আংটি রহস্য – ১৪

১৪

আমরা যে এখান থেকে এগারোটার মধ্যেই বেরিয়ে পড়তে চাই, ডোরাকে সে-কথা জানিয়ে আমরা আমাদের ঘরে চলে আসি। ঘরে ঢুকে ভাদুড়িমশাই দরজা ভেজিয়ে দিলেন। তারপর হ্যান্ডব্যাগ থেকে তাঁর সেলুলার ফোন বার করে বললেন, “বব-এর সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার।”

বললুম, “বব কে?”

“রবার্ট স্টুয়ার্ট। লন্ডনে আমাদের আপিস নেই, ফলে হোলটাইমার এজেন্টও নেই। হঠাৎ-হঠাৎ কাজ পড়ে গেলে ববই সেটা করে দেয়। তবে স্ট্রিংগার হলেও আ ভেরি সিনসিয়ার অ্যান্ড হার্ড-ওয়ার্কিং ম্যান।…ক’টা বাজে বলুন তো।”

হাতঘড়িটা দেখে নিয়ে বললুম, “দশটা।”

“লন্ডন তো আমাদের থেকে সাড়ে চার ঘন্টা পিছিয়ে,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তার মানে ওখানে এখন সাড়ে পাঁচটা বাজে। আনআর্থলি আওয়ার, ব্যাটার এখনও ঘুমই হয়তো ভাঙেনি। তবু দেখা যাক।”

ডায়াল করার মিনিট খানেক বাদে ওদিক থেকে সাড়া পাওয়া গেল। তারপর, ওদিক থেকে বব স্টুয়ার্ট কোন কথার জবাবে কী বলছেন, তা তো আর শুনতে পাওয়া গেল না, তাই ভাদুড়িমশাই এ-দিক থেকে যা-যা বলে গেলেন, শুধু সেইটুকুই এখানে দিচ্ছি :

“কোড নাম্বার ফাইফ জিরো ডাবল এইট।…হ্যাঁ, আমি ভাদুড়ি বলছি।…খুব দুঃখিত, কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমার ঘুম না-ভাঙিয়ে উপায় ছিল না। …হ্যাঁ, একটা খবর চাই।…ভীষণ জরুরি।… বিশ্বনাথ সেনগুপ্ত…রিপিট বিশ্বনাথ সেনগুপ্ত নামে একজন ডাক্তারের সম্পর্কে যতটা সম্ভব ব্যাকগ্রাউন্ড মেটিরিয়াল জোগাড় করে আমাকে জানাও।…বলছি, বলছি। বিশ্বনাথ সেন্ট টমাস হসপিটালের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফিফটি এইটে কাজ ছেড়ে দিয়ে ইন্ডিয়ায় ফিরে আসেন।…তোমাকে জানতে হবে তাঁর সার্ভিস রেকর্ড কেমন ছিল, তিনি ওদেশে বিয়ে করেছিলেন কি না, করলে সেটা কবে করেছিলেন, বিয়ের পর তাঁর সন্তান হয়েছিল কি না, যদি হয়ে থাকে তো কবে হয়েছিল, আর হ্যাঁ, চাকরিটা তিনি কবে ছাড়লেন ও কেন ছাড়লেন।…বব, আমি বুঝতে পারছি যে, তোমার চটে যাওয়ার কারণ আছে, কিন্তু প্লিজ কাজটা যত তাড়াতাড়ি পারো করে দাও।…আহ্, দ্যাট’স লাইক আ রিয়াল ফ্রেন্ড। সো প্লিজ গো টু সেন্ট টমাস অ্যাজ সুন অ্যাজ পসিবল। আর হ্যাঁ, যদি পারো তো গ্লস্টার রোডে পেডিয়াট্রিক সেন্টারে ডঃ আর্থার কেলির সঙ্গেও একবার দেখা কোরো, হি মে গিভ ইউ সাম ডোপ অন দিস ম্যান।…অফ কোর্স আই নো ইট’স আ টল অর্ডার, চল্লিশ বছর আগের ঘটনা, খোঁজ-খবর করাটা নেহাত চাট্টিখানি ব্যাপার নয়, বাট বব, হোয়ট এল্স কুড আই ডু…হবে, হবে, ডাবল হয়তো এক্ষুনি হবে না, তবে যতটা সম্ভব বাড়িয়ে দেব ঠিকই…ওয়েল, থ্যাঙ্কস আ লট…বাই।”

ফোনটা অফ করে দিয়ে ভাদুড়িমশাই আমাদের দিকে তাকাতেই সদানন্দবাবু বললেন, “মাইনে বাড়াবার কতা বলছিল, তাই না?”

