১৫
আসার সময়ে আমি চালিয়েছি, এবারে ফেরার পথে ভাদুড়িমশাইয়ের গাড়ি চালাবার পালা। গাড়িতে উঠে তিনি স্টিয়ারিং হুইল হাতে নিলেন, আমি তাঁর পাশের সিটে বসলুম। পিছনের আসন থেকে সদানন্দবাবু বললেন, “ওরে বাবা রে বাবা, এ তো ডেঞ্জারাস কুকুর মশাই!”
গাড়ি যে ভাদুড়িমশাই আমার চেয়ে ঢের ভাল চালান, সে আমি বেশ ভালই জানি। তবু উপদেশ দেবার একটা সুযোগ পেয়ে সেটা ছাড়া গেল না। বললুম, “ঢালটা যে কার্শিয়াঙের পাঙ্খাবাড়ি রোডের চেয়েও স্টিপ, সেটা মনে রাখবেন। ওঠা সহজ নয়, তবে নামা আরও কঠিন।”
ভাদুড়িমশাই মৃদু হেসে ঢালু পথটুকু সাবধানে পেরিয়ে এসে হাইওয়ের উপরে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে বললেন, “দাঁড়ান, কেদারেশ্বরের খবরটা নিয়ে তারপর রওনা হব।”
পকেট থেকে সেল-ফোন বার করে কেদারেশ্বরের নম্বর ডায়াল করে কথা বললেন মিনিট খানেক। তারপর গাড়িতে ফের স্টার্ট দিয়ে আস্তে-আস্তে স্পিড তুলে বললেন, “অনুপমা ফোন ধরেছিল। বলল জ্বরটা বেড়েছে। মুশকিল হল। ওর কথায় কলকাতা থেকে ছুটে এলুম, আর এই সময়েই ও কিনা জ্বর বাধিয়ে বসল।”
সদানন্দবাবু বললেন, “জুজুর কামড় খেয়ে যদি জ্বর হয়ে থাকে, তা হলে কিন্তু ভয়ের কতা। ওটা তো একটা ম্যাড ডগ, মশাই। সেই দিনই ওঁর ইঞ্জেকশন স্টার্ট করা উচিত ছিল।”
“কে বলল ওটা ম্যাড ডগ!” ভাদুড়িমশাই বললেন, “নর্মাল, হেলদি কুকুর। তবে হ্যাঁ, একটু বদরাগী তো বটেই। তা এই রকম একটা নির্জন জায়গায় যাকে বাড়ি পাহারা দেবার জন্যে রাখা হয়েছে, তার তো একটু বদরাগী হওয়াই দরকার, তা না-হয়ে সে একটা মেনি-বেড়ালের মতো মিউ-মিউ করে ঘুরে বেড়ালে কি সেটা একটা কাজের কথা হত?”
আমি বললুম, “আমার চেনা এক ভদ্রলোক এককালে ডগ-ট্রেনার ছিলেন। তাঁর কাছে শুনেছি, কুকুর অনেক সময় বদরাগী হয় সেন্স অভ সিকিওরিটির অভাবে। এই ধরুন এক মালিকের কাছ থেকে আর-এক মালিকের কাছে এসেছে, কিন্তু নতুন পরিবেশে ঠিক ধাতস্থ হতে পারেনি, এই রকম সময়ে, ওই যা বললুম আর কি, নিজেকে একটু ইনসিকিওর মনে করা তো স্বাভাবিক, তা সেই জন্যেও কুকুরের মেজাজ নাকি গোড়ায়-গোড়ায় কিছুদিন বেশ তিরিক্ষে হয়ে থাকে।”
গাড়ি চালাতে-চালাতেই আমার দিকে মুখ ফেরালেন ভাদুড়িমশাই। চোখে কৌতুক। তারপরেই ফের সামনে তাকিয়ে, চাপা গলায়, যেন আমাকে নয়, নিজেকেই কিছু শোনাচ্ছেন, এইভাবে বললেন, “দ্যাটস ইট!”
পিছন থেকে সদানন্দবাবু বললেন, “কাজের কাজ তো কিছুই হল না?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “তার মানে?”
