আংটি রহস্য – ৪

পরশু রোববার বারোই এপ্রিল কেদারেশ্বর ফুকন কলকাতায় ডাক্তার অরুণ সান্যালের কাঁকুড়গাছির ফ্ল্যাটে এসেছিলেন। সেখান থেকে তিনি দমদম এয়ারপোর্টে রওনা হবার পরে-পরেই সদানন্দবাবু বলেছিলেন, “কী, কতাটা শেষ অব্দি ফলল তো?” তাতে অরুণ স্যান্যাল জিজ্ঞেস করেন, কী কথা? উত্তরে সদানন্দবাবু বলেন, “বাঃ ওই যে খেতে বসে যা বললুম, মনে নেই? …আরে বাবা, আমি জানতুম যে, এবারে গৌহাটি যেতে হবে।” ভাদুড়িমশাই কোনও কথা না-বলে একেবারে চুপচাপ বসে ছিলেন। দৃষ্টি সামনের দেওয়ালে। বললুম, “কিছু ভাবছেন?” তাতে, হঠাৎ যেন চটকা ভেঙে গেছে, এইভাবে আমার দিকে চোখ ফিরিয়ে তিনি বললেন, “ও হ্যাঁ, কেদারের কথা ভাবছিলুম। দুজনকেই সেই কলেজ-জীবন থেকে চিনি… তার উপরে কেদার যে-ভাবে বলে গেল… তাই মানে….” কথাটা ভাদুড়িমশাই শেষ করলেন না। অরুণ সান্যাল বললেন, “তাই ভাবছিলেন যে, যেতে পারবেন কি না, কেমন?” তাতে ভাদুড়িমশাই বললেন, “না না, যেতে তো হবেই। কিন্তু কথা হচ্ছে, হাতে যা কাজ জমে আছে তাতে যাই কী করে? অবশ্য কৌশিক যদি কলকাতা-আপিসের কাজটা আমার হাত থেকে বুঝে নেয়, তা হলে একটা উপায় হয়। এখন দেখি, কেদারকে এয়ারপোর্টে ছেড়ে কৌশিক তো ফিরে আসুক, তখন তার সঙ্গে কথা বলে একটা ডিসিশান নেওয়া যাবে।”

বাড়িতে কাজ ছিল বলে কৌশিক ফেরার আগেই সদানন্দবাবুকে নিয়ে আমি উঠে পড়ি। তারপর ভাদুড়িমশাইয়ের ফোন পাই রাত সাড়ে দশটায়। ফোনে তিনি জানান, গৌহাটি পৌঁছে রাত ন’টায় কেদারেশ্বর তাঁকে এসটিডি করে বলেছেন যে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভাদুড়িমশাইয়ের একবার যাওয়াই চাই। শুনে জিজ্ঞেস করি, “তার মানে যাচ্ছেন, কেমন?” উত্তরে তিনি বলেন, “যাচ্ছি ঠিকই, তবে কাল নয়, পরশু। …আপনি যেতে পারবেন? …না না, এখুনি কিছু বলতে হবে না। বাসন্তীর সঙ্গে কথা বলুন, তারপর কাল সকালে আমাকে জানান। তাই বুঝে টিকিট কাটব।”

কাল সকালে ফোন করে জানাই যে, মোট তিনটি টিকিট কাটতে হবে, তার কারণ, সদানন্দবাবুও না-গিয়ে ছাড়বেন না। শুনে, ফোনের ওদিক থেকে ভাদুড়িমশাই স্পষ্ট করে হাসেন। তারপর বলেন, “ঠিক আছে, গৌহাটি যাওয়ার সম্ভাবনার কথাটা তো উনিই প্রথম বলেছিলেন। …তা হলে এটাই ঠিক রইল, কাল সকালে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের পরপর দুটো ফ্লাইট আছে, তার মধ্যে কোনটার টিকিট পাওয়া গেল, দুপুরেই জানিয়ে দেবখন।”

সদানন্দবাবু আমাদের বাইরের ঘরে বসে ফোনের ফলাফল জানার জন্যে অধীরভাবে অপেক্ষা করছিলেন। তাঁকে সব জানাতে তিনি হাতের কাগজ ফেলে দিয়ে সঙ্গে-সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে বললেন, “তা হলে চলি মশাই, আর তো সময় নেই, চটপট সব গুছিয়ে নিতে হবে।

