২
কাজের মেয়েটি যে-ভদ্রলোককে এনে ড্রয়িং রুমে পৌঁছে দিয়ে গেল, তাঁকে দেখেই ভাদুড়িমশাই সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠেছিলেন, পরমুহূর্তে সামনে দু’পা এগিয়ে বললেন, “আরে, কেদার-সাহেব! বোসো, বোসো!… তা কোথায় আছ এখন? কী করছ?”
ভদ্রলোকের মাথা-জোড়া বিশাল টাক, গায়ের রং টকটকে ফর্সা, পরনে বাদামি রঙের কর্ডরয়ের পাতলুন আর সুতি কাপড়ের হাফ-হাতা সাদা শার্ট। শার্টের কাপড় পাতলা বলে বোঝা যায় যে, তার তলায় অন্তর্বাস হিসেবে একটি সুতি জালি স্যান্ডো গেঞ্জি পরেছেন। পায়ে বাদামি রঙের চকচকে-পালিশের শু। চোখে ওয়াইন-কালারের সরু ফ্রেমের চশমা। বয়েস মনে হল আমাদেরই মতো। গায়ে মেদ জমেনি। টান হয়ে যে-ভাবে এসে ঘরে ঢুকলেন, তাতে আন্দাজ করলুম, শরীরটাকে বিশেষ বেজুত হতে দেননি। একটু যে শৌখিন প্রকৃতির মানুষ, এক নজর দেখে সেটাও বুঝে নেওয়া যায়।
ভদ্রলোক ইতিমধ্যে আসন গ্রহণ করেছিলেন। বললেন, “কোথায় আর থাকব, এইট্টিফোরে যে হিমাচল ডিস্টিলারির চাকরি থেকে রিটায়ার করে ধুবুড়িতে ফিরে গিয়েছিলাম, তা তুমি জানো। তো সেই থেকে সেখানেই আছি। কলকাতায় এসেছিলাম আমার এক ভাগ্নির মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে। সে-সব মিটে গেছে। এখন তোমার কাছে এসেছি একটা জরুরি ব্যাপারে পরামর্শ করতে। …কিন্তু অসময়ে এসে পড়িনি তো?”
“আরে না না, অত ভদ্রতা করার দরকার নেই,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ইউ আর অলওয়জ ওয়েলকাম। কিন্তু ব্যাপারটা কী?”
ভদ্রলোক একটু সংকুচিতভাবে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বলছি, চারুদা। কিন্তু এঁদের সঙ্গে তো পরিচয় করিয়ে দিলে না?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আরে তা-ই তো! এটা তো খেয়ালই করিনি!” তারপর একে-একে আমাদের পরিচয় দিয়ে বললেন, “আর এ হচ্ছে কেদারেশ্বর ফুকন, কলেজে আমার এক বছরের জুনিয়ার। তা আমরা মিশনারি কলেজে পড়তুম তো, চল্লিশের দশকে সেখানে অনেক অধ্যাপকই ছিলেন খাঁটি ইংরেজ। তাঁদের সঙ্গে কথা বলার দরকার তো রোজই হত, তখন আমরা মহা ফ্যাসাদে পড়ে যেতুম। যা বলতে চাই, বাংলায় সেটা ভাল করে ভেবে নিয়ে, নাউন ভার্ব প্রিপোজিশান ইত্যাদি ব্যাপারগুলোকে ঠিক-ঠিক জায়গায় বসিয়ে তারপর গোটা সেনটেন্সটাকে মনে-মনে ইংরিজিতে ট্রানস্লেট করে তবেই তাঁদের কাছে মুখ খোলবার সাহস হত। আর কলেজের করিডর দিয়ে আসতে-যেতে দেখতে পেতুম যে, আমাদের যখন এই অবস্থা, তখন আমাদের এক ক্লাস নীচের এই কেদার-ছোকরা তাঁদের সঙ্গে অনর্গল ইংরিজিতে কথা বলছে। কলেজে তাই ওর নামই হয়ে গেসল কেদার-সাব।”
