৩
এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ফের তাঁর কথার খেই ধরে কেদারেশ্বর বললেন, “বাইরে চলে গেলেও যোগাযোগ তো ছিলই, তার বিয়েতে উপস্থিত থাকার অনুরোধ জানিয়ে সুশান্ত একটা চিঠিও আমাকে ঠিকই পাঠিয়েছিল, কিন্তু একেবারে নতুন চাকরি, ছুটি পাওয়া গেল না, ফলে কলকাতাতেও আসতে পারলুম না, পরের বছর কলকাতায় এসে ওদের এলগিন রোডের বাড়িতে গিয়ে দেখা করি।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “সুশান্তদের জমিদারি তো চলে গিয়েছিল, চলত কীভাবে? চাকরি-বাকরি করত?”
কেদারেশ্বর বললেন, “চাকরিতে একটা ঢুকেছিল ঠিকই, খুব-একটা খারাপ চাকরিও নয়, অন্তত মাইনেটা নেহাত মন্দ ছিল না, জেঙ্কিনস অ্যান্ড জেঙ্কিনস কোম্পানির জুনিয়ার অফিসার…”
খাওয়াটা সম্ভবত বেশি হয়ে যাওয়ায় সদানন্দবাবুর ইতিমধ্যে একটু ঝিমুনি এসে গিয়েছিল। কিন্তু ঝট করে সেটা কেটে গেল। সোফার উপরে সিধে হয়ে বসে, কেদারেশ্বরের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে তিনি বললেন, “জেঙ্কিনস অ্যান্ড জেঙ্কিনস? ও তো আমাদের আপিস মশাই! কবে ঢুকেছিলেন?”
“বিয়ের পরে-পরেই, তার মনে নাইন্টিন ফিফটিতেই ঢুকেছিল।”
“কী নাম বললেন? সুশান্ত চৌধুরি তো? হ্যাঁ, আমার মনে আচে। ধপধপে ফর্সা ইয়াং ম্যান, ছিপছিপে লম্বা চ্যায়রা, নাকের তলায় তখনকার কালের কায়দায় ছাঁটা সরু গোঁপ। কী, ঠিক বলচি তো?”
“ঠিকই বলছেন।” কেদারেশ্বর হেসে বললেন, “সিলভিয়ার কথায় এই রকমের গোঁফ রাখতে শুরু করে। এ নিয়ে আমি তখন ওকে ঠাট্টাও নেহাত কম করিনি।
শেষের দিকের কথায় বিশেষ কান না-দিয়ে সদানন্দবাবু বললেন, “কিন্তু তিনি তো মশাই মাস ছয়েকের মদ্যেই রাগমাগ করে চাকরি ছেড়ে দেন। খোদ জেঙ্কিনস সায়েবের সঙ্গেই নাকি কী নিয়ে খুব কতা-কাটাকাটি হয়েছিল।”
কেদারেশ্বর বললেন, “এটাও আপনি ঠিকই বলেছেন। আসলে ব্যাপার কী জানেন, জমিদারি থাক আর না-ই থাক, শরীরে তো জমিদার-বংশের রক্ত বইছে, চাকরিতে ওর লেগে থাকার কথা নয়, থাকেওনি, তবে কিনা চাকরি ছাড়ার ফলে যে ওর হাড়ির হাল হয়েছিল, তাও কিন্তু না।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “তার মানে ব্যাঙ্ক-ব্যালান্সটা ভালই ছিল, কেমন?”
“না, চারুদা।” কেদারেশ্বর বললেন, “ব্যাঙ্কে তেমন কিছু ছিল না। তবে এলগিন রোডের বাড়িটা ছাড়াও কলকাতায় ওদের আরও দু’টো বাড়ি ছিল। একটা রাসেল স্ট্রিটে আর একটা চৌরঙ্গী টেরাসে। তা সেই বাড়ি দুটো থেকে মাস-মাস ভাড়াও নেহাত খারাপ পাওয়া যেত না। তাই বলছিলুম যে, চাকরি ছেড়ে দেওয়ার ফলে যে ও আতান্তরে পড়ে গিয়েছিল, তা কিন্তু ভাববেন না। বসতবাড়িটা তো ছিলই, বাকি রইল সংসার চালানোর খরচা। তা বুঝে-শুনে চলতে পারলে দু-দুটো বাড়ির ভাড়ার টাকাতেই ওর সংসার-খরচা দিব্যি চলে যেতে পারত।”
“কিন্তু চলেনি, এই তো?”
