৭
ডজন তিনেক স্যান্ডুইচ ছাড়াও ঝুড়ির মধ্যে রয়েছে ডজন খানেক পেস্ট্রি আর কিছু সন্দেশ। সেই সঙ্গে বড় সাইজের দু’ দুটো ফ্লাস্ক ভর্তি কফি আর কয়েক বোতল মিনারেল ওয়াটার। অর্থাৎ কলকাতার অতিথিদের যাতে অন্তত ক্ষুন্নিবৃত্তির ব্যাপারে কোনও অসুবিধে না হয়, তার ব্যবস্থা করতে মহিম বরুয়া মশাই কোনও ত্রুটি রাখেন নি। ঝুড়ির মধ্যে কাগজের কিছু প্লেট আর প্লাস্টিকের গোটাকয় গেলাশও দিয়ে দিয়েছেন। ফলে পানভোজন নির্বিঘ্নে সমাধা হল। কফি খেতে-খেতে সদানন্দবাবু বললেন, “রাগে আমার গা জ্বলে যাচ্চিল, মশাই।”
বলেই সম্ভবত তাঁর সন্দেহ হল যে, কার উপরে রাগ, সেটা আমরা ধরতে পারিনি। তাই ব্যাখ্যা করে বললেন, “ওই মিলিটারিগুলোর ব্যাভার দেকলে তো যে-কোনও ঠান্ডা মেজাজের মানুষও ফায়ার হয়ে যাবে।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “কেন, ওরা আবার কী করল?”
“বাঃ, সার্চ করার নামে কীভাবে আমাদের হ্যারাস করল, সেটা ভুলে গেলেন?”
“কিন্তু, সদানন্দবাবু, সার্চ করাটাই তো ওদের কাজ, সেটা ওরা করবে না?”
“তাই বলে অতক্ষণ ধরে করবে?” সদানন্দবাবু বললেন, “আর তা ছাড়া নিজেরা তো দিব্যি মগে করে গর্মাগরম চা খাচ্ছিল, আমাদেরও যে চায়ের তেষ্টা পেয়ে থাকতে পারে, সেটা ওদের বোজা উচিত ছিল, মশাই। আমাদেরও তো এক-এক মগ অফার করতে পারত।”
বললুম, “সেটা করেনি বলেই রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিল আপনার?”
“জ্বলবে না? আমি তো তেড়ে দু’কতা শুনিয়ে দিতুম। পরে দেকলুম, আপনারা যখন চুপ করে রয়েচেন, তখন একা আমিই বা কেন বকাঝকা করতে যাই।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “সেটা না-করে ভালই করেছেন।”
“এ-কতা বলচেন কেন?”
“তাও বুঝতে পারছেন না?” আমি বললুম, “রাইফেলগুলো কাদের কাঁধে ঝুলছিল? আমাদের, না ওদের?”
“কেন, ওদের।”
“তো সেটাই হচ্ছে আসল কথা।” ভদুড়িমশাই হেসে বললেন, “যাদের কাঁধে রাইফেল ঝোলে, ভুলেও তাদের বকাঝকা করতে নেই। তাদের মধ্যে এক-আধটা ট্রিগার-হ্যাপি লোক তো থাকতেই পারে। দুমদাম তারা গুলি চালিয়ে দেয়। আর চলালেই তো হয়ে গেল, যে-কাজটা আমরা করতে এসেছি, সেটায় হাত দেবার আগেই তখন এই রাস্তার উপরে চিতপটাং হয়ে পড়ে থাকতে হবে।”
“ওরে বাবা!” সদানন্দবাবু শিউরে উঠে বললেন, “ঠিক, ঠিক! এ একেবারে লাক কতার এক কতা কয়েচেন! বাপ রে, কী ভুলই না করতে যাচ্ছিলুম! একেবারে বেঘোরে মারা পড়তে হত! ওদিকে আবার কমলির মা’কে প্রমিস করে এইচি যে, এখেন থেকে তাঁর আর কমলির জন্যে আমি দুখানা মুগা শাড়ি নিয়ে ফিরব উইথ ব্লাউজ পিস। সে-সব তো কিছুই হত না, মশাই!”
