আংটি রহস্য – ২০

২০

আজ আঠারোই এপ্রিল, চৌঠা বৈশাখ, শনিবার। সকাল এখন দশটা। মহেশ্বর ফুকনের বাড়ির একতলার লাইব্রেরি-ঘরে, গোল একটা টেবিল ঘিরে, আমরা পাঁচজন মুখোমুখি বসে আছি। ভাদুড়িমশাই, ডোরা, সুশান্ত চৌধুরি, আমি ও সদানন্দবাবু। জানলাগুলিকে ছেড়ে দিয়ে চারিদিকের দেওয়াল জুড়ে মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত কাচের আলমারিতে সাহিত্য, সমাজ, ধর্ম, বিজ্ঞান, অর্থনীতি ইত্যাদি হরেক বিষয়ের অসংখ্য বই। অসমিয়া সাহিত্যে যাঁকে নবযুগের পথিকৃৎ বলা হয়, সেই লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার গ্রন্থাবলির পাশে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলির খন্ডগুলিও চোখে পড়ল। মহেশ্বর ফুকন সম্পর্কে এ-পর্যন্ত যা শুনেছি তাতে আমার ধারণা হয়েছিল যে, অসংখ্য উপায়ে অর্থার্জন ছাড়া আর অন্য কোনও বিষয়ে তাঁর আগ্রহ নেই। কিন্তু এই লাইব্রেরি-ঘরে ঢোকার পরে সেই ধারণা একটা জবর ধাক্কা খেয়েছে। তাঁর গ্রন্থ-সংগ্রহ সত্যিই তাক লাগিয়ে দেবার মতো। আজই ডোরার কাছে শুনেছি যে, প্রতি মাসেই তিনি কিছু-না-কিছু বই কেনেন, কী কী বই কেনা হবে, তা নিজেই ঠিক করে দেন, তা ছাড়া দিনে অন্তত ঘন্টা দুয়েক তিনি বই পড়ে কাটান।

আজকের কথায় একটু বাদেই আবার আসছি। তার আগে গতকালের দু’-একটা কথা বলে নিই। ভাদুড়িমশাই যে ডোরা আর সুশান্ত চৌধুরিকে এক জায়গায় বসিয়ে কিছু বলতে চান, ব্যাপারটা যে একান্ত ব্যক্তিগত, আর ফুকন-পরিবারের কারওই যে সেখানে থাকা চলবে না, এটা শুনে যেমন কেদারেশ্বর তেমন অনুপমা দেবীও বেশ বিভ্রান্ত বোধ করছিলেন। তাঁরা দুজনেই জানতেন যে, ডোরার সঙ্গে সেই দশই মার্চের পার্টিতে সুশান্ত মোটেই ভাল ব্যবহার করেননি। তাই, তাঁদের এইভাবে একসঙ্গে বসানো ঠিক হচ্ছে কি না, তা নিয়েও তাঁদের মনে যথেষ্ট সংশয় ছিল। সেটা প্রকাশ পেল কেদারেশ্বরের কথায়। ও-বাড়ি থেকে আমরা যখন চলে আসি, তখন গাড়ি পর্যন্ত আমাদের এগিয়ে দিতে আসার সময় তিনি বললেন, “তুমি ওদের কী বলবে, তা আমি জানি না, চারুদা; কিন্তু দেখো, এতে আবার হিতে বিপরীত না হয়।”

উত্তরে ভাদুড়িমশাই বলেছিলেন, “কিন্তু যা সত্য, তা তো বলাই উচিত। ওয়ন হ্যাজ টু ফেস দ্য ট্রুথ।”

এ-বাড়িতে ফিরে এসে ফোনে কথাও বলেছিলেন তিনি। প্রথম ফোনটা কৌশিকই করেছিল। ভাদুড়িমশাই ফোন ধরে মিনিটখানেক তার কথা শুনে বলেছিলেন, “এইট্টিসেভেন নেলসন স্কোয়ারে ওই নামে কেউ থাকে না, এই তো?…বিমল বাঁড়ুজ্যে ঠিকই বলেছিলেন। থাকার কথাও নয়।”

দ্বিতীয় ফোনটা ভাদুড়িমশাই নিজেই করেন। কোকরাঝাড়ে ফোন করে সুশান্ত চৌধুরিকে জানিয়ে দেন, পরদিন সকাল ন’টার মধ্যেই সে যেন ধুবড়িতে কেদারেশ্বরের বাড়ি হয়ে সরাসরি মহেশ্বর ফুকনের বাড়িতে চলে আসে।

তৃতীয় ফোনটা এসেছিল বাইরে থেকে। ভাদুড়িমশাইয়ের কথা থেকে বোঝা গেল, লন্ডন থেকে বব্ স্টুয়ার্ট ফোন করছে। এদিক থেকে তাঁর কথা শুনে ভাদুড়িমশাই বা বললেন, তা এই রকম :

“হ্যাঁ, আমি ফাইভ জিরো ডাব্‌ল এইট কথা বলছি…অ্যাঁ, রেভারেন্ডের এ-বিয়েতে মত ছিল না? এটা আবার কার কাছে শুনলে?…তাঁর ভাইপো রিচার্ড বোল্টনের কাছে?…তিনি গোল্ডার্স গ্রিনে থাকেন?…ও. কে., ও. কে., তারপর বলে যাও।…অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেসলেন?…তারপর?…এইটিথ্রির নাইন্‌থ মে মেলবোর্নে মারা যান। মেয়েকে এক পয়সাও দিয়ে যাননি?…থ্যাঙ্কস বর্, দ্যাটস অল ফর টুডে, বাই।”