“না, চারুদা, চলেনি।”
সদানন্দবাবু বললেন, “চলবে কী করে? এ তো আর আমাদের ঘরের বউ নয় যে, মাসান্তে যা এনে দেবে, তা-ই দিয়েই হাসিমুকে সংসার চালিয়ে নেবে। এ হল গে মেম-বউ, ওদের মশাই হাজার বায়নাক্কা, সে-সব কি আর আমরা মেটাতে পারি। আপনার বন্ধুটি ওই যে মেম বিয়ে করলেন, ওই হয়ে গেল গোড়ায় গলদ!”
কেদারেশ্বর বললেন, “না না, শুধু বউয়ের দোষ দিয়ে কী হবে। আর তা ছাড়া মেম-বউ হলেই যে সে উড়নচন্ডী হবে, তা-ই কি বলা যায়? আমাদের চেনা-জানার মধ্যেও তো আরও দু’-চার জনের মেম-বউ রয়েছে, কিন্তু কই, তারা তো মোটেই বেহিসেবি নয়, স্বামীর যা রোজগার তা-ই দিয়েই তো দিব্যি চালিয়ে নিচ্ছে তারা। আসল কথা, সুশান্ত নিজেও বেহিসেবি কিছু কম ছিল না। তবে হ্যাঁ, তার বউয়ের দোষটা এইখানে যে, কোথায় সে তার স্বামীর বেহিসেবি স্বভাবে একটু রাশ টেনে ধরবে, তা নয়, তাতে সে আরও ইন্ধন জুগিয়ে গেছে।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “এ-সব তুমি জানলে কী করে? তুমি তো কলকাতায় থাকতে না।”
“বাইরে থাকলে কী হয়, কমন ফ্রেন্ডদের চিঠিতে ঠিকই খবর পেয়ে যেতুম, চারুদা। কখনও শুনতুম, সামারে ওরা লন্ডনে গেছে, মাস দুয়েক সেখানে কাটিয়ে তারপর কন্টিনেন্টের দু’-চারটে দেশ দেখে তবে দেশে ফিরবে। কখনও শুনতুম, পুরনো বেবি-অস্টিনটা বেচে দিয়ে ওরা বিশাল একটা গাড়ি কিনেছে। কখনও শুনতুম, বেঙ্গল ক্লাবে ওরা প্রায়ই পার্টি দিচ্ছে। কখনও শুনতুম, সুশান্তদের বাড়িতে ফি শনিবার ব্রিজের আড্ডা বসছে, সেখানে হাই স্টেকে যে কনট্রাক্ট ব্রিজ চলছে, তাতে এক-এক রাত্তিরে উড়ে যাচ্ছে হাজার-হাজার টাকা।”
আবার একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন কেদারেশ্বর। তারপর বললেন, “বাইরে থাকতুম বটে, কিন্তু ছুটি কাটাতেই হোক কি আপিসের কাজেই হোক, কলকাতায় কি আর আসতুম না? আসতুম ঠিকই। আর তখনই দেখতুম যে, যে-সব খবর পাচ্ছি, তা নেহাত মিথ্যে নয়, সুশান্তর লাইফ-প্যাটার্নটা সত্যি একেবারে পালটে গেছে।”
সদানন্দবাবু বললেন, “তার মানে দু’হাতে টাকা ওড়াচ্চেন, কেমন?”