দুপুরে আপিসে বসে কাজ করছি, দুটো নাগাদ ফোন এল। আই সি ৭০৩-এ আসন পাওয়া গেছে। ডিপার্চার সকাল সাতটায়। তার মানে সকাল ছ’টায় এয়ারপোর্টে হাজিরা দিতে হবে।

তো তা-ই দিয়েছিলুম। ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে ট্যাক্সি ধরতে একটু দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু রাস্তায় ভিড়ভাট্টা ছিল না, তাই মিনিট চল্লিশের মধ্যেই এয়ারপোর্টে পৌঁছে যাই। ভাদুড়িমশাই টার্মিনাল বিল্ডিংয়ের ঠিক সামনে অপেক্ষা করছিলেন, ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে তাঁর পিছন-পিছন ডোমেস্টিক টার্মিনালে ঢুকে আমরা গুয়াহাটি কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। কাউন্টারের সামনে তখনই বেশ লম্বা লাইন পড়ে গিয়েছে। বোর্ডিং কার্ড পেতে তাই একটু সময় লেগে যায়। কার্ড পেয়ে, যার-যার হ্যান্ডব্যাগে ট্যাগ লাগিয়ে, সুরক্ষা যাচ অর্থাৎ সিকিউরিটি চেক করিয়ে দোতলায় চলে যাই আমরা। সেখানে খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয় না, আমাদের উড়ান যে তৈরি, পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে এই ঘোষণা হতেই আসন ছেড়ে আমরা অ্যারোব্রিজ দিয়ে আমাদের প্লেনের পেটের মধ্যে ঢুকে পড়ি। পাশাপাশি তিনটি আসন পাওয়া গিয়েছিল। নিসর্গশোভা দেখবেন বলে সদানন্দবাবু জানলার ধারের আসনটি নিয়ে নেন, আমি মাঝখানে বসি, ভাদুড়িমশাই আইলের ধারে। সারাটা পথ ভাদুড়িমশাই একেবারে চুপ করে বসে ছিলেন, একবারও মুখ খোলেননি। মনে হচ্ছিল, তিনি কিছু ভাবছেন। সম্ভবত তাঁর কলেজ-জীবনের কথা, সেই সঙ্গে কেদারেশ্বর ও সুশান্তর কথা, মানুষের ভাগ্য-বিপর্যয়ের কথা, কিংবা…কিংবা সে-সব কিছুই নয়, কলকাতায় যে কাজের বোঝা তিনি কৌশিকের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে এসেছেন, স্রেফ তারই কথা।

প্লেন যথাসময়ে, গুয়াহাটিতে পৌঁছল। ভেবেছিলুম, এত যখন তাড়া, তখন ভাদুড়িমশাইকে রিসিভ করার জন্য কেদারেশ্বর নিজেই নিশ্চয় এয়ারপোর্টে হাজির থাকবেন। কিন্তু তিনি ছিলেন না। তাঁর বদলে যাঁকে পাঠিয়েছিলেন, দূর থেকে দেখেই যে তিনি কীভাবে আমাদের শনাক্ত করলেন, তা একমাত্র তিনিই জানেন। পরনে ঢোলা-হাতা পাঞ্জাবি ও পায়জামা, গাত্রবর্ণ তামাটে, পায়ে কাবলি চপ্পল, দৈর্ঘ্য মাঝারি, চোখে পুরু ফ্রেমের চশমা, অন্য কোনও যাত্রীর দিকে দৃপাত না করে ভদ্রলোক সরাসরি আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, “নমস্কার। আমার নাম মহিম বরুয়া। লাগেজ কালেক্ট করতে হলে আমার সঙ্গে আসুন।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমাদের সঙ্গে কোনও লাগেজ নেই, জাস্ট তিনজনের তিনটে হ্যান্ডব্যাগ।”

“তা হলে তো ভালই হল, আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি, চলুন, আপনারা যেখানে থাকবেন সেখানে পৌঁছে দিচ্ছি।”

“আমরা কোথায় থাকব।”

“কেন,” মহিম বরুয়া একটু দাঁড়িয়ে গিয়ে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কেদারবাবু আপনাদের কিছু বলেননি?”

