৫. পাহাড়ের চূড়ার দমকা বাতাসে

পাহাড়ের চূড়ার দমকা বাতাসে দেখতে দেখতে গ্লাইডারটি ওপরে উঠে গেল। নায়ীরা তার ককপিটে বসে আছে, বেল্ট দিয়ে সিটের সঙ্গে বাঁধা, তারপরেও সে শক্ত করে ককপিটের দেয়াল ধরে রেখেছে। সামনের ককপিটে বসে থাকা রিশি গলা উঁচিয়ে বলল, ভয় পেও না। নায়ীরা, রুটাই একটু ঝামেলার। একবার ভেসে গেলে আর কোনো সমস্যা নেই।

নায়ীরার বুক ধুকধুক করছিল, কিন্তু সে বলল, আমি ভয় পাচ্ছি না রিশি।

চমৎকার। আরেকটু ওপরে উঠে নিই, তখন ছেড়ে দেব।

গ্লাইডারটি শক্ত নাইলনের দড়ি দিয়ে বাঁধা রয়েছে। রিশি আস্তে আস্তে দড়িটি ছাড়ছে আর গ্লাইডারটি ওপরে উঠছে, অনেকটা ঘুড়ি ওড়ানোর মতো। যখন অনেক ওপরে যাবে তখন দড়ির বাধন খুলে গ্লাইডারটি মুক্ত হয়ে উড়ে যেতে শুরু করবে।

নায়ীরা তার ককপিট থেকে মাথা বের করে সাবধানে নিচে তাকাল। তারা পাহাড়ের চূড়া থেকে অনেক ওপরে উঠে গেছে। এখান থেকে ঝরনাধারাটিকে বেশ স্পষ্ট দেখা যায়, মনে হচ্ছে সরু সাদা একটি সুতো ঝুলছে। নিচের বনাঞ্চল সবুজ গাছে ঢাকা। সামনে বহুদূরে সবুজ প্রান্তর, যেখানে অবমানবেরা তাদের ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। নায়ীরা বুকের ভেতর এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করে। তারা কি এই ভয়াল উপত্যকা পার হয়ে সত্যিই টেহলিস শহরে যেতে পারবে?

রিশি তার কন্ট্রোল প্যানেলে চোখ রেখে খুব সাবধানে ওপরে উঠে যাচ্ছে। দুই পাশে গ্লাইডারের ডানা বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত, বাতাসে মাঝে মাঝে থরথর করে কাঁপছে। আকাশে সাদা মেঘ, একটু পরেই গ্লাইডারটা ওই সাদা মেঘের ওপর দিয়ে ভেসে যাবে। নারীরা নিচে তাকাল। তারা এত ওপরে উঠে এসেছে যে পাহাড়ের চূড়াটুকুও আর আলাদা করে বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে পুরো এলাকাটাই বুঝি একই সমতলের অংশ।

ককপিট থেকে রিশির গলা শোনা গেল, নায়ীরা, যেটুকু ওঠার কথা উঠে গেছি।

এখন তা হলে আমরা রওনা দেব?

হ্যাঁ। দড়িটুকু কেটে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্লাইডারটা কিন্তু খানিকটা নিচে নেমে আসবে। ভরশূন্য মনে হবে নিজেকে, ভয় পেও না।

নায়ীরা হাসার চেষ্টা করল। বলল, পেলেও তোমাকে বুঝতে দেব না!

তোমার যেরকম ইচ্ছে। দেখতে দেখতে গ্লাইডারের বেগ বেড়ে যাবে, ইচ্ছে করলে ককপিটের ঢাকনাটা টেনে দিতে পার।

এমনিতেই ভালো লাগছে।

বেশ। তুমি কি প্রস্তুত?

হ্যাঁ রিশি। আমি প্রস্তুত।

ককপিটটা শক্ত করে ধরে রাখ, আমরা যাচ্ছি।

পরমুহূর্তে নায়ীরা একটা ঝাঁকুনি অনুভব করে। তারপর হঠাৎ করে তার মনে হতে থাকে সে নিচে পড়ে যেতে শুরু করেছে। নিজেকে তার রশূন্য মনে হতে থাকে, মনে হয় সে বুঝি খোলা ককপিট থেকে উড়ে বের হয়ে যাবে। গ্লাইডারটি গতি সঞ্চয় করছে। তার মুখের ওপর সে বাতাসের তীব্র বেগ অনুভব করতে থাকে।

রিশি চিৎকার করে বলল, তুমি ঠিক আছ নায়ীরা?

