শেষ মাথায় উঁচু একটা বেদির ওপর, রত্নখচিত একটা সোনার সিংহাসনে বসে আছেন স্বয়ং সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। এই মুহূর্তে তিনি তাকিয়ে আছেন সভার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা দু-জন ব্যক্তির দিকে। একজন দীর্ঘাঙ্গী, মাথায় অল্প চুল, ছোটো ছোটো চোখ মেলে চেয়ে আছে সম্রাটের দিকে। আর দ্বিতীয়জন মোটা, উচ্চতায় মাঝারি, মাথা ভরতি সাদা-কালো চুল। এই মুহূর্তে দু-জনের বিচার চলছে। বিচার চলছে বললে ভুল হবে, বিচার আগেই হয়ে গেছে। একটা দোকানে এই দু-জনই কর্মচারী হিসেবে কাজ করত। কিন্তু একটা মূল্যবান জিনিস সেখান থেকে চুরি যায়। দ্বিতীয় ব্যক্তিকে ন্যায়রক্ষী অধ্যক্ষ আগেই দোষী সাব্যস্ত করেছে। কিন্তু এই ব্যক্তি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে সম্রাটের হস্তক্ষেপ দাবি করেছে। অতএব এখন তারা রাজসভায়।
অমাত্য কৃষ্ণনাথ এই সামান্য বিষয় নিয়ে রাজকার্যে বাধা পড়াটা পছন্দ করছেন না। তাই ব্যাপারটা সহজেই শেষ করতে তৎপর। তিনি বলে চলেছেন,
—দোকানের মালিক এই দুই কর্মচারীর বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ দায়ের করেছে। রুপোর একটা মূল্যবান মূর্তি সেখানে ওপরের তাকে রাখা ছিল। সকালে তিনি দোকানে এসে দেখেন যে সেটা নেই। সৈনিকদের খবর দিলে তারা তদন্ত শুরু করে। মূর্তিটা ছিল একটা উঁচু দেরাজে। তদন্তকারী প্রধান সৈনিক সেখানে গিয়ে দেখে ঠিক সেই দেরাজের নীচে এই কাঠের চারপায়া রাখা। এর থেকেই তারা অনুমান করে যে চোরের উচ্চতা নিশ্চয়ই বেশি নয়। ওই চারপায়ায় চড়ে তবে মূর্তির নাগাল পেয়েছিল। আর সেই হিসেবেই তারা এই ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করে। তার বাড়িতে তল্লাশি চালালে মূর্তিটা তার ঝোলায় পাওয়া যায়। সেই ঝোলাটা নিয়েই যে সে রোজ কাজের জায়গায় যায়, সেটা সে নিজেই স্বীকার করেছে।
কাঠের পুরোনো একটা ছোটো চারপায়া সভায় আনা হয়েছে প্রমাণ হিসেবে। সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত একবার সেটার দিকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। অমাত্য বলে চলেছেন,
—অতএব, আমি সম্রাটের কাছে আর্জি করছি দোষীর সাজা বহাল রেখে আমরা সভা শেষ করি।
—আমি চুরি করিনি, সম্রাট! আমি সত্যি জানি না ওই মূর্তি কীভাবে…
—অনুমতি না পেলে কথা বলবে না!
ভয়ে চুপ করে যায় দ্বিতীয় ব্যক্তি। চন্দ্রগুপ্ত এইবার অমাত্যর দিকে ফিরে বলেন,
—আপনি তাহলে বলছেন এই ব্যক্তিই চোর?