“কই, না তো।”

“সে কী, পরশু বিকেলের স্পেশ্যাল ফ্লাইটে কলকাতা থেকে এখানে ফিরে উনি আমাকে বললেন যে, আজ আপনি গুয়াহাটি আসছেন, আমি যেন ওর কাকার কোম্পানির গেস্ট-হাউসে আপনার থাকার ব্যবস্থা করে রাখি। কাল সকালে এখান থেকে ধুবুড়ি রওনা হবার আগে এও বললেন, ধুবুড়ি পৌঁছেই কলকাতায় ফোন করে আপনাকে জানিয়ে দেবেন যে, আজকের দিনটা এখানে আপনি কোথায় থাকছেন।”

“কিন্তু কই, আমি তো কাল কোনও ফোন পাইনি।”

“তা হলে বোধহয় কলকাতার লাইন পাওয়া যায়নি।” ভদ্রলোক বললেন, “যা-ই হোক, আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি, আপনার কোনও অসুবিধে হবে না।”

“ব্যবস্থাটা তিনজনের জন্যেই করেছেন তো?”

মহিম বরুয়ার মুখচোখ দেখেই বোঝা গেল, ভদ্রলোক একটু অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেছেন। মাথা চুলকে বললেন, “উনি আসলে একজনের কথাই বলেছিলেন, …মানে আপনারা যে তিনজন আসবেন, তা বোধহয় বুঝতে পারেননি। তো তা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই, গেস্ট হাউসের দোতলার দুটো ঘরই খালি পড়ে আছে, দুটোই ডাবল বেড-রুম, আর তা ছাড়া একটাই তো রাত, আশা কবি আপনাদের কোনও অসুবিধে হবে না। ওই মানে একটা ঘরে দু’জনকে থাকতে হবে আর কি।”

“না না, এতে অসুবিদে হবে কেন,” সদানন্দবাবু প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বললেন, “ও আমরা ম্যানেজ করে নেবখন।”

কথা বলতে-বলতে আমরা টার্মিনাল বিল্ডিংয়ের বাইরে চলে এসেছিলুম। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই একটা অ্যাম্বাসাডার পার্কিং এনক্লোজার থেকে বেরিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। উর্দি-পরা ড্রাইভারটি গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে ডিকি খুলে আমাদের হাত থেকে হ্যান্ডব্যাগ তিনটি নিয়ে নিল, তারপর সেগুলিকে ডিকিতে রেখে ডালা বন্ধ করে মহিম বরুয়াকে জিজ্ঞেস করল, “এখন কোথায় যাব?”

মহিমবাবু ইতিমধ্যে অ্যাম্বাসাডরের পিছনের দরজা খুলে আমাদের তিনজনকে পাশাপাশি বসিয়ে দিয়েছিলেন। বললেন, “গেস্ট হাউস।”

ড্রাইভার গিয়ে স্টিয়ারিং হুইলের সামনে বসে, ইগনিশন কি ঘুরিয়ে, গাড়িতে স্টার্ট দিল। মহিম বরুয়া তার পাশ থেকে মুখ ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বেশি সময় লাগবে না।”

তা লাগলও না।

গৌহাটির বরঝার এয়ারপোর্ট থেকে শহর তেমন-কিছু দূরে নয়। ইউনিভার্সিটি এলাকা ছাড়িয়ে খানিক এগিয়ে, কামাখ্যা পাহাড়কে বাঁয়ে রেখে, ব্রহ্মপুত্রের গা-ঘেঁষা রাস্তা দিয়ে আমরা কটন কলেজের কাছাকাছি যেখানে এসে পৌঁছলুম, সেটা আমার চেনা জায়গা।

গৌহাটিতে এই যে আমি প্রথম আসছি, তা নয়। প্রথম এসেছিলুম পঞ্চাশের দশকে। শিলং যাবার পথে একটা রাত সেবারে গৌহাটিতে কাটাই। পরে আরও বার কয়েক এসে নেহাত একটা রাত নয়, বেশ ক’দিন এখানে কাটিয়ে গেছি। একবার তো কামাখ্যা পাহাড়ের উপরেই তা প্রায় হপ্তাখানেক থেকেছিলুম। অথচ, ব্রহ্মপুত্রের ধারের এই গেস্ট হাউসটি একবারও আমার চোখে পড়েনি। হতে পারে যে, আমিই খেয়াল করিনি, অথবা এমনও সম্ভব যে, হালে এটি তৈরি হয়েছে।

