আংটি রহস্য – ১৮

১৮

প্রশ্নগুলো ব্যক্তিগত হতেই পারে, এবং আমাদের সামনে তার উত্তর দিতে সুশান্ত চৌধুরি খুবই অস্বস্তি বোধ করতে পারেন, এটা ধরে নিয়ে সদানন্দবাবু আর আমি উঠে পড়তে যাচ্ছিলুম, কিন্তু সুশান্ত চৌধুরিই আমাদের উঠতে দিলেন না। বললেন, “না না, আপনাদের উঠে পড়ার কোনও দরকার নেই। একে তো আমি ধরেই নিচ্ছি যে, কেদারের কাছে আমার পাস্ট লাইফ সম্পর্কে সবই আপনারা শুনেছেন, তার উপরে আবার চারুদার আপনারা বন্ধু। সুতরাং আপনাদের কাছেও আমার লুকোবার কিছু নেই। চারুদা যা-ই জিজ্ঞেস করুক, তার উত্তরে যা বলবার, তা আপনাদের সামনেই আমি নিঃসংকোচে বলতে পারব। যদি অবশ্য উত্তর আমার জানা থাকে। …কই চারুদা, কী জানতে চাও বলো।”

গোবিন্দ ইতিমধ্যে আবার নতুন করে চা দিয়ে গিয়েছিল। পট থেকে নিজের পেয়ালায় চা ঢেলে নিয়ে ভাদুড়িমশাই তাতে দুধ-চিনি মিশিয়ে চামচ দিয়ে নাড়লেন। পেয়ালায় চুমুক দিলেন। একটা সিগারেট ধরিয়ে অন্যমনস্কভাবে ধোঁয়া ছাড়লেন কিছুক্ষণ। তারপর প্রায়-না-খাওয়া সিগারেটটিকে অ্যাশট্রেতে পিষে দিয়ে সুশান্ত চৌধুরিকে জিজ্ঞেস করলেন, “এই বাড়ি ছেড়ে তুমি বড়-একটা কোথাও যাও না, কেমন?”

“যেতে ইচ্ছে করে না, চারুদা।” সুশান্ত ম্লান হেসে বললেন, “এটার সঙ্গে বড্ড বেশি বাঁধা পড়ে গেছি। আগে তবু হপ্তায়-হপ্তায় অন্তত দুটো-একটা দিন কেদারের ওখানে কাটিয়ে আসতুম। ইদানীং তাও যাওয়া হচ্ছিল না। যাওয়ার কথা যে কখনওই ভাবতুম না, তা নয়। কিন্তু পরক্ষণেই মনে কত, কী হবে গিয়ে? এই তো দিব্যি আছি। কেদার কি তা-ই নিয়ে দুঃখ করতে না? খুব করত। দুঃখ করত, রাগারাগি করত, এমনও বলত যে, আমি যদি মাঝেমধ্যে ওর বাড়িতে না যাই, তো ও’ও এখানে আসা বন্ধ করে দেবে। তাই যেতেও হত। কিন্তু গিয়েই মনে হত, এখানে এই নিরিবিলিতে ফিরতে পারলে যেন বেঁচে যাই।”

বুঝতে পারছিলুম যে, আস্তে-আস্তে ভাদুড়িমশাই একটা জরুরি প্রশ্নের দিকে এগোচ্ছেন, এখন এঁদের এই কথাপার্তার মধ্যে আমাদের নাক গলানো উচিত হবে না। কিন্তু সব ব্যাপারেই যাঁর নিজস্ব কিছু-না-কিছু মতামত রয়েছে এবং সেটা না-জানানো পর্যন্ত যাঁর স্বস্তি নেই, কতক্ষণ তিনি চুপ করে বসে থাকবেন? সদানন্দবাবু বললেন, “এ তো আপনি ভাল কতাই বলেচেন। আরে মশাই, আমি তো মাত্তর দু’দিন এই বাড়িটাকে দেকলুম, তাও কতক্ষণের জন্যেই বা দেকিচি। কিন্তু তাতেই মনে হচ্চে যে, আহা, জীবনের বাদবাকি ক’টা দিনও যদি এখেনে থেকে যেতে পারতুম, তো সে নেহাত মন্দ হত না।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কী জানো, সুশান্ত, সেদিন কেদারেশ্বরও তোমার সম্পর্কে এই একই কথা বলেছিল। অনেক বলেও সে নাকি তোমাকে এই বাড়ি থেকে কোথাও বার করতে পারেনি। এই নর্থ-ইস্ট ইন্ডিয়ায় তো বেড়াবার জায়গা কিছু কম নেই। মেঘালয়ে রয়েছে শিলং আর বড়াপানি, সিকিমে রয়েছে গ্যাংটক আর নামচি, তা ছাড়া এই অসমেই তো কাজিরঙ্গার মতন চমৎকার জায়গা রয়েছে। কিন্তু এই কোকরাঝাড়ের বাড়ি ছেড়ে তুমি নাকি বেরোতেই চাও না। কেন? বাড়িটার উপরে বড্ড বেশি মায়া পড়ে গেছে?”