এই তো গেল কালকের কথা। এখন আবার আজকের কথায় ফিরি। লাইব্রেরি-ঘরের গোল টেবিল ঘিরে আমরা বসে আছি। কিন্তু কেউ কোনও কথা বলছি না। আমরা সবাই যে অল্পবিস্তর অস্বস্তি বোধ করছি, তাতে সন্দেহ নেই। সবচেয়ে বেশি অস্বস্তি যে সুশান্ত চৌধুরির, সে তাঁর মুখ দেখলেই বোঝা যায়। ভদ্রলোক তাঁর চেয়ারটিতে বসে আছেন একেবারে কাঠের পুতুলের মতো। অস্বস্তিতে ভুগছেন ভাদুড়িমশাইও। নইলে তিনি আজ সকাল থেকে এত ঘনঘন সিগারেট খেতেন না। একমাত্র ডোরার মুখে কোনও অস্বস্তির ছাপ নেই। তাঁর ঠোটে যে একটু চাপা কৌতুক খেলে বেড়াচ্ছে, তাও আমার চোখে পড়ল। তাঁকে দেখলে মনে হয় যেন এক্ষুনি একটা মজার ব্যাপার ঘটবে, আর তারই জন্যে তিনি আগ্রহভরে অপেক্ষা করছেন।

নৈঃশব্দ্যের একটা চাপ থাকে। সেই চাপটাকেও তিনিই প্রথম ভেঙে দিলেন। বললেন, “কী ব্যাপার মিঃ ভাদুড়ি, কী যেন আপনি বলবেন? আমি আপনাকে যে কাজটা দিয়েছি, তার কথা?”

ভাদুড়িমশাই তাঁর আধ-খাওয়া সিগারেটটিকে অ্যাশট্রেতে পিষে দিয়ে বললেন, “কাজ তো আপনি আমাকে একটা দেননি, দুটো দিয়েছিলেন। প্রথম কাজটা ছিল আপনার হারানো আংটি খুঁজে দেওয়া। সেটা খুঁজে দিয়েছি।”

“তা দিয়েছেন।” ডোরা বললেন, “তার জন্যে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। কিন্তু ওটা পেলেন কোথায়?”

“পায়েসের মধ্যে।”

“সে কী?” কথাটা ডোরা যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। “পায়েসের মধ্যে? তা কী করে হয়?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনার শোবার ঘরের লাগোয়া অ্যান্টি-রুমে যে ড্রেসিং টেব্‌ রয়েছে, তার একটা ড্রয়ারে আংটিটা রেখে আপনি বাথরুমে স্নান করতে ঢোকেন। কিন্তু স্নান সেরে বেরিয়ে আর আংটিটা আপনি পাননি, এই তো?”

“হ্যাঁ, সে তো আপনাকে আমি বলেইছি। কিন্তু ওখান থেকে সেটা পায়েসের মধ্যে ঢুকল কী করে?”

“বলছি। আপনার কথা শুনে প্রথমেই যে-প্রশ্নটা আমার মনে দেখা দেয়, সেটা হল, আপনার অ্যান্টি-রুম থেকে ওটা সরাতে হলে কাউকে তো আপনার ঘরে ঢুকতে হবে, তা কে আপনার ঘরে ঢুকতে পারে? কোনও কাজের লোক নিশ্চয়। কিন্তু সে পুরুষ না মেয়ে? তা নর্মালি কোনও পুরুষ আপনার ঘরে ঢুকবে না। তাও এ তো শুধু আপনার বেডরুমে ঢোকা নয়, বেডরুম পেরিয়ে অ্যান্টি-রুমে ঢোকা। ওখানে ঢোকার সাহস একমাত্র মেয়েদেরই হতে পারে। কিন্তু এ-বাড়ির কাজের লোকেদের মধ্যে মেয়ে তো মাত্র একটিই—আপনাদের রাঁধুনি। ফলে আমার মনে হল এটা তারই কাজ।”

চেয়ারের হাতল দুটিকে দুহাতে শক্ত করে চেপে ধরে সুশান্ত চৌধুরি হঠাৎ সামনে ঝুঁকে বললেন, “এটা কি সেই আংটি?”

“হ্যাঁ,” ভাদুড়িমশাই অত্যন্ত কঠিন গলায় বললেন, “ডোরার…আই মিন মিসেস ফুকনের হাতে এই আংটিটা দেখেই তুমি সেই দশই মার্চের পার্টি থেকে অতি অভদ্রের মতো চলে গিয়েছিলে। ভেবেছিলে, ওটা চুরি করা হয়েছে। কিন্তু এখন আর এ নিয়ে একটিও কথা নয়। লেট মি ফিনিশ মাই স্টোরি।”