আছি।

চমৎকার।

গ্লাইডারটি মাথা নিচু করে খানিকটা নিচে নেমে গতি সঞ্চয় করেছে। রিশি এখন এটাকে সোজা করে নেয়। মেঘের ওপর দিয়ে তখন এটা ভেসে যেতে শুরু করে। একটু আগের সেই ভরশূন্য হয়ে উড়ে যাওয়ার অনুভূতিটা নেই। নায়ীরা মুখের ওপর প্রবল বাতাসের ঝাঁপটা অনুভব করে। সে সামনের ড্রয়ার খুলে এক জোড়া গগলস বের করে চোখে পরে নেয়।

বিকেলের পড়ন্ত আলোতে চারপাশে এক ধরনের মায়াময় পরিবেশ, তার ভেতর দিয়ে নিঃশব্দে তারা গ্লাইডারে করে আকাশের মেঘের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। অত্যন্ত বিস্ময়কর একটা অনুভূতি। নায়ীরা ককপিট থেকে মাথা বের করে সাবধানে নিচে তাকাল। অনেক নিচে গাছপালা, বনবাদাড়, সরু সুতার মতো নদী। নায়ীরা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। রিশি ককপিটে তার রেডিওটি চালু করে কিছু একটা শুনছে। একটু পর রেডিও বন্ধু করে দিয়ে গলা উঁচিয়ে বলল, উষ্ণ প্রবাহটি চলে এসেছে। চোখ বন্ধ করে আট শ কিলোমিটার চলে যাব।

কতক্ষণ লাগবে?

ধরে নাও, সারা রাত।

সারা রাত চুপচাপ করে বসে থাকব?

বসে থাকতে হবে। কিন্তু চুপচাপ বসে থাকবে, নাকি কথা বলতে থাকবে সেটা তোমার ইচ্ছে।

বাতাসের জন্য কথা বলা যায় না। চিৎকার করে আর কতক্ষণ কথা বলা যায়?

রিশি হাসল। বলল, ঠিকই বলেছ?

নায়ীরা তার জ্যাকেটের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল, তুমি উষ্ণ প্রবাহের কথা বলছ, কিন্তু এখানে তো দেখছি বেশ ঠাণ্ডা।

অন্ধকারটা নামুক তখন দেখবে ঠাণ্ডা কাকে বলে। ককপিটের ঢাকনা ফেলে তখন ভেতরে গুটিসুটি মেরে বসে থাকতে হবে।

নায়ীরা দুই হাত ঘষে একটু গরম হওয়ার চেষ্টা করতে করতে ককপিটে আরাম করে বসে থাকার চেষ্টা করল। মাত্র কয়েক দিন আগেই তার এক ধরনের নিস্তরঙ্গ একঘেয়ে জীবন ছিল, এখন হঠাৎ করে পুরো জীবনটি পাল্টে গেছে। মাথায় করে সে একটা তথ্য নিয়ে যাচ্ছে টেহলিস শহরে, কথাটা যদিও সে বিশ্বাস করে না। তবে সে যে কিছু একটা নিয়ে যাচ্ছে, সে কথাটি সত্যি। কী নিয়ে যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে কে জানে! নায়ীরা দূরে। অস্তায়মান সূর্যের দিকে তাকাল। নিচে বিস্তীর্ণ বনভূমিতে এখন নিশ্চয়ই অন্ধকার নেমে এসেছে। আকাশের কাছাকাছি সূর্যটা যাই যাই করেও যেতে পারছে না। চারপাশে সাদা মেঘে সূর্যের রশ্মিটুকুকে কী অপূর্বই না দেখায়! সে কি কখনো ভেবেছিল, তার ধরাবাঁধা ক্লোন-জীবনে কখনো এরকম একটি দৃশ্য দেখার সুযোগ পাবে?

হঠাৎ বহুদূর থেকে গুম গুম শব্দ ভেসে আসে। নায়ীরা চমকে উঠে বলল, কিসের শব্দ?

রিশি দূরে তাকানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, জানি না, মনে হয় অবমানব গোলাগুলি শুরু করেছে।

আমাদের গুলি করেছে?

