৬
বিদেশ থেকে আমার এক বন্ধু যে ঘড়িটি হালে এনে দিয়েছে, হাতঘড়ি হলেও তাতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখা যায়, আর নির্দিষ্ট সময়ে তার থেকে যে আওয়াজ বার হয়, খুব জোরালো না-হলেও একটা মানুষের ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়ার পক্ষে তা-ই যথেষ্ট। তবে কাল রাত্তিরে এই ঘড়িটি হাতে পরে শোবার যে খুব একটা দরকার ছিল, তা নয়। মনের মধ্যে উদ্বেগ থাকলে রাত্তিরে আমার ঘুম বিশেষ হয় না, কাল রাত্তিরেও হয়নি, বিছানায় সারা রাত এ-পাশ ও-পাশ করতে-করতে শুধু একটা কথাই ভেবেছি। চিরকুটটা যে লিখেছে, তার উদ্দেশ্য কী? সে কি বন্ধু হিসেবে আমাদের সাবধান করে দিতে চায়? নাকি শত্রু হিসেবে ভয় দেখাতে চায় আমাদের? সে চায় যে, আমরা এখান থেকেই ফিরে যাই। কিন্তু কেন?
চারটের সময় অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছি, হাত ঘড়িতে পিক-পিক করে শব্দ হতেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লুম। সদানন্দবাবুরও নিশ্চয় যৎপরোনাস্তি উদ্বেগ ছিল, কিন্তু তাতে তাঁর নিদ্রার কোনও ব্যাঘাত ঘটেনি। তবে তাঁর ঘুমও যে ইতিমধ্যে ভেঙেছে, সেটা বুঝতে পারলুম তাঁর কথা থেকে। “বাথরুম তো একটার বেশি দুটো নয়, তাই চটপট কাজ সেরে বেরিয়ে আসুন দিকি, আপনি বেরুলে আমি ঢুকব।”
দাড়ি কামিয়ে, মুখ-হাত ধুয়ে, দুচোখে আর ঘাড়ে বেশ ভাল করে জলের ঝাপটা দিয়ে মিনিট কুড়ির মধ্যেই বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে সদানন্দবাবুকে বললুম, “যান। তবে আপনিও বেশি সময় নেবেন না। তৈরি হয়ে পাঁচটার মধ্যেই বেরিয়ে পড়তে হবে।”
“চান করেচেন?”
বললুম, “আপনি সময় দিলে তো করব। ওটা ধুবড়িতে গিয়ে করা যাবে।”
সদানন্দবাবু কিন্তু স্নানের পর্বটাও সেরে নিয়ে তবে বেরিয়ে এলেন। চটপট পোশাক পালটে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে-আঁচড়াতে ও নিচু গলায় নিধুবাবুর একটা বিখ্যাত গানের প্রথম দুটি কলি ভাঁজতে-ভাঁজতে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে অতিশয় তৃপ্ত গলায় বললেন, “চানটা করে নিলেই পারতেন, মশাই। যা ফ্রেশ লাগচে না, আঃ! …ভালবাসিবে বলে ভালবাসিনে। …আহা, নিদুবাবু কী গানই না লিকে গেচেন!”
পিত্তি জ্বলে গেল। বললুম, “ঝোলার ভিতর থেকে এই চিরকুটখানা বেরুবার পরেও আপনার গান আসছে? আশ্চর্য!”
সদানন্দবাবুর মুখে একেবারে সঙ্গে-সঙ্গেই লোডশেডিং। শুকনো গলায় বললেন, “ওরে বাবা রে বাবা, আমি তো ভুলেই গেসলুম! এই সাত-সকালে এ কী সব্বোনেশে কতা মনে করিয়ে দিলেন মশাই!”
“তার উপরে আবার আজকের দিনটার কথাও ভাবুন।”
“তার মানে?”
“মানে আর কিছুই নয়, সাহেবি মতে আজ ফিফটিনথ এপ্রিল ঠিকই, কিন্তু বাংলা মতে পয়লা বৈশাখ। তার মানে মাসপয়লা, যাত্রা নাস্তি। অথচ সেই দিনেই আমরা কিনা ধুবড়ি যাত্রা করছি! ভাবা যায়?”