—অবশ্যই, সম্রাট।
—আমি দ্বিমত পোষণ করি।
থতোমতো খেয়ে গেছেন অমাত্য কৃষ্ণনাথ। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন সেইসময়েই একজন সৈনিক এসে সম্রাটের উদ্দেশে প্রণাম জানিয়ে বলল:
—সম্রাটের জয় হোক। আচার্য চাণক্য সভায় আসছেন।
চন্দ্রগুপ্ত সামান্য ঘাড় নেড়ে তাকে বিদায় দিলেন। কয়েক মুহূর্ত পরেই সভায় কাঠের খড়মের শব্দ ভেসে এল। গেরুয়া বেশধারী এক ব্রাহ্মণ প্রবেশ করলেন। কপালে ত্রিবলী টিকা, ন্যাড়া মাথায় লম্বা টিকি, কাঁধে একটা কাপড়ের ঝোলা। মুখে শান্ত সৌম্য ভাব, তবে চোখের তারা দুটো দ্যুতিময়, তাতে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। তাঁকে দেখে সভার প্রত্যেকে নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়িয়েছেন স্বয়ং সম্রাট। কারণ এই ব্যক্তি সম্রাট চন্দ্রগুপ্তর আচার্য, বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্য। অনেকের মতে তিনিই আর্যাবর্তের সবচেয়ে ক্ষমতাবান পুরুষ। সম্ভবত স্বয়ং সম্রাটের চেয়েও তাঁর প্রভাব বেশি এই দেশে।
সম্রাট করজোড়ে বললেন,
—প্রণাম, গুরুদেব। স্বাগত।
—হুম। আয়ুষ্মান ভবঃ, সম্রাট।
সম্রাটের পাশের আসনটা তাঁর জন্যে বরাদ্দ থাকে। যদিও তিনি রাজমহলে খুবই কম আসেন। অন্যমনস্কভাবে একবার সভাসদদের দিকে চোখ বুলিয়ে তিনি আসন গ্রহণ করলেন। চন্দ্রগুপ্ত একবার নিজের আচার্যর দিকে চেয়ে তারপর অমাত্য কৃষ্ণনাথকে বললেন,
—কে চোর সেটা স্বয়ং আচার্য বিচার করুন।
অমাত্য কিছুটা হতবাক আর সম্রাটের চোখে কৌতুকের আভাস। বললেন,
—আচার্য, এরা দু-জন একই জায়গায় কাজ করে। চুরির অভিযোগ করেছে এদের মালিক। তদন্তে জানা যায় কেউ একজন, ওই যে দেখুন, ওই চারপায়ায় উঠে, ওপরের দেরাজে রাখা একটা রুপোর মূর্তি চুরি করেছে। আমার ধারণা আপনি সহজেই অনুমান করতে পারবেন এই দু-জনের মধ্যে কে আসল অপরাধী। আচার্য?
চাণক্য প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই বলে উঠলেন,
—যদি চোর এই দু-জনের মধ্যেই কোনো একজন হয়ে থাকে, তবে আমি বলব এই ব্যক্তি অপরাধী।
চাণক্য আঙুল দিয়ে নির্দেশ করেছেন প্রথম ব্যক্তির দিকে। সম্রাট চন্দ্ৰগুপ্ত মৃদু হেসে বললেন,
—আমারও তাই অভিমত। আচার্য কি দয়া করে অমাত্য মহাশয়কে বুঝিয়ে দেবেন কারণটা? আমার ধারণা এখনও অনেকেই ধোঁয়াশায় রয়েছেন।
চাণক্য মৃদু হেসে বললেন,
—ওহে। এই যে… তুমি।
দ্বিতীয় ব্যক্তির উদ্দেশে কথাটা বললেন চাণক্য।
—তুমি ওই চারপায়ায় একবার উঠে দাঁড়াও দেখি।
আদেশ পেয়ে দ্বিতীয় ব্যক্তি এগিয়ে এসে উঠে দাঁড়াল চারপায়াটাতে। পুরোনো, জীর্ণ কাঠের সেই জিনিসটা তার ওজন নিতে না পেরে কিছুক্ষণের মধ্যেই ভেঙে পড়ল। চাণক্য বললেন,
—দ্বিতীয় ব্যক্তি স্থূলকায় এবং তার ওজন বেশি। ওই চারপায়াটার জীর্ণ দশা দেখে সহজেই অনুমান করা যায় যে তার পক্ষে ওতে চড়ে দেরাজ খোলা অসম্ভব। আমার অনুমান প্রথম ব্যক্তি চুরি করে, ইচ্ছে করে চারপায়া ওখানে রেখে দিয়েছিল, যাতে সন্দেহ অন্যজনের ওপর পড়ে। উচ্চতা বেশি হওয়ায় কেউই তাকে সন্দেহ করবে না এর ফলে।
চাণক্যর কথা শেষ করলেন সম্রাট,
—এবং তারপর চুরি করা মূর্তিটা সুযোগ বুঝে অন্যজনের ঝোলাতে রেখে দেয়। সম্ভবত কাজ নিয়ে রেষারেষি ছিল দু-জনের।
দ্বিতীয় লোকটি মেঝেতে বসে বার বার প্রণাম করতে শুরু করল। সৈনিক তাকে ছেড়ে প্রথম ব্যক্তিকে ধরল। হাতের ইশারায় সম্রাট তাদের বিদায় দিলেন। অমাত্য উঠে দাঁড়িয়ে সেদিনের মতো সভার সমাপ্তি ঘোষণা করলেন।
৩.