পরেশ গিয়ে বনেটের ডালা নামিয়ে বলল, “গাড়ির রেস্ট হয়ে গেছে, এবারে আপনারা উঠে পড়ুন।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনারা উঠে পড়ুন। কাগজের এই এঁটো প্লেট আর প্লাস্টিকের গেলাশগুলো এখানে রাস্তার উপরে ছড়িয়ে রেখে যাওয়া ঠিক হবে না, আমি এগুলোকে একটা কাগজে মুড়ে ডিকিতে তুলে দিচ্ছি, এরপরেই তো বরপেটা শহর আসবে, সেখানে একটা ভ্যাটের মধ্যে ফেলে দেব।”
বরপেটা জেলায় তো এরই মধ্যে ঢুকে পড়েছি, তবে শহরে পৌঁছতে আরও বেশ কিছুটা সময় লেগে গেল। ঘিঞ্জি শহর, রাস্তা জুড়ে ট্রাকের ভিড়, প্রচুর দোকানপাট, প্রতিটি দোকানেই ট্রানজিস্টরে আর টেপ-রেকর্ডারে তারস্বরে হিন্দি ফিল্মের গান বাজছে, গোটাকয় প্রাইভেট গাড়ি পার্কিং করার জায়গা খুঁজছে, তিন-চারটে যাত্রিবাহী বাস থেকে কানে তালা ধরিয়ে মুহুর্মুহু বাজানো হচ্ছে এয়ার-হর্ন, বড়-বড় গোটা দুই-তিন রেস্তোরাঁ-কাম-হোটেলও আমাদের চোখে পড়ল।
পরেশ বলল, “এই যে ট্রাকগুলোকে দেখছেন, এদের ড্রাইভার কুলি আর ক্লিনাররাই এই হোটেলগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছে।”
একে তো আমরা কফিতে অভ্যস্ত নই, তার উপরে যে-রাজ্যে এসেছি, সেটা চায়েরই রাজ্য, কিন্তু সেখানে এসেও চায়ের বদলে কফি গিলতে হল, ফলে যেমন আমাদের তেমন সদানন্দবাবুরও যে মন একটু খুঁতখুঁত করছিল, সেটা তাঁর প্রশ্ন শুনেই বুঝতে পারলুম। “ওহে ভাই পরেশ, এখানে চা পাওয়া যায় না?”
একটা জ্যামের জালে আমাদের গাড়িটা আটকে গিয়েছিল। খুব সন্তর্পণে জাল কেটে বেরুতে-বেরুতে পরেশ বলল, “যায়, কিন্তু কোথায় বসে খাবেন?”
“কেন, হোটেলের সঙ্গে রেস্টুরেন্টও তো রয়েচে দেকচি, ওখানে বসে খাব।”
‘পারবেন না, স্যার।” সামনের দিকে চোখ রেখে, অ্যাক্সিলেটরে পায়ের চাপ সামান্য বাড়িয়ে পরেশ বলল, “বড্ড নোংরা। বাইরে থেকে দেখে বুঝতে পারছেন না, কিন্তু ভিতরে ঢুকলে দেখবেন টেবিলের ওপরে মাছি থিকথিক করছে। ট্রাকের লোকেরা ও-সব নিয়ে মাথা ঘামায় না, তারা পারে।”
আস্তে-আস্তে ভিড়ভাট্টা কমে এল। গাড়ির স্পিডও বাড়িয়ে দিল পরেশ। তারপরে শহরের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে ফাঁকা রাস্তায় পড়ে বলল, “মাইল দশেক পরে একটা ধাবা আছে। আমার চেনা। সেখানেও অবশ্য বেশির ভাগ খদ্দের এইসব ট্রাকেরই লোক… এদের ছাড়া তো আর ধাবা চালানো যায় না… তবে কিনা জায়গাটা এখানকার চেয়ে অনেক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বললে পরে ভাল করে ধুয়ে-মেজে স্টিলের গেলাসে ঘন দুধে এলাচ-দারুচিনি দিয়ে ফুটিয়ে চা করে দেবে। চা খেতে হলে সেখানে খাবেন। পাশে একটা পেট্রোল পাম্প আছে, আমার অবশ্য তেল নেবার দরকার নেই, গুয়াহাটি থেকেই কাল রাত্তিরে আমার ট্যাঙ্ক ভর্তি করে নিয়েছি, তবে আপনারা চা খাবেন তো, সেই ফাঁকে আমি টায়ারের হাওয়াটা একবার চেক করিয়ে নেব।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “কী সদানন্দবাবু, এলাচ-দারচিনির চা চলবে নাকি?”
