ছয় – রাঙির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া
মনুষ্যপ্রেমিক গোরাং ডাক্তার রাঙিহত্যার খবর শুনে পড়ি—কী—মরি করে টাট্টু চেপে কোদলার ঘাটে চলে যান। তখন ইয়াকুব রাঙির ছেলেকে ন্যাকড়ায় জড়িয়ে আস্তানায় তুলেছে। শম্ভু ঘেটেল সব খতিয়ে দেখে দুধেল ছাগলটাও তাকে দিয়েছে—যার নাম মুংলি, আসলে রাঙিরই ছাগল। রাঙা মাটি গাঁয়ে থাকবার সময় অর্থাৎ হেরু আন্ডারগ্রাউন্ডে যাবার আগে রাঙি যখন ইতিহাসের সেই কবরখানায় টিলায়টিলায় কাঠঘুঁটে কুড়িয়ে বেড়াত, তখন মুংলিকে কুড়িয়ে পেয়েছিল। ব্যাপারটা কতকটা বর্তমান নৃশংসতা ও করুণার সঙ্গে বেশ মিলে যায়। মুংলির মাকে শেয়ালে ধরেছিল। রাঙি তখন মাটিতে ঝুঁকে একটুকরো শুকনো গোবর তুলছে। পিছনে ছাগলটার চ্যাঁচানি শুনে সে ওই গোবরটুকু ছুঁড়ে মেরেছিল—তাতে অবশ্য শেয়ালটার কিছুই হয়নি। তবে লাভের মধ্যে শেষঅব্দি কিছু মাংস পাওয়া যেতে পারে, রাঙি ভেবেছিল। সেই সময় বৈঁচির ঝোপের দিক থেকে চারঠ্যাঙে লাফাতে লাফাতে এসে গেল একটা মোটাসোটা ধাড়ি বাচ্চা। রাঙির হাঁটুর কাপড়ে চুমু খেয়ে সম্ভবত মাতৃসম্বোধন করল আর রাঙি করল কী, তাকে ঝুড়িতে চাপিয়ে আঁচল ঢাকা দিয়ে বাড়ি নিয়ে এল। বাচ্চাটা বরাবর ঘরে লুকিয়ে পুষত সে। পাছে কেউ টের পায়, রাঙি মুংলির মায়ের মাংসের ভাগ দাবি করতেও যায়নি। এবং কী অদ্ভুত যোগাযোগ, ওই ছাগলদুটোর মালিক ছিল দানেশ ব্যাপারী। কিংবা দানেশ ব্যাপারীর বউ! কে জানে, দানেশের সঙ্গে তার নিষিদ্ধ সাঁকো স্থাপনের ব্যাপারে এই মুংলির কোনো ভূমিকা আছে কি না। এবং কেই বা জানে, হেরুর নিজের স্ত্রীচরিত্রের প্রতি সন্দিগ্ধতা ও এই চরম পরিণতির পিছনেও মুংলির কী অবদান।
সবাই দেখেছে, ইয়াকুব সাধুর বুকের কাছে দুহাতে সাবধানে রাখা রাঙির কচি বাচ্চা, কনুইয়ের কাছে বাঁধা মুংলির দড়িতে টান পড়ায় মুংলি চার ঠ্যাঙে মৃদু আপত্তিসহ বঙ্কিম গতিতে চলেছে এবং মুংলির পুষ্টু ধাড়ি ছানাটাও তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে কখনও মায়ের আগে—কখনও পিছনে চমৎকার দৌড়াচ্ছে। আকাশ থেকে তখন বৃষ্টি ধোওয়া পবিত্র রোদ্দুর গলে গলে পড়ছিল। ভরা গঙ্গায় একটা করুণাঘন স্বস্তি চকচক করছিল। আর বাঁকের কাছে লাঠিহাতে রাঙির লাশটা পাহারা দিচ্ছিল—আবার কে—এলাকার সেই নীলমণি নীলকুর্তা নীলপাগড়ি চরণ চৌকিদার। ‘ডিউটিতে’ থাকলে তাকে রাশভারী ও সম্ভ্রান্ত দেখায়।…
গোরাং ডাক্তার টাট্টুটা চরতে দিয়ে সব ঘুরে—ফিরে দেখে বেড়ান। কাকেও কিছু বলেন না। কোনো প্রশ্নও করেন না। রাঙির লাশটা দেখেই তিনি মুখ ঘুরিয়ে নেন। চরণ নিঃশব্দে ও গাম্ভীর্যে তাঁকে সেলামবাজি করে প্রথা অনুযায়ী। গোরাং ডাক্তার কয়েক মিনিট গঙ্গার ডাইনে—বাঁয়ে তাকিয়ে থাকেন। তারপর আস্তে আস্তে চলে যায় ইয়াকুবের আস্তানার দিকে। একলা চিলটা ট্যা ট্যা করে মাথার ওপর উড়ে যায়, আর সেই ডাকটা কতক্ষণ মাথার ভিতর ঘুরে বেড়ায় গোরাংবাবুর। মনে হয়, এক্ষুনি তাঁর চোখ ফেটে বেড়িয়ে পড়ার জন্যে চিৎকারটা ভীষণ ছটফট করছে। চোখে রুমাল ঢাকেন একবার। তারপর সামলে নেবার জন্যে দূরে রাঙামাটির টিলাগুলোর দিকে তাকালে ঘোড়া চেপে আসা আফতাব দারোগার মূর্তিটি নজরে পড়ে।
ইয়াকুব তার ডেরার সামনে আতাগাছের গুঁড়িতে মুংলিকে বেঁধে তখন দুধ দুইতে ব্যস্ত। বাচ্চাটা তার পাঁজরে ঢুঁ দিচ্ছে। আর সুড়সুড়ি লাগায় সাধু মুখ ঘুরিয়ে হ্যাৎ হ্যাৎ শব্দ করছে। কয়েক মুহূর্ত দেখার পর গোরাংবাবু বলে ওঠেন, ‘অ্যাই হতচ্ছাড়া! ছাগলটা মরে যাবে যে! বাপের জন্মে নেইকো গাই—তো চালুনি নিয়ে দুইতে যায়। এ শালার হয়েছে সেই কাণ্ড!’
