আংটি রহস্য – ১০

১০

পরেশ চলে যাবার পরে ভাদুড়িমশাই বললেন, “তোমার কাকা মহেশ্বর ফুকন মশাইয়ের সমস্যার কথা তো শুনলুম। আশা করি ওটা মিটে যাবে। তবে কিনা, বিদেশে চলে যাবার পরে যে ছেলে একবারও তার বাপের ডাকে সাড়া দেয়নি, বরং বারবার জানিয়েছে যে, সে আর দেশে ফিরবে না, হঠাৎ সে কেন বউ-ছেলে নিয়ে দেশে ফিরল, সেটাও জানতে চাই। এনি পার্টিকুলার রিজন?”

“না না, তুমি যা ভাবছ, তা নয়।” কেদারেশ্বর বললেন, “বাপের সম্পত্তির লোভে সে ফেরেনি। আসলে, আমিই তাকে জরুরি খবর পাঠিয়েছিলুম।”

“কেন?”

“কাকা হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। এটা গত বারোই ফ্রেব্রুয়ারির ঘটনা। তারিখটা আমার মনে আছে, তার কারণ সেদিন ছিল অনুপমার জন্মদিন। ভেবেছিলুম যে, এখানকার সিনেমা-হলে বিকেলের শোয়ে দুজনে মিলে একটা ছবি দেখতে যাব। কিন্তু তা আর হল না, আমরা যখন বাড়ি থেকে বেরোবার জন্যে তৈরি হচ্ছি, তখন একেবারে হঠাৎই তাঁর ড্রাইভার এসে খবর দিল যে, কাকা এসেছেন। শুনলুম তিনি এতই অসুস্থ যে, গাড়ি থেকে নেমে ভেতরে আসতে পারছেন না। শুনে আমি আর অনুপমা বাইরে ছুটে যাই, বাড়ির লোকজনদের দিয়ে ধরাধরি করে গাড়ি থেকে নামিয়ে তাঁকে ভিতরে নিয়ে এসে শুইয়ে দিই। ডাক্তারকে ফোন করে ডেকে পাঠাই। যাতে তাঁর আসতে দেরি না হয়, তার জন্যে বাড়ি থেকে গাড়িও পাঠিয়ে দিয়েছিলুম। তিনি এসে পরীক্ষা করে ওষুধ দেন। বলেন, অতিরিক্ত একজারশনের ফলে এটা হয়েছে, তবে ভয়ের কিছু নেই, দিন দুই-তিন টানা রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবেন। পরে, ডাক্তারবাবুকে যখন গাড়িতে তুলে দেবার জন্য তাঁর সঙ্গে বাইরে আসি, তখন তিনি আমাকে আড়ালে পেয়ে বলেন যে, কাকার একটা মাইল্ড হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে, খুবই সাবধানে থাকা দরকার। শুনে আমি আর ঝুঁকি না নিয়ে সেইদিনই লন্ডনে ফোন করে শঙ্করকে সব জানাই। বলি যে, হি শুড কাম ইমিডিয়েটলি। তা, কাকার উপরে যতই রাগ থাক, এবারে কিন্তু সে বুঝতে পারে যে, দেরি করাটা বিপজ্জনক হয়ে যাবে। ইন ফ্যাক্ট, বউ আর ছেলেকে নিয়ে আর্লিয়েস্ট অ্যাভেইলেব্‌ল ফ্লাইট ধরে সে চলে আসে। পনেরোই ফেব্রুয়ারির দুপুরে সে ধুবুড়িতে এসে পৌঁছয়।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কাকা তখন তোমার বাড়িতেই ছিলেন?”

“হ্যাঁ,” কেদারেশ্বর বললেন, “এখানে ছিলেন। ধুবুড়িতে যে ভাল… আই মিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নার্সিং হোম নেই, তা নয়, কাকা নিজেই তো তার একটার মালিক, একটু সুস্থ হয়ে উঠে পরদিনই তিনি সেখানে চলে যেতেও চেয়েছিলেন, এটা আরও চেয়েছিলেন অনুপমার খাটনির কথা ভেবে, কিন্তু আমরা তাতে রাজি হইনি, বলেছিলুম যে, রাত্তিরের জন্যে একজন নার্স তো রাখাই আছে, দরকার হলে দিনের বেলার জন্যেও একজনকে রেখে দেওয়া যাবে, কিন্তু শঙ্কর এসে যতক্ষণ না পৌঁছচ্ছে, ততক্ষণ তাঁকে এখান থেকে আমরা নড়তে দিচ্ছি না।”

“শঙ্কর আসার পরে তাঁকে নার্সিং হোমে ট্রান্সফার করা হল?”