“যদি বলি যে, এলাচ-দারচিনি বাদ দিয়ে চা করে দাও, তা হলে কি ওরা রেগে যাবে?” সদানন্দবাবু ঢোঁক গিলে বললেন, “মানে চায়ের নামে গরম শরবত খেতে হবে কেন? এমনি চা-ই তো ভাল। সেটা পাওয়া যাবে না।”
“পাওয়া যাবে, তবে খাওয়া যাবে কি না, তাতে সন্দেহ আছে। তার চেয়ে বরং এই মশলাদার চা-ই একদিন খেয়ে দেখুন, খারাপ লাগবে না।”
তা-ই হল। পরেশ যে ধাবার কথা বলেছিল, সেখানে পৌঁছে দড়ির খাটিয়ায় বসে চা খেলুম আমরা। পরেশ সেই ফাঁকে পাশের পেট্রোল পাম্পে ঢুকে হাওয়া চেক করিয়ে নিল তার গাড়ির টায়ারের। মিনিট কুড়ি-পঁচিশ বাদে আবার আমরা গাড়িতে উঠে পড়লুম। রাস্তার দু’ধারে আবার সেই ধুধু মাঠ আর চাষের জমি। অনেকক্ষণ বাদে-বাদে টুকরো-টুকরো লোকালয়ের, দু’ চারটে দোকানপাটের চকিত আভাস ফুটেই আবার মিলিয়ে যায়, তা ছাড়া দৃশ্যপটের আর -কোনও অদল-বদল ঘটে না। দেখতে-দেখতে চোখ জুড়ে আসে, ঘুম এসে যায়।
পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে উত্তরপূর্ব ভারতে বেড়াতে এসেছিলুম। সে-ই আমার প্রথম আসা। এদিকে তখন এত-সব রাজ্য গড়ে ওঠেনি, অসম বলতে তখন মস্ত একটা অঞ্চলকে বোঝাত, আজকের তুলনায় অসমের চৌহদ্দি তখন ছিল অনেক বড়। আজই ভোরবেলায় যে বিরাট ব্রিজের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে এলুম, সেই ব্রিজ তখন ভবিষ্যতের গর্ভে। সন্ধেবেলায় রেলগাড়ি থেকে নেমে কুলির মাথায় সুটকেস আর হোল্ডল চাপিয়ে ফেরিঘাটে পৌঁছে আজকাল যাকে ভটভটি বলে সেই মোটর-লাগানো নৌকোয় উঠে সেবারে নদী পেরিয়ে গুয়াহাটিতে পৌঁছতে হয়েছিল। ততক্ষণে রাত নেমেছে, আকাশে আলো নেই, দূরে-দূরে সম্ভবত অন্য সব নৌকোর পাটাতনে মিটমিট করে জ্বলছে লন্ঠনের আলো, ব্রহ্মপুত্র তো বিশাল চওড়া জলধারা, তার কুচকুচে কালো বুকের উপর দিয়ে ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে আমরা এক পার থেকে অন্য পারে চলেছি। বেশ যে ভয় পেয়েছিলুম, সেটা এখনও মনে পড়ে।
আর মনে পড়ে, আলিপুরদুয়ার থেকে আরও খানিক দূরত্ব পার হবার পর রেলগাড়ির জানলা থেকেই রোমাঞ্চিত হয়েছিলুম এদিককার প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য দেখে। শুধু কি গাছপালার বৈচিত্র্য? ধানের খেতে বসে আছে হলুদ-ঠোঁটওয়ালা বিশাল সাইজের ধনঞ্জয় পাখি; রেল-লাইনের পাশের ডোবায় বক আর সারসের মেলা বসেছে; সে-সব রাস্তা কখনও কাছে আসছে, আবার কখনও দূরে চলে যাচ্ছে, তার উপরে মস্ত-মস্ত কাঠের গুঁড়ি শুঁড়ে জড়িয়ে হেঁটে চলেছে হাতির মিছিল। এমন দৃশ্য তো এর আগে কখনও দেখিনি। এমন বনাঞ্চলই বা দেখলুম কোথায়? দেখেই বোঝা যায়, এ সেই ভার্জিন ফরেস্ট, যার গায়ে এখনও ব্যাবসাদার মানুষের লোভী হাতের ছোঁয়া লাগেনি। মেঘালয় বলে তখন কোনও রাজ্য ছিল না। দিশপুর নয়, শিলংই ছিল অসমের রাজধানী। কিন্তু গুয়াহাটি থেকে শিলং যাবার রাস্তাটা ছিল এতই সরু যে, নংপোতে একদিকের গাড়িগুলোকে আটকে রেখে তবে অন্যদিকের গাড়িগুলোকে সামনে এগোতে দিত! তখন আটকে-থাকা গাড়ির মিছিলের সামনে রাস্তার পাশের পাহাড় থেকে নেমে আসত খাসিয়া বস্তির অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা। হাতে ফলের টুকরি। তাতে পেঁপে ছাড়াও নানা রকমের পাহাড়ি ফল। গাড়ির ভিতরকার টুরিস্টদের কাছে ফল বেচে, দাম নিয়ে, হাসতে-হাসতে তারা আবার পাহাড়ে উঠে যেত।