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “মাইনে তো নয়, রিটেইনার হিসেবে মাস-মাস কিছু দিতে হয়, তা ছাড়া যখন যে-কাজ করবে…এই ধরুন এখন যে কাজটা দিলুম, তার জন্যে আলাদা। তা রিটেইনারের অঙ্কটা বাড়াতে হবে বই কী।…দাঁড়ান, এ নিয়ে পরে কথা বলব, এখন নীচে নামার আগে আর-একটা ফোন করতে হবে।”

কথাটা বলেই ফের সেল-ফোনে ডায়াল করে, কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে, বললেন, কৌশিক? আমি তোর মামাবাবু বলছি, একজন ডাক্তার সম্পর্কে একটু খোঁজ নিতে হবে। নাম বিশ্বনাথ সেনগুপ্ত, বয়েস এখন বছর সত্তরেক হবে। এককালে লন্ডনে ডাক্তারি করতেন, ফিফটি এইটে নাকি সেখানকার চাকরি ছেড়ে দিয়ে দেশে ফিরে যান।…বলছি, বলছি। খোঁজ নিবি ×, ভদ্রলোক এখন বেঁচে থাকেন তো এই মুহূর্তে কোথায় আছেন, কী করছেন, আর হ্যাঁ, দেশে ফিরে বিয়ে করেছিলেন কি না। ভদ্রলোকের এখনকার ঠিকানা জোগাড় করাটা খুব জরুরি।…এক্ষুনি কাজে লেগে যা। টেলিফোন ডাইরেক্টরি দ্যাখ, সেখানে না পেলে গেট ইন টাচ উইথ ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন। কিছু জানতে পারলেই আমাকে জানাবি। মোবাইল নাম্বারে ফোন করবি, তার কারণ সারাক্ষণ আমাকে এখন দৌড়ঝাঁপ করতে হবে, কখন কোথায় থাকি, তার ঠিক নেই। ছেড়ে দিচ্ছি।” ভাদুড়িমশাই তাঁর সেল-ফোন ফের হ্যান্ডব্যাগে পুরে ফেললেন। তারপর বললেন, “ডোরা যে কাজের ভার দিয়েছে, সেটা তো শুরু হয়ে গেল।”

সদানন্দবাবু বললেন, “একটা কতা জিজ্ঞেস করব?”

“স্বচ্ছন্দে।”

“এ-ফোনের খরচা তো শুনিচি আমাদের অর্ডিনারি ফোনের চেয়ে বেশি। সেটা ঠিক কতা?”

ষোলো অনা ঠিক। কিন্তু সুবিধেও অনেক বেশি যে। গাড়ি চালাতে-চালাতে ফোন করতে পারছেন, অর্ডিনারি ফোনে কি সেটা সম্ভব হত?”

“তা তো জানি। মানে আমার এক ভায়রা-ভাইয়ের ছেলে, বড় চাকরি করে, সিঙ্গাপুর না কোতাকার একটা কোম্পানির ক্যালকাটা-আপিসের সেলস ডিপার্টমেন্টের কর্তা, তাকে ওই রকমের একটা ফোন পকেটে নিয়ে ঘুরতে দেকি, গাড়ি থেকে ফোন করে বাড়ির সঙ্গে কতা কয়, তো তা-ই দেকে আমারও ইচ্ছে হয়েছিল যে…”

সদানন্দবাবু কথাটা শেষ করলেন না। বললুম, “কী ইচ্ছে হয়েছিল? ওই বস্তু পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াবার?”

“সেটা পারলে তো মন্দ হত না।” সদানন্দবাবু বললেন, “মানে বয়েস হয়েচে তো, অনেক কতাই ভুলে যাই, ফলে নিত্যি বাজার করে ফিরে এসে ওয়াইফের বকুনি খেতে হয়। তাই ভাবছিলুম, একটা সেলুলার ফোন থাকলে বাজার করতে করতেই ওয়াইফকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে পারতুম যে, পাতিনেবু তো কিনিচি, সেই সঙ্গে কাঁচানঙ্কাও কি কিনতে হবে? কী ধরুন, এক ফালি নাউ যখন নিয়েচি, তখন সেই সঙ্গে দেড়শো গ্রাম কুচো-চিংড়িও নেব কি না।”

“তা একটা কিনে ফেললেই তো হয়।”

“বাপ রে,” সদানন্দবাবু বললেন, “খর্চার ধাক্কাটা কোত্থেকে সামলাব? তা ভাদুড়িমশাই, এই যে আপনি টকাটক দুটো ফোন করে ফেললেন, এর খর্চাটা কে দেবে? আপনি?”

