॥ ৭ ॥
যা ভাবা যায় সেটা যখন না হয়, তখন মনের অবস্থাটা আবার স্বাভাবিক হতে বেশ কিছুটা সময় লাগে। সিংঘানিয়ার নামটার সঙ্গে সিংহের মিল আছে বলে বোধহয় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কাউকে আশা করেছিলাম। যিনি এলেন তাঁর মাঝারি গড়ন, মেজাজে মাঝারি গাম্ভীর্য, গলার স্বর সরুও নয়। মোটাও নয়। শুধু একটা মোটা পাকানো গোঁফে বলা যায় কিছুটা ভারিক্কি ভাব এসেছে।
‘মাই নেম ইজ সিংঘানিয়া’ বললেন ভদ্রলোক। ‘প্লীজ সিট ডাউন।’
আমরা তিনজনে দুটো গদীতে ভাগাভাগি করে বসলাম, সিংঘানিয়া বসলেন তৃতীয় গদীতে সোজা আমাদের দিকে মুখ করে। কথা হল ইংরিজি হিন্দি মিশিয়ে।
সিংঘানিয়া বললেন, ‘আপনার খ্যাতির সঙ্গে আমি পরিচিত, মিঃ মিটার, কিন্তু আলাপ হবার সৌভাগ্য হয়নি।’
ফেলুদা বলল, ‘বিপদে না পড়লে ত আর আমার ডাক পড়ে না, তাই আলাপ হবার সুযোগও হয় না।’
‘আমি অবিশ্যি আপনাকে বিপদে পড়ে ডাকিনি।’
‘তা জানি,’ বলল ফেলুদা। ‘আপনার নামও কিন্তু আমি শুনেছি। অবিশ্যি সিংঘানিয়া ত অনেক আছে, কাজেই যাঁর নাম শুনেছি তিনিই আপনি কিনা বলতে পারব না।’
‘আই অ্যাম ভেরি ইন্টারেস্টেড টু নো আপনি কী ভাবে আমার নাম শুনলেন।’
‘আপনি হরিদ্বার গিয়েছিলেন কখনো?’
‘সার্টেনলি।’
‘সেখানে ভবানী উপাধ্যায় বলে একজনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন?’
‘করেছিলাম বৈ কি; কিন্তু আপনি সেটা কী করে জানলেন?’
‘উপাধ্যায়ের বাড়িওয়ালা আমাকে বলেছিলেন যে মিঃ সিংঘানিয়া এবং আরেকটি ভদ্রলোক উপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।’
‘আর কিছু বলেন নি?’
‘বলেছিলেন যে উপাধ্যায়কে নাকি আপনি লোভে ফেলে দিয়েছিলেন, কিন্তু উপাধ্যায় সেটা কাটিয়ে ওঠে।’
‘হোয়াট এ স্ট্রেঞ্জ ম্যান, দিস উপাধ্যায়! আমি এমন লোক আর দ্বিতীয় দেখিনি। ভেবে দেখুন মিঃ মিটার—লোকটার রোজগার মাসে পাঁচশো টাকার বেশি নয়, কারণ গরীবদের সে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করে। সেই লোককে আমি পাঁচ লাখ টাকা অফার করলাম। আপনি জানেন বোধহয় যে ওঁর কাছে একটা অত্যন্ত ভ্যালুএব্ল লকেট আছে—খুব সম্ভবত এককালে সেটা ট্র্যাভাঙ্কোরের মহারাজার ছিল।’
‘সে তো জানি, কিন্তু আমার জানার কৌতূহল হচ্ছে আপনি এই লকেটের খবরটা জানলেন কি করে। ওটা ত রাজার পাঁচ-ছ জন খুব কাছের লোক ছাড়া আর কারোর কাছে প্রচার হয়নি।’
‘আমি খবরটা জেনেছিলাম সেই কাছের লোকের একজনের কাছ থেকেই। আমার জুয়েলারির ব্যবসা আছে দিল্লীতে। আমার কাছে এই লকেটের খবর আনে রূপনারায়ণগড়ের ম্যানেজার মিঃ পুরীর ছেলে দেবীশঙ্কর পুরী। সে আমাকে লকেটটা কিনতে বলে। ন্যাচারেলি হি এক্সপেক্টেড এ পারসেনটেজ। আমরা গেলাম হরিদ্বার। উপাধ্যায় রিফিউজ করলেন। পুরীর উৎসাহ চলে গেল। কিন্তু আমি ওটা কেনার লোভ ছাড়তে পারছি না। আমার মনে হয় এখন চেষ্টা করলে হয়ত পাওয়া যাবে। তখন তিনি ডাক্তারি করছিলেন, লোকের সেবা করছিলেন, এখন হি ইজ এ সন্ন্যাসী। একজন গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীর ওই রকম একটা পার্থিব সম্পদের উপর কোনো আসক্তি থাকবে এটা ভাবতে একটু অদ্ভুত লাগছে না? আমি চাই ওঁকে আরেকবার অ্যাপ্রোচ করতে।’
‘বেশ ত, করুন না।’
‘দ্যাট ইজ ইমপসিব্ল, মিঃ মিটার।’
‘কেন?’