“শুধু বাড়িটা কেন,” সুশান্ত বললেন, “মায়া পড়ে গেছে এই পাহাড় আর এই জঙ্গলের উপরেও। তা ছাড়া এই নির্জনতা আমি আর কোথায় পাব? যেখানেই যাব, সেখানেই তো টুরিস্টদের ভিড়, সেখানেই হুল্লোড়, সেখানেই চেঁচামেচি। তাই কোথাও যাই না।

“কিন্তু মহেশ্বর ফুকনের পার্টিতে তো গিয়েছিলে।”

“না-গিয়ে উপায় ছিল না, চারুদা। কেদার বলেছিল, যেতেই হবে। তা সে যদি বলে তো আমি না-গিয়ে পারি? সে যেমন সুখের দিনে আমার পাশে ছিল, তেমন ঘোর দুঃখের দিনেও আমাকে ছাড়েনি। আমার বউ আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, কিন্তু গোবিন্দ আর কেদার ছাড়েনি। অনেক ভাগ্য করে জন্মালে তবে কেদারের মতো বন্ধু পাওয়া যায়। তা সেই কেদার যদি বলে যে, পার্টিতে আমাকে যেতেই হবে, তা হলে তো আমার না-গিয়ে উপায় থাকে না, চারুদা। না-গেলে কেদার দুঃখ পেত, তাই গিয়েছিলুম।”

“কিন্তু গেলেই যদি, তো যার জন্যে পার্টি, তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পরে একটাও কথা না-বলে তুমি চলে এলে কেন? কারণটা যে আমি বুঝতে পারিনি, তা ভেবো না। তবু তোমার মুখ থেকেই সেটা শুনতে চাই।”

সুশান্ত চৌধুরির চোখে হঠাৎ স্পষ্ট একটা বেদনার ছায়া পড়ল। অনেকক্ষণ কিছুই বললেন না তিনি। তারপর খুবই নিচু গলায়, যেন কষ্ট করে বলতে হচ্ছে এইভাবে আস্তে-আস্তে বললেন,

“কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে। জীবনানন্দ ঠিকই বলেছেন। কেউই বাসে না। না, চারুদা, যা চাপা পড়ে আছে, তা চাপাই থাক। তাকে আর খুঁড়ে তুলতে বোলো না।”

“কিন্তু না-খুঁড়ে তুলে তো উপায় নেই।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “যা সত্য, তা থেকে তুমি পালিয়ে বেড়াবে কী করে? আর পালানো যখন সম্ভব নয়, তখন তার মুখোমুখি হওয়াই তো ভাল।…বলো, সেদিন তুমি ওইভাবে চলে এসেছিলে কেন।”

“সেটা না শুনে তুমি ছাড়বেই না দেখছি।” ম্লান হেসে সুশান্ত বললেন, “ঠিক আছে, তা হলে শোনো, সেদিন আমি ডোরাকে দেখেই চলে এসেছিলুম।”

“এটা কিন্তু পুরোপুরি সত্যি কথা হল না, সুশান্ত। আসলে ডোরাকে দেখে নয়, পরিচয় করিয়ে দেবার পরে সে যখন দু’হাত জোড় করে তোমাকে নমস্কার করে, তখন তার হাতের আংটিটা নিশ্চয় তোমার চোখে পড়ে গিয়েছিল। ওটা যদি না চোখে পড়ত, তা হলে বোধহয় তুমি অমনভাবে সেদিন পালিয়ে আসতে না। ঠিক বলছি?”

সুশান্তর চোখ থেকে বেদনার ছায়াটা সরে গিয়েছিল। বেদনার জায়গায় ফুটে উঠেছিল বিস্ময়। তাঁর কথাতেও সেটা চাপা রইল না। বললেন, “কিন্তু তোমার তো তা জানার কথা নয়। কী করে জানলে?”

