আমাদের ইশকুল, আমাদের গোরস্থান

আমাদের ইশকুল, আমাদের গোরস্থান

আমি কেমন ইশকুল চাই, তা আলোচনা করার আগে আমার একটি ইশকুল পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা আপনাদের জানাতে চাই। ২০১৯ সালের দিকে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমি ঢুকেছিলাম। ইশকুলটির উল্টো দিকে ছিলো আমার বাসা। সকাল সাড়ে নয়টা থেকে ইশকুল। ইশকুলে যাওয়ার জন্য রাস্তা পার হতে গিয়ে দেখি অনেকগুলো ট্রাফিক পুলিশ। এর আগে মেলবোর্নে ট্রাফিক পুলিশ দেখিনি। তাহলে আজ হঠাৎ ট্রাফিক পুলিশ কেন? খোঁজ নিয়ে জানলাম- কোনো রাস্তার পাশে ইশকুল থাকলে, ওই ইশকুল খোলা এবং ছুটি হওয়ার সময় ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করে থাকে। তারা বাচ্চাদেরকে হাত ধরে ধরে রাস্তা পার করায়।

তাকিয়ে দেখলাম, এটি এক অসাধারণ দৃশ্য। এক-দুইজন নয়, প্রায় দশ-বারো জন পুলিশ! একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের রাস্তা পার করাতে প্রতিদিন তারা সকাল ও দুপুরে হাজির হচ্ছেন— এটি ভাবতেই আমার খুব আনন্দ হলো। আমি পুলিশের সাজসজ্জার দিকে একটু তাকালাম। দেখলাম, কোনো মারণাস্ত্র তাদের কোমরে নেই। গায়ে উজ্জ্বল জ্যাকেট। হাতে একটি আলো-জ্বলা প্লাস্টিকের লাঠি। লাঠির আলো দিয়ে গাড়ি থামাচ্ছেন। গাড়ি চালকরা ইশারা পাওয়া মাত্রই থেমে যাচ্ছেন। বাচ্চারা কী নির্ভয়ে, কী উৎফুল্ল মনে পুলিশের হাত ধরছে, তা দেখে আমার বাংলাদেশের কথা মনে হতে লাগলো। পেটের ভেতর একটি আফসোসের আগুন কুল্লি দিয়ে উঠলো

ইশকুলে ঢুকেই দেখি মাছের হল্লার মতো শিশুদের হল্লা। শিক্ষকরা তাদের সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছেন। মাঠের নানা স্থানে জটলা। কোনো শিশুর হাতেই বই-খাতা নেই। বইয়ের কোনো ব্যাগ তাদের পিঠে নজরে পড়লো না। তাহলে কি তারা বইপত্র পড়ে না?

জিগ্যেস করে জানলাম – তারা বইপত্র পড়ে, কিন্তু বই-খাতা কখনো ইশকুলের বাহিরে নিয়ে যায় না। ইশকুলের ভেতর প্রতিটি শিশুর নিজস্ব ড্রয়ার আছে, যেগুলোতে ওরা বই-খাতা রেখে যায়। ইশকুলের বই বাসায় পড়ার কোনো প্রথা এখানে নেই। ইশকুলের পাঠ ইশকুলেই শেষ করা হয়। তারা খালি হাতে আসে, খালি হাতে ফেরে। শুধু তাদের হৃদয়টি, পড়া ও হাসি দিয়ে ভরপুর থাকে।

ভবনটির দিকে চোখ গেলো। দেখলাম আধুনিক স্থাপত্যরীতির সাথে গথিক ও ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যরীতির অসাধারণ মিলন। মনে হয় কোনো রাজার বাড়ি। মাঠে খেলতে থাকা শিশুরা এ বাড়ির মেহমান। মাঠটির কোথাও কোনো কাদা নেই, ছাল-ওঠা দূর্বা নেই। তিনজন শিক্ষক শিশুদের সাথে ‘যেমন খুশি তেমন সাজ’ ভঙ্গিতে কসরত করছেন। তাদের একজনের পেটে কাগজের তৈরি একটি সামুদ্রিক মাছ, এবং আরেকজনের পেটে বেলুনের তৈরি একটি কোয়ালা ঝুলছে। তারা এগুলো পরে নৃত্য করছেন, আর শিশুরা একটু পরপর হাসিতে ফেটে পড়ছে।

ভবনটিতে ঢুকলাম। দেখি, এমন অনেক কিছুই আছে যা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও নেই। প্রিন্সিপাল বললেন — আসুন, আপনাকে একটু ঘুরিয়ে দেখাই। শিশুরা ততোক্ষণে ভবনে ঢুকে পড়েছে।