“না। কাকা অবশ্য বাই দ্যাট টাইম প্রায় পুরোপুরিই সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি যখন বললেন যে, তাঁকে নিয়ে কাউকে ব্যস্ত হতে হবে না, নিতান্তই যদি তাঁর নর্মাল কাজকর্মের জীবনে ফিরে যেতে দিতে ডাক্তারের আপত্তি থাকে তো বেশ, তিনি বরং আর কয়েকটা দিন নার্সিং হোমে কাটিয়ে যাবেন, তখন শঙ্কর কিছুটা ইতস্তত করছে দেখে ডোরা-ই শঙ্করকে বলল, তার কিছু মাত্র দরকার নেই, এমনকী দরকার নেই দু’জন নার্স রাখারও। ‘ইউ নো, আই অ্যাম আ ট্রেন্ড নার্স মিসেল্ফ, সো আই ক্যান জলি ওয়েল লুক আফটার ইয়োর ওল্ড ম্যান।’ সেইদিনই সে কাকাকে তাঁর নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। ডোরার কথা শুনে কাকার মুখে যে হাসি ফুটেছে, এটা দেখে আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।”

সদানন্দবাবু বললেন, “তা আজ রাত্তিরে যে উনি আমাদের খেতে বলেচেন, আবার থাকতেও বলেচেন ওখেনেই, এতে ওঁর কোনও অসুবিদে হবে না? মানে অসুস্থ মানুষ তো, তাই ভাবছিলুম যে…”

মাঝপথেই সদানন্দবাবুকে বাধা দিয়ে কেদারেশ্বর বললেন, “ছাড়ুন তো। ও-সব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আর তা ছাড়া হঠাৎ ওই যে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, সে তো দু’মাস আগের ব্যাপার। এখন তিনি পুরোপুরি ফিট, ব্রহ্মপুত্রের ধারে এই বয়েসেও রোজ চার মাইল হাঁটেন। চা-র মাইল!”

“কিন্তু ব্যাবসার কাজকর্ম এখনও দেখছেন না।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ব্যাবসার তাতে ক্ষতি হচ্ছে নিশ্চয়?”

কেদারেশ্বর বললেন, “তা হচ্ছে, কিন্তু কাকার সে-দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। ওঁর ম্যানেজাররা মাঝে-মধ্যেই এখানে আসেন, খাতাপত্তর দেখিয়ে প্রশ্নও করেন যে, কবে থেকে উনি আবার ট্যুরে বেরোবেন। তা ট্যুরের কথা উঠলেই উনি হাসতে থাকেন, আর বলেন যে, দাঁড়া রে বাবা, বউমা পারমিশান দিক, তবে তো বেরুব। আপাতত ওর সেবাযত্ন খাচ্ছি, আশ মিটিয়ে সেটা খেয়ে নিতে দে।”

“শুনে তাদের… আই মিন তোমার কাকার ম্যানেজারদের রিঅ্যাকশনটা কী হয়?”

“খুব একটা অখুশি হয় বলে তো মনে হয় না।” কেদারেশ্বর বললেন, “তারা বলে, ‘সেই ভাল স্যার। বউমা যখন অদ্দুর থেকে ছুটে এসেছেন আর আপনার এত সেবাযত্ন করছেন, তখন আর তাড়াতাড়ি আপনার ট্যুরে বেরিয়ে কাজ নেই। আমরা তো আপনি যে-ভাবে চালাতে বলেছেন, সেইভাবেই সব কাজকর্ম চালিয়ে নিচ্ছি, আপনি একেবারে অম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠুন, তারপর বেরুবেন।’ মোটামুটি এই একই কথা বলে সবাই।”

সদানন্দবাবু বললেন, “তা-ই তো বলবে।”

“তার মানে?”

“মালিক যদ্দিন বাড়ির মদ্যে আটকে আচেন, মানে হুটহাট করে তাঁর একটা আপিসে ঢুকে পড়ে হিসেবের খাতাপত্তর তলব করতে পারচেন না, তদ্দিনই তো এই ম্যানেজারবাবুদের লুটেপুটে খাবার সুবিদে।”

শুনে কেদারেশ্বর একেবারে অবাক হয়ে সদানন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “আশ্চর্য! আপনি যা বললেন, ডোরাও সেই একই কথা বলে। কালই আমাকে বলছিল, ‘দাদা, এ-যাত্রায় তো ফিরে যেতেই হবে, তবে সত্যি-সত্যি আপনার ভাইকে রাজি করিয়ে যদি বরাবরের মতো আমরা এখানে চলে আসতে পারি, তা হলে প্রথমেই কী করব জানেন?’ কী করতে চায় জিজ্ঞেস করতে বলল, ‘এই ম্যানেজারগুলোর মধ্যে যে দু’জন সবচেয়ে বেশি হাত কচলায়, প্রথমেই তাদের স্যাক করব। দে সিম টু বি আটারলি ডিজনেস্ট।’ আমি বললুম, ‘কী করে বুঝলে?” তাতে ডোরা বলল, ‘নইলে অত ঘনঘন হাত কচলায়? আরে বাবা, কাজ না-করে তো মাইনে নিচ্ছিস না, তা হলে অত হাত কচলাবি কেন? হয় কাজে ফাঁকি দিচ্ছে, নয় তো টাকা মারছে।’ শুনে আমি হতবাক। বললুম, ‘তোমার তা-ই মনে হয়?’ তাতে হেসে বলল, ‘অ্যাজ শিয়োর অ্যাজ এগস আর এগস!’ তা ডোরার কথা তো শুনলে চারুদা, এনি কমেন্টস?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কী আর বলব। মেয়েটিকে তো এখনও পর্যন্ত চোখেই দেখিনি। তবে হ্যাঁ, আজ রাত্তিরে তো ওখানে যাচ্ছি, তখন নিশ্চয় আর-একটু ভাল করে বুঝতে পারব। কিন্তু ও-সব কথা এখন থাক, যেজন্যে এখানে এসেছি তা-ই নিয়ে বরং দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করি।”