সদানন্দবাবুর মুখ একেবারে পাংশুবর্ণ ধারণ করেছিল। বিড়বিড় করে কী বললেন, শোনা গেল না। কেননা, ঠিক সেই মুহূর্তেই একতলায় হর্ন বেজে উঠল। গাড়ি এসে গেছে।
ভাদুড়িমশাই তৈরি হয়েই ছিলেন। সবাই মিলে নীচে নেমে দেখলুম, গেস্ট হাউসের ভৃত্যটি কার্ডবোর্ডের একটি বড়সড় বাক্স, দুটি ফ্লাস্ক ও মিনারেল ওয়াটারের গুটি ছয়েক বোতল নিয়ে আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলি সে গাড়িতে তুলে দেওয়ার পর সদানন্দবাবু আর আমার জন্যে পিছনের সিটটা ছেড়ে দিয়ে ভাদুড়িমশাই গিয়ে বসলেন ড্রাইভারের পাশে। গেস্ট হাউসের ভৃত্যটির নাম দীনবন্ধু। বকশিস বাবদে ইতিমধ্যেই তার হাতে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট গুঁজে দেওয়া হয়েছিল। কম্পাউন্ড ছাড়িয়ে অ্যাম্বাসাডর গিয়ে সামনের রাস্তায় নেমে পড়ল। সদানন্দবাবু এতক্ষণ কোনও কথা বলেননি। এবারে হাতজোড় করে কপালে ঠেকিয়ে অস্ফুট গলায় বললেন, “দুগ্গা দুগ্গা!”
ভোরের হাওয়া এমনিতেই মনোরম। ব্রহ্মপুত্রের পাশ দিয়ে যাচ্ছি বলে তাতে একটু বাড়তি মাধুর্যেরও মিশেল ঘটেছে। এই শীতল ভাবটা অবশ্য খুব বেশিক্ষণ থাকবে না। চৈত্রমাসেই গরমের দিন শুরু হয়ে যায়, আর এখন তো চৈত্রও শেষ হয়ে গেল, সকালের কয়েকটা ঘন্টা কাটার পরেই হাওয়া বিলক্ষণ তেতে উঠবে।
পথটাও নেহাত কম দীর্ঘ নয়। কামরূপ জেলার সদর-শহর গৌহাটি থেকে এই যে আমরা রওনা হয়েছি, এরপর ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে একে-একে নলবাড়ি, বরপেটা, বঙ্গাইগাঁও আর কোকরাঝাড় জেলার কোনওটার মাঝ-বরাবর আবার কোনওটার ধার ঘেঁষে তা বেশ কয়েক-শো মাইল পাড়ি দিয়ে আমাদের ধুবড়িতে পৌঁছতে হবে। তার মধ্যে গাড়িটাকে মাঝে-মাঝে বিশ্রাম দিতে হবে, তাও ঠিক এই রাস্তা ধরে কিছু দিন আগেও আমাকে অন্য-একটা কাজে একবার ধুবড়িতে যেতে হয়েছিল। তাই অন্তত আমার এটা বিলক্ষণ জানা আছে যে; মহিম বরুয়া ওই যে বলেছেন ধুবড়ি পৌঁছতে তা অন্তত ঘন্টা সাতেক লেগে যাবে, তিনি কিছু বাড়িয়ে বলেননি।
আমাদের ড্রাইভারের নাম পরেশ বরা। হাসিখুশি, মিষ্টি স্বভাবের ছেলে। বয়েস মনে হয় বছর চব্বিশ-পঁচিশের বেশি হবে না। কথায়-কথায় পরেশ আমাদের জানাল যে, গোটা রাজ্যের রাস্তাঘাট সে তার হাতে তালুর মতো চেনে ঠিকই, তবে কিনা এই রাস্তা ধরে তার বড়-একটা গাড়ি চালাবার দরকার হয় না, এর আগে সে বার দুয়েকের বেশি গাড়ি নিয়ে এদিকে আসেনি।
গাড়ি নিয়ে তা হলে সাধারণত কোন দিকে তাকে যেতে হয়, জিজ্ঞেস করতে পরেশ বলল, “কেন, কাজিরঙ্গার দিকে। এই যে আপনারা গুয়াহাটিতে এলেন, কলকাতা থেকে দিন কয়েকের জন্যে বেড়াতে এসেছেন তো?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “হ্যাঁ।”
“তা এসে আপনারা কোথায় বেড়াতে যাবেন বলে ঠিক করলেন? না ধুবুড়িতে। সায়েব-মেমরা কিন্তু ধুবুড়ি-টুবুড়িতে বেড়াতে যায় না। ঝাঁকে-ঝাঁকে তারা এরোপ্লেন থেকে বরঝারে এসে নামে, আর নেমেই বলে কাজিরঙ্গা চলো।”
“তার মানে গন্ডার দেখতে চায়,
“ঠিক ধরেছেন।” পরেশ বলল, “ওখানে খুব ভাল হোটেল আছে। রাতটা হোটেলে কাটিয়ে পরদিন ভোরবেলায় তারা হাতির পিঠে চড়ে গন্ডার দেখতে বেরিয়ে পড়ে আর ক্লিক-ক্লিক করে ছবি তোলে। হাতি আর গন্ডারের মধ্যে যে লড়াই হয়, তার ছবিও তুলতে ছাড়ে না।”
সদানন্দবাবু বললেন, “বলো কী! হাতিতে-গন্ডারে ওখেনে খুব ফাইট হয়?”
