৯
মিনিট কয়েক একেবারে চুপচাপ কাটল। কেদারেশ্বর সম্ভবত আশা করছেন যে, ভাদুড়িমশাই-ই প্রথম মুখ খুলবেন, কিন্তু ভাদুড়িমশাই কিছুই বললেন না, একেবারে নির্বাক হয়ে তিনি বসে আছেন, আর মাঝে-মাঝে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছেন। আমার আর সদানন্দবাবুর অবস্থাও তথৈবচ। মুখে কুলুপ এঁটে আমরা দুজনে কখনও ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকাচ্ছি, কখনও কেদারেশ্বরের দিকে।
শেষ পর্যন্ত কেদারেশ্বরই নীরবতা ভঙ্গ করলেন। বললেন, “আমার কাকার সম্পর্কে তখন তুমি কী জানতে চাইছিলে চারুদা?”
সিগারেটের আগুন একেবারে ফিল্টার পর্যন্ত এসে পৌঁছেছিল। সেটাকে সেন্টার-টেবিলে-রাখা অ্যাশট্রেতে পিষে দিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “ও হ্যাঁ, জানতে চাইছিলুম যে, তিনি তাঁর ব্যাবসা এখন আস্তে-আস্তে গুটিয়ে নিচ্ছেন কি না।”
প্রশ্নটার সরাসরি উত্তর দিলেন না কেদারেশ্বর। সামান্য ইতস্তত করে বললেন, “এই ধরনের কথা তুমি কার কাছে শুনলে?”
কথাটা আমরা মহিম বরুয়ার কাছে শুনেছি। ভাদুড়িমশাই কিন্তু মহিম বরুয়ার নাম করলেন না। বললেন, “এ কি একটা প্রশ্ন হল কেদার? তোমার জানা উচিত যে, গৌহাটিতে আমার পাকাপোক্ত আপিস না থাক, সেখানে স্ট্রিঙ্গার বেসিসে দু’জন লোক আমার ইনভেস্টিগেশন-কোম্পানির হয়ে কাজ করে। তা ছাড়া, শুধু গৌহাটি কেন, এ রাজ্যের অন্য সব শহরেও আমার বন্ধুবান্ধবের কিছু অভাব নেই। ধরে নাও যে, তাঁদেরই কারও কাছে কথাটা আমি শুনেছি। আমার ধারণা, কথাটা মিথ্যে নয়। এমন ধারণা কেন হল জানো?”
“কেন হল?”
“হল তোমার কাছে এই কথাটা শুনে যে, মাস দুয়েক হল, এই ধুবড়িতে তিনি আছেন।”
“বাঃ, ধুবুড়ি তাঁর হোম-টাউন, এখানেই তিনি জন্মেছেন, এখানেই তিনি বড় হয়েছেন, এখানেই তাঁর বাড়ি, আর এই শহরে তিনি থাকবেন না?”
“এটা কি খুব জোরালো যুক্তি হল কেদার?” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “হতে পারে এখানেই তাঁর ঘরবাড়ি। কিন্তু মহেশ্বর ফুকনের ব্যাবসাটা তো শুধু ধুবড়িতে নয়, গোটা রাজ্য জুড়ে। এ-রাজ্যের বলতে গেলে প্রায় প্রতিটি জেলা-সদরে আপিস রয়েছে তাঁর। তা এত বড় একটা এলাকা জুড়ে যাঁর ব্যাবসার কাজকর্ম চলছে, তাঁর কি কোথাও… মানে বিশেষ কোনও জায়গায় শিকড় গেড়ে বসে যাওয়া চলে? তুমি বলবে, কেন, একগাদা আপিস যেমন রয়েছে, তেমন ম্যানেজারও তো তিনি কম রাখেননি, কাজকর্ম দেখেশুনো তারাই করবে, তারাই সব দিক সামলাবে, মালিককে ছুটোছুটি করতে হবে কেন। কিন্তু তার উত্তরে আমি বলব, ম্যানেজাররা সত্যিই দেখাশুনো করছে কি না, ঠিকমতো সব দিক সামলাচ্ছে কি না, অন্যের মুখে ঝাল না-খেয়ে স্বচক্ষে সেটা দেখবার জন্যেই মালিককেও ছুটোছুটি করতে হয়। বিশেষ করে তেমন মালিককে, যিনি বিশাল একটা ব্যাবসা ফেঁদে বসে আছেন, অথচ যার উপরে ষোলো-আনা নির্ভর করা যায়, এমন কাউকে… আই মিন নিজের পরিবারের কাউকে… সেই ব্যাবসার মধ্যে টেনে নিতে পারেননি।”
আবার একটা সিগারেট ধরালেন ভাদুড়িমশাই। জ্বলন্ত দেশলাই-কাঠিটাকে বার দুয়েক বাতাসে নেড়ে নিভিয়ে অ্যাশট্রেতে নিক্ষেপ করলেন। তারপর একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “আমার খবর, তোমার কাকা সেটা পারেননি, কিংবা ইচ্ছে করেই টানেননি। ব্যাবসার তাবৎ ঝক্কি তিনি একা সামলাচ্ছেন। তা হলে টানা দু’মাস তিনি ধুবড়িতে বসে আছেন কী করে? থাকা সম্ভব, আনলেস হি হ্যাজ লস্ট ইন্টারেস্ট ইন হিজ বিজনেস অ্যান্ড নাউ ওয়ান্টস টু ওয়াইন্ড আপ দ্য হোল ড্যাড্ থিং? …বলো, সম্ভব?”