কথাটায় কাজ হল। সুশান্ত চুপ করে গেলেন।

ডোরা বললেন, “কিন্তু আমার হাতে একটা আংটি দেখে উনি অমন কথা ভাবলেন কেন, সেটাই তো বুঝতে পারছি না।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটু বাদে বুঝবেন। আপাতত চুপ করে বরং আমাকে কথা বলতে দিন।… তো যা বলছিলুম। আমি বুঝে গেলুম যে, আংটি এ-বাড়ির রাঁধুনি মেয়েটিই সরিয়েছে। কিন্তু শুধু সরালেই তো হল না, সেটা লুকিয়েও তো রাখতে হবে। ও-দিকে বাড়িতে ততক্ষণে হইচই শুরু হয়ে গেছে, জোর তল্লাসি চলছে, প্রত্যেকের বাক্স-প্যাঁটরা খোলা হচ্ছে। এই অবস্থায় সে তার চোরাই মাল কোথায় লুকোবে। উত্তরটা প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে পেয়ে গেলুম। তার হাতে তো পায়েস রান্নার ভার। সুতরাং আংটিটা যদি লুকোতে হয়, তো ওই পায়েসের মধ্যে লুকিয়ে ফেলাই সবচেয়ে সহজ কাজ একই সঙ্গে সবচেয়ে নিরাপদও বটে। উনুন থেকে পায়েসের কড়াই নামিয়ে সে দু’ভাগ করে দুটো বড়-বড় পাত্রে ঢেলে রেখেছিল। এক ভাগ দোতলার ডাইনিং হলে পরিবেশনের জন্য আর অন্য ভাগ ফ্রিজে তুলে রাখার জন্য। এই তুলে রাখা পায়েসের মধ্যেই সে আংটিটা লুকিয়ে রাখে।”

আমি বললুম, “তা যে সে রাখবে, এইটে আন্দাজ করেই সে-দিন মাঝরাত্তিরে নিঃশব্দে নীচে নেমে…’”

“হ্যাঁ, নীচে নেমে কিচেনে ঢুকে ফ্রিজ খুলে আমি আংটিটা উদ্ধার করেছিলুম।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “এ হল চোরের উপর বাটপাড়ি….কিন্তু মিসেস ফুকন, আংটি উদ্ধার করে যখন বেরিয়ে আসছি, তখন আপনাদের রাঁধুনির সঙ্গে ওই কিচেনের দরজাতেই আমার দেখা হয়ে যায়। সেও সম্ভবত আংটি উদ্ধার করতেই এসেছিল। আমাকে দেখে ভয়ে সে কেঁদে ফেলে। তা কাউকে কান্নাকাটি করতে দেখলে যা হয় আর কি, বেচারাকে আমি ভরসা দিই যে, এর জন্যে তার চাকরি যাবে না। তবে হ্যাঁ, আর কখনও এমন কাজ করবে না বলে সেও আমাকে কথা দিয়েছে। তো মিসেস ফুকন, প্লিজ, ওর চাকরিটা যেন না যায়।”

ডোরা হাসছিলেন। হাসি থামিয়ে বললেন, “তাই বলি, ফ্রিজে তোলা ছিল, পায়েসের তবু ওই হাল হল কেন। আংটি খুঁজতে গিয়ে যে নাড়াঘাঁটা করেছিলেন, পরশু ব্রেকফাস্টে আর ওটা সার্ভ করা যায়নি, পায়েসটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেল।…যা-ই হোক, আপনি যখন ভরসা দিয়েছেন, তখন ওর চাকরি যাবে না।…কিন্তু আমার দ্বিতীয় কাজটার কী হল?…আই মিন সেই ‘বিবেকবান’ ডাক্তারবাবুটিকে খুঁজে বার করবার কাজ। ওটায় কি হাত দিয়েছেন, নাকি কলকাতায় ফিরে গিয়ে হাত দেবেন?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “না না, ডঃ বিশ্বনাথ সেনগুপ্তকে খুঁজে বার করার কাজটাও পরে করব বলে ফেলে রাখিনি। খোঁজ শুরু করেছি পরশু থেকেই। আর হ্যাঁ, খোঁজটা পেয়েও গেছি। কিন্তু, মিসেস ফুকন, আর-যাই করুন, ‘বিবেকবান’ বলে তাঁকে ঠাট্টা করবেন না। ডঃ কেলি ভুল বলেননি, সত্যিই তিনি একজন বিবেকবান ডাক্তার, সেইসঙ্গে অত্যন্ত বিবেচক আর দয়ালু স্বভাবের মানুষ। কলকাতা থেকে আমাদের এজেন্ট অন্তত সেই কথাই জানিয়েছেন।”