“তা হয়।” পরেশ বলল, “তবে সেটা সত্যিকারের ফাইট নয়, নক্লি। তড়পানিতে অবিশ্যি দুটোর কোনওটাই কিছু কম যায় না। হাতি যদি দু’পা তেড়ে আসে, তো গন্ডার দু’পা পেছোয়, তারপর গন্ডার দু’পা তেড়ে এলে হাতিও দু’পা পিছু হটে। তো এইরকমই চলতে থাকে দশ-পনেরো মিনিট, আর সেই সঙ্গে চলতে থাকে সায়েব-মেমদের ক্যামেরা।”
“তার মানে সবটাই শেকানো ব্যাপার?”
“সবটাই। অথচ দেখে কিছু বোঝবার জো নেই। কী বলব, ক্যামেরার সামনে গন্ডারগুলো এমন পোজ দিয়ে দাঁড়ায় যে, আপনার মনে হবে, এটা যে ছবি তোলার ব্যাপার, ব্যাটারা তা খুব ভালই জানে। পারলে বোধহয় পাউডার-পমেটম মেখে এসে ছানাপোনা নিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে যেত।”
একটুক্ষণ চুপ করে রইল পরেশ। তারপর বলল, “কে জানে, বললুম তো শেখানো ব্যাপার, কিন্তু তা হয়তো না-ও হতে পারে। আমরা ভাবি, জানোয়ার তো, একদম বোধবুদ্ধি নেই, তবে সেটা বোধহয় সত্যি নয়, ব্যাটারা সব বোঝে।”
সদানন্দবাবু বললেন, “এ একেবারে লাক কতার এক কতা কয়েচ। ব্যাটারা সব বোজে। হাতি আর গন্ডারের ব্যাপারটা না হয় বাদই দেওয়া গেল, নিত্যি যাদের দেকচি, সেই কুকুর-বেড়ালগুনোও কিচু কম ইনটেলিজেন্ট নয়। এমনকি, সাইজে কড়ে আঙুলের মতন হলে কী হয়, নেংটি ইঁদুরগুলোও ভেরি ভেরি ইনটেলিজেন্ট। ঘরের মদ্যে এক টুকরো কলা, কি একটা গুঁজিয়া, কি একখানা বাতাসা কোতাও নুকিয়ে রাকুন, ব্যাটারা ঠিক ঝানু গোয়েন্দার মতন সেটা খুঁজে বার করে ফেলবে।”
আলোচনাটা হাতি আর গন্ডার থেকে ঝপ করে নেংটি ইঁদুরে নেমে আসায় পরেশ সম্ভবত খুশি হয়নি। খানিকক্ষণ সে একেবারে চুপ করে রইল। তারপর, গাড়ি চালাতে-চালাতেই, বাঁয়ে মুখ ঘুরিয়ে ভাদুড়িমশাইকে বলল, “ধুবুড়ি থেকে আপনারা তো আবার গুয়াহাটিতেই ফিরবেন, তাই না?”
“তা ফিরব,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তবে কবে নাগাদ ফিরব, তা তো এখুনি বলা যাচ্ছে না।”
“যবেই ফিরুন, একবার কাজিরঙ্গাটা দেখে যান। মহিমবাবুকে দিয়ে আমাকে একটা খবর পাঠিয়ে দেবেন, বাস, আমিই আপনাদের কাজিরঙ্গা থেকে ঘুরিয়ে আনব।”
সদানন্দবাবুর বেড়াবার শখ ষোলো-আনার উপরে আঠারো-আনা। কাজিরঙ্গার প্রস্তাবে তিনি ভিতরে-ভিতরে ফুটতে শুরু করেছিলেন। ভাদুড়িমশাইয়ের উদ্দেশে বললেন, “তা পরেশ নেহাত মন্দ কতা বলেনি। …মানে আবার যে কবে কলকাতা থেকে বেরুতে পারব, কে জানে। আর তা ছাড়া, বেরুলেই যে ফের ইদিকে আসা হবে, তারও তো ঠিক নেই। একবার যখন এসেই পড়িচি…”
ভাদুড়িমশাই এতক্ষণ সামনের দিকে তাকিয়ে বসে ছিলেন। এবারে আমাদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, “তখন কাজিরঙ্গাটাই বা বাদ পড়ে কেন, কেমন? কিন্তু, সদানন্দবাবু, যে কাজ নিয়ে আমরা এখানে এসেছি, সেটা যে কবে শেষ হবে, তা-ই এখনও পর্যন্ত জানি না। হতে পারে যে, সেটা দু’দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে, আবার দু’হপ্তা যে লাগবে না, তারই বা ঠিক কী!”