“পাগল হয়েছেন? তা হলে তো আমি ফতুর হয়ে যাব।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “যিনি ফতুর হবেন না, তিনি দেবেন। অর্থাৎ এক্ষেত্রে মিঃ মহেশ্বর ফুকন দেবেন।

“সত্যি তিনি দেবেন তো?”

“আলবাত দেবেন। তাঁর বেয়াইমশাইকে খুঁজে বার করার জন্যে ফোন করতে হল, আর তার খর্চা তিনি দেবেন না?”

বাইরে টোকা পড়ল। দরজা খুলে দেখি ডোরা। বললেন, “লাঞ্চ রেডি।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি। তার মধ্যে জামাকাপড় পালটে নীচে নামুন।… ও হ্যাঁ, যে যার হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে নামবেন। রাত্তিরে হয়তো এ-বাড়িতে আর নাও ফিরতে পারি।”

তৈরি হয়ে নীচে নামতে পাঁচ মিনিটই লাগল। খাওয়া শেষ হতে-হতে ঠিক এগারোটা। গাড়ি তৈরিই ছিল। এ-বাড়ির অ্যাম্বাসাডর। এ-বাড়ির ড্রাইভার। আমি আর ভাদুড়িমশাই, দুজনেই গাড়ি চালাতে পারি। তাই ড্রাইভারটিকে আর সঙ্গে নেওয়া হল না। হ্যান্ডব্যাগ তিনটিকে ডিকিতে তুলে দেওয়া হল। তার আগে ভাদুড়িমশাই অবশ্য তাঁর হ্যান্ডব্যাগ থেকে সেল-ফোনটিকে বার করে পকেটে পুরতে ভুললেন না। এগারোটা পাঁচে আমরা মহেশ্বর ফুকনের বাড়ির গেট পেরিয়ে রাস্তায় নেমে পড়লুম।

প্রথমেই গেলুম কেদারেশ্বরের বাড়িতে। অনুপমা দেবী সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, গাড়ি থেকে আমাদের নামতে দেখে হেসে বললেন, “আসুন। ডোরা একটু আগেই ফোন করে আপনাদের রওনা হবার কথা জানিয়েছে।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কেদার কেমন আছে?”

“ওই একই রকম। জ্বর ছাড়েনি, কাসিটাও আছে, তবে আপনাদের সঙ্গে যেতে পারবেন।”

“চলুন, ওকে একবার দেখে আসি।”

বলতে-না-বলতে, সম্ভবত ভিতর থেকেই ভাদুড়িমশাইয়ের গলার আওয়াজ পেয়ে থাকবেন, কেদারেশ্বর বাইরে বেরিয়ে এলেন। ধোপদুরস্ত পোশাক দেখে মনে হল, তিনিও যাবার জন্য তৈরি। ভদ্রলোকের কথা শুনে বুঝলুম, ভুল অনুমান করিনি। বললেন, “খবর পেয়েছি যে, তোমরা ও-বাড়ি থেকে একেবারে খেয়ে বেরিয়েছ। সেটা ভালই করেছ। কিন্তু তা হলে আর দেরি করে লাভ কী। চলো, চারুদা, বেরিয়ে পড়া যাক।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “দাঁড়াও, দাঁড়াও, অত তাড়াহুড়ো কোরো না। তোমার জ্বর এখন কত?”