মুখশুদ্ধির কাচের বাটি থেকে দু-একটা এলাচদানা খুঁটে তুলে মুখে ফেলে দিয়ে কেদারেশ্বর বললেন, “তুমি ঠিকই ধরেছ, চারুদা। তবে কাকা যে কাউকে তাঁর ব্যাবসায় টানবার চেষ্টা করেননি, এটা ঠিক নয়। চেষ্টা তিনি খুবই করেছিলেন, কিন্তু শঙ্কর যদি জেদ ধরে বসে থাকে যে, কিছুতেই সে দেশে ফিরবে না, তা হলে আর কী করা যাবে।”
“শঙ্কর কে?”
“কাকার একমাত্র ছেলে। খুবই গুণী ছেলে। কিন্তু বাপের সঙ্গে বনে না।”
“সে কোথায় থাকে?”
“আগে থাকত নিউ জার্সিতে।” কেদারেশ্বর বললেন, “চাকরি করত। বেল কোম্পানির চাকরিটা যে নেহাত খারাপ ছিল, তাও নয়। কিন্তু, কেন জানি না, সেখানে তার মন বসেনি, চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্টেটস থেকে সে ফ্রান্সে চলে যায়। তারপর বছরখানেক বাউন্ডুলের মতো ঘুরে বেরিয়ে ইংল্যান্ডে চলে আসে।”
“খরচ চলত কী করে?”
“বেল কোম্পানির চাকরি করে হাতে কিছু জমেছিল, তার থেকে চলে যেত। তারপর তো ইংল্যান্ডে গিয়ে ফের একটা কাজ জুটিয়ে নিল। বিয়েও করেছে ইংল্যান্ডেই। বিয়ের বছর দুয়েক বাদে ফের চাকরি ছেড়ে দেয়। কিন্তু তারপরে আর নতুন কোনও চাকরিতে না-ঢুকে নিজেই আপিস খুলে বসে একটা। সেলস প্রোমোশনের ফার্ম। জনা দশ-বারো লোক সেখানে কাজ করে। লাভও নাকি কম হয় না। ইতিমধ্যে একটা ছেলেও হয়েছে। তারপরে আবার যেমন খাস-লন্ডনে একটা ফ্ল্যাট কিনেছে, তেমন হ্যাম্পস্টেড হিথে একটা বাড়িও কিনেছে শুনলুম।”
সদানন্দবাবু আর কাঁহাতক চুপ করে বসে থাকবেন। বললেন, “তার মানে বেশ গুচিয়ে বসেচে আর কি। …তা বউটি কি মেমসায়েব?”
কেদারেশ্বর বললেন, “হ্যাঁ। ফলে আমরা ধরেই নিয়েছিলুম যে, আমার ছেলে যেমন বরাবরের মতন বিদেশেই রয়ে গেল, শঙ্করও তেমনি আর দেশে ফিরবে না।”
“ধরে নিয়েছিলে বলছ কেন, কেদার?” ভাদুড়িমশাই প্রশ্ন করলেন, “তার মানে এখন আর সেটা ধরে নিচ্ছ না? অর্থাৎ এখন তোমরা ভাবছ যে, সে ফিরতেও পারে?”
“ফেরাবার জন্যে কাকা অন্তত এখনও সমানে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।” কেদারেশ্বর বললেন, “তিনি এখনও হাল ছাড়েননি। আসল কথাটা কী জানো, চারুদা, শঙ্কর যতই গোঁ ধরে থাক, ডোরা… আই মিন শঙ্করের বউটি কিন্তু কাকার পক্ষে। কাকার হয়ে সে-ই এখন তার স্বামীর সঙ্গে লড়াই চালাচ্ছে। দ্য ব্যাটল ইজ নট ওভার। নট ইয়েট। ডোরা যদি শঙ্করকে এখানে ফিরে আসতে আর ফিরে এসে কাকার ব্যাবসার হাল ধরতে রাজি করাতে পারে, তা হলে কিন্তু ছবিটা পালটে যাবে। কাকা সে-ক্ষেত্রে তাঁর ব্যাবসাও নিশ্চয় গুটিয়ে ফেলবেন না। কিন্তু রাজি করাতে পারবে কি না, সেটাই হচ্ছে কথা।”
“রাজি করাতে পারবে না, এমন সম্ভাবনাও আছে তা হলে?”