“মানে গোবিন্দকে জিজ্ঞেসাবাদ করে নতুন-কিচু খবর পেলুম কই! ও যা-যা বলল, সে-সব তো আমরা আগেই জানতুম।”
“তা জানতুম বটে, কিন্তু তাই বলে যে কাজের কাজ কিছু হয়নি, তা নয়। হয়েছে। এখানে না-এলে যেটা হতে পারত না। এই যেমন ধরুন সুশান্তর পিয়ানোটা যে বিগড়ে গেসল, তা কি আপনি জানেন?”
সদানন্দবাবু বললেন, “পিয়ানো আবার কোতায় দেকলেন?”
“সুশান্তর শোবার ঘরে। কিন্তু আপনি জানবেন কী করে? কুকুরের ভয়ে আপনি তো সারাক্ষণ বাইরের ঘরেই সিঁটিয়ে বসে রইলেন, মশাই।”
আমি বললুম, “পিয়ানোটা ‘বিগড়ে গেসল’ মানে? পাস্ট টেনসে কথা বলছেন কেন?”
“এইজন্যে বলছি যে, এখন আর ওটা বিগড়ে নেই।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমি ওটা ঠিক করে দিয়ে এসেছি।
তাজ্জব বনে গিয়ে বললুম, “কখন করলেন?”
উত্তর পাওয়া গেল না। গাড়ির গতি কমে এসেছিল। সামনেই চেকিং ক্যাম্প। ভাদুড়িমশাই তাঁবুর সামনে গাড়িটিকে দাঁড় করিয়ে দিলেন। তবে এবারেও চেকিং হল নামমাত্র। যেমন ড্রাইভার, তেমন প্যাসেঞ্জার, তিনজনই বয়োবৃদ্ধ, সুতরাং এদের পক্ষে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকা সম্ভব নয়, সম্ভবত এই রকমের বিবেচনাতেই মামুলি গোটাকতক প্রশ্ন করে আমাদের ছেড়ে দেওয়া হল। মাইল খানেকের মধ্যে আমাদের আর-কোনও কথাবার্তা হল না। তারপর আমিই প্রথম কথা বললুন। “উত্তরটা কিন্তু পাইনি। পিয়োনোটা আপনি কখন ঠিক করে দিলেন? মানে সময় পেলেন কখন?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “বাঃ, আমাদের চা কীভাবে করতে হবে, সেটা বলে দেবার জন্যে গোবিন্দর সঙ্গে ওই যে কিচেন গেলুম, সেখান থেকে ফেরার পথে টুক করে আবার ঢুকে পড়েছিলুম সুশান্তর শোবার ঘরে।”
“সে তো জানি।…মানে বসার ঘরে ফিরে এসে আপনি নিজেই তো তা আমাদের বললেন। কিন্তু তখন আর কতটুকু সময় পেয়েছিলেন আপনি? বড়জোড় মিনিট খানেক। তারই মধ্যে মেরামতির কাজটা হয়ে গেল?”
“বড় কোনও মেরামতির কাজ তো ছিল না।” সামনের দিক থেকে চোখ না-ফিরিয়ে ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “খুবই সামান্য গন্ডগোল, সেটা ঠিক করে দেবার পক্ষে এক মিনিটই যথেষ্ট।”
“তার মানে?”
“মানে পিয়ানোর দুটো রিড একটু উঁচু হয়ে ছিল বলে সে-দুটো থেকে আওয়াজ ঠিকমতো বেরুচ্ছিল না। প্রথমবার যখন সুশান্তর ঘরে ঢুকে পিয়ানোর উপরে আঙুল চালাই, ওই উঁচু হয়ে থাকার ব্যাপারটা তখনই চোখে পড়েছিল আমার। কিন্তু গোবিন্দ তখন ঘরে ছিল তো, তাই তক্ষুনি-তক্ষুনি কিছু করিনি। পরের বার ঘরে ঢুকে চটপট পিয়ানোর ঢাকনা খুলে রিডের তলা থেকে একটা জিনিস বার করে আনি। সেটা আমার পকেটেই রয়েছে। পরে দেখাব।”
“জিনিসটা কী, সেটা বলবেন তো?”
