৮
যেমন ভাদুড়িমশাই তেমন সদানন্দবাবুও আজ ভোর পাঁচটায় গৌহাটি থেকে রওনা হবার আগে স্নানের পর্বটা সেরে নিয়েছিলেন। স্নান হয়নি শুধু আমারই। কিন্তু এ-বাড়ির কাজের লোক শিবু যখন এসে জানাল যে, বাথরুমে আমার জন্যে সাবান তোয়ালে শ্যাম্পু, সবই দেওয়া হয়েছে, তখন সদানন্দবাবু বায়না ধরলেন, তিনিও আর-একবার স্নান করবেন। “সারাটা রাস্তা তো ধুলো আর ডিজেলের ধোঁয়া খেতে-খেতে এইচি, আর-একবার মশাই চান না-করলেই নয়।” তাতে অবশ্য কোনও অসুবিধে হল না। বাড়িটা একতলা হলেও, শুধু ভিতর-বাড়িতেই দু’ দুটো বাথরুম। শিবু গিয়ে পাশাপাশি সেই বাথরুম দুটোয় আমাদের ঢুকিয়ে দিয়ে এল। জলেরও অভাব নেই। শাওয়ার খুলে আরাম করে স্নান করেছি। এবারে খেতে বসব। তার আগে বাড়িটার একটা বর্ননা দিই।
এদিককার বাড়ি সাধারণত যেমন হয়, এটাও সেই রকমের বাড়ি। অর্থাৎ পুরোপুরি পাকা নয়। ভিতটা পাকা, মেঝেও নকশা-করা টালির, কিন্তু দেওয়াল কাঠের। ঘরগুলির পার্টিশনও মেঝে থেকে ফুট-তিনেক পর্যন্ত ইট দিয়ে গেঁথে প্লাস্টার করা, তার উপরের অংশে কাঠের কাজ। কাঠের পার্টিশন রং দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়নি, সবই বার্নিশ করা। কাঠের যে নিজস্ব কিছু জড়ুল বা চক্কর থাকে, তার প্রতিটি তার ফলে স্পষ্ট হয়ে ফুটেছে, সেই সঙ্গে এটাও বোঝা যাচ্ছে যে, এগুলি দামি সেগুন কাঠ। জানালাগুলি বেশ বড় সাইজের। তার ফ্রেম কাঠের হলেও পাল্লা কাচের। লাল রঙের ঢেউ-খেলানো টিনের চালের এইসব বাড়ি খুব সহজেই আমাদের চোখ টেনে নেয়।
আসলে কাঠ কাচ আর টিনকে প্রাধান্য দিয়ে বাড়ি বানাবার এই যে পদ্ধতি, উত্তরবঙ্গ থেকে শুরু হয়ে এটা গোটা উত্তরপূর্ব ভারত, ব্রহ্মদেশ, থাইল্যান্ড, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপিনস ইত্যাদি দেশ পার হয়ে আরও অনেক দূর পর্যন্ত চলে গেছে। এর সঙ্গে আমাদের মধ্য, দক্ষিণ, পশ্চিম কিংবা উত্তর ভারতের গৃহনির্মাণ-পদ্ধতির কোনও মিল নেই। উত্তরবঙ্গে যার সূচনা, উত্তর-পূর্ব ভারত পেরিয়ে যতই দক্ষিণ-পুবে যাওয়া যায়, এই পার্থক্যটা ততই আরও স্পষ্ট হয়ে ফোটে। ঘরবাড়ি দেখলে মনে হয়, একেবারে অন্য একটা জগতে এসে পৌঁছেছি। কিন্তু আপাতত সে-প্রসঙ্গে যাচ্ছি না; কেদারেশ্বর ফুকনদের বাড়ির কথা বলছিলুম, সেই কথাতেই ফিরে যাই।
ফুকনদের এই বাড়িটা একতলা হলেও বেশ ছড়ানো। আয়তন নেহাত কম নয়, বেডরুম অন্তত গুটি চারেক, তা ছাড়া, কিচেন, বাথরুম, ডাইনিং হল আর ড্রয়িং রুম তো আছেই। বাড়ির সামনে পালিশ-করা লাল সিমেন্টের টানা চওড়া বারান্দা। তার সামনে বাগান। পরিচ্ছন্ন বাগানটি দু’ভাগ করা। মাঝখান দিয়ে ফুট চারেক চওড়া যাতায়াতের পথ। বাগানের সীমানা শেষ হবার পরে বাড়ির হাতায় ফুট দশেক চওড়া ড্রাইভ, যা দিয়ে বাড়ির পিছনে চলে যাওয়া যায়। সেখানেই বেশ বড়সড় গ্যারাজ। তাতে পাশাপাশি দু’খানা গাড়ি দিব্যি এঁটে যাবে।