“ঠিক তা-ই। একটা ঘটনার কথা বলি, তার থেকেই যা বোঝবার বুঝতে পারবেন। এ হল ওদের বিয়ের বছর তিনেক পরের ঘটনা। তখন আমি লখনউয়ে থাকি। বাবার অসুখের খবর পেয়ে কলকাতায় এসেছিলুম, বাবা একটু সুস্থ হয়ে উঠতে একদিন গিয়ে সুশান্তর সঙ্গে দেখা করি। গিয়ে দেখলুম গ্যারাজে একটা নয়, দু’দুটো গাড়ি। পুরনো বেবি-অস্টিন বেচে দিয়ে যে ঢাউস ডজটা কিনেছিল, তার পাশে এবারে ঝকঝকে একটা ট্রায়াম্ফ মে-ফ্লাওয়ারও চোখে পড়ল। বললুম, ‘বাড়িতে তো লোক মাত্র দু’জন। তা হলে আবার একটা নতুন গাড়ি কেনার দরকার হল কেন?’ তাতে বলল, সিলভিয়া নাকি নতুন একটা গাড়ির জন্যে বায়না ধরেছিল, ‘তাই তার এবারকার জন্মদিনে ওটা দিলুম।’ বুঝুন ব্যাপার!”
“এর আর বোজাবুজির কী আচে!” সদানন্দবাবু বললেন, “তা এর ফলটা কী দাঁড়াল? দশ বছরের মদ্যেই সব ফতুর?”
কেদারেশ্বর ম্লান হেসে বললেন, “দশ কী বলছেন, পাঁচ বছরও লাগেনি। ফিফটিফাইভে কলকাতায় এসে ফের ওর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলুম। গিয়ে দেখি, বাড়ি অন্ধকার। মাত্র দু’বছর আগেও তো ঝি চাকর মালি ড্রাইভার বাবুর্চি খানসামা দরোয়ান আর ইয়ার-দোস্তদের ভিড়ে বাড়িটা গমগম করতে দেখেছি, এবারে সুশান্তর বাপের আমলের এক বুড়ো চাকর ছাড়া আর কাউকেই দেখতে পাওয়া গেল না। ডাকাডাকি করতে সেই বুড়ো চাকরই একটা লন্ঠন হাতে দরজা খুলে দিয়ে আমাকে উপরে নিয়ে যায়। দোতলায় সুশান্ত তার শোবার ঘরে একটা ইজিচেয়ারে চুপচাপ বসে ছিল। চাকরটি আমাকে সেখানে পৌঁছে দিয়ে, হাতের লন্ঠন মেঝেতে নামিয়ে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পরে সুশান্ত বলল, ‘আয়।” বাড়ি অন্ধকার কেন, জিজ্ঞেস করতে জানা গেল, ইলেকট্রিক কোম্পানি কানেকশন কেটে দিয়েছে।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “তারপর?”
কেদারেশ্বর বললেন, “তারপর আর কী, আস্তে-আস্তে সবই জানতে পারলুম। বউকে নিয়ে ফরেন-ট্যুর, নতুন গাড়ি, নিত্যি-নিত্যি পার্টি দেওয়া, হাই স্টেকে ব্রিজ খেলা, নতুন-নতুন লোক-লশকর, দামি-দামি আসবাবপত্তর দিয়ে বাড়ি সাজানো, এ-সবের টাকা কোত্থেকে এসেছে, সবই আস্তে-আস্তে পরিষ্কার হয়ে গেল। শুনলুম, রাসেল স্ট্রিট আর চৌরঙ্গী টেরাসের বাড়ি দুটো সে সিলভিয়াকে বিয়ে করার পরে-পরেই বিক্রি করে দেয়। এলগিন রোডের বাড়িটাও শুনলুম এক মারোয়াড়ির কাছে বাঁধা রেখে পাঁচ লাখ টাকা কর্জ করেছিল, এখন আর শোধ করার ক্ষমতা নেই, ফলে এটাও বেহাত হতে চলেছে। তবে কিনা সব থেকে বড় ধাক্কা খাওয়া তখনও তার বাকি ছিল। সেটা এল সিলভিয়ার কাছ থেকে। তার ড্রিম-প্রিন্স যে একেবারে খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে, এটা বুঝবার পরে সে আর দেরি করেনি। তার বাবা ইতিমধ্যে বিলেতে ফিরে গিয়েছিলেন। নিজের জমানো টাকা থেকে টিকিট কেটে সেও বিলেতে চলে যায়। যাবার আগে একটা চিঠি লিখে সুশান্তকে জানিয়ে দিয়ে যায় যে, সে আর ফিরবে না। এ হল ওই ফিফটিফাইভের সেপ্টেম্বরের ঘটনা।”
এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে কেদারেশ্বর বললেন, “এলগিন রোডের বাড়ি থেকে সেদিন যখন বেরিয়ে আসি, সুশান্ত তখন আমাকে কী বলেছিল জানো চারুদা??”
