আংটি রহস্য – ১৬

১৬

আজ সতেরোই এপ্রিল, তেসরা বৈশাখ, শুক্রবার। ভোর পাঁচটা বাজতে পাঁচ মিনিটে একতলায় নামি। গাড়ি তৈরিই ছিল, তাই ঠিক পাঁচটাতেই বেরিয়ে পড়েছি। স্টিয়ারিং হুইলে হাত রেখে ভাদুড়িমশাইকে জিজ্ঞেস করেছিলুম, আজও কেদারেশ্বর ফুকনের বাড়ি হয়ে যাব কি না। তাতে তিনি বললেন, “না না, ওকে যখন সঙ্গে নিচ্ছি না, তখন আর ওর বাড়ি হয়ে যাবার দরকার নেই; তবে হ্যাঁ, ফিরতি পথে একবার খবর নিতে হবে যে, কেমন আছে।”

যদিও বৈশাখ মাস, তবু এখনও গরম পড়েনি, তা ছাড়া কাল মাঝরাত্তিরে ঝড় উঠেছিল, সেই সঙ্গে জোর এক পশলা বৃষ্টিও হয়ে গেছে, ফলে আশা করছি যে, দুপুরের দিকেও খুব-একটা গরম পড়বে না। ভোরের বাতাসে একটু-একটু ঠান্ডার ভাবও মিশে আছে, আকাশটা একেবারে ঝকঝকে নীল, আমার ডান দিকের জানালার কাচটা পুরোপুরি নামিয়ে দিয়ে বললুম, “আ গ্লোরিয়াস ডে!”

ভাদুড়িমশাই কোনও উত্তর দিলেন না। সম্ভবত কিছু ভাবছেন। পিছন থেকে সদানন্দবাবু বললেন, “গ্লোরিয়াস না ঘেঁচু। বাড়ি থেকে বেরোবার আগে কমসে কম এক পেয়ালা চা তো খাব, তাও আজ খাওয়া হয়নি। কোতাও একটু থামিয়ে রেকে সেটা খেয়ে নিলে হত না?”

“এখন নয়।” ভদুড়িমশাই গম্ভীর গলায় বললেন, “যতক্ষণ না কোকরাঝাড়ে সুশান্তর বাড়িতে পৌঁছচ্ছি, ততক্ষণ কোথাও পাঁচ মিনিটের জন্যেও থামা চলবে না। চেকিংয়ের জন্যে পাছে দেরি হয়ে যায়, তাই আজ হ্যান্ডব্যাগগুলোও সঙ্গে আনিনি।”

সদানন্দবাবু দেখলেন, গাড়ি থামিয়ে চা খাওয়ার প্রস্তাবটাকে আমলই দেওয়া হল না, সেটা একেবারে পত্রপাঠ খারিজ হয়ে গেল। এমনটা যে হবে, সম্ভবত তিনি তা ভাবতেও পারেননি। ভদ্রলোক তাতে একটু চুপসে গেলেন ঠিকই, কিন্তু পরক্ষণেই সুর পালটে বললেন, “সত্যিই তো, তাড়াতাড়ি এখন আমাদের কোকরাঝাড় পৌঁছানো দরকার, হাতে কাজ ফেলে রেকে চায়ের জন্যে পাগল হওয়ার কোনও মানেই হয় না।…কী হল কিরণবাবু, গাড়ি এত আস্তে চালাচ্চেন কেন? এটা কি গোরুর গাড়ি নাকি? স্পিড বাড়ান, স্পিড বাড়ান!”

স্পিডোমিটারের কাঁটা সত্তর থেকে আশির মধ্যে ঘোরাফেরা করছে, তাও কিনা সদানন্দবাবুর পছন্দ নয়! হাসি সামলে বললুম, “স্পিড যদি আরও বাড়াই তো দুটো ব্যাপার ঘটতে পারে। হয় একটা মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্ট ঘটবে, আর নয়তো পুলিশে ধরবে। কোনটা চান?”

