১
সদানন্দবাবু তাঁর হাতের কাগজখানা ভাঁজ করে সেন্টার-টেবিলের উপরে সশব্দে নামিয়ে রেখে বললেন, “আর তো পারা যায় না, মশাই! এমনটা যে হবে, এ তো ভাবতেও পারিনি! এসব হচ্ছে কী, অ্যাঁ?”
সম্ভবত তিনি আশা করেছিলেন যে, এবারে অন্তত কেউ একজন মুখ তুলে তাঁর দিকে তাকাবেন
কিন্তু আমরা কেউই মুখ তুললুম না। আমি যেমন ‘শরদিন্দু-অমনিবাস’ খুলে বরদার ভৌতিক কাহিনী পড়ছিলুম, তেমনই পড়তে থাকলুম। পাছে আমাদের কারও বিরক্তি ঘটে, তাই টিভির সাউন্ডটাকে একেবারে সবচেয়ে নিচু পর্দায় নামিয়ে দিয়ে কৌশিক যেমন মগ্ন হয়ে এম জি এম-এর কার্টুন-ছবি ‘টম অ্যান্ড জেরি’ দেখছিল তেমন দেখতেই ও মাঝেমধ্যে আপন মনে খুকখুক করে হাসতেই থাকল। অরুণ সান্যাল যেমন মেডিক্যাল জার্নালের নতুন-আসা সংখ্যাটির উপরে চোখ বুলোচ্ছিলেন, তেমন বুলোতেই থাকলেন। এমনকি ভাদুড়িমশাইও ‘ইস্টার্ন কুরিয়ার’-এর সানডে সেকশনের শেষ পৃষ্ঠাটি সামনে রেখে যেমন ওযার্ড জাম্বল-এর সমাধান খুঁজে যাচ্ছিলেন, তেমন খুঁজতেই থাকলেন। কারও মুখে টু শব্দটি নেই, সক্কলে স্পিকটি নট্।
অথচ সদানন্দবাবুর কথা যে কারও কানে যায়নি, তা নয়। আমার কানে যেমন গিয়েছে, তেমন অন্যদের কানেও নিশ্চয় গিয়ে থাকবে। তবু, মুখ তোলা তো দূরের কথা, কারও যে কিছুমাত্র ভাবান্তর হয়েছে, তাও আমার মনে হল না।
শেষ পর্যন্ত আমাকেই মুখ তুলতে ও খুলতে হল। বললুম, “কী হল, এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন?” ভাদুড়িমশাইও একেবারে সঙ্গে-সঙ্গেই মুখ খুললেন। বললেন, “টি, আর, ইউ, ই, টি উলটে-পালটে, ইউ, টি, টি, ই, আর! অর্থাৎ আটার। উত্তরটা যে হন্টেড হাউস হবে, সে তো ছবি দেখেই বুঝেছিলুম, কিন্তু দুটো ইউ-এর একটা এতক্ষণ খুঁজে পাচ্ছিলুম না। যাক, সার্কলের মধ্যে সেটাও পাওয়া গেল। …তো সদানন্দবাবু, আপনি যেন কী বলছিলেন?”
প্রশ্নটার জবাব না দিয়ে সদানন্দবাবু পালটা প্রশ্ন করলেন। “হন্টেড হাউস? সেটা আবার কী? আজকাল যেসব পনেরোতলা বিশতলা বাড়ি হচ্চে, সেই রকমের কোনও হাল-ফ্যাশানের বাড়ি?”
টিভিতে ইতিমধ্যে ‘টম অ্যান্ড জেরি’ শেষ হয়ে গিয়ে নতুন যে কার্টুন-ছবি শুরু হয়েছিল সেটা বিশেষ পছন্দ না-হওয়ায় সুইচ অফ করে দিয়ে, আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে কৌশিক বলল, “বোস-জেঠু, হাল-ফ্যাশানের বাড়ি নয়, হানাবাড়ি।”
অরুণ সান্যাল তাঁর হাতের ম্যাগাজিন নামিয়ে রেখে বললেন, “কিছু বোঝা গেল?”