“তা তো আছেই। আমার এই খুড়তুতো ভাইটিকে তো আমি চিনি, কাকার উপরে ওর রাগ এখনও যায়নি।”
“রাগটা কেন, বলতে কোনও অসুবিধে আছে?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “অবিশ্যি এটা যদি তোমাদের এমন কোনও পারিবারিক ব্যাপার হয়, বাইরের লোকের সঙ্গে যা নিয়ে তুমি কথা বলতে চাও না…”
কথা শেষ হবার আগেই হোহো করে হেসে উঠলেন কেদারেশ্বর। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, ‘পারিবারিক ব্যাপার তো অবশ্যই। কিন্তু তুমি কেন বাইরের লোক হবে? আর এঁরা দুজনে তো তোমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সুতরাং এঁদের সামনেও কোনও কিছু নিয়ে কথা বলতে আমার কিছুমাত্র আপত্তি নেই। কিন্তু শঙ্করের রাগের কারণটা যদি বলতে হয় তো একটু পিছন থেকে আমাকে শুরু করতে হবে।”
অতঃপর দীর্ঘ সময় নিয়ে মহেশ্বর ফুকন ও তাঁর পুত্র শঙ্করের পারস্পরিক সম্পর্কের যে ইতিবৃত্ত কেদারেশ্বর ফুকন আমাদের সামনে তুলে ধরলেন, ডালপালা ছেঁটে দিয়ে কখনও কেদারেশ্বরের আর কখনও আমার নিজের কথায়, তার শুধু সংক্ষিপ্তসারটুকুই আমি এখানে জানাচ্ছি :
কেদারেশ্বরের বাবা সুরেশ্বর ফুকন বেঁচে থাকলে তাঁর বয়স এখন হত নিরানব্বই বছর। মহেশ্বর ফুকন তাঁর একমাত্র ভাই; বয়সে তিনি দাদার চেয়ে পনেরো বছরের ছোট। তাঁর বয়স এখন চুরাশি বছর। ধুবুড়ির এই বাড়িটা এঁদের পৈতৃক বাড়ি। এখান থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে সুরেশ্বর কলকাতায় চলে যান। তাঁর কলেজ-জীবন কলকাতায় কাটে। বি.এ. পাশ করে একটি বাঙালি মেয়েকে তিনি বিয়ে করেন ও কলকাতাতেই সংসার পেতে ছোটখাটো একটি ব্যাবসা শুরু করে দেন। দাদা যখন ম্যাট্রিক পাশ করেন, মহেশ্বর তখন এক বছরের শিশু। তাঁর শৈশব ও বাল্যবয়স বাপ-মায়ের কাছে ধুবড়ির এই বাড়িতেই কেটেছে। বাপ-মা বেশি দিন বাঁচেননি। তাঁরা মারা যাওয়ার পরে দূর-সম্পর্কের এক নিঃসন্তান বিধবা পিসিমাকে এসে বালক-মহেশ্বরের দেখাশোনার ভার নিতে হয়। মহেশ্বরের লেখাপড়া বেশি দূর এগোয়নি, কিন্তু তাঁর ব্যাবসাবুদ্ধি ছিল খুবই প্রখর। যৎসামান্য পুঁজি নিয়ে সতেরো-আঠারো বছর বয়সেই তিনি পড়তির বাজারে নানা রকমের রাখি-মাল কিনে রেখে তারপর উঠতির বাজারে সেগুলি চড়া-দামে বিক্রি করার ব্যাবসায় হাত লাগান। পরের কয়েক বছরে সেই ব্যাবসার পরিধি বিশেষ বাড়েনি। কিন্তু ১৯৩৯ সালে বাধে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। সেই যুদ্ধ যখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে এবং ক্রমেই এগিয়ে আসতে থাকে আমাদের ঘরের কাছে, মহেশ্বরের কপাল তখন রাতারাতি খুলে যায়। তাঁর বয়স তখন বছর ছাব্বিশ-সাতাশের বেশি হবে না। সেই সময়ে ফার ইস্টার্ন কমান্ডের এক ইংরেজ ব্রিগেডিয়ারের সঙ্গে সরাসরি দেখা করে ও ভাব জমিয়ে তিনি রসদ সরবরাহের কয়েকটি বৃহৎ কনট্রাক্ট বাগিয়ে নেন। পরের ইতিহাস তাঁর একটানা আর্থিক উন্নতির ইতিহাস। বন্যার মতন প্রবল তোড়ে তাঁর অর্থাগম হতে থাকে। যুদ্ধ যখন শেষ হয়, তখন তিনি কোটিপতি।
মহেশ্বরের জীবন সেই সময়ে খুব সুশৃঙ্খল ছিল না। চারিত্রিক কিছু শৈথিল্যও হয়তো ঘটে থাকবে। কিন্তু কেদারেশ্বরের কথা যদি সত্য হয়, তা হলে বুঝতে হবে, সেটা নেহাতই সাময়িক বিচ্যুতি, কেননা “ওই বয়সে অত টাকার মালিক হওয়া সত্ত্বেও কাকার মাথা ঘুরে যায়নি।” তা যদি ঘুরত, তা হলে যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে সেই বিপুল পরিমাণ অর্থকে ঠিকমতো খাটিয়ে দশ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে অসমের একটা বিশাল এলাকা জুড়ে এত বড় একটা ব্যাবসার জাল তিনি ছড়িয়ে বসতে পারতেন না। ব্যাবসা গড়ে তোলার কাজে মহেশ্বর তখন এতই ব্যস্ত যে, সময়মতন বিয়েটা পর্যন্ত করে উঠতে পারেননি। সেটা করলেন উনিশশো পঞ্চান্ন সালে। মহেশ্বরের বয়স তখন একচল্লিশ। কেদারেশ্বর হেসে বললেন, “কী বলব, আমারই বয়স তখন সাতাশ পেরিয়ে আঠাশ চলছে। তার আগে আমি চাকরিতে ঢুকেছি, বিয়েও করেছি তার বছর দুয়েক আগে। বাবা অসুস্থ ছিলেন বলে ধুবুড়িতে আসতে পারেননি। অসুস্থ অবস্থায় বাবাকে ফেলে মা’ই বা কী করে আসবেন? তিনিও আসতে পারলেন না। কাকাকে যিনি ছেলেবেলা থেকে বড় করে তুলেছেন, সেই বিধবা পিসি তখনও বেঁচে, কিন্তু তাঁরও বয়স তখন আশি পেরিয়ে গেছে, বিয়েবাড়ির ঝক্কি সামলানো তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। মায়ের কথায় আমাকেই তাই আপিস থেকে দিন পনেরোর ছুটির ব্যবস্থা করে বউকে সঙ্গে নিয়ে সমস্ত দিক সামাল দেবার জন্যে ধুবুড়ি চলে আসতে হল। কাকিমা বঙ্গাইগাঁওয়ের মেয়ে। বরযাত্রী হয়ে বিয়ের দিন সেখানে আমি গিয়েছিলুম। বিয়ের আসরে চেলি-পরা কনেকে দেখে মনে হল, বয়স বছর-কুড়ির বেশি হবে না। তার চেয়ে কমও হতে পারে। কাকা ও কাকিমাকে নিয়ে পরদিন বিকেলে বঙ্গাইগাঁও থেকে ধুবুড়িতে ফিরে আসি।”