“একটু আগে টেম্পারেচার নিয়েছি, নিরানব্বুই পয়েন্ট আট।”

“সেটাকে বাড়িয়ে লাভ নেই। তা ছাড়া মাঝে-মাঝেই তো কাসছও। না হে, তোমার এখন বিশ্রাম দরকার। অন্তত আজকের দিনটা চুপচাপ শুয়ে থাকো।”

“যাচ্চলে!” কেদারেশ্বর বললেন, “আমি যদি শুয়ে থাকি তো তোমাদের পথ দেখিয়ে কে নিয়ে যাবে? ও-বাড়ি থেকে একটা গাড়ি তো নিয়ে এসেছ, সেই সঙ্গে একজন ড্রাইভারও যদি নিয়ে আসতে, তা হলেও না হয় বুঝতুম, সে-ই তোমাদের কোকরাঝাড়ে সুশান্তর বাড়িতে নিয়ে যেতে পারত। কিন্তু তাও তো আনোনি দেখছি।”

“ও নিয়ে ভেবো না,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিরণবাবু এদিককার রাস্তাঘাট বেশ ভালই চেনেন, উনিই আমাদের কোকরাঝাড়ে নিয়ে যাবেন। তারপর একে-ওকে জিজ্ঞেস করে সুশান্তর বাড়িটাও ঠিক চিনে নিতে পারব।…যাও, জ্বর-গায়ে তুমি আর দাঁড়িয়ে থেকো না, শুয়ে পড়ো গিয়ে।”

কেদারেশ্বরকে জোর করে ভিতরে পাঠিয়ে দিয়ে আমরা গাড়িতে এসে উঠলুম। ইগনিশন কি ঘুরিয়ে এঞ্জিন স্টার্ট করে বাঁ পাশের সিটে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললুম, “এখন আমিই চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, ফেরার পথে বরং আপনি চালাবেন।”

একটা গাড়ির কলকব্জা ঠিক আছে কি না, এঞ্জিনের শব্দ থেকেই সেটা মোটামুটি বুঝে নেওয়া যায়। মনে হল, মহেশ্বর ফুকনের এই গাড়িটা একেবারে নিখুঁত কন্ডিশনে আছে। ভাদুড়িমশাইকে সে-কথা বলতে তিনি বললেন, “তেলটা দেখে নিয়েছেন তো?”

বললুম, “তেলের কাঁটা কীভাবে পুরোপুরি ঘুরে গেল, দেখলেন না? ট্যাঙ্ক ভর্তি!”

জেলা-সদরের রাস্তা। তার উপরে কাজের দিন। লোকজন হাঁটাচলা করছে, গাড়িঘোড়াও নেহাত কম নয়। তাই খুব সাবধানে এগোতে হচ্ছিল, স্পিড তোলা যাচ্ছিল না। সেটা একটু তোলা গেল শহরের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে আরও খানিকটা পথ পেরিয়ে গৌরীপুরে পৌঁছে। বললুম, “বাঁ দিকের রাস্তা ধরে খানিক এগোলেই প্রমথেশ বরুয়ার বাড়ি।”

পিছনের সিট থেকে সদানন্দবাবু বললেন, “বলেন কী! মানে দেবদাস, মুক্তি, এইসব বই যাঁর তোলা, তাঁর কতাই বলচেন তো?”

“তা ছাড়া আর কার কথা বলব। প্রমথেশ বরুয়া কি দুটো হয় নাকি?”

“তা হলে তো বাড়িটা একবার দেকে গেলে হত। কলকাতায় ফিরে আমার ওয়াইফকে একটা মস্ত বড় এক্সপিরিয়েন্সের কতা বলতে পারতুম।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “এখন থাক বোসমশাই। আগে বরং হাতের কাজটা মেটাই। তারপর সময় থাকলে ফিরতি পথে এক্সপিরিয়েন্স গ্যাদার করবেন।”

বিলাসীপাড়া ছাড়াবার পর পথ একেবারে ফাঁকা। হাইওয়ের অবস্থাও মোটামুটি ভাল। তেলের মতো রাস্তা হয়তো নয়, তবে খানাখন্দও নেই, এদিককার রাস্তার এখনও হাড়পাঁজরা বেরিয়ে পড়েনি। স্পিড বাড়িয়ে দিয়ে,কোকরাঝাড়ের বর্ডারে পৌঁছতে আমাদের খুব একটা সময় লাগল না। বর্ডারে যে চেকিং হচ্ছে তার ধকলও এ-যাত্রায় খুব অল্পেই মিটে গেল। গাড়ি থামাতে রাস্তার পাশের তাঁবু থেকে সিকিওরিটির যে-লোকটি বেরিয়ে এল, সে ডিকিটা পর্যন্ত খুলে দেখল না। আমার ড্রাইভিং লাইসেন্সটার উপরে চোখ বুলিয়ে, মামুলি দু’-একটা প্রশ্ন করে, দায়সারা ভাবে গাড়ির ভিতরটা একবার দেখে নিয়ে বিরক্ত গলায় বলল, “আগে বাড়ো।”

