আংটি রহস্য – ৫

বলেছিলেন তিনটে নাগাদ ফিরতে পারবেন, কিন্তু ভাদুড়িমশাইয়ের ফিরতে-ফিরতে চারটে বেজে গেল। ফিরেই দোতলায় উঠে এসে সদানন্দবাবুকে বললেন, “আপনি তৈরি তো? …বাঃ, তা হলে বেরিয়ে পড়ুন। আমাকেও এক্ষুনি ফের বেরুতে হবে। তবে আমি আর এদের গাড়িটা নিচ্ছি না, ওটা আপনি নিয়ে নিন।”

পেপসি কাপের ফাইনালে আমাদের অবস্থা মোটেই সুবিধের নয়, গতিক যা দেখছি, তাতে আর সন্দেহ নেই যে, শেষ রাত্তিরে ওস্তাদের মার দিয়ে অস্ট্রেলিয়া এ ম্যাচ হাসতে-হাসতে বার করে নেবে। চোখ তবু টেলিভিশনের স্ক্রিনে আঁটা, সেই অবস্থাতেই মুখ না-ফিরিয়ে বললুম, “গাড়িটা তো সদানন্দবাবুকে ছেড়ে দিচ্ছেন, আপনি তা হলে বেরুবেন কী করে?”

“আমাকে নিয়ে ভাববেন না।” ভাদুড়মশাই বললেন, “এখানকারই এক বন্ধু তাঁর গাড়ি নিয়ে আসছেন। তিনিই আমাকে যেখানে যাবার নিয়ে যাবেন। একটা জরুরি কাজ রয়েছে, ধুবুড়ি যাবার আগে সেটা সেরে নিতে চাই।”

কথা শেষ হবার সঙ্গে-সঙ্গেই কম্পাউন্ডের গেট খোলার ও সেইসঙ্গে ভিতরে একটা গাড়ি ঢোকার শব্দ পাওয়া গেল। ভাদুড়িমশাই বললেন, “ভদ্রলোক এসে গেছেন। সদানন্দবাবু, আপনিও বেরিয়ে পড়ুন।”

ঘর থেকে দুজনে বেরিয়ে গেলেন।

টিভির সামনে আমাকেও আর খুব বেশিক্ষণ বসে থাকতে হল না। পঞ্চাশ ওভারের তিন বল বাকি থাকতেই ২২৭ রানে ইন্ডিয়ার দৌড় শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাড়াহুড়ো না-করে, অকারণে কোনও ঝুঁকি না-নিয়ে ধীরে সুস্থে সেটা টপকে গেল অস্ট্রেলিয়া। এ একেবারে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি! গ্রুপ লিগের সব ক’টা ম্যাচ জিতেও টাইটান কাপের ফাইনালে পৌঁছে দক্ষিণ আফ্রিকা যে-ভাবে ভারতের কাছে হেরে গিয়েছিল, পর পর প্রতিটি ওয়ান-ডেয়ারে জিতেও পেপসি কাপের ফাইনালে পৌঁছে ভারতকেও ঠিক সেইভাবে আজ অস্ট্রেলিয়ার কাছে হারতে হল। কলকাতার কাগজগুলিতে অবশ্য লেখা হয়েছিল যে, ভারতকে হয়তো তার অতিরিক্ত আন্ততুষ্টির খেসারত দিতে হবে! কিন্তু সত্যিই যে তা-ই হবে, তা তো ভাবিনি।

পুরস্কার বিতরণের অনুষ্ঠান পর্যন্ত আর অপেক্ষা করলুম না, অপেক্ষা করার মতো মনই তখন আর ছিল না আমার, টিভির সুইচ অফ করে দিয়ে পিছন-দিকের বারান্দায় এসে দাঁড়ালুম। ব্ৰহ্মপুত্ৰ এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। নদীর মধ্যে ছোট-ছোট ঢেউ উঠছে, ঢেউগুলি পরপর পাড়ের জমিতে এসে ভেঙে পড়ছে, পাহাড়ে গাছপালার পত্রপল্লব বাতাসে কাঁপছে, সবই দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে, একটা দিন এখানে থেকে যেতে হল, এ ভালই হল। আরও কয়েকটা দিন যদি থাকতুম, সেও মন্দ হত না। দেখা যাক, রিটার্ন টিকিটে তো ডেট বসানো হয়নি, সেটা ওপেন-ই রাখা হয়েছে, ফিরতি পথে যদি ভাদুড়িমশাইকে রাজি করানো যায়।