কেদারেশ্বরের কাছে আর যা শোনা গেল, তার সবটা না-হলেও কিছুটা আমরা সহজেই অনুমান করে নিতে পারতুম। স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর বয়সের ব্যবধান যেখানে কুড়ি বছরের কি তার চেয়েও বেশি, সেখানে বড়জোর একটা শারীরিক সম্পর্কই হতে পারে, মানসিক সম্পর্ক বড়-একটা হয় না। এক্ষেত্রেও হয়নি। বিয়ের পরে মহেশ্বর তাঁর ব্যবসায়িক কাজকর্ম মাসখানেকের জন্যে মুলতুবি রেখেছিলেন ঠিকই, এবং শিশুরা যেমন নতুন একটা খেলনা পেলে কয়েকটা দিন তা-ই নিয়ে মত্ত থাকে, মহেশ্বরও তেমন তাঁর বালিকা-বধূটিকে নিয়ে কয়েকটা দিন বেশ মসগুল হয়ে ছিলেন, বস্তুত সেই ক’টা দিন তিনি যে বাড়ির থেকে এমনকী কাছেপিঠেও বিশেষ বার হতেন, তাও নয়, কিন্তু তারপরেই তাঁর আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে যায়, ধুবুড়ির বাড়িতে আটকে থাকার ফলে তাঁর রাজ্যজোড়া ব্যাবসার যে ক্ষতি হচ্ছে, এটা বুঝবা মাত্র তিনি বউটিকে তাঁর বুড়ি-পিসির কাছে রেখে ধুবুড়ি ছেড়ে ফের বেরিয়ে পড়েন। বিয়ের আগে যেমন ছিল, ব্যাবসাই তখন আবার তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়ায়। কী করে তার আয়তন আরও বাড়াবেন এবং একই সঙ্গে বাড়িয়ে যাবেন তাঁর অর্থাগমের পরিমাণ, এ ছাড়া আর অন্য কোনও চিন্তাই তখন তাঁর ছিল না। বাড়িতে ফিরতেন কালেভদ্রে। বিয়ের পরের বছর যখন তাঁর একমাত্র পুত্রটি ভূমিষ্ঠ হয়, তখনও তিনি ফেরেননি; বুড়ি-পিসিটি যখন মারা যান, তখনও তাঁর শ্রাদ্ধের দু’দিন আগেও তিনি ফেরেননি; আবার ব্ল্যাকওয়াটার ফিভারে আক্রান্ত হয়ে তাঁর স্ত্রী যখন মরণাপন্ন, মহেশ্বর তখনও বাইরে-বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একটা সংসারের তাবৎ প্রয়োজন, এমনকী তার অন্যান্য রকমের শখ-আহ্লাদ ও বিলাস-ব্যসনের চাহিদা পর্যন্ত মেটাবার জন্য যে টাকা দরকার, মাসে-মাসে তার চেয়েও ঢের বেশি টাকা তিনি পাঠিয়ে দিতেন ঠিকই, কিন্তু সেইখানেই শেষ হত তাঁর কর্তব্য, নিজে উপস্থিত থেকে কোনও দায়দায়িত্বই তিনি সামলাতেন না। এ নিয়ে তাঁর স্ত্রী কেন অনুযোগ করেননি, ভাদুড়িমশাইয়ের এই প্রশ্নের উত্তরে কেদারেশ্বর বললেন, অনুযোগ করার সাহসই তাঁর ছিল না। সাহস না-থাকার কারণ হয়তো এই যে, বয়সের ব্যবধানের জন্য স্বামীকে তিনি ভয় পেতেন। “তা ছাড়া,” কেদারেশ্বর বললেন, “কাকিমা ছিলেন খুবই গরিব ঘরের মেয়ে। ছেলেবেলায় বাপ-মা হারিয়ে মামাবাড়িতে অনাদরে-অবহেলায় বড় হয়েছেন; তাই, স্বামীর বয়স যা-ই হোক, মামারা যে তাঁকে এমন একটা বাড়িতে বিয়ে দিয়েছেন, যেখানে খাওয়া-পরার কোনও অভাব নেই, হয়তো তাতেই খুশি ছিলেন তিনি।”
“ছিলেন-ছিলেন বলছ কেন?” ভাদুড়িমশাই জিজ্ঞেস করলেন, “কাকিমা বেঁচে নেই?”
“অনেক দিন আগেই গত হয়েছেন।” কেদারেশ্বর বললেন, “ওই যে ব্ল্যাকওয়াটার ফিভারের কথা বললুম, তাতেই তিনি মারা যান। মৃত্যুর সময়েও কাকা তাঁর পাশে ছিলেন না। তাঁর ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির নতুন একটা ব্রাঞ্চ আপিস খুলতে সেদিন তিনি ডিব্রুগড়ে গিয়েছিলেন। বুড়ি-পিসিমা মারা গিয়েছিলেন তার বছর দুয়েক আগেই। ফলে, কাকিমা যেদিন মারা যান, বাড়িতে সেদিন শঙ্কর আর জনা-তিনেক কাজের লোক ছাড়া আর কেউই ছিল না। পাড়া-প্রতিবেশীরাই মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার ও শবদাহের ব্যবস্থা করে। শঙ্করও তাদের সঙ্গে ছিল। শ্মশান থেকে বাড়িতে ফেরার পরে পাড়ারই এক মহিলা এসে শঙ্করকে তাঁদের বাড়িতে নিয়ে যান। কাকা তার দু’দিন বাদে ধুবুড়িতে এসে পৌঁছন।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “কাকিমা’র অসুখের খবর তাঁকে দেওয়া হয়েছিল?