“তা কেন বুজব না?” সদানন্দবাবু বললেন, “ওই যাতে ভূত-পেত্নি থাকে আর কী! জানলার ছিটকিনি আর দরজার খিল আপনা থেকেই খুলে গিয়ে হঠাৎ-হঠাৎ জানলা-দরজা হাট হয়ে যায়, সারারাত্তির বাচ্চা-ছেলের কান্না শোনা যায়, গরমের দিনেও, কিচুর মদ্যে কিচু না, কোত্থেকে যেন ঠান্ডা বাতাস এসে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে, সে আবার এমন ঠান্ডা যে, হাড় হিম হয়ে যাবার জোগাড় হয়। তা-ই না?”
“ঠিক তা-ই।”
শুনে সদানন্দবাবু এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। তারপর, গলাটা একটু খারে নিয়ে বললেন, “দুগ্গা দুগ্গা! কী বলব মশাই, আমাদের তারকেশ্বরের ওদিকেও ঠিক এই রকমের একটা বাড়ি ছিল। অনেক কালের পুরনো বাড়ি। আমার ছেলেবেলায় যখন দেকিচি, তখনই তার আলসেয় আর দেয়ালে ইয়াব্বড়-বড় সব বটগাছ গজিয়ে গেচে, ছাত ফুটো হয়ে বর্ষাকালে জলের তোড়ে ঘর ভেসে যাচ্ছে, পলেস্তারা খসে গিয়ে এখেনে-ওখেনে ইট বেরিয়ে পড়েছে। এখনকার কালের ইট নয়, সেই আমলের পাতলা ইট…ওই মানে মান্ধাতার কালের মন্দিরে-টন্দিরে যে-রকম ইট দেখা যায় আর কী।”
কৌশিক বলল, “তবে তো খুবই পুরনো।
“পুরনো বলে পুরনো!” সদানন্দবাবু বললেন, “বাবার কাচে শুনিচি এইট্রিনথ্ সেঞ্চুরির শেষের দিকে…ব্যাটল অব প্ল্যাসির বছর পনেরো-কুড়ি পরে তৈরি হয়েছিল। ওদিককার এক জমিদারের বাড়ি। কিন্তু খুব বেশিদিন তিনি নিজেও ও-বাড়িতে থাকতে পারেননি। সময়মতো খাজনা দিতে পারেননি বলে বাড়িসুদ্দু তাঁর জেমিন্ডারি নিলেম হয়ে যায়। কর্নওয়ালিস সায়েব তখনও পার্মানেন্ট সেটেলমেন্টের ব্যবস্থা করেননি তো… অন্তত আমার বাবার কাচে সেই রকমই শুনিচি।”
“ঠিকই শুনেছেন।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “পার্মানেন্ট সেট্লমেন্ট চালু হয় আরও বছর কয়েক বাদে, সেভেনটিন নাইনটিথ্রিতে।”
সদানন্দবাবু বললেন, “তা-ই? তবে তো বলতে হয়, বাবা মোটেই ভুল বলেননি, বাড়িটা যিনি করিয়েছিলেন, নেহাতই বছর কয়েকের মদ্যে তিনি ভিটেছাড়া হয়ে যান। কিন্তু সেটা কোনও কতা নয়, আসল কতা হল বাড়িসুদ্দু ওই জেমিন্ডরি কে কিনে নিল।”
অরুণ সান্যাল বললেন, “কে কিনল?”
“কিনল তাঁর নেমকহারাম নায়েব।”
অরুণ সান্যাল বললেন, “এ তো সিপয় মিউটিনির ষাট-পঁয়ষট্টি বছর আগের কথা!”