আমাকে প্রথম যে কক্ষটিতে নেয়া হলো, সেটিতে কোনো চেয়ার- টেবিল নেই। মেঝেতে পরিষ্কার কার্পেট। বাচ্চারা কেউ মেঝেতে বসে, কেউ দাঁড়িয়ে শিক্ষকের কথা শুনছে। শিক্ষকের জন্যও কোনো টেবিল নেই শুধু বসার জন্য একটি চেয়ার আছে। চেয়ারের এক কোণে বসে তিনি শিশুদের সাথে গল্প করছেন। গল্পে গল্পে নানা বিষয় তিনি শিশুদের মাথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। শিক্ষকের পেছনের দেয়ালে কয়েকটি হোয়াইট বোর্ড। বাম পাশে একটি স্ট্যান্ডিং বোর্ডও আছে। হোয়াইট বোর্ডগুলো এবং কক্ষের দেয়ালগুলো, ভরে আছে নানা স্টিকারে। এ স্টিকারগুলোতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে প্রাণিজগতের নানা দিক, মহাকাশের নানা খণ্ড। দেয়ালের স্থানে স্থানে প্রচুর পোস্টার নজরে পড়লো। বাচ্চাদের আঁকা নানা ছবি চকচক করছে পোস্টারগুলোতে। শিক্ষক মাঝে মাঝে চেয়ার ছেড়ে এসে মেঝেতে বসছেন, এবং নিজেই শিশু হয়ে উঠছেন।

আরেকটি কক্ষে ঢুকলাম। দেখলাম — শিক্ষক গিটার বাজিয়ে গান গাইছেন আর শিশুরা দলবেঁধে ওই গানের সাথে কোরাস মেলাচ্ছে। হঠাৎ গান বন্ধ করে তিনি একটি ছবি বের করলেন। ছবিটি বাচ্চাদের দেখিয়ে জিগ্যেস করলেন, তোমরা কি তাকে চেনো? বাচ্চারা মাথা নাড়ল – না, চিনি না। শিক্ষক বললেন, তিনি মোজার্ট। বাচ্চারা বললো- ওওও! শিক্ষক আবার গান শুরু করলেন, এবং দুই মিনিট পর আরেকটি ছবি বের করলেন। জিগ্যেস করলেন, এটা কী জিনিস তোমরা জানো? একজন দাঁড়িয়ে বললো, ইট লুকস লাইক আ ম্যাপ। শিক্ষক বললেন— তোমার অনুমান ঠিক। এটি লাতিন আমেরিকার ম্যাপ। এই বলে তিনি আবার গান শুরু করলেন।

আমি বেরিয়ে অন্যে একটি কক্ষের দিকে গেলাম। প্রিন্সিপাল বললেন, এটি আমাদের রান্নাঘর। শিশুরা এখানে নানা রকম খাবার তৈরি করে থাকে। কীভাবে নিজের খাবার নিজে প্রস্তুত করতে হয়, তা একজন শিক্ষক শিশুদেরকে হাতে-কলমে শেখান। কোন খাবারের পুষ্টিমান কেমন, কীভাবে রান্না করলে খাবারের পুষ্টিগুণ ভালো থাকে, তা-ও এখানে বুঝিয়ে দেয়া হয়। রান্নাঘর কীভাবে পরিষ্কার রাখতে হবে, রান্নার বর্জ্য কোথায় ফেলতে হবে, রান্নাঘরের নিরাপত্তা কেমন হওয়া উচিত, তা শিশুরা এখানেই শিখে ফেলে। এতে তারা রাঁধুনি বা বেকিং মাস্টার হয় না, কিন্তু রান্নাবান্না ব্যাপারটির সাথে তাদের একটি সম্পর্ক তৈরি হয়। এটি আমাদের ‘হেলথ অ্যান্ড লাইফ স্কিল’ কোর্সের অংশ।

আমি আনন্দিত হলাম। বুঝতে পারলাম, কেন তারা বড়ো হয়ে কোনো কাজকেই ছোটো মনে করে না। ছোটো কাজ বলে যে পৃথিবীতে কিছু আছে, এ ধারণাটির সাথেই তারা পরিচিত নয়।

আরেকটি কক্ষে দেখলাম আট-দশটি টেবিল। টেবিলগুলোর চারপাশে একজন করে শিক্ষক, আর তিন-চারজন করে ছাত্র বসে আছে। একটি টেবিলে শিক্ষক তার পাশে বসা ছাত্রদের জিগ্যেস করছেন— তোমাদের মধ্যে কে বলতে পারবে, আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কাজ কী? একটি ছাত্র হাত তুললো। সে বললো, আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কাজ আমেরিকার শিশুদের দেখভাল করা। শিক্ষক হাসলেন। আরেকটি টেবিলে দেখলাম, শিক্ষক তার পাশে বসা শিশুদের খাতা মূল্যায়ন করছেন। শিশুরা কিছু জিনিস লিখে এনেছে, আর শিক্ষক তা পড়ে পড়ে মতামত দিচ্ছেন। আমরা যেটিকে হোম-ওয়ার্ক বলি, সেটি ওখানে ইশকুল-ওয়ার্ক।

একটি কক্ষে দেখলাম প্রজেক্টরের সাহায্যে ভিডিও দেখানো হচ্ছে। বাচ্চাদের সবার হাতেই আইপ্যাড। প্রিন্সিপাল জানালেন, এই আইপ্যাড ইশকুল থেকেই দেয়া হয়। এগুলো বিশেষভাবে কাস্টমাইজড করা, যেন বাচ্চারা খেলাচ্ছলে নানা বিষয়ে ধারণা পেতে পারে। সাগরে কী কী প্রাণী আছে বা আমাজন জঙ্গলে কোন কোন আদিবাসী আছে, তার ধারণা ভিডিওর মাধ্যমে দেয়া অধিক সহজ। এ প্রক্রিয়ায় মহাকাশ সম্পর্কেও ভালো ধারণা দেয়া যায়। জাতিসংঘ অধিবেশনের কিছু ভাষণও আমরা শিশুদেরকে এভাবে শুনিয়ে থাকি। নতুন প্রযুক্তি, নতুন যন্ত্রপাতি, এগুলোর সাথেও এ প্রক্রিয়ায় পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়।