এইসব মানুষদের সঙ্গে গোরাংবাবুর বাক্যালাপের ভঙ্গিটি এরকমই। ইয়াকুব ত্বরিতে ঘুরে ডাক্তারকে দেখে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে হাসে।
গোরাংবাবু বলেন, ‘হেরুর ব্যাটা কই?’
‘কেঁদে কেঁদে ঘুমোচ্ছে।’…ইয়াকুব ঘরের দিকে চোখ ঠারে।
‘অ্যাই শালা সাধু!’ গোরাংবাবু সন্দিগ্ধস্বরে বলেন। ‘… তোর মতলব কী বল তো?’
ইয়াকুব ছাগলের বাঁট টানতে টানতে জবাব দেয়—’কীসের?’
‘বলিদান দিবি না তো?’
‘হ্যাৎ! হ্যাৎ! পুষব। আমার শখ।’
‘হ্যা রে, তুই ব্যাটা তো ক্ষ্যাপা—নিজের ছেলেটাকে নাকি বলি দিয়েছিলি!…’ বলতে বলতে কী কৌতুকবোধে হাসেন গোরাং ডাক্তার।… ‘শোন এ্যাকুব, স্পষ্ট বলছি—হেরুর ছেলে নিতে হলে তোকে কাগজে টিপছাপ দিতে হবে। আফতাব দারোগা আসছে। হুই দ্যাখ! দারোগা আর আমি সাক্ষী থাকব।’
ইয়াকুব দূরে দারোগা দেখে তাচ্ছিল্য করে বলে, ‘হ্যাৎ, হ্যাৎ!’
‘দাঁড়া শালা, দাঁড়া। আফতাব দারোগা তোর পিণ্ডি চটকাবে, আসতে দে।’ গোরাংবাবু সকৌতুকে শাসান। ‘মোছলমান হয়ে সাধুগিরি ঘোচাচ্ছে! আফতাব দারোগা কড়া মোছলমান। দেখেছিস, তার কপালে নমাজ পড়ে কেমন ঘেঁটো ধরে গেছে?’
ইয়াকুব ভয় পায় একটু। আধ গেলাস দুধ নিয়ে উঠে আসে। চাপা গলায় বলে, ‘ডাক্তারবাবু, হেরুকে আমি ধরিয়ে দেব। দারোগাকে বলবেন, শালা ডাকু রেতের বেলা এসে আমাকে বড্ড জ্বালায়। যা ভাত থাকে, খেয়ে ফেলে। তার ওপর ওই একখানা মাত্র তালাই—আমাকে খালি মেঝেয় শুতে হয়।’
গোরাংবাবু হতভম্ব হয়ে যান। কিন্তু কথাটা ভাববার মতো।
আর না, হেরুকে ধরিয়ে দেওয়া দরকার। একটার পর একটা তাজা মানুষগুলোকে মেরে ফেলছে দিনের পর দিন। সোনাদানা পয়সাকড়িগুলো অন্য ডাকাতের মতন কোনো কাজে লাগালেও বোঝা যেত তার ডাকাতির উদ্দেশ্য। ব্যাটা নির্বোধ জন্তু যেন নিতান্ত উদ্দেশ্যহীনভাবে মানুষ মারছে। কে জানে কত সোনাদানা মালকড়ি ওই গঙ্গায় ফেলে দিয়েছে সে! স্বর্ণের ধারণা এটা। শুনে মনে হয়েছে, অসম্ভব নয়—সেই তার পক্ষে স্বাভাবিক।
ডাক্তার ফিসফিস করে বলেন, ‘সত্যি বলছিস? হেরু রাতে তোর ঘরে থাকে?’