কেদারেশ্বর বললেন, “বেশ তো, করো।”

“সুশান্তর সঙ্গে তোমার মাঝেমধ্যে দেখা হত নিশ্চয়?”

“প্রথম কয়েকটা বছর তো ফি হপ্তাতেই দেখা হত।” কেদারেশ্বর বললেন, “কলকাতার ভিড়ভাট্টা ও পছন্দ করত না, তাই একটা নিরিবিলি জায়গা দেখে আমাকে কিছুটা জমি কিনে দিতে বলেছিল। ধুবুড়িতে তেমন পছন্দসই জমি পাইনি বলে কোকরাঝাড়ে বাগানসুদ্ধু একটা বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি প্রায় জলের দরে ওকে কিনিয়ে দিই। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে হাইওয়ের ধারে বাড়ি, দেখেই ওর ভাল লেগে যায়। বাড়িটা একটু সারিয়ে-সুরিয়ে নিয়ে এইট্রিফাইভের গোড়ার দিকে ও সেখানে চলে আসে। তা, এ-সব কথা তো কলকাতাতেই তোমাকে বলেছি।”

সদানন্দবাবু এরই মধ্যে বোধহয় একটু রহস্যের সন্ধান পেতে শুরু করেছিলেন। বললেন, “সারিয়ে-সুরিয়ে নেবার দরকার হল কেন? খুব পুরনো বাড়ি? মানে ওই যাকে হানাবাড়ি বলে, সেই রকমের বাড়ি নয় তো?”

“আরে না না,” কেদারেশ্বর হেসে বললেন, “এক প্ল্যান্টার-সায়েবের বাড়ি। শখ করে করিয়েছিলেন, পরে এদিকে ল অ্যান্ড অর্ডার সিচুয়েশন একটু খারাপ হয়ে পড়তে শিলং চলে যান। এ হল এইট্টিওয়ানের কথা। ভদ্রলোক তখন থেকেই বাড়িটা বিক্রি করে দেবার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু খদ্দের পাচ্ছিলেন না। আমি যে জমির খোঁজে আছি, আসাম ট্ৰিবিউনে এই বিজ্ঞাপন দেখে তিনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বাড়ি আর জমি দেখেই আমি বায়না করে ফেলি। তবে, বুঝতেই তো পারছেন, বছর চারেক বাড়িটা খালি পড়ে ছিল, কোনও মেনটেন্যান্সই ছিল না, বাগানটাও আগাছায় ভর্তি হয়ে গিয়েছিল, এই আর কি। তবে মিস্ত্রি আর মালি লাগিয়ে যা-যা দরকার সেগুলো করে নিতেই তার ভোল ফিরে গেছে। …না না, হানাবাড়ি-টাড়ি নয়।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তোমার সঙ্গে ফি-হপ্তাতেই দেখা হত বলছিলে না?”

“তা তো হতই। আসলে, তেমন কিছু দূরে তো নয়। জায়গাটা কোকরাঝাড় জেলায় হলেও ধুবুড়ির বর্ডারের খুব কাছেই। কলকাতা থেকে এখানে চলে আসার পরে-পরেই সুশান্ত একটা সেকেন্ডহ্যান্ড ফিয়াট কিনে ফেলেছিল। সেটা চালিয়ে এ-হপ্তায় ও যদি ধুবুড়িতে এসে আমার এখানে উইকএন্ডটা কাটিয়ে যেত তো পরের হপ্তাতেই উইকএন্ড কাটাতে অনুপমাকে নিয়ে আমি চলে যেতুম ওর ওখানে। ইদানীং অবশ্য দেখাসাক্ষাৎ একটু কমে এসেছিল। তাও মাসে অন্তত একবার আমাদের দেখা হতই। তা ছাড়া, বয়েস হয়েছে বলে এখন আর হুটহাট গাড়ি চালিয়ে দেখা করতে যেতে পারি না বটে, তবে যেমন আমার, তেমন ওরও তো একটা টেলিফোন রয়েছে, তাই পরস্পরের খবর নেবার ব্যাপারে আমাদের কোনও অসুবিধে ছিল না। অবশ্য যন্তরটা ঠিক থাকলে তবেই। ওভারহেড তার তো, কখন যে বিগড়ে যাবে, বোঝা ভার। প্রায়ই বিগড়ে যায়।”

“এখন ঠিক আছে তো?”