ফুকন পদবি থেকে বুঝতে পেরেছিলুম, ভদ্রলোক বাঙালি নন। তাই বললুম, “শুধু ইংরিজি কেন, ইনি তো দেখচি বাংলাটাও গড়গড়িয়ে বলছেন।
“তা কেন বলবে না,” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “ওর মা তো বাঙালি, আমাদের নর্থ ক্যালকাটার মেয়ে। তা ছাড়া কেদারের বাবা অসমের মানুষ হলে কী হয়, ব্যাবসার সূত্রে তিনিও তো সারা জীবন এই কলকাতাতেই কাটিয়ে গেছেন।”
“আরে, বাবা, আই অ্যাম অ্যাজ গুড আ বেঙ্গলি অ্যাজ ইউ আর।” কেদারেশ্বর বললেন, “কলকাতার ইস্কুল-কলেজে পড়েছি, বন্ধুবান্ধবদের সবাই না হোক নাইন্টি পার্সেন্ট ছিল এখানকার বাঙালি-বাড়ির ছেলে, তা হলে আমি বাংলা বলতে পারব না কেন?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “তবেই বুঝুন।” তারপর কেদারেশ্বরের দিকে তাকিয়ে: “কিন্তু তোমার খবরাখবর তো কিছুই শোনা হল না। যে-বার সিমলায় যাই, তোমার গিন্নির সঙ্গে দেখা হয়নি। তিনি কেমন আছেন? তোমার ছেলের খবরই বা কী? সে এখন কোথায়? সে তো শুনেছিলুম নিউ অর্লিয়েন্সে কাজ করে। এখনও সেখানেই আছে?”
“সে-সব কথা ডিটেলসে পরে হবে। আপাতত জেনে রাখো যে, তোমার বউমা ভাল আছেন। ছেলেও ভালই আছে। তবে কিনা মেমসায়েব বিয়ে করেছে তো, তাই দেশে ফিরবে এমন আশা করি না।”
একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন কেদারেশ্বর। তারপর বললেন, “আমি আজ গুয়াহাটি যাচ্ছি! সেখান থেকে কাল সকালে বাই রোড ধুবুড়ি যাব। তার আগে হঠাৎ তোমার কাছে ছুটে আসার দরকার হল কেন, সেটাই বরং বলি। কিন্তু তোমাদের দুপুরের খাওয়া হয়ে গিয়েছে তো? নাকি হঠাৎ আমি এসে পড়ে তার ব্যাঘাত ঘটালাম?”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “তোমার দুপুরের খাওয়া হয়েছে?”
“ভাগ্নির বাড়িতে উঠেছিলাম তো, সেখান থেকে রওনা করিয়ে দেওয়ার আগে সে আমাকে না-খাইয়ে ছাড়েনি। তো আমি বলি কী, তোমরা খেয়ে নাও, আমি বরং একটু অপেক্ষা করি।”
“তোমার ফ্লাইট কখন?”
“গুয়াহাটির ফ্লাইট তো নর্মালি সকালের দিকে থাকে। তবে আজ বোধহয় বিস্তর প্যাসেঞ্জার, তাই বিকেলেও একটা বাড়তি ফ্লাইটের ব্যবস্থা হয়েছে। সেটার ডিপার্চার টাইম সিক্সটিন আওয়ার্স, অর্থাৎ বিকেল চারটে। সাড়ে তিনটে নাগাদ চেক ইন করলেই চলবে।”
কেদারেশ্বর কব্জি ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখে বললেন, “এখন পৌনে একটা বাজে। আমাকে যে-কোনও একটা ম্যাগাজিন দাও, আমি একটু উলটে-পালটে দেখি, সেই ফাঁকে তোমরা খেয়ে নাও। খাওয়া শেষ হতে-হতে আশা করি দেড়টা পেরিয়ে যাবে না। তখন থেকে তিনটে পর্যন্ত কথা বলার সময় পাচ্ছি। তিনটের সময় একটা ট্যাক্সি নিয়ে এয়ারপোর্টে চলে যাব। এখান থেকে এয়ারপোর্টে পৌঁছতে কি আর আধ ঘন্টার বেশি সময় লাগবে?”