ইয়াকুব জবাব দ্যায়, ‘হ্যাঁ। আর গতরাতে কাণ্ডটা শুনুন।’ ইয়াকুব সব বলতে থাকে। উঠোনে গনগনে রোদের মধ্যেই কথা শুরু হয়েছিল, শেষ হয় মেঘের ছায়ায়। এবং ওদিকে আফতাব দারোগা ততক্ষণে ঘোড়া ছুটিয়ে নদীর বাঁকে চলে গেছে। সেখানে শ’খানেক মানুষের কালো কালো মাথা যেন গঙ্গার ধারে কী ফুল ফুটিয়েছে। ঘটকঠাকুর বাড়ি থেকে এতদূরে নিজের হাতে টুল আর চেয়ার বয়ে এনেছে। আফতাব দারোগা খচখচ করে কী লিখছে। সীতু ডোম আর তার বউ পিংলি রাঙির মড়াটা ডাঙায় তুলেছে।
ইয়াকুব দুধটুকু গরম করতে থাকল—অবশ্য মড়ার মুণ্ডু দিয়ে বানানো উনুনে নয়, মাটির। গোরাংবাবু ভিড়ের কাছে এসে দেখলেন মড়াটা। মুখ ঘুরিয়ে নেবেন ভাবলেন, পারলেন না। রাঙির মড়ার গায়ে যে শাড়িটা জড়ানো ছিল, আফতাব দারোগা ছড়ির গুঁতোয় সেটা সরিয়ে মৃত্যুর কারণ খুঁজছিল। সে—আমলের পাড়াগাঁয়ে ওই যথেষ্ট। ডাক্তার, মর্গ ইত্যাদি বড়লোকের ব্যাপার। রাঙির তলপেট থেকে জননাঙ্গ অব্দি আট ন ইঞ্চি লম্বালম্বি চেরা—ফাঁক হয়ে আছে। রক্ত ধুয়ে সাদা মাংস আর কিছু নাড়িভুঁড়ি দেখা যাচ্ছে। আলতোভাবে ফিতে ধরে সেটা মাপার পর আফতাব দারোগা বলেন, ‘ঠিক হ্যায়! আবে সীতুয়া, জলদি ফেক বে গাঙমে!’… তারপর রুমালে মুখ মুছে বারকতক ‘তৌবা’, ‘তৌবা’ বলেন।
রাঙি তার চেরা নাভি আর জননাঙ্গ নিয়ে গঙ্গায় ঝাঁপ দেয়। ভিড়ের অন্তত একজন—সে দুঃখিত প্রেমিক সরা বাউরি, তার মাথায় এককলি গান চিলের ডাকের মতো উড়ে বেড়ায়…
(একদিন) চিত হয়ে ভাসবি জলে
ভালকয়োতে ঠুকরে খাবে।
আফতাব দারোগার তদন্ত শেষ। বিড়বিড় করে ‘দোওয়া’ (মন্ত্র) আওড়ে তারপর গোরাংবাবুকে দেখতে পান। ‘ডাকটারবাবু, খরিয়াৎ? (কুশল তো)?
ডাক্তার মৃদু হেসে মাথা দোলান।
ফেরার সময় কাঁচামাটির রাস্তায়—জায়গায়—জায়গায় কাদা আছে, পাশাপাশি চললেন গোরাংডাক্তার আর আফতাব দারোগা। দুটো ঘোড়া দুই বিপরীত মানুষকে ঐতিহাসিক টিলার কাছাকাছি এসে দুমুখো করল। দারোগা পূর্বে, ডাক্তার পশ্চিমে।
মজা ভাগীরথীর খাতে এখন জল এসেছে প্রচুর। নৌকো চলছে। নৌকায় ঘোড়া আর দারোগা ফিরে যাবে সদর কোতোয়ালে।
গোরাংবাবুর বমিভাব। সঙ্গে ছোট্ট বাকসো খুলে কয়েকটা বড়ি খেয়ে নিলেন। নৃশংস হেরু সম্ভবত আজ রাতেই ধরা পড়বে। বাঁচা গেল। ইয়াকুবের ওপর দারোগার ধর্মঘটিত পুরোনো রাগ আত্মপ্রকাশের সুযোগই পায়নি। এমনকি হেরুর ছেলের ব্যাপারেও দারোগা উৎসাহ দ্যাখায়নি—গোরাংবাবুর ধারণা, এসবের একমাত্র কারণ ইয়াকুব হেরুকে ধরিয়ে দিচ্ছে এবং তার গূঢ় অর্থ আফতাব খান একশো টাকা বখশিস আর প্রমোশন পাচ্ছে।