“বিবেকবান! বিবেচক! দয়ালু!” ঠোঁট বেঁকে গেছে, নাক কুঁচকে গেছে, ডোরা বললেন, “ঠিক আছে, সেই মহাপুরুষের খোঁজ যখন পেয়েই গেছেন, তখন তাঁর ঠিকানাটা আমাকে দিন; তিনি যেখানেই থাকুন, সেইখানে গিয়ে সকলের সামনে তাঁর ভন্ডামির মুখোশটা আমি টেনে খুলে দেব!”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তার আগে বরং তাঁর সম্পর্কে যা-যা খবর আমি পেয়েছি, সেটা শুনে নিন। লন্ডন থেকে আমাদের এজেন্ট যা জানিয়েছেন, তার সবই প্রশংসার কথা। সেন্ট টমাস হসপিটালে তাঁর সার্ভিস-রেকর্ডে একটাও অ্যাডভার্স কমেন্ট নেই। তাঁর কালিগরা প্রত্যেকেই তাঁকে বিবেকবান ডাক্তার বলে জানতেন আর পেশেন্টরা জানতেন বিবেচক সহানুভূতিশীল মানুষ বলে। আমাদের কলকাতার এজেন্টের খবরও একইরকম। কলকাতায় ফিরে তিনি আর বিয়ে করেননি। বড়লোকের ছেলে, বাবার কাছ থেকে দুটো বাড়ি আর প্রচুর টাকা পান। কিন্তু সেই টাকা দিয়ে চেম্বার খুলে প্র্যাকটিস করতে শুরু করেননি। বস্তিতে-বস্তিতে ঘুরে বেড়াতেন, বিনা পয়সায় সেখানকার গরিব ছেলেমেয়েদের চিকিৎসা করতেন, ওষুধও কিনে দিতেন নিজের টাকায়। নাউ মিসেস ফুকন, ডু ইউ রিয়েলি নিড টু নো মোর টু আন্ডারস্ট্যান্ড দ্যাট হি ওয়জ আ ডক্টর উইথ আ ক্লিন কনশেন্স, আ ভেরি বিগ হার্ট, অ্যান্ড দ্যাট হি ওয়জ অ্যান এক্সট্রর্ডিনারি ম্যান?”

“কিন্তু এ তো তাঁর বাইরের চেহারা, তাঁর সামাজিক ইমেজ!” ডোরা বললেন, “তাঁর পারিবারিক চেহারাটা কেমন ছিল? কেমন স্বামী ছিলেন তিনি? কেমন বাবা?…না, আপনাদের এজেন্টকে তা জানাতে হবে না। তিনি আমার বাবা, তাই তাঁর সেই পরিচয়টা আমি ভালই জানি। ইন ফ্যাক্‌ট, সেই জন্যেই তাঁর ঠিকানাটা আমার জানা দরকার। যাতে আমি তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারি। বাস্‌, শুধু ঠিকানাটাই আমার চাই। সেটা কি জানতে পেরেছেন?”

“তা পেরেছি।” বলেই বড় বিষণ্ণ ও বিধুর হয়ে এলে ভাদুড়িমশাইয়ের গলা। বললেন, “কিন্তু সেখানে গিয়ে তো আপনি তাঁর দেখা পাবেন না। ডঃ বিশ্বনাথ সেনগুপ্ত গত বছর মারা গেছেন। আর হ্যাঁ, এটাও আপনার জেনে রাখা দরকার যে, তিনি আপনার বাবা নন।”

যেন বজ্রপাত হল ঘরের মধ্যে। হঠাৎই পাংশু হয়ে গেল ডোরার মুখ। মনে হল, নিমেষে যেন তাঁর মুখের রক্ত কেউ শুষে নিয়েছে। কয়েক সেকেন্ড একেবারে প্রস্তরীভূত একটা মূর্তির মতো বসে রইলেন তিনি। তারপর চাপা কিন্তু তীব্র গলায় বললেন, “তার মানে? ডঃ বিশ্বনাথ সেনগুপ্ত আমার বাবা নন? কী বলছেন আপনি?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমি ঠিকই বলছি। লন্ডনের যে হসপিটালে আপনার জন্ম, সেখানে বার্থ রেজিস্টারে আপনার বাবা হিসেবে ডঃ সেনগুপ্তর নামই লেখা রয়েছে বটে, কিন্তু তবু বলছি, তিনি ‘ আপনারা বাবা নন।”

“উড ইউ কাইন্ডলি এক্সপ্লেন?”

কথাটা প্রায় ধমকের মতো শোনাল। কিন্তু তাতে কোনও ভাবান্তর ঘটল না ভাদুড়িমশাইয়ের। সেই আগের মতোই ধীর, বিষণ্ণ গলায় তিনি বললেন, “একটা অ্যাসাইনমেন্ট যখন নিয়েছি, আর একটা স্টেটমেন্টও যখন করেছি, তখন কেন সেটা করলুম, ক্লায়েন্টের কাছে তা তো আমাকে এক্সপ্লেন করতেই হবে। কিন্তু এক্সপ্লেন করতে হলে, সব কথা খুলে বলতে হলে আপনার অনুমতিটাও চাই যে।”

চেয়ার ছেড়ে প্রথমেই উঠে পড়লেন সুশান্ত চৌধুরি। তাঁর দেখাদেখি আমি আর সদানন্দবাবুও উঠে পড়ার উপক্রম করছিলুম। কিন্তু ভাদুড়িমশাই বললেন, “না না, কাউকে উঠতে হবে না। যে-কাজে কিরণবাবু আর সদানন্দবাবু আমাকে সাহায্য করেন, তা নিয়ে আলোচনার সময়ে ওঁদের থাকাই চাই। আর হ্যাঁ, সুশান্তর থাকাটাও জরুরি, কেননা এই আলোচনায় কিছু পুরনো কথাও এসে যাবে, আর তাতে যদি আমার কোনও ভুল হয় তো সুশান্ত ছাড়া আর কেউ তা শুধরে দিতে পারবে না। তো মিসেস ফুকন, যা সত্য, এঁদের সামনে তা শুনতে আপনার আপত্তি নেই তো?”