না। অনেক দূর থেকে শব্দ আসছে। আমাদের দিকে নয়।

আমাদের কি ওরা গুলি করতে পারে?

সম্ভাবনা খুব কম। অন্ধকার নেমে আসছে, আমাদের আর দেখা পাবে না। নিরাপত্তার। জন্য আমরা ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন পর্যন্ত ব্যবহার করছি না।

নায়ীরা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, মানুষ আর মানুষ যদি যুদ্ধ না করত তা হলে পৃথিবীটা কী সুন্দর হত, তাই না রিশি।

হ্যাঁ। ঠিকই বলেছ। 

রিশি, তোমার কি মনে হয় যে, একদিন মানুষ এত উন্নত হবে যে তারা বুঝতে পারবে যুদ্ধবিগ্রহ করার কোনো অর্থ নেই। তারা একজনের সঙ্গে আরেকজন যুদ্ধ করবে না?

আমার মনে হয় হবে। নিশ্চয়ই হবে।

.

দেখতে দেখতে অন্ধকার নেমে এল। আকাশে আধখানা চাঁদ এবং অসংখ্য নক্ষত্র। নায়ীরা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে নক্ষত্রগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। পৃথিবী থেকে কত লক্ষ কোটি মাইল দূরে ওই নক্ষত্রগুলো, সেখানে কি পৃথিবীর মতো কোনো গ্রহ আছে? সেই গ্রহে কি মানুষের মতো কোনো প্রাণী আছে? সেই প্রাণী কি এখন আকাশের দিকে তাকিয়ে একই কথা ভাবছে? নায়ীরা অকারণে নিজের ভেতরে এক ধরনের শিহরন অনুভব করে।

গ্লাইডারটি হঠাৎ মৃদু একটা ঝাঁকুনি দিয়ে কাঁপতে শুরু করে। নায়ীরা ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী হল?

কিছু না। আমি গতিপথটা একটু পরিবর্তন করছি।

রিশি।

বলো।

গ্লাইডার চালানো কি খুব কঠিন?

একেবারেই কঠিন না। এটা নিজে ভেসে থাকে। পাখাগুলো নাড়াচাড়া করে গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।

বিজ্ঞান কেন্দ্রের একজন বলেছিল, তুমি নাকি পৃথিবীর সেরা গ্লাইডার পাইলট!

রিশি শব্দ করে হেসে বলল, ঠাট্টা করে বলেছে। কারণ কাজটা এত সোজা যে, এর মধ্যে সেরা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। রিশি হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে বলল, তুমি গ্লাইডার চালানো শিখতে চাও?

নায়ীরা অবাক হয়ে বলল, কে? আমি?

হ্যাঁ।

আমি কেমন করে শিখব?

তুমি যদি সাহস করে ফিউজলেজের ওপর দিয়ে আমার ককপিটে চলে আস আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব।

আমি ফিউজলেজের ওপর দিয়ে চলে আসব?

হ্যাঁ। ককপিটে যথেষ্ট জায়গা আছে। একটু চাপাচাপি হবে কিন্তু দুজন বসতে পারব।

নায়ীরা উত্তেজিত গলায় বলল, তুমি সত্যি বলছ?

হ্যাঁ। আমি সত্যি বলছি। তবে খুব সাবধান, পড়ে যেও না যেন। তা হলে বিজ্ঞান কেন্দ্রের লোকজন আমাকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে।

নায়ীরা সিটবেল্ট খুলে নিজেকে মুক্ত করতে করতে বলল, আমি পড়ব না।

ককপিট থেকে শরীরটা বের করে ফিউজলেজটা আঁকড়ে ধরে নায়ীরা সাবধানে সামনে অগ্রসর হতে থাকে, বাতাসে তার চুল উড়ছে, ভয়ে সে নিচে তাকাতে সাহস পাচ্ছে না। মনে হতে থাকে একটু অসাবধান হলেই বুঝি বাতাস তাকে উড়িয়ে নেবে।

কিন্তু সেরকম কিছু হল না, রিশির কাছাকাছি আসতেই সে হাত বাড়িয়ে খপ করে নায়ীরাকে ধরে ফেলে তারপর শক্ত হাতে তাকে টেনে ককপিটে ঢুকিয়ে নেয়। নায়ীরা ছেলেমানুষের মতো খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল, কী মজা হল, তাই না?