বাঁদিকের পাহাড় যেখানে হাইওয়ের খুব কাছাকাছি এসে পড়েছে, সেখানেও বেশ তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেলুম। কেদারেশ্বর বলেছিলেন, সুশান্তর বাড়ি হাইওয়ের ধারেই। বাড়িটার একটা বর্ণনাও তিনি দিয়েছিলেন। মুশকিল হল এই যে, তাঁর বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায়, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে হাইওয়ের ধারে অমন কোনও বাড়ি আমাদের চোখে পড়ল না। কিন্তু আজ তো সবকিছুই একেবারে মসৃণভাবে চলেছে। তাই স্থানীয় দু’-চারজন লোককে জিজ্ঞেস করে বাড়ির হদিশও পাওয়া গেল। আসলে কেদারেশ্বরের বলে দেওয়া উচিত ছিল, বড়-বড় কয়েকটা শাল আর সেগুন গাছের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাওয়ায় হাইওয়ের পাশের একটা ঢালু রাস্তা ধরে শ’খানেক ফুট উপরে উঠতে হয়। রাস্তাটা দশ ফুটের বেশি চওড়া হবে না, কিন্তু পাহাড়িয়া রাস্তা হলেও ঢালটা যেহেতু মোটামুটি মসৃণ, তাই আর আমাদের হেঁটে উঠতে হল না, ফার্স্ট গিয়ারেই গাড়ি চালিয়ে আমরা বাড়ির সামনের সমতল জমিতে পৌঁছে গেলুম।

একেবারে ছবির মতো বাড়ি। পিকচার-কার্ডে ইয়োরোপের গ্রামাঞ্চলের যে লাল টালির ঢালু ছাতের আষ্টেপৃষ্ঠে আইভিলতা-জড়ানো, পরিপাটি বাগানওয়ালা বাড়ি আমরা সবাই দেখেছি, একেবারে সেই রকম। আইভিলতার জালে এ-বাড়ি বাঁধা পড়েনি বটে, কিন্তু বেগনোলিয়া ভ্যানেস্তার হলুদ শোভা এ-বাড়ির ছাত পর্যন্ত উঠে গেছে। সামনে লনের চারধারে ফুটে আছে হরেক রঙের মরসুমি ফুল। লনের ঘাসও একেবারে পরিপাটি করে ছাঁটা। কেন যে সুশান্ত চৌধুরি তাঁর এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে চাইতেন না, সেটা আন্দাজ করা শক্ত নয়, এমন চমৎকার আস্তানা পেলে বোধহয় ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসও তাঁর উঠোনের বাইরে পা বাড়াতেন না।

কিন্তু মুগ্ধ হয়ে যে মিনিট খানেক এই বাড়িটির দিকে তাকিয়ে থাকব, তার জো কী। গাড়ি আসার শব্দ পেয়েই বাড়ির ভিতর থেকে একটা কুকুর অতি গম্ভীর গলায় ডাকতে শুরু করেছিল। ডাকের বহরেই বুঝতে পেরেছিলুম যে, এর সাইজ নেহাত কম হবে না; তা ছাড়া এর মেজাজও খুব প্ৰসন্ন নয়।

ঘরপোড়া গোরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়। এই প্রবাদবাক্যটি যে মিথ্যা নয়, সেটা বোঝা গেল সদানন্দবাবুকে দেখে। একে তিনি নিজেই একবার মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে গোলদিঘির কাছে পাগলা কুকুরের কামড় খেয়েছিলেন, তার জন্যে তাঁকে লম্বা ছুঁচের ইঞ্জেকশনও নিতে হয়েছিল বেশ কয়েকটি, তার উপরে আবার গতকালই তিনি শুনেছেন যে, সুশান্ত চৌধুরির খবর নিতে এসে মাত্র তিন-চার দিন আগে এই বাড়িতেই কেদারেশ্বরকে কুকুরের কামড় খেতে হয়েছে। ফলে তিনি আর কালক্ষেপ করলেন না, মাটিতে পা রেখেছিলেন বটে, কিন্তু কুকুরের ডাক কানে যেতেই ফের গাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লেন।