“হয়েছিল।” কেদারেশ্বর বললেন, “কিন্তু অবস্থা যে এত গুরুতর, কাকা বোধহয় তা বুঝতে পারেননি। বুঝলে নিশ্চয় ডিব্রুগড়ের কাজ মুলতুবি রেখে ছুটে আসতেন। কাজ-পাগলা লোক ঠিকই, কিন্তু অমানুষ তো নন।
“শঙ্করের বয়স তখন কত?”
“হার্ডলি দশ।” কেদারেশ্বর বললেন, “কাকার বিয়েটা হয়েছিল নাইনটিন ফিফ্টিফাইভে। তার পরের বছর ডিসেম্বরে ওর জন্ম। কাকিমা সিক্সটিসিক্সে মারা যান। …হ্যাঁ, দশই হবে। আমার ছেলের থেকে মাত্র এক বছরের বড়।”
বললুম, “খুবই ইমপ্রেশনেল এজ। ওই বয়েসে মনের উপরে একটা ছাপ পড়ে গেলে সেটা আর কিছুতেই মুছে যেতে চায় না।”
কেদারেশ্বর বললেন, “আপনি ঠিকই বলেছেন। নয়তো দেখুন, কাকিমাকে যতই অবহেলা করে থাকুন, শঙ্করের ব্যাপারে তো কোনও কর্তব্যেরই কাকা কোনও ত্রুটি রাখেননি।”
তা যে সত্যিই রাখেননি, কেদারেশ্বরের পরের কথাগুলি থেকেই তা বোঝা গেল। সুরেশ্বর তাঁর কলকাতার ছোটখাটো ব্যাবসাটা ইতিমধ্যে গুটিয়ে ফেলেছিলেন। এবারে ভ্রাতৃবধূর মৃত্যুর খবর পেয়েই স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি কলকাতা থেকে ধুবড়িতে চলে আসেন। কেদারেশ্বর বাইরে-বাইরে চাকরি করলেও মাঝেমধ্যে কলকাতায় এসে ছুটি কাটাতেন বলে কলকাতার বাসাবাড়িটি তাঁরা ছেড়ে দিয়ে আসেননি। তবে ঠিকই করেছিলেন যে, এখন থেকে তাঁরা ধুবড়িতেই স্থায়ীভাবে থাকবেন। আসলে এটা কেদারেশ্বরের মায়েরই সিদ্ধান্ত, এবং সিদ্ধান্তটা তিনি নিয়েছিলেন শুধুই মা-হারা ছেলে শঙ্করের কথা ভেবে।
কেদারেশ্বর বললেন, “আমার কাকা মহেশ্বর ফুকনের ডাকনাম ছোটকু। মা তাঁকে ওই নামেই ডাকতেন। কাকিমার শ্রাদ্ধের কাজ মিটে যাবার পর মা তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে বলেন, ‘ছোটকু, আমরা তো এখন থেকে এখানেই থাকব। ব্যাবসার কাজে তোকে বাইরে-বাইরে ঘুরতে হয়, তা আমি জানি। কিন্তু নিশ্চিন্ত চিত্তে তুই শঙ্করকে আমার কাছে রেখে যা। ও আমার কাছে থেকে বড় হোক, আমি ওকে ওর মায়ের অভাব বুঝতে দেব না।’ কিন্তু কাকা তাতে রাজি হননি।”
সদানন্দবাবু বললেন, “সে কী মশাই, আপনার মা তো খুব ভাল কতাই বলেছিলেন। আপনার কাকা তা হলে রাজি হলেন না কেন?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “সম্ভবত একটা অপরাধবোধে কষ্ট পাচ্ছিলেন তিনি। হয়তো ভাবছিলেন, স্ত্রীকে তিনি কাছে টেনে নেননি, সেটাই খুব বড় রকমের ভুল হয়ে গেছে, এবারে ছেলেটাকেও যদি না নিজের কাছে রাখেন তো সেও দূরে চলে যাবে, বাপ আর ছেলের মধ্যে একটা স্বাভাবিক মায়া-মমতা-শ্রদ্ধা-ভালবাসার সম্পর্কই তা হলে গড়ে উঠবে না।”
“সত্যিই অমন কথা ভাবছিলেন কি না, তা তো জানার উপায় নেই,” কেদারেশ্বর বললেন, “তবে যা-ই ভেবে থাকুন, তার নিট-ফলটা এই দাঁড়াল যে, শঙ্করকে সঙ্গে নিয়ে তিনি গুয়াহাটিতে ফিরে গেলেন। শঙ্কর যেতে চায়নি, মাকে আঁকড়ে ধরে সে হাপুস নয়নে কাঁদছিল আর বলছিল যে, সে জ্যাঠাইমার কাছে থাকবে, বাবা আর মা’ও কাকাকে অনেক করে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কারও কথাই কাকা কানে তুললেন না।”