পড়ে গেলে মজাটা বের হত! অবমানবেরা যখন দেখত আকাশ থেকে পরী নেমে আসছে, কী অবাক হত বলো দেখি?

কিন্তু সেই পরী তো উড়তে উড়তে নামত না, ঢেলার মতো পড়েই থেঁতলে যেত!

এগুলো হচ্ছে ছোটখাটো ঘুঁটিনাটি। উড়ে উড়ে নামলেও পরী, ঢেলার মতো নামলেও পরী। আকাশ থেকে ফুটফুটে একটা মেয়ে নামছে, সেটাই হচ্ছে বড় কথা।

নায়ীরা কৌতূহল নিয়ে ককপিটের দিকে তাকাল। ভেতরে অনেকগুলো মিটার জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। রিশি তার একটা দেখিয়ে বলল, এই যে এটা দেখাচ্ছে আমরা কত উঁচুতে আছি, আর এটা দেখাচ্ছে আমাদের গতিবেগ। এই এটা দেখাচ্ছে আমরা কোনদিকে যাচ্ছি। আমরা কোনদিকে যেতে চাই সেটা সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছি। যখন সেটা থেকে একটু সরে যায় আমাকে আবার নিজের হাতে আবার ঠিক করে নিতে হয়।

রিশি একটা একটা করে নায়ীরাকে দেখিয়ে দেয়। নারীরা কৌতূহল নিয়ে দেখে, রিশির অনুমতি নিয়ে হাত দিয়ে স্পর্শ করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্লাইডারটা উড়িয়ে নেওয়ার ছোটখাটো বিষয়গুলো সে শিখে যায়। রিশি তাকে উড়িয়ে নিতে দেয় এবং নায়ীরা ছেলেমানুষের মতো খুশি হয়ে গ্লাইডারটি উড়িয়ে নিয়ে যায়।

ছোট ককপিটে দুজন পাশাপাশি বসেছে। বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস। রিশি তাই ককপিটের ঢাকনাটা টেনে দেয়। কিছুক্ষণের ভেতরই ভেতরে একটা আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে। রিশি সামনের ড্রয়ার খুলে তাদের শুকনো খাবারের প্যাকেট বের করে, দুজনে খেতে খেতে হালকা গলায় গল্প করে।

নায়ীরা তার কফির মগে একটা চুমুক দিয়ে ডান দিকের একটা স্ক্রিন দেখিয়ে বলল, এটা কী?

একটা ভিডিওস্ক্রিন। কেন রেখেছে বুঝতে পারছি না। চালু করার চেষ্টা করেছি, কোনো লাভ হয় নি।

নায়ীরা উচ্চতার মিটারটির দিকে তাকিয়ে বলল, খুব ধীরে ধীরে আমাদের উচ্চতা কমে আসছে রিশি।

তুমি ঠিক করে নাও।

নায়ীরা উচ্চতা বাড়ানোর জন্য গ্লাইডারের পাখাগুলো ঠিক করার চেষ্টা করে বলল, এখন আগের উচ্চতায় ফিরে এসেছি, কিন্তু আমাদের গতিবেগ কমে এসেছে।

যেটুকু কমেছে সেটা এমন কিছু নয়।

কিন্তু কেন এরকম হচ্ছে?

রিশি একটু হেসে বলল, এটা অসম্ভব হালকা গ্লাইডার। এর কোথায় কতটুকু ওজন হবে সেটা একেবারে গ্রাম পর্যন্ত হিসাব করা আছে। তোমাকে সামনে নিয়ে আসায় ককপিটটায় ওজন বেশি হয়ে গেছে। তাই গ্লাইডারের ওজনের ব্যালেন্স ঠিক নেই, আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসছে।

নায়ীরা চিন্তিত মুখে বলল, তা হলে আমি পেছনে আমার ককপিটে চলে যাই। 

কোনো তাড়াহুড়ো নেই। ধীরেসুস্থে যেও। রিশি হঠাৎ কী মনে করে বলল, তার চেয়ে আরেকটা কাজ করা যাক।

কী কাজ?

তুমি এই ককপিটে বস। আমি পেছনে তোমার ককপিটে বসি।

কিন্তু যদি হঠাৎ করে কিছু হয়?

