১৩
কাগজের মোড়ক খুলতে যা বেরিয়ে পড়ল, তা একটা আংটিই বটে। আমি একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলুম, অন্যদের দিকে তাকিয়ে দেখি, তাঁদেরও সেই একই অবস্থা। সদানন্দবাবুর চোখের সাইজ ডবল হয়ে গেছে, কিন্তু মুখে কোনও কথা নেই। ডোরা আর মহেশ্বর ফুকনও একেবারে নিঃশব্দ বসে আছেন। হিপনোটাইজ করলে মানুষের যে প্রস্তরীভূত দশা হয়, তাঁদের অবস্থা প্রায় সেই রকম। একটা পিন পড়লেও তার শব্দ বোধহয় শোনা যাবে
একমাত্র ভাদুড়িমশাই-ই মিটিমিটি হাসছেন। কথাও প্রথম তাঁরই মুখ থেকে বার হল। বললেন, “কী, এটাই সেই হারিয়ে যাওয়া আংটি তো?”
হাতের তালুতে রাখা আংটির দিকে একাগ্র চোখে তাকিয়ে চুপ করে বসে ছিলেন ডোরা। লক্ষ্য ভেদ করার সময় অর্জুন যেমন পাখির চক্ষুটিকেই শুধু দেখছিলেন, তেমনি ডোরাও সম্ভবত হাতের আংটি ছাড়া আর কোনও কিছুই দেখছিলেন না। ভাদুড়িমশাইয়ের প্রশ্নে যেন হঠাৎই সম্বিত ফিরল তাঁর। আস্তে-আস্তে মুখ তুলে বললেন, “আমার মায়ের স্মৃতিচিহ্ন। কী করে এটাকে খুঁজে বার করলেন আপনি? তাও এত কম সময়ে? আপনি কি জাদুকর?”
মহেশ্বর ফুকন বললেন, “তাজ্জব কাণ্ড! ম্যাজিশিয়ানরা যেমন টুপির ভেতর থেকে পায়রা বার করে, আপনিও তো দেখছি সেই রকমের কান্ড করে ছাড়লেন!”
ডোরা বললেন, “কী করে হল, তা-ই তো ভেবে পাচ্ছি না। কাজের লোকেদের দিয়ে গোটা বাড়ি তন্ত্র-তন্ন করে খোঁজানো হল, তারা কেউই এটা বার করতে পারল না, আর আপনি কিনা যেই না একজন ডিটেকটিভ হিসেবে আপনার খ্যাতি নিয়ে একটু ঠাট্টা করেছি, অমনি এটা বার করে দিলেন!”
ভাদুড়িমশাই বিনয়ের বিশেষ ধার ধারেন না। হেসে বললেন, “তা হলে এখন মানছেন তো যে, সত্যিই আমি একজন মস্ত বড় ডিটেকটিভ?”
“মানছি।” ডোরা বললেন, “হাজার বার মানছি। কিন্তু একটা কথা যে বুঝতে পারছি না।
“কোন কথাটা বুঝতে পারছেন না?”
“যিনি যত বড় ডিটেকটিভই হোন না কেন,” ডোরা বললেন, “তিনি তো আর ভগবান নন, একটা হারানো জিনিসের সন্ধান করতে হলে তাঁকেও একটু খোঁজাখুঁজি করতে হবে। কিন্তু কই, আপনাকে তো খোঁজাখুঁজি করতে দেখলুম না। অবশ্য তার সময়ই বা আপনি পেলেন কোথায়!”
ভাদুড়িমশাই আবারও হাসলেন। কিন্তু এবারে আর কোনও কথা বললেন না।
সময় যে তিনি কখন পেয়েছিলেন, তা একমাত্র আমিই জানি। সময় পেয়েছিলেন কাল রাত বারোটার সময়, সেই যখন তিনি আমাকে তাঁর ডামি হিসেবে বিছানায় শুইয়ে রেখে একতলায় নেমে গিয়েছিলেন। কিন্তু একতলায় তো তিনি ছিলেন মাত্র মিনিট পনরো, তারপরেই তিনি দোতলায় উঠে আসেন। তার মানে তিনি খুব ভালই জানতেন যে, আংটিটাকে একতলার ঠিক কোন জায়গাটিতে লুকিয়ে রাখা হয়েছে, তা নইলে নিশ্চয় মাত্র পনরো মিনিটের মধ্যে আংটিটাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে তিনি দোতলায় উঠে আসতে পারতেন না। কিন্তু তারপরেও একটা প্রশ্ন থেকে যায়। সেটা এই যে, কোনখানে সেটা লুকিয়ে রাখা হয়েছে, তা তিনি জানলেন কী করে। চুরিটা যে কাজের লোকেদেরই কেউ করেছিল, তাতে অবশ্য সন্দেহ নেই। কিন্তু কই, কাল রাত্তির থেকে আজ সকালের মধ্যে তাদের কাউকে জেরা করা তো দূরের কথা, কারও সঙ্গে তাঁকে তো কথাই বলতে দেখিনি।
মহেশ্বর ফুকন তাঁর পুত্রবধূর কথার খেই ধরে বললেন, “ডোরা তো ভুল বলেনি। খোঁজাখুঁজি করলেন না, অথচ জিনিসটা ঠিকই উদ্ধার করে দিলেন, মিরাল ছাড়া একে আর কী বলব!”