পরেশ বলল, “দু’দিনই লাগুক আর দু’হপ্তাই লাগুক, কাজ সেরে যখন গুয়াহাটি ফিরবেন, কাজিরঙ্গাটা তখন কিন্তু বাদ দেবেন না, স্যার। ওটা দেখাই চাই। আর তা ছাড়া সময়ও তো তেমন-কিছু লাগছে না। গুয়াহাটি থেকে রওনা হয়ে বিকেলের মধ্যে ওখানে পৌঁছচ্ছেন, রাত্তিরটা ওখানকার হোটেলে থাকছেন, পরদিন ভোর-ভোর হাতির পিঠে চড়ে জঙ্গলটা এক-চক্কর ঘুরে আসছেন, তারপর হোটেলে ফিরে দুপুরেই খাওয়াটা সেরে ফের আমার গাড়িতে উঠে পড়ছেন। বাস, আমিও সেইদিনই আপনাদের গুয়াহাটিতে পৌঁছে দিচ্ছি। একটা দিনের তো মামলা।”
সদানন্দবাবু বললেন, “একটা কতা বলব?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “বলে ফেলুন।”
“ওখেনে ছবি… মানে ফটো তোলানো যায়?”
“তা কেন যাবে না,” ভাদুড়িমশাই মুখ খোলবার আগে পরেশই বলল, “হাতির পিঠে চড়ে আপনারা গন্ডারের সামনে গিয়ে পৌঁছেছেন, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে আপনাদের হাতি আর জঙ্গলের গন্ডার, চান তো তার ছবিও তুলিয়ে দেওয়া যাবে। হোটেল থেকে ফিরতি-পথে রওনা হবার আগে তার প্রিন্টও আপনি পেয়ে যাবেন।
সদানন্দবাবুর মুখ ক্রমেই উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। পরেশ থামতে তিনি বললেন, “বাস্ বাস্, ওই রকমের একখানা ছবি আমার চাই।”
কেন চাই, সেটা আমার বুঝতে না-পারার কথা নয়। কলকাতায় ফিরে ওই ছবি দেখিয়ে গিন্নিকে তাক লাগিয়ে দেবেন সদানন্দবাবু। হাসি চেপে বললুম, “চান তো গুয়াহাটি থেকে একটা নকল বন্দুকও কিনে নেওয়া যায়।”
“কেন,” সদানন্দবাবু বললেন, “বন্দুকের দরকার হচ্চে কেন?”
“বাঃ, হাতির পিঠে কি খালি-হাতে বসে থাকবেন নাকি? হাতে যদি একটা বন্দুক থাকে, আর এক্ষুনি গুলি করবেন এই রকমের একটা পোজ দিয়ে যদি সেটাকে গন্ডারের দিকে উঁচিয়ে ধরেন, তো মিসেস বোস আরও ইম্প্রেসড হবেন, মশাই।”
মনে হল কথাটা সদানন্দবাবুর খুব-একটা অপছন্দ হয়নি। লাজুক হেসে বললেন, “তা হলে তো ভালই হয়। তবে কিনা ও-বস্তু কি এখেনে পাওয়া যাবে?”
“ও-বস্তু মানে? নকল বন্দুক?”
“হ্যাঁ।” সদানন্দবাবু বললেন, “গেল বছর যখন সিকিম থেকে ফিরি, তখন বাগডোগরায় প্লেন ধরার আগে ওই যে ঘন্টা কয়েক শিলিগুড়ি শহরে থাকতে হয়েছিল, তখন তারই মদ্যে এক ফাঁকে শিলিগুড়ির হংকং-বাজারে একবার ঢুঁ মেরেছিলুম তো… কী বলব মশাই, সেখেনে কিন্তু ওই বস্তু অঢেল দেকিচি। একেবারে আসল মালের মতন দেকতে। আওয়াজও একেবারে ভড়কে দেবার মতো। কিন্তু এখনে কি আর তা পাওয়া যাবে?”