“বিলক্ষণ।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “দেবী সিঙ্গি ছিল কোম্পানির ইজেরাদার। কোম্পানির হয়ে সে-ই জমিদারদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করত। খলিফা লোক, তার উপরে ঘোর অত্যাচারী, খাজনা দিতে দেরি হওয়ার অজুহাতে এদিককার বিস্তর জমিদারিকে সে নিলামে তুলিয়ে ছেড়েছে। সে-সব জমিদারির অনেকগুলি যে সে জলের দরে নিজেই কিনে নেয়নি, তাও নয়। নাইনটিনথ সেঞ্চুরির গোড়ায় সে-ব্যাটা মারা যেতে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। তা সদানন্দবাবু, আপনাদের এই জমিদারবাবুটির খাজনা বাকি পড়ল কেন? অজন্মা হয়েছিল বলে প্রজারা খাজনা দেয়নি?”
“তা আমি কী করে বলব?” সদানন্দবাবু বললেন, “সে কি আজকের ব্যাপার? তবে হ্যাঁ, আমার বাবা তাঁর ঠাকুর্দার কাচে ছেলেবেলায় যা শুনেচিলেন, সেটা বলতে পারি।”
“তিনি কী শুনেছিলেন?”
“শুনেচিলেন যে, প্রজারা তাদের খাজনা ঠিকই দিয়েছিল, তবে কিনা তার যে-অংশটা কোম্পানির ইজেরাদারের কাচে পৌঁচে দেবার কতা, মাঝপথেই সেটা লুট হয়ে যায়। তো লোকে বলে যে, সব সাজানো ব্যাপার, ওই ব্যাটা নায়েবই তার লোক লাগিয়ে টাকাটা লুট করিয়েছিল। তা যদি না-ই হবে তো জমিদারি নিলেমে ওঠার পর সে ওই চক-মেলানো বাড়িসুদ্দু সেটা কিনল কী করে?”
“তারপর?”
“তারপরেই তো আসল ব্যাপার। কিনল ঠিকই, কিন্তু ধম্মে সইল না।”
“তার মানে?”
“তার মানে যারা আনগ্রেটফুল লোক, শেষ পর্যন্ত তাদের যা হয়, এই নায়েব-ব্যাটাচ্ছেলেরও তা-ই হল আর কী!”
গল্পের টানে কৌশিক ইতিমধ্যে টিভির সামনের চেয়ার থেকে উঠে এসে তার মামাবাবু ভাদুড়িমশাইয়ের পাশে বসে পড়েছিল। সেইখান থেকেই সে ঝুঁকে পড়ে বলল, “আঃ, বোস-জেঠু, আপনি বড্ড ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বলেন! কী হয়েছিল, সেটা সাফ-সাফ বলবেন তো। তা নয়, ইউ আর অল দ্য টাইম বিটিং অ্যাবাউট দ্য বুশ। কী হয়েছিল? বাজ পড়ে লোকটা মারা গেসল?”
উত্তরটা তক্ষুনি-তক্ষুনি পাওয়া গেল না। কেননা মালতী ইতিমধ্যে তার কাজের মেয়েটির হাত দিয়ে আর-এক প্রস্ত চা পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেন্টার-টেবিলে চায়ের ট্রে নামিয়ে রেখে মেয়েটি বলল, বারোটা বাজে, আজ আর চা দেওয়া হবে না, আধ ঘন্টার মধ্যেই খাবার ডাক পড়বে। “মা ওদিকে টেবিল সাজাচ্ছেন।”
সদানন্দবাবু বললেন, “তা হলে আবার এখুনি চা দেবার কী দরকার ছিল? আর তা ছাড়া আমি তো এনাদের মতো চা-খোর নই, মিনিটে-মিনিটে চা খাই না, হিসেব করে যেটুকু খাই তা এরই মধ্যে খাওয়া হয়ে গেচে। এটা খেলে তো বাড়তি হয়ে যাবে।”
আমি বললুম, “খান, খান, একে তো আজ রবিবার, তার উপরে ভাদুড়িমশাই বাঙ্গালোর থেকে সবে এসেছেন, এবারে নাকি পুরো এক হপ্তা এখানে থাকবেন, তা এটাকে সেলিব্রেট করার জন্যে আপনি যদি এক্সট্রা এক কাপ চা খান তো কিচ্ছু ক্ষতি হবে না।”
কৌশিকের ধৈর্যের বাঁধ একেবারে ভেঙে পড়বার উপক্রম হয়েছিল। অসহিষ্ণু গলায় বলল, “হচ্ছেটা কী? এখন আবার চা নিয়ে ডিসকাশন শুরু হয়ে গেল! বলি, গপ্পোটা কি শেষ হবে না?”