তার একটু বাদেই বাড়ির ভিতর থেকে কুচকুচ কালো লোমে ঢাকা বিশাল একটি কুকুর সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে এল ডোরাকাটা নীল লুঙ্গি ও সাদা ফতুয়া পরা একটি লোক। পক্ককেশ লোকটির বয়স মনে হল পঁয়ষট্টি থেকে সত্তরের মধ্যে হবে, তবে শরীর এখনও শক্ত সমর্থ। কুকুরের গলায় বকলস পরানো, বকলসের চেন লোকটির হাতে, কিন্তু আমাদের দেখবামাত্র কুকুরটি যে-ভাবে দাঁত বার করে লম্ফঝম্প শুরু করে দিল, তাতে মনে হল, চেন যদিও লোকটির হাতে, এই ভয়ংকর প্রাণীটিকে খুব বেশিক্ষণ সামলে রাখা তার পক্ষে হয়তো সম্ভব হবে না, আর কোনওক্রমে একবার যদি ছাড়া পায় তো তক্ষুনি এই কুকুর এসে আমাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কথাটা মনে হওয়া মাত্র আমি তিন-পা পিছিয়ে এলুম!

ভাদুড়িমশাই কিন্তু এক পাও নড়লেন না। বললেন, “তুমি গোবিন্দ?”

অপরিচিত মানুষের মুখে নিজের নাম শুনে লোকটি সম্ভবত একটু বিস্ময় বোধ করে থাকবে। ভুরু কুঁচকে বলল, “আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু আপনাদের তো চিনতে পারলাম না।”

“আমরা সুশান্তবাবুর বন্ধু, কলকাতা থেকে এসেছি। তবে এখন আসছি ধুবড়ির কেদারেশ্বরবাবুর কাছ থেকে। তোমার কাছে দু’-একটা খবর জানতে চাই। কিন্তু তোমাদের কুকুর যা চেঁচাচ্ছে, তাতে তো কথাবার্তা বলা সহজ হবে না। যাও, আগে তুমি কোথাও ওকে বেঁধে রেখে এসো, তারপর কথা হবে।”

কী যে ছিল ভাদুড়িমশাইয়ের গলার স্বরে আর কথা বলার ভঙ্গিতে, জানি না। সম্ভবত সেই শান্ত কর্তৃত্ব ছিল, ভৃত্যস্থানীয় লোকেরা যা খুব সহজেই শনাক্ত করতে পারে, আর শনাক্ত করার পরে হুকুম তামিল করতে কিছুমাত্র দেরি করে না। গোবিন্দও দেরি করল না। বলল, “আপনারা ভিতরে এসে বসুন। জুজুকে আমি বেঁধে রাখছি, ও কোনও ঝামেলা করবে না।”

আমি বললুম, “কুকুরের নাম জুজু? বলো কী! তা ঠিক আছে, আগে তুমি তোমার জুজুকে কোথাও বেঁধে রেখে এসো, তারপর আমরা ভিতরে ঢুকব।”

গোবিন্দ আর কথা বাড়াল না, কুকুর নিয়ে ভিতরে চলে গেল; তারপর মিনিট দুয়েক বাদে বেরিয়ে এসে বলল, “আসুন।”

আমরা ভিতরে ঢুকলুম। ঢুকে পড়লেন সদানন্দবাবুও। নিঃশব্দে কখন গাড়ি থেকে নেমে তিনি আমাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন, তা আমি টেরই পাইনি।

কুকুরটিকে গোবিন্দ যে কোথায় বেঁধে রেখে এসেছে, জানি না। তবে তার হাঁকডাক ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

এ-বাড়ির ভিত ইঁট দিয়ে গাঁথা হলেও মেঝের সবটাই যে পালিশ-করা কাঠের, ভিতরে ঢুকেই তা বুঝতে পেরেছিলুম। বসবার ঘরটি নেহাত ছোট নয়, কিন্তু আসবাবপত্রের বাহুল্য না থাকায় প্রকৃত আয়তনের চেয়ে আরও বড় দেখায়। একদিকের দেওয়াল জুড়ে টানা বইয়ের র‍্যাক। তাতে বাংলা বই যেমন প্রচুর চোখে পড়ল, তেমনি ইংরেজি বইয়ের সংখ্যাও দেখলুম কম হবে না। অন্য দিকের দেওয়ালের সামনে গোল একটি সেন্টার টেবিলকে ঘিরে খান পাঁচ-ছয় লেদার-চেয়ার। তা ছাড়া এ-ঘরে আর কোনও আসবাব নেই। তবে যেটুকু যা আছে, সবই ঝকঝক করছে। দেওয়ালের কোথাও একটু ঝুল কিংবা আলমারি আর চেয়ার-টেবিলের কোথাও এক ফোঁটা ধুলোবালি আমার চোখে পড়ল না।