“কী বলেছিল?”
“বলেছিল, আসবাবপত্রের প্রায় সবই তো একে-একে বিক্রি হয়ে গেছে, বলতে গেলে বেচার মতো আর কিছুই বাকি নেই। তারপর খুব ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করেছিল যে, কিছু টাকা তাকে আমি ধার দিতে পারি কি না। তা তখন তো আমার কাছে কিছুই ছিল না। পরদিনই ব্যাঙ্কে গিয়ে চেক ভাঙিয়ে আমি ওকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে আসি। টাকাটা নিয়ে ও বলে যে, যত তাড়াতাড়ি পারে এটা ও শোধ করে দেবে। তাতে আমি বলি, ‘এ নিয়ে ভাবতে হবে না, কলেজের চার-চারটে বছর তোর ক্লাসমেটদের পিছনে যা খরচা করেছিস, ধরে নে তারই একটা ফ্র্যাকশন তোকে কেউ আজ দিয়ে গেল।’ …দ্যাখো চারুদা, একটা তেজি, ডেভিল-মে-কেয়ার চরিত্রের দাপুটে লোকের চোখ ছলছল করছে, এটা দেখতে আমার ভাল লাগে না; সুশান্তর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ার আগেই তাই আমি ওর ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। ছুটি ফুরিয়ে গিয়েছিল। তবে চেষ্টা করলে যে আর দু’চার দিন বাড়িয়ে নেওয়া য়েত না তা নয়। কিন্তু ট্রেনের টিকিট তো কাটাই ছিল, সেটা ক্যানসেল না-করে সেদিনই দেরাদুন এক্সপ্রেসে আমি লখনউ ফিরে যাই।”
“তারপর?” অরুণ সান্যাল বললেন, “তারপর আর দেখা হয়নি?”
কেদারেশ্বর বললেন, “হয়েছিল। তবে অনেক বছর পরে। অনেক বছর মানে পুরো কুড়ি বছর। তখন আমি আমাদের সিমলা অফিসের চার্জ নিয়ে সদ্য সেখানে পৌঁছেছি। এ হল সেভেন্টিফাইভের কথা।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “এইট্টিথ্রিতে ওই সিমলাতেই হোটেল থেকে ওষুধ কিনতে বেরিয়ে আই জাস্ট র্যান ইনটু ইউ। দেখেই চিনতে পেরেছিলুম যে, এ আমাদের সেই কেদার-সাব না হয়ে যায় না। তোমার সঙ্গে তোমাদের বাড়িতে গেলুম, শুনলুম যে পরের বছরেই তুমি রিটায়ার করবে। তো সে-কথা থাক, যা বলছিলে বলো।”
“মজা কী জানো, চারুদা,” কেদারেশ্বর বললেন, “তোমার সঙ্গে যে-ভাবে সেদিন দেখা হল, সেভেন্টিফাইভেও ঠিক ওইভাবেই সুশান্তর সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গিয়েছিল। ওই যে বললুম, বদলি হয়ে সদ্য তখন আমি সিমলা অফিসে জয়েন করেছি, ছেলে বিদেশে, বউকে রেখে আসতে হয়েছে কলকাতায়, তার কারণ কোম্পানি বলেছে আপাতত কোয়ার্টার্স দিতে পারবে না, নিজে উদ্যোগী হয়ে আমাকে কারও বাড়িতে পেইং গেস্ট হিসেবে থাকতে হবে কিংবা খুঁজে নিতে হবে একটা ফ্ল্যাট, তবে তার জন্যে যা টাকা লাগে তা তারা মিটিয়ে দেবে। তো সেই অবস্থায় অফিস আওয়ার্সের পরে আমি একদিন ফ্ল্যাট খুঁজে বেড়াচ্ছি, এমন সময় রেল-স্টেশনের কাছাকাছি একটা রাস্তায় একেবারে হঠাৎই ওর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়।”
“ফিফটিফাইভে সেই যে ওদের এলগিন রোডের বাড়িতে গিয়েছিলে, তারপরে এই প্রথম দেখা?”