“একটু আগেও ঠিক ছিল না।” কেদারেশ্বর হেসে বললেন, “তেরো তারিখের সকাল থেকে বিগড়ে ছিল, আজ দশটায় ঘন্টাখানেকের জন্যে লাইন এসেই আবার চলে যায়। তোমরা এসে পৌঁছবার পরে ভেবেছিলুম যে, মহিমকে একটা ফোন করে তোমাদের আসার খবরটা জানিয়ে দেব। তা রিসিভার তুলে দেখলুম, ডায়াল টোন আসছে না।”

বলতে-না-বলতে ঘরের কোণে একটা চৌকো নিচু টেবিলে রাখা টেলিফোনটা বেজে উঠল। কেদারেশ্বর উঠে গিয়ে ক্রেডল থেকে রিসিভার তুলে বললেন, “হ্যালো…ও, মহিম? …

আরে ভাই, বোলো না, আমাদের টেলিফোন এতক্ষণ ঠিক ছিল না, লাইন এই মাত্তর এল। …আরে হ্যাঁ, ওরা ঠিকমতো এসে পৌঁছেছেন। …তোমার ট্যাক্সি অবশ্য আজ ফেরত যাচ্ছে না, পরেশ প্যাসেঞ্জার পেয়ে গেছে, নলবাড়ির প্যাসেঞ্জার, তাঁকে নিয়ে কাল ভোরে রওনা হবে। …কী বললে? ওঁরা কবে ফিরবেন? …তা তো বলতে পারছি না, দু-এক দিনের মধ্যেও ফিরতে পারেন, আবার হপ্তাখানেকও লেগে যেতে পারে। তবে তাই নিয়ে চিন্তা কোরো না, কাকার ড্রাইভার আর গাড়ি তো এখন এখানেই, উনিই ওঁর গাড়িতে ওঁদের গুয়াহাটিতে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করবেন। …আরে না না, তুমি যথেষ্ট করেছ। থ্যাংকস আ লট।”

রিসিভার নামিয়ে রেখে কেদারেশ্বর আবার আমাদের সামনে এসে বসলেন। বললেন, “মহিম বরুয়া ফোন করেছিল। খুবই উপকারী লোক। আগে কাকার আপিসে কাজ করত, এখন নিজেই একটা ছোটখাটো ব্যাবসা খুলে বসেছে। কাকার সঙ্গে সম্পর্ক তাই বলে খারাপ হয়নি। ইন ফ্যাক্ট ওর ব্যাবসাটা যাতে দাঁড়িয়ে যায়, কাকা তার জন্যে ওকে সাহায্যও কিছু কম করেন না।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “লোকটি যে ভাল, সে তো গৌহাটিতে ওই যে একটা দিন ছিলুম, তারই মধ্যে আমরা বুঝতে পেরেছি। আমরা যে তিনজন আসব, তা তো উনি জানতেন না। আর সেটা জানবেনই বা কী করে, ফোন খারাপ ছিল বলে তেরো তারিখে তো তুমি আমার সঙ্গে যোগাযোগই করতে পারোনি। ফলে উনিও জানতেন না যে, আমরা ক’জন আসছি। তা সত্ত্বেও, আমাদের যাতে কোনও ব্যাপারেই কোনও অসুবিধে না হয়, তার জন্যে উনি যথাসাধ্য করেছেন।”

ছেলেবেলায় নেসফিল্ডের গ্রামার-বইয়ে যে ইংরেজি বাক্যটি আমাদের শেখানো হয়েছিল, সদানন্দবাবু দেখলুম সেটা এখনও ভোলেননি। কেদারেশ্বরের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “হি লেফ্‌ট নো স্টোন আনটার্নড।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু সে-কথা এখন থাক। আচ্ছা কেদার, তুমি বলছ যে, টেলিফোনে তোমার সঙ্গে সুশান্তর মাঝেমধ্যে কথা হত। তা শেষ কবে কথা হয়েছিল, মনে পড়ে?”

“ভালই মনে পড়ে।” কেদারেশ্বর বললেন, “দশই মার্চ রাত্তিরে কাকার বাড়িতে একটা পার্টি দেওয়া হয়েছিল।”

“কীসের পার্টি?”

“খাওয়া-দাওয়ার।”

“উপলক্ষটা কী?”

“উপলক্ষটা আর-কিছু নয়, যে-ছেলে ইহজন্মে আর ফিরবে না বলে জানিয়ে দিয়েছিল, অনেক বছর বাদে সে আবার ফিরে এসেছে, তাও সে একা ফেরেনি, সঙ্গে নিয়ে এসেছে তার বউ আর ছেলেকে, সেটা সেলিব্রেট করতে হবে না? কাকার ইচ্ছে ছিল শঙ্কর থাকতে-থাকতেই এখানকার জনাকয় আত্মীয় আর বন্ধুবান্ধবকে ডেকে একটু খাওয়া-দাওয়া করবেন। কিন্তু একে তো তিনি নিজেই তখন ডাক্তারের আদেশে শষ্যাবন্দি, তার উপরে আবার শঙ্গর তো মাত্র দিন কয়েক এখানে থেকেই তার ছেলেকে নিয়ে লন্ডনে ফিরে গেল, ফলে পিছিয়ে দিতে হল পার্টির দিন। ঠিক করলেন, ছেলে আর নাতি না-থাকল তো না-ই থাকল, পুত্রবধূটি তো রয়েছে, পাঁচজনের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যেই একটা পার্টি দেবেন। তা সেটাই হল গত মাসের দশ তারিখে। আর তার পরদিন অর্থাৎ এগারোই মার্চ সকালে সুশান্তকে আমি ফোন করি। ফোনে তার সঙ্গে মিনিট পাঁচ-সাত কথা হয়। সেই আমাদের শেষ কথা।”