সদানন্দবাবু সম্ভবত হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। বেজার গলায় বললেন, “আমার কোনও কতাই দেকচি আপনাদের পছন্দ নয়। ঠিক আচে, এই আমি চুপ করলুম, আর কোনও কতাই কইব না।”

সত্যিই চুপ করে গেলেন।

দিনটা আজ চমৎকার শুরু হয়েছে, আর এখনও পর্যন্ত চলেছেও অতি মসৃণভাবে। ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখতে ভুলে গিয়েছিলুম, তবু ঠিক চারটের সময় ঘুম ভেঙেছে। তারপর মুখ ধোয়া, দাড়ি কামানো আর স্নানের পর্ব শেষ করেছি সাড়ে চারটের মধ্যে। বাথরুমের দখল নিয়ে সদানন্দবাবুর সঙ্গে কোনও ঝামেলা হয়নি। তার কারণ তখনও তিনি পড়ে-পড়ে ঘুমোচ্ছিলেন। ধাক্কা মেরে তাঁকে জাগিয়ে আর কল-ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে যেমন জামা-কাপড় পালটে আমি তৈরি হয়ে নিয়েছি, তেমনি তারপরে নীচে নেমে লনের পাশের ঘোরানো রাস্তা দিয়ে হেঁটে এসেছি এক চক্কর। তা ছাড়া, আজ অনেক বছর বাদে আবার সূর্যোদয় দেখা হল।

কারণ কী, তা জানি না বটে, তবে ভাদুড়িমশাই যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কোকরাঝাড়ে পৌঁছতে চান, আর তাড়াতাড়ি না-পৌঁছতে পারলে যে তাঁর কাজের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে, সেটা বুঝতে পেরেছিলুম বলেই নিতান্ত এক-আধবার ছাড়া কোথাও গাড়ির স্পিডে আমি একটুও ঢিলে দিইনি। একবার দিয়েছিলুম গৌরীপুরে একটা গোরুর গাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ বাঁচাতে, আর একবার দিয়েছিলুম বিলাসীপাড়ার মাঠের ধারে এক সদ্য-সাইকেল-চালাতে-শেখা ছোকরাকে তার সাইকেল নিয়ে মাঝরাস্তা থেকে একপাশে সরে গিয়ে প্রাণ বাঁচাবার সুযোগ দেবার জন্যে। তা ছাড়া তো স্পিডোমিটারের কাঁটাটাকে সারাক্ষণ সত্তর থেকে আশির মধ্যেই আটকে রেখে গাড়ি চালাচ্ছি।

চালাচ্ছি আর মনে-মনে প্রার্থনা করছি যে, হে ভগবান, চেক-পোস্টে আমাদের গাড়িটাকে যেন খুব বেশিক্ষণ আটকে রাখা না হয়। যেন কালকের মতো আজও তাড়াতাড়ি ছাড়া পাই।

তা ভগবান যখন দেন, তখন যে ছপ্পর ফুঁড়েই দেন, এই কথাটা দেখলুম মিথ্যে নয়। প্রার্থনার উত্তরে প্রাপ্তিটা একেবারে ছপ্পর ফুঁড়েই হল। চেয়েছিলুম যে, চেকিংয়ের ঝামেলাটা যেন তাড়াতাড়ি মেটে। তা কোনও চেকিংই হল না। ধুবড়ি-কোকরাঝাড়ের বর্ডার আজ খাঁখাঁ করছে। সেখানে না আছে রাস্তার উপরে আড়াআড়ি ভাবে লম্বা বাঁশ ফেলে গাড়িঘোড়া আটকানোর ব্যবস্থা, না আছে রাস্তার ধারে সিকিওরিটির লোকজনদের তাঁবু। আন্দাজ করলুম যে, রক্ষিবাহিনীর লোকজনেরা কাল রাতেই এখান থেকে সরে গিয়ে অন্য-কোথাও তাঁবু ফেলেছে।