“তাও এখন বলব না।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপাতত শুধু একটা কথা জানিয়ে রাখি, জিনিসটা দেখলে আপনি তাজ্জব হয়ে যাবেন।”
বাইরে অন্ধকার হয়ে এসেছিল। দেশের এদিকে সকাল যেমন তাড়াতাড়ি হয়, রাতও তেমন তাড়াতাড়ি নেমে আসে। ভাদুড়িমশাই হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন। বিলাসীপাড়ার বিশাল মাঠ আমরা একটু আগেই পেরিয়ে এসেছি। ধুবড়ি প্রায় এসে গেল।
সদানন্দবাবু বললেন, “আজ রাত্তিরে আমরা কোতায় থাকব? কেদারেশ্বরবাবুর বাড়িতে, না তাঁর কাকার বাড়িতে?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা তো জানি না। আগে তো কেদারের বাড়িতে যাই, তখনই সেটা বোঝা যাবে।”
“সে না হয় থাকার ব্যবস্থা হল, খাবই বা কোতায়?” সদানন্দবাবু উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, “ধুবড়ি থেকে বেরোবার আগে তো তা নিয়ে কোনও কতাই হল না!”
“তাও বটে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এক কাজ করলে হয়। রাস্তা থেকেই নাহয় কিছু খেয়ে যাই।”
ভারতবর্ষের কোনও রাজ্যের বোধহয় এমন কোনও এলাকা নেই, ন্যাশনাল কিংবা স্টেট হাইওয়ের দু’ধারে, দু’পাঁচ মাইল অন্তর-অন্তর, যেখানে পাঞ্জাবি ধাবা গজিয়ে ওঠেনি। তেমন একটা ধাবার সামনে গাড়ি থামিয়ে আমরা রুটি-তরকা আর সেই সঙ্গে এক গেলাস করে নোন্তা লসি খেয়ে নিলুম। তাতে নৈশাহারের প্রয়োজন না মিটুক, অন্তত তখনকার মতো ক্ষুন্নিবৃত্তি হল। সকাল একারোটায় সেই যে মহেশ্বর ফুকনের বাড়ি থেকে খেয়ে বেরিয়েছিলুম, তারপরে তো আর কিছুই পেটে পড়েনি, ফলে বেশ খিদেও পেয়ে গিয়েছিল।
ধাবা থেকে বেরিয়ে কেদারেশ্বরের বাড়িতে পৌঁছুতে-পৌঁছুতে রাত সাড়ে আটটা। হর্ন দিতে হল না। গাড়ি থামার শব্দ পেয়েই অনুপমা দেবী বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনিই আমাদের বাইরের ঘরে নিয়ে বসালেন। শুনে স্বস্তি পাওয়া গেল যে, কেদারেশ্বরের জ্বর আর বাড়েনি। কাসিটা অবশ্য একই রকম। তবে ডাক্তার এসেছিলেন, তিনি ওষুধ দিয়ে গেছেন, সেই সঙ্গে ভরসা দিয়েছেন, দিন তিনেকের মধ্যেই জ্বরের রেমিশন হয়ে যাবে। কাসিটা আরও কয়েকদিন ভোগাবে, তবে সেটা কোনও চিন্তার ব্যাপার নয়। “একটু আগেও জেগে ছিলেন, এখন ঘুমোচ্ছেন, তবে আমাকে বলে রেখেছেন যে, আপনারা এলে যেন জাগিয়ে দিই।”
“না না, জাগিয়ে দেবার কথাই ওঠে না,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমরা বরং এখন চলি। তবে এর মধ্যে যদি নিজের থেকে জেগে ওঠে, তো বলে দেবেন যে, সুশান্তর ব্যাপার নিয়ে ও যেন চিন্তা না করে, আমাদের কাজ ঠিকমতোই এগোচ্ছে। আর হ্যাঁ, এটাও বলবেন, যে-কুকুর ওকে কামড়েছে, সেটা হেলদি ডগ, পাগলা নয়, সুতরাং তা নিয়েও চিন্তার কিছু নেই।”
অনুপমা বললেন, “তা-ই? ওঃ, মস্ত একটা দুর্ভাবনা কেটে গেল। উনি আসলে মুখে বলছিলেন না, কিন্তু ভিতরে-ভিতরে বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন যে, ওটা পাগল হয়ে গেছে। নয়তো দিনের-পর-দিন যার পিঠে আর মাথায় উনি হাত বুলিয়ে দিয়েছেন, জুজু বলে ডাকলেই যে ছুটে এসে ওঁর পায়ের কাছে লুটোপুটি খেয়েছে, হঠাৎ সে ওঁকে কামড়ে দিল কেন। উনি ভয় পাচ্ছিলেন যে, পাগলা কুকুরের কামড় যখন খেয়েছেন, তখন ওঁর জলাতঙ্ক হবে।