“কথা বলে কী মনে হয়েছিল তোমার?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “মানে এমনটা কি মনে হয়নি যে, সে একটা মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছে?”

“কই, না তো।”

“কেউ তাকে ভয় দেখাচ্ছে বা ওই রকমের কিছু?”

“না, তাও তো বলল না।”

“যা-কিছু বলল, সবই একেবারে নর্মাল?”

তক্ষুনি এ-কথার উত্তর না-দিয়ে মিনিট খানেক চুপ করে রইলেন কেদারেশ্বর। তারপর ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “নাউ দ্যাট ইউ হ্যাভ সেইড ইট, এখন আমার মনে হচ্ছে যে,সুশান্তর সব কথাই সেদিন স্বাভাবিক ছিল, শুধু একটা কথা বাদে।’

ভাদুড়িমশায়ের চোখ দেখলুম সরু হয়ে এসেছে। গলার স্বর নামিয়ে, একটু সামনে ঝুঁকে, তিনি বললেন, “কথাটা কী?”

কেদারেশ্বর বললেন, “এ-কথা ও-কথার পরে সুশান্তকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলুম যে, তার শরীর ঠিক আছে তো? তাতে সে বলে যে, শরীর ঠিকই আছে, কিন্তু এখানে থাকতে আর তার ভাল লাগছে না।”

“তা কথাটা তোমার অস্বাভাবিক ঠেকল কেন?”

“আর-কেউ বললে ঠেকত না, সুশান্ত বলল বলেই ঠেকল।”

“একটু বুঝিয়ে বলবে?”

“বলছি। কলকাতায় যখন ওকে শেষ দেখি, তখন ওর দুর্দিন পুরোপুরি কেটে গেছে। ইন ফ্যাক্‌ট সুশান্ত তখন বহু লক্ষ টাকার মালিক। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার মনে হয়েছিল যে, ও একটা মারাত্মক রকমের ডিপ্রেশানে ভুগচে। কোকরাঝাড়ে আসার পরে কিন্তু সেটা কেটে যায়। আর হ্যাঁ, মনে আনন্দ থাকলে যা হয়, স্বাস্থ্যটাও পুরোপুরি ফিরে গিয়েছিল। রোজ পাহাড়ে উঠে গিয়ে বেশ খানিকটা ট্রেকিং করত, নীচে নেমে বাগানের কাজ করত, মালি তো একজন ছিলই, কিন্তু নিজেও বাগানের পিছনে খাটাখাটুনি কিছু কম করত না। কখনও মাটি কোপাচ্ছে, কখনও ঝারিতে করে জল দিচ্ছে, কখনও লনের ঘাস ছাঁটছে, কখনও আগাছা সাফ করছে, কখনও বারান্দার রেলিংয়ে তুলে দিচ্ছে বেগনোলিয়া ভ্যানেস্তার লতা। আর যখনই দেখা হচ্ছে, তখনই বলছে, বড় ভাল আছি রে ভাই, এখানে নিয়ে এসে তুই আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিস। সব সময়ে যেন টগবগ করে ফুটত। সেই লোকটা বলে কিনা এখানে আর ওর ভাল লাগছে না। এমন কথা এর আগে কখনও ওর মুখে শুনিনি তো, তাই একটু অস্বাভাবিক ঠেকেছিল।”

“সেদিনই বা অমন কথা বলল কেন, কিছু আন্দাজ করতে পারো?”

“না।”

“ওকে তো এইট্টিফাইভে এখানে নিয়ে এসেছিলে,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তার মানে টানা তেরো বছর ও কোকরাঝাড়ে রয়েছে। এর মধ্যে আর কলকাতায় যায়নি?”

“কলকাতায় কেন, কোথাও যায়নি। এমনকী গুয়াহাটি কিংবা শিলংয়েও না। অনুপমাকে নিয়ে ফি বছরই তো আমি ডিউরিং দ্য সামার মান্থস দিন পনেরোর জন্যে শিলংয়ে বেড়াতে যাই। তা একবারও কি আমাদের সঙ্গে ওকে শিলংয়ে নিয়ে যেতে পারলুম? কম তো বলিনি, কিন্তু কোথাও যাবার কথা উঠলেই বলত, না রে, এখানেই দিব্যি আছি, আমি গেলে বাগানটা কে দেখবে?”