যদিও ভিতরে ঢুকেছিলেন, তবু—সম্ভবত জুজুর ভয়েই—সদানন্দবাবু আর নড়াচড়া করতে চাইছিলেন না। তাঁকে তাই বাইরের ঘরে বসিয়ে রেখে গোবিন্দকে সঙ্গে নিয়ে আমরা গোটা বাড়িটার উপরে একবার চোখ বুলিয়ে এলুম। বাইরের ঘরের পিছনে পাশাপাশি দুটি বেডরুম। গোবিন্দ বলল, তার একটায় সুশান্ত থাকেন, অন্যটা গেস্ট-রুম। “কেদারবাবু তো আগে প্রায়ই এ-বাড়িতে আসতেন, তখন তাঁকে ওই ঘরটা ছেড়ে দেওয়া হত। আজকাল অবিশ্যি ঘরটা খালিই পড়ে থাকে, বড়-একটা তিনি আসেন না।” গোবিন্দ নিজে কোথায় থাকে, তাও দেখলুম। বাড়ির পিছনে পাশাপাশি দুটি ঘরের একটি আলাদা ইউনিট। তার একটায় গোবিন্দ থাকে। অন্যটা কিচেন।

সুশান্তর শোবার ঘরে একটা সিংগল খাট ও জামাকাপড় রাখার একটা আলমারি ছাড়া ঘরের এককোণে ছোট-সাইজের একটা পিয়ানো চোখে পড়ল। কেদারেশ্বরের কাছে শুনেছি সুশান্ত মাঝে-মাঝে পিয়ানো বাজাতেন। পিয়ানোর ডালা তুলে ভাদুড়িমশাই তার রিডগুলোর উপরে দ্রুত একবার আঙুল চালালেন। যে আওয়াজ বার হল, তাতে আমার মতো গোলা লোকেরও বুঝতে অসুবিধা হল না, যে, স্বর-সংগতিতে কোথাও কিছু-একটা গণ্ডগোল ঘটছে। গোবিন্দর দিকে তাকিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “পিয়ানোটা তো মেরামত করা দরকার, সুশান্তবাবু কিছু বলেননি?”

শুনে গোবিন্দ বলল, “কই, না তো। খোকাবাবু যেদিন নিখোঁজ হন, তার আগের দিন রাত্তিরেও তো অনেকক্ষণ এটা বাজিয়েছিলেন।”

“তার পরে তো মাস-খানেক কেটে গেল,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এর মধ্যে হয়তো ধুলো-ময়লা জমে থাকবে। যা-ই হোক, চলো, এবারে বসবার ঘরে ফিরে যাওয়া যাক।”

শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে গেস্ট-রুমেও একবার উঁকি মারলুম। সিংগল খাটের বদলে এখানে একটা ডবল-খাট, আর জামাকাপড় রাখার একটা আলমারি ছাড়া অন্য-কিছুই নেই। বোঝা যায় যে, বাড়ির মালিক আসবাবপত্রের বাহুল্যে বিশ্বাস করতেন না। যে দু-একটি জিনিস না-হলেই নয়, বাড়িতে শুধু তা-ই তিনি রেখেছেন।

বসবার ঘরে ঢুকে দেখলুম, সদানন্দবাবু ইতিমধ্যে র‍্যাক থেকে বেশ মোটাসোটা একটি বই নামিয়ে নিয়েছেন। বইয়ের নামটাও চোখে পড়ল: ‘হোয়ট ইউ শুড নো অ্যাবাউট ইয়োর ডগ’। সদানন্দবাবু অবশ্য পড়ছিলেন না, ছবি দেখছিলেন। আমরা ঘরে ঢুকতে বইখানি আবার যথাস্থানে রেখে এসে বললেন, “ন্যাজকাটা একটা বুলটেরিয়ারের ছবির নীচে কী ক্যাপশান লিকেচে জানেন? লিকেচে যে, কুকুরের ন্যাজ কেটে দিলে তার মেজাজ বিগড়ে যায় আর তার পার্সোনালিটির খেতি হয়। বুজুন ব্যাপার, কুকুরের পার্সোনালিটি! এ তো ভাবাই যায় না।”

গোবিন্দ বলল, “আমি কি আপনাদের জন্যে একটু চা করে আনব?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিচ্ছু দরকার নেই। তুমি বরং একটু বোসো, আমরা তোমার কাছ থেকে কয়েকটা কথা জেনে নিই।”

“কী জানতে চান বলুন।”

“সুশান্তবাবুর খোঁজ কবে থেকে পাওয়া যাচ্ছে না?”