‘উনি এমন জায়গায় থাকেন সেখানে আমার পক্ষে যাওয়া অসম্ভব। আমি আপনাকে একটা কথা জিগ্যেস করতে পারি?’
‘করুন।’
‘হোয়াই আর ইউ হিয়ার?’
‘প্রধানত ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। তবে আমার উপাধ্যায় লোকটার উপর একটা শ্রদ্ধা রয়েছে। তার যদি কোনো অনিষ্ট হচ্ছে দেখি তাহলে কিন্তু আমি বাধা দেব।’
‘ইউ আর অ্যাকটিং অ্যাজ এ ফ্রী এজেন্ট? আপনাকে কেউ এমপ্লয় করেনি?’
‘না।’
‘আপনি আমার হয়ে কাজ করবেন?’
‘কী কাজ?’
‘আপনি উপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে তাকে বুঝিয়ে বলে লকেটটা এনে দিন। আমি আপনাকে পাঁচ লাখের টেন পার্সেন্ট দেব। উনি যদি নিজে টাকা না নেন, তাহলে ওঁর যদি কোনো উত্তরাধিকারী থাকে তাকে আমি টাকাটা দেব।’
‘কিন্তু এই লকেট সম্বন্ধে ইন্টারেস্টেড কয়েকজন এখানে রয়েছে আপনি জানেন সেটা?’
‘রূপনারায়ণগড়ের ছোটকুমার ত?’
‘আপনি জানেন?’
‘জানতাম না। আজ বিকেলেই ভার্গব বলে এক সাংবাদিক এসেছিল। কেদারে এসেও যে সাংবাদিকদের উৎপাত সহ্য করতে হবে সেটা ভাবিনি। যাই হোক্, সে-ই খবরটা দিল। কিন্তু ছোটকুমার ত ফিল্ম তুলতে এসেছে।’
‘জানি;কিন্তু তাতে উপাধ্যায় আর লকেটের একটা বড় ভূমিকা আছে।’
সিংঘানিয়ার চেহারাটা এবার একটা ইঁদুরের মতো হয়ে গেল। সে হাতজোড় করে বলল—
‘দোহাই মিঃ মিটার—প্লীজ হেল্প মি!’
‘আপনি ভার্গবকে এসব নিয়ে কিছু বলেননি ত?’
‘পাগল! আমি বলেছি তীর্থ করতে এসেছি। কেদারে আসার আর কোনো কারণ থাকার দরকার আছে কি?’
‘ভার্গব লোকটাও উপাধ্যায় সম্বন্ধে ইন্টারেস্টেড। তবে খবরের কাগজের খোরাক হিসেবে।’
‘আপনি কিন্তু এখনো আমার কথার উত্তর দেন নি।’
‘মিঃ সিংঘানিয়া—আমি এইটুকু বলতে পারি যে আপনার প্রস্তাব আমি উপাধ্যায়কে জানাব। তবে আমার ধারণা যে তিনি যদি লকেটটা নিজে না রাখেন, তবে সেটা হয়ত অন্য কাউকে দিয়ে যেতে চাইবেন। কাজেই এখন কোনো পাকাপাকি কথা বলার দরকার নেই; তখন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা হবে, কেমন?’