সুশান্ত চৌধুরির বাড়ির কাছেও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে গেলুম। আজ আর বাড়ি খুঁজতে হল না। হাইওয়ে থেকে সরু একটা খাড়াই রাস্তা যেখানে পাহাড়ের উপরে উঠে গেছে, সেই জায়গাটা কালই চিনে রেখেছিলুম, স্পিড কমিয়ে গিয়ার পালটে এবারে সেই সরু রাস্তায় গাড়ি ঢোকাব, এমন সময় ভাদুড়িমশাই বললেন, “গাড়িটা নীচেই থাক, আজ হেঁটেই উপরে উঠব।”

অর্থাৎ ভাদুড়িমশাই চান না যে, উপরে যারা রয়েছে তারা কেউ কিছু টের পাক, কেউ আমাদের আসার ব্যাপারটা বুঝতে পারুক। কিন্তু উপরে তো শুধু গোবিন্দ রয়েছে। সে ছাড়া দু’তিনজন কাজের লোকও অবশ্য থাকতে পারে। যেমন নালি। যেমন চৌকিদার। সুশান্ত চৌধুরির নিখোঁজ হওয়ার পিছনে কি এদেরই কারও হাত আছে বলে ভাদুড়িমশাই সন্দেহ করেন? তা নইলে এত সতর্কতা কেন? একেবারে হঠাৎই একটা সন্দেহ উঁকি দিয়ে গেল আমার মনে। সুশান্ত চৌধুরি বেঁচে আছেন তো? টেররিস্ট অর্গানাইজেশনের তো এদিকে অভাব নেই। এই পাহাড় তাদের লুকিয়ে থাকার পক্ষে একটা চমৎকার জায়গা। তাদেরই কোনও একটা দল এখান থেকে সুশান্তকে তুলে নিয়ে যায়নি তো? তুলে নিয়ে গিয়ে হয়তো মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করেছিল। হয়তো সেই দাবি মেটাতে রাজি হননি সুশান্ত। সেক্ষেত্রে তাঁকে মেরে ফেলাই বা বিচিত্র কী! আর তা-ই যদি হয়ে থাকে, তো তাদের সঙ্গে যে গোবিন্দ কিংবা মালি কিংবা চৌকিদারের কোনও যোগসম্পর্ক নেই, তাও কি নিশ্চিতভাবে বলা যায়? গোবিন্দর প্রভুভক্তির কথা অবশ্য আমরা শুনেছি। কিন্তু খোকাবাবুকে যখন সে দু’হাতে আগলে রেখেছিল, তখন তো খোকাবাবুর চরম দুর্দিন চলছে। পরে যখন খোকাবাবুর কপাল আবার পালটে গেল, ফকির খোকাবাবু ফের আমির হলেন, তখন থেকে গোবিন্দও একটু-একটু করে পালটে যায়নি তো?

কথাগুলি লিখতে যত সময় লাগল, ভাবতে তার এক-শতাংশও সময় লাগেনি। একেবারে বিদ্যুচ্চমকের মতোই আমার মাথার মধ্যে ঝিলিক দিয়ে গিয়েছিল এই ভয়ংকর ভাবনা। কিন্তু ভিতরে-ভিতরে যতই টলে গিয়ে থাকি, মুখে আমি একটি কথাও প্রকাশ করলুম না। গাড়িটাকে খুবই সন্তর্পণে একটু ব্যাক করে হাইওয়ের পিচ-মোড়া অংশের পাশে কাঁচা রাস্তায় একটা গাছের তলায় দাঁড় করিয়ে রেখে বললুম, “চলুন তা হলে, ওঠা যাক।”

সদানন্দবাবু সেই যে চুপ করে গিয়েছিলেন, তারপরে আর মুখ খোলেননি। বললেন, “আমি গাড়িতেই আচি, আপনারা বরং উপর থেকে ঘুরে আসুন।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কেন, কেন, পথের মধ্যে গাড়ি থামিয়ে চা খেতে দিইনি বলে রাগ হয়েছে?”