ভাদুড়িমশাই উঠে পড়ে বললেন, “তাও লাগবে না। তবে ট্যাক্সি নেবার দরকার নেই, আমার ভাগ্নেই তোমাকে এয়ারপোর্টে ছেড়ে দিয়ে আসবে। …নাও, তুমি বসে-বসে এ-হপ্তার ‘আউটলুক’টা দ্যোখো।”
ভাদুড়িমশাইকে উঠতে দেখে আমরাও উঠে পড়েছিলুম। সবাই মিলে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসে পড়া গেল। ভাদুড়িমশাই ডালের বাটি থেকে পাতে খানিকটা ডাল ঢেলে নিয়ে বললেন, “হ্যাঁ রে মালতী, বাড়িতে মিষ্টি-ফিষ্টি আছে?”
মালতী বলল, “বাঃ, তুমিই তো আজ সকালে বাজার করে ফেরার পথে একগাদা মিষ্টি নিয়ে এসেছ।”
“ঠিক আছে, ড্রয়িংরুমে তা হলে মিষ্টি আর কফি পাঠিয়ে দে। ভদ্রলোক একা বসে আছেন।”
“তা পাঠিয়ে দিচ্ছি,” প্রত্যেকের থালার পাশে মাছের বাটি সাজিয়ে দিতে-দিতে মালতী বলল, “কিন্তু ভদ্রলোকটি কে?”
কথাটার সরাসরি উত্তর না দিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “বছর পনেরো আগে হপ্তা খানেকের ছুটি কাটাতে তোদের নিয়ে সিমলায় গিয়েছিলুম, মনে পড়ে?”
“তা কেন পড়বে না? গোটা হপ্তাটাই তো আমি ঠান্ডা লেগে ভুগলুম বলে একটা দিনের জন্যেও হোটেল ছেড়ে বেরোতে পারিনি। না পারলুম শহরটা একটু ঘুরে দেখতে, না কিছু কেনাকাটা করতে। ছুটিটা একেবারে মাঠে মারা গেল।”
“হোটেল থেকে বেরোতে পারিসনি বলেই চিনিস না।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ও হল কেদার ফুকন, আমাদের কলেজে পড়ত, অনেক বছর যোগাযোগ ছিল না, তারপর সিমলা থেকে চলে আসার আগের দিন তোর জন্যে ওষুধ কিনতে বেরিয়ে রাস্তায় ওর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। রাস্তা থেকে ও ওর বাড়িতেও টেনে নিয়ে গিয়েছিল, ঘন্টাখানেক সেখানে ছিলুমও, কিন্তু তারপরে আর কোনও যোগাযোগ নেই। আজ যে কেন এসেছে তাও জানি না।”
সদানন্দবাবু বললেন, “আমার মশাই একটা কতা মনে হচ্চে।”
“কী মনে হচ্ছে?”
“মনে হচ্ছে এবারে আমাদের বোধহয় গৌহাটি যেতে হবে… ওই মানে যে-জায়গাটাকে এখন গুয়াহাটি বলা হয় আর কি!”