“গত মাসের বারো তারিখের সকাল থেকে।” গোবিন্দ বলল, “যেমন রোজ যান, সেদিনও তেমনি ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন, তার পরে আর ফিরে আসেননি।”

“খোঁজ করেছিলে?”

“প্রথমে কাজের লোকেরা পাহাড়ে উঠে খোঁজ করেছিল। আমিও তাদের সঙ্গে ছিলাম। কিন্তু তাঁর খোঁজ পাইনি। এমনকী তাঁর কোনও জিনিস, এই ধরুন ছেঁড়া জামা কি চশমা কি রুমাল, না, তাও দেখতে পাইনি কোথাও। তখন পাহাড় থেকে নীচে নেমে কেদারবাবুকে ফোন করি, থানায় গিয়ে পুলিশে খবর দিই, পরে তো কেদারবাবু গৌহাটিতে গিয়ে কাগজে-কাগজে বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলেন। কিন্তু না, কেউ কোনও খবর দিতে পারল না।”

“এই যে একটা মাস গেল, এর মধ্যে তিনি একটা ফোনও করেননি কি একটা চিঠিও লেখেননি তোমাকে?”

“না বাবু,” গোবিন্দ ম্লান হেসে বলল, “ফোন করলে কি চিঠি লিখলে আমি কেদারবাবুকে তক্ষুনি সে-কথা জানাতাম।”

“ঠিক আছে, গোবিন্দ,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এবারে তা হলে আমরা উঠব।”

কোথাও একটা কুকুর ডাকল। মনে হল, জুজু নয়, অন্য কোনও কুকুর।

চেয়ার ছেড়ে উঠেও আবার বসে পড়লেন ভাদুড়িমশাই। বললেন, “ও হ্যাঁ, এখন মনে হচ্ছে একটু চা পেলে মন্দ হত না। ঠিক আছে, তা হলে বরং চাটা খেয়েই যাই। কিন্তু খুব বেশি দেরি হবে না তো?”

“না, না, দেরি হবে কেন, আপনারা বসে কথা বলুন, এক্ষুনি আমি চা করে আনছি।”

“আর হ্যাঁ, একটা কথা মনে রেখো, গোবিন্দ। আমরা কিন্তু খুব হালকা চা খাই।”

“বেশ তো,” দরজার কাছ থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে গোবিন্দ বলল, “তিন কাপ জলে কতটা চা দেব, বলে দিন।”

“চলো, আমি তোমাকে দেখিয়ে দিচ্ছি।”

গোবিন্দর সঙ্গে ভাদুড়িমশাইও ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ফিরে এলেন মিনিট তিনেক বাদে। এসে বললেন, “এ হল আসামের চা, তিন কাপ হালকা চা বানাতে এর এক চামচই যথেষ্ট। তাও জল ফুটিয়ে তাতে চায়ের পাতা দিয়ে এক মিনিটের বেশি ভেজানো চলবে না। তারপরেই কাপে ঢেলে ফেলতে হবে। গোবিন্দকে সেটা বেশ ভাল করে বুঝিয়ে দিয়ে এলুম। সেই সঙ্গে কিচেন থেকে এখানে আসার পথে সুশান্তর শোবার ঘরটাও আর-একবার দেখে আসা গেল।”

আরও মিনিট তিনেক বাদে ট্রে’তে তিন কাপ চা নিয়ে গোবিন্দ এসে বলল, “দেখুন, আপনাদের পছন্দ-মতো হল কি না।”

ট্রে থেকে কাপ তুলে নিলুম আমরা। নিজের কাপে আলতো একটা চুমুক দিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “চমৎকার হয়েছে।…শোনো গোবিন্দ, তোমার সঙ্গে সব কথা আজ হল না, তাই আর-একবার আসতে হবে। তবে কাল নয়, আমরা তো এখন ধুবড়িতে কেদারবাবুর বাড়িতে আছি, কাল সেখানে একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে। তাই পরশু আসব।”

চা খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। কাপগুলোকে ট্রের উপরে নামিয়ে রেখে আমরা উঠে পড়লুম।