ডোরা বললেন, “এয়ারলুমটা হারিয়ে কী যে মন-খারাপ হয়ে গিয়েছিল, সে আমি আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না। ও, আই’ম সো গ্রেটফুল টু ইউ। এর জন্যে আমি সারা জীবন আপনার কাছে ঋণী রইলুম।”
লোকে যে-ভাবে মাছি তাড়ায়, বাতাসের মধ্যে সেইভাবে হাত নেড়ে মহেশ্বর বললেন, “দ্যাখো ডোরা, আমি ব্যবসায়ী মানুষ, আমি ঋণী থাকতে ভালবাসি না, তাই মিঃ ভাদুড়িকেই একটা প্রশ্ন করছি।” বলে, ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “যা করেছেন, তার জন্যে কত দেব?…মানে কত দিলে আপনার মনে হবে যে, মহেশ্বর ফুকন লোকটা একেবারে হাড়কেপ্পন নয়?…বলুন বলুন, চুপ করে রইলেন কেন?”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আপাতত আপনাকে কিছুই দিতে হবে না। আমার ধারণা, এ-বাড়িতে আমার কাজ এখনও শেষ হয়নি। সমস্ত কাজ শেষ হোক, তখন এ নিয়ে কথা বলা যাবে।”
“তার মানে ওই আধ-পাগলা, অভদ্র, দেড়েল লোকটাকে খুঁজে বার করাকেও আপনি এ-বাড়ির কাজ বলে ধরে নিয়েছেন।”
“ধরে নিয়ে থাকলে উনি ঠিকই করেছেন, ড্যাড।” ডোরা বললেন, “খুঁজে বার করার কাজটা দাদা ওঁদের করতে বলেছেন, আর দাদা তো এ-বাড়িরই লোক, কাজটাও তাই এ-বাড়িরই হল।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “কথাটা আমি কিন্তু ওভাবে বলিনি।”
মহেশ্বর ফুকন আবার সেই মাছি তাড়াবার ভঙ্গি করে বললেন, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, ডোরা যখন বলছে, তখন ওটাও এ-বাড়ির কাজ বলেই আমি মেনে নিচ্ছি। কিন্তু একই সঙ্গে বলছি যে, আই ডোন্ট লাইক দ্যাট বেয়ার্ডেড বাফুন। তাকে খুঁজে পান আর না-ই পান তাতে আমার কিছু আসে যায় না।”
কথা বলতে-বলতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছিলেন মহেশ্বর ফুকন। ডোরাও তাঁর চেয়ার থেকে এগিয়ে এসে বললেন, “শরীরটা খারাপ লাগছে নাকি?”
“আরে না,” মহেশ্বর ফুকন বললেন, “শরীর ঠিকই আছে। তোমরা গল্প করো, আমি একটু লাইব্রেরি-ঘরে গিয়ে বসছি। গোটা কয়েক চিঠি এসেছে, তার উত্তর লিখব। কিছু কাগজপত্তরও দেখতে হবে।”
মহেশ্বরকে চেয়ার থেকে উঠতে দেখেই একজন কাজের লোক তাঁর দিকে ছুটে এসেছিল। ডোরা তাকে বললেন, “বড়বাবুকে লাইব্রেরি-ঘরে নিয়ে যাও। যতক্ষণ না ওঁর কাজ শেষ হচ্ছে, ততক্ষণ তুমি ওখানেই থাকবে।”
দরজা পর্যন্ত নিজেও তাঁর শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে-সঙ্গে গেলেন ডোরা। তারপর ফিরে এসে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে বললেন, “আমরা কি এখানে বসেই কথাবার্তা বলব, নাকি ড্রয়িংরুমে যাব? “ ভাদুড়িমশাই বললেন, “এখানেই তো দিব্যি আছি, তবে কিনা আর-এক রাউন্ড চা হলে মন্দ হত না।”
দ্বিতীয় রাউন্ডের চা দেবার প্রস্তুতি বোধ হয় চলছিলই। তাই কাউকে কিছু বলার আগেই কিচেন থেকে একজন বেয়ারা ট্রে-হাতে আমাদের টেবিলে এসে দুধ, চিনি আর চায়ের পাত্র নামিয়ে রাখল। সেই সঙ্গে দুটো রেকাবিতে কিছু বিস্কুট আর কাজুবাদাম। সদানন্দবাবু আগেই বলে দিয়েছিলেন যে, এখন আর তিনি চা খাবেন না। তাই, টি-পট থেকে আমার ও ভাদুড়িমশায়ের পেয়ালায় চা ঢেলে ডোরা বললেন, “আপনারা যে-যার মতো দুধ-চিনি মিশিয়ে নিন।” তারপর নিজের পেয়ালায় চা ঢালতে-ঢালতে অনুচ্চ গলায়, অনেকটা যেন নিজেকে শুনিয়ে, বললেন, “সো হোয়াট হ্যাভ আই বিন ওয়েটিং ফর?”