পুরনো দিনের ভাবনার মধ্যে এতই ডুবে গিয়েছিলুম যে, আশপাশের পরিবেশ কিংবা মানুষজন সম্পর্কে সম্ভবত কোনও হুঁশই আমার ছিল না। সদানন্দবাবুর চিৎকারে তাই যেন একটা ধাক্কা খেয়ে সেই অতীত থেকে আবার বর্তমানে ফিরে এলুম।
“আরে ওই তো… ওই তো সেই লোকটা!”
শুধু আমি নই, চমকে গিয়েছিলেন ভাদুড়িমশাইও। সামনের সিট থেকে পিছন ফিরে তাকিয়ে তিনি বললেন, “কী হল সদানন্দবাবু, কার কথা বলছেন?”
পরেশও স্পিড কমিয়ে, ইঞ্জিন কেটে দিয়ে, রাস্তার একধারে গাড়িটাকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করল, “চেনা কাউকে দেখলেন?”
“তা তা দেকলুমই!” সদানন্দবাবু বললেন, “ওই বাসটার পিছনের সিটে বসে ছিল। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতে হাসলও একবার। কিন্তু বাসটা তো ডান দিকের রাস্তা ধরে চলে গেল মশাই!”
পরেশ বলল, “ওটা বঙ্গাইগাঁও স্টেশনে যাবার রাস্তা।”
আমি বললুম, “তার মানে আমরা বরপেটা জেলা ছাড়িয়ে বঙ্গাইগাঁওয়ে ঢুকেছি?”
“বেশ কিছুক্ষণ আগেই ঢুকেছি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনি বোধহয় একটু অন্যমনস্ক ছিলেন, তাই রাস্তার ধারে বসানো রুট-ইন্ডিকেটরটা খেয়াল করেননি। …কিন্তু সদানন্দবাবু, বাসটার মধ্যে আপনি কাকে দেখলেন?”
“সেই সন্নিসিকে।”
“সন্নিসি?” ভাদুড়িমশাই ভুরু কুঁচকে সদানন্দবাবুর দিকে তাকালেন। “কোন সন্নিসি?” আমি বললুম, “সে তো কাল রাত্তিরে খাওয়ার টেবিলে বসেই আপনাকে বলেছিলুম।”
ভাদুড়িমশাই এবারে আমার দিকে চোখ ফেরালেন। তাঁর ভুরু তখনও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে যায়নি, কুঁচকেই আছে। বললেন, “কই, আমার মনে পড়চে না তো?”
বললুম, “বোধহয় আপনি তখন অন্য কিছু ভাবছিলেন। তাই ঠিক শুনতে পাননি। কিংবা হয়তো গা করেননি।”
“এখন করছি। সন্নিসিটি কে? সদানন্দবাবু কি তাকে আগে থাকতে চিনতেন? নাকি এখানে এসে চেনা-পরিচয় হয়ছে।”
“এখেনে মানে কামিখ্যে পাহাড়ে।” সদানন্দবাবু বললেন, “মায়ের মন্দিরের সামনের চত্বরে একটা গোদা বাঁদর আমার পকেট থেকে মনিব্যাগটা তুলে নিয়ে পালিয়ে যায়। সেই সন্নিসির সঙ্গে ছিল একটা ফেরোশাস কুকুর। সন্নিসি-ঠাকুর কুকুরটাকে বাঁদরের পেছনে লেলিয়ে দেন। কিন্তু কুকুর তো আর গাচে চড়তে পারে না। ইদিকে বাঁদরটা আমার পকেট মেরেই তরতর করে একটা গাচের মগডালে উটে গেসল। সেখেন থেকে সে ভ্যানিশ হয়ে যায়। তাই কুকুরটা তাকে ধরতে পারেনি। তা না-ই পারুক, সন্নিসি-ঠাকুর যে খুবই হেল্পফুল অ্যান্ড কাইন্ড-হার্টেড, সেটা তো মানবেন। তাই ভাবছিলুম যে…
“কী ভাবছিলেন?”