কিন্তু গৌহাটিতেই বা কার কাছে শঙ্করকে রাখবেন তিনি? তিনি নিজেই বা সেখানে ক’দিন থাকেন? ব্যাবসার জালে জড়িয়ে গিয়ে তাঁকে তো ক্রমাগত এখানে-ওখানে ছুটোছুটি করে বেড়াতে হয়। শঙ্কর তা হলে লেখাপড়াই বা কার কাছে থেকে করবে? উপায়ান্তর না-দেখে মহেশ্বর শেষ পর্যন্ত শিলংয়ের এক রেসিডেন্সিয়াল মিশনারি স্কুলে তাকে ভর্তি করে দিয়ে আসেন। সেখানকার স্কুল থেকে পাশ করে বেরোবার পর তাকে পাঠিয়ে দেন কলকাতায়। ছেলে যখন শিলংয়ে ছিল, তখন সপ্তাহে অন্তত একবার মহেশ্বর সেখানে যেতেনই, আর কলকাতায় সে যখন হস্টেলে থেকে আই.এ.-বি.এ. পড়ত, তখন বার-বার তাকে দেখতে আসা সম্ভব না-হলেও প্রতিটি ছুটিতে তিনি ছুটে এসেছেন, আর ছুটির ক’টা দিন তাকে নিয়ে কলকাতারই কোনও হোটেলে কাটিয়েছেন কিংবা ঘুরে এসেছেন কোনও স্বাস্থ্যকর জায়গা থেকে। কিন্তু এত করেও শঙ্করের মন পাননি তিনি। না পেয়েছেন তার শ্রদ্ধা, না পেয়েছেন তার ভালবাসা। শঙ্কর মেধাবী ছাত্র ছিল, কিন্তু বি. এ. পরীক্ষায় আশাতিরিক্ত রকমের ভাল ফল করেও সে আর এখানকার এম. এ. ক্লাসে ভর্তি হয়নি। সুযোগ মিলবামাত্র একটা স্কলারশিপ জোগাড় করে সে আমেরিকায় চলে যায়। তারপর পাবলিক রিলেশানস-এর তিন বছরের একটা কোর্স শেষ করে বেল কোম্পানির চাকরি নিয়ে সে নিউ জার্সিতে চলে আসে। তার বয়স তখন মাত্র চব্বিশ।
বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে বাবার অনুমতি নেয়নি শঙ্কর। বিদেশে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার ব্যাপারেও না। সে যাতে দেশে ফেরে, আর ফিরে এসে সে যাতে তার বাবার ব্যাবসায় যোগ দেয়, তার জন্য মহেশ্বর তাকে বারবার অনুরোধ করেছেন। কিন্তু প্রতি বার একই উত্তর এসেছে; না, সে দেশে ফিরতে চায় না, বাবার ব্যাবসা বুঝে নেবার কোনও ইচ্ছাই তার নেই। মহেশ্বর বুঝতে পারতেন, ছেলে তার উপরে রেগে আছে। কিন্তু কেন যে রেগে আছে, তা তিনি বুঝতে পারতেন না।
ভাদুড়িমশাই বললেন, “না বোঝার তো কিছু নেই। মায়ের মৃত্যুর সময়েও বাবা যে উপস্থিত ছিলেন না, শঙ্কর সে-কথা ভুলতে পারেনি। বাবাকে ক্ষমা করতে পারেনি সে।”
সদানন্দবাবু বললেন, “করবে কী করে? ব্যাপারটা একবার ভাবুন দিকি। একটা বাচ্চা বই তো নয়। চোকের সামনে তার মা মারা যাচ্চেন, অথচ বাড়িতে তখন গুটিকয় কাজের লোক ছাড়া তার আপ্না বলতে কেউ নেই। পাড়ার লোকের সঙ্গে তাকে শ্মশানে যেতে হল, মায়ের মুকে আগুন দিতে হল, ইদিকে বাবার পাত্তা নেই। আর বাবা তখন সেখেনে থাকলেই বা কী হত? তাঁকে তো সে কালেভদ্রে দেকেচে।”
“বয়েসটাই হচ্চে আসল কথা।” আমি বললুম, “সেদিনকার ওই ঘটনার ছাপটা নিশ্চয় শঙ্করের মন থেকে আজও মুছে যায়নি। আর হ্যাঁ, তখনকার আর-একটা ঘটনার কথাও ভাবুন। মা’কে হারাবার পর ছেলেটা তার জ্যাঠাইমা’কে আঁকড়ে ধরেছিল। কিন্তু জ্যাঠাইমা’র কাছেও বাবা তাকে থাকতে দিলেন না, জোর করে তাকে গৌহাটিতে নিয়ে গেলেন। এটারও একটা ছাপ নিশ্চয় তার মনের মধ্যে থেকে গেছে। বাবার কথা ভাবলেই তার তাই মনে হচ্ছে যে, তিনি হৃদয়হীন, তিনি নিষ্ঠুর মানুষ। মহেশ্বরের ডাকে সে তাই সাড়া দিচ্ছে না।”
“আচ্ছা কেদার,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটা কথা তোমাকে জিজ্ঞেস করব?”
কেদারেশ্বর হেসে বললেন, “কী জিজ্ঞেস করবে, সেটা আমি অনুমান করতে পারছি, চারুদা। কাকা আমাকে কখনও তার বিজনেসে ঢুকতে বলেছেন কি না, এই তো?”
“হ্যাঁ।”
“একবার নয়, অনেকবার বলেছেন।” কেদারেশ্বর বললেন, “শঙ্কর যখন কাকাকে কিছু না-জানিয়ে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে চলে যায়, তখনই একবার বলেছিলেন। কিন্তু একে তো আমি জানতুম যে, ওটা রাগের কথা, তার উপরে আবার চাকরিটা আমি তখন ভালই করছি। তা ছাড়া, ব্যাবসা যে একটা খেলা-খেলা ব্যাপার নয়, যারা ব্যাবসা করে তাদের যে ঝঞ্ঝাট নেহাত কম পোয়াতে হয় না, সে তো আমি আমার বাবাকে দেখেই বুঝে গিয়েছিলুম। সঙ্গে-সঙ্গে এটাও বুঝেছিলুম যে, বিজনেস ইজ নট মাই কাপ অব টি। তা নইলে আর ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে হয়ে আমি চাকরিতে ঢুকব কেন?”