ভাদুড়িমশাই বসে আছেন টেবিলের অন্যদিকে। ডোরা যে কিছু বলছে, এটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ঠিকই, তবে কথাগুলি তাঁর কানে যায়নি। তাই টেবিলের উপরে ঈষৎ ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু বলছেন?”
“ওহ্ নো,” ডোরা লজ্জিত হেসে বললেন, “আমি একটা অন্য কথা ভাবছিলুম। তবে হ্যাঁ, একটু আগে আপনার ক্ষমতার যা প্রমাণ পেয়েছি, তাতে আবার আর-একটা কথাও আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে।…মানে ভাবছি যে, আপনি তো আমার মস্ত একটা উপকার করলেন, এখন আর-একটা উপকারের জন্যে আপনাকে রিকোয়েস্ট করা যায় কি না।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “অত কিন্তু-কিন্তু করার দরকার নেই, যা বলতে চান, স্বচ্ছন্দে বলে ফেলুন। কিন্তু তার আগে বরং আমি আপনাকে দু-একটা প্রশ্ন করি, কেমন?”
“বেশ তো, কী জানতে চান বলুন।”
“যে আংটিটা খুঁজে বার করেছি, তাতে দেখছি ক্যাপিটাল হরফে এস. এস. খোদাই করা হয়েছে। সাধারণ বুদ্ধিতে বুঝতে পারছি যে, ওর দ্বারা স্টিমশিপও বোঝানো হচ্ছে না, নাটসি গোয়েন্দা-পুলিশ শুটস-স্টাফেলকেও বোঝানো হচ্ছে না। এস. এস. তা হলে কীসের আদ্যক্ষর?”
প্রশ্ন শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন ডোরা। হাসলে এই ভদ্রমহিলার দু’গালে দুটো মস্ত টোল পড়ে, কাল রাত্তির থেকেই এটা দেখছি। হাসতে-হাসতেই বললেন, “জাহাজও নয়, হিটলারের পুলিশও নয়…হাহাহা, হোহোহো…উফ্, পেটে খিল ধরে যাচ্ছে…হাহাহা…”
সদানন্দবাবু অনেকক্ষণ কিছু বলেননি। এবারে গম্ভীর গলায় বললেন, “ওর দ্বারা সত্যেন সিঙ্গি মশাইয়ের কতা বলা হচ্চে না তো? মানে ওই যাঁকে লর্ড সিঙ্গি বলা হত আর কি।”
“লর্ড সিঙ্গি? তিনি আবার কে? হাহাহা…হাহাহা…ওহ্ নো…হাহাহা! লর্ড সিঙ্গি!… হোহোহো… আমার মায়ের আংটিতে তাঁর নাম আসবে কোত্থেকে!…হাহাহা…কে তিনি?”
তাঁর কথায় যে এতটাই হাসির উদ্রেক হতে পারে, সদানন্দবাবু তা ভাবতেও পারেননি। ফলে, ভদ্রলোক একেবারে চুপসে গিয়েছিলেন। আমি বললুম, “লর্ড সিঙ্গি হচ্ছেন সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ। নামটা আপনি শোনেননি মনে হচ্ছে?”
“না, শুনিনি।” হাসির দমক সামলে নিয়ে ডোরা বললেন, “কিন্তু তিনি যে-ই হোন, তাঁর নাম এখানে আসছে কেন?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওহ্, ফরগেট হিম। এস. এস. তা হলে কী? নামের আদ্যক্ষর?”
“হ্যাঁ, আমার মায়ের নামের। ইট’স অ্যাজ সিম্পল অ্যাজ দ্যাট।”
“পুরো নামটা কী?”
“সিলভিয়া সেনগুপ্ত। এস. এস. আর কিছুই নয়, নাম আর পদবির আদ্যক্ষর। ওটা আমার মায়ের বিয়ের আংটি। বিয়ের দিনে বাবা মা’কে দিয়েছিলেন।”
সিলভিয়া! নামটা শুনে আমি চমকে উঠেছিলুম। ভাদুড়িমশাইয়ের মুখে কিন্তু কোনও ভাবান্তর দেখতে পেলুম না। এতক্ষণ যে-ভাবে কথা বলছিলেন, সেইরকম ধীর শান্তভাবেই জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার বাবার নাম কী?”