“ওহ্ নো,” ডোরা বললেন, “যা সত্য, কারও সামনেই তা বলতে, শুনতে কিংবা ফেস করতে আমার কিছুমাত্র আপত্তি কখনও হয়নি, আজও হবে না। বাট ইট হ্যাজ টু বি দ্য ট্রুথ, দ্য আনডাইলুটেড ট্রুথ।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ভাল, আপনার কাছে আমি এই উত্তরটাই আশা করেছিলুম। তা হলে সব কথাই আপনাকে খুলে বলছি। কোথাও কোনও প্রশ্ন থাকলে আপনি করবেন, আমি সঙ্গে-সঙ্গে উত্তর দেব।”

ডোরা যে ভিতরে-ভিতরে অধৈর্য হয়ে উঠেছেন, সেটা তাঁর কথা থেকেই বোঝা গেল। অসহিষ্ণু গলায় বললেন, “ওহ্, গো অ্যাহেড।”

“বলছি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ডঃ সেনগুপ্ত আপনার বাবা নন দুটো কারণে। প্রথমত, তিনি আপনারে মা’কে নাইনটিন ফিফটিফাইভের ফিফটিন্থ অক্টোবর বিয়ে করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু…”

বাধা দিয়ে ডোরা বললেন, “না না, বিয়ের তারিখ ভুল বলছেন। বিয়ে হয়েছিল ফিফটিফোরের টুয়েন্টিয়েথ সেপ্টেম্বর।”

“না, মিসেস ফুকন,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “বিয়েটা তো লন্ডনে হয়েছিল। তা ফিটিফোরের সেপ্টেম্বরে আপনার মা লন্ডনে কেন, ইংল্যান্ডেই ছিলেন না। বিয়ের তারিখ সম্পর্কে আপনি মায়ের কাছে যা শুনেছেন সেটা ভুল। আমি যা বলেছি, সেটাই তাঁদের বিয়ের ঠিক তারিখ। বিশ্বাস না-হলে লন্ডনে ফিরে ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অফিসে গিয়ে তাঁদের খাতাটা আপনি দেখে নেবেন।…তো যা বলছিলুম। বিয়ে একটা হল ঠিকই, কিন্তু আইনে সেটা বৈধ নয়। তার কারণ, এর আগেই আপনার মা একটা বিয়ে করেছিলেন, সেটাও রেজিস্ট্রেশন ম্যারেজ, আর সেটা তখনও ভেঙে যায়নি, এমনকি ভেঙে দেবার জন্য একটা ডিভোর্স স্যুট তো ফাইল করা দরকার, আপনার মা তাও করেননি, অথচ সে-সব চেপে গিয়ে তিনি আর-একটা বিয়ে করে বসলেন। তা হলে আপনার মায়ের দিক থেকে এটা বিগ্যামি ছাড়া আর কী। কেউ যদি আদালতে এটা জানায়, তো আদালত সঙ্গে-সঙ্গেই রায় দেবে যে, ডঃ সেনগুপ্তর সঙ্গে আপনার মায়ের বিয়েটা বে-আইনি ভাবে হয়েছে। আর ওই বিয়েটাই যদি খারিজ হয়ে যায়, তো আপনার অবস্থাটা কী দাঁড়াবে? না ইল্লিগ্যাল চাইল্ড অব অ্যান ইল্লিগ্যাল ম্যারেজ!”

ডোরা বললেন, “এ-সব কী বলছেন আপনি? এর একটা কথাও আমি বিশ্বাস করি না। প্রথমত, আমার মায়ের কাছে তাঁর অন্য কোনও বিয়ের কথা আমি শুনিনি। আর দ্বিতীয়ত, তেমন কোনও বিয়ে যদি তাঁর হয়েই থাকে তো প্রথম স্বামীকে ডিভোর্স না-করে দ্বিতীয় বিয়ে তিনি করতেই বা যাবেন কেন?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনার মায়ের প্রথম বিয়ের কথা আপনি শোনেননি কেন, তা আমি জানি না। তবে ডিভোর্সটা কেন হয়নি, তা জানি। আসলে আপনার দাদামশাই ছিলেন রোমান ক্যাথলিক ধর্মযাজক, ডিভোর্সে তাঁর সায় ছিল না। তিনি আপনার মা’কে তাঁর স্বামীর কাছে ফিরে যেতে বলেন। কিন্তু আপনার মা তাতে রাজি হননি। আপনার দাদামশাই তারপরে আর বিলেতে থাকেননি, মেয়েকেও আশ্রয় দেননি, হি লেফ্‌ট ফর অস্ট্রেলিয়া।”

“এ-কথা আপনি কার কাছে শুনলেন?”

“আমি শুনেছি আমাদের লন্ডন-এজেন্টের কাছে, আর তিনি শুনেছেন গোল্ডার্স গ্রিনের বাসিন্দা মিঃ রিচার্ড বোল্টনের কাছে। সম্পর্কে তিনি আপনার দাদামশাইয়ের ভাইপো, অর্থাৎ আপনার মায়ের খুড়তুতো ভাই। তো মিঃ রিচার্ড বোল্টন এটাও আমাদের লন্ডন-এজেন্টকে জানিয়েছেন যে, এইট্টিথ্রির নাইথ মে তারিখে আপনার দাদামশাই রেভারেন্ড বোল্টন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরে মারা যান। তাঁর টাকাকড়ি খুব-একটা ছিল না, যা ছিল তা ওই ভাইপোটিকেই দিয়ে গেছেন।”