“না মানে ভাবছিলুম যে, দ্যাকাটা হয়ে গেল, উনি হাসলেনও, অথচ কথাবার্তা হল না… সেটা হলে অন্তত আর-একবার ওঁকে থ্যাঙ্কু বলতে পারতুম।”
পরেশ বলল, “চান তো জোরে গাড়ি চালিয়ে বাসটাকে এখনও ওভারটেক করতে পারি… মানে খুব বেশি দূরে তো যায়নি। কী স্যার, ওভারটেক করব?”
“না না, ওভারটেক করতে হবে না,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ধুবড়িতে পৌঁছতে তা হলে আরও দেরি হয়ে যাবে। এখনও তো অনেকটা পথ বাকি… পথটা বিশেষ ভালও নয়… দেরি হলে কেদারেশ্বরের দুর্ভাবনা আরও বাড়বে।”
আমি বললুম, “সেই ভাল, সিধে এখন ধুবড়িতেই যাওয়া যাক। আর তা ছাড়া, একটা ব্যাপারে আমার একটু খটকা লাগছে।”
“সন্নিসি-ঠাকুর এত তাড়াতাড়ি এখানে এসে পৌঁছলেন কী করে, এই তো?”
গাড়ি আবার ইতিমধ্যে চলতে শুরু করেছিল। বললুম, “হ্যাঁ। কাল বিকেলেও তো ইনি কামাখ্যা-পাহাড়ে ছিলেন। তা ছাড়া যাচ্ছেন দেখলুম প্যাসেঞ্জার বাসে, যা কিনা নন-স্টপ চলে না, প্যাসেঞ্জার নামাতে-নামাতে আর ওঠাতে-ওঠাতে চলে। বাসটা তা হলে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে আমাদেরই সঙ্গে একেবারে একই সময়ে এখানে এল কী করে? হাউ ডাজ ওয়ান এক্সপ্লেন ইট?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “এটা আপনি ধরে নিচ্ছেন কেন যে, উনিও আমাদেরই মতো আজই সকালে গৌহাটি থেকে রওনা হয়েছেন? হয়তো উনি কাল বিকেলেই গৌহাটি থেকে বাস ধরে খানিকটা পথ… এই ধরুন নলবাড়ি কি বরপেটা পর্যন্ত চলে এসেছিলেন। তারপর রাত্তিরটা সেখানে কাটিয়ে আবার সকালবেলার বাসে উঠে বঙ্গাইগাঁওয়ে এসে পৌঁছেছেন।… কী, সেটা কি সম্ভব নয়?”