গাড়ি থেকে নেমে একবার দেখেই ভাল লেগে গেল। বাড়িটি ছোট। সামনে এক ফালি বাগান। বাগানে মরসুমি ফুলের পরিপাটি কয়েকটা বেড। মাঝখান দিয়ে রাস্তা থেকে গ্যারাজ অবধি মোরাম-ঢালা ড্রাইভ। কম্পাউন্ড ওয়াল ঘেঁষে ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে নাতিবৃহৎ একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ, আর নীচে থেকে একটি ফুলন্ত লতা দোতলার বারান্দা পর্যন্ত উঠে গেছে। লতার সর্বত্র যে ফুল ফুটে আছে, ঠিক সেই ধরনের ফুল এর আগে কখনও দেখিনি।

দোতলায় নিয়ে গিয়ে ঘর দুটি আমাদের দেখিয়ে দিয়ে মহিম বরুয়া বললেন, “আপনারা নিশ্চয় ক্লান্ত বোধ করছেন, হাতমুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম করুন, আমি ততক্ষণে নীচে গিয়ে আপনাদের চায়ের কথা বলে আসি।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ঠিক আছে, কিন্তু শুধু চায়ের কথাই বলবেন, প্লেনে ব্রেকফাস্ট দিয়েছিল, এখন আর কিছু খেতে পারব না।”

“বেশ, তা হলে শুধু চা-ই দিতে বলি। …ও হ্যাঁ, দুপুরে আর রাত্তিরে কী খাবেন, সেটাও যদি দয়া করে বলে দেন, তো খুব ভাল হয়। মানে, যে লোকটি এখন বাজারে যাচ্ছে, তাকে তা হলে সেই মতো যা-যা দরকার সব নিয়ে আসতে বলব।”

“ও নিয়ে ভাববার কিছু নেই,” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আমরা ডাল-ভাতের ভক্ত, তার সঙ্গে একটা মাছ, ব্যস, আর কিছু চাই না।”

“ঠিক আছে, আমি এদের বলে দিয়ে আসছি।”

“আসুন, আমরা ততক্ষণে মুখ-হাত ধুয়ে নিচ্ছি। চা খেতে-খেতে আপনার সঙ্গে কথা হবে।” মহিম বরুয়া ঘর থেকে বেরিয়ে নীচে নেমে গেলেন।

গেস্ট-হাউসটি মোটামুটি পরিচ্ছন্ন। দোতলায় মোট তিনটি ঘর। দু’দিকে দুটি বেড-রুম, মাঝখানেরটিতে কমন বসার ব্যবস্থা। সেখানে সেন্টার-টেবিলটিকে কেন্দ্র করে গুটিকয় সোফা। একদিকে কাচের একটি বুক-কেস। তাতে কিছু ইংরেজি পেপারব্যাক। সবই থ্রিলার। বেশির ভাগই হ্যাডলি চেজ আর নিক কার্টারের। দু’চারখানা ফ্রেডারিক ফোরসাইথ, কেন ফোলেট আর আর্ভিং ওয়ালেসও চোখে পড়ল। বইয়ের আলমারির পাশে একটি নিচু টেবিলে টেলিফোন। ঘরের অন্যদিকে টিভি-সেট।

মুখ-হাত ধুয়ে ড্রয়িং রুমে এসে আলমারি থেকে একটা বই টেনে নিয়ে পাতা ওলটাচ্ছি, এমন সময় মহিম বরুয়া ফিরে এলেন। তাঁর পিছনে চায়ের ট্রে হাতে একটি লোক। লোকটিকে এর আগেও দেখেছি, এয়ারপোর্ট থেকে এখানে পৌঁছবার পর গাড়ির ডিকি থেকে আমাদের হ্যান্ডব্যাগ তিনটিকে এ-ই দোতলায় তুলে দিয়েছিল। সেন্টার টেবিলে চায়ের ট্রে নামিয়ে রেখে লোকটি দাঁড়িয়ে ছিল, মহিম বরুয়া বললেন, “বাথরুমে তেল সাবান তোয়ালে, সব-কিছু দিয়েছ তো?”

