১৯
সুশান্ত চেয়েছিলেন, দুপুরের খাওয়াটা আমরা তাঁর ওখানে সেরে নিই। বারবার বলেছিলেন যে,; যথেষ্ট বেলা হয়ে গেছে, এখন যদি আমরা না-খেয়ে বেরোই তো খুব কষ্ট হবে, আর তা ছাড়া গোবিন্দ তো বাজার থেকে ফিরেই এসেছে, চটপট আমাদের জন্যে দুটি ঝোলভাতের ব্যবস্থা করে দিতে তার একটুও অসুবিধে হবে না। কিন্তু বিস্তর অনুরোধ সত্ত্বেও ভাদুড়িমশাই রাজি হননি; হেসে বলেছিলেন, “না হে সুশান্ত, বসে গেলেই পুরনো দিনের গল্পগুজবে জমে যাব, ধুবড়িতে ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। তা ছাড়া, কেদারকে কিছু না-বলেই এখানে চলে এসেছি, সে নিশ্চয় খুব চিন্তা করছে, তাড়াতাড়ি ফিরে গিয়ে সব কথা তাকে বলা দরকার, জরুরি কিছু ব্যাপার নিয়ে তার সঙ্গে একটু আলোচনাও করতে হবে, আজ আর তাই বসছি না, কাজটা শেষ করে বরং তোমার এখানে এসে দু’দিন একটু আরাম করা যাবে, আজ উঠি।”
ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে-সঙ্গে আমি আর সদানন্দবাবুও উঠে পড়লুম। সুশান্ত আমাদের হাইওয়ে, পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। তাঁর পিছনে-পিছনে লেজ নাড়তে-নাড়তে জুজুও নীচের রাস্তা পর্যন্ত নেমে এল। গাড়িতে ওঠার আগে সুশান্তর কাঁধে হাত রেখে ভাদুড়িমশাই বললেন, “রাত্তিরে তোমাকে ফোন করব। ধুবড়িতে কাল তোমাকে কোথায় আসতে হবে, কেদারের বাড়িতে, না তার কাকার বাড়িতে, তখনই জানিয়ে দেব সেটা। …আর হ্যাঁ, দাড়ি কামাবার কথাটা নেহাত ঠাট্টা করে বলিনি। সত্যিই ওই জঙ্গল সাফ করে একেবারে ফিটফাট হয়ে এসো।”
কথা শেষ করে গাড়িতে ঢুকে স্টিয়ারিং হুইলে হাত রাখলেন ভাদুড়িমশাই। ইগনিশন কি ঘুরিয়ে স্টার্ট দিলেন। জেলার বর্ডার সেই সকালের মতোই ফাঁকা, সেখানে এই ফিরতি-পথেও কোনও চেকিং হল না। বর্ডার ছড়িয়ে মাইল দশেক এগিয়ে গাড়িটা একটা ধাবার সামনে রেখে আমরা দুপুরের খাওয়া সেরে নিলুম। ধুবড়ি শহরে ঢুকে কেদারেশ্বরের বাড়িতে পৌঁছতে-পৌঁছতে বিকেল চারটে।
বাড়ির সামনের বারান্দায় পায়চারি করছিলেন কেদারেশ্বর। আমাদের দেখে এগিয়ে এসে বললেন, “আরে আসুন, আসুন।” তারপর ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার চারুদা, আজ একেবারে ভোরবেলায় উঠে কোকরাঝাড়ে গিয়েছিলে কেন?”
“বলছি, সব বলছি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু তার আগে বলো, তুমি এখন কেমন আছ।” কেদারেশ্বর বললেন, “জ্বর আর আসেনি। কাসিটাও নেই বললেই হয়। …তো কুকুরটাকে কেমন দেখলে?”