সবাই সভাঘর ত্যাগ করলে চন্দ্রগুপ্ত এক ভৃত্যকে দিয়ে একটা চিঠি আনালেন। চিঠিটা চাণক্যর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
—আজ সকালেই তক্ষশিলা থেকে আপনার নামে চিঠিটা এসেছে।
চাণক্য খানিকটা ভুরু কুঁচকে চিঠিটা হাতে নিলেন এবং সিলমোহর খুলে পড়তে শুরু করলেন,
প্রিয় বিষ্ণুগুপ্ত,
আশা করি তুমি আর মগধের সকলে কুশলে আছ। তোমার এবং চন্দ্রগুপ্তর তত্ত্বাবধানে যে গোটা আর্যাবর্ত সুরক্ষিত সে-খবর আমি রাখি। আমি আশা রাখি রাজধর্মর পাশাপাশি তোমার বিদ্যাচর্চাও সমানভাবে চলছে। তোমার স্বপ্ন-সৃষ্টি ‘অর্থশাস্ত্র’ লেখা কতটা অগ্রসর হয়েছে জানতে মন চায়। বহু বছর তোমার এবং তোমার ছাত্রদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি। তবে আশা রাখি তোমরা কুশল মঙ্গল আছ।
কিন্তু এখানে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় এমন কিছু অতিপ্রাকৃত শক্তির মুখোমুখি হয়েছে যার ফলে অবস্থা ক্রমেই জটিল হয়ে উঠেছে। এর কোনো সমাধান না হলে আমার আশঙ্কা, মানবসভ্যতার এই আদি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে হবে। হ্যাঁ। ঠিকই বলেছি। এখানে ছাত্র এবং শিক্ষকরা দিনরাত এক অজানা ভয়ে কাটাচ্ছেন। গত কয়েকমাস ধরে যেন মৃত্যু মিছিল শুরু হয়েছে। তিন জনের মৃত্যু হয়েছে খুবই কম সময়ের ব্যবধানে। অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিত্যাগ করে চলে গেছে, আর পরিস্থিতি এরকম থাকলে আমার নিজের পক্ষেও তাদের আটকে রাখা সম্ভব হবে না। তক্ষশিলা বন্ধ হলে, জেনো তা আমাদের সকলের লজ্জার, সারা দেশের লজ্জার।
আমি জানি, প্রশাসনিক দায়িত্বে তুমি অতি ব্যস্ত। তুমি অবসর নিয়েছ বহু বছর আগেই, অতএব এই অনুরোধ করার কোনো অধিকার আমার নেই। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি তোমার আন্তরিকতা এবং শ্রদ্ধা আমার অজ্ঞাত নয়। তক্ষশিলাকে যতটা আমি ভালোবাসি, সে রকমই এই মহাবিদ্যালয়কে তুমিও হৃদয় থেকে ভালোবাসো। সেই অধিকারেই আমি আজ তোমার কাছে অনুরোধ নিয়ে এই চিঠি লিখছি। তুমি ফিরে এসো। সমাধান করো এই রহস্যর। এই বিপদের মুহূর্তে তোমার কথাই মনে এল, বিষ্ণুগুপ্ত। আমার নিজেকে বড়ো অসহায় মনে হচ্ছে। তোমায় এই মুহূর্তে পাশে পেলে এই বৃদ্ধ বুকে বল পাবে। তোমার বুদ্ধি এবং পরামর্শ আমার বড়ো প্রয়োজন এই দুঃসময়ে। আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি যে তক্ষশিলাকে এই মহা বিপদ থেকে একমাত্র তুমিই উদ্ধার করতে পারবে।