লোকটি বলল, “হ্যাঁ, সাব।”

“ঠিক আছে, শ্যাম, তা হলে তুমি এবারে বাজারে চলে যাও।”

ঘর থেকে লোকটি বেরিয়ে যাবার পরে মহিম বরুয়া বললেন, “তা হলে আমিও এবারে যাই। আপনারা বিশ্রাম করুন, গাড়িটা রইল, দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে নিয়ে যদি ইচ্ছে হয় তো একটু ঘুরে আসতে পারেন। আমি আবার বিকেলে এসে দেখা করব।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “এখুনি আমাদের বিশ্রামের কোনও দরকার নেই, পরে অনেক সময় পাওয়া যাবে, বিশ্রাম বরং তখনই নেব। আপাতত আপনি একটু বসে যান, আমার দু’-একটা কথা জেনে নেবার আছে।”

মহিম বরুয়া দরজার দিকে পা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, ফিরে এসে একটা সোফায় বসে পড়ে বললেন, “বেশ তো, কী জানতে চান, বলুন।”

“ আপনি বলছিলেন যে, এটা কেদারেশ্বরের কাকার কোম্পানির গেস্ট হাউস। ওঁর আপন কাকা?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। দুই ভাইয়ের মধ্যে কেদারবাবুর বাবা সুরেশ্বরবাবুই বড়। আর ইনি মহেশ্বরবাবু ছোট।”

“সুরেশ্বরবাবুও তো ব্যাবসা করতেন বলেই শুনেছি।”

“ঠিকই শুনেছেন। তবে তিনি কলকাতায় থাকতেন, ব্যাবসাও করতেন সেখানেই। এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ব্যাবসা। মারা যাবার আগে অবশ্য ব্যাবসার কাজকর্ম তিনি গুটিয়ে ফেলেছিলেন। জীবনের শেষ কয়েকটা বছর তিনি ধুবুড়ির বাড়িতে এসে কাটান।”

“বড় ভাইয়ের তুলনায় মহেশ্বরবাবুর ব্যাবসা আরও বড়?”

“অনেক বড়।”

“কীসের ব্যাবসা?”

“কীসের নয়?” মহিম বরুয়া হেসে বললেন, “চা থেকে পাট আর ট্রাক থেকে টিম্বার, সব কিছুতেই তিনি আছেন। তবে তিনিও এখন ভাবতে শুরু করেছেন যে, এর সবটা না হলেও খানিক-খানিক তিনি গুটিয়ে ফেলবেন। তা ছাড়া উপায়ই বা কী। বয়স তো তাঁরও কিছু কম হয়নি, অ্যাটলিস্ট এইট্রিফাইভ। এই বয়সে আর সব দিকে নজর রাখতে পারছেন না।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “একা তাঁকেই বা সব দিকে নজর রাখতে হবে কেন?”

মহিম বরুয়া হাসলেন। “উপায় কী, মাইনে-করা লোকজনের তো কিছু অভাব নেই, ম্যানেজার, অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, সুপারভাইজার থেকে শুরু করে ডেসপ্যাঁচ ক্লার্ক অব্দি একশো গন্ডা লোক রয়েছে। ফুকন ট্রেডার্সের যে আপিসেই যান, তাদের দেখতে পাবেন। কিন্তু চায়ের পেটি কিংবা পাটের বেল বোঝাই ট্রাক মাঝপথেই হাল্কা হয়ে গেল কি না, তাও যেমন তারা দ্যাখে না, তেমনি আবার একটা ট্রাকের যে জার্নিতে যতটা ডিজেল লাগার কথা, তার দেড়গুণ ডিজেল লেগে গেলেও তারা চোখ বুজে পেট্রল পাম্পের বিল মিটিয়ে দেয়। তার ফল যা হবার তা-ই হচ্ছে। মহেশ্বরবাবুর ছেলে যদি বাপের ব্যাবসাটা বুঝে নিতেন, তা হলে এমনটা হত না। কিন্তু বাপের ব্যাবসায় তিনি ঢুকলেন কোথায়।”

“মহেশ্বরবাবুর কি এই একটিই মাত্র ছেলে?”