ভাদুড়িমশাইয়ের কথার প্রায় প্রতিধ্বনি করে কেদারেশ্বর বললেন, “এই প্রথম দেখা।”
“এর মধ্যে কোনও যোগাযোগই ছিল না?”
“না।”
“এমনকী, ও কোথায় থাকে, কী করে, তাও তুমি জানতে না?”
“না, চারুদা। কিছুই জানতাম না। কেউ আমাকে কিছু বলতে পর্যন্ত পারেনি। পরের বছরই মানে ফিফটিসিক্সেই ফের কলকাতায় ওর বাড়িতে গিয়েছিলুম, গিয়ে দেখি সেখানে অন্য লোক থাকেন, সুশান্ত কোথায় থাকে জিজ্ঞেস করতে তিনি হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, কিছুই বলতে পারলেন না। কোনও খবর পাওয়া গেল না আমাদের কমন ফ্রেন্ডদের কাছেও। জনে-জনে ঘুরে-ঘুরে একই উত্তর পেলুম: না, কেউ কিছু জানে না। কী যে খারাপ লেগেছিল, সে আমি বলে বোঝাতে পারব না, চারুদা। খালি-খালি একটা কথাই মনে হচ্ছিল। ভাবছিলুম যে, এমনটা হয়? হতে পরে? এ-সব তো সিনেমায় দেখা যায়, গল্প-উপন্যাসেও পড়া যায়। তা-ই বলে কি আমাদের জীবন থেকেও একটা লোক, যাকে আমি এতদিন ধরে দেখছি, যার সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছি, একটা চিহ্ন পর্যন্ত না রেখে সে এইভাবে হারিয়ে যাবে?”
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে কেদারেশ্বর বললেন, “চারুদা, তুমি জিজ্ঞেস করছিলে, ফিফ্টিফাইভ থেকে সেভেন্টিফাইভের মধ্যে আমাদের কোনও যোগাযোগ ছিল কি না। উত্তরে আমি বলেছি, না। এখন আবার বলছি, যোগাযোগ বলতে আমি যা বুঝি, সত্যি সেটা ছিল না। তবে এরই মধ্যে যে একটা ঘটনা ঘটেছিল, তাও ঠিক। এ হল সিমলায় বদলি হওয়ার দু’বছর আগের কথা। আমি তখন লখনউয়ে থাকি। তো সেভেন্টিথ্রিতে সেখানে আমার কাছে একটা মনিঅর্ডার এসে পৌঁছয়। পাঁচ হাজার টাকার মনিঅর্ডার। কুপনে লেখা: ‘টাকাটা পাঠালাম। যেখানে আছি, ভালই আছি। সবকিছু এখন স্পষ্ট দেখতে পাই।—সুশান্ত।’”
সদানন্দবাবু বললেন, “চোকের কোনও ব্যামো ছিল?”
হেসে বললুম, “তা তো ছিলই। তবে কী রকমের ব্যামো, সে আপনি বুঝবেন না।”
ভাদড়িমশাই বললেন, “মনি অর্ডারের ফর্মে তো প্রেরকের ঠিকানা লিখতে হয়। সেটা ছিল?”
“ছিল।” কেদারেশ্বর বললেন; “কিন্তু সেটা ভুল-ঠিকানা। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি যে, ওই ঠিকানায় সুশান্ত চৌধুরি বলে কেউ থাকে না।”
“কিন্তু পঁচাত্তর সালে সিমলায় তোমাদের দেখাটা যখন হয়েই গেল, তখন তো তার আসল ঠিকানাটা জেনে নিতে পারতে। সেটা নিয়েছিলে? নাকি সেবারেও সে তোমাকে একটা ভুল-ঠিকানা গছিয়ে দিয়ে ফের ছটকে বেরিয়ে যায়?”