“না না, রাগের কী আচে?” সদানন্দবাবু বললেন, “আসলে শরীরটা কেমন যেন ম্যাজম্যাজ করচে, জুত পাচ্চি না।”

“উপরে চলুন,” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “গোবিন্দর হাতের চা খেলেই শরীর ঠিক হয়ে যাবে।”

সদানন্দবাবু তবু গাড়ি থেকে নামলেন না, গোঁজ হয়ে বসে রইলেন। আমি বললুম, “আসলে উনি জুজুর ভয়ে উপরে যেতে চাইছেন না।”

কথাটায় কাজ হল প্রায় মন্ত্রের মতো। তক্ষুনি গাড়ি থেকে নেমে এলেন সদানন্দবাবু। আমার দিকে তাকিয়ে নিজের বুকে আঙুলের একটা টোকা মেরে বললেন, “ভয়? আমার? তাও আবার কুকুরের ভয়? আর হাসাবেন না মশাই, চলুন, চলুন, বজ্জাত কুকুরকে কীভাবে শায়েস্তা করতে হয়, আজ‍ই সেটা দেকিয়ে দিচ্চি।”

বললেন বটে, কিন্তু সামনে এলেন না। ওঁর যে একটা মাথায়-লোহার-বল-বসানো খেটে-লাঠি আছে, সেইটে হাতে নিয়ে গুটিগুটি আমাদের পিছনে এসে দাঁড়ালেন।

খাড়া ঢাল বেয়ে আমরা উপরে উঠে এলুম।

একেবারে হঠাৎই কানে এল পিয়ানোর স্বরতরঙ্গ। আওয়াজ এত মৃদু যে, বোঝা যায়, রিডের উপরে আঙুলের চাপ মোটেই জোরে পড়চে না, কেউ খুবই আলতো হাতে রিডগুলির উপর দিয়ে তাঁর আঙুল চালিয়ে যাচ্ছে মাত্র।

কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে বাড়ির দরজার উপরে বার-দুয়েক টোকা মারলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর একটু বাদে গলা উঁচিয়ে ডাকলেন, “গোবিন্দ।”

টোকা মারার সঙ্গে-সঙ্গেই পিয়ানো থেমে গিয়েছিল। কিন্তু কাঠের মেঝের উপর দিয়ে কেউ এগিয়ে আসছে, এমন কোনও শব্দ পাওয়া যায়নি। সেটা পাওয়া গেল গোবিন্দর নাম ধরে উঁচু গলায় ডাকার পর। সেই সঙ্গে শোনা গেল চল্লিশের দশকের প্রথম দিকের বিখ্যাত বাংলা গান ‘যবে কন্টক-পথে হবে রক্তিম পদতল’-এর টিউন। শিস দিয়ে ওই টিউনটা ভাঁজতে-ভাঁজতে কেউ দরজার দিকে এগিয়ে আসছেন। দরজার পাল্লা সামান্য ফাঁক করে প্রথমে আমাদের বেশ ভাল করে দেখে নিলেন তিনি, তারপর আমরা যে নিতান্তই তিন বৃদ্ধ, কোনও বদ মতলব নিয়ে এখানে আসিনি, সম্ভবত এই ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে দরজার আড়াল থেকে সামনে বেরিয়ে এলেন। তখনই দেখলুম যে, তাঁর প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ভিতর থেকে সেই ভয়াবহ কুকুরটিও বেরিয়ে এসেছে। জুজু।

কিন্তু জুজু আজ তারস্বরে চেঁচাচ্ছেও না, দাঁতও দেখাচ্ছে না। তার গলায় আজ বকলস বাঁধা নেই। অথচ এমন লক্ষণ তার ভাবেভঙ্গিতে আজ দেখছি না যে, এক্ষুনি সে আমাদের দিকে তেড়ে আসবে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে অতি শান্তভাবে সে ডাইনে-বাঁয়ে লেজ নাড়ছে।