“তার মানে তোমার কাকার কথায় তুমি রাজি হলে না, কেমন?”
“হব কী করে?” কেদারেশ্বর হেসে বললেন, “আমার শরীরে সম্ভবত পিতৃকুলের চেয়ে মাতৃকুলের রক্তই বেশি। দাদামশাই চাকরি করতেন। দুই মামাকেও দাদামশাই তাঁর কোম্পানির বড়-সায়েবকে ধরে চাকরিতে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। তো আমারও সেই একই ধাত। চাকরি করব, মাসান্তে মাইনে পাব, বছর-বছর ইনক্রিমেন্ট হবে, প্রভিডেন্ট ফান্ডে টাকা জমা পড়বে, রিটায়ার করার পর সেই জমানো-টাকার সঙ্গে কিছু গ্র্যাচুইটিও হাতে পেয়ে যাব, বাস, তাতেই আমি খুশি। হোয়ারঅ্যাজ ব্যাবসা হচ্ছে একটা ঘোর আনসার্টেন ব্যাপার, তাতে লাভ হবে না লোকসান হবে, কেউ বলতে পারে? না রে বাবা, ওর মধ্যে আমি নেই। কিন্তু কাকাকে তো আর কথাটা ওইভাবে বলা যায় না। তাই বলেছিলুম যে, তুমি এখনই আমাকে তোমার পার্টনার করে নেবার কথা ভাবছ কেন? তোমার বয়েস এখনও সত্তর হয়নি, স্বাস্থ্যটাও দেখছি ভালই আছে, তাই যেমন চালাচ্ছ, তেমনি করে আরও বছর কয়েক ব্যাবসাটাকে একাই চালিয়ে নাও; কিচ্ছু অসুবিধে হবে না। শঙ্কর তার মধ্যে নিশ্চয় ফিরে আসবে।”
“তারপর?”
“তারপর আর কী, বছরের পর বছর যায়, কিন্তু শঙ্কর ফিরে আসে না। ফলে ফি বছরই কাকা আমাকে মাঝেমধ্যে তাগাদা দিতে থাকেন। কখনও চিঠি লিখে, কখনও সামনা-সামনি। আর প্রত্যেক বারই আমি একটা-না-একটা কারণ দেখিয়ে ব্যাপারটাকে ঝুলিয়ে রাখি।”
“শেষ কবে তাগাদা দিয়েছিলেন?”
“নাইনটিন এইট্টিফোরে। সেই বছরেই রিটায়ার করে অনুপমাকে নিয়ে বরাবরের মতো কলকাতা ছেড়ে আমি ধুবুড়িতে চলে আসি। বাবা আর মা ইতিমধ্যে মারা গিয়েছিলেন। কাকাও ইতিমধ্যে এই পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে দিয়ে ব্রহ্মপুত্রের ধারে তৈরি করিয়ে নিয়েছিলেন তাঁর নতুন বাড়ি। একদিন তিনি সেই বাড়িতে আমাকে ডেকে পাঠান। তাঁর সঙ্গে সেদিন অনেকক্ষণ ধরে আমার কথা হয়েছিল। বারবার তিনি সেদিন আমাকে তাঁর পুরো ব্যাবসার ভার নিতে বলেছিলেন। আমি রাজি না-হওয়ায় বলেছিলেন, ‘তুই কি শঙ্কর বঞ্চিত হবে ভেবে রাজি হচ্ছিস না? তো ঠিক আছে, আমার ট্রাক আর টিম্বারের অংশটা আমি তোর নামে লিখে দিচ্ছি, ও দুটো তুই সামলা। টি, জুট আর অন্য সব ব্যাবসা বরং শঙ্করের জন্যে রেখে দিচ্ছি। তবে হ্যাঁ, শঙ্কর যদি আদৌ না-ফেরে, তা হলে সে-সব অংশের মালিকানাও কিন্তু তোরই উপরে বর্তাবে। আমার উইলে অন্তত সেই রকমই আমি লিখে যাব।’ কিন্তু না চারুদা, তাতেও আমি রাজি হইনি।”
সদানন্দবাবু বললেন, “সে কী মশাই, আপনার হাফ, আপনার খুড়তুতো ভাইয়ের হাফ, এ তো বেশ ভাল ব্যবস্থাই হয়েছিল, তাও আপনি রাজি হলেন না?”
“না, হলুম না।” কেদারেশ্বর বললেন, “না-হওয়ার দুটো কারণ। এক নম্বর কারণ হল, সুস্থ শরীরকে ব্যস্ত করতেই আমার আপত্তি। আরে মশাই, কাজই যদি করব, তো যেখানে কাজ করছিলুম, সেই কোম্পানিতেই তো আরও তিন বছর আমি চালিয়ে যেতে পারতুম। কিন্তু তা না করে সাতান্ন বছর বয়সেই যে আর্লি রিটায়ারমেন্টের সুবিধে নিয়ে আমি চাকরি থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলুম, সে তো স্রেফ এইজন্যেই যে, কাজ করতে আমি ভালবাসি না। আমি বিশ্বাস করি যে, দেয়ার ইজ আ টাইম ফর ওযার্ক অ্যান্ড দেয়ার ইজ আ টাইম ফর রেস্ট। কাজ করার সময়ে আমি কাজ করেছি, এখন আমার রেস্ট নেবার পালা, বাস্। তা কাকা কী করলেন? না রেস্টের বারোটা বাজিয়ে দিয়ে একটা রিটায়ার্ড লোকের ঘাড়ে আবার কাজের জোয়াল চাপিয়ে দেবার তাল করলেন। তাতে আমি রাজি হবে কেন?”