‘ভেরি গুড।’
*
বাইরে রাত। কেদার শহর ঝিমিয়ে পড়েছে। বাড়ির বাতি, রাস্তার বাতি, দোকানের বাতি—সবই যেন ধুঁকছে। তারই মধ্যে এক জায়গায় বেশ একটা উজ্জ্বল আলো দেখে অবাক হয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখি ছোটকুমার পবনদেও একটা ব্যাটারি-আলো জ্বালিয়ে কেদারের গলির ফিল্ম তুলছে। আমাদের দেখে শুটিং থামিয়ে ফেলুদাকে উদ্দেশ করে প্রশ্ন করল, ‘উপাধ্যায়ের কোনো খবর পেলেন?’
ফেলুদা উত্তর না দিয়ে একটা পাল্টা প্রশ্ন করল।
‘আপনি উঠেছেন কোথায়?’
এখানে পাণ্ডারা ঘর ভাড়া দেয় জানেন ত? তারই একটাতে রয়েছি—এই বাঁয়ের রাস্তা দিয়ে দুটো বাড়ি পরে ডান দিকের বাড়ি।’
‘ঠিক আছে—আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করছি’, বলল ফেলুদা। আমরা এগিয়ে গেলাম আমাদের ধরমশালার দিকে।’
লালমোহনবাবু হঠাৎ মন্তব্য করলেন, ছোটকুমার কেমন লোক জানি না মশাই, কিন্তু সিংঘানিয়া লোকটা ধড়িবাজ আছে।’
‘কী করে জানলেন?’ ফেলুদা প্রশ্ন করল।
‘আপনি যেখানে বসেছিলেন সেখান থেকে বোধহয় দেখতে পাননি, কিন্তু আমি দেখলাম লোকটার কোটের বাঁ পকেটে একটা ক্যাসেট রেকর্ডার। কথা শুরু হবার আগে সেটা টুক করে চালু করে দিল।’
‘ধড়িবাজের উপর আবার ধড়িবাজতর হয় জানেন ত?’
ফেলুদাও তারও পকেট থেকে মাইক্রোক্যাসেট রেকর্ডারটা বার করে দেখিয়ে দিল।
‘আপনি কি ভাবছেন যে এটা আমি—’
ফেলুদার কথা শেষ হল না, কারণ কাঁধে একটা ঘা খেয়ে সে মাটিতে পড়ে গেছে। গলির এই অংশটা নিরিবিলি, সেই সুযোগে পাশের একটা গলি থেকে একটা লোক আচমকা বেরিয়ে এসে ওই কাণ্ডটি করেছে।
মুহূর্তের মধ্যে একটা তুলকালাম কাণ্ড হয়ে গেল।
লোকটা মেরেই পালাচ্ছিল; আমি তার উপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ে তার কোমরটা দুহাতে জাপটে ধরে তাকে দেয়ালে চেপে ধরলাম। সেও পালটা চাপ দিয়ে আমাকে ঠেলে সরিয়ে পালাতে যাচ্ছিল, এমন সময় লালমোহনবাবু তার হাতের অস্ত্রটা দিয়ে তাকে এক ঘায়ে ধরাশায়ী করে দিলেন।
অস্ত্রটা আর কিছুই না, গৌরীকুণ্ডে দু-টাকা দিয়ে কেনা সেই লোহা লাগানো লাঠি। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি লোকটার মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে, কিন্তু সেই অবস্থাতেই সে আবার উঠে এক দৌড়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
এদিকে ফেলুদা উঠে বসেছে। বোঝাই যাচ্ছে সে বেশ কাবু। আমরা দুজন দুদিক থেকে তাকে ধরে তুললাম। আমাদের ধরমশালা প্রায় পৌঁছে গেছি। শেষ পথটুকু ফেলুদা শুধু একটা কথাই বলল, ‘কেদারেও তাহলে গুণ্ডা এসে পৌঁছে গেছে!’