দেশের একেবারে পূর্ব-প্রান্তে এসেছি। দিন এখানে যেমন তাড়াতাড়ি শুরু হয়, শেষও হয় তেমনি তাড়াতাড়ি। খানিক বাদে রাস্তার আলো জ্বলে উঠল। আকাশের আলো নিবে গিয়েছে, নদীটিকেও আর দেখা যাচ্ছে না। বারান্দা থেকে ড্রয়িং রুমে ফিরে আলো জ্বেলে দিলুম। বুক-কেসের স্লাইডিং কাচ সরিয়ে বই বার করলুম একটা। ফ্রেডারিক ফোরসাইথের ‘নো কাম ব্যাকস’। গল্পের বই। এ-বই আগেও পড়েছি, তবে প্রায় প্রতিটি গল্পেরই প্লট এত জমাট, আর তাতে রহস্যের মোড়কটা শেষ পর্যন্ত এমনভাবে খুলে যায় যে, দ্বিতীয়বার পড়তেও খারাপ লাগছে না। দুটির বেশি গল্প অবশ্য পড়ে উঠতে পারা গেল না। সবে তৃতীয় গল্পটি শুরু করেছি, এমন সময় প্রায় হাঁফাতে হাঁফাতে সদানন্দবাবু এসে ঘরে ঢুকলেন, আর ঘরে ঢুকেই টিপয়ে-রাখা জলের জাগ থেকে কাচের গেলাসে জল ঢেলে ঢকঢক করে জলটা খেয়ে নিয়ে ধপ করে একটা সোফায় বসে পড়ে বললেন, “উফ, আর তো পারা যায় না, মশাই!”

বললুম, “স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যাপারে নিজে তো সারাক্ষণ সবাইকে অ্যাডভাইস দিয়ে বেড়াচ্ছেন, কিন্তু এই যে নিজে বাইরে থেকে গলদঘর্ম হয়ে এসে, একটুও না জিরিয়ে, পুরো এক গ্লাস জল খেলেন, এটা তো ভাল হল না।”

“আরে রাকুন, মশাই,” সদানন্দবাবু খেঁকিয়ে উঠলেন, “জ্ঞান দিতে হয় তো পরে দেবেন, নট নাউ। …উফ, আজ যা হল,তাতে এক গেলাশ জল তো কিছুই নয়, পুরো এক বালতি জল আমার খাওয়া উচিত। গলা একেবারে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেচে।”

হাতের বই সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রেখে বললুম, “কেন, কী হল?”

“যা হবার তা-ই হল! কী বলব, মশাই, সবে মন্দির-চত্বরে ঢুকিচি, এমন সময়… উঃ, সে যা হল, সে-কথা ভাবতেও তো গায়ে কাঁটা দিচ্চে, মশাই!”

“যাচ্চলে, কী হয়েছে, সেটা বলবেন তো।”

“বলচি, বলচি! মন্দিরের ভেতরে ঢোকবার আগে সবে চোক বুজে, হাত জোড় করে মা’কে একটা পেন্নাম করে নিচ্ছি, এমন সময় চাদ্দিকে হঠাৎ ‘গেল গেল’ চিৎকার শুনে ঘাবড়ে গিয়ে চোক খুলে দেকি… ওরে বাপ রে বাপ, …আচ্ছা মশাই, চোক খুলে কেউ যদি দ্যাকে যে, তার সামনে একটা গোদা বাঁদর দাঁড়িয়ে আচে, তো তার কী হবে?”

“কী আর হবে,” হাসি চেপে বললুম, “তার আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাবে।”

সদানন্দবাবু বললেন, “অ্যাই, এতক্ষণে আপনি একটা খাঁটি কতা বলেচেন। আমারও আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেসল।”

ভদ্রলোকের যে বানিয়ে-বানিয়ে কথা বলার অভ্যাস আছে, তা জানি। কিন্তু, কী জানি কেন, হঠাৎ আমার মনে হল যে, সদানন্দবাবু যা বলছেন, তা বোধহয় মিথ্যা নয়। তাই একটু উদ্বিগ্ন হয়ে বললুম, “সে কী, আঁচড়ে-কামড়ে দেয়নি তো?”