আশা করি এই বৃদ্ধর অনুরোধ তুমি রাখবে। তুমিই বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ আশার জ্যোতি।
আশীর্বাদান্তে।
ইতি,
ভদ্রভট্ট
প্ৰধানাচার্য।
তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়।
চিঠিটা পুরোটা পড়া শেষ করে আরও একবার প্রথম থেকে পড়লেন চাণক্য। তারপর আরও একবার। এটা যে প্রধানাচার্য ভদ্রভট্টর লেখা সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এইসব কী লিখেছেন তিনি? কীসের বিপদ? অতিপ্রাকৃত? বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হতে চলেছে এরকম মহা বিপদ? এ যে অবিশ্বাস্য। বিশেষ করে প্রধানাচার্যর মতো একজন মানুষের থেকে এইরকম কথা যে কল্পনাতীত। চাণক্যর মনে এখন ভদ্রভট্টর মুখ ভেসে উঠছে। শান্ত, বুদ্ধিমান, ধী, ধৈর্যশালী এবং অত্যন্ত জ্ঞানী একজন মানুষ এই বৃদ্ধ। সারাজীবন এই মানুষটাকে চাণক্য অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে এসেছেন। যুক্তিবাদী এবং বিজ্ঞানমনস্ক একজন মানুষ। যদিও বহুদিন আগে তাদের শেষ সাক্ষাৎ হয়েছে, তবু, এইরকম কথা যে এই মানুষটি লিখতে পারে তা বিশ্বাসই হচ্ছে না চাণক্যর। চিঠিটা তিনি বাড়িয়ে দিলেন পাশের আসনে বসে থাকা সম্রাট চন্দ্রগুপ্তর দিকে। চন্দ্রগুপ্তও যতই চিঠিটা পড়তে থাকলেন তাঁরও চোখে একইরকম বিস্ময় ফুটে উঠতে থাকল। পড়া শেষ করে বললেন:
—বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাবে? অতিপ্রাকৃতর প্রকোপ? কার মৃত্যু? এইসব কী লিখেছেন প্রধানাচার্য? কী এমন বিপদ হতে পারে সেখানে? আমি গান্ধারকে সব ধরনের অনুপ্রবেশ এবং আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত করেছি অনেক আগেই। তবে কীসের কথা বলছেন তিনি?
চাণক্যর কপালেও ভ্রূকুটি। বললেন,
—হুম। তুমি কি চিঠিটায় কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ করতে পারছ?
—পুরোটাই তো অস্বাভাবিক, আচার্য! এই লেখা যে প্রধানাচার্য ভদ্রভট্টর মতো একজন মানুষ লিখতে পারেন সেটাই বিশ্বাস করা কঠিন। অথচ এই লেখা যে তাঁরই, সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আছে কি?
—নাহ্। হাতের লেখা তাঁরই। তা ছাড়া তক্ষশিলার নিজস্ব সিলমোহরটাও আছে।
—তবে?
—হাতের লেখা দেখো। এই চিঠি লেখার সময় লেখকের হাত কাঁপছিল। কয়েকটা জায়গা ভুল লেখাও হয়েছে। এর কোনোটাই প্রধানাচার্যর হওয়ার কথা নয়।
—আপনি বলতে চাইছেন তিনি অসুস্থ?