“ওটা যে পাগলা কুকুর নয়, সে তো কালই বুঝেছিলুম, অনুপমাকে তা বলেওছি। সুতরাং নিশ্চিন্ত থাকো।”
বাগান পেরিয়ে বারান্দায় উঠে আমরা বসার ঘরে ঢুকে পড়েছিলুম। আমাদের গলা পেয়ে অনুপমাও ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। বললেন, “সকালে ডোরা ফোন করেছিল। তার কাছেই শুনলুম যে, আপনারা কোকরাঝাড়ে গেছেন। কিন্তু কেন যে গেছেন, তা বলতে পারল না। আজও আবার ওখানে কী কাজ ছিল?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “সব বলছি। কিন্তু তার আগে চায়ের ব্যবস্থা করুন তো, গলা একেবারে কাঠ হয়ে গেছে।”
অনুপমাদেবী নিজেও একটা মোড়া টেনে বসে পড়েছিলেন। সেখান থেকেই শিবুকে ডেকে চায়ের কথা বলে দিলেন।
সদানন্দবাবু বললেন, “ওহে শিবু, চা তো বানাবে, কিন্তু আমি আর কিরণবাবু যে লিকার খাই, দুধ-চিনি-ছাড়া স্রেফ হালকা লিকার, সেটা খ্যাল রেকো।”
শুনে, ঘাড় হেলিয়ে শিবু ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
কেদারেশ্বর বললেন, “আর দগ্ধে মেরো না। মনে হচ্ছে, বেশ-কিছু খবর দেবে তুমি।”
“তা দেব।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “প্রথম খবর, তেরো তারিখে যে কুকুরটি তোমাকে কামড়েছিল, সেটা আদৌ সুশান্তর কুকুর জুজু নয়। অন্য কুকুর। তবে নর্মাল হেলদি ডগ।”
“সে কী, ওটা ও-বাড়িতে এল কোত্থেকে?” কেদারেশ্বর বললেন, “দেখতে তো একেবারে একই রকম।”
“দেখতে একরকম বলেই তো ওটাকে ওখানে আনা হয়েছিল। যাতে সবাই ভাবে যে, ওটা জুজু। গোবিন্দও সেই কথাই সবাইকে বলেছে। আর পুলিশ থেকে শুরু করে ও-তল্লাটের সবাই তার ফলে ভেবেছে যে, সুশান্ত তার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার সময়ে কুকুরটিকে সঙ্গে নিয়ে যায়নি। ফলে সুশান্তকে খুঁজতে গিয়ে পুলিশের লোকেরা এমন লোকেরই সন্ধান করে বেরিয়েছে, যার সঙ্গে আর যা-ই থাক, কালো একটা ভোটানিজ ডগ নেই। আসলে কিন্তু জুজু সব সময়েই সুশান্তর সঙ্গে ছিল।”
“তা হলে তো বুঝতে হবে যে, গোবিন্দ সবই জানত।”
“সব জানত বলে আমার মনে হয় না। তবে কুকুর নিয়ে এই চালাকির খেলাটা সে যে তার মনিবের কথাতেই খেলেছে, তাতে সন্দেহ নেই। আর হ্যাঁ, গোবিন্দ হয়তো আন্দাজ করেছিল যে, তার মনিব চিরকালের জন্যে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়নি, আসলে এটা কোনও একটা দরকারে কিছু দিনের জন্যে গা-ঢাকা দেবার ব্যাপার, দরকার ফুরোলেই সে আবার ফিরে আসবে।”
“কিন্তু দরকারটা কী?”
“আমার মুখে সেটা না-ই শুনলে।” ভাদুড়িমশাই মৃদু হেসে বললেন, “আসলে এর মধ্যে কিছু ব্যক্তিগত ব্যাপার জড়িয়ে রয়েছে, তাই আমার পক্ষে এ নিয়ে কিছু বলা ঠিক হবে না। তবে সুশান্ত তো তোমাকে খুব ভালবাসে, সে-ই তোমাকে সব বলবে নিশ্চয়। এখন অন্য সব খবর শোনো। আসল জুজুকে ও-বাড়িতে আজ আমরা দেখেছি। দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে তবে এখানে আসছি।”
“তা-ই?” কেদারেশ্বর বললেন, “কিন্তু জুজুকে তুমি চিনলে কী করে। তাকে তো তুমি কখনও দ্যাখোইনি।”
“এটা খুব বোকার মতো কথা হল, কেদার।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “যেটা তোমাকে কামড়েছিল, সেই রাগী কুকুরটাকে তো কাল দেখেছি। আজকের কুকুরটার মেজাজ দেখলুম মোটেই তার মতো তিরিক্ষে নয়। তা ছাড়া দুটোরই যদিও একই সাইজ, আর দুটোই যদিও কুচকুচে কালো, তবু দুটোর মধ্যে সামান্য একটু পার্থক্যও আছে।”
“পার্থক্যটা কী?”