মৃত্যুর খবর। ডোরা তাই আড়াআড়িভাবে নিজের বুকে একটা ক্রস কাটলেন। তারপর বললেন, “আমার যে একজন দাদামশাই আছেন, তা-ই তো জানতুম না।”

“ছিলেন। এখন নেই।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনার মায়ের দ্বিতীয় বিয়েতে তাঁর একেবারেই মত ছিল না। অ্যান্ড হি লেফ্‌ট নাথিং ফর ইয়োর মাদার ইন হিজ উইল। যা-ই হোক, ডঃ সেনগুপ্তকে যে কেন আপনার বাবা বলা যাচ্ছে না, তার প্রথম কারণটা তো বলেছি। এবারে দ্বিতীয় কারণটা বলব। কিন্তু তার আগে একটা কথা জিজ্ঞেস করি। আপনার মায়ের এই অবৈধ দ্বিতীয় বিয়েটা হয়েছিল ফিটিফাইভের ফিটিথ অক্টোবর, আর আপনার জন্ম যেন কবে?”

“সেভেন্থ এপ্রিল, নাইনটিন ফিফ্‌টিসিক্স।”

“তাও আপনি কিছু বুঝতে পারছেন না?”

এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন ডোরা। ভুরু কুঁচকে, বিস্ফারিত চোখে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকালেন একবার। তারপর দু’হাতে মুখ ঢেকে, প্রায় আর্তনাদের মতন, বলে উঠলেন, “ওহ্ মাই গড, ওহ্ মাই গড!”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “যাক, তা হলে বুঝতে পেরেছেন?”

মুখ থেকে হাত না-সরিয়েই ডোরা বললেন, “ওহ্ ইয়েস, ওহ্ ইয়েস, শি হ্যাড অলরেডি বিন ক্যারিয়িং ফর কোয়াইট আ ফিউ মান্‌স!”

“তো আপনি তা হলে বুঝতেই পেরেছেন যে, সেইজন্যেও ডঃ সেনগুপ্তকে আপনার বাবা বলে মেনে নিতে পারছি না।” বলে একটুক্ষণের জন্যে চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “বাট ডঃ সেনগুপ্ত ওয়জ আ ডিসেন্ট ম্যান। ডাক্তার মানুষ তো, তাই আগে কিছু বুঝতে না-পারলেও বিয়ের রাত্তিরেই নিশ্চয় ব্যাপারটা তিনি ধরতে পেরেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁকে ধোঁকা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা নিয়ে তিনি হইচই করেননি, বার্থ রেজিস্ট্রেশনের খাতায় আপনার বাবা হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন নিজের নাম, এমনকী—আমি যদ্দুর বুঝতে পারি—ঘুণাক্ষরেও আপনার মা’কে তিনি কখনও বলেননি যে, কোনও কিছুই তাঁর জানতে বাকি নেই।”

আবার একটুক্ষণের জন্যে চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “না, মিসেস ফুকন, আপনি ডঃ বিশ্বনাথ সেনগুপ্তের মেয়ে নন। কিন্তু এই যে সেটা প্রকাশ পেল, এই যে জানা গেল ইয়োর মাদার হ্যাড আলরেডি বিন ক্যারিয়িং, এর একটা ভাল দিকও আছে। এতে আর কিছু না হোক, এটা প্রমাণিত হল যে, আপনি একটা অবৈধ বিবাহের সন্তান নন, ইউ আর দ্য চাইল্ড অভ আ পার্ফেক্‌টলি লফুল ম্যারেজ।”

এতক্ষণ আমি একটাও কথা বলিনি, কিন্তু এবারে আর না-বলে পারলুম না। বললুম, “ধোঁকাটা যখন ধরেই ফেলেছিলেন, ডঃ সেনগুপ্ত তখন তক্ষুনি দেশে না-ফিরে দু-আড়াই বছর অপেক্ষা করতে গেলেন কেন?”

“আমার ধারণা, তারও দুটো কারণ।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “প্রথমত, ওই যা আগেই বলেছি, হি ওয়জ আ ডিসেন্ট ম্যান। তক্ষুনি হাত ধুয়ে ফেললে তাঁর স্ত্রী যে ঘোর বিপদে পড়ে যাবেন, তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু তা তিনি চাননি। দ্বিতীয়ত, মেয়েটার উপরে বোধহয় একটু মায়াও পড়ে গেল তাঁর। হয়তো ভেবেছিলেন, ওই দুধের বাচ্চা তো কোনও দোষ করেনি, তা হলে অন্যের কাজের ফল তাকে কেন ভুগতে হবে? ডঃ কেলি যে তাঁকে একজন বিবেকবান মানুষ বলেছিলেন, সে তো অকারণে বলেননি। আবার এটাও ঠিক যে, ভিতরে-ভিতরে তিনি ভেঙে পড়েছিলেন। যাকে তিনি বিয়ে করেছেন, আসলে সে যে অন্যের প্রেমিকা কিংবা স্ত্রী, এটা বুঝে যাবার পরে আর তার সঙ্গে তিনি রাত কাটাননি। দিনের বেলায় খানিকটা সময় নেলসন স্কোয়ারের ফ্ল্যাটে কাটাতেন বটে, কিন্তু আমাদের লন্ডনের এজেন্ট জানাচ্ছে যে, রাত্তিরে সেখানে থাকতেন না। সেন্ট টমাস হসপিটালে তো তাঁর একটা সিঙ্গল্-বেডেড রুম ছিলই, রাত্তিরে সেখানে ফিরে যেতেন। কিন্তু ওই যে বললুম, ভিতরে-ভিতরে ভেঙে যাচ্ছিলেন, ক্ষয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত তিনি ফিরে আসতে বাধ্য হন।” ডোরা বললেন, “মিঃ ভাদুড়ি, আপনি বলেছেন, আমি যে তাঁর সন্তান নই, ডঃ সেনগুপ্ত তা জেনে গিয়েছিলেন। কিন্তু সত্যিই কি জানতে পেরেছিলেন তিনি?”