কেদারেশ্বর ফুকনের বাবা সুরেশ্বর ফুকন যে বেঁচে নেই, কলকাতার ব্যাবসা গুটিয়ে ধুবড়িতে ফিরে আসার বছর কয়েক বাদেই যে তিনি মারা যান, গৌহাটিতে মহিম বরুয়ার কাছেই তা শুনেছি। এখানে এসে জানা গেল যে, বেঁচে নেই মা’ও। আর কেদারেশ্বরের একমাত্র সন্তান যে ছেলে, সে যে বিয়ে-থাওয়া করে বিদেশেই থেকে গেছে, তার আর দেশে ফেরার কোনও সম্ভাবনাই নেই, তাও জানি। কাজের লোকজন ছাড়া এই বিরাট বাড়ির বাসিন্দা তাই এখন মাত্র দু’জন, কেদারেশ্বর আর তাঁর স্ত্রী। স্ত্রীর নাম অনুপমা। হাসিখুশি মহিলা, একটু আগে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। অনুপমা দেবী অবশ্য আমাদের সঙ্গে খেতে বসলেন না। বললেন, “কাজের লোকরাও না-খেয়ে আছে। তাদের খেতে না-দিয়ে আমি খাই কী করে? আপনারা খেয়ে নিন, তারপর ওদের দিয়ে আমি খেতে বসব।”
খাওয়ার টেবিলে গোড়ার দিকে একবার সুশান্ত চৌধুরির কথা উঠেছিল। কথাটা কেদারেশ্বরই তুলেছিলেন। কিন্তু ভাদুড়িমশাই তাকে বাধা দিয়ে বললেন, “ও-সব কথা খাওয়ার পরে ধীরেসুস্থে শুনব। এখন তোমার হাতের কথাটা হলো তো। কাদের কুকুর? হঠাৎ তোমাকে কামড়াতেই বা গেল কেন?”
কুকুরের কামড় সম্পর্কে সদানন্দবাবুর অভিজ্ঞতা বিশেষ ভাল নয়। রাস্তার কুকুরের কামড় খেয়ে একবার তাঁকে গুচ্ছের ইঞ্জেকশন নিতে হয়েছিল। সেই কথাটা নিশ্চয় তাঁর মনে পড়ে গিয়ে থাকবে। তাই কেদারেশ্বর কিছু বলবার আগে তিনি প্রশ্ন করলেন, “নেড়িকুত্তা নয় তো?”
“না না, নেড়িকুত্তা নয়, পোষা কুকুর।” কেদারেশ্বর বললেন, “তা ছাড়া কুকুরটা আমার চেনা, আমাকে খুব পছন্দও করে। কতদিন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছি, নিজের হাতে বিস্কুট খাইয়ে দিয়েছি। আমাকে একবার দেখলেই হল, সঙ্গে-সঙ্গে ছুটে এসে ল্যাজ় নাড়তে থাকবে।”
“তা নাড়ুক, সেটা কোনও কতা নয়। আসল কতা হল, ন্যাজটা কীরকম, সেটা কি আপনি খ্যাল করে দেকেছেন?”
কেদারেশ্বর ডাল দিয়ে ভাত মেখে মুখে তুলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সদানন্দবাবুর কথা শুনে হাতটা আর মুখ পর্যন্ত পৌঁছল না, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়ে বললেন, “তার মানে? ল্যাজ আবার কীরকম হবে? কুকুরের ল্যাজ যেমন হয়, সেইরকম।”
“না না, তা আমি বলছি না,” সদানন্দবাবু বললেন, “কুকুরের ন্যাজ যে টিয়াপাখির ন্যাজের মতো হবে না, সে তো আমরা সবাই জানি। আসলে আমি জানতে চাইচি যে, ন্যাজটা কি একটা বিড়ের মতো পাকানো ছিল, নাকি ভার্টিক্যালি একটা স্ট্রেট লাইনের মতো মাটির দিকে ঝুলে ছিল?”
কেদারেশ্বর আমতা-আমতা করে বললেন, “তা তো নজর করে দেখিনি। বাট ডাজ ইট মেক এনি ডিফারেন্স?”