দরজা খুলে যিনি বেরিয়ে এসেছিলেন, তিনি দোহারা চেহারার মানুষ, মুখে ফ্রেঞ্চ-কাট দাড়ি, পরনে আদ্দির পাঞ্জাবি ও চুস্ত পাজামা, পায়ে শুঁড়-তোলা বিদ্যাসাগরি চটি। ভদ্রলোককে দেখে মনে হচ্ছিল, এঁকে আগে কোথাও দেখেছি। আমাদের দেখে যে তিনি একটু অবাক হয়েছেন, সে তাঁর চাউনি থেকেই বোঝা যায়। বললেন, “আপনারা কি গোবিন্দকে ডাকছিলেন?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “হ্যাঁ।”

“কিন্তু সে তো বাজারে গেছে, ফিরতে দেরি হবে। আপনারা কোত্থেকে আসছেন?”

“আপাতত ধুবড়ি থেকে। সেখানে কেদারেশ্বর ফুকনের বাড়িতে আছি।”

“গোবিন্দর সঙ্গে আপনাদের কোনও জরুরি কথা ছিল?”

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “তা তো ছিলই। তবে গোবিন্দর সঙ্গে নয়, তার মনিব সুশান্ত চৌধুরির সঙ্গে।”

“কিন্তু সুশান্ত চৌধুরির কোনও খোঁজই তো কিছুদিন হল পাওয়া যাচ্ছে না। এনিওয়ে, তাঁর সঙ্গেই বা কী কথা ছিল আপনাদের?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “এরই মধ্যে আমি পরপর তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। এবারে আমি একটা প্রশ্ন করব। তাতে কোনও আপত্তি নেই তো?”

“না, না, আপত্তি থাকবে কেন? কী জানতে চান বলুন।”

“আপনার এই কুকুরটির নাম কী?”

প্রশ্ন শুনে ভদ্রলোক সামান্য হাসলেন। বিস্ময়-মেশানো খানিকটা কৌতুকও যে ঝিলিক দিয়ে গেল তাঁর চোখে, তাও আমার নজর এড়াল’ না। বললেন, “নাম শুনে হাসবেন না। ওর নাম জুজু। নামের সঙ্গে ওর স্বভাবের কিন্তু কোনও মিল নেই। জুজু ভারী শান্তশিষ্ট ফ্রেন্ডলি নেচারের প্রাণী।”

“কাল এ-বাড়িতে গোবিন্দ যার ওই এই একই নাম বলেছিল, সেই জুজুটি কিন্তু মোটেই শান্তশিষ্ট প্রাণী নয়।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমাদের এই বন্ধুটি তো তাকে দেখে…আরে, সদানন্দবাবু আবার কোথায় সরে পড়লেন?”

দরজার আড়াল থেকে কুকুরটি মুখ বাড়াবার পরে সদানন্দবাবু আর কালক্ষেপ করেননি। আমাদের পিছন থেকে দ্রুত পা ফেলে বাড়ির চৌহদ্দি পেরিয়ে তিনি ঢালের মুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, যাতে জুজু তাড়া করলেই চোখের পলকে ঢাল ছাড়িয়ে হাইওয়েতে নেমে তিনি ফের গাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়তে পারেন। ভাদুড়ি মশাই চেঁচিয়ে বললেন, “যাচ্চলে, আপনি অত ভয় পাচ্ছেন কেন? ভয়ের কিছু নেই। এ-জুজু সে-জুজু নয়।”

“দাঁড়ান, দাঁড়ান,” ভদ্রলোক যেন তাজ্জব বনে গিয়ে বললেন, “আপনি কী বললেন, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। হোআট ডু ইউ মিন এ-জুজু সে-জুজু নয়?”