শুনে হো-হো করে হেসে উঠলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর, চোখ একটু ছোট করে, সদানন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “বেড়াবার শখ হয়েছে বুঝি? তা তার জন্যে গুয়াহাটি যেতে হবে কেন? চলুন না, দিন তিনেকের জন্যে পুরী থেকে ঘুরে আসি।”
খাবার টেবিলে এ ছাড়া আর বিশেষ কথাবার্তা হল না। চটপট খাওয়া চুকিয়ে আমরা দেড়টা বাজার খানিকক্ষণ আগেই আবার বসবার ঘরে এসে ঢুকলুম। কেদারেশ্বর তাঁর কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে পেয়ালা-পিরিচ হাত থেকে সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রেখে বললেন, “আমার জন্যে তোমাদের ছুটির দিনের খাওয়াটা মাটি হল, চারুদা! একস্ট্রিমলি সরি ফর দ্যাট। কিন্তু কী করব বলো, আজই এই ফ্লাইটে আমাকে গুয়াহাটি ফিরতে হবে।”
পকেট থেকে ছোট্ট একটা কৌটো বার করে তার থেকে দু-তিনটি এলাচদানা খুঁটে নিয়ে মুখে ফেলে দিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “কেন, এত তাড়া কীসের? আর দু-একটা দিন তোমার এই স্মৃতির শহরে থেকে গেলে হত না? যেমন ইস্কুল তেমনি তোমার কলেজ-জীবনও তো এইখানেই কেটেছে।”
“তা কেটেছে ঠিকই, কিন্তু স্মৃতির সঙ্গে আর এই কলকাতাকে মেলাতে পারছি কোথায়।” সদানন্দবাবু এতক্ষণে একটা জুতসই প্রসঙ্গ পেয়ে গিয়ে বললেন, “আরে ছ্যা ছ্যা, কলকাতা কি আর সেই কলকাতা আচে মশাই! তাই তো তখন বলছিলুম যে, এমনটা যে হবে, তা তো ভাবতেও পারিনি! …নষ্ট হয়ে গেচে, একদম নষ্ট হয়ে গেচে! সায়েবরা কত সুন্দর একটা শহর বানিয়ে দিয়ে গেসল, আর ইন্ডিপেনডেন্স পাবার পরে এরা তাকে একেবারে নরক বানিয়ে ছাড়ল! আরে ছ্যাছ্যা!”
সদানন্দবাবু হঠাৎ ঝাঁঝিয়ে ওঠায় কেদারেশ্বর সম্ভবত একটু ভড়কে গিয়েছিলেন। ফ্যালফ্যাল করে বেশ খানিকক্ষণ তাঁর দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর নিজের হতভম্ব-ভাবটা একটু কাটিয়ে নিয়ে তিনি বললেন, “না না, আমি কিন্তু কলকাতাকে নিন্দে করার জন্যে ওটা বলিনি। কিন্তু সে-কথা থাক। যে-জন্যে এইভাবে ছুটে এসেছি, সেই কথাই বরং বলি।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “কী হয়েছে খুলে বলো। তোমার কোনও বিপদ ঘটেছে?”
“তা যে ঘটেনি, তা নয়, তবে কিনা বিপদটা আমার নয়, আমার এক বন্ধুর। কিন্তু সেটা যে কী ধরনের বিপদ, তাও ভাল করে বুঝে উঠতে পারছি না।”
“যে-ভাবে তুমি কথা বলছ, তাতে তো আমিও কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। এভাবে বললে হবে না, কেদার। সাফ-সাফ বলো কী ঘটেছে, হোয়াট এগজ্যাক্টলি হ্যাজ হ্যাপেনড। তার থেকে যা বুঝতে হয়, সে আমি বুঝে নেব অখন।”
“ঠিক আছে।” কেদারেশ্বর বললেন, “চারুদা, সুশান্ত বলে কাউকে তোমার মনে পড়ে?”
“কে সুশান্ত? সুশান্ত দত্তরায়?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমাদের সঙ্গে যে পড়ত, এখন একজন নামজাদা ফিজিয়ো-থেরাপিস্ট, থিয়েটার রোডে চেম্বার, তার কথা বলছ?”
সদানন্দবাবু বললেন, “আমার ওয়াইফকে তো উনিই এখন দেকচেন। কী বলব মশাই, বাতে প্রায় পঙ্গু হবার জোগাড় হয়েছিল, তা এখন ওঁর চিকিচ্ছেয় তবু যা হোক খাট থেকে নেমে একটু নড়তে-চড়তে পারচেন। তা উনি আপনার ক্লাস-ফ্রেন্ড ছিলেন? গুরুদেব লোক মশাই!”