—স্নায়ুর ওপর প্রবল চাপ থাকলে মানুষের হাতের লেখা এরকম হয়। তাঁর চিঠির বক্তব্য এবং হাতের লেখা থেকেই স্পষ্ট যে তিনি ভয় পেয়েছেন। চিঠিটার দিকে আরও কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলেন চন্দ্রগুপ্ত। তারপর সেটা রেখে দিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন,
—আপনি কী করবেন তবে, আচার্য? যাবেন তক্ষশিলা?
—এর উত্তর তুমি দিতে পারো, চন্দ্রগুপ্ত। সম্রাটের অনুমতি না পেলে আমি কখনোই মগধ ছেড়ে যাব না।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চন্দ্রগুপ্ত বললেন,
—সত্যি বলতে আমার বিষয়টা ভালো লাগছে না। আমার কেন জানি না মনে আশঙ্কা হচ্ছে। কিন্তু আমি বলব আপনার যাওয়া উচিত। প্রধানাচার্য মহাশয় অহেতুক উদ্বেগ করার মতো মানুষ নন। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের বছরগুলোতে তাঁকে আমি যতদূর চিনেছি, তিনি অত্যন্ত পণ্ডিত এবং বাস্তববাদী মানুষ।
—হুম।
—অতএব, তিনি যখন আপনার শরণাপন্ন হয়েছেন, তখন আমার ধারণা, সমস্যা অত্যন্ত গভীর। চরম কোনো বিপদ ছাড়া তিনি আপনাকে এত দূর ডাকতেন না। অতএব, আমার মনে হয় আপনার যাওয়াই শ্রেয়। আর তা ছাড়া, আমার মত না থাকলেও, আপনি যেতে চাইলে আমি কখনোই আপনাকে বাধা দিতাম না, আচার্য। এবার বাকিটা আপনার সিদ্ধান্ত।
মগধ ছেড়ে যেতে আমার মন সায় দেয় না। কিন্তু বৃদ্ধর এই আর্তি উপেক্ষা করিই-বা কী করে?
—আচার্য, আমি আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি। কয়েক মাস অন্তত মগধের দায়িত্ব আমি এবং আমার অমাত্যরা সামলে নেব। অমাত্যপ্রমুখ কৃষ্ণনাথ আপনার মতো বুদ্ধিমান না হতে পারে। তবে সে পরিশ্রমী এবং রাজকার্য সঞ্চালনায় যথেষ্ট পারদর্শী। আপনার শিষ্য হিসেবে এইটুকু শিক্ষা আমায় আপনি দিয়েছেন যাতে আপনার অনুপস্থিতেও আমি কয়েক মাস সামলে নেব।
—আহা! তুমি ভুল বুঝছ, সম্রাট। তোমার ওপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে। বিষয়টা তা নয়। এটা আসলে আমারই সমস্যা। মগধ ছেড়ে যেতে আমার মন সায় দেয় না।
আমি বুঝি। কিন্তু আপনি নিশ্চিন্ত মনে যান। আমি নিয়মিত আপনাকে চিঠি মারফত এদিককার খবর দিতে থাকব। আপনিও দূত মারফত আমায় পরামর্শ দিতে থাকবেন। আপনি যান, আচার্য। আমার মনে হয় এই মুহূর্তে মগধের থেকে তক্ষশিলায় আপনার প্রয়োজন বেশি। সেখানে কিছু ঘটেছে বা ঘটছে যার ফলে প্রধানাচার্যর মতো মানুষও ভীত এবং উদ্বিগ্ন।
একটু চুপ করে থেকে চাণক্য কিছুক্ষণ ভাবলেন। সবশেষে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
—বেশ। তবে তাই হোক। আমি দেরি করতে চাই না। পরশুই যাত্রা শুরু করব উত্তর-পশ্চিমের দিকে। কিন্তু….
—বলুন?
—রাজকোষের স্বর্ণমুদ্রা লুণ্ঠনের ব্যাপারটা?