আমি একটু টয়লেটে যেতে চাইলাম। টয়লেটে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিলো না, কিন্তু ইশকুলটির টয়লেট দেখতে কেমন তা জানার জন্যই এ অভিনয়টুকু করা। দেখলাম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে টয়লেট। প্রস্রাব করার জন্য ইউরিন্যালও আছে। আছে ঠান্ডা এবং গরম উভয় ধরনের পানি। কমোডের ফ্ল্যাশ খুবই সক্রিয়। প্রতিটি টয়লেটেই পর্যাপ্ত টিস্যু পেপার রয়েছে। টয়লেটটিই আমাকে জানিয়ে দিলো, ইশকুলটি খারাপ নয়।

প্রিন্সিপালের কক্ষে যাওয়ার পথে একটি মজার কক্ষ নজরে এলো। ওখানে ইনকিউবেটরের মাধ্যমে মুরগির বাচ্চা ফুটানো হচ্ছে! অনেক শিশুর ভিড়। শিশুরা মুরগির বাচ্চা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। একজন শিক্ষক শিশুদেরকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, কী প্রক্রিয়ায় ডিম থেকে বাচ্চা বেরিয়ে আসে। একটি শিশু প্রশ্ন করলো, আমরাও কি এভাবে ডিম ফুটে বের হয়েছি? শিক্ষক বললেন— না, তোমরা অন্যভাবে বের হয়েছো। তবে ওই প্রক্রিয়াটিও তোমাদেরকে শীঘ্রই শেখানো হবে।

প্রিন্সিপাল আমাকে ইশকুলের বাগানে নিয়ে গেলেন। সুন্দর ছিমছাম বাগান। ওখানে একজন গার্ডেনিং ইনস্ট্রাক্টর, কীভাবে গাছ রোপণ করতে হয়, কীভাবে গাছের পরিচর্যা করতে হয়, মাটি কীভাবে প্রস্তুত করতে হয়, গাছের উপকারিতা কী, বাড়ির পেছনে কীভাবে বাগান বানাতে হয়, এ বিষয়গুলো শিশুদেরকে বুঝিয়ে ও দেখিয়ে দিচ্ছেন।

এর মধ্যে সাড়ে এগারোটা বেজে গেলো। সাড়ে এগারোটা থেকে বারোটা পর্যন্ত ইশকুলের স্ন্যাক্স ব্রেক, অর্থাৎ হালকা খাবার খাওয়ার ছুটি। দেড়টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত মধ্যাহ্নভোজের ছুটি, এবং তিনটায় পুরো ইশকুল ছুটি। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর ছবি কোথাও নজরে পড়লো না। প্রতিটি কক্ষে শীতাতপ যন্ত্র লাগানো। পুরো মাঠে একধরনের নরোম কার্পেটিং করা।

স্ন্যাক্স ব্রেকের পর আমি কিছুক্ষণ প্রিন্সিপালের সাথে গল্প করলাম। প্যারেন্টস ডে, ক্যাম্পিং ডে, ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাস, ফিজিক্যাল এজুকেইশোন, মিউজিক ক্লাস— এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা হলো। ‘ক্যাম্পিং ডে’-তে শিশুদেরকে কীভাবে দাঁত ব্রাশ করা শেখানো হয়, এটিও জানা হলো। কোথায় কোথায় শিশুদেরকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হয়, লাইফ স্কিলগুলো কীভাবে চর্চা করানো হয়, এ নিয়েও অনেক কথা হলো।

প্রতিটি বিষয়ের জন্য তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপকদের পরামর্শক হিশেবে রেখেছেন। ওই পরামর্শকেরা প্রায়ই ভিডিও কনফারেন্সে শিশুদের সাথে কথা বলেন। শিক্ষকদের তারা দিকনির্দেশনা দেন— কীভাবে কোন ক্লাসটি নিতে হবে।

‘ধর্ম শিক্ষা’ নামে কোনো সাবজেক্ট আছে কি না, এমন প্রশ্ন করতে তিনি জানালেন— শিশুদের ধর্ম শেখানো ইশকুলের কাজ নয়। এটি পরিবারের বিষয়। আমি বললাম, আমাদের ইশকুলে ‘ধর্ম শিক্ষা” নামে সাবজেক্ট আছে। প্রিন্সিপাল বললেন— দেখুন, আপনি যদি কোনো শিশুকে বলেন ‘মিথ্যা বলা পাপ’, ‘চুরি করা পাপ’, তাহলে আপনি কিন্তু শিশুটিকে ‘মিথ্যা’ ও ‘চুরি’— এ দুটি জিনিসের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। যে শিশু ‘মিথ্যা কী’, ‘চুরি কী’ তা জানত না, তাকে আপনি এগুলো শিখিয়ে দিচ্ছেন। শিশুরা কৌতূহলী। ধর্মের বই যখন বলবে ‘মিথ্যা বলা পাপ, তখন শিশুটি মিথ্যার ব্যাপারে কৌতূলী হয়ে উঠবে। এ জন্য এ বিষয়গুলোর সাথে শিশুদেরকে ওই বয়সে পরিচয় করাতে নেই। আপনাদের দেশে দুর্নীতি কেমন?