কেদারেশ্বর বললেন, “না, না, চারুদা, আমি তাঁর কথা বলছি না। তোমাদের সঙ্গে যিনি পড়তেন, সেই সুশান্তদাকে আমার ভালই মনে আছে। তিনি যে এখন একজন মস্ত ডাক্তার, তাও জানি। কিন্তু আমি অন্য সুশান্তর কথা বলছি। এ হল সুশান্ত চৌধুরি, তোমাদের এক বছরের জুনিয়ার, আমাদের সঙ্গে পড়ত, ইস্ট বেঙ্গলের কমলদিঘির জমিদার-বাড়ির ছেলে, বিরাট বড়লোক, কলকাতার বাড়ি থেকে গাড়ি হাঁকিয়ে কলেজে আসত, মনে নেই?”
ভাদুড়িমশাই মৃদু-মৃদু হাসছিলেন। বললেন, “বিলক্ষণ মনে আছে। কোঁকড়া চুল, চিবুকের পাশে একটা জড়ুল ছিল, হাসলে গালে টোল পড়ত। তা ছাড়া শিস দিয়ে সেকালের সব হিট বাংলা গানের টিউনও ধরতে পারত চমৎকার। কিন্তু তাকে তুমি সুশান্ত বলছ কেন? দুই সুশান্তর মধ্যে একটা ফারাক রাখার জন্যে তোমাদের ক্লাসের সুশান্তকে তো গোটা কলেজ অশান্ত চৌধুরি বলে ডাকত। ওই নামটাই পাকা হয়ে যায় আমাদের ভাইস-প্রিন্সিপাল বোল্টন সায়েব কলেজের সামনের রাস্তায় ওর গাড়ির ধাক্কা লেগে পড়ে যাবার পর।”
এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “ভাগ্যিস বোল্টন সায়েব চটপট উঠে দাঁড়িয়ে, গায়ের ধুলো ঝেড়ে বললেন যে, দোষটা তাঁরই, তিনিই একটু অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিলেন, সুশান্ত হর্ন দেওয়া সত্ত্বেও শুনতে পাননি, তাই সুশান্ত সে-যাত্রা বেঁচে যায়, নয়তো রাস্তার লোকেরা তাকে ছাড়ত না, বেধড়ক পেটাত। তবে তার পরেও যে তার দৌরাত্ম্য কিছু কমেছিল, তা নয়।”
“তা যা বলেছ!” কেদারেশ্বর হেসে বললেন, “কলেজের ক্রিকেট-গ্রাউন্ড থেকে টিপ করে সিক্সার হাঁকিয়ে দিনের পর দিন ওয়েবার ল্যাবোরেটরির জানলার কাচ ভাঙা কি সাইকেল চালিয়ে যারা কলেজে আসত তাদের টায়ারের হাওয়া বার করে দেওয়া, এ-সব তো তার পরেও ও সমানে চালিয়ে গেছে!”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আবার একই সঙ্গে এও শুনেছি যে, ছাত্র হিসেবে দারুণ তুখোড় ছিল। সেই সঙ্গে যেমন ভাল গান গাইত তেমনি আবার নানান রকমের মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টেও নাকি দখল নেহাত কম ছিল না।”
“ঠিকই শুনেছ, চারুদা। তবে গানের চর্চা অনেকদিন আগেই ছেড়ে দেয়। ইদানীং স্রেফ একটা বাজনা নিয়ে পড়ে ছিল।”
সোফা থেকে খানিকটা ঝুঁকে পড়ে, গলার স্বর নামিয়ে, যেন খুব গোপন কোনও খবর জানতে চাইছেন এই রকমের ভঙ্গিতে সদানন্দবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “ব্যায়লা?”
কেদারেশ্বর বললেন, “না, ভায়োলিন না, পিয়ানো।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “তো ওই যে বিপদের কথা বলছিলে, সেটা কি এই সুশান্তেরই নাকি?”