ধীরেসুস্থে নিজের পেয়ালায় লিকার ঢেলে নিয়ে তাতে আলতো একটা চুমুক দিয়ে সদানন্দবাবু বললেন, “হবে, বাবা, হবে।”
“তার তো কোনও লক্ষণ দেখছি না,” কৌশিক বলল, “খালিই তো আগড়ম-বাগড়ম কথা হচ্ছে। তারপর কী হল?”
‘সে তো বললুমই।” সদানন্দবাবু বললেন, “বললুম না?”
“কী বললেন?”
“ওই যে বললুম, ধম্মে সইল না। বুজলে বাবা, তোমরা এ কালের ছেলেপুলে, ধম্ম মানো না, জাত মানো না, যেখেনে-সেখেনে যা-ইচ্ছে তা-ই খেয়ে বেড়াও, কিন্তু একটা কতা সব সময়ে মনে রাখবে। ধৰ্ম্মের কল বাতাসে নড়ে, এটা কখনো ভুলে যেয়ো না।”
“ঠিক আছে, ভুলব না।” হাত জোড়-করে কৌশিক বলল, “কিন্তু কলটা এক্ষেত্রে কী ভাবে নড়ল, সেইটে বলুন দিকি। বাজ পড়ে লোকটার মাথা ফাটল?”
“ঠাট্টা করচ? তা করো।” সদানন্দবাবু আর-একবার তাঁর চায়ের পেয়ালার চুমুক দিয়ে বললেন, “কিন্তু বাবাজীবন, কলটা একবার নড়ে গেলে বাজ তো পড়তেই পারে আর সেটা পড়লে যে দুষ্টু লোকের মাতা ফাটে না, তাও কিন্তু নয়।”
ভাদুড়িমশাই ইতিমধ্যে চা শেষ করে একটা সিগারেট ধরিয়েছিলেন। একগাল ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “মিরনের কথা বলছেন তো?”
শুনে সদানন্দবাবু এমন হাঁ করে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন যে, তাতেই বোঝা গেল, নামটা তিনি আগে কখনও শোনেননি। অরুণ স্যান্যাল বললেন, “মিরজাফর নামটার সঙ্গে পরিচয় আছে তো?”
“তা কেন থাকবে না?” সদানন্দবাবু হেসে বললেন, “সিরাজুদ্দৌল্লার সেনাপতি ছিল। তবে কিনা ঘোর নেমকহারাম। তা নইলে কখনও সিরাজের চাকরি করেও যুদ্ধের সময় তাঁকে ফাঁসিয়ে দিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলায়?”
“মিরন তাঁরই ছেলে। বাজ পড়ে কিন্তু সত্যিই মিরনের মাথা ফেটেছিল।”
“তা-ই?” সদানন্দবাবু বললেন, “কিন্তু আমি মশাই মিরজাফরের ছেলের কতা ভাবছিলুম না। আমি ভাবছিলুম আমাদের ওদিককার অঘোর মণ্ডলের শালা তারিণীর কতা। শুনিচি মুনসেফ-আদালতে মিথ্যে সাক্ষী দিয়ে সে বাড়ি ফিরছিল। সেই সময়ে ঝড় উঠে মাঠের মদ্যিখানে বাজ পড়ে সে মারা যায়।”
বলে, একটুখানি চুপ করে থেকে, চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে তিনি বললেন, “তবে হ্যাঁ, মিরজাফরের সঙ্গে এই ব্যাপারেও সেই নায়েব-ব্যাটাচ্ছেলের একটা ভাল রকমের মিল রয়েচে দেকচি।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “নায়েবের ছেলেও বজ্রাঘাতে মারা গিয়েছিল?”