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “না, জলাতঙ্ক হবে না। ওকে নিশ্চিন্ত থাকতে বলুন।”
রাত্তিরে আমরা কোথায় থাকব আর খাব, তা নিয়ে অবশ্য কোনও প্রশ্ন করতে হল না। অনুপমা দেবী নিজের থেকেই জানালেন যে, ডোরা চান আমরা ও-বাড়িতেই থাকি। “ডোরা বলল যে, আপনাদের বন্ধু যখন অসুস্থ, তখন আপাতত কয়েকটি দিন আপনারা কাকার বাড়িতেই থাকবেন। ও সেই মতো ব্যবস্থা করে রেখেছে।”
“ঠিক আছে, তা-ই হবে।” ভাদুড়িমশাই উঠে পড়ে বললেন, “তা হলে আর বসব না। কাল আবার খুব ভোরবেলায় আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে।”
কেদারেশ্বরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমরা আবার গাড়িতে উঠে পড়লুম। মহেশ্বর ফুকনের বাড়িতে যখন পৌঁছলুম, তখন ঠিক ন’টা বেজেছে। গাড়ি থেকে নেমে দেখলুম, সকালে যে ড্রাইভারটিকে আমাদের গাড়ি চালাতে বলা হয়েছে, সে একতলার বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির চাবি তার হাতে তুলে দিয়ে আমরা দোতলায় উঠে এলুম। মহেশ্বর ফুকনের ঘরে আলো জ্বলছে না, সম্ভবত তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমরা সদ্য আমাদের ঘরে এসে জামাকাপড় পালটে নিয়েছি, এমন সময় টোকা পড়ল। দরজা খুলে দেখি, ডোরা দাঁড়িয়ে আছেন। বললেন, “রাত্তিরে আপনারা কী খান? ভাত না রুটি?”
বললুম, “ভাদুড়িমশাই কী খাবেন জিজ্ঞেস করেছেন?”
“উনি কোনওটাই খাবেন না। বললেন, একটা ক্লিয়ার সুপ আর খুব কড়া করে সেঁকা একটা টোস্ট পেলেই সবচেয়ে ভাল হয়।”
“দ্য সেম ফর আস। কিন্তু কোনও অসুবিধে ঘটালুম না তো?”
“অসুবিধে আবার কীসের।” ডোরা হেসে বললেন, “আমার শ্বশুরমশাইয়ের জন্যে রোজ রাতে তাঁর বাবুর্চি তো স্রেফ ওই দুটি বস্তুই পরিবেশন করে। কাল রাত্তিরে অবশ্য উনি একটু অনিয়ম করেছিলেন, কিন্তু এমনিতে উনি রাত্তিরে রোজ দু’খানা টোস্ট আর এক বাটি ক্লিয়ার স্যুপ খান। আজও তা-ই খেয়েছেন।”
ডোরা চলে গেলেন। যাবার আগে বলে গেলেন, দশটায় যেন আমরা নীচে নামি।
বারান্দা থেকে আমরা ভাদুড়িমশাইয়ের ঘরে ঢুকলুম। সদানন্দবাবু বললেন, “একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলুম। অনুপমা দেবীকে ওই যে আপনি বললেন, কাল আবার খুব ভোরবেলায় আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে, সত্যিই বেরুব নাকি?…মানে আমি ভাবছিলুম যে, বড্ড বেশি দৌড়ঝাঁপ হয়ে যাচ্ছে তো, তাই একটা দিন একটু রেস্ট পেলে নেহাত মন্দ হত না।”
“তা বেশ তো,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “বিশ্রাম নিতে হয় তো নিন। সে-ক্ষেত্রে অবশ্য আপনাকে ফেলে রেখেই কিরণবাবুকে নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়ব।”
“না না,” সদানন্দবাবু বললেন, “আপনারা বেরিয়ে পড়বেন আর আমি একা বাড়িতে পড়ে থাকব, তাও কি হয় নাকি? বেরোতে যদি হয়ই, তো সবাই মিলেই বেরুব। কিন্তু যাব কোতায়?”