“বিশ্বনাথ সেনগুপ্ত।” ডোরা বললেন, “কিন্তু বাবার কথা আমার কিছু মনে নেই। থাকা সম্ভবও নয়। আমার বয়স যখন মাত্র দু’বছর, মা’কে ছেড়ে বাবা তখন ইন্ডিয়ায় ফিরে আসেন। ইট ওয়াজ অ্যান আনহ্যাপি ম্যারেজ।”
“বিয়েটা কবে হয়েছিল আপনি জানেন?”
“তা জানি। মায়ের কাছে শুনেছি ওঁদের বিয়ে হয়েছিল ফিফটিফোরের সেপ্টেম্বরে।”
শুনে, প্রথমেই যা আমার মনে হল, তা এই যে, এই সিলভিয়া তা হলে সেই সিলভিয়া হতেই পারেন না। কেননা, কেদারেশ্বরের কাছেই আমরা শুনেছি যে, সুশান্তর স্ত্রী সিলভিয়া কলকাতা ছেড়ে উনিশশো পঞ্চান্ন সালে বিলেতে ফিরে গিয়েছিলেন। বিশ্বনাথ সেনগুপ্তের সঙ্গে এই সিলভিয়ার বিয়ে তার এক বছর আগের ঘটনা।
একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করলেন। দেশলাইটাও বার করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু করলেন না। ডোরার দিকে তাকিয়ে বলেন, “একটা সিগারেট খেতে পারি?…মানে ধোঁয়ায় আপনার অসুবিধে হবে না তো?”
“কিচ্ছু অসুবিধে হবে না।” ডোরা বললেন, “স্বচ্ছন্দে খেতে পারেন।” বলে উঠে গিয়ে একজন কাজের লোককে ডেকে বললেন, “ড্রয়িং রুম থেকে এখানে একটা অ্যাশট্রে এনে দাও।”
অ্যাশট্রে এনে দিয়ে লোকটি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ভাদুড়িমশাই সিগারেট ধরালেন। ধোঁয়া ছাড়লেন। তারপর বললেন, “আরও কয়েকটা প্রশ্ন ছিল। কিন্তু করা উচিত হবে কি না, বুঝতে পারছি না।”
ডোরাকে হঠাৎই যেন একটু গম্ভীর দেখাল। বললেন, “তার মানে প্রশ্নগুলো একটু ব্যক্তিগত ধরনের হবে, এই তো?”
“হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ধরেছেন।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “যদি বলেন, ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর দিতে আপনি রাজি নন, তা হলে সেটা বলে দিন, আমিও সে-ক্ষেত্রে প্রসঙ্গ পালটে অন্য কথায় চলে যাব। আর যদি বলেন যে, আমি ছাড়া অন্য কারও সামনে কোনও ব্যাক্তিগত বিষয়ে কিছু জানাতে আপনার আপত্তি আছে, তো ওয়েল অ্যান্ড গুড, আমার এই বন্ধু দুটিকে সে-ক্ষেত্রে…”
ভাদুড়িমশাইয়ের কথা শেষ হবার আগেই আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলুম। সদানন্দবাবুকেও চোখের ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছিলুম যে, তাঁরও এবারে উঠে পড়া দরকার। ইঙ্গিতটা সদানন্দবাবু ধরতে পেরেছিলেন কি না জানি না, সম্ভবত পারেননি, কিন্তু ডোরা ঠিকই ধরেছিলেন। গালে টোল ফেলে আবার তিনি হোহো করে হেসে উঠলেন। তারপর ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, “মিঃ ভাদুড়ি, আপনার সব প্রশ্নেরই আমি উত্তর দেব। কিন্তু তার একটা শর্ত আছে। আংটিটা উদ্ধার করে আপনি আমার কী যে উপকার করেছেন, সে আমি বলতে পারব না। এখন আপনাকে আর-একটা কাজের ভার নিতে হবে। রাজি?”
“কী কাজ, সেটা করা আমার সাধ্যে কুলোবে কি না, সে-সব না-জেনে না-বুঝে রাজি হই কী করে?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কাজটা কী, সেটা তো আগে শুনি। আর তা ছাড়া, যে-কাজ নিয়ে এখানে এসেছি, সেটা তো শেষ করতে হবে। সেটাকে ফেলে রেখে অন্য কাজে কী করে হাত দেব?” ডোরা বললেন, “ঠিক আছে, হাতের কাজ শেষ করুন, কিন্তু তারপর আমার কাজটা নেবেন তো?”