বললুম, “হ্যাঁ, তাও সম্ভব।”
“ব্যাপারটার সে-ক্ষেত্রে একটা সহজ ব্যাখ্যা পাওয়া যায় আর আপনারও কোনও খটকা থাকে না।”
সদানন্দবাবু বললেন, “কিরণবাবুকে নিয়ে এই হচ্চে সমিস্যে। সব ব্যাপারেই ওঁর খটকা, সব কিছুতেই সন্দেহ। কাক ডাকলেও ওঁর সন্দেহ যে ডাকল কেন, আবার না-ডাকলেও সন্দেহ যে, ডাকল না কেন। বাতিকগ্রস্ত লোক হলে যা হয় আর কী।”
আমার পিছনে লাগাটা দেখছি সদানন্দবাবুর স্বভাবে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। তবে তাঁর জন্য ওঁকে দোষ দেব না, কেননা সুযোগ পেয়ে গেলে আমিও এই একই কাজ করে থাকি। ফলে, কথাটা বিনা-প্রতিবাদে হজম করে নিয়ে আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলুম।
ভূপ্রকৃতির কিছু-কিছু পরিবর্তন ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রাস্তার দু’দিকে অবশ্য এখনও সেই চষা মাঠের একঘেয়ে দৃশ্য। যা দেখতে-দেখতে ক্লান্ত লাগে, ঘুম এসে যায়। হয়তো দু’চোখ ইতিমধ্যে বুজেও অসত। কিন্তু সেটা এই জন্যে হল না যে, দূর দিগন্তে ইতিমধ্যেই দেখা দিয়েছে পাহাড়ের সারি। ন্যাড়া পাহাড় যে নয়, তাও বোঝা যাচ্ছে। সাদাসাপ্টাভাবে যাকে ভুটানের পাহাড় বলা হয়, ওগুলো তারই নীচের দিকের অংশ, ভুটানের সীমানা ছাড়িয়ে দক্ষিণে অসম রাজ্যের মধ্যে নেমে এসেছে।
এই যে রাস্তা দিয়ে চলেছি, এ হল একত্রিশ নম্বর ন্যাশনাল হাইওয়ে। আগেও এই রাস্তা দিয়ে গিয়েছি বলে জানি যে, পাহাড় যখন দেখা দিয়েছে, বঙ্গাইগাঁও জেলার সীমানাও তখন প্রায় শেষ হয়ে এল, একটু বাদেই আমরা কোকরাঝাড় জেলায় ঢুকে পড়ব।
তা-ই ঢুকলুম। তারপর যতই আরও সামনে এগোতে লাগলুম, পাহাড়ের সারিও ততই এগিয়ে আসতে লাগল আমাদের কাছে। আমাদের বাঁ দিকে এখন সমতল ভূমি। চাষের মাঠ, গোলাঘর, ছোট-ছোট গ্রাম, চালাঘর, কাঠের কিংবা দরমার অর্থাৎ ছ্যাঁচা-বাঁশের দেওয়াল, টিনের কিংবা খড়ের চাল, টানা বারান্দার একতলা ইস্কুলবাড়ি, পাশের জমিতে বাচ্চা ছেলেরা ফুটবল খেলছে, রাস্তার ধারে পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকান। ডাইনে পাহাড়। তাতে ছোট-বড় অসংখ্য রকমের গাছ। সেই সঙ্গে এস্তার বাঁশঝাড়। বিহারের শালজঙ্গলে যাঁরা গেছেন, তাঁরা জানেন যে, সেখানে আন্ডারগ্রোথ বা আগাছার ভিড় খুব-একটা চোখে পড়ে না, ফলে একটু নিচু হয়ে তাকালে জঙ্গলের এলাকার অনেকখানি পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়। এখানে কিন্তু তেমন নয়। আগাছায় আর হরেক রকমের বুনো লতায় এদিককার জঙ্গলের তলার দিকটাও এমন ভরাট যে, সামনের দিকে বলতে গেলে প্রায় এগোনোই যায় না। যারা উপরে উঠতে চায়, তারা তাই ধারালো দা সঙ্গে নিয়ে জঙ্গলে ঢোকে, যাতে আগাছার বাধা আর লতাপাতার শেকল কাটতে-কাটতে পাহাড়ের উপরে ওঠা সম্ভব হয়। গাছপালাও এখানে এত ঘন যে, তাদের ডালপালা আকাশকে একেবারে আড়াল করে রাখে। ডুয়ার্সেও এই একই ব্যাপার।
ডুয়ার্সের প্রসঙ্গে দমনপুরের জঙ্গলের কথা মনে পড়ল। বাসে করে আলিপুর দুয়ার থেকে ভুটানের ফুন্সলিংয়ে যাচ্ছিলুম। পথে পড়েছিল এই জঙ্গল। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে বাসের রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে যেতে-যেতে মনে হচ্ছিল যেন ঘোর অন্ধকার একটা সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে চলেছি। ভরদুপুরে যাচ্ছিলুম, অথচ বাস যাচ্ছে হেডলাইট জ্বালিয়ে। সেই হেডলাইটের আলোয় যেটুকু দেখা যায়, তা ছাড়া আর কিছুই আমাদের চোখে পড়ছিল না। তারপর যখন জঙ্গল ছাড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে আসি, সূর্যদেবের হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে চোখ একেবারে ধাঁধিয়ে যাবার জোগাড়।
কোকরাঝাড়ের এই পাহাড়ি জঙ্গল অবশ্য ততটা ঘন নয়। মাঝেমধ্যে খানিক-খানিক ফাঁকও চোখে পড়ে। তবে সবটা মিলিয়ে এখানকার ভূপ্রকৃতির বাহার খুলেছে খুব। পাহাড় থেকে এখানেও হাতির পাল নেমে আসে কি না, আর নামলে এখানকার মানুষজন তাদের খেতের ফসল বাঁচাবার জন্য কী করে, পরেশকে জিজ্ঞেস করব ভাবছি, এমন সময় পথের একটা বাঁক ঘুরেই থেমে গেল আমাদের গাড়ি। কেন থামল, তা আর জিজ্ঞেস করার দরকার হল না। সামনে তাকিয়ে দেখলুম, সেই নলবাড়ির মতন এখানেও রাস্তা আটকে চেকিং চলছে। বিরক্তি চেপে অস্ফুট গলায় পরেশ বলল, “এখানে আবার কতক্ষণ আটকে রাখবে, কে জানে!”