“কেন, একজন মালি তো রয়েছে।”

“রাইট। বাগানের দেখাশোনা করার জন্যে মালি রয়েছে, বাড়ি পাহারা দেবার জন্যে একজন চৌকিদার রয়েছে, আর সবকিছুর তদারকি করার জন্যে রয়েছে গোবিন্দ।”

সদানন্দবাবু বললেন, “এই গোবিন্দটি কে?”

আমি বললুম, “যাচ্চলে, কিছুই দেখছি আপনার মনে থাকে না। গোবিন্দ কে, সে তো কেদারবাবুর কাছে কলকাতাতেই আমরা শুনেছি।”

কেদারেশ্বর ও কলকাতার উল্লেখ নিশ্চয়ই সদানন্দবাবুর স্মৃতির সলতেটাকে একটু উশকে দিয়ে থাকবে। তাই প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে তিনি বললেন, “মনে থাকবে না কেন, পষ্ট মনে আচে, ওই মাঝেমদ্যে একটু ভুলে যাই আর কি। গোবিন্দ হল গে সুশান্তবাবুর বাপের আমলের চাকর। তাই না?”

“চাকর বললে খুব কমই বলা হয়।” কেদারেশ্বর বললেন, “সুশান্তর সমবয়সি, ওর ছেলেবেলার খেলার সঙ্গীও বটে। তা ছাড়া, সুশান্তর যখন ঘোর দুঃসময়, এই গোবিন্দই তখন দু’হাতে ওকে আগলে রেখেছিল। কলকাতার পাট তুলে দিয়ে সুশান্ত যখন কোকরাঝাড়ে চলে আসে, তখন গোবিন্দও চলে এসেছিল ওর সঙ্গে। …তো যা বলছিলুম, বাড়ি আর বাগানের দেখাশোনা করার জন্যে গোবিন্দই যখন রয়েছে, তখন কোকরাঝাড় থেকে দশ-পনেরো দিনের জন্যে সুশান্ত কি কোথাও যেতে পারত না? ছুটি কাটাবার জায়গার তো এই নর্থ-ইস্ট ইন্ডিয়ার কিছু অভাব নেই, দিন কয়েকের জন্যে সেখান থেকে ঘুরে আসতে পারত না? পারত ঠিকই, কিন্তু যেত না। ওই যা মাঝেমধ্যে আমার এখানে এসে উইকএন্ডটা কাটিয়ে যেত, বাস্। তাও উইকএন্ডের পরে এমন পড়িমরি করে ছুট লাগাত যে, বুঝতে পারতুম, ওর মন সেই কোকরাঝাড়েই পড়ে আছে। কথাটা ও নিজেও স্বীকার করত। বলত, ওই বাড়িটা ছেড়ে কোথাও আমার যেতে ইচ্ছে করে না। তা সেই লোক যদি বলে বসে যে, কোকরাঝাড়ে থাকতে আর ওর ভাল লাগছে না, তা হলে সেটাকে একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার বলে ভাবতে হবে বই কি।”

পর্দা সরিয়ে অনুপমা এসে ঘরে ঢুকলেন। পিছনে চায়ের ট্রে হাতে শিবু। ট্রেটা শিবুর হাত থেকে নিয়ে সেন্টার-টেবিলে নামিয়ে রেখে অনুপমা বললেন, “একটু আগে শিবুকে ও-বাড়িতে পাঠিয়েছিলুম। শুনলুম, কাকার বাবুর্চি নাকি কাল রাত্তিরেই গুয়াহাটি থেকে এখানে এসে গেছে। শিবুর কথা শুনে মনে হল, বাইরের এক-আধজন লোকের কথা যদি ছেড়ে দাও, তো ইনভাইটি বলতে শুধু নাকি আমরাই। তবে বাবুর্চি যখন এসে গেছে, তখন আইটেম নেহাত কম হবে না। তাই…’

কথাটা অনুপম শেষ করলেন না। কেদারেশ্বর বললেন, “তাই কী?”

অনুপমা হেসে বললেন, “তাই আপাতত চায়ের সঙ্গে বিস্কুট ছাড়া আর-কিছু দিচ্ছি না। খিদে নষ্ট করে তো লাভ নেই।”

কথা শেষ করে অনুপমা চলে যাচ্ছিলেন। যেতে-যেতে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, “ও হ্যাঁ, আর-একটা কথা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখুন, পাঁচটা বেজে গেছে। আমরা কিন্তু সাড়ে ছ’টায় বেরিয়ে পড়ব।”

টি-পট থেকে নিজের পেয়ালায় চা ঢেলে নিলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর পটটা সদানন্দবাবুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজের পেয়ালায় দুধ আর চিনি মিশিয়ে নিতে-নিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনারা যে যার মতো বানিয়ে নিন। আমার মশাই দুধ-চিনি ছাড়া চলে না।”

কেদারেশ্বরেরও দেখলুম, দুধ-চিনি ছাড়া চলে না। আমি আর সদানন্দবাবু স্রেফ লিকার খাচ্ছি দেখে বললেন, “আমারও মশাই ব্ল্যাক খাওয়াই উচিত!”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তার মানে শুগার বাধিয়ে বসেছ?”