“এই একটিই মাত্র।”

“তা হলে তিনি তাঁর বাপের ব্যাবসায় ঢুকলেন না কেন?”

তক্ষুনি এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন না মহিম বরুয়া। ঈষৎ অপ্রতিভভাবে হাসলেন। তারপর বললেন, ‘দেখুন, এখন আর আমি এঁদের কাজ করি না ঠিকই, কিন্তু বছর পাঁচেক আগেও তো করতুম, আর তা ছাড়া এখানকার চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেরই একটা ছোটখাটো ব্যাবসা যদিও করে নিয়েছি, ফুকনদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা তাই বলে নষ্ট হয়ে যায়নি। যেমন মহেশ্বরবাবু তেমন তাঁর ভাইপো কেদারেশ্বরবাবু এখনও আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন। তাই …বুঝতেই পারছেন …এ-সব কথার মধ্যে আমার না-যাওয়াই ভাল।”

“ঠিক আছে,” ভাদুড়িমশাইও ঈষৎ হেসে বললেন, “আপনার অসুবিধে থাকলে এ নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করব না। বরং অন্য দু-একটা প্রশ্ন করি, কেমন?”

“বেশ তো, করুন।”

“সুশান্ত চৌধুরি নামে কাউকে আপনি চেনেন?”

“সুশান্ত চৌধুরি… সুশান্ত চৌধুরি…” মাথা নিচু করে, নামটা বার-দুয়েক অস্পষ্ট গলায় উচ্চারণ করলেন মহিম বরুয়া, তারপর মুখ তুলে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “নামটা বোধহয় শুনেছি। …দাঁড়ান, দাঁড়ান, ইনি কি কেদারেশ্বরবাবুর বন্ধু?”

“হ্যাঁ।”

“ওই মানে যিনি কোকরাঝাড়ে থাকতেন? কিছুদিন আগে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন?”

“হ্যাঁ।”

“তা-ই বলুন।” মহিম বরুয়া বললেন, “এখানকার কাগজে তাঁর নামে বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল। বিজ্ঞাপনের সঙ্গে ছবিও ছিল একটা। চোখে চশমা, একমুখ দাড়ি। নামটা এই জন্যেই চেনা-চেনা লাগছিল।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু ইনি যে কেদারেশ্বরবাবুর বন্ধু, তা আপনি জানলেন কী করে? বিজ্ঞাপনে উল্লেখ ছিল?”

“তা ছিল না। তবে বিজ্ঞাপনের নীচে উল্লেখ ছিল যে, এর সন্ধান পেলে হয় যে-কোনও থানায় কিংবা ধুবুড়ি শহরে কেদারেশ্বর ফুকনকে জানাতে হবে। বিজ্ঞাপনে কেদারেশ্বরবাবুর ধুবুড়ির ঠিকানা আর ফোন নম্বরও দেওয়া ছিল। আপনারা তো এখান থেকে কাল ধুবুড়িতেই যবেন।”

“তা যাব, কিন্তু কাল পর্যন্ত এখানে বসে থাকতে হবে কেন? আমরা যদি ঘন্টা খানেক বাদে গাড়ি নিয়ে রওয়া হই তো ক্ষতি কী?”

মহিম বরুয়া হাসলেন। বললেন, “পথে কোনও ভাল একটা খাবার জায়গা পাবেন না। ফলে দুপুরের খাওয়া এখানে সেরে নিয়ে তারপর আপনাদের রওনা হতে হবে। তা দুপুর একটা নাগাদ যদি রওনা হন তো ধুবুড়ি পৌঁছতে-পৌঁছতে রাত আটটা। তাতেও আপত্তি ছিল না, যদি রাস্তাটা নিরাপদ হত।”

আমি আর সদানন্দবাবু এতক্ষণ চুপচাপ সব শুনে যাচ্ছিলুম। কিন্তু রাস্তা যে নিরাপদ নয়, এ-কথা শুনে সদানন্দবাবু আর স্থির থাকতে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, “আপদটা কীসের?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপদ বলতে মহিমবাবু বোধহয় উগ্রপন্থীদের কথা বোঝাতে চাইছেন। রেডিয়ো আর টিভির নিউজ-বুলেটিনে যাদের ‘আতঙ্কবাদীয়োঁ’ বলা হয় আর কী।”