“হ্যাঁ। তবে কিনা বিপদটা যে. ঠিক কী ধরনের, এখনও তা আমি জানি না।”
হঠাৎই সরু হয়ে এল ভাদুড়িমশাইয়ের চোখ। বললেন, “কিন্তু আদৌ যে তার বিপদ ঘটেছে, এটা কি তুমি হালে… মানে কলকাতায় এসে জানলে?”
“না, কলকাতায় নয়, ধুবুড়ি থেকে কলকাতায় রওনা হবার আগেই জেনেছিলাম। …
ঠিক যে জেনেছিলাম, তাও নয়, আঁচ করেছিলাম।”
“তার মানে সুশান্তের সঙ্গে কিংবা তার পরিবারের লোকজনদের সঙ্গে তোমার যোগাযোগ ছিল, কেমন?”
“পরিবারের লোকজন বলতে তো এখন সুশান্তের কেউ নেই, চারুদা। আমার যা-কিছু যোগাযোগ, তা শুধু সুশান্তেরই সঙ্গে।”
এই পর্যন্ত বলে এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন কেদারেশ্বর। তারপর বললেন, “আসলে এই ব্যাপারটা তোমাকে যদি ঠিকমতো বুঝতে হয়, চারুদা, তা হলে আমাকে বেশ-খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে সব বলতে হবে। কিন্তু বিস্তারিতভাবে তা বলার মতো সময় তো আজ নেই, তাই এর ব্যাকগ্রাউন্ডের যেটুকু তোমার না-জানলেই নয়, শুধু সেইটুকুই বলব। তাও সংক্ষেপে বলতে হবে।”
“বেশ তো,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “শুধু জিস্টটুকুই দাও। দেখি তার থেকে কিছু বুঝি কি না।”
কেদারেশ্বর বললেন, “দ্যাখো, চারুদা, যারা স্কুল কিংবা কলেজ-জীবনের বন্ধু, স্কুল-কলেজের পড়া শেষ হয়ে যাবার পরে তাদের মধ্যে আর যোগাযোগ বিশেষ থাকে না। কিন্তু আমার আর সুশান্তর মধ্যে ছিল। সত্যি বলতে কী, ওর মতো উদার মানুষ আমি সারা জীবনে খুব কমই দেখেছি। কলেজে যখন পড়ত, তখন ওর দৌরাত্ম্যে সবাই কী রকম অস্থির হয়ে উঠেছিল, সে তো তুমি ভালই জানো, কিন্তু সেই সময়েই কত গরিব ছেলের টুইশান ফি থেকে শুরু করে পরীক্ষার ফি পর্যন্ত ও জুগিয়ে গেছে, তা কেউ জানে না। ওর যে টাকাপয়সার কোনও অভাব ছিল না, তা অবশ্য ঠিক, ওর বাবা-মা থাকতেন কমলদিঘিতে …ওই মানে যেখানে ওদের জমিদারি ছিল… আর সুশান্ত থাকত কলকাতায়। এলগিন রোডের সেই বাড়িতে ওর খরচা বাবদ মাস-মাস যে একটা মোটা অঙ্কের টাকা আসত, তা আমি জানি। কিন্তু টাকা থাকলেই সবাই কি আর অন্যদের এইভাবে সাহায্য করে? ও কিন্তু করত।”
আবার একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন কেদারেশ্বর। তারপর বললেন, “কিন্তু চিরকাল তো কারও সমান যায় না। ওরও যায়নি। সাতচল্লিশ সালে দেশ স্বাধীন হল। যা ছিল পুব-বাংলা, রাতারাতি তা হয়ে গেল ইস্ট-পাকিস্তান। জমিদারি বেদখল হল। সুশান্তর বাবা-মা কমলদিঘি থেকে কলকাতায় চলে আসতে বাধ্য হলেন। আসার সময়ে বলতে গেলে প্রায় কিছুই নিয়ে আসতে পারলেন না। এখানে আসার পরে আর খুব বেশি দিন তাঁরা বাঁচেননি। জীবনটাই তো ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল, সেই সঙ্গে বোধ হয় ভেঙে গিয়েছিল বাঁচবার ইচ্ছাও। বাবা আটচল্লিশ সালে মারা গেলেন। মা তার পরের বছর। সুশান্ত তাঁদের একমাত্র সান্তান। সে একেবারে একা হয়ে গেল। …আচ্ছা চারুদা, বোল্টন সায়েবের মেয়ে সিলভিয়ার কথাও তোমার মনে থাকতে পারে।”