আমি খুব লজ্জা পেলাম। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, প্রিন্সিপালের এমন প্রশ্নের অর্থ কী। আমি ভগ্নমনে ইশকুল থেকে বেরিয়ে এলাম, এবং মনে মনে খুঁজতে লাগলাম আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়টিকে। আমাদের অতো টাকা নেই, কিন্তু সৌন্দর্যের সাথে, একটি ভালো পরিবেশের সাথে, টাকার সম্পর্ক ঠিক কতোটুকু? মেলবোর্নের ওই ইশকুলটিতে যা যা শেখানো হয়, তা কি বাংলাদেশের কোনো ইশকুলে শেখানো সম্ভব নয়? আমার মনে হয় খুবই সম্ভব। শুধু আমাদের জীর্ণ শিক্ষা পদ্ধতিটিকে একটু লাথি মারতে হবে।

এই মুহূর্তে আমার গ্রামে যে প্রাথমিক বিদ্যালয়টি আছে, সেটিকে দেখলে মনে হবে- একটি প্রকাণ্ড ইট কিছু খুপরি নিয়ে মুখ উল্টে পড়ে আছে।

বহু টাকা ব্যয় করে সম্প্রতি এটিকে বানানো হয়েছে। আমার জীবনে এরকম কুৎসিত ভবন আর দেখিনি। ভবনটি দেখে মনে হয় না যে বাংলাদেশে কোথাও আর্কিটেকচার বিষয়টি পড়ানো হয়। এই মুহূর্তে দেশের যেকোনো গ্রামে গেলে এই কুৎসিত ভবনটির দেখা মিলবে। কে বা কারা এই বাকসো আকৃতির ইশকুল সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিয়েছে আমি জানি না। সম্ভবত স্বর্গবিতাড়িত শয়তান এটি নিজ হাতে ডিজাইন করেছে। শয়তান হয়তো প্রার্থনা করেছিলো— হে ঈশ্বর, মহাবিশ্বের সবকিছুই তো আপনি সৃষ্টি করেছেন, আমাকে কিছু একটা সৃষ্টি করার সুযোগ দিন। প্রার্থনাটি কবুল হওয়া মাত্রই শয়তান, বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে এই কুৎসিত ভবন সৃষ্টি করলো।

এর একটি লোহার গেইট রয়েছে, যেটিতে লেখা— অমুক মেম্বার গেইটটি দান করেছেন! গেইটটি দেখলে মনে হবে, চোরের আতংকে বানানো কোনো পশুর খোঁয়াড়ের গেইট। ওই গেইট দিয়ে শিশুরা ইশকুলে প্রবেশ করছে, এটি আমি কল্পনাও করতে পারি না। গেইটটি অত্যন্ত অমর্যাদাকর। কোনো মন্ত্রী ওই গেইট দিয়ে ঢুকতে চাইলে ঢুকুক, কিন্তু শিশুদের আমি ওই গেইট দিয়ে ঢুকতে দিতে রাজি নই।

পুরাতন ভবনটিকে না ভেঙে (পুরাতন ভবনটি এর চেয়ে অনেক সুন্দর ছিলো), ইশকুলের মাঠের উপরই নির্মাণ করা হয়েছে নতুন ভবন, যা মাঠটিকেই খেয়ে ফেলেছে। মাঠের পশ্চিম দিকে করা হয়েছে দুটি টয়লেট, যেগুলোকে দেখলে মনে হবে— কাকতাড়ুয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে দুটি পায়খানার ডিব্বা। ডিব্বার দরজায় লেখা— ‘শিক্ষকদের জন্য’ ‘ছাত্রদের জন্য’!

ইশকুলের প্রধান শিক্ষক গতবছর মাঠের মধ্যেই নির্মাণ করেছেন একটি শহিদ মিনার। তার কাছে নাকি উপর থেকে নির্দেশ এসেছিলো— যেভাবেই হোক শহিদ মিনার নির্মাণ করতে হবে! শহিদ মিনার নির্মাণ করার পর দেখা গেলো, একপাল কুকুর প্রতিদিন মিস্ত্রীকর্মটির বেদিতে বিশ্রাম নিচ্ছে! শহিদ মিনারটি ইশকুলের কী উপকার করলো জানি না, তবে কুকুরদের অশেষ উপকার করেছে। ঝোপে-ঝাড়ে ঘুমিয়ে তারা হাঁপিয়ে উঠেছিলো।

শিক্ষকেরা ক্লাসে ঢুকেই একটি হাঁক দেন, আর ব্ল্যাকবোর্ডে চক ঘষতে থাকেন। ওই ঘষায় চকের মুখের সাথে ব্ল্যাকবোর্ডের একটি সংঘর্ষ তৈরি হলেও, সংঘর্ষটি আসলে কী নিয়ে তা ছাত্ররা কেউ বুঝতে পারে না। ছাত্ররা আদিম বেঞ্চিতে বসে কেবল হাঁসফাঁস করতে থাকে। মাঝেমধ্যে শিক্ষকের দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকায়, আর কয়েদির মতো প্রার্থনা করে মুক্তির।

একগাদা বই নিয়ে তারা ইশকুলে আসে। ইশকুল থেকে যখন বাসায় ফেরে, তখনো তাদের ঘাড়ে ইশকুলটি ভূতের মতো চেপে থাকে। সারারাত এ ভূত তাদের মগজে চাবুক মারতে থাকে। একটি শিশু এতো বই পড়ে কী করবে? ইশকুলের কাজ কি শুধুই বই পড়ানো? কাউকে পড়তে বললেই কি সে পড়ে ফেলে? যারা এতো বই পড়ে না, বা কোনো বই-ই পড়ে না, তারা কি প্রকৃতিতে টিকে থাকে না?