কাজটা কী, তা না জেনে ভাদুড়িমশাই কখনও কোনও কেস হাতে নিয়েছেন বলে আমি জানি না। কিন্তু এ-ক্ষেত্রে যে কী হল, একমাত্র ঈশ্বরই তা বলতে পারবেন, খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে বসে থেকে, তারপর ডোরার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে তিনি বললেন, “ঠিক আছে, নেব।”
ডোরাও হেসে বললেন, “থ্যাঙ্কস আ লট। এবারে কী জিজ্ঞেস করবেন, করুন। যতই ব্যক্তিগত হোক, আপনার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেব। অবশ্য যদি উত্তর আমার জানা থাকে।”
“আপনি বলেছেন, আপনার মায়ের বিয়ে হয়েছিল ফিফটিফোরের সেপ্টেম্বরে। আপনি এও বলেছেন যে, বিয়ের এই তারিখটা আপনি আপনার মায়ের কাছে জেনেছেন।”
“হ্যাঁ,” ডোরা বললেন, “ফিফটিফোর সেপ্টেম্বরে। টু বি প্রিসাইজ, অন্য দ্য টুয়েন্টিয়েথ ডে অভ সেপ্টেম্বর।”
“এই তারিখটার কথা কি আপনার মা ছাড়া আর কারও কাছে কখনও শুনেছেন আপনি? ফর এগজাম্পল আপনার মায়ের দিকের কোনও আত্মীয়ের কাছে, কি ধরা যাক, বিয়ের সময়ে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তেমন কারও কাছে?”
“না, আর-কারও কাছে শুনিনি।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনি বলেছেন যে, আপনার বাবা যখন আপনার মা’কে ছেড়ে ভারতবর্ষে ফিরে আসেন, আপনার বয়স তখন মাত্র দু’বছর, তাই বাবার কথা আপনার মনে পড়ে না। না-পড়াই স্বাভাবিক, অত অল্প বয়সের কথা নিতান্তই এক-আধজন মানুষ ছাড়া কারও মনে থাকে না। কিন্তু মায়ের কাছে নিশ্চয়ই তাঁর বিষয়ে কিছু-না-কিছু কখনও-না-কখনও শুনেছেন?”
“না, তাও শুনিনি।” ডোরা বললেন, “বাবার বিষয়ে যখনই কোনও প্রশ্ন করেছি, মা চুপ করে যেতেন, কিংবা অন্য কোথাও চলে যেতেন। আসলে, আগে যা বলেছি, সেটাই ঠিক কথা। ইট ওয়াজ অ্যান আনহ্যাপি ম্যারেজ। তাই, আমি যদ্দুর বুঝতে পারি, মায়ের মধ্যে একটা তিক্ততা এসে গিয়েছিল। তার ফল যা হয় আর কি, বাবার সম্পর্কে কিছু বলতে তাঁর ভাল লাগত না। তিনি চুপ করে যেতেন।”
“আপনার বাপ-মায়ের আপনিই একমাত্র সন্তান?”
“হ্যাঁ, আমার কোনও ভাই-বোন নেই।”
“আপনার জন্ম কত সালে?” কথাটা বলেই ভাদুড়িমশাই লাজুক হেসে যোগ করলেন, “মানে আমি যে একটু ঘুরিয়ে আপনার বয়েস জানতে চাইছি, তা কিন্তু ভাববেন না। সেটা যে অভদ্রতা, তা আমি জানি।”
ডোরার চোখমুখ দেখে মনে হল, কথাটা শুনে তিনি একটু বিস্ময়বোধ করছেন। বললেন, “অভদ্রতা হবে কেন? বয়েসের কথা জিজ্ঞেস করলে আজকাল আর কেউ সেটাকে অভদ্রতা বলে ভাবে না। এনিওয়ে, কালই তো যেন কাকে আমি আমার বয়েসের কথা বললুম। ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে, ও-বাড়ির দিদিকে। আমার জন্ম উনিশশো ছাপ্পান্ন সালের এপ্রিল মাসে, বয়েস এখন বিয়াল্লিশ বছর। বিশ্বাস না হয় তো বলুন, পাসপোর্ট এনে ডেট অভ বার্থটা দেখিয়ে দিচ্ছি।”
বললুম, “আপনার হয়তো মনে নেই, কথাটা কাল আপনি আমাদের সামনেই বলেছিলেন।”
ডোরা আবার হাসলেন। বললেন, “ঠিক ঠিক, মনে পড়েছে, আপনারাও তখন সেখানে ছিলেন বটে।…তো মিঃ ভাদুড়ি, বয়েসের কথা জিজ্ঞেস করলে কারা চটে জানেন? সত্যি যাদের বিস্তর বয়স হয়েছে, সেই বুড়োবুড়িরা চটে। কিন্তু আমি তো এখনও বুড়ি হইনি, আমার বয়েস মাত্র বিয়াল্লিশ, তা হলে আমি চটব কেন?…নিন, আর কী প্রশ্ন করবেন, করুন।”
“আর মাত্র দু-একটা প্রশ্ন করব।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনার বাবা বিশ্বনাথ সেনগুপ্ত বিলেতে কী করতেন আপনি জানেন?”