কী আর হবে? রিশি শব্দ করে হেসে বলল, এটা একটা গ্লাইডার, গাছের পাতা যেরকম বাতাসে ভাসতে ভাসতে নামে, এটাও সেরকম ভাসতে ভাসতে নেমে যাচ্ছে। এর মধ্যে হঠাৎ করে কিছু হওয়ার নেই।

ঠিক আছে, নায়ীরা খুশি হয়ে বলল, আমি হলে তোমার ককপিটে বসছি। তুমি আমার ককপিটে যাও।

রিশি ককপিট থেকে বের হয়ে ফিউজলেজের ওপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে নায়ীরার ককপিটে গিয়ে বসে যায়।

.

ককপিটে বসে নায়ীরা গ্লাইডারটিকে কখনো ওপরে কখনো নিচে নামিয়ে পরীক্ষা করে দেখল। বাতাসের প্রবাহের কারণে কখনো কখনো গতিবেগের পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছিল, নায়ীরা সেটাও ঠিক করে নিতে শিখেছে। ককপিটে বসে সে দেখতে দেখতে প্রায় দুই শ কিলোমিটার উড়িয়ে নিয়ে এসেছে। বাইরে নিশুতি রাত। চাঁদটি পশ্চিম দিকে খানিকটা ঢলে পড়েছে। জ্যোৎস্নার নরম আলোয় গ্লাইডারটিকে একটি প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর মতো দেখায়। নিচে, বহু নিচে অবমানবেরা হিংস্র চোখে হয়তো আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। নায়ীরা। একবার পেছনে ফিরে রিশিকে দেখার চেষ্টা করল। রিশি ককপিটে শান্তভাবে বসে আছে, এই কনকনে শীতেও তার ককপিটের ঢাকনা খোলা, বাতাসে তার চুল উড়ছে। নায়ীরা রিশিকে উদ্দেশ করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ ছোট একটা বিস্ফোরণের মতো শব্দ হল-সঙ্গে সঙ্গে রিশি ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে ওঠে। নায়ীরা শুনতে পেল রিশি একটা কাতর আর্তনাদের মতো শব্দ করেছে। নায়ীরা ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, রিশি, কী হয়েছে রিশি?

রিশি তার কথার উত্তর দিল না। নায়ীরা আবার ডাকল, রিশি। রিশি-

রিশি এবারেও তার কথার উত্তর দিল না, শুধু একটা চাপা আর্তনাদের মতো শব্দ করল। এক মুহূর্তের জন্য ভয়ে আতঙ্কে নায়ীরার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হল, অনেক কষ্টে সে নিজেকে শান্ত করল। ফিউজলেজের ওপর উঠে সে রিশির ককপিটে এগোতে এগোতে বলল, আমি আসছি বিশি।

গ্লাইডারটি দুলছে, সামনের ককপিটটি সম্ভবত কখনো খালি রাখার কথা নয়, কিন্তু এখন সেটি নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। পেছনের ককপিটের কাছাকাছি গিয়ে নায়ীরা আবার ডাকল, রিশি।

ককপিটের ভেতর থেকে রিশি গোঙানোর মতো শব্দ করে বলল, কাছে এস না নায়ীরা।

কেন?

এই ককপিটটাতে বুবি ট্র্যাপ বসানো।

কী বসানো?

বুবি ট্র্যাপ। আমি মারা যাচ্ছি নায়ীরা।

নায়ীরা আর্তনাদ করে বলল, কী বলছ তুমি?

গ্লাইডারটি খুব খারাপভাবে দুলছে, তার মধ্যেই নায়ীরা আরো একটু অগ্রসর হয়ে গেল। রিশি চাপা স্বরে বলল, খবরদার নায়ীরা, কাছে এস না খবরদার।

জ্যোৎস্নার আলোয় নারীরা অস্পষ্টভাবে রিশিকে দেখতে পায়। তার শরীরে ছোপ ছোপ কালো রঙ। আসলে রঙটি কালো নয়, সেটা যে রক্তের ছোপ সেটা বুঝতে নায়ীরার একটুও দেরি হয় না।

তোমার এখানে থাকার কথা ছিল। রিশি ফিসফিস করে বলল, এখানে তোমাকে হত্যা করার কথা ছিল। তুমি বেঁচে গেছ নায়ীরা-।