—আচার্য, আমি দেশ জুড়ে প্রতিটা সড়কে সড়কে তল্লাশি চালাচ্ছি। ওই স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে কেউ পালাতে পারবে না। আমার ধারণা কোনো বণিকের গাড়ি ভেবে দস্যুরা লুঠ করেছে। রাজকীয় সিলমোহর দেখলে তারা বুঝবে যে তারা কী অপরাধ করেছে। তারা রাজসৈনিকদের হত্যা করেছে। ওই মুদ্রায় হাত দেয়ার সাহস তারা পাবে না। আমি আপনাকে আশ্বস্ত করছি যে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আমরা ওই চোরদের ধরে ফেলব। আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে যাত্রা করুন।
—তাই যেন হয়, সম্রাট। আমারও তাই ধারণা। বেশ। তবে আমি যাত্রার প্রস্তুতি নিই।
—হ্যাঁ। আমি সুরক্ষার জন্যে আপনার সঙ্গে পঞ্চাশ জন সৈনিকের একটা ঘোড়সওয়ার দল দেব।
—না না। তার প্রয়োজন হবে না।
—অবশ্যই প্রয়োজন হবে। আপনাদের সুরক্ষা নিশ্চিত না করলে আমার মনে শান্তি থাকবে না।
—বেশ। তাই হোক। সম্রাট … আর একটা কথা। আমার সঙ্গে কিন্তু…
—হ্যাঁ, জানি আচার্য। জীবসিদ্ধি ভাইও যাবে। জানি। তাকে বাদ দিয়ে আপনাকে পাঠানোর মতো দুঃসাহস আমারও নেই।
হেসে উঠলেন দু-জনেই।
৪.
বেশ কয়েক দিন যাত্রার পরে এখন ছোটো দলটা গান্ধারের সীমানায় এসে পৌঁছেছে। দূরে তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয় নজরে আসছে। আগামীকালই তারা পৌঁছে যাবে সেখানে। সন্ধে হয়ে আসায় তারা আজ এই ছোটো টিলাটার ওপরেই তাঁবু পেতেছে। যদিও এখন ঠান্ডার মরসুম নয়, তবু বৃষ্টির কারণে হালকা ঠান্ডার রেশ রয়ে গেছে। তাই ছোটো দলটা আলাদা আলাদা কয়েকটা জায়গায় আগুন জ্বেলে বসেছে। দু-জন প্রহরী অবশ্য সতর্ক পাহারা দিচ্ছে। একটু আগুন ঘেঁষে মুখোমুখি বসে আছেন দুই ব্রাহ্মণ। চাণক্য এবং জীবসিদ্ধি।
জীবসিদ্ধি চাণক্যরই প্রাক্তন শিষ্য। তাঁদের দু-জনেরই জীবনের কয়েকটা বছর কেটেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই তক্ষশিলার ভেতরেই প্রথম পরিচিত হয়েছিলেন তাঁরা দু-জন। আচার্য চাণক্য, সেই সময়ে ছাত্রদের কাছে ‘বিদ্রোহী আচার্য’ বলে পরিচিত ছিলেন। তাঁর বিচার-ভাবনা, শিক্ষা সব কিছুই ছিল গতানুগতিকের বাইরে। জীবসিদ্ধির মনে আছে, নেহাতই কৌতূহল বশে সে আচার্য চাণক্যর আশ্রমে একদিন গেছিল। সে জানতে ইচ্ছুক ছিল যে কী কারণে তার বন্ধু শশাঙ্ক এই আচার্যর এরকম ভক্ত হয়ে গেছে। জীবসিদ্ধি আশ্রমে এসে দেখতে পায় একদল ছাত্রর মাঝখানে বসে আছেন আচার্য চাণক্য। প্রতিটা ছাত্র তাঁর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে। তাদের মধ্যে তার বন্ধু শশাঙ্কও আছে। ছাত্রদের মোটেই তিনি অর্থনীতির জ্ঞান দিচ্ছেন না। বরং তিনি তাদের সমাজ ও রাষ্ট্রর কথা বলছেন।
—রাজনীতিতে কেউ কারুর স্থায়ী শত্রু বা স্থায়ী মিত্র হয় না। একটা দেশ ততক্ষণই তোমার মিত্র থাকবে, যতক্ষণ সেই দেশের স্বার্থ তোমার দেশের সঙ্গে জড়িয়ে।
জীবসিদ্ধি ভেবেছিল তাকে কেউ খেয়াল করেনি। কিন্তু আচার্য তাকে দেখে নিয়েছেন। কথা থামিয়ে তাকে পর্যবেক্ষণ করলেন এবং প্রশ্ন করলেন,
—তোমার নাম?
