আংটি রহস্য – ১৭

১৭

আমরা সবাই বসবার ঘরে ঢুকে এক-একটি চেয়ার দখল করলুম। খবরের কাগজের ‘নিরুদ্দেশ’ কলমে এঁর যে ছবি বেরিয়েছিল, ভাদুড়িমশাইকে কেদারেশ্বর তার একটি কপি দিয়েছিলেন। কপিটি আমি দেখেছি, তাই প্রথম থেকেই এঁকে চেনা-চেনা মনে হচ্ছিল আমার। কিন্তু আমরা কে, সেটা বুঝতে না-পারায় তাঁকেই বরং যৎপরোনাস্তি বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল। ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমাকে আপনি চেনেন দেখছি! কিন্তু আপনাকে তো আমি ঠিক চিনতে পারলুম না। কে আপনি?”

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “কেদারেশ্বরের যেমন পাওয়ার অভ অবজার্ভেশন কম, তেমনি তোমারও দেখছি স্মৃতিশক্তির একেবারে বারোটা বেজে গেছে! কলেজে আমি তোমার এক বছরের সিনিয়র ছিলুম। যাকে তোমার গাড়িতে দিনের পর দিন লিফট দিয়েছ, আর পরীক্ষার আগে জোর করে পুরো এক হপ্তা তোমাদের এলগিন রোডের বাড়িতে আটকে রেখে যার কাছে ইকনমিকস পড়েছিলে, তাকে তোমার মনে নেই?”

চেয়ার থেকে উঠে এসে ভাদুড়িমশাইয়ের হাত দুখানা জড়িয়ে ধরে সুশান্ত চৌধুরি চাপা গলায় বললেন, “আর বলতে হবে না, আর বলতে হবে না, তুমি চারুদা!”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “যাক্, মনে পড়েছে তা হলে। এবারে এসো, আমার দুই বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি হচ্ছেন কিরণ চাটুজ্যে আর উনি সদানন্দ বসু। তোমারই খোঁজে আমরা এখানে এসেছি।”

সুশান্ত বললেন, “নাম অবশ্য জানতুম না, তবে সদানন্দবাবুকে আমি এর আগেও দেখেছি। কামাখ্যা-পাহাড়ে আপনিই তো দিন কয়েক আগে একটা বাঁদরের পাল্লায় পড়েছিলেন, তাই না?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ,” লজ্জিত গলায় সদানন্দবাবু বললেন, “বাঁদরটা আমার পকেট মেরে পালিয়ে গেসল।”

“তখন এক সন্ন্যাসীর কুকুর যে বাঁদরটাকে তাড়া করেছিল, সেটা মনে আছে?”

“খুব মনে আচে। তবে কুকুর তো আর গাচে উঠতে পারে না, তাই বাঁদরটাকে সে ধরতে পারেনি। তা মশাই, আপনি এত সব কতা কী করে জানলেন?”

সুশান্ত এবারে হেসে বললেন, “আমিই সেই সন্ন্যাসী, আর এই জুজুই সেই কুকুর। আপনি বোধহয় আমাকে আজ চিনতে পারেননি।”

সদানন্দবাবু বললেন “কী করে পারব? তখনও আপনার দাড়ি ছিল বটে, তবে সেটা জঙ্গুলে দাড়ি, ফ্রেঞ্চ-কাট নয়। তা ছাড়া সেদিন আপনার গলায় ছিল রুদ্রাক্ষের মালা, পায়ে ছিল খড়ম। আজ তো সে-সব নেই, তাই চিনতে পারিনি। তবে হ্যাঁ, চেনা-চেনা লাগছিল বটে।”

আমি বললুম, “দাড়ির ছাঁট, গলার মালা আর পায়ের খড়ম দিয়ে যে একটা লোককে চিনতে হয়, এমন কথা এর আগে কখনও শুনিনি।”

সদানন্দবাবু বললেন, “কিন্তু একটা কতা তো বুজতে পারচি না, মশাই।”

সুশান্ত বললেন, “কী?”

“আমার ঝোলার মদ্যে কে যেন একটা চিরকুট ঢুকিয়ে দিয়েছিল। তাতে লেকা ছিল, সময় নষ্ট না করে ফিরে যান। ওটা কার লেকা?”

“আমার।” সুশান্ত হেসে বললেন, “সিঁড়ি ভেঙে মন্দিরে ওঠার সময় পান্ডাকে আপনি বলছিলেন যে, সুশান্ত চৌধুরি বলে একে ভদ্রলোককে আপনারা খুঁজতে এসেচেন, কামাখ্যা-মায়ের দয়ায় তাঁকে যেন খুঁজে পাওয়া যায়। তার থেকেই যা বোঝার আমি বুঝে ফেলি। তারপর একটা বাজে কাগজে ওই কথাটা লিখে আপনারা ঝোলার মধ্যে ফেলে দিই।”

“আর সেটা আমি টের পেলুম না?”