“জানতে যে পেরেছিলেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু আপনাকে তিনি ভোলেননি।”

‘এটা কী করে জানলেন?”

“জানলুম তাঁর উইলের বয়ান শুনে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “সেখানে তিনি আপনাকে তাঁর কন্যা বলে উল্লেখ করেননি, আপনার নাম করে লিখেছেন ‘হুম আই হ্যাভ অলওয়েজ লুক্‌ক্ড আফটার অ্যাজ মাই ডটার।” অর্থাৎ কন্যা নয়, তবে কন্যাসমা। মেয়ে নয়, তবে মেয়ের মতোই বটে।”

“তা-ই?”

“হ্যাঁ, মিসেস ফুকন,” ভাদুড়িমশাই মৃদু হেসে বললেন, “তাঁর সম্পত্তির অর্ধেক অর্থাৎ ষোলো লাখ টাকা তিনি আপনাকে দিয়ে গেছেন, আর বাকি অর্ধেক কলকাতার এক শিশু-হাসপাতালে। কিন্তু মুশকিল হয়েছে এই যে, তাঁর অ্যাটর্নি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। আর পারবেনই বা কী করে, ডঃ সেনগুপ্ত তো আপনাদের সেই নেলসন স্কোয়ারের পুরনো ঠিকানাটা তাঁকে দিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে তো আর এখন আপনাদের পাওয়া সম্ভব নয়। তা আপনি যদি অনুমতি করেন তো কলকাতায় ফিরে ডঃ সেনগুপ্তর অ্যাটর্নি বিমলচন্দ্র বাঁড়ুজ্যের সঙ্গে দেখা করে আপনার এখানকার ঠিকানাটা তাঁকে আমি জানিয়ে দিতে পারি। তবে আপনি নিজে তাঁর সঙ্গে কথা বললেই ভাল হয়।”

ডোরা ম্লান হেসে বললেন, “ঠিক আছে, আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলব। কিন্তু আমি টাকার কথা ভাবছি না, মিঃ ভাদুড়ি। সম্ভবত ওই টাকাটার খুবই সামান্য একটা অংশ আমি নেব, তাও অ্যাজ আ মার্ক অভ মাই সিনসিয়ারেস্ট ফিলিংস ফর দ্য ম্যান হুম আই নিউ অ্যাজ মাই ড্যাড, না-নিলে তাঁর ইচ্ছার অসম্মান হয় বলেই নেব, তারপর বাদবাকি অংশ ওই হাসপাতালেই দিয়ে দেব আমি। কিন্তু আমি তো এখন সে-সব কথা ভাবছি না। আমি ভাবছি অন্য একটা কথা। যাঁর উপরে রাগ করে, যাঁর উপরে অভিমান করে, জ্বলেপুড়ে আমি এই বিয়াল্লিশটা বছর কাটিয়ে দিলুম, এখন তো দেখছি সত্যি‍ই তিনি আমাকে ভুলে যাননি।”

“ভুলবেন কেন,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তাঁকে আমি দেখিনি। কিন্তু লন্ডন আর কলকাতার সোর্স থেকে যেটুকু যা খবর পেয়েছি তাঁর সম্পর্কে, তাতেই বুঝতে পেরেছি যে, শুধু একজন বড়-মাপের ডাক্তার নন, হি ওয়জ অ্যান এতস্ট্রিমলি কমপ্যাশনেট ম্যান। ওঁরা কাউকে ভুলে যান না।”

সদানন্দবাবু এতক্ষণ নিঃশব্দে শুধুই অন্যদের কথা শুনছিলেন। আর শুনতে-শুনতেই একবার যদি ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকাচ্ছিলেন তো পরক্ষণেই ডোরার দিকে। এবারে তিনি বললেন, “তার মানে কি আমাদের কাজ এখানেই শেষ হয়ে গেল?”

উত্তরটা এল ডোরার কাছ থেকে। “কাজ শেষ হবে কেন? ডঃ সেনগুপ্ত যে আমার বাবা নন, তবে হ্যাঁ, বাবার চেয়ে কিছু কমও নন, তা তো বোঝা গেল। কিন্তু বিয়ে করেও কাকে ছেড়ে এসেছিলেন আমার মা, তাও তো আমার জানা চাই । মিঃ ভাদুড়ি, সত্যিই যিনি আমার বাবা, তাঁকে আপনি খুঁজে দিন।”

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “সে তো খুঁজে দিতেই হবে। কিন্তু তার আগে বরং সুশান্তকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি। সুশান্ত, তুমি ভাল করে নিজের মুখখানা কখনও দেখেছ?”