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আছে রে ভাই, তার কথাও মনে আছে। মা-মরা মেয়ে। লোরেটো হাউজে পড়ত। প্রফেসর বোল্টন তো কলেজ কম্পাউন্ডের মধ্যেই স্টাফ-কোয়ার্টার্সে থাকতেন। সিলভিয়া যে সেখান থেকে রোজ বিকেলে কলেজের ক্রিকেট গ্রাউন্ডে এসে নেট-প্র্যাকটিস্ দেখত, তাও ভুলিনি।”
এবারে কেদারেশ্বরও হাসলেন। বললেন, “আসত আসলে সুশান্তের টানে। কী জানো, ব্যাপারটা একেবারে ধাপে-ধাপে ঘটে গিয়েছিল। সেই সে মোটর-অ্যাকসিডেন্ট, তার থেকে অপরাধ-বোধ, তার ফলে বোল্টন-সায়েবের খবর নেবার জন্যে নিত্য তাঁর কোয়ার্টার্সে যাতায়াত, তার থেকে সিলভিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, প্রেম। অ্যাজ সিম্পল অ্যাজ দ্যাট। তবে দু’জনের কেউই তখনও বিয়ের কথা ভাবেনি। দে ওয়্যার জাস্ট গোয়িং স্টেডি, বাস।”
“তা বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হয়েছিল?”
“হয়েছিল, তবে সুশান্তর বাবা-মা বেঁচে থাকতে নয়।”
“কেন?”
“ফর আ ভেরি সিম্পল রিজন। সুশান্ত জানত যে, তার বাবা-মা অত্যন্ত গোঁড়া মানুষ, এ-বিয়ে তাঁরা মেনে নেবেন না।”
“বিয়েটা তা হলে তাঁদের মৃত্যুর পরে হয়েছিল?”
“হ্যাঁ, চারুদা।” কেদারেশ্বর বললেন, “সুশান্তর বাবা মারা যান আটচল্লিশ সালে। আর তার পরের বছরই মারা যান তাঁর মা। কিন্তু এসব কথা তো তোমাকে একটু আগেই বলেছি। এও বোধহয় বলেছি যে, সুশান্তর আত্মীয়-স্বজন কিংবা ভাইবোন বলতে কেউই ছিল না। ফলে বাবা-মা মারা যেতে সে একেবারে একা হয়ে যায়। মজা কী জানো, বিয়ের জন্যে যা-কিছু তাগাদা, এর আগে পর্যন্ত সেটা সিলভিয়াই দিয়ে যাচ্ছিল, আর সুশান্তই তার বাবা-মায়ের কথা ভেবে ক্রমাগত ঠেকিয়ে রাখছিল তাকে। কিন্তু বাবা-মা মারা যেতে ওই যে সে একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ল, তার চাপটাই বোধহয় সে সহ্য করতে পারেনি। ফলে এবারে সে নিজেই একদিন উপযাচক হয়ে প্রোফেসর বোল্টনকে গিয়ে জানায় যে, সিলভিয়াকে সে বিয়ে করতে চায়। তাঁর মেয়ের সঙ্গে সুশান্তর ঘনিষ্ঠতার কথা বোল্টন-সায়েব অনেক আগে থেকেই জানতেন, ফলে তাঁর অনুমতি পেতে কোনও অসুবিধা হল না, পঞ্চাশ সালেই বিয়েটা হয়ে গেল। বিয়েতে আমি উপস্থিত থাকতে পারিনি, কেননা চাকরি নিয়ে তার এক বছর আগেই আমি বাইরে চলে গেসলুম।”