“পাবেন কী করে? আপনি তো তখন বাঁদরের কান্ড দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেসলেন!”

“আমি কিন্তু ওই যে তুমি দরজা খুলে বেরিয়ে এলে, তার আগেই বুঝে গিয়েছিলুম যে, এ আমাদের সুশান্ত না হয়ে যায় না।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কী করে বুঝেছিলুম জানো? স্রেফ তোমার শিস্ শুনে। তার আগে পিয়ানো শুনেও অবিশ্যি মনে হয়েছিল যে, নিশ্চয় তুমি বাড়িতেই আছ। তা সিয়ানোটা এখন ঠিকঠাক চলছে তো?”

পিয়ানোর প্রসঙ্গ ওঠার সঙ্গে-সঙ্গেই যে সুশান্ত চৌধুরির ভুরু হঠাৎ কুঁচকে গিয়েছিল, তা আমার নজর এড়ায়নি। ভাদুড়িমশাইয়ের কথা শেষ হতেই তিনি বললেন, “তা চলছে। কিন্তু যে-জন্যে চলছিল না, সেটা কোথায়?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সেটা আমার কাছেই আছে, তবে এখন তুমি পাবে না। আমার কাজ এখনও শেষ হয়নি। শেষ হোক, তখন ফেরত দেব।”

গোবিন্দ একটা মস্ত বড় থালার উপরে প্রচুর টোস্ট আর মিষ্টি নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল। গোল টেবিলের উপরে থালাটা নামিয়ে রেখে সে বেরিয়ে গেল, তারপর আর-একটা থালায় চায়ের পট আর চারটে পেয়ালা নিয়ে ফের ঘরে ঢুকে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “কাল যে-রকম চা করতে বলেছিলন, ঠিক সেই রকম করেছি। কিন্তু আপনাদের তো আজ আসার কথা ছিল না।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কথা ছিল না বলেই তো আজ এসেছি। নইলে কি আর তোমার খোকাবাবুকে এখানে পেতুম?”

সুশান্ত চৌধুরি বললেন, “এটা তুমি ঠিকই বলেছ, চারুদা। বলতে গেলে আমি তো এখন পালিয়ে-পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কথামতো যদি আগামী কাল আসতে, তা হলে আমাকে পেতে না। তিন ভদ্রলোক আগামী কাল এখানে আবার আসবেন, গোবিন্দর কাছে এই খবর শুনেই আমি ঠিক করে ফেলেছিলুম যে, আজকের দিনটা এখানে কাটিয়ে তারপর সকাল হবার আগেই সরে পড়ব।”

“কিন্তু তুমি পালিয়ে-পালিয়ে বেড়াচ্ছ কেন?”

“তা তুমি বুঝবে না, চারুদা।” সুশান্ত বললেন, “একটা সময়ে তুমি আমাকে চিনতে। কলেজ-জীবনে তুমি যখন আমার রোল-মডেল ছিলে, তোমার মুখে একটা প্রশংসার কথা শুনলে যখন আমি ধন্য হয়ে যেতুম, রাস্টিকেটেড হয়ে যাওয়ার হাত থেকে যখন তুমি আমাকে বাঁচিয়েছিলে, যখন তুমি কলেজের গভর্নিং বডির মিটিংয়ে বলেছিলে যে, সুশান্তকে যতই আনরুলি বলে মনে হোক, আসলে ওর দৌরাত্ম্য নেহাতই ইউথফুল এবারেন্স ছাড়া আর কিছুই নয়, তখন তুমি চিনতে আমাকে। কিন্তু তারপরে আমার কী হয়েছিল, আমার ভাগ্যের চাকাটা যে কতবার কীভাবে ঘুরেছে, তার কিছুই তো তুমি জানো না। আর তা না-জানলে আজকের এই আমিকে তুমি কী করে চিনবে। কী করেই বা বুঝতে পারবে যে, কেন আমাকে পালিয়ে-পালিয়ে বেড়াতে হয়?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তুমি ভুল করছ, সুশান্ত। কেদারেশ্বরের কাছে তোমার সমস্ত কথাই আমি শুনেছি। তোমার ভাগ্যবিপর্যয়, সিলভিয়ার চলে যাওয়া, সব। আর কেদার যদিও বুঝতে পারেনি, আমি কিন্তু ঠিকই বুঝেছি যে, মহেশ্বর ফুকনের বাড়িতে গত মাসের দশ তারিখে যে পার্টি হয়েছিল, তার সঙ্গে তোমার এই আত্মগোপনের ব্যাপারটার একটা স্পষ্ট যোগ রয়েছে। যোগটা কী, তাও যে আঁচ করতে পারিনি, তা নয়।”

যেন চমকে উঠলেন সুশান্ত। পরক্ষণেই দু’হাতে মুখ ঢেকে বললেন, “তাও আঁচ করতে পেরেছ? …ওহ্ গড, ওহ্ মাই গড!”