“না না, আমি শুধু তাদের কথা বোঝাতে চাইছি না,” মহিম বরুয়া বললেন, “যেমন তারা আছে, তেমনি লুঠপাট করাই যাদের পেশা, তারাও আছে বই কী। তা ছাড়া, সিকিওরিটি চেকিংয়ের নামে যে হ্যারাসমেন্ট চলে, তার কথাও ভুলে যাবেন না। হাইওয়ের সর্বত্র সিকিওরিটির লোকেরা আপনাদের গাড়ি থামাবে। আপনাদের সঙ্গে অবশ্য মালপত্র বিশেষ নেই, থাকার মধ্যে আছে তিনটে হ্যান্ডব্যাগ, কিন্তু ওই হ্যান্ডব্যাগের জিনিসপত্রও তারা সমানে হাঁটকে দেখবে। কোথায় যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন, রাত্তিরেই বা যাচ্ছেন কেন, জেরায় জেরায় জেরবার করে ছাড়বে। তাই বলছিলুম যে, পথটা যখন ভাল নয়, মাঝে-মাঝেই নানা রকমের ঘটনা ঘটছে, তখন ভোর পাঁচটায় রওনা হওয়াই তো সেফ, দিব্যি বারোটা নাগাদ ওখানে পৌঁছে লাঞ্চ করতে পারবেন।”

সদানন্দবাবু বললেন, “আর ব্রেকফাস্ট?”

“প্যাকেটে করে আপনাদের সঙ্গে দিয়ে দেওয়া হবে। বড় একটা ফ্লাস্ক-ভর্তি কফিও থাকবে সেই সঙ্গে। আর থাকবে ছ’ বোতল মিনারেল ওয়াটার। পথে কোথাও জল খাবেন না।”

“কেন?”

“রিস্কি।” মহিম বরুয়া বললেন, “আর-একটা কথা বলে দিচ্ছি। হাইওয়ের উপরে সিকিওরিটির লোকেরা এখানে-ওখানে রাইফেল উঁচিয়ে আপনাদের গাড়ি থামাবে, মালপত্তর হাঁটকাবে, জেরা করবে। কিন্তু তাতে যতই বিরক্ত হোন, দয়া করে তাদের সঙ্গে তর্ক করতে যাবেন না বা তাদের কাজে কোনও বাধা দেবেন না।”

সদানন্দবাবু বললেন, “বাঃ, এ তো দেকচি মজার ব্যাপার। আমরা তো আর আতঙ্কবাদীয়োঁ নই, ছাপোষা মানুষ, এক ফ্রেন্ডের বাড়িতে দু’দিনের জন্যে বেড়াতে যাচ্চি। তা হলে আমাদের জিনিসপত্তর সার্চ করতে চাইলে আপত্তি করব না কেন?”

“এইজন্যে করবেন না যে, মোস্ট অব দেম আর রাফ অ্যান্ড টাফ পিপ্‌ল, অ্যান্ড কোয়াইট আ ফিউ অব দেম আর ট্রিগার-হ্যাপি। আসলে ওরা নিজেরাই একটু ভয়ে ভয়ে থাকে তো, সেটা কিছু অস্বাভাবিকও নয়, কখন কোথায় অ্যাম্বুশড হবে তার ঠিক নেই, ফলে সন্দেহ হলেই হল, প্যানিকি হয়ে গিয়ে দুমদাম গুলি চালিয়ে দেয়। …না মশাই, ওদের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি করতে যাবেন না।”

এ যে অতিশয় যুক্তিসংগত কথা, নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই তা আমি জানি। বছর খানেক আগে এই পথ দিয়েই আমাকে বঙ্গাইগাঁও যেতে হয়েছিল। নলবাড়িতে আর্মির লোকেরা গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি চালায়। আমার সঙ্গে ছিলেন একজন আই. এ. এস. অফিসার। তিনি তাঁর আইডেন্টিটি কার্ড দেখিয়েও রেহাই পাননি। সঙ্গের জিনিসপত্র আর ফ্লোর-বোর্ড তো বটেই, গাড়ির ডিকি আর বনেট পর্যন্ত খুলিয়ে সবকিছু তন্ন-তন্ন করে দেখে, বিস্তর জেরা করে তারপর তারা আমাদের রেহাই দেয়। সদানন্দবাবুকে তাই বললুম, “শুনলেন তো? যারা বন্দুকের ঘোড়ায় আঙুল রেখে কথা বলে, তারা যা করতে বলে করবেন, যা জিজ্ঞেস করে লক্ষ্মী ছেলের মতো তার জবাব দেবেন, তক্কো-টক্কো করতে যাবেন না, মশাই।”