“কোকরাঝাড়ে, সুশান্তর বাড়িতে।”
“তার মানে?” চোখের ভুরু দুটোকে তাদের স্বাভাবিক জায়গা থেকে আধ-ইঞ্চিটাক উপরে তুলে সদানন্দবাবু বললেন, “গোবিন্দকে তো আপনি বলে এলেন, কাল আপনার ধুবড়িতেই একটা জরুরি কাজ পড়ে গেচে, তাই কোকরাঝাড়ে পরশু যাবেন।”
“আর সেটাকেই আপনি সত্যিকথা বলে ধরে নিলেন?” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আরে মশাই, আমি কি ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির যে, সব সময়ে আমাকে সত্যি কথা বলতে হবে? গোবিন্দকে আমি পরশু যাব বলেছি তো? তা হলে জেনে রাখুন যে, সেইজন্যেই আমি পরশু না-গিয়ে কাল। যাব।…আর হ্যাঁ, এখান থেকে বেরিয়ে পড়ব কিন্তু খুব ভোরবেলায়।”
জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলুম খুব ভোরবেলায় মানে ঠিক কটায়। কিন্তু তার আগেই সেল-ফোন বেজে উঠল। ভাদুড়িমশাই তাঁর পাঞ্জাবির পকেট থেকে ফোন বার করে মাউথপিসে মুখ লাগিয়ে বললেন, “হ্যালো…’
অতঃপর কিছুক্ষণ যে একতরফা কথা শুনলুম, তা এইরকম :
“হ্যাঁ, আমি ফাইভ জিরো ডবল এইট কথা বলছি।…বাঃ, তা হলে আমি প্রশ্নগুলো করি, তুমি উত্তরগুলো বলে যাও। এম.আর.সি.পি. কবে করলেন আর কার আন্ডারে করলেন?…নাইনটিন ফিফটি- থ্রি, আর ডক্টর কেলি?…এক্সেলেন্ট। সেন্ট টমাসে কবে জয়েন করলেন?…সেম ইয়ার? ফাইন। …সার্ভিস রেকর্ড?…অ্যাডভার্স কমেন্ট একটাও নেই? সবই শুধু প্রশংসা?…লাস্ট লাইনটা কী বললে?…আ ডেডিকেটেড ফিজিশিয়ান হু ওয়াজ অ্যাজ মাচ রেসপেক্টেড বাই হিজ কলিগস অ্যাজ লাভড বাই হিজ পেশেন্ট্স …ফাইন এগেন। বিয়ের তারিখ? …পনেরোই অক্টোবর নাইনটিন ফিফটিফাইভ?…অ্যাঁ, ব্রাইডের নাম সিলভিয়া বোল্টন?… আর ইউ শিয়োর বব?…রেভারেন্ডের সম্পর্কে খোঁজ নাও।…এনিওয়ে, লেট’স কাম টু আওয়ার নেক্সট কোয়েশ্চন। চাকরি ছাড়ার কারণ কী?…ইস্তফার চিঠিতে জাস্ট ‘পার্সোনাল রিজন’ ছাড়া আর কিচ্ছু বলেননি?…ঠিক আছে, ঠিক আছে…পারিবারিক জীবন সম্পর্কে কিছু জানা গেল?…কী বললে?…জোরে বলো, ডিসটারব্যান্স হচ্ছে…এইট্টিসেভেন নেলসন স্কোয়ারে একটা ছোট ফ্ল্যাট নিয়েছিলেন, কিন্তু রাত্তিরে সেখানে বড় একটা থাকতেন না, হাসপাতালে তাঁকে যে একটা সিং-বেডেড রুম দেওয়া হয়েছিল, সাধারণত সেখানেই রাত কাটাতেন, এই তো?…কিন্তু কেন? এনি এক্সট্রা-ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার? সে উইথ আ ইয়াং নার্স…? সে-সব কিচ্ছু নয়?…সো থ্যাঙ্কিউ, বব।…ও হ্যাঁ, ব্যাঙ্গালোরে ফিরেই ব্যবস্থা করব। থ্যাঙ্কস এগেন।”