ভাদুড়িমশাই ইতিমধ্যে ফের একটা সিগারেট ধরিয়েছিলেন। একগাল ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “রাজি না-হওয়ার সেটা তো প্রথম কারণ। দ্বিতীয় কারণটা কী?
কেদারেশ্বর এতক্ষণ হাসতে-হাসতে কথা বলছিলেন। এবারে হঠাৎই একটু গম্ভীর হয়ে গিয়ে বললেন, “সেটা তোমার বোঝা উচিত, চারুদা। ন্যায্যত যা আমি পেতে পারি না, তার অর্ধেকটাই বা আমি নেব কেন? পুরোটাই তো শঙ্করের প্রাপ্য। বেশ তো, তর্কের খাতিরে না হয় ধরে নিচ্ছি যে, যেমন আমার ছেলে বিদেশে থেকে গেছে, শঙ্করও তেমনি বিদেশেই থেকে যাবে, দেশে ফিরে কাকার ব্যাবসার ভার নেবে না। কিন্তু তার বড় তো রয়েছে, তার বছর-দশেকের একটা ছেলেও তো রয়েছে। শঙ্কর যদি না-ও ফেরে তো কাকার পুরো সম্পত্তির মালিকানা তাদের উপরে বর্তায়, তা থেকে তারা বঞ্চিত হবে কেন? আসলে তাদের কথাও আমার মনে ছিল। কাকার কথায় তাই আমি রাজি হইনি।”
একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন কেদারেশ্বর। গাম্ভীর্যের মেঘটা সরে গিয়ে তাঁর মুখে আবার ইতিমধ্যে হাসির আভাস দেখা দিয়েছিল। বললেন, “আর তা ছাড়া এটাও ভেবে দ্যাখো চারুদা যে, আমার তো কোনও অভাব নেই। ঠাকুর্দা একটা বাড়ি করে রেখে গিয়েছিলেন, সেই বাড়িতেই আমি আর অনুপমা দিব্যি আছি। ব্যাঙ্কে রয়েছে প্রভিডেন্ড ফান্ড আর গ্র্যাচুইটির পুরো টাকা, তার থেকে যে সুদ পাই, তাতেই আমাদের চমৎকার চলে যায়। আর তা ঝাড়া, অনুপমা তার বাপ-মায়ের একমাত্র সন্তান। তাঁদের মৃত্যুর পর অনুপমাও বেশ কয়েক লাখ টাকা পেয়েছে। তা হলে? কাকার কথায় রাজি হলে অবশ্য আরও অনেক অনেক টাকা আমাদের হত। কিন্তু সেই টাকাটা আমাদের কোন কাজে লাগবে? না চারুদা, টাকার জন্যে টাকা করায় আমার বিশ্বাস নেই। কাকার সম্পত্তি ন্যায্যত যাদের পাওয়া উচিত, তারা পেলেই আমরা খুশি হব। …আর হ্যাঁ, তারাই যে পাবে, ডোরাকে নিয়ে শঙ্কর এখানে আসার পরে তেমন একটা সম্ভাবনা যে দেখা দেয়নি, তাও কিন্তু নয়।”
ভাদুড়িমশাই বলেনল, “শঙ্কর আর ডোরা কি এখন এখানে?”
“ডোরা এখানেই। তবে শঙ্কর তার ছেলেকে নিয়ে লন্ডনে ফিরে গেছে। ছেলে একটা পাবলিক স্কুলে পড়ে, তাই ক্লাস কামাই করে বেশি দিন এখানে থাকতে পারেনি। তবে যাবার আগে নাকি বলে গেছে যে, উইন্টারের লম্বা ছুটিটা সে এখানে এসে তার দাদুর সঙ্গে কাটিয়ে যাবে।”
“ওরা কবে এসেছিল?”
“ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। কাকাও সেই থেকে এখানেই আছেন। ডোরা এখনও রয়েছে তো। ও যদ্দিন থাকবে, অন্তত তদ্দিন পর্যন্ত ধুবুড়ি ছেড়ে কাকা কোথাও যাবেন বলে মনে হয় না। মায়া-মমতার বন্ধন যে কাকে বলে, কাকা তো অ্যাদ্দিন পর্যন্ত তা জানতেন না, জানবার চেষ্টাও করেননি। কিন্তু এখন বোধহয় সেই বাঁধনে একটু-একটু করে জড়িয়ে যাচ্ছেন। অনুপমা খুব খুশি। সে বলে, মেয়েটা ভাল বলে এটা সম্ভব হল। আমারও সেই একই কথা। সত্যি খুবই লক্ষ্মী মেয়ে। বেশ বুদ্ধিমতীও। পুরো মেমসায়েব তো নয়। মা খাঁটি মেমসায়েব বটে, তবে বাপ ইন্ডিয়ান। হয়তো সেইজন্যেই আমাদের ইন্ডিয়ান ভ্যালুজ বলতে যা বুঝি, ওর রক্তে সেটা কিছু-কিঞ্চিৎ রয়েছে, বুড়োদের নিতান্ত আবর্জনা বলে ভাবে না। তা আজ রাত্তিরে তো আমরা সবাই ও-বাড়িতে যাচ্ছি। তখন নিজের চোখেই সব দেখতে পাবে।”
ভাদুড়িমশাই কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগে পরেশ এসে ঘরে ঢুকল। বলল, “এখানেই একজন প্যাসেঞ্জার পেয়ে গেলুম স্যার। নলবাড়ি পর্যন্ত যাবেন। কাল ভোরে রওনা হব। তাই রাতটা এখানে থাকব বলে ভাবছি।”
কেদারেশ্বর বললেন, “বেশ তো, থাক। তবে মা’কে বলে রাখ যে, রাত্তিরে তুই এখানেই খাবি।”