পরেশ ইতিমধ্যে একবারও আমাদের দিকে মুখ ফেরায়নি। কিন্তু সদানন্দবাবুর কথাগুলি যে সে খুব মন দিয়ে শুনছিল, তার জবাব শুনেই সেটা বোঝা গেল। সামনের দিকে চোখ রেখেই সে বলল, “পাওয়া কি আর যাবে না? যাবে, কিন্তু…”
“কিন্তু কী?”
“আওয়াজ করা চলবে না।”
“কেন?”
“আওয়াজ শুনে গন্ডার ভড়কে যেতে পারে। ভড়কে গিয়ে হাতির দিকে তেড়ে আসতে পারে। আর হাতিও তাতে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়ে পিঠের ওপর থেকে ঝটকা মেরে আপনাদের ফেলে দিয়ে দৌড় লাগাতে পারে। আর, হাতির পিঠ থেকে যদি একবার মাটিতে পড়ে যান, তো…’”
পরেশ তার কথা শেষ করার আগেই দু’চোখ বন্ধ করে, দাঁতে দাঁত চেপে সদানন্দবাবু প্রায় ডুকরে উঠে বললেন, “থাক্ থাক্, আর বলবার দরকার নেই, হাতির পিট থেকে যদি গন্ডারের সামনে পড়ে যাই, তো… ওরে বাবা রে বাবা, সে তো একটা বিতিকিচ্চিরি ব্যাপার হয়ে যাবে।”
আমি বললুম, “গন্ডার তার শিং দিয়ে তখন গুঁতিয়ে দিতে পারে, হাতি তার শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে তুলে আছাড় মারতে পারে, কিংবা ধরুন তারও দরকার হবে না, স্রেফ তার একখানা গোদা পা আমাদের বুকের উপরে তুলে দিতে পারে…”
ভাদুড়িমশাই আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, “অ্যান্ড অল বিকজ অব আ টয় গান।”
সদানন্দবাবু বললেন, “আহা-হা, খেলনা-বন্দুকের কতা কি আর আমি বলিচি, ওটা তো কিরণবাবুর অ্যাডভাইস! উনিই তো বললেন যে, হাতির পিটে যদি বন্দুক বাগিয়ে ধরে বসি তো দিব্যি দেকাবে! না না, ও-সব হুজ্জুতের দরকার নেই, মশাই, সেরেফ হাতির পিটে বসা অবস্থার একখানা ফটো তোলাতে পারলেই আমি খুশি।”
পরেশ বলল, “ওটা হয়ে যাবে।”
কথায়-কথায় ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে অনেকটা পথ চলে এসেছি। রোদ অবশ্য এখনও তেমন তেতে ওঠেনি, তবে বাতাসে সেই ঠান্ডার ভাবটা আর নেই। বললুম, “এখানে কোথাও খানিকক্ষণের জন্যে গাড়ি থামিয়ে ব্রেকফাস্টটা সেরে নিলে হত না?”
“ব্রেকফাস্ট একটু পরে করলেও ক্ষতি নেই,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তবে কিনা গলাটা একটু ভিজিয়ে নিতে পারলে ভালই হত। …ওহে পরেশ, একটা গাছতলায় খানিকক্ষণের জন্যে গাড়িটা একটু থামানো যায়? …মানে সবাই তা হলে এক ঢোক করে কফি খেয়ে নিতে পারি।”
“এখানে গাড়ি থামানো ঠিক হবে না, স্যার।” পরেশ বলল, “নলবাড়ি জেলা পেরিয়ে যাই, তখন কফি খাবেন।”
সদানন্দবাবু বললেন, “কেন, নলবাড়ি পেরোতে হবে কেন? এখানে গাড়ি থামাবার নিয়ম নেই?”
“নিয়ম থাকবে না কেন, নিয়ম আছে, তবে কিনা বিপদও আছে।”
“অ্যাঁ, কীসের বিপদ? হাতি?”