একজন প্রধান শিক্ষক জানালেন, তিনি নিজেও জানেন না কেন এতো বই পড়ানো হয়। এখন যেভাবে ইশকুল চালানো হচ্ছে, সেটি যে ইশকুল চালানোর কোনো ভালো প্রক্রিয়া হতে পারে না, এ ব্যাপারেও তিনি একমত পোষণ করলেন। ইশকুলের ভবন এবং পরিবেশ নিয়েও তিনি সন্তুষ্ট নন। তার মতে, এরকম কুৎসিত ইটের দালানের চেয়ে বিক্রমপুর এলাকায় কাঠ দিয়ে যে বাড়ি তৈরি করা হয়, সেগুলো দেখতে অনেক সুন্দর। এ ভবনটি ভেঙে, বড়ো করে ওরকম একটি কাঠের বাড়ি বানালেও ভালো লাগতো। শিশুরা আনন্দ পেতো। এই সিমেন্টের খুপরিটি শিশুদের উপযুক্ত নয়। শিশুরা দম বন্ধ পরিবেশ সহ্য করতে পারে না। তাদের সম্পর্ক যতোটা না মাটির সাথে, তার চেয়েও বেশি আকাশের সাথে। বাতাস তারা টেনে নিতে চায় না। তারা চায়, বাতাস নিজেই এসে তাদের নাকে ঝাপটা দিক।

ইশকুলটির টয়লেটের ভেতর ঢুকলে মনে হয়, দোজখের কোনো সুড়ঙ্গ বুঝি কেউ খুলে রেখেছে। ডিভাইন কমেডির ঘ্রাণে মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। শিশুরা ধরে নিয়েছে, টয়লেট বুঝি এরকমই হয়। পায়খানার ভেতর পোকা কিলবিল করবে, ওই পোকা ধীরে ধীরে শিশুদের পা বেয়ে উপরে উঠবে, এটিই হয়তো টয়লেটের নিয়ম।

শুনেছি, ইশকুল থেকে শিশুদের বিস্কুট খাওয়ানো হচ্ছে। এটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু ইশকুলের কাজ বিস্কুট খাওয়ানো নয়। ইশকুলের কাজ, কীভাবে বিস্কুট বানাতে হয় তা শিশুদের মগজে ঢুকিয়ে দেয়া। বিস্কুটের উপাদান কী, বিস্কুট খেলে কী কী উপকার ও অপকার হয়, বিস্কুটের কাঁচামাল কোথা থেকে আসে, ওই কাঁচামাল কীভাবে জমিতে ফলাতে হয়, এ বিষয়গুলো শিশুদেরকে গল্পে গল্পে জানিয়ে দেয়া।

ইশকুলটির যে দেয়ালেই তাকাই, সে-দেয়ালেই লেখা— “শিক্ষার আলো, ঘরে ঘরে জ্বালো’। কিন্তু আলো জ্বালাতে যে দিয়াশলাই দরকার, এ কথা সবাই ভুলে গেছেন। ইশকুলগুলোর সুযোগ ছিলো দিয়াশলাই হওয়ার, আর শিক্ষকদেরও সুযোগ ছিলো দিয়াশলাইয়ের কাঠি হওয়ার। কিন্তু শিক্ষার মালিকেরা দিয়াশলাই ছাড়াই আলো জ্বালাতে চান। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে ভুলভাল আলো। এই আলো অন্ধকে আরো অন্ধ করে দিচ্ছে। বধিরকে আরো বধির করে দিচ্ছে।

এই আলো না পেলে কেউ হয়তো কৃষিকাজ করতো, মাছ চাষ করতো, গরু পালন করতো। কিন্তু ভুল শিক্ষার ভুল আগুনে পুড়ে তারা সবাই পাড়ি জমাচ্ছে ঢাকা। শহর নামক বস্তিগুলোতে লোক সরবরাহ করাই এখন ইশকুলগুলোর প্রধান কাজ।

এরকম ইশকুলকে আমি ইশকুল না বলে বলবো পচা শামুক। এগুলোতে ঢুকলেই শিশুদের পা কেটে যায়। যে শিশুর পা কেটে গেছে, তার কাছ থেকে আমরা কী আশা করবো?

শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা যে শুধু চাকরি করতে চায়, এর প্রধান কারণ— তাদের পা কাটা। চাকরি ছাড়া অন্য কোনো কাজের জন্য তারা উপযুক্ত নয়। এজন্য এ পা-কাটারা বছরের পর বছর ধরে বেকার থাকে। এদের যদি বলা হয়, তুমি একটি বেকারি শুরু করো, তাহলে ওরা বলবে – নো নো নো! এতো পড়ালেখা করেছি কি বনরুটি বিক্রি করতে? কিন্তু ইশকুলগুলো যদি প্রকৃত আলো জ্বালাতো, তাহলে এতো পা-কাটা অন্ধ মানুষ তৈরি হতো না।

চাকরিতে শ্রেণী প্রথাটি কে বা কারা টিকিয়ে রেখেছে জানি না, তবে ইশকুলে যারা পড়ান, তাদের শ্রেণী নাকি তৃতীয়! থানার ওসি প্রথম শ্ৰেণী, ডিসি প্রথম শ্রেণী, কৃষি অফিসার প্রথম শ্রেণী, পশু চিকিৎসক প্রথম শ্রেণী, কিন্তু ইশকুলের শিক্ষক তৃতীয় শ্রেণী! এটি প্রমাণ করে, শিশুদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা কতো তীব্র! আমরা প্রথম শ্রেণী, আর আমাদের বুকের মানিকদের ভেতর যারা আলো জ্বালবেন, তারা তৃতীয় শ্রেণী, আহা!

তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষক থেকে যে প্রথম শ্রেণীর আলো পাওয়া যায় না, তা প্রতিদিনই টের পাচ্ছি। চারপাশে তাকালে যা দেখি, তা সবই তৃতীয় শ্রেণীর। আমাদের দোকানগুলোতে যা পণ্য পাওয়া যায়, তা তৃতীয় শ্রেণীর। আমাদের রেস্তোরাঁগুলোর খাবার ও তার পরিবেশ তৃতীয় শ্রেণীর। আমাদের ধর্মকর্ম তৃতীয় শ্রেণীর। আমাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা তৃতীয় শ্রেণীর। আমাদের সৌন্দর্যবোধ তৃতীয় শ্রেণীর। আমাদের হাসপাতাল তৃতীয় শ্রেণীর। আমাদের পত্রিকা তৃতীয় শ্রেণীর। আমাদের টিভি চ্যানেল তৃতীয় শ্রেণীর। আমাদের সততা তৃতীয় শ্রেণীর। আমাদের চিন্তা তৃতীয় শ্রেণীর। অর্থাৎ প্রথম শ্রেণীর টেলি সামাদরা ছাড়া, আমাদের চারপাশে যা কিছু দেখা যায়, তার সবই তৃতীয় শ্রেণীর।

কয়েকজন শিশুকে জিগ্যেস করেছি, ইশকুল থেকে তোমাদের কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হয় কি না? তারা বলেছে, ইশকুল ঘুরতে নিয়ে যাবে কেন? আমরা নিজেরাই তো ক্ষেত-খামারে ঘুরি। অর্থাৎ ইশকুল যে শিশুদের কোথাও ঘুরতে নিয়ে যেতে পারে, এ ধারণাটাই শিশুদেরকে দেয়া হয়নি। শহরের শিশুরা তো ক্ষেত-খামার দেখারও সুযোগ পায় না।

একটি বন কীভাবে কাজ করে, বনের প্রাণীদের সাথে গাছপালার সম্পর্ক কী, তা এ শিশুরা জানে না। অনেক শিশুই ইশকুল থেকে ফিরে এখন পাখির ভাসা ভাঙছে। পাখি কী, পাখিদের সাথে আমাদের আত্মীয়তা কেমন, পাখিদের বাঁচিয়ে রাখা জরুরি কি না, তা ইশকুলগুলো শিশুদেরকে শেখাচ্ছে না। কীভাবে একটি গাছ ও গরুর যত্ন নিতে হয়, তা আমাদের কিশোররা রপ্ত করে নি। শিক্ষার মালিকেরা কিছু কথা বইয়ে লিখে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছে। এ মালিকদের কারও সন্তান কিন্তু এ ইশকুলগুলোতে পড়ে না।

শিশুদেরকে স্বাস্থ্যসচেতন করার কোনো উদ্যোগও ইশকুলদের নেই। শিল্প-সংস্কৃতির সাথে পরিচয় তো আরও নেই। কৃষি এবং পরিবেশের প্রতি মমতা তৈরি হয়, এমন কার্যক্রমও কারিকুলামে অনুপস্থিত। নিজের অঙ্গ- প্রত্যঙ্গগুলোর ব্যাপারেও তারা অন্ধকারে আছে। কিছু অঙ্গ নিয়ে তো তাদের কৌতূহলের সীমা নেই। ইশকুলগুলোর উচিত— এ অঙ্গগুলোর ব্যাপারে শিশুদেরকে সত্য বলা।

আমাদের অর্থনীতি আমদানিনির্ভর, এবং ভূমি কৃষিপ্রধান। আমদানি কমানো ও কৃষিজমির সদ্ব্যবহার— এ দুটি বিষয়কে ইশকুলে প্রাধান্য দেয়া উচিত ছিলো। কিন্তু এ দিকে কেউ ভ্রূক্ষেপই করেনি। বরং শিশুরা যেন বড়ো হয়ে কোনোদিন কৃষিকাজই না করে, সে ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়েছে। ব্যবসা ও শিল্পায়ন বিষয়ে ইশকুলগুলো শিশুদেরকে কোনো ধারণাই দিচ্ছে না। ফলে শিশুরা শুধু চাকরির স্বপ্ন নিয়েই বড়ো হচ্ছে।