“তিনি এম.আর.সি.পি. করতে বিলেতে গিয়েছিলেন। সেটা করে সেন্ট টমাস হসপিটালে যোগ দেন। শুনেছি, ডাক্তার হিসেবে তাঁর যথেষ্ট সুনাম ছিল।”
“এটা আপনি কার কাছে শুনলেন? আপনার মায়ের কাছে?”
“না, মিঃ ভাদুড়ি, মায়ের কাছে নয়। একটু বড় হয়ে ওঠার পরে মা’কে আমি অনেক বার জিজ্ঞেস করেছি যে, আমার বাবা কেমন মানুষ ছিলেন, তিনি কী করতেন। কিন্তু কোনও বারই উত্তর পাইনি। শি জাস্ট কেল্ট মাম্।”
“তা হলে কার কাছে শুনলেন? পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে?”
“না, তাও নয়। পাড়া-প্রতিবেশী যে কাকে বলে, ছেলেবেলায় তা-ই তো আমি জানতুম না।” একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ডোরা। হাতের মধ্যে মায়ের আংটিটিকে ঈষৎ অন্যমনস্কভাবে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলেন। তারপর মুখ তুলে বললেন, “জানার কোনও সুযোগই বা পেলুম · কোথায়। আমার বয়েস যখন মাত্র পাঁচ বছর, মা আমাকে তখনই একটা রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে ভর্তি করে দেন। ছুটিছাটাতেও কখনও বাড়ি আসিনি, তার কারণ বাবা আমাদের ছেড়ে আসার পরে বাড়ি বলতে আমাদের কিছু ছিলই না। মা নার্সের কাজ জুটিয়ে নেন। থাকতেন নার্সেস’ ইউনিয়নের একটা হস্টেলে। পাঁচ বছর বয়েস পর্যন্ত মায়ের সঙ্গে সেই হস্টেলে থেকে তারপর ইস্কুলে ভর্তি হয়ে আমি নিজেও হস্টেলে চলে আসি। ছুটির মধ্যেও হস্টেল খোলা থাকত, ক্রিসমাসের লম্বা ছুটিতে মা দু’-চারটে গিফট নিয়ে এসে সেখানে আমার সঙ্গে খানিকটা সময় কাটিয়ে যেতেন; বাস্, এর মধ্যে পাড়া-প্রতিবেশী কোত্থেকে আসে! না, কোনও আত্মীয় কিংবা প্রতিবেশীর কাছে আমি কিছু শুনিনি। আমার বাবা যে ডাক্তার, তা আমি আর-এক ডাক্তারের কাছে জানতে পারি।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “তিনি কে?”
“ডঃ আর্থার কেলি। বিখ্যাত পেডিয়াট্রিস্ট। গ্লস্টার রোডে ‘পেডিয়াট্রিক সেন্টার’ বলে ছোটদের যে মস্ত নার্সিং হোম রয়েছে, সেটার তিনিই সিনিয়ার পার্টনার। আমার বাবার পরিচয় তিনিই আমাকে জানান।”
“তাঁর কাছে আপনি গিয়েছিলেন কেন? ছেলেকে দেখাতে?”
“ওহ্ নো, তখনও আমার বিয়েই হয়নি। গিয়েছিলুম স্রেফ চাকরির খোঁজে।” ডোরা বললেন, “আপনারা কি জানেন যে, আমি একজন ট্রেন্ড নার্স?”
কথাটা কেদারেশ্বরের কাছে শুনেছি। যেমন আমি আর সদানন্দবাবু শুনেছি, তেমন ভাদুড়িমশাইও শুনেছেন। কিন্তু ভাদুড়িমশাই ঘাড় না-নেড়ে বললেন, “তা-ই?”