“হাতির বিপদ এদিকে নেই, স্যার।” পরেশ বলল, “সেটা আছে এ-জেলার উত্তরদিকে। এর উত্তরেই তো ভুটান, সেখানকার জঙ্গল থেকে মাঝে-মাঝে হাতি নেমে আসে। খেতের ফসল নষ্ট করে, চাষিদের ঘরবাড়ি ভাঙে, অনেক সময় আবার দল বেঁধে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে যায়। তখন খুব মুশকিল হয়। রাস্তা বন্ধ মানেই গাড়ি বন্ধ। মহা ঝামেলা।”
আমি বললুম, “হাতির আর দোষ কী, পারলে তো তারা জঙ্গলেই থাকত, কিন্তু সেটা পারছে কোথায়। নির্বিচারে জঙ্গলের গাছপালা কেটে একদিকে যেমন তাদের ন্যাচারাল হ্যাবিট্যাটের বারোটা বাজিয়ে দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে তেমন টান পড়ছে তাদের খাবারে। তা ছাড়া, জঙ্গলের মধ্যে হাতির পালের যাতায়াতের তো কতকগুলি নির্দিষ্ট পথ থাকে, জঙ্গল সাফ করে সেগুলিও দিনের পর দিন নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। দলমা পাহাড় থেকে হাতি নেমে এসে আমাদের ফসলের খেত তছনছ করে দেয় না? চাষির ঘরবাড়ি ভাঙে না? তখন কী করি আমরা? না ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে খবর পাঠিয়ে, লোকজন আনিয়ে, ড্রাম পিটিয়ে, মশাল জ্বালিয়ে, ভয় দেখিয়ে জঙ্গলের হাতিকে আবার জঙ্গলে ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করি। কিন্তু সেটা তো কোনও স্থায়ী সমাধান নয়। জঙ্গলে খাবার নেই, তাই পরের বছর আবার তারা জঙ্গল থেকে নেমে চাষের খেতে ঢুকে পড়ে।”
পরেশ বলল, “নলবাড়ির এদিকটায় অবশ্য হাতি বড়-একটা নামে না।”
সদানন্দবাবু বললেন, “এদিকে তা হলে কীসের বিপদ?”
“কেন, মহিমবাবু আপনাদের কিছু বলেননি?”
উত্তরে ভাদুড়িমশাই সম্ভবত বলতে যাচ্ছিলেন যে, হ্যাঁ, মহিম বরুয়া আমাদের সাবধান করে দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তার আর সময় পাওয়া গেল না, গাড়িটা একটা শাপ টার্ন নিয়ে বাঁয়ে ঘুরতেই দেখলুম, আড়াআড়িভাবে একটা বেঞ্চি ফেলে রাস্তা আটকে রাখা হয়েছে। রাস্তার একদিকে একটা তাঁবু খাটানো। তাঁবুর বাইরে একটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে, আগাপাস্তলা সাদা-সাদা ছোপ ধরানো জলপাই-রঙের জংলা শার্ট-প্যান্ট পরা, চার-পাঁচজন জওয়ান তাদের হাতের মগ থেকে সম্ভবত চা খাচ্ছিল। আমাদের গাড়িটা থেমে যেতে তাদের দু’জন এগিয়ে এসে পরেশকে জিজ্ঞেস করল, “কাঁহা জাওগে?”
পরেশ ইতিমধ্যে স্টার্ট বন্ধ করে গাড়ি থেকে নেমে এসেছিল। কিন্তু তাকে কিছু বলতে হল না। ভাদুড়িমশাই নিজেই এগিয়ে গিয়ে বললেন, “আমরা ধুবড়ি যাব।”
“কোত্থেকে আসছেন?”
“আমরা কলকাতার লোক, তবে আপাতত আসছি গৌহাটি থেকে।”
“ধুবুড়ি যাচ্ছেন কেন?”
“ছুটি কাটাতে।”
“কদ্দিন থাকবেন?”