তক্ষুনি এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন না ভাদুড়িমশাই। বললেন, “ডোরার হাতে যে-আংটিটা তুমি দেখেছিলে, পরশু সেটা হারিয়ে যায়। কিন্তু পরশু রাত্তিরেই সেটা আমি উদ্ধার করে দিই। আংটিতে যে দুটি অক্ষর খোদাই করা ছিল, তাও তখনই আমার চোখে পড়ে। ডোরা বলে, ও দুটি তার মায়ের নাম আর পদবির আদ্যক্ষর।”

“মিথ্যে কথা, ডাহা মিথ্যে কথা।” সুশান্ত বললেন, “মেয়েটা তোমাকে মিথ্যে কথা বলেছে।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “উত্তেজিত হোয়ো না সুশান্ত, সবটা আগে শোনো। আংটির উপরে কলকাতার এক বিখ্যাত মণিকারের ছাপ দেখেই আমি আঁচ করেছিলুম যে, ডোরা ভুল বলছে, সম্ভবত ওটা তোমার আর সিলভিয়ার নামের আদ্যক্ষর। কিন্তু ওই যা বললুম, আঁচই করেছিলুম মাত্র, নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারিনি। ‘এস্’ অক্ষর দুটোর মানে যে সুশান্ত আর সিলভিয়া, একদিন বাদেই তা অবশ্য স্পষ্ট জেনে যাই।”

“কী করে জানলে?”

“তাও বুঝতে পারছ না?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “সুশান্ত, তুমি বড্ড ভাল আর বড্ড বোকা। জেনেছি ওই আংটির জোড়টাকে দেখে, যেটা কিনা তোমার পিয়ানোর রিডের তলায় লুকোনো ছিল। দুটো আংটির একই নকশা, একই মেকার, আর দুটোতেই খোদাই করা রয়েছে একই আদ্যক্ষর। …কিন্তু সুশান্ত, ডোরার হাতে ও আংটি দেখে তুমি পালালে কেন?”

“পালাব না?” ফের সেই একই রকমের উত্তেজিত গলায় সুশান্ত বললেন, “সিলভিয়াকে আমি যে আংটি দিয়েছিলুম, সেটা ও চুরি করেছে, আর নয়তো তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। এবারে নিশ্চয় ওটাকে একটা প্রমাণ হিসেবে দাখিল করে বলবে যে, ও আমাদের মেয়ে। সিলভিয়া ওর মা আর আমি ওর বাবা! নির্ঘাত খবর পেয়েছে যে, আমার এখন অনেক টাকা, সেই টাকাটা আমার ওয়ারিস হিসেবে দাবি করবে। অথচ ওর বয়েস আর কত হবে, মেরেকেটে বছর পঁয়ত্রিশ। তা হলে ও কী করে আমার মেয়ে হয়? সিলভিয়া তো আজ থেকে তেতাল্লিশ বছর আগে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে! তা হলে? ও একটা জোচ্চোর! ওর কাছ থেকে না-পালিয়ে উপায় আছে?”

সবটা শুনলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর শান্ত গলায় বললেন, “তোমাকে বোকা বলেছি। এবারে বলছি, তুমি একটা গাধা। আজ আর কিছু বলব না। শুধু তিনটি প্রশ্ন করব। এক নম্বর প্রশ্ন, সিলভিয়ার সঙ্গে তোমার ডিভোর্স হয়েছে কি না।”

“না, হয়নি।” সুশান্ত বললেন, “এমনকী, গত তেতাল্লিশ বছরে ওর তরফে ডিভোর্সের কোনও নোটিসও আমি পাইনি।”

“ভাল। আমার দু’নম্বর প্রশ্ন, তোমার টেলিফোন আর গাড়ি ঠিক আছে কি না। কথাটা এইজন্যে জিজ্ঞেস করছি যে, রাত্তিরে হয়তো তোমাকে আমার একটা ফোন করার দরকার হবে, আর ফোন করে হয়তো কাল তোমাকে একবার ধুবড়িতে চলে আসতে বলব। মনে রেখো, এটা জরুরি ব্যাপার। হয়তো এরই উপরে তোমার সবকিছু নির্ভর করছে। টেলিফোন আর গাড়িটা তাই ঠিক থাকা দরকার।”

“দুটোই ঠিক আছে।”

“তিন নম্বর প্রশ্ন, আয়নায় নিজের মুখখানা কখনও ভাল করে দেখেছ?”

“নিজের মুখ?” সুশান্ত হেসে ফেললেন। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, “চারদিকে এত সুন্দর-সুন্দর দৃশ্য, এত সব সুন্দর-সুন্দর মুখ। সে-সব ছেড়ে নিজের মুখ দেখতে যাব কোন্ দুঃখে?”

“তার মানে দ্যাখোনি।” এবারে ভাদুড়িমশাইও হেসে বললেন, “কাল সকালেই দাড়িটা পুরোপুরি কেটে ফেলে আয়নায় নিজের মুখখানা একবার ভাল করে দেখবে। এককালে তো আমার প্রতিটি হুকুম বিনাবাক্যে মেনে নিতে, ধরে নাও এটাই আমার শেষ হুকুম, ইয়োর চারুদা’জ লাস্ট অর্ডার।”