“না, চারুদা, শুধু তখনকার ঠিকানা নয়, তার আগের কুড়ি বছরের মধ্যে ও কখন কোথায় ছিল, কী করছিল, বছরের পর বছর কী কষ্টে ওর কেটেছে, সবই সেদিন সুশান্ত আমাকে খুলে বলে। ওর বাবার আমলের সেই চাকর, গোবিন্দ, যে কিনা ওরই সমবয়সি, একমাত্র সে ছাড়া আর কেউই তখন ওর সঙ্গে ছিল না। কালীঘাট থেকে শ্যামবাজার, কলকাতা শহরের হরেক বস্তিতে ও তখন থেকেছে। গোবিন্দ কাজ করত। খবরের কাগজের হকারি থেকে রেল-স্টেশনের কুলিগিরি, হরেক রকমের কাজ কিন্তু সুশান্তকে ও কোনও কাজ করতে দিত না। সুশান্ত তাই নিয়ে রাগারাগি করলে বলত, এ-সব তোমার কাজ নয়, তুমি পারবে না। তারপর একেবারে হঠাৎই একটা ঘটনা ঘটে। বাহাত্তর সালের মাঝামাঝি এই গোবিন্দের সঙ্গেই শেয়ালদা স্টেশনে একদিন ওদের কমলদিঘি এস্টেটের ম্যানেজারবাবুর দেখা হয়ে যায়। সাতচল্লিশ সালে তিনিও ইস্ট পাকিস্তান থেকে কলকাতায় চলে এসেছিলেন, তারপর অন্য কোনও কাজ জোটাতে না-পেরে শুরু করেছিলেন ওকালতি। সুশান্তের বিপর্যয়ের খবর তিনি রাখতেন, কিন্তু সে যে কোথায় থাকে, তা জানতেন না। গোবিন্দকে তিনি দু’দুটো খবর দেন। এমন খবর, যাতে সুশান্তের জীবন আবার পালটে যায়। প্রথম খবর, কমলদিঘির সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ বাবদে পনেরো লাখ টাকা পাওয়া যাবে। আর দ্বিতীয় খবর, কলকাতায় সুশান্তদের একটা বাজার ছিল, যার কথা সুশান্ত নিজেই জানত না। তা সেই বাজারের মালিকানা নিয়ে যে মামলা চলছিল, তাতে হাইকোর্টের রায় গিয়েছে সুশান্তদের পক্ষেই, আর সেই রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ যেহেতু আপিল করেনি, তাই সেই বাবদে সুশান্ত আরও লাখ দশেক টাকা পাবে। বাস, ম্যানেজারবাবুকে সঙ্গে নিয়ে গোবিন্দ তক্ষুনি বেলেঘাটার বস্তিতে ছুটে আসে। সুশান্তর ভাগ্যও আবার পুরোপুরি ঘুরে যায়। …তো পঁচিশ লাখ টাকা হাতে পেয়ে সুশান্ত প্রথমেই কী করে জানেন?
“জানি না, তবে অনুমান করতে পারি।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “প্রথমেই মনি অর্ডার করে পাঠিয়ে দেয় সেই পাঁচ হাজার টাকা, ঘোর দুর্দিনে যা তুমি একদিন ওকে দিয়ে এসেছিলে।”
সদানন্দবাবু বললেন, “বুজলে হে কৌশিক, তোমরা একালের ছেলেছোকরারা তো সব ব্যাপারেই ঠোঁট ওলটাও, কিন্তু বাবাজীবন, এনার কাচে যা শুনলে তার পরে আর কী বলা যায়! আরে বাবা, নিয়তি বলে একটা কিছু আচেই।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা সিমলায় যখন তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, তখনও কি সে ওই বস্তিতেই থাকত নাকি?”