“এই ধরুন দু’তিন দিন,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তবে জায়গাটা যদি ভাল লেগে যায় তো দু’তিন হপ্তাও থাকতে পারি।”
জওয়ান দু’জন একটু সরে গিয়ে নিচু গলায় নিজেদের মধ্যে কিছু বলাবলি করল। তারপর যে লোকটি এতক্ষণ ভাদুড়িমশাইকে জেরা করছিল, সে এগিয়ে এল পরেশের দিকে। এসে বলল, “লাইসেন্স দেখাও।”
পরেশ তার পকেট থেকে লাইসেন্স বার করে এগিয়ে ধরল। জাওয়ানটি উপর-উপর সেটি দেখল একবার। তারপর পরেশের হাতে সেটি ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “আমরা গাড়ি সার্চ করব।
ফ্লোর-বোর্ডের উপরে টর্চের আলো ফেলে, বসার গদি উলটে, ডিকি আর বনেটের ডালা তুলে, আমাদের হ্যান্ডব্যাগ তিনটির মধ্যে হাত চালিয়ে তন্ন-তন্ন করে পরীক্ষা করা হল সবকিছু। তারপরেও বোধহয় আরও কিছুক্ষণ জেরা করা হত আমাদের, কিন্তু উলটো-দিক থেকে আরও দশ-বারোটা গাড়ি ততক্ষণে এসে রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে গিয়েছে, মাঝরাস্তায় আটকে গিয়ে দু-তিনটি গাড়ি থেকে হর্নও বাজানো হচ্ছে মুহুর্মুহু, ফলে আর আমাদের দাঁড় করিয়ে রাখা হল না। ছাড়া পেয়ে, উলটো-দিকে যে জ্যাম ইতিমধ্যে জমাট বাঁধতে শুরু করেছিল, তার ভিতর দিয়ে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি গাড়ি বার করে এনে পরেশ বলল, “কান্ডটা দেখলেন? এই হয়রানির কোনও মানে হয়?”
সদানন্দবাবু বললেন, “কী ব্যাপার বলো তো? মিলিটারি এখেনে এত হজ্জুত করচে কেন? কিছু হয়েচে?”
“তা হয়েছে বই কী,” পরেশ বলল, “কেন, কালকের কাগজে কিছু পড়েননি?”
“কালকেই তো এসিচি। কাগজ পড়ার সময় পেলুম কোতায়?”
“আমি মশাই সময় পেয়েছিলুম।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “পরশু সন্ধের দিকে এই নলবাড়ির সড়কের উপরেই একটা প্রাইভেট গাড়ির উপরে গুলি চালানো হয়েছিল। দু’জন লোককে তুলেও নিয়ে গেছে।”
“কারা তুলে নিয়ে গেচে?”
সদানন্দবাবুর প্রশ্নের উত্তরে ভাদুশিাই কাষ্ঠ হেসে বললেন, “হিন্দি খবরে ওই যাদের আতঙ্কবাদীয়োঁ বলা হয় আর কি। তবে কিনা নর্থ-ইস্ট ইন্ডিয়ায় তো এ-সব এখন জলভাত হয়ে গেছে বললেই হয়, রেলগাড়ি-টাড়ি উড়িয়ে না-দিলে তাই আর খবরের কাগজের ফার্স্ট পেজে এ-সব খবর জায়গা পায় না।”
শুনে, একটা কথা মনে হল আমার। একেবারে হঠাৎ যে মনে হল, তা অবশ্য নয়। আসলে, এদিককার নানা অশান্তির খবর তো কলকাতার কাগজগুলিতেও কিছু কম বার হয় না, মাঝে-মাঝেই বেরোয় চা-বাগান কি কোনও শাঁসালো কোম্পানির একজিকিউটিভদের তুলে নিয়ে গিয়ে মোটা-অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করার খবর, তাই কাঁকুড়গাছিতে অরুণ সান্যালের ফ্ল্যাটে বসে কেদারেশ্বর ফুকনের মুখে যখন সুশান্ত চৌধুরির নিরুদ্দেশ হবার কথা শুনি, তখন থেকেই একটা সন্দেহের কাঁটা আমার মনে খচখচ করছিল। ভাবছিলুম যে, এটাও সেই রকমেরই ব্যাপার নয় তো?
ভাদুড়িমশাইকে আমার সন্দেহের কথাটা জানালুমও। বললুম, “আপনাদের এই বন্ধুটি… মানে বেশ কিছুদিন ধরে যাঁর কোনও খোঁজখবর পাওয়া যাচ্ছে না, তাঁকেও ওরা… ওই মানে যাদের কথা হচ্ছিল সেই ইনসার্জেন্টরা তুলে নিয়ে গেছে, এমনটাও তো হতে পারে।”
“হতে তো অনেক কিছুই পারে,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনি যা সন্দেহ করছেন, সেটা হতে পারে; এখানে যে ইনসার্জেন্সি চলছে, তার সুযোগ নিয়ে একেবারে অন্য ধরনের কোনও গ্যাং তাকে কিডন্যাপ করে থাকতে পারে; সুশান্ত তার নিজের ইচ্ছায় বিবাগি হয়ে গিয়ে থাকতে পারে; কোনও কারণে তার কিছু দিনের জন্যে গা-ঢাকা দেবার দরকার হয়ে থাকতে পারে; আবার এমনও হয়ে থাকতে পারে যে, কোনও একটা কাজের জন্যে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথাও গিয়েছিল, মানে এমন কোথাও গিয়েছিল যেখানে কেউ তার পরিচিত নয়… সেখানে হঠাৎ তার অ্যামনেসিয়া হয়েছে।… এমনটা তো হতেই পারে, হয় না?”