“হ্যাঁ।” ডোরা বললেন, “স্কুল-লিভিংয়ের পরীক্ষা পাশ করে, মায়ের কথা মতো নার্সিংয়ের ট্রেনিং নিই। মা তো নিজে নার্স ছিলেন, তাই হয়তো ভেবে থাকবেন যে, নার্সিংয়ের পরীক্ষায় টেনেটুনে পাশ করে গেলে তাঁর পেশায় আমাকে ঢুকিয়ে দিতে পারবেন। কিন্তু না, মায়ের কোনও দরকারই আমার হয়নি। ট্রেনিংয়ের শেষ পরীক্ষা দিলুম। তার ফল বেরোতে দেখা গেল, হাজার কয়েক পরীক্ষার্থীর মধ্যে একেবারে প্রথমেই আমার নাম রয়েছে। ফল বেরোবার সঙ্গে-সঙ্গেই এমপ্লয়মেন্ট ব্যুরোতে নাম লেখাই। তার সাত দিনের মধ্যেই সেখান থেকে চিঠি দিয়ে আমাকে জানানো হয় যে, চিঠিখানা আর সেই সঙ্গে আমার বায়ো-ডাটা নিয়ে অবিলম্বে আমি যেন পেডিয়্যাট্রিক সেন্টারে গিয়ে ডঃ আর্থার কেলির সঙ্গে দেখা করি।”
“তারপর?”
“পেডিয়্যাট্রিক সেন্টারের রিসেপশানে গিয়ে নিজের নাম বলতেই রিসেপশনিস্ট ভদ্রমহিলা আমাকে ডঃ কেলির কাছে পৌঁছে দেন। ডঃ কেলি আমার সঙ্গে দু’-একটা কথা বলার পরেই বলেন, ‘কাল থেকেই কাজে লেগে যান।’ শুনে ‘থ্যাঙ্কিউ সার’ বলে কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছি, এমন সময় ডঃ কেলি বলেন, ‘একটা কথা জিজ্ঞেস করি মিস সেনগুপ্ত। বায়ো-ডাটায় আপনি আপনার বাবার নাম লিখেছেন বিশ্বনাথ সেনগুপ্ত, কিন্তু তাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি যে ভারতীয়, এ ছাড়া আর কিছুই লেখেননি। কেন?’ এ-কথার কী উত্তর দেব আমি? বিশ্বনাথ সেনগুপ্ত যে ইন্ডিয়ান সিটিজেন, আর তিনি যে আমার বাবা, তা ছাড়া তো এই মানুষটি সম্পর্কে কিছুই আমার জানা নেই। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ডঃ কেলি বললেন, ‘কথাটা এইজন্যে জিজ্ঞেস করছি যে, বিশ্বনাথ সেনগুপ্ত নামে একজন ভারতীয় ডাক্তারকে আমি চিনি। ইন ফ্যাক্ট, আমার গাইডেন্সেই সে এখানে এসে এম.আর.সি.পি. করেছিল। তা ছাড়া সেন্ট টমাস হসপিটালে সে বেশ কয়েক বছর আমার কলিগ হিসেবে কাজও করেছে। ফ্রম হোয়াট আই হ্যাভ সিন অভ দিস ম্যান, একটা কথা আমি বিনা দ্বিধায় বলব। সেটা এই যে, অমন মেধাবী ছাত্র আমি আর একটিও পাইনি, অমন বিবেকবান আর দক্ষ ডাক্তারও দেখেছি কালেভদ্রে। জাস্ট কয়েকটা সিম্পটম দেখে রোগ নির্ণয়ে তো তার তুলনাই ছিল না। হি ওয়জ নট ওয়ান অভ দোজ ফ্যান্সি ফিজিশিয়ানস, রোগ সারাবার নাম করে যারা দুহাতে শুধুই টাকা কামিয়ে বেড়ায়।’…কী বলব মিঃ ভাদুড়ি, তখনও আমি ভাবতে পারিনি যে, ইনি আমার বাবার কথা বলছেন। ভেবেছিলুম যে, একই নামের দুজন মানুষ তো থাকতেই পারে, ইনি নিশ্চয় অন্য-কোনও বিশ্বনাথ সেনগুপ্ত হবেন।
ভাদুড়িমশাই বললেন, “কেন, নাম যখন এক, তখন ডঃ কেলি যাঁকে বিবেকবান দক্ষ ডাক্তার বলে মনে রেখেছেন, সেই বিশ্বনাথ সেনগুপ্তই যে আপনার বাবা, তা আপনি ভাবতে পারেননি কেন?”