“না, মশাই, নায়েবের ছেলেকে সাপে কামড়েছিল।” সদানন্দবাবু বললেন, “জলের দরে জমিদারি হাতিয়ে নিয়ে, মনিবকে তাঁর বসতবাটী থেকে উচ্ছেদ করে, নায়েব তো তার ছেলে-বউ নিয়ে সেই চক-মেলানো বাড়ির মদ্যে গিয়ে ঢুকল। বাস, তারপর সাত দিনও কাটল না, সাপে কামড়াল তার জোয়ান ছেলেকে। তাও আবার ওই বাড়ির সামনেকার গোলাপ-বাগানের মদ্যেই কামড়াল। গোখরো সাপ। তার ছোবল খাবার পর ছেলেটা ঘন্টা তিনেকের মদ্যেই মুখে গ্যাজলা তুলে চোখ উলটে ফিনিশ।”
কৌশিক বলল, “আর সেই জমিদারবাবু? তাঁর কী হল? নিজের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়ে তিনি কোথায় গেলেন?”
সদানন্দবাবু বললেন, “কোতায় গেলেন, তাই নিয়ে নানান জনে নানান কতা বলে। শুনিচি তাঁর ছেলেপুলে ছিল না, থাকবার মদ্যে ছিল শুদু বউ। তা কেউ বলে যে, বউয়ের হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে শেষ বারের মতো পাল্কিতে উঠে তিনি বর্ধমানে চলে যান। সেখেনে বউটিকে তাঁর বাপের বাড়িতে পৌঁচে দিয়ে পাল্কির চার কাহারের পাওনাগন্ডা মিটিয়ে নিজে আবার রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত নাকি হরিদ্বারে গিয়ে পৌঁচেছিলেন। আবার কেউ বলে যে, হরিদ্বারে যাননি, আসলে বর্ধমান থেকে খানিক এগিয়ে দুগাপুরের জঙ্গলে ঢুকে নিজের মাতায় গুলি চালিয়ে তিনি আত্মঘাতী হন। আসলে সে-কালের জমিদার তো, মান-অপমানের জ্ঞানটা ছিল টনটনে। ওই যে নিজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে হল, এ তো একটা ঘোর অপমানের ব্যাপার, তা সেই অপমানের জ্বালাটা তিনি সহ্য করতে পারেননি।”
“আর সেই নায়েব?” অরুণ স্যান্যাল জিজ্ঞেস করলেন, “ছেলে মরার পর তার কী হল?”
“তার যা হল, তাতে আমার কী মনে হয় জানেন?”
“কী মনে হয়?”
“মনে হয় যে, জমিদারবাবু সন্নিসি হয়ে হরিদ্বারে যাননি, আসলে তিনি আত্মঘাতীই হয়েছিলেন। তা সে দুগ্গাপুরের জঙ্গলেই হোক কি আর-কোতাও হোক।”
“এ-কথা কেন বলছেন?”
“এইজন্যে বলচি যে, তার পরে ওই বাড়ির মদ্যে দিনের-পর দিন যা ঘটতে থাকল, তাঁবা-তুলসী হাতে নিয়ে বললেও তা আপনারা বিশ্বেস করবেন না।”
কৌশিক বলল, “আহা বোস-জেঠু, আপনি বলুনই না, বিশ্বাস করা যায় কি যায় না, সেটা বরং আমাদের উপরেই ছেড়ে দিন।”
“বেশ, তা হলে বলচি।” সদানন্দবাবু তাঁর গল্পের খেই ধরে ফের শুরু করলেন। “কী ঘটল জানেন? নায়েব-ব্যাটা সেই বাড়ির মদ্যে যেখেনেই যায়, সেখেনেই সেই জমিদারবাবুকে দেকতে পায়। চানের ঘরে গিয়ে দেকতে পায়, জমিদারবাবুটি চোক পাকিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আচেন। চুল আঁচড়াবার জন্যে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে দ্যাকে, আয়নায় তার নিজের চ্যায়রা নয়, জমিদারবাবুর চ্যায়রা ফুটে উটেচে। ভুরু কোঁচকানো, কটমটে চাউনি, ওঃ, সে এক বীভৎস ব্যাপার।”
“তা এ-সব তো আপনার শোনা-ব্যাপার বোস-জেঠু। তা-ই না?”