সদানন্দবাবু বললেন, “এই যে আপনি অ্যামনেসিয়া না কী যেন বললেন, ওটা কী?”
“স্মৃতিভ্রংশ।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটা অসুখ। বড় রকমের কোনও শারীরিক কিংবা মানসিক ধাক্কা খেলে অনেক সময় এটা হয়। যার হয়, সে নিজের অতীতটাকে একদম ভুলে যায়। নিজের নাম পরিচয় ঠিকানা, কিছুই তার মনে থাকে না।”
আম বললুম, “র্যান্ডম হার্ভেস্ট দেখেছেন?”
সদানন্দবাবু বিহ্বল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “সেটাই বা কী?”
“রোনাল্ড কোলম্যান আর গ্রিয়ার গার্সনকে নিয়ে তোলা হলিউডের একটা ছবি। তাতে দেখানো হয়েছিল যে, ছবির নায়কের স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে, নিজের সম্পর্কে কিছুই তার মনে নেই। এই ইংরিজি ফিল্মটার আদলে অবশ্য বাংলা ছবিও তার পরে কিছু কম হয়নি। যেমন ধরুন আলোছায়া কি হারানো সুর।”
একগাল হেসে সদানন্দবাবু বললেন, “তা-ই বলুন। …না মশাই, ইংরিজি ছবিটা আমি দেকিনি। তবে হ্যাঁ, হারানো সুর দেকিচি বই কী। সে তো উত্তম-সুচিত্রা জুটির আনফর্গেটেবল বই। সে-বই একবার কেন, তিন-তিন বার দেকিচি। ওঃ, দুজনেই যা অ্যাক্টিং করেছিল না… কী বলব, তার জবাব নেই। একেবারে জুতিয়ে ছেড়েছিল!”
বললুম, “সেও ওই অ্যামনেসিয়ার ব্যাপার। তবে, যেমন র্যান্ডম হার্ভেস্টে, তেমন হারানো সুরেও স্মৃতিটা শেষ পর্যন্ত আবার ফিরে এসেছিল।”
“সুশান্তর জীবনেও তেমন-কিছু হয়ে থাকতে পারে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমি অন্তত অ্যামনেসিয়ার সম্ভাবনাকে এখুনি রুল আউট করছি না। ইন ফ্যাক্ট, তা-ই যদি হয়ে থাকে তো অল উই ক্যান ডু ইজ হোপ দ্যাট তার ক্ষেত্রেও স্মৃতিটা আবার ফিরে আসবে।”
পরেশ ইতিমধ্যে আস্তে-আস্তে স্পিড কমাতে কমাতে তার গাড়িকে একটা ডালপালা-ছড়ানো গাছের তলায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। দূর থেকেই গাছটা চোখে পড়েছিল, তবে কী গাছ সেটা বুঝতে পারিনি। কাছে এসে বোঝা গেল, সেটা ঘোড়ানিম। আমাদের গাড়ি যেখানে সার্চ করা হয়, তারপরে অনেকখানি পথে বড় কোনও গাছ দেখতে পাইনি, দু’দিকে যদ্দুর চোখ যায়, শুধু আবাদি মাঠ আর মাঠ। এদিকে রোদ্দুরের তেজ বেশ বেড়ে গেছে, তাই ভাবছিলুম যে, গাড়িটারও তো একটু বিশ্রাম দরকার, তাই একটা শেড ট্রি পেলে দিব্যি হত। তবে ভাবার সঙ্গে-সঙ্গেই যে এই ঘোড়ানিম গাছটা পেয়ে যাব, এতটা আশা করিনি।
গাড়ির বনেট খুলে ফেলল পরেশ। ডিকি থেকে একটা জেরিক্যান বার করে এনে রেডিয়েটরে নতুন করে জল ঢালল। তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বলল, “নলবাড়ি জেলা পেরিয়ে এসেছি। নিন, এবারে আপনারা চা-জলখাবার খেয়ে নিন।”
সদানন্দবাবু এরই মধ্যে খাবারের বাস্কেট খুলে ফেলেছিলেন। বললেন, “মহিমবাবু তো দেকচি বিস্তর খাবার দিয়ে দিয়েচেন। ওহে ভাই পরেশ, এ তো আমরা একা শেষ করতে পারব না, তুমিও হাত লাগাও।”