এবারেও সেই একই প্রশ্নমালা। কোত্থেকে আসছি, কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, কত দিন থাকব। গাড়ি আর মালপত্রের তল্লাশিতে অবশ্য সময় এবারে আগের তুলনায় অনেক কম লাগল। মনে হল, ক্রমাগত এই একই কাজ করতে-করতে এদেরও কিছুটা বিরক্তি ধরে গিয়েছে। তা ছাড়া, এরা নিজেরাও সে সারাক্ষণ একটা টেনশনের মধ্যে থাকে, তাও ঠিক। ফলে হাতের কাজটা চটপট সেরে ফেলতে পারলে এরাও বেঁচে যায়।
কোকরাঝাড়ের সীমানা যখন পেরিয়ে আসি, তখন আরও একবার চেকিং হল। তবে এবারেও কাজটা সারা হল নমো নমো করে। সীমানা পেরিয়ে আমরা ধুবড়ি জেলায় এসে ঢুকলুম।
খানিক আগে যখন কোকরাঝাড়ের পাহাড়ি এলাকা দিয়ে গাড়ি চলছিল, তখন পাহাড়ের শোভা দেখতে-দেখতে আমি যে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলুম, ভাদুড়িমশাইয়ের সেটা নজর এড়ায়নি। বললেন, “কী অত ভাবছিলেন তখন?”
সদানন্দবাবু টিপ্পনী কেটে বললেন, “উনি হচ্চেন কবি-মানুষ, পাহাড় দেকে তাই বোধহয় মাতার মদ্যে কোনও একটা কাব্য-ভাবের উদয় হয়েছিল। ধুবড়িতে পৌঁছেই হয়তো খাতা-পেন্সিল নিয়ে একটা পদ্য লিকতে বসে যাবেন।’”
এই হচ্ছেন সদানন্দবাবু। যেহেতু আমি খবরের কাগজে কাজ করি, আর তার বাইরেও কিছু-না-কিছু লেখালিখির কাজও যেহেতু আমাকে উনি করতে দেখেছেন, আর সেইসব লেখা নিয়ে মাঝেমধ্যে যেহেতু এক-আধটা বইও আমার ছেপে বার হয়, তাই উনি ধরেই নিয়েছেন যে, নির্ঘাত আমি একজন কবি, এবং পাহাড় কিংবা নদী কিংবা জঙ্গল একবার দেখলেই হল, অমনি আমার মাথার মধ্যে পদ্যের পোকা কিলবিল করে ওঠে।
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আহা, সেটা কোনও কথা নয়। পাহাড় দেখে আমারই মাথায় ভাবের উদয় হচ্ছে, আর ওঁর তা হলে হবে না-ই বা কেন? কিন্তু সে-কথা হচ্ছে না। আমি বলছি, অন্য কোনও কথা উনি ভাবছিলেন কি না।”
বললুম, “কী আবার ভাবব। বুরুলি বলে কোনও কথা কখনও শুনেছেন?”
সদানন্দবাবু বললেন, “সেটা আবার কী? খায়, না গায়ে মাকে?
“কথাটার দুটো অর্থ হয়। আসতে-আসতে তো বিস্তর খোড়ো চালের বাড়ি দেখলেন। তো যা দিয়ে চাল ছাওয়া হয়, সেই খড় বস্তুটাকে অসমে বলে বুরুলি।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আর দ্বিতীয় অর্থটা?”