সদানন্দবাবু ইতিমধ্যে আবার আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। সেখান থেকেই বললেন, “আমার ফ্রেন্ড মিঃ ভাদুড়ি বলতে চাইচেন যে, দিস জুজু ইজ নট দ্যাট জুজু।”

“এ তো মহা বিপদে পড়া গেল!” ভদ্রলোক বললেন, “কিছুই তো আমার মাথায় ঢুকছে না! দিস জুজু, দ্যাট জুজু, এ-সব কথার মানে কী? দয়া করে একটু বুঝিয়ে বলবেন?”

“না-বোজার তো কিছু নেই।” সদানন্দবাবু বললেন, “মিঃ ভাদুড়ি কিচু বলবার আগেই একে দেকে… মানে এর ন্যাজ নাড়ার ধরন দেকেই আমি বুজে গেসলুম যে, দিস জুজু ইজ এ ভেরি জেন্টল অ্যানিম্যাল হোয়ারঅ্যাজ দ্যাট জুজু ওয়াজ ফেরোশাস। সময়মতো যদি না গাড়ির মদ্যে ঢুকে পড়তুম, তো সে আমাকে নির্ঘাত কামড়ে দিত, ঠিক যে-ভাবে কেদারেশ্বরবাবুকে কামড়ে দিয়েছিল।”

‘কেদারকে কামড়ে দিয়েছিল?” ভদ্রলোক উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, “কবে? সে কেমন আছে এখন?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কামড়েছিল গত তেরোই এপ্রিল, অর্থাৎ আজ থেকে মাত্র চার দিন আগে। ঘটনাটা ঘটেছিল অবশ্য এই বাড়িতেই। তার উপরে আবার কেদারের ধারণা, এই কুকুরই তাকে কামড়েছিল।”

“না না, জুজু তাকে কামড়াবে কেন?” ভদ্রলোক বললেন, “কেদারকে তো জুজু ভালই চেনে। আজ পর্যন্ত কোনও চেনা লোককে, কামড়ানো তো দূরের কথা, জুজু একটু আঁচড়ে পর্যন্ত দেয়নি।”

“কেদার তো সেইজন্যেই অবাক হয়ে গেছে।”

“আর হ্যাঁ, তেরো তারিখে তো জুজু এখানে ছিলও না।”

“কোথায় ছিল?”

কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন ভদ্রলোক। কিন্তু তক্ষুনি বললেন না। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “যেখানেই থাক, সেটা তো জরুরি নয়। জরুরি কথাটা হচ্ছে কেদার এখন ভাল আছে কি না!”

“ভাল আছে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “যে-কুকুর তাকে কামড়েছে, তাকে তো কালই এখানে দেখেছি আমরা। খুবই হিংস্র কুকুর তাতে সন্দেহ নেই, তবে না, পাগল নয়। সুতরাং জলাতঙ্ক হবার কোনও আশঙ্কা নেই।”

“আর ইউ শিয়োর?”

“অ্যাবসলুটলি। কিন্তু একটা কথা ভেবে আমার একটু অবাক লাগছে। কেদারের পাওয়ার অভ অবজার্ভেশন এত কম কেন। যেটা তাকে কামড়েছে, সেটা যে এই কুকুর নয়, তা তো তার তৎক্ষণাৎ বোঝা উচিত ছিল।”

এতক্ষণ আমি চুপ করে ছিলুম। কিন্তু এবারে আমাকে মুখ খুলতে হল। বললুম, “এ আপনি কী বলছেন? কাল যাকে দেখেছি আর আজ যাকে দেখছি, দুটোই তো একই জাতের কুকুর, লোমওয়ালা ভোটানিজ ডগ। তার উপরে একই সাইজ, একই রকমের কুচকুচে কালো। তফাতটা কোথায়? কই, আমি তো কোনও তফাত দেখতে পাচ্ছি না।”