এ জন্য আমার প্রস্তাব হলো, বর্তমান ইশকুলগুলোকে বিক্রি করে, অথবা ভেঙে ফেলে, নতুন ইশকুল নির্মাণ করতে হবে। ইশকুল হতে হবে ইশকুলের মতো, যেটি বন্ধ হলে শিশুরা সেটিকে খুলে দেয়ার জন্য চিৎকার করবে। করোনায় প্রায় দুই বছর ইশকুল বন্ধ ছিলো, কিন্তু কোনো শিশু চিৎকার করে বলেনি- আমি ইশকুলে যেতে চাই। কারণ শিশুটি জানে, ওই ইশকুল একটি অভিশাপ। ওখানে গেলেই তার দম বন্ধ হয়ে আসবে।

ইশকুল নির্মাণ করার সময় সৌন্দর্যকে প্রাধান্য দিতে হবে। ভালো মানের আর্কিটেক্ট দিয়ে ইশকুলের ডিজাইন করাতে হবে। প্রয়োজনে টিন এবং কাঠ দিয়ে দৃষ্টিনন্দন দেশীয় ভবন তৈরি করা যেতে পারে। কুৎসিত দালানের চেয়ে চোখ জুড়ানো টিনের ঘর ভালো। তবে যে টাকা দিয়ে অশ্লীল ইটের ইশকুল বানানো হচ্ছে, সে টাকা দিয়েই নান্দনিক পাকা ভবন নির্মাণ করা সম্ভব। কয়েকজন প্রকৌশলী আমাকে জানিয়েছেন, সরকার চাইলে খরচ না বাড়িয়েই সুন্দর ডিজাইনের ইশকুল তৈরি করা যাবে, যদি দুর্নীতি রুখা যায়।

একেকটি ইশকুলের ডিজাইন হবে একেক রকম। একই ডিজাইনের বিরক্তিকর ইশকুল উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিদেশি কোনো ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। দেশীয় ঠিকাদারদের তৈরি ইশকুল দেখতে দেখতে আমরা বিরক্ত। ইট, সিমেন্ট, রড, রং—এমন কোনো উপকরণ নেই যে উপকরণটি তারা ভালো মানের ব্যবহার করেছেন। তাদের লক্ষ্যই হলো, কোনোরকমে একটি বিল্ডিং গছিয়ে দিয়ে বিল হাতিয়ে নেয়া। এ কাজে সরকারি স্যারগণ ঠিকাদারকে উদারহস্তে সহযোগিতা করে থাকেন। এতে উভয় দলের হাতেই কিছু জল আসে।

এই মুহূর্তে যে কারিকুলাম আছে, তা ধ্বংস করে ফেলতে হবে। চালু করতে হবে নতুন বই ও কারিকুলাম। ইশকুলের প্রধান কাজ হবে ভাষা শেখানো। যে ব্যক্তি ভাষা জানেন, সে ব্যক্তি যেকোনো বিষয় পড়ার ও উপলব্ধি করার ক্ষমতা রাখেন। সুতরাং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক বই পড়ানোটা খুব জরুরি নয়। জরুরি হলো ভাষাটা শেখানো।

ভাষা শেখার এ প্রক্রিয়ার অংশ হিশেবেই ছাত্ররা পড়বে কিছু বই। তিনটি ভাষার ওপর জোর দিতে হবে— বাংলা, ইংরেজি ও গণিত। এ তিনটি ভাষাকে মাথায় রেখে বই তৈরি করতে হবে। এ বই বিষয়ভিত্তিক হতে পারে, আবার কয়েকটি বিষয়ের মিশ্রণেও হতে পারে।

কোনো শ্রেণীতে চারটির বেশি বই রাখা যাবে না। তবে কোর্স রাখতে হবে পাঁচটি বা ছয়টি। যতোটি বই ততোটি কোর্স, এবং বইয়ের বাইরে একটি বা দুইটি কোর্স।

বইয়ের বাইরের কোর্সগুলি হতে হবে জীবনমুখী। কী কী দক্ষতা না থাকলে একজন মানুষ এ পৃথিবীতে সহজে টিকতে পারবে না, তা মাথায় রেখে এ কোর্স সাজাতে হবে। যেমন রান্নাবান্নার কোর্স, প্রাথমিক চিকিৎসার কোর্স, ধান ও মসলা চাষের কোর্স, দুর্যোগ মোকাবেলার কোর্স, সাধারণ আইন-কানুন শেখার কোর্স, হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার কোর্স, পশুপালন কোর্স, বৃক্ষরোপণ কোর্স, সরকারি অফিস থেকে সেবা গ্রহণ করার কোর্স, সাঁতার ও অন্যান্য ব্যায়াম শেখার কোর্স, ইত্যাদি।

গ্রামের ইশকুল থেকে নিয়মিত শহর ভ্রমণের আয়োজন, এবং শহরের ইশকুল থেকে নিয়মিত গ্রাম ভ্রমণের আয়োজন করতে হবে। তবে গ্রাম ও শহর- উভয় এলাকার ইশকুল থেকেই, নিয়মিত পাহাড়, নদী, ও সাগর ভ্রমণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ইশকুলের পড়া বাড়িতে পাঠানো যাবে না। শিশুরা বাড়িতে তাদের পরিবারের সাথে সময় কাটাবে। নিজের পছন্দমতো বই পড়বে। ছবি আঁকবে। গান গাইবে। ছড়া লিখবে। সিনেমা দেখবে। খেলাধুলা করবে। ধর্মকর্ম, অধর্মকর্ম— এগুলো করবে। অন্তত ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত এ ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলো বাতিল করতে হবে। একটি শিশু কার সাথে প্রতিযোগিতা করবে? এক শিশুকে আরেক শিশুর কাছে লজ্জা দেয়ার প্রক্রিয়াগুলো বিলুপ্ত করতে হবে।