“না না, বাঁদরটা সে-সব কিছু করেনি, কিন্তু যা করেচে, সেও মশাই কম বজ্জাতি নয়। ওই যে বললুম, আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেসল, তার মানে তো বুঝতেই পারচেন, নট নড়ন-চড়ন নট কিচ্ছু অবস্থা, ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়ে কাঠ হয়ে ডাঁড়িয়ে রয়েচি, তা সেই অবস্থায় ব্যাটা আমার বুক-পকেট থেকে মানিব্যাগটা তুলে নিয়ে তড়তড় করে কাচেই একাট গাচের মগডালে উঠে গেল, তারপর ডাল ধরে ঝুল খেতে-খেতে এ-গাচ ও-গাচ করতে-করতে হাওয়া! ব্যাটা যে কোতায় ভ্যানিস হয়ে গেল, বুজতেই পারলুম না।”

“কত ছিল আপনার ব্যাগে?”

“খুব বেশি নয়, এই ধরুন শ-দেড়েক টাকা। তার বেশি থাকবেই বা কী করে। কলকাতা থেকে যে তিন হাজার টাকা নিয়ে বেরিয়েচি, সে তো আমার ধুতির খুঁটে বাঁদা রয়েচে।”

আবার হাসি পেয়ে গেল আমার। বললুম, “বাঁদর-ব্যাটাচ্ছেলে ভাগ্যিস সে-কথা জানত না। জানলে কিন্তু আপনার ধুতি কেড়ে নিত। তবে কিনা দেড়শো টাকাই বা কম কী। ওটা তো গচ্চা গেল!”

সদানন্দবাবু বললেন, “তা যাক। যাবার ছিল, তাই গেচে! তা নিয়ে দুঃখু করি না। তবে কিনা, এও বলব মশাই যে, ওখানকার লোকগুলো খুব ভাল, ভেরি সিমপ্যাথেটিক। টাকা যা গেচে, সে তো আমার, কিন্তু তাতে সবাই মিলে এমন হায়-হায় করতে লাগল যেন আমার নয়, তাদেরই একটা মস্ত বড় লোকসান হয়ে গেচে। তার উপরে আবার মাতায় জটা বাঁদা, মুকে পাকা গোঁপদাড়ির জঙ্গল, পায়ে কাটের খড়ম, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, ওই মানে তান্ত্রিক সন্নিসি টাইপের এক বুড়ো আমার মাতায় হাত বুলিয়ে-বুলিয়ে বললেন, আপসোস করিসনি, বেটা, ও যদি তোর ধম্মের পথে রোজগারের টাকা হয় তো ঠিক ফেরত পেয়ে যাবি। বুজুন ব্যাপার!”

“তা তো বুঝলুম। কিন্তু যাদের আপনি ভাল লোক বলে ঢালাও সার্টিফিকেট দিচ্ছেন, তারা তো স্রেফ চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল আর হায়-হায় করতে লাগল! তা হলে? আরে মশাই, আপনি না হয় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেসলেন, কিন্তু তারা কেন বাঁদরটাকে তাড়া করল না?”

সদানন্দবাবু বললেন, “তারাও বোধহয় আমারই মতো ঘাবড়ে গেসল। তবে হ্যাঁ, কেউ যে কিচু করেনি, তা কিন্তু নয়। এই যে তান্ত্রিক বুড়োর কতা বললুম, মিশমিশে কালো ইয়াব্বড় একটা কুকুর দেকেছিলুম সারাক্ষণ তাঁর সঙ্গে-সঙ্গে ঘুরচে। তা বাঁদর যে আমার পকেট মারচে, এইটে দেকেই তিনি ছু-ছু করে লেলিয়ে দিয়েছিলেন সেই কুকুরটাকে। কুকুরটা যে তেড়ে যায়নি তাও নয়, তেড়ে গিয়ে গাচতলায় ডাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ ঘেউ-ঘেউও করেছিল ঠিকই, কিন্তু ওপর থেকে বাঁদরটা তাকে দু’চার বার দাঁত খিঁচোতেই ন্যাজ নাড়তে-নাড়তে ফিরে এল তার মালিকের কাচে। তা ছাড়া আর কী করবে বলুন, কুকুর তো আর গাচে চড়তে পারে না।”

বললুম, “শুধু কুকুর কেন, কুকুরজাতীয় কোনও জন্তুই পারে না। যেমন ধরুন হায়েনা পারে না, নেকড়ে পারে না। ওদিকে আবার বেড়াল-বংশের সব জন্তুই পারে। বাঘ-সিঙ্গি তো বিগ ক্যাট। তার মধ্যে লেপার্ড দিব্যি গাছে উঠে যায়।”

“আর আমাদের রয়াল বেঙ্গল টাইগার?”