“সে তো রোজই আমরা দেকি।” সুশান্তর বদলে উত্তরটা এল সদানন্দবাবুর কাছ থেকে। “দাড়ি কামাবার সময় তো নিত্যি একবার দেকতেই হয়। তবে দেকে যে খুব আহ্লাদ হয়, তা অবিশ্যি বলতে পারি না।”

আমি বললুম, “দেখবার আছেই বা কী, নিজের-নিজের মুখ তো আমরা হাতের পাতার মতো চিনি।”

“কিন্তু কথাটা আমি আপনাদের নয়, সুশান্তকে জিজ্ঞেস করেছিলুম।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কী হল সুশান্ত, চুপ করে আছ কেন?”

অনেকক্ষণ ধরেই যে সুশান্ত চৌধুরি কোনও কথা বলছেন না, একেবারে ঝিম মেরে মুখ নিচু করে বসে আছেন, এই প্রথম সেটা খেয়াল করলুম আমি। বললুম, “সত্যিই তো, আপনি কিছু বলছেন না কেন?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ঠিক আছে সুশান্ত, তোমাকে কিছু বলতে হবে না। উত্তরটা বরং আমিই দিচ্ছি। আসলে, হাতের পাতার মতো চেনাটা একটা কথার কথা মাত্র, ওটাও খুব ভাল করে কেউই চিনি না আমরা। বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? ঠিক আছে, কিরণবাবুই যখন কথাটা বলেছেন, তখন ওঁকেই যদি আমি জিজ্ঞেস করি যে, ওঁর দু’হাতের পাতায় ক’টা তিল আছে, আর তার মধ্যে ক’টাই বা ওঁর ডান-হাতে আর ক’টাই বা বাঁ-হাতে, কিংবা ওর দু’হাতের তর্জনী আর অনামিকার দৈর্ঘ্য সমান কি না, তা হলে উনি তার নির্ভুল উত্তর দিতে পারবেন না। সত্যি বলতে কী, নিজের হাতের পাতার চেয়েও নিজের মুখকে আমরা কম চিনি। সুশান্তর তো নিজের মুখ সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই। সেই তুলনায় বরং আমার ধারণা অনেক স্পষ্ট। না না, নিজের মুখ নয়, কথাটা আমি বলছি ওরই মুখ সম্পর্কে। সেই যে আমরা দু’বছর একই কলেজে পড়েছিলুম, তখন থেকেই আমার মনে আছে যে, হাসলে ওর গালে টোল পড়ে। আর হ্যাঁ, ওর চিবুকের পাশে ছোট্ট একটা জড়ুল আছে। তা গোটা মুখটা দাড়ির জঙ্গলে ঢাকা ছিল বলে অ্যাদ্দিন কেউ বুঝতে পারছিল না যে, হাসলে সত্যিই ওর গালে টোল পড়ে কি না, আর সত্যিই ওই দাড়ির তলায় একটা জড়ুল ঢাকা পড়ে গেছে কি না।”

এতক্ষণে সুশান্ত হেসে উঠলেন। দেখে সদানন্দবাবু বললেন, “বাঃ, বাঃ, এই বয়েসেও গালে তো দিব্যি টোল পড়েচে দেকচি। আর হ্যাঁ, সত্যিই তো একটা জড়ুলও দেকচি ওঁর চিবুকের পাশে।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “দেখবেনই তো, সুশান্ত আজ দাড়ি কামিয়েছে যে!” বলতে-বলতেই ডোরার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, “হাসলে কিন্তু আপনার গালেও টোল পড়ে, মিসেস ফুকন। তার চেয়েও বড় কথা, কালো রং মাখিয়ে যেটাকে আপনি একটা বিউটি-স্পট করে তুলেছেন, আমার সন্দেহ আপনার চিবুকের পাশে সেটা আসলে ছোট একটা জড়ুল ছাড়া আর কিছুই নয়, যেটা আপনি আপনার বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন।…কী, তাও আপনার বাবাকে আপনি চিনতে পারছেন না?”

কথা বলবেন কী, যেমন ডোরা তেমন সুশান্ত চৌধুরি, বিস্ফারিত চোখে পরস্পরের দিকে তাঁরা তাকিয়ে আছেন, কারও মুখেই কথা সরছে না। ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “তাও যদি চিনতে কষ্ট হয় তো এটা দেখুন।” বলে পকেট থেকে সুশান্তর সেই আংটিটা বার করে ডোরার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “আপনার মায়ের কাছ থেকে যে আংটি পেয়েছেন, এটা তার জোড়। দেখুন, এটাতেও সেই এস. এস. অক্ষর দুটো খোদাই করা রয়েছে। কিন্তু ওটা সিলভিয়া সেনগুপ্তের আদ্যক্ষর নয়, সিলভিয়া আর সুশান্তর নামের আদ্যক্ষর। কলকাতার একই জুয়েলারের দোকান থেকে একই ডিজাইনে এই আংটি দুটো বানানো হয়েছে। একটা সুশান্ত তার বউকে অর্থাৎ আপনার মা’কে দিয়েছিল, আর একটা নিজে পরত। আংটি দুটো ওদের ওয়েডিং রিং। নিন, নিন, ভাল করে দেখে নিন।”

কে দেখবেন, আর কী করেই বা দেখবেন? যেমন মেয়ে, তেমনি বাবা, দুজনেরই চোখ তখন জলে ভেসে যাচ্ছে।

রচনাকাল : ১৪০৫