“বাঃ, ডিফারেন্স আচে বই কী, হেভেন অ্যান্ড হেল ডিফারেন্স!” সদানন্দবাবু কেদারেশ্বরকে এই জবাব দিয়ে বেশ বড় এক টুকরো ভাজা মাছ মুখের মধ্যে চালান করে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “অতি উপাদেয় মাচ মশাই। এমন সোয়াদের মাচের কতা তো কলকাতায় আমরা ভাবতেও পারি না।”
বললুম, “কী করে পারবেন? কলকাতায় কি আমরা ধুবড়ির ব্রহ্মপুত্রের এই টাটকা তাজা রুই মাছ পাই? সেখানে তো পাই অন্ধ্রের চালানি মাছ।”
ভাদুড়িমশাই মৃদু-মৃদু হাসছিলেন। হাসি থামিয়ে বললেন, “মাছের প্রসঙ্গ আপাতত মূলতুবি থাক। কুকুরের ল্যাজের কথা হচ্ছিল। তা ডিফারেন্সটা কী, তা তো বোঝা গেল না।”
সদানন্দবাবু বললেন, “ওই যে বললুম, ডিফারেন্স একেবারে হেভেন অ্যান্ড হেলের। মানে লাইফ অ্যান্ড ডেথের। আরে মশাই, যে কুকুরের ন্যাজ পার্পেন্ডিকুলারের মতো মাটির দিকে ঝুলে পড়েছে, সেটা তো ম্যাড গড, পাগলা কুকুর। তার কামড় খেলে আর রক্ষে নেই, ইঞ্জেকশন আপনাকে নিতেই হবে। না নিলেই জলাতঙ্ক।”
“কী হে কেদার,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কুকুরটা পাগল কি না, খোঁজ নিয়েছ?”
কেদারেশ্বরের মুখে একটু আগেই মেঘ জমে উঠেছিল। দেখলুম সেটা কেটে গেছে। বললেন, “আরে না, ম্যাড ডগ নয়, সুস্থ স্বাভাবিক পোষা কুকুর। কলকাতা থেকে তো গত রোববার বারো তারিখে গুয়াহাটি চলে আসি। রাতটা গুয়াহাটিতে কাটিয়ে পরদিন সকালে… মানে পরশু তেরো তারিখের সকালে ধুবুড়ি ফিরি। ফেরার পথেই কোকরাঝাড়ে সুশান্তের বাড়িতে খোঁজ করতে গিয়েছিলুম যে, সে ফিরল কি না। তো সেখানেই সুশান্তের পোষা কুকুরটা আমাকে কামড়ে দেয়। তবে ভয়ের কিছু নেই। আজ সকালেও ওখান থেকে ফোন পেয়েছি যে, কুকুরটা ভালই আছে, অন্তত এখনও পর্যন্ত তার মধ্যে পাগলামির কোনও লক্ষণ দেখা দেয়নি।
সদানন্দবাবু বললেন, “তাই বলে নিশ্চিন্ত বসে না-থেকে আরও কয়েকটা দিন কুকুরটাকে একটু ওয়াচে রাকবেন।”
অনুপমা দেবী পরিবেশন করছিলেন। বললেন, “আপনারা তো শুধু গল্পই করছেন, কিছুই তো খেলেন না। রান্না ভাল হয়নি বুঝি?”
সদানন্দবাবু একেবারে হাঁ-হাঁ করে উঠলেন। “ভাল হয়নি মানে? ডাল থেকে শুরু করে ওই যে… টককে যেন আপনারা কী বলেন? যাচ্চলে, কতাটা ভুলে গেলুম যে?”
অনুপমা দেবী হেসে বললেন, “ট্যাঙা।”
“ইয়েস, ট্যাঙা।” সদানন্দবাবু বললেন, “ডাল থেকে ট্যাঙা পর্যন্ত প্রতিটি আইটেম তো দু-দু’বার করে চেয়ে খেলুম। রান্নার কতা বলছিলেন তো, অতি চমৎকার হয়েছে। ওটা কী? পায়েস?”
“হ্যাঁ। এ-বাড়িতে দোকানের মিষ্টি চলে না। উনি বললেন, পায়েস করো। তাই করেছি। এখন খেয়ে দেখুন কেমন হয়েছে।”
কাচের বাটিতে পায়েস দেওয়া হয়েছে। বাটিটাকে পাতের উপরে তুলে নিলেন সদানন্দবাবু। তারপর চামচেতে করে খানিকটা পায়েস মুখে ফেলে চোখ বুজে বললেন, “উরেব্বাবা, এও তো দেকচি দেবভোগ্য জিনিস করেচেন। কিন্তু কীসের পায়েস, তা তো বুজতে পারলুম না। আলুর?”