কথা শেষ করে ফোনটা পকেটে পুরতে যাচ্ছেন, এমন সময় আবার সেটা বেজে উঠল। বুঝলুম, কলকাতা থেকে কৌশিক কথা বলতে চাইছে। ঠিক তা-ই। ভাদুড়িমশাইয়ের কথাগুলি এখানে তুলে দিচ্ছি :
“হ্যাঁ, আমি মামাবাবু কথা বলছি। যা-যা জোগাড় করতে পেরেছিস, বলে যা।…লিখে নিতে হবে না, মনে রাখতে পারব। তবে তুই যা-যা বলবি, আমি সঙ্গে-সঙ্গে রিপিট করব, যাতে ভুল হলে তুই শুধরে দিতে পারিস। নাউ গো অ্যাহেড।…নেবুতলার একশো সাতাশ বাই তিন কালিদাস সরকার লেনে থাকতেন।…মেডিক্ল কলেজ থেকে এম.বি. করে বিলেত যান, সেখান থেকে ফিটি এইটে দেশে ফিরে নেবুতলার পৈতৃক বাড়িতে ওঠেন।…বাবা শিবনাথ সেনগুপ্তও ডাক্তার, তবে অর্থপিশাচ বলে দুর্নাম ছিল, কলকাতায় আরও তিনটে বাড়ি করেছিলেন। তার মধ্যে দুটো বাড়ি ছোট ছেলেকে দিয়ে গেছেন। বাবা মারা যান উনিশশো একষট্টি সালে। বড় ছেলে কাশীনাথও ডাক্তার। বাবার মৃত্যুর পরে বড় ছেলেই বাবার চেম্বারে বসতে শুরু করেন। কাশীনাথও মারা গেছেন। দাঁড়া, এটা কবেকার কথা?…ঠিক আছে, নাইনটিন এইটি নাইন। থামলি কেন, বলে যা।… বিশ্বনাথও দেশে ফিরে প্র্যাকটিস শুরু করেছিলেন, তবে বাবার চেম্বারে বসতেন না। বস্তিতে-বস্তিতে বাচ্চা ছেলেদের চিকিৎসা করে বেড়াতেন। ওষুধ দিতেন। কিন্তু পয়সা নিতেন না। বস্তির লোকেরা বলত, উনি মানুষ নন, ভগবান।…বাবার কাছ থেকে যে দুটো বাড়ি পেয়েছিলেন, নাইনটিন এইট্টিতে তা বেচে দিয়ে পঁচিশ লাখ টাকা পান। তা ছাড়া, বাবার উইল অনুযায়ী নগদ আরও লাখ পাঁচেক টাকা পেয়েছিলেন। … দেশে ফিরে আর বিয়ে করেননি বিশ্বনাথ। কী বললি?…গট ইট, একটু মুডি মানুষ ছিলেন।…কলকাতা ছেড়ে বছর পাঁচেক আগে হঠাৎই একদিন হরিদ্বারে চলে যান। গত বছর সেখানেই মারা গেছেন। হোঅট? কীভাবে মারা গেলেন?…নর্মাল ডেথ, হার্ট ফেলিয়োর।…আর খবর আছে?…দাঁড়া, দাঁড়া, বড্ড ডিসটারব্যান্স হচ্ছে, মেসেজ ঠিকমতো রিসিভ করতে পারছি না।…এক কাজ কর, বাড়িতেই আছিস তো?…ঠিক আছে, এখন ছেড়ে দে, একটু বাদে আমি তোকে ফোন করছি।”
.
ভাদুড়িমশাই তাঁর ফোন পকেটে পুরে বললেন, “ক’টা বাজে দেখুন তো।”
ঘড়ি দেখে বললুম, “দশটা বাজতে পাঁচ।”
“চলুন তা হলে, একতলায় নেমে খেয়ে আসা যাক।”
“ডোরার বাবা গত বছর মারা গেছেন?”
“হ্যাঁ,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “বিশ্বনাথ সেনগুপ্ত মারা গেছেন। কৌশিক অন্তত সেই কথাই বলব। তবে তিনি ডোরার বাবা কি না, তা আমি জানি না। সম্ভবত তিনি কারওই বাবা নন।”
সদানন্দবাবু বললেন, “সে কী মশাই, তা কী করে হয়?”