“তা বই কী। কপাল করে আমি কি ওই এইটিনথ সেঞ্চুরিতে জন্মেছিলুম যে, নিজের চোকে এ-সব দেকতে পাব। তবে কিনা শোনা-কতা হলেই যে সেটা মিথ্যে-কতা হবে তার তো কোনও মানে নেই। “ ভাদুড়িমশাই বললেন, “আর এই শোনা-কথা থেকেই আপনার মনে হল যে, জমিদারবাবুটি আত্মঘাতীই হয়েছিলেন?”
“বিলক্ষণ।” সদানন্দবাবু বললেন, “আরে মশাই, অপঘাতে মৃত্যু না-হলে কি কারও প্রেতাত্মা এমনি করে কাউকে তাড়া করে ফেরে? চোক পাকিয়ে এইভাবে তাকে ভয় দ্যাকায়? শুদু কি তা-ই? নায়েব-ব্যাটার ঘুমেরও সেই থেকে দফা-রফা। যদি-বা একটু ঝিমুনি ভাব আসে তো হঠাৎ-হঠাৎ চটকা ভেঙে যায়, আর তখনই শুনতে পায়… ওঃ, কী বলব মশাই, আমার তো সে-কথা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্চে!”
“কী শুনতে পায়?”
“শুনতে পায় যে, বাড়ির মদ্যেই কে যেন তেড়ে ব্যায়লা বাজাচ্চে!”
বললুম, “তারপর?”
সদানন্দবাবু বললেন, “তারপর আর কী, চান-ঘরে আর আয়নার মদ্যে জমিদারবাবুকে বার কয়েক দেকেই তো নায়েব-ব্যাটার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেসল, তারপর রাতের-পর-রাত না-ঘুমিয়ে আর ব্যায়লার ক্যা-কোঁ শুনতে-শুনতে অস্থির হয়ে গিয়ে নিজের পরনের কাপড়খানাকে পাগড়ির মতো করে মাতায় জড়িয়ে নিয়ে লোকটা একদিন তল্লাট ছেড়ে পালাল।”
কৌশিক বলল, “অর্থাৎ পাগল হয়ে গেসল, কেমন?”
“পাগল সে একা হয়নি, বাবাজীবন।” সদানন্দবাবু বললেন, “বাড়িটা তো খালিই পড়ে ছিল। বছর কয়েক বাদে এক নীলকর সায়েব সেখেনে এসে ঢোকে। জায়গাটা ভাল লেগে যাওয়ায় সে ঠিক করেছিল যে, সেখেনেই থেকে যাবে, কিন্তু তেরাত্তিরও কাটেনি, তার আগেই তাকেও সেখান থেকে পালাতে হয়।”
“সেও পাগল হয়ে গেসল?”
“তা আকাশে ভাল করে আলো ফোটার আগেই যদি কেউ তার বাড়ির ভেতর থেকে ডিগবাজি খেতে-খেতে বেরিয়ে আসে, তারপর দেউড়ি পেরিয়ে রাস্তায় নেমে, ধুলোর মদ্যে একবার গড়াগড়ি খেয়ে তাপর উটে ডাঁড়িয়ে নিজেরই দু’হাতে নিজের দু’কান পাকড়ে ধরে পাঁই-পাঁই করে ছুটতে থাকে তো লোকে তাকে পাগল ছাড়া আর কী বলবে?”
“ওই অবস্থায় তাকে কেউ দেখেছিল?”