কপাল জোরে আমাদের পাশের ঘরেই একজন বাঙালী ডাক্তার পাওয়া গেল, নাম অধীর সেন। অধীরবাবু আবার ফেলুদাকে চিনে ফেললেন, কাজেই যত না জখম, তার তুলনায় শুশ্রুষাটা একটু বেশিই হল। ডান কাঁধে একটা জায়গায় কেটে গিয়েছিল, সেখানে ওষুধ দিয়ে ব্যাণ্ড-এড দিয়ে দিলেন। বললেন, ‘ফ্র্যাকচার হয়েছে কি না সেটা ত এক্স-রে না করলে বোঝা যাবে না।’
ফেলুদা বলল, ‘ফ্র্যাকচারই হোক আর যাই হোক, আমাকে বিছানায় শুইয়ে রাখতে পারবেন না এটা আগে থেকেই বলে দিলাম।’
ফী-এর কথা জিগ্যেস করাতে ভদ্রলোক জিভ-টিভ কেটে একাক্কার।—‘তবে ব্যাপারটা কী জানেন, মিঃ মিত্তির। এই নিয়ে আমার তিনবার হল কেদার। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন ছিল তেমনই আছে, কিন্তু ক্রমে অ্যান্টি-সোশ্যাল এলিমেন্টস ঢুকে পড়ছে শহরে। এর জন্য দায়ী কী জানেন ত? আমাদের যানবাহনের সুব্যবস্থা। একদিকে ভালো করেন ত অন্যদিক দিয়ে খারাপ ঢুকে পড়ে—এই ত দেখে আসছি জগতের নিয়ম।’
কালীকমলীর ম্যানেজার নিজের বুদ্ধি খাটিয়েই এখানকার পুলিশকে খবর দিয়ে আনিয়ে নিয়েছিলেন। ফেলুদা তার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ ধরে কথা বলল। বুঝতে পারলাম যে নানারকম নির্দেশ দেওয়া হল, এবং সবই দারোগা সাহেব অতি মনোযোগের সঙ্গে শুনে নিলেন।
পুলিশ চলে যাবার পর সাংবাদিক মিঃ ভার্গব এসে হাজির।—‘শুনলাম আপনার লাইফের উপর একটা অ্যাটেম্পট হয়ে গেছে?’
‘গোয়েন্দার জীবনে এতো দৈনন্দিন ঘটনা, মিঃ ভার্গব। এখানকারই কোনো গুণ্ডা হয়ত পকেট মারতে চেয়েছিল, কিন্তু বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি।’
‘আপনি বলতে চান আপনার কোনো তদন্তের সঙ্গে এর কোনো কানেকশন নেই?’
‘তদন্ত আবার কোথায়? আমি ত এখানে এসেছি উপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে।’
‘ভালো কথা, তিনি কোথায় থাকেন সে খবর পেয়েছেন?
‘আপনি পেয়েছেন?’
‘উপাধ্যায় বলে এখানে কেউ কাউকে চেনে না।’
‘তাহলে ভদ্রলোক হয়ত নাম বদলেছেন।’
‘তাই হবে।’
ফেলুদা আসল ব্যাপারটা বেমালুম চেপে গেল। ভার্গব কিছুটা নিরাশ হয়েই যেন চলে গেলেন।
কাল সকাল সকাল উঠতে হবে বলে আমরা সাড়ে আটটার মধ্যে পুরী তরকারি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ার আয়োজন করতে লাগলাম। এই সময় ফেলুদা যে ব্যাপারটা করল সেটা কিন্তু আমি আর লালমোহনবাবু মোটেই অ্যাপ্রুভ করতে পারলাম না। ও বলল, ‘তোরা দুজন শুয়ে পড়, আমি একটু ঘুরে আসছি।’
‘ঘুরে আসছ মানে?’ আমি অবাক এবং কিছুটা বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলাম। আমি জানি ওর কাঁধে এখনো বেশ ব্যথা। ‘কোত্থেকে ঘুরে আসছ?’
‘একবার ছোটকুমারের সঙ্গে দেখা করা দরকার।’
‘সে কি, তুমি সোজা এনিমি ক্যাম্পে চলে যাবে?’
‘আমার এরকম অনেকবার হয়েছে রে তোপ্সে। একটা চোট খেয়ে বুদ্ধিটা খুলে গেছে। এবারও তাই। পবনদেও আমাদের শত্রু না।’
‘তবে?’
‘আসল শত্রু কে সেটা জানতে পারবি। খুব শিগ্গিরই।’
‘কিন্তু তুমি বেরোবে, আর শত্রু যদি এখন ওৎ পেতে থাকে?’
‘আমার সঙ্গে অস্ত্র আছে। তোরা শুয়ে পড়। আমি যখনই ফিরি না কেন, কালকের প্রোগ্রামে কোনো চেঞ্জ নেই। গান্ধী সরোবর। ভোর সাড়ে চারটায় রওনা হচ্ছি।’
সঙ্গে রিভলভার আর একটা বড় টর্চ নিয়ে ফেলুদা চলে গেল।
‘তোমার দাদার সাহসের জবাব নেই,’ বললেন জটায়ু।