যে শিক্ষকেরা বর্তমানে আছেন, তাদেরকে নতুন কারিকুলামের জন্য প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এটি আহামরি কিছু নয়। নতুন শিক্ষকদের ক্ষেত্রে নিয়োগ পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্ররা যেন ইশকুলগুলোতে শিক্ষকতা করতে পারে, এ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। থানার ইউএনও থাকবেন আরামদায়ক সরকারি প্রাসাদে, আর ইশকুলের শিক্ষক বাসে চড়ে আসবেন তিরিশ মাইল দূর থেকে, এটি হতে পারে না। একজন শিক্ষক হেঁটে গেলে যেন কারও মনে না হয়, ওই দেখো, নিরুপায় দরিদ্র শিক্ষক যাচ্ছেন— এ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কিছুদিন আগে এক প্রধান শিক্ষক ইশকুলের দপ্তরির বাসায় আশ্রয় নিয়েছেন। কারণ তার বাসা এতো দূরে যে, ওখান থেকে গ্রামের ভাঙা রাস্তা মাড়িয়ে রোজ ইশকুলে আসা অসম্ভব।

ভালো পড়াশোনা করা কোনো তরুণ যখন দেখবে যে— না, ইশকুলে চাকরি করলে অধিক মর্যাদা ও বেতন পাওয়া যাবে, তখন তারা এ পেশায় আগ্রহী হবে। শুরুতে বাসা বা বাংলোর ব্যবস্থা না করা গেলে, আপাতত একটি ভালো বেতন তাদের দিতে হবে। বেতনের বাইরে প্রাইমারি শিক্ষকদের আয়ের সুযোগ নেই বললেই চলে, এ বিষয়টি রাষ্ট্রকে মাথায় রাখতে হবে। সহকারী শিক্ষকদের আবাসনের প্রয়োজন খুব একটা আছে বলে মনে হয় না, কারণ তারা সাধারণত নিজ নিজ এলাকার ইশকুলেই চাকরি করেন। তবে যাদের দরকার, তাদের জন্য অবশ্যই আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে ইশকুলে শিক্ষকতা করার একটি প্রতিযোগিতা তৈরি হবে, এবং পাওয়া যাবে ভালো মানের শিক্ষক।

বর্তমানে যে অযোগ্য শিক্ষকেরা আছেন, তাদের বাছাই করে ধীরে ধীরে অন্য চাকরিতে পুনর্বাসন করতে হবে। ম্যানেজিং কমিটি নামক প্রথা উঠিয়ে দিতে হবে। কোনো অভিভাবক কমিটি, ছড়ি ঘোরানো কমিটি ইশকুলের জন্য রাখা যাবে না। শিক্ষকদের দেখভাল করবেন জেলা শিক্ষা কমিশনার। জেলা শিক্ষা কমিশনারদের দেখভাল করবে ‘জাতীয় শিক্ষা কমিশন’। নির্বাচন কমিশনের আদলে, এ ধরনের একটি স্বাধীন কমিশন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের একটি অংশ থেকে এ কমিশনের লোকবল নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। শিক্ষা ও শিক্ষক বিষয়ক যাবতীয় কার্যক্রম এ কমিশনের আওতায় থাকবে। শিক্ষকদের দেখভাল করার বর্তমান পদ্ধতি বিলুপ্ত করতে হবে।

ইশকুলগুলোর সাথে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংযোগ স্থাপন করতে হবে। ইশকুলের শিক্ষকরা যেন বিভিন্ন বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকদের মতামত নিতে পারেন, এ ব্যবস্থা থাকতে হবে। আমি যখন ইশকুলে ছিলাম, তখন বিশ্ববিদ্যালয় নামে যে পৃথিবীতে কিছু আছে, এটি জানতামই না। কোনো শিক্ষকের মুখেও কোনোদিন বিশ্ববিদ্যালয় নামটি শুনিনি। বাংলাদেশে সর্বোচ্চ পড়ালেখা ম্যাট্রিক পাস, এমনটিই জানতাম। আমার লক্ষ্য ছিলো, কোনোভাবে ম্যাট্রিক পাস করা। আমার সাথে প্রায় বিশ জন ছেলেমেয়ে পড়তো। তাদের আঠারো জনেরই ম্যাট্রিক পাস করার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। আমারও হতো না, যদি না আমার বাবা নিজে ইশকুল হয়ে উঠতেন।

ইশকুলের প্রথম দিনেই শিশুদেরকে জানাতে হবে, তোমাদের সামনে এতো মাইল পথ পড়ে আছে। তাদেরকে হাই ইশকুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়— এ প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। শিক্ষার উদ্দেশ্য কী, কতোখানি শিক্ষা লাভ করা প্রয়োজন, এটিও তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে। অন্যথায় আমাদের ইশকুল, শীঘ্রই আমাদের গোরস্থানে পরিণত হবে।