“রঙে। এটার গায়ের রং কালকেরটার মতন আপাদমস্তক কালো নয়, পিছনের পায়ের থাবা দুটো সাদা।”
“যাচ্চলে, এতদিন ধরে কুকুরটাকে দেখছি, অথচ এটা আমার নজর এড়িয়ে গেছে!”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “মেজাজ আর রঙের পার্থক্য দেখেই নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়েছিলুম যে, এটা অন্য কুকুর। তবে হ্যাঁ, ষোলো আনার উপরে আঠারো-আনা নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, যখন সুশান্ত নিজেই আমার সামনে কবুল করল যে, হ্যাঁ, এর নাম জুজুই বটে।”
শুনে, আমাদের চলতি বাংলায় যাকে বলে হাঁ হয়ে যাওয়া, কেদারেশ্বরকে দেখে মনে হল, তিনি ঠিক তা-ই হয়ে গেছেন। বিস্মিত অবশ্য অনুপমা দেবীও কিছু কম হননি। তবে হতভম্ব-ভাবটা তিনিই প্রথম কাটিয়ে উঠে বলতেন, “তা-ই?”
এতক্ষণে কথা বলতে পারলেন, কেদারেশ্বরও। বললেন, “তার মানে সুশান্ত ফিরে এসেছে? তুমি, ঠিক বলছ, চারুদা?”
শিবু চা নিয়ে এসেছিল। চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “হ্যাঁ, ফিরে এসেছে। শুধু যে ফিরেছে, তা নয়, কাল তাকে ধুবড়িতে আসতে বলেছি। ইচ্ছে করলে ফোন করে তুমি তার সঙ্গে কথাও বলতে পারো। তোমার শরীর ভাল নেই শুনে সে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে আছে।…না না, এখুনি ফোন কোরো না, আগে একটা জরুরি কথা সেরে নিই, তারপর কোরো।”
অনুপমা দেবী বললেন, “কী জরুরি কথা? সুশান্তবাবু ফিরে এসেছেন, এর চেয়ে জরুরি কথা আজ আর হয় নাকি?”
“হয়।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “জরুরি কথাটা এই যে, সুশান্তর খোঁজ করতেই তো এখানে আসতে বলা হয়েছিল আমাকে, তা সুশান্ত যখন ফিরে এসেছে, আমার কাজও তখন এইখানেই শেষ হয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু তা হয়নি। ইন ফ্যাক্ট তার চেয়ে অনেক বড় একটা কাজ এখনও বাকি পড়ে আছে।”
যেমন অনুপমা দেবীর, তেমনি কেদারেশ্বরেরও ভুরু কুঁচকে গিয়েছে। মনে হল, ভাদুড়িমশাইয়ের কথার কোনও তাৎপর্যই তাঁরা ধরতে পারছেন না। কেদারেশ্বর বললেন, “আর কী কাজ চারুদা?”
“ডোরা আর সুশান্তকে সামনাসামনি বসিয়ে আমি ওদের কয়েকটা কথা বলতে চাই। এমন কথা, যার উপরে ওদের জীবনের অনেক-কিছু নির্ভর করছে। এমন কথা, যা এমনকি তোমাদের দুজনের সামনেও বলা সম্ভব নয়। তোমার কাকা মহেশ্বর ফুকনের সামনেও না। আমি ওদের যা জানাতে চাইছি, পরে হয়তো…হয়তো কেন, নিশ্চয়ই…ওরা নিজেরাই তোমাদের তা জানিয়ে দেবে, কিন্তু আমার পক্ষে আর-কাউকে তা বলা উচিত হবে না। বললে সেটা ঘোর আনএথিক্যাল কাজ হয়ে যাবে।”
কেদারেশ্বর বললেন, “তার মানে এটা খুব ব্যক্তিগত ব্যাপার?”
“এক্সট্রিমলি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “যেখানে কথাবার্তা হবে, সেখানে মাত্র পাঁচজন থাকবে। আমরা তিনজন, আর ওরা দুজন। নাউ ক্যান ইউ সাজেস্ট সাম প্লেস, যেখানে আমরা এই পাঁচজন বসে কথা বলতে পারি?”
“সেটা তো কাকার বাড়িতে বসেই বলতে পারো।”
“কিন্তু সেখানে তো তোমার কাকা রয়েছেন, তা হলে?”
“আরে, কাকা নেই বলেই তো ওখানে তোমাদের বসতে বলছি।” কেদারেশ্বর হেসে বললেন, “গুয়াহাটি থেকে আর্জেন্ট কল এসেছিল, সেখানে খুব জরুরি কিছু কাজ পড়ে গেছে, কাকার একবার না গেলেই নয়, তাই ডাক্তারের পারমিশান নিয়ে কাকা সকাল দশটায় ধুবড়ি ছেড়ে চলে গেছেন, দিন তিনেকের আগে ফিরবেন না। সো দ্য কোস্ট ইজ ক্লিয়ার।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ঠিক আছে, কাল সকালে তা হলে ও-বাড়িতেই বসছি।”