যেন ফুঁসে উঠলেন ডোরা। বললেন, “কী করে পারব? আমার বাবা একজন দক্ষ ডাক্তার ছিলেন কি না, তা জানি না। বাট হাউ ক্যান ইউ কল হিম কনসেনশাস? কাকে আপনি বিবেকবান বলবেন? যে-লোক নিজের স্ত্রী আর শিশুকন্যাকে ত্যাগ করে চলে যায়, তাকে? আমার মায়ের কী অপরাধ, সে সম্পর্কে কোনও ধারণাই আমার নেই। কী জানেন, আমার মা তো, তাই ভাবতে খুবই কষ্ট হয়, তবু মাঝে-মাঝে ভাবি যে, কী দোষ তিনি করেছিলেন? ওয়াজ শি আ ব্যাড ওয়াইফ? ওয়াজ শি গ্রিডি? অর ইভন আনফেইথফুল? ভাবি, কিন্তু কোনও উত্তর পাই না। আর আমি? আমি কী দোষ করলুম? আমার কী অপরাধ? আমার কথা আমার বাবা একবার ভাবলেন না কেন? কোনও বিবেকবান মানুষ তাঁর সন্তানের কথা না-ভেবে পারে? না মিঃ ভাদুড়ি, খুব স্বাভাবিকভাবেই আমার মনে হয়েছিল যে, ডঃ কেলি যাঁর কথা বলছেন, তিনি অন্য মানুষ, তিনি আমার বাবা নন।”
মুখ নিচু করে খানিকক্ষণ একেবারে ঝিম মেরে বসে রইলেন ডোরা। মিনিট দুই-তিন বাদে যখন আবার মুখ তুলে আমাদের দিকে তাকালেন, তখন তাঁর মুখচোখের চেহারা একেবারে পালটে গেছে। মনে হল, এই হাসিখুশি ভদ্রমহিলার ভিতরে-ভিতরে এমন নিদারুণ একটা সংঘাত চলেছে, যার ধাক্কা তিনি সামলে উঠতে পারছে না। তিনি ভেঙেচুরে যাচ্ছেন।
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ডঃ কেলি কি আরও কিছু বলেছিলেন আপনাকে?”
“হ্যাঁ, বলেছিলেন।” দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরে চাপা গলায় ডোরা বললেন, “যা বলেছিলেন, তাতেই আমি একটা মারাত্মক রকমের ধাক্কা খেয়ে যাই। বুঝতে পারি, এতক্ষণ ধরে যা কিছু আমি ভেবেছি, সব ভুল ভেবেছি! বুঝতে পারি…বুঝতে পারি…ওহ্ মাই গড…..”
কথাটা শেষ করতে পারলেন না ডোরা। একেবারে হঠাৎই দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললেন।
গোটা ঘর স্তব্ধ। ঘরের মধ্যে এয়ার-কন্ডিশনার চলছে। তার মৃদু গুঞ্জন ছাড়া আর কোথাও কোনও শব্দ নেই। ইলেট্রনিক দেওয়াল-ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটাটা নিঃশব্দে ঘুরে চলেছে। আমরা কেউই কোনও কথা বলছি না। বুকের উপরে চেপে বসা সেই নৈঃশব্দ্যকে ভেঙে দিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “কী বললেন ডঃ কেলি?”
মুখের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিলেন ডোরা। বললেন, “ডঃ কেলি বললেন,
‘বিশ্বনাথ ওয়জ অ্যান একসেপশনালি ট্যালেন্টেড ফিজিশিয়ান। বাট দেন অ্যাজ আ ম্যান হি ওয়জ এক্সট্রিমলি মুডি অ্যান্ড ইমপালসিভ। অ্যাজ অলসো আনপ্রেডিক্টেবল। নইলে আর নাইন্টিন ফিফটি এইটে, বলতে গেলে প্রায় বিনা নোটিসে, হাসপাতালের চাকরি ছেড়ে দিয়ে সে দেশে ফিরে যাবে কেন?’…মিঃ ভাদুড়ি, ওই একটা কথাতেই আমি যা বুঝবার তা বুঝে যাই।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনার বাবাও তো ফিফটি এইটেই আপনাদের ছেড়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন?”
“হ্যাঁ,” ডোরা বললেন, “আমার বয়েস তখন দু’বছর।”
একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে ঠোঁটে ঝুলিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করলেন। অন্যমনস্কভাবে ধোঁয়া ছাড়লেন কিছুক্ষণ। হাওয়ায় গোটা কয়েক রিং বানালেন। তারপর আধ-খাওয়া সিগারেটটাকে অ্যাশট্রেতে পিষে দিয়ে বললেন, “আপনি কী চান?”
একটু আগেই যিনি প্রায় ভেঙে পড়েছিলেন, একেবারে হঠাৎই আবার সেই আগের আক্রোশ যেন ফিরে এল তাঁর গলায়। ফুঁসে উঠে বললেন, “আমার বাবাকে আপনি খুঁজে বার করুন।”
“তাতে লাভ কী?”
“লাভ আর কিছুই নয়। আমার মা মারা গেছেন। কিন্তু আমি মরিনি। আমি তাঁর মেয়ে। আমি বেঁচে আছি। আমি তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াব।”
“কিন্তু ডঃ বিশ্বনাথ সেনগুপ্তকে কী বলবেন আপনি?”
ডোরা বললেন, “বলব যে, লোকে তোমাকে বিবেকবান বলে জানে। কিন্তু তুমি তোমার মেয়ের কথাটাও জেনে রাখো। ইউ আর দ্য মোস্ট হার্টলেস ম্যান দ্যাট ওয়জ এভার বর্ন।”