“না। তা থাকত না।” কেদারেশ্বর বললেন, “তখন সে গোবিন্দকে নিয়ে সেন্ট্রাল ক্যালকাটার মধ্যবিত্ত পাড়ায় একটা বাড়ি ভাড়া করে উঠে এসেছে। কিন্তু কলকাতায় তখন আর তার মন টিকছিল না। পরের বছর কলকাতায় গিয়ে যখন তালতলা-পাড়ার সেই বাড়িতে তার সঙ্গে দেখা করি, তখন সে বলে যে, বাইরে এমন কোথাও তাকে কিছুটা জায়গা খুঁজে দিতে হবে, যেখানে একটু নিরিবিলি পরিবেশে তার বাদবাকি জীবনটা সে শান্তিতে কাটাতে পারবে। তাতে আমি বলি, আর কটা বছর কাটিয়ে দে, আমি তো এইট্টিফোরের গোড়াতেই রিটায়ার করব, রিটায়ার করে আর কলকাতায় থাকব না, চলে যাব আমাদের ধুবুড়ির বাড়িতে, তা সেখানে শহরের বাইরে যদি কিছু জায়গা কেনার ব্যবস্থা করে দিই তো তুই যাবি? শুনে সুশান্ত বলে, তা হলে তো খুবই ভাল হয়, তোর কাছাকাছি থাকতে পারব, এটাই তো মস্ত অ্যাটট্রাকশন।”
“তা জমির ব্যবস্থা হল?”
“হল, তবে ধুবুড়িতে নয়, কোকরাঝাড়ে। সেখানে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে, বলতে গেলে হাইওয়ের পাশেই, বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি আর বাগানসুদ্ধু প্রায় জলের দরে বিঘেখানেক জায়গা পেয়ে গিয়ে আমি আর লোভ সামলাতে পারলুম না। সুশান্তর জন্যে একেবারে সঙ্গে-সঙ্গেই বায়না করে ফেললুম।”
“কিন্তু সে তো তোমার বাড়ির কাছে হল না।”
“খুব দূরেও হয়নি। ধুবুড়ি আর কোকরাঝাড় তো পাশাপাশি জেলা। তা ছাড়া, জমি আর বাড়ি যেখানে কেনা হল, সেটা ধুবুড়ির বর্ডারের খুব কাছেই। রোজ না হোক, ফি হপ্তায় অন্তত একবার তো যাওয়াই যায়। দিব্যি কাটিয়ে আসা যায় উইকএন্ডটাও। জমি আর বাড়ির দাম মিটিয়ে কলকাতা থেকে সুশান্ত সেখানে চলে এল। আর ওই যা বলছিলুম, ফি হপ্তায় উইকএন্ড কাটাবার জন্যে হয় আমি ওর ওখানে চলে যেতুম, আর নয়তো ও চলে আসত ব্রহ্মপুত্রের ধারে আমাদের ধুবুড়ির বাড়িতে।”
দেখলুম ভাদুড়িমশাইয়ের চোখ ফের আবার সরু হয়ে গেছে। সোফা থেকে সামান্য ঝুঁকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “পাস্ট টেনসে কথা বলছ কেন?”
“বলছি তার কারণ, গত এক মাস ধরে সুশান্তর কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।”
“তার মানে? …পুলিশকে জানিয়েছ?”
“তা জানিয়েছি, কিন্তু আজ সকালেই ধুবুড়ি থেকে ফোন এসেছিল, তাতে জানলুম, এখনও কোনও কিনারা হয়নি।” এই পর্যন্ত বলেই হঠাৎ ভাদুড়িমশাইয়ের হাত চেপে ধরে কাতর গলায় কেদারেশ্বর বললেন, “চারুদা, তুমি একবার এসো! আমার মন বলছে, আনলেস সামথিং ইজ ডান, খুব খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে। দয়া করে একবার এসো, চারুদা।”
কৌশিক বলল, “তিনটে বাজতে চলল, এখনই যদি না বেরিয়ে পড়ি তো সাড়ে তিনটের মধ্যে এয়ারপোর্টে পৌঁছতে পারব না।”