মহিম বরুয়া উঠে পড়লেন। বললেন, “তা হলে আমি এখন চলি। ধুবুড়ি যাবার গাড়ির ব্যবস্থা পাকা করে রাত্তিরের দিকে একবার আসব। আপনারা স্নান করে খাওয়া-দাওয়া করুন। দুপুর একটা নাগাদ লাঞ্চ দেবে। তারপর, গেস্ট হাউসের গাড়িটা তো রইল, ইচ্ছে হলে এদিক-ওদিক একটু ঘুরে আসতে পারবেন।”

নমস্কার করে ভদ্রলোক বেরিয়ে গেলেন।

স্নান করে, দুপুরের খাওয়া শেষ হতে-হতে দেড়টা। একতলার ডাইনিং হল থেকে দোতলায় ফিরে এসে ভাদুড়িমশাই একটা সিগারেট ধরিয়েছিলেন। তারপর হঠাৎ কোনও একটা কাজের কথা মনে পড়ে যাওয়ায় সিগারেটটা অ্যাসট্রেতে পিষে দিয়ে, পকেট থেকে নোটবুকটা বার করে তাতে একবার চোখ বুলিয়ে নোটবুকটা ফের পকেটে ঢুকিয়ে রেখে টেলিফোনের সামনে মোড়ায় বসে ডায়াল ঘোরাতে লাগলেন। ওদিক থেকে কে ফোন ধরলেন, জানি না। এদিক থেকে ভাদুড়িমশাই বললেন, “নমস্কার… আমি ভাদুড়ি কথা বলছি… হ্যাঁ, চারু ভাদুড়ি… কী, বিশ্বাস হচ্ছে না? …আরে ভাই, আজ যে বিহু, আপনাদের ভাষায় চতর সংক্রান্তিত ডাঙর উৎসব, ছুটির দিন, সেটা জানি বলেই তো আপিসে না-করে বাড়িতে ফোন করছি। …যেতে হবে? …ঠিক আছে, বাড়িতেই যাচ্ছি। …কী বললেন, …না না, গাড়ি পাঠাতে হবে না, দুটোর মধ্যেই পৌঁছে যাব।”

রিসিভারটা ক্রেডলে নামিয়ে রেখে, মোড়া থেকে উঠে পড়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমি একটু বেরুচ্ছি।”

সদানন্দবাবু বললেন, “কখন ফিরবেন?”

‘দেরি হবে না। চেনা একজনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। আশা করি, তিনটের মধ্যেই ফিরে আসতে পারব।”

“বেশ, আপনি ফিরে আসুন, তখন আমি একবার গাড়িটা নিয়ে বেরুব ভাবছি।”

“কোথাও যাবার আছে? মানে চেনাশোনা কারও সঙ্গে দেখা করতে যাবেন?”

“বাঃ, মায়ের থানে এইচি, একবার কামিখ্যে-মন্দিরে যেতে হবে না?” সদানন্দবাবু বললেন, “আমার ওয়াইফকে বলে এইচি যে, মায়ের মন্দিরে পুজো দিয়ে প্রসাদ নিয়ে কলকাতায় ফিরব।” সদানন্দবাবুর দিক থেকে আমার দিকে চোখ ফিরিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “আর আপনি?” বললুম, “আমি কোথাও যাব না। দিল্লিতে পেপসি কাপের ফাইনাল হচ্ছে, ইন্ডিয়া ভার্সাস অস্ট্রেলিয়া। ধুন্ধুমার লড়াই। ফার্স্ট পার্টটা দেখা হযনি। এখন টিভি চালিয়ে পাঁচটা পর্যন্ত চুপচাপ বাকি অংশটা দেখব।”