—- জী… জীবসিদ্ধি।
শশাঙ্ক তখনই বলে উঠল,
—গুরুদেব, এ আমার সুহৃদ।
—হুম। তা, তুমি এখানে?
—এমনিই। কোনো বিশেষ কারণ নেই, আচার্য।
মৃদু হেসে চাণক্য তাকে একটা কথা বলেছিলেন, যা জীবসিদ্ধি সারাজীবন মনে রেখেছে।
—মনে রাখবে, কোনোদিন অকারণে কোনো কাজ করবে না। প্রতিটা কাজ শুরু করার আগে নিজেকে তিনটে প্রশ্ন করবে, এই কাজ আমি কেন করছি? এই কাজের উদ্দেশ্য কী? এবং এই কাজ করার পর আমার কি কোনো লাভ হবে? যদি এই প্রশ্নর উত্তর না জানা থাকে, তবে সেই কাজ করা থেকে বিরত থাকো।
এই কথায় জীবসিদ্ধি প্রচণ্ড চমকে গিয়েছিল। সেইদিন সে চলে যায়নি, বসে শুনেছিল চাণক্যর কথা। তারপর কয়েক দিনের মধ্যেই নিজের আয়ুর্বেদ অধ্যয়নের আশ্রম ছেড়ে চাণক্যর আশ্রমে নাম লিখিয়েছিল। এখানেই সে পরিচিত হয়েছিল পুরুষদত্ত, অক্ষয়, আদিত্য এবং চন্দ্রগুপ্তর সঙ্গে। ধীরে ধীরে সে আর শশাঙ্ক জানতে পেরেছিল যে এই কয়েকজন ছাত্র চাণক্যর বিশেষ কাছের বৃত্তর ছাত্র। জীবসিদ্ধি আর শশাঙ্কও সময়ের সঙ্গে সেই বৃত্তর অন্তর্গত হয়ে পড়ে। জানতে পারে চাণক্যর গোপন উদ্দেশ্যর কথা
আচার্য এই ভূমির সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যর পতন করে নতুন সাম্রাজ্য স্থাপন করতে চান। তাই সম্রাট হিসেবেই চন্দ্রগুপ্তকে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। অন্য কেউ এরকম অসম্ভব পরিকল্পনা করছে শুনলে জীবসিদ্ধি তাকে উন্মাদ বলত। কিন্তু সে বুঝেছিল, এই ব্রাহ্মণ কোনো সাধারণ শিক্ষক নয়। তার দেখা সবচেয়ে বুদ্ধিমান ব্যক্তি এই মানুষটি। এঁর পক্ষে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।
এরপর চাণক্য তাদেরকেও যুদ্ধকলা, রাজনীতি এবং গুপ্তচর বৃত্তির প্রশিক্ষণ দেন। তবে আর কেউ চাণক্যর উদ্দেশ্য অনুমান করতে না পারলেও, বিশ্ববিদ্যালয়ে দু-জন কিন্তু ঠিকই আন্দাজ পেরেছিল। প্রথমজন প্রধানাচার্য ভদ্রভট্ট, যিনি সমর্থন জানিয়েছিলেন আচার্যকে এবং দ্বিতীয়জন হলেন আচার্য শঙ্কমনী, যাঁকে ছাত্ররা বলত আচার্য ‘শকুনি’। এই লোকটি প্রথম থেকেই চাণক্যর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এসেছেন। তিনি বহুবার চেষ্টা করেছিলেন এই ছয় ছাত্রর থেকে সত্য কথা বের করতে। কিন্তু তিনি পারেননি। এই আচার্য পরবর্তীকালেও চাণক্যর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলেন। সফল হননি।