“তার মানে আপনারও পাওয়ার অভ অবজার্ভেশন খুবই কম।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কালকের কুকুরটির গোটা শরীর ছিল কুচকুচে কালো, সে-ক্ষেত্রে এর শরীরের বাদবাকি অংশ কুচকুচে কালো হলেও পিছনের পায়ের থাবা দুটো সাদা। আ ভেরি স্মল ডিফারেন্স নো ডাউট, বাট আ ডিফারেন্স অল দ্য সেম।”

“কিন্তু এ-বাড়িতে ওই হিংস্র কুকুরটির…আই মিন দ্যাট সেকেন্ড ডগ…আমদানি হল কোত্থেকে?” ভদ্রলোক বললেন, “দাঁড়ান, গোবিন্দ আসুক।”

গোবিন্দ যে ইতিমধ্যে নিঃশব্দে তাঁর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, ভদ্রলোক তা বুঝতে পারেননি। সম্ভবত এই বাড়ি থেকে নীচের হাইওয়েতে নামার অন্য কোনও পথ আছে, আর গোবিন্দ সম্ভবত সেই পথ দিয়েই উপরে উঠে পিছন দিক দিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকেছে। দরজা থেকেই সে বলল, “আজ্ঞে ওটাকে আমি এনেছি। বাড়ির কুকরটা বাড়িতে নেই, অথচ কুকুর না-থাকলে তো রাত্তিরে বড্ড ভয় করে, তাই চৌকিদারকে বলে…’”

“এমন একটা কুকুর জোগাড় করেছ,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “যেটা দেখতে একেবারে এ-বাড়ির কুকুর জুজুর মতো, তাই না?”

যেন উপযুক্ত একটা ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে, এইভাবে গোবিন্দ বলল, “আজ্ঞে হ্যাঁ, যাতে জুজুর অভাবটা বুঝতে না-পারি। মানে জুজু না-থাকায় বড্ড ফাঁকা-ফাঁকা লাগত তো। অবিশ্যি এটাও ঠিক করে রেখেছিলুম যে, জুজুকে নিয়ে খোকাবাবু ফিরে এলেই ওটা ফেরত দিয়ে দেব।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা আসল জুজু যখন ফিরে এসেছে, তখন তোমার খোকাবাবুও ফিরেছেন নিশ্চয়?”

“আজ্ঞে না, খোকাবাবু এখনও ফেরেননি।”

“ঠিক আছে, গোবিন্দ,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “খোকাবাবু তো ফেরেননি, খুবই ভাল কথা। কিন্তু ইনি তা হলে কে?”

গোবিন্দ কিছু বলার আগেই ভদ্রলোকটি বললেন, “আমার নাম অজিত বসু। আমি সুশান্তবাবুর বন্ধু। এই কোকরাঝাড়েই থাকি, সুশান্তবাবু যখন বাইরে যান, তখন মাঝেমধ্যে এসে এখানকার খোঁজখবর নিয়ে যাই।”

ভাদুড়িমশাই এতক্ষণ মুখ টিপে হাসছিলেন, এবারে একেবারে হোহো করে হেসে উঠলেন। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, “আর আপনি-আজ্ঞে করছি না। যেমন তুমি, তেমন তোমার গোবিন্দ! তোমরা দুজনেই ঘোর মিথ্যেবাদী। কিন্তু মিথ্যেটাকে কীভাবে সত্যি বলে চালাতে হয়, তাও তোমরা জানো না। চলো সুশান্ত, ঘরে গিয়ে বসা যাক, তোমার সঙ্গে আমার জরুরি কিছু কথা আছে। …আর হ্যাঁ, গোবিন্দ, তুমি চটপট চা বানাও, পারলে কিছু খাবারও নিয়ে এসো। সকাল থেকে ব্রেকফাস্ট তো দূরের কথা, এক কাপ চা পর্যন্ত খাওয়া হয়নি।”