“হ্যাঁ। ডাক্তার অন্তত সেই কথাই বললেন। এমনিতেও নাকি এই বয়েসে শুগারের ইনটেক যত কম হয় ততই ভাল। কিন্তু পারছি কোথায়। আর তা ছাড়া, প্রতিটি অ্যাডভাইসই যদি মেনে চলব, তবে আর বেঁচে থেকে লাভই বা কী?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আর-একটা কথা জিজ্ঞেস করি, কেদার। সুশান্তর নিখোঁজ হওয়ার খবরটা তুমি প্রথম কখন পেলে?”

“তার পরদিন,” কেদারেশ্বর বললেন, “অর্থাৎ বারোই মার্চ দুপুরে। ফোন করে গোবিন্দই আমাকে জানায় যে, সকাল থেকেই সে তার মনিবের কোনও খোঁজ পাচ্ছে না। গোবিন্দ বলে যে, সে ভেবেছিল, ‘খোকাবাবু যেমন রোজ ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে পাহাড়ে বেড়াতে যায়, তেমনি আজও গিয়েছে। কিন্তু পাহাড় থেকে সে তো ফিরেও আসে সকাল আটটা-ন’টার মধ্যে। কিন্তু আজ বারোটার মধ্যেও ফেরেনি।’ কাছাকাছি খোঁজ করে দেখেছে কি না, জিজ্ঞেস করতে সে বলে দশটার পরেই সে কাছেপিঠে সব জায়গায় খোঁজ করার জন্যে লোক পাঠিয়েছিল। কিন্তু মালি, চৌকিদার আর ঝি-চাকর দুজন বারোটা নাগাদ ফিরে এসে তাকে বলে যে, কোত্থাও কেউ তার খোঁজ দিতে পারল না। শুনে গোবিন্দকে আমি বলি, ভয় পাবার কিছু নেই, হয়তো কোথাও কোনও কাজে গেছে, তাড়াহুড়ো করে গেছে বলে জানিয়ে যেতে পারেনি, তবে আজ-কালের মধ্যেই ফিরে আসবে নিশ্চয়।”

“তারপর?”

“সুশান্ত কিন্তু পাঁচ দিনের মধ্যেও ফেরে না।” কেদারেশ্বর বললেন, “গোবিন্দকে তো ভয় না-পেতে বলেছিলুম। কিন্তু আমিই তখন ভয় পেয়ে যাই। লোকাল থানায় আগেই খবর দেওয়া হয়েছিল, তারা পাহাড়ে উঠেও তল্লাসি চালায়। কিন্তু কোনও সন্ধান পাওয়া তো দূরের কথা, হঠাৎ একটা লোক কেন নিখোঁজ হল, তার কোনও ক্লু পর্যন্ত খুঁজে পায় না। আমি তখন আর দেরি না-করে গৌহাটি গিয়ে প্রতিটি ইংরেজি আর অসমিয়া কাগজের নিরুদ্দেশ কলামে বিজ্ঞাপন দিই। উইথ ফোটোগ্রাফ।”

“ফোটোগ্রাফের একটা কপি তোমার কাছে পাওয়া যাবে?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “মানে ওটা পাওয়া গেলে বুঝতে পারতুম যে, সুশান্তর চেহারাটা এখন কেমন দাঁড়িয়েছে। সেই যখন তোমরা কলেজে পড়তে, তার পরে তো আর ওকে দেখিনি। পাওয়া যাবে?”

“তা কেন যাবে না। বছর দুয়েক আগে ওর সঙ্গে একটা ফোটো তুলিয়েছিলুম। নেগেটিভটা ছিল। কাগজে বিজ্ঞাপন দেবার সময় ছবির দরকার হয়, তখন নেগেটিভ থেকে ওর চেহারাটা আলাদা করে পাসপোর্ট সাইজের গুটি কয়েক প্রিন্ট করিয়ে নিই। একটা প্রিন্ট আমার কাছে রয়েছে। দাঁড়াও, এনে দিচ্ছি।”

সোফা ছেড়ে উঠে পড়লেন কেদারেশ্বর। ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মিনিট দুই-তিন বাদে ফিরে এসে ভাদুড়িমশাইয়ের হাতে ছোট একটা এনভেলাপ তুলে দিয়ে বললেন, “খুলে দ্যাখো। বোধহয় চিনতে পারবে না।”

খাম খুলে ছবিটা বার করলেন ভাদুড়িমশাই। দেখলুম, ছবির দিকে তাকিয়ে তার ভুরু একটু কুঁচকে গেছে। বললেন, “লোকে বলে, আই হ্যাভ আ গুড মেমারি ফর ফেসেস। খুব-একটা ভুল বলে না। একবার যাকে দেখেছি, অনেক দিন বাদে দেখলেও তাকে ঠিকই চিনতে পারি। সিমলার কথা মনে পড়ে? সেখানে তোমাকে দেখেছিলুম তা প্রায় চল্লিশ বছর বাদে, কিন্তু দেখামাত্র চিনতে পেরেছিলুম যে, এ সেই কেদার। কিন্তু একে তো সুশান্ত বলে চিনতে পারছি না।

“কী করে পারবে? ওর চেহারা তো একেবারে পালটে গেছে।”

“চেহারা তোমারও কিছু কম পালটায়নি। যেমন প্রত্যেকের পালটায়, তেমনি তোমারও পালটেছে কিন্তু তা সত্ত্বেও তোমাকে ঠিকই চিনতে পেরেছিলুম। কিন্তু সুশান্তকে পারছি না। কেন পারছি না, আন্দাজ করতে পারো?”