“না। লাউয়ের।”
“সে কী, লাউয়েরও পায়েস হয়?”
“হবে না কেন,” অনুপমা দেবী হেসে বললেন, “তবে লাউটা একেবারে কচি হওয়া চাই। আজ রাত্তিরে তো আপনারা ও-বাড়িতে খাচ্চেন, সেখানে দেখবেন এই জিনিসই ও-বাড়ির রাঁধুনি আরও কত ভাল করে।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ও-বাড়ি মানে?”
“আমার খুড়শ্বশুরের বাড়ি।” কেদারেশ্বরের দিকে তাকিয়ে অনুপমা দেবী বললেন, “তুমি ওঁদের বলোনি?”
“ওঁরা তো একটু আগে এসে পৌঁছলেন, তাই এখনও বলা হয়নি।” স্ত্রীর প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে কেদারেশ্বর বললেন, “আমার কাকার বাড়ি এখান থেকে খুব কাছেই। তো চারুদা, তোমরা আসছ শুনে কাকা বললেন, আজ রাত্তিরে সবাই যেন তাঁর ওখানেই খাই। রাত্তিরে তোমাদের থাকার ব্যবস্থাও তিনি ওই বাড়িতেই করে রেখেছেন। খাওয়ার পরে আমি আর অনুপমা এ-বাড়িতে ফিরে আসব, তোমরা ওখানেই থেকে যাবে। বিরাট বাড়ি, একেবারে ব্রহ্মপুত্রের ধারে, দেখো, তোমাদের খারাপ লাগবে না। …কী, আপত্তি নেই তো?”
“না না, আপত্তির কী আছে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা ছাড়া, তুমি আমাদের হোস্ট, তুমি যা বলবে, তা-ই হবে। কিন্তু তোমার কাকা মহেশ্বর ফুকন মশাই তো শুনেছি মস্ত বিজনেসম্যান। তা তিনি কি আজকাল ধুবড়িতে থাকেন নাকি?”
“আজকাল থাকেন। মানে মাস দুয়েক হল এখানেই টানা রয়েছেন। …কিন্তু আমার কাকাকে তুমি চেনো?”
“সাক্ষাৎ-পরিচয় নেই, তবে তিনি যে এ-রাজ্যের একজন নামজাদা ব্যবসায়ী, তা জানি বই কি। অবিশ্যি এটাও শুনেছি যে, বয়েস হয়ে গেছে বলে আর দেখাশোনা করার মতন উপযুক্ত লোক নেই বলে মহেশ্বর ফুকন তাঁর ব্যাবসা আস্তে-আস্তে গুটিয়ে নিচ্ছেন। ঠিক কথা?”
তক্ষুনি এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না কেদারেশ্বর। একটু পরে বললেন, “চলো, বসবার ঘরে যাওয়া যাক। ওখানে সব বলব।”
ডাইনিং টেবিল ছেড়ে উঠে পড়তে অনুপমা দেবী তাঁর বালক-ভৃত্যটিকে বললেন, “শিবু, জায়গাটা পরিষ্কার করে দাও, তারপর তোমরা খেতে বোসো। … আর হ্যাঁ, ওই যে ছেলেটি গাড়ি চালিয়ে এসেছে, তাকেও ডেকে নিতে ভুলো না।”
বেসিনে হাত-মুখ ধুয়ে আমরা ড্রয়িং রুমে চলে এলুম।
সেন্টার টেবিলে অ্যাশট্রে’র পাশে একটা কাট-গ্লাসের বাটিতে দেখলুম আলাদা-আলাদা খোপের মধ্যে মৌরী, লবঙ্গ আর এলাচদানা রয়েছে। আমরা দু-একটি করে এলাচদানা তুলে নিলুম ভাদুড়িমশাই একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, “কী সদানন্দবাবু, একে লম্বা জার্নি, তার উপরে এই ভূরিভোজ, ঘুম পেয়ে যায়নি তো?”
কেদারেশ্বর বললেন, “বেশ তো, পাশের দুটো ঘরে আপনাদের জন্যে বিছানা করে রাখা হয়েছে, ইচ্ছে হলে একটু গড়িয়ে নিতে পারেন, কথাবার্তা পরেও হতে পারবে।”
সদানন্দবাবু বললেন, “না না, আমার একটুও ঘুম পায়নি। তবে আমি থাকলে যদি আপনাদের কথাবার্তার অসুবিদে হয়…”
“কিচ্ছু অসুবিধে হবে না।” কেদারেশ্বর হেসে বললেন, “আপনারা যে চারুদার খুবই কাছের লোক, তা আমি জানি।”