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোনোর পর জীবসিদ্ধি বেশ কয়েক বছর নন্দ শাসিত মগধে থেকে গুপ্তচরের কাজ করেছিল। সে ছিল শত্রু শিবিরে আচার্যর বিশ্বস্ত চোখ-কান। চন্দ্রগুপ্ত আজ সম্রাট হলেও, সবার চোখের আড়ালে আজও এই ছয় জন ছাত্র গুরুভাই। প্রত্যেকে আজ বিভিন্ন রাজকার্যে নিযুক্ত। কিন্তু জীবসিদ্ধি চাণক্যর সবচেয়ে বিশ্বস্ত হওয়ায় সে আজকাল তাঁর ছায়াসঙ্গী। এই মানুষটার সান্নিধ্যে রোজই কিছু-না-কিছু নতুন শিখতে পারা যায়।
আজ এত বছর পরে আবার গান্ধার রাজ্যে এসে এইসব ফেলে আসা কৈশোরের স্মৃতিই মনে আসছিল জীবসিদ্ধির। তাকিয়ে দেখল চাণক্য মধুর পাত্র থেকে চোখ তুলে তার দিকে চেয়ে আছেন এবং মিটিমিটি হাসছেন।
—আপনি হাসছেন কেন, আচার্য?
—ছাত্রজীবন আর গুপ্তচরবৃত্তির দিনগুলো নিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে তুমি। সেই দেখেই হাসছি।
—তা ঠিক। কিন্তু আপনি কীভাবে বুঝলেন আমি কী ভাবছি?
—ভাবনার মাঝে তুমি নিজের অজান্তেই একবার হাতের লোহার বালাটা ছুঁলে। ওটা আমি আমার ছ-জন ছাত্রকে উপহার দিয়েছিলাম তোমাদের ছাত্র অবস্থায়। এর থেকে অনুমান করলাম তুমি নিজের কৈশোরের দিনগুলোর কথা ভাবছ।
—বেশ। তারপর?
—এরপর তুমি ভাবনার মধ্যেই নিজের ঘাড়ের কাছের পুরোনো ক্ষতটায় হাত দিলে। যেদিন গুপ্তচরবৃত্তি করতে গিয়ে সৈনিকদের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছিল সেদিন তোমার এই ক্ষতটা হয়। এক সৈনিকের ছোড়া বল্লমের আঘাতে তোমার ঘাড়ে জখম হয়েছিল, তা আমি জানি। এর থেকে অনুমান করা যায় যে তুমি নিজের গুপ্তচরবৃত্তির সময়কার কথা ভাবছ। ওই ক্ষত তোমার শরীরে সেই সময়কার নিশান হিসেবে রয়েছে।
—আগে আপনার এই যুক্তিনির্ভর অনুমানগুলো শুনে চমৎকৃত হতাম। – আজকাল হও না?
হেসে জীবসিদ্ধি উত্তর দিল,
—তা আজও হই বটে।
হেসে উঠল গুরু শিষ্য। জীবসিদ্ধি প্রশ্ন করল,
—আপনার মনে কি পুরোনো স্মৃতি ফিরে আসছে না, আচার্য?
—আসছে। তবে অতীতে ডুবে থাকা আর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হওয়া, দুটোই মূর্খদের লক্ষণ। বুদ্ধিমান মানুষের কাছে শুধুই বর্তমানের গুরুত্ব আছে। এবং সত্যি বলতে আমি এই মুহূর্তে বর্তমান সমস্যা নিয়ে চিন্তিত।
—ঠিকই বলেছেন। আমিও অনুমান করতে পারছি না যে কী বিপদের কথা বলতে চেয়েছেন আচার্য প্রমুখ। তবে কালই তো সেকথা জানতে পারব। আজ রাত হল, বিশ্রাম নিন, আচার্য।
—হ্যাঁ। আমি নিজের তাঁবুতে চললাম। তুমিও বিশ্রাম নাও।
—শুভরাত্রি, আচার্য।