“না মশাই,” হেসে বললুম, “রয়্যাল বেঙ্গলকে কখনও … মানে সামনাসামনি দেখার তো কথাই উঠছে না, কোনও ফিল্মেও কখনও গাছে চড়তে দেখিনি। তবে হ্যাঁ, আফ্রিকায় তোলা একটা ফিল্মে দেখেচিলুম যে, একটা সিঙ্গি তার ছানাপোনা নিয়ে দিব্যি গাছে চড়ে বসে আছে। …তা সে-কথা থাক, আসল কথা বলুন। মন্দিরে তো গিয়েছিলেন, পুজো দিয়েছেন?”

সদানন্দবাবু বললেন, “বিলক্ষণ। মন্দিরে যাব আর পুজো দেব না, তা-ই কখনও হয়? পুজো দিয়েচি, কামিখ্যে-মায়ের পেসাদও এনিচি। আমার এই ঝোলার মদ্যেই রয়েচে। তা ভাদুড়িমশাই ফিরুন, তখন আপনাদের দুটি-দুটি করে দোব অখন।”

ভাদুড়িমশাইয়ের ফিরতে-ফিরতে ন’টা বাজল। ডাইনিং হলে খেতে বসলুম সাড়ে ন’টায়। খাওয়া মধ্যপথ পর্যন্ত এগিয়েছে, এমন সময় মহিম বরুয়া এলেন। প্রাথমিক দু’-একটা কথার পরে ভদ্রলোক জানালেন, কাল ভোর পাঁচটাতেই গাড়ি আসবে। আমরা যেন তৈরি থাকি। ড্রাইভার হর্ন দেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই একতলায় নেমে এসে রওনা হতে হবে। “দয়া করে দেরি করবেন না। পথ তো ভাল নয়, বারোটায় মধ্যে না পৌঁছলে কেদারেশ্বরবাবু খুব চিন্তা করবেন।”

কথা শেষ করে ভদ্রলোক আর বসলেন না।

ভাদুড়িমশাইকে একটু চিন্তিত দেখাচ্ছিল। বাঁদরের হাতে সদানন্দবাবুর নাকাল হওয়ার কথা শুনেও তিনি বিশেষ হাসেননি। মনে হল, কোনও-কিছু ভাবছেন। খাওয়া শেষ হতে-হতে আরও মিনিট দশেক লাগল। তারপর আমরা দোতলায় উঠে এলুম। ভাদুড়িমশাই বললেন, “শুনলেনই তো, কাল সকালে খুব তাড়াতাড়ি উঠতে হবে, নইলে পাঁচটায় রওনা হওয়া যাবে না। যান, আপনারা গিয়ে শুয়ে পড়ুন।” আমাদের শুতে বলে তিনি তাঁর ঘরের দিকে পা বাড়াচ্ছেন, পিছন থেকে সদানন্দবাবু বললেন, “যাচ্চলে, পেসাদটাই তো দেওয়া হল না।”

“কীসের প্রসাদ?” ভাদুড়িমশাই ঘুরে দাঁড়ালেন।

“বাঃ, মন্দিরে গেসলুম না? মায়ের পেসাদ এনিচি। নিন, দুটো নকুলদানা মাতায় ঠেকিয়ে মুকে ফেলে দিন।”

বলে ঝোলার ভিতরে হাত ঢুকিয়ে সদানন্দবাবু একটা ঠোঙা বার করে আনলেন। পরক্ষণেই বললেন, “যাব্বাবা, এটা আবার কী?”

দেখলুম, নকুলদানার ঠোঙার সঙ্গে ভাঁজ-করা এক টুকরো কাগজও তাঁর হাতে উঠে এসেছে। ভাঁজ খুলে কাগজের টুকরোটির উপরে চোখ বুলোতে বুলোতে তাঁর ভুরু যে কুঁচকে গেছে আর মুখে ফুটেছে আতঙ্কের ছাপ, তাও আমার নজর এড়াল না। কাগজটিকে তিনি ভাদড়িমশাইয়ের হাতে তুলে দিলেন। ভাদুড়িমশাই সেটি একবার দেখে নিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, “পড়ুন।”

পড়লুম। ময়লা তেলচিটে কাগজ। তাতে বড় হাতের গোটা-গোটা হরফে ইংরেজিতে যা লেখা রয়েছে, বাংলায় তার অর্থ দাঁড়ায়: সময় নষ্ট না-করে ফিরে যান।