“গাঁয়েরই এক চাষি দেকেছিল। বদনা হাতে সে গেসল মাটের কাজ সারতে। ব্যাপার দেকে সে তো হাঁ। মাটের মদ্যেই বদনা ফেলে রেকে সে এক-ছুটে বাড়িতে ফিরে আসে আর বলতে থাকে, ‘আরে ব্যাটা, তুই হচ্চিস সায়েব, কোতায় অন্যের কান পাকড়ে দুটো থাপ্পর মারবি, তা নয়, নিজেই নিজের কান মলচিস? আরে ছ্যাছ্যা!’ ঘটনার পরে পুরো সাত দিন সে নাকি ওই একটা কতাই বলে গেসল। শেষ পর্যন্ত পাশের গাঁ থেকে ওঝা ডেকে জলপড়া আর তেলপড়ার ব্যবস্তা করে তাকে সারিয়ে তুলতে হয়।”
অরুণ সান্যাল খুকখুক করে হাসছিলেন। সদানন্দবাবু তাতে খাপ্পা হয়ে বললেন, “আরে মশাই, এতে এত হাসির কী আচে? বিশ্বেস করতে ইচ্ছে না হয় তো করবেন না, কিন্তু নিজের কানে আমি যা শুনিচি, তা তো আমাকে বলতেই হবে। আর হ্যাঁ, এটাও জেনে রাকুন যে, তারপর থেকে আর ও-বাড়িতে কেউ ঢোকেনি।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “বাড়িটার অবস্থা এখন কী রকম?”
“দুশো বছর ধরে ফাঁকা পড়ে থাকলে যেমন হতে পারে, ঠিক সেইরকম। দরজা-জানলার কাঠ লোপাট, এখেনে-ওখেনে খিলেন ভেঙে পড়েচে, ছাত ফেটে জল পড়চে, বাগানে তিন-ফুট লম্বা ঘাস আর জঙ্গল গজিয়েচে, যেমন বাগান তেমনি বাড়ির মদ্যেও সাপ আর শ্যাল ঘুরে বেড়াচ্চে। কী বলব মশাই, ভূতের কতাটা জানাজানি হয়ে গেচে তো, তাই পার্টিশনের পরে পুব-বাংলা থেকে এত যে লোক এল, তাদেরও কেউ ও-বাড়িতে ঢোকেনি। এমনকি, নকশালরাও না।”
একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন সদানন্দবাবু। তারপর সোফা থেকে মুখটা একটু সামনে ঝুঁকিয়ে বললেন, “কী ভাবচেন? গিয়ে একবার স্বচক্ষে দেকে আসবেন নাকি?”
উত্তরটা আর শোনা হল না। কেননা, ঠিক এই সময়েই ডোর-বেল বেজে উঠল। কৌশিক বলল, “এখন আবার কে এল রে বাবা!”
কাজের মেয়েটি ঘরে ঢুকে বলল, “এক ভদ্দরলোক এয়েচেন। নাম বললেন ফুকন। মামাবাবুর সঙ্গে দেকা করতে চান।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “কী আপদ! আমি যে এখন কলকাতায়, লোকটা তা জানল কী করে?” অরুণ সান্যাল বললেন, “আমিই জানিয়েছি, দাদা। পরশু দিন ফোন করেছিলেন। আপনার বাঙ্গালোরের ফোন নম্বর জানতে চাইলেন। তখন আমিই বলেছি যে, আপনি আপাতত হপ্তা খানেক কলকাতায় থাকবেন। তাই বাঙ্গালোরে ফোন করার দরকার নেই, কিছু যদি জানাতে হয় তো এখানেই জানানো যেতে পারে। তা আজকেই যে ইনি চলে আসবেন তা ভাবিনি।”
“নিশ্চয়ই খুব জরুরি দরকার।” কাজের মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “যাও, নিয়ে এসো।”
কাজের মেয়েটি বলল, “কতাবাত্তা এট্টু তাড়াতাড়ি সারুন, মামাবাবু। মা ওদিকে ভাত বাড়তে নেগেচেন।”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “মাকে একটু দেরি করে বাড়তে বলো। কথাটা না সেরে তো উঠতে পারছি না।”