হেসে বললুম, “দ্বিতীয় অর্থে ওটা খাবার জিনিসই বটে। বুরুলি এক জাতের মাছের নাম। স্বাদু মাছ, যেমন এদিকে তেমন আমাদের ডুয়ার্সের ওদিকেও প্রচুর পাওয়া যায়। তা ধরে নিন যে, সেই মাছের কথাই ভবছিলুম। মানে বুঁদ হয়ে চিন্তা করছিলুম যে, দিব্যি খিদে পেয়েছে, ধুবড়ি শহরে কেদারেশ্বরবাবুর বাড়িতে পৌঁছে যদি গরম ভাতের সঙ্গে বুরুলি মাছের ঝোল মেলে তো নেহাত মন্দ হয় না।”
“ধুর মশাই, আপনার শুধু খাওয়ার ভাবনা! আর কোনও কথা কি একবারের জন্যেও আপনার মনে পড়েনি? …মানে এমন কোনও কথা, কোকরাঝাড়ের প্রসঙ্গে যা মনে পড়াই ছিল সবচেয়ে স্বাভাবিক?”
যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল আমার মাথায়। একেবারে হঠাৎই মনে পড়ে গেল যে, সুশান্ত চৌধুরি তো কোকরাঝাড়েই থাকতেন। সেখানেই তো পাহাড়ের কোল ঘেঁষে হাইওয়ের ধারে কেদারেশ্বর তাঁর জন্যে বাগানসুদ্ধ একটা বাড়ি কিনিয়ে দিয়েছিলেন। সেই বাড়ি থেকেই তো মাসখানেক আগে তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান। কলকাতার ফ্ল্যাট থেকে দমদম এয়ারপোর্টে রওনা হবার আগে অন্তত এই কথাই কেদারেশ্বর আমাদের জানিয়েছিলেন।
মুখ তুলে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে আমি মৃদু হাসলুম। হাসির অর্থ বুঝে নিতে তাঁর অসুবিধা হল না। তিনিও ঈষৎ হাসলেন। বললেন, “যাক্, তা হলে মনে পড়েছে।”
আমরা ইতিমধ্যে ধুবড়ি শহরে ঢুকে পড়েছিলুম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলুম, সাড়ে বারোটা। তার মানে গুয়াহাটি থেকে এখানে আসতে সাড়ে সাত ঘন্টা লাগল। শহর বলেই গাড়ির গতি কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওহে পরেশ, সামনে একটা পেট্রোল পাম্প দেখছি। কেদারেশ্বর ফুকনের বাড়িটা কোন পাড়ায়, এখানে একবার জিজ্ঞেস করে নেবে নাকি?”
পরেশ হেসে বলল, “দরকার হবে না। ওঁর বাড়িতে এর আগেও আমি একবার এসেছি। ঠিক চিনে যেতে পারব।”
মিনিট তিন-চারের মধ্যেই পরেশ যে বাগানওয়ালা একতলা বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামাল, কেদারেশ্বর দেখলুম তার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। সম্ভবত আমাদেরই প্রতীক্ষায় ছিলেন। গাড়িটা থামতেই তিনি বারান্দা থেকে নীচে নেমে এসে বাগানের গেট খুলে বললেন, “এসো চারুদা, ভিতরে এসো। …আপনারাও আসুন মশাই, গাড়িতে বসে থেকে আর গরমে সেদ্ধ হবেন না। পথে খুব কষ্ট হয়েছে নিশ্চয়?”
কেদারেশ্বরের বাঁ-হাতের পাতাটা দেখলুম ব্যান্ডেজ-করা। গলার থেকে একটা স্লিং দিয়ে সেটা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসার পরে ভাদুড়িমশাই বললেন, “কী ব্যাপার কেদার, হাতে আবার কী হল? মচকে-টচকে গেছে নাকি?”
“না না, সে-সব কিছু নয়,” কেদারেশ্বর একটু লজ্জিত হেসে বললেন, “কুকুরে কামড়ে দিয়েছে। কিন্তু ও-সব কথা এখন থাক। আগে একটু বিশ্রাম করো, সকাল থেকে তো বলতে গেলে কিছুই খাওনি, এদিকে প্রায় একটা বাজতে চলল, নিশ্চয় বেশ খিদে পেয়ে গেছে, বিশ্রাম করে খেয়ে নাও, তারপরে সব বলছি।”