প্রশ্নের জবাব না-দিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “চলুন চলুন, ডাইনিং হলের কাজটা চুকিয়ে আসা যাক। দোতলায় ফিরে এসে আবার ফোন করতে হবে।”
হালকা ডিনার। শেষ করতে মিনিট দশের বেশি লাগল না। তারই মধ্যে ভাদুড়িমশাই ডোরাকে জানিয়ে রাখলেন যে, কাল ভোর পাঁচটায় আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ব, দুপুরে এখানে লাঞ্চ করব না, পথে কোথাও খেয়ে নেব, ফিরতে-ফিরতে সন্ধে হয়ে যাবে। ড্রাইভার দরকার হবে না, তবে গাড়িটা কাল সারা দিনের জন্যে চাই।
শুনে ডোরা বললেন, গাড়ি নিয়ে ভাবতে হবে না, রাত্তিরেই তিনি বলে রাখবেন যাতে গাড়ি তৈরি থাকে। খাওয়া আর কথাবার্তা শেষ করে সাড়ে দশটার আগেই আমরা দোতলায় উঠে ভাদুড়িমশাইয়ের ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিলুম। ভাদুড়িমশাইও আর দেরি না করে পকেট থেকে ফের বার করলেন তাঁর সেল-ফোন। শুরু হল কৌশিকের সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয় দফার কথাবার্তা। এদিক থেকে ভাদুড়িমশাই যে-ভাবে সেই আগের মতোই যা শুনছেন তা রিপিট করে যেতে লাগলেন, তাতে কৌশিক কী বলছে তা বুঝতে কোনও অসুবিধে হল না। ভাদুড়িমশাইয়ের কথা এখানে তুলে দিচ্ছি :
“কৌশিক, আমি মামাবাবু কথা বলছি। এই পর্যন্ত বলেছিস যে, বিশ্বনাথ সেনগুপ্ত গত বছর হরিদ্বারে মারা গেছেন। তারপরে আর কী জেনেছিস, বলে যা।…কী বললি?…বাড়ি বিক্রি করে যে-টাকা পেয়েছিলেন আর বাবা যে নগদ টাকা দিয়ে যান, দুটো মিলিয়ে লাখ তিরিশেক টাকা তিনি ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপজিট করেন, সেই টাকার সুদ মাসে-মাসে তাঁর সেভিংস অ্যাকাউন্টে জমা পড়ত। তারপর?…সুদের টাকার অঙ্কটা যে কম নয়, সে তো বুঝতেই পারছি, তো তার যৎসামান্য একটা অংশ দিয়ে তিনি নিজের খরচ-খর্চা চালাতেন, আর বাদবাকি অংশ ব্যয় করতেন বস্তির গরিব ছেলেমেয়েদের জন্যে। তারপর বলে যা।…মরার আগে উইল করে গেছেন বললি, সেটা কার কাছে রয়েছে?…অ্যাটর্নি বিমলচন্দ্র ব্যানার্জির কাছে? ভালো। ভদ্রলোককে আমি চিনি, হি ইজ অ্যান আপরাইট ম্যান। তা উইলের বিষয়ে কিছু শুনলি?…বলিস কী? ফিক্সট আর সেভিংস অ্যাকাউন্ট মিলিয়ে বত্রিশ লাখ টাকার অর্ধেক দিয়েছেন কলকাতার এক শিশু-হাসপাতালে আর বাকিটা এক ইংরেজ মহিলাকে?…কী বললি? কন্যাসমা?… অ্যাটর্নি-আপিস থেকে মহিলার খোঁজ করা হচ্ছে, কিন্তু বিশ্বনাথ সেনগুপ্ত তাঁর যে ঠিকানার কথা বলে গিয়েছেন, সেখানে তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে না?…ঠিক আছে, দ্যাটস অল ফর টু-ডে। কাল আবার এই সময়ে ফোন করব।”
ফোনটা ফের পকেটে ঢুকিয়ে ভাদুড়িমশাই স্বগতোক্তির মতন করে বললেন, “কন্যাসমা! তার মানে সবই বুঝতে পেরেছিলেন!”
বললুম, “বিশ্বনাথ তো সত্যিই দেখছি অন্য রকমের মানুষ!”
ভাদুড়িমশাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “অ্যাঁ?”
বুঝলুম, এখন আর কোনও কথা বলে লাভ হবে না। সদানন্দবাবুকে নিয়ে নিজেদের ঘরে চলে এলুম।