“আঁচ করতে পেরেছি, কিন্তু ছবিটা তবু পরিষ্কার হচ্ছে না।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “সেইজন্যই দু’-একটা প্রশ্ন আমাকে করতে হবে। তার আগে একটা কথা বলি। তোমাকে যে আজ এখানে পাওয়া যাবে, তা আমি জানতুম।”

মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছিলেন সুশান্ত। বললেন, “কী করে জানতে?”

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “কামাখ্যা পাহাড়ে এক দাড়িওয়ালা সন্ন্যাসীর সঙ্গে সদানন্দবাবুর দেখা হওয়ার কথা আমি শুনেছি। কথাটা শুনে বিশেষ গা করিনি। এমনকি, পরে যখন শুনলুম যে, বঙ্গাইগাঁওয়ে সেই সাধু একটা বাসের পিছনের সিট থেকে সদানন্দবাবুকে দেখে হেসেছেন, তখনও না। কিন্তু ধুবড়িতে কেদারেশ্বর যখন তোমার দাড়িওয়ালা চেহারার ছবি দেখাল, তখন আমাকে ভাবতেই হল যে, সেই দাড়িওয়ালা সন্ন্যাসীটি আসলে সুশান্তই নয় তো? কিন্তু গৌহাটি থেকে সুশান্ত বঙ্গাইগাঁওয়ে এল কেন? সে বাসে করে যে রাস্তায় যাচ্ছে, আমাদের ড্রাইভার পরেশ বলছিল যে, সেটা স্টেশনে যাবার রাস্তা, তা হলে কি সে রেলগাড়িতে উঠে কোথাও যাবে? কোথায় যেতে পারে, ভাবতে-ভাবতেই আমার মনে হল, বঙ্গাইগাঁও থেকে কোকরাঝাড় তো খুবই কাছে। তা হলে কি যে-বাড়িকে সুশান্ত এত ভালবাসে, সেই বাড়িতেই সে ফিরে যাচ্ছে?”

একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “সেইদিনই তুমি বাড়িতে ফিরে এসেছিলে সুশান্ত। তাই না?”

“হ্যাঁ।” বিষণ্ণ গলায় সুশান্ত বললেন, “হ্যাঁ, সেইদিনই। তবু শুধু রাতটাই এখানে থাকতুম। দিনের বেলায় বাড়িতে থাকতুম না। মানে সবে তো পরশু ফিরেছি। কাল গোটা দিন জঙ্গলে কাটিয়েছি। আজও সন্ধ্যার দিকে জঙ্গলে চলে যেতুম। কিন্তু তার আগেই তো তুমি এসে পড়লে।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “জঙ্গলে গেলেও বাড়ির থেকে খুব দূরে যেতে না। গতকালও তুমি এ-বাড়ির কাছেপিঠেই ছিলে।”

“কী করে বুঝলে?”

“কাল এ-বাড়ি থেকে চলে যাবার একটু আগে একটা কুকুরের ডাক শুনেছিলুম। মনে হল, ডাকটা জঙ্গলের দিক থেকে আসছে। কিন্তু এটা সেই ফেরোশাস কুকুরের ডাক নয়। একটা শান্ত কুকুরের ডাক। কিন্তু এখানে তো অন্য কোনও বাড়ি নেই, তা হলে এটা কাদের কুকুর ডাকছে? সুশান্ত, তখনই আমি বুঝে যাই যে, বাড়িতে তুমি নেই বটে, তবে কাছেপিঠেই আছ।”

সুশান্ত বললেন, “চারুদা, তুমি একটুও পালটাওনি। কলেজের ল্যাবোরেটরির চোরকে যে-ভাবে ধরেছিলে, আমাকেও একেবারে সেইভাবেই ধরেছ।”

“একটু তফাত আছে, সুশান্ত।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “সেবারে চোর ধরেছিলুম আর এবারে যাকে ধরেছি, সে বোধহয় কাউকে চোর ভেবে নিয়ে তার কাছে থেকে পালাতে চাইছে।”

ম্লান হেসে সুশান্ত বললেন, “কী জানি!”

“এবারে তা হলে দু-একটা প্রশ্ন করি, কেমন?”