“কেন?”

“দ্য আসার ইজ ভেরি সিম্পল।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আসলে চেহারাটা একটা ফ্যাক্টর বটে, কিন্তু একমাত্র ফ্যাক্টর নয়। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা পুরনো পরিচিত মানুষদের চিনে নিই তাদের হাঁটাচলার ভঙ্গি দেখে, তাঁদের হাসি দেখে, কখনও-কখনও দু-একটা মুদ্রাদোষ দেখে, কি এই রকমের অন্য-কিছু ব্যাপার দেখে। কিন্তু এটা তো মুভি নয়, স্টিল ফোটোগ্রাফ। সুশান্তর হাঁটার ভঙ্গি তাই এখানে দেখতে পাচ্ছি না। তার উপরে একটু আড়ষ্ট হয়ে ছবি তুলিয়েছিল, মুখে তাই হাসি নেই। তা ছাড়া, গোটা মুখ দাড়িতে ঢাকা। তা হলে আর চিনব কী করে?”

সদানন্দবাবু বললেন, “এ একেবারে খাঁটি কতাই বলেচেন। আমার এক মাসতুতো শালা, নর্থ ক্যালকাটার শিকদেরবাগানের হাবুল মিত্তির, যেন বাতাসের মদ্যে সাঁতার কেটে চলচেন, এইভাবে তাঁর হাত দুখানাকে সামনে-পেছনে দোলাতে দোলাতে আর লগরবগর করতে-করতে রাস্তা দিয়ে চলতেন। তা তাঁর মুক দেকারও দরকার হত না, পেছন থেকে সেরেপ হাঁটার ভঙ্গি দেকেই যে-কেউ বলে দিতে পারত যে, হ্যাঁ, লোকটা হাবুল মিত্তিরই বটে।”

ফোটোগ্রাফখানা নিজে দেখে নিয়ে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন ভাদুড়িমশাই। আমার ও সদানন্দবাবুর হাত ঘুরে ভাদুড়িমশাইয়ের কাছে ফিরে যেতে তিনি ফের সেটিকে এনভেলাপে ঢুকিয়ে নিজের বুকপকেটে রেখে দিলেন। তারপর কেদারেশ্বরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ছবি দেখে কী মনে হল জানো?”

“কী মনে হল?”

“মনে হল, বয়েস তো সুশান্তরও এতদিনে সত্তর হয়ে যাওয়া উচিত, কিন্তু বয়েস এখনও তার উপরে তেমন ছাপ ফেলতে পারেনি। মুখময় দাড়ি বটে, কিন্তু কপালটা তো দেখতে পাচ্ছি, তাতে বলিরেখার কোনও চিহ্নই নেই, বেশ টান-কপাল। তা ছাড়া, তোমার মতো টাক পড়েনি, মাথাভর্তি চুল। যেমন চুল তেমন দাড়িতেও পাকার তুলনায় কাঁচারই প্রাধান্য। চোখে হাসির ছোঁয়া নেই বটে, কিন্তু তাতে এখনও একটু বিস্ময়ের ছোঁয়া লেগে আছে। তাতে মনে হয়, জীবন সম্পর্কে তার আগ্রহ এখনও শেষ হয়ে যায়নি।”

কেদারেশ্বর হেসে বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ, চারুদা। দেখলে মনে হবে, ওর বয়েস এখনও পঞ্চাশ পেরোয়নি।”

ভাদুড়িমশাই হাসলেন, “আপাতত আর মাত্র একটা প্রশ্ন করব তোমাকে। এগারোই মার্চের সকালে তো ওর সঙ্গে শেষবারের মতো কথা হয়েছিল তোমার। তার আগে শেষ দেখাটা হয়েছিল কবে?”

“ঠিক তার আগের দিন। অর্থাৎ দশই মাৰ্চ।”

“কিন্তু সেদিন তো তোমার কাকার বাড়িতে পার্টি ছিল, তা-ই না?”

“হ্যাঁ।” কেদারেশ্বর বললেন, “ওই পার্টিতেই ওর সঙ্গে শেষ দেখা।”

ভাদুড়িমশাইয়ের চোখ দুটি দেখলুম আবার সরু হয়ে এসেছে। দেওয়ালে ঝুলছে কাঞ্চনজঙ্ঘার একটা বাঁধানো ফোটোগ্রাফ। চুপ করে তিনি তাকিয়ে রইলেন সেদিকে। কিছুই বললেন না।