নায়ীরা আর্তনাদ করে বলল, না। আমি বাঁচতে চাই না –

নায়ীরা, তোমাকে বাঁচতে হবে। তোমাকে টেহলিস শহরে যেতে হবে। আমার জ্যাকেটের পকেটে- 

রিশি তার কথা শেষ করতে পারল না, জ্যোত্সর আবছা আলোতে হঠাৎ বিদ্যুঝলকের মতো কিছু একটা রিশির দিকে ছুটে যায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসে, সঙ্গে সঙ্গে একটা চাপা আর্তনাদ করে হঠাৎ রিশি নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

নায়ীরা ফিউজলেজে শুয়ে আকুল হয়ে কেঁদে কেঁদে ডাকল, রিশি, রিশি। আমার রিশি!

মাটি থেকে পাঁচ হাজার মিটার ওপরে গ্লাইডারটি বিপজ্জনকভাবে দুলতে দুলতে নিচে নেমে আসতে থাকে। তার ফিউজলেজে শুয়ে পনের বছরের কিশোরী একটা মেয়ে আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে। পৃথিবীর কোনো মানুষ সেই মেয়েটির অসহায় কান্নার শব্দ শুনতে পায় না।

.

নায়ীরা ককপিটে পাথরের মতো বসে আছে। গ্লাইডারটি খুব ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসছে, সেটাকে ওপরে নেওয়া দরকার, কিন্তু নায়ীরা তার চেষ্টা করে না। দক্ষিণ দিক থেকে একটা বাতাস এসে গ্লাইডারটাকে তার গতিপথ থেকে সরিয়ে নিতে শুরু করেছে, নায়ীরা সেটাও ঠিক করার চেষ্টা করল না-এখন কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না। ঠিক তখন খুট করে ককপিটে একটা শব্দ হল, সঙ্গে সঙ্গে কন্ট্রোল প্যানেলের ভিডিও মনিটরটি জ্বলে ওঠে। রিশি বলেছিল সে এটা চালু করার চেষ্টা করেছিল লাভ হয় নি। এখন নিজে নিজেই এটা চালু হয়েছে। সেখানে প্রথমে কয়েকটি সংখ্যা ভেসে আসে, তারপর সংখ্যাগুলো সরে গিয়ে একটা নীল আলো দেখা দেয়। প্রথমে এক ধরনের যান্ত্রিক শব্দ এবং তারপর হঠাৎ একজন মানুষের। ছবি ভেসে আসে। নায়ীরা মানুষটিকে চিনতে পারে, বিজ্ঞান কেন্দ্রের পরিচালক রুবা।

রুবা তার কঠিন মুখে জোর করে একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, যদি সবকিছু আমাদের পরিকল্পনা মতো ঘটে থাকে, তা হলে রিশি তুমি সামনের ককপিটে বসে আছ এবং খানিকটা বিস্ময় নিয়ে বোঝার চেষ্টা করছ পেছনের ককপিটে এইমাত্র কী ঘটে গেল। যদি তোমাকে আমরা ঠিকমতো বুঝে থাকি তা হলে তুমি সম্ভবত খানিকটা ক্ষুব্ধ। তিন শ নয় নম্বর ক্লোন মেয়েটি-যে প্রতি মুহূর্তে নিজেকে নায়ীরা বলে ঘোষণা করে আসছে, তাকে কেন আকাশের এত ওপরে রক্তক্ষরণে নিঃশেষিত করা হল, তুমি নিশ্চয়ই সেটি বোঝার চেষ্টা করছ। ক্লোন তিন শ নয় নিজেকে একটি নাম দিয়ে পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করলেও তার কোনো নাম পাওয়ার অধিকার নেই। সে একটি ক্লোন এবং যেখান থেকে আমরা তাকে এনেছি সেখানে হুবহু তার মতো আরো দশটি ক্লোন রয়েছে। প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রয়োজনে এই ক্লোনদের প্রস্তুত করা হয় এবং প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রয়োজনে তাদের খরচ করা হয়।

বিজ্ঞান কেন্দ্রে আমরা লক্ষ করেছি তিন শ নয় নম্বর ক্লোনের জন্য তোমার খানিকটা মমতার জন্ম হয়েছিল। আমরা সেটাকে অস্বাভাবিক মনে করি না। বাড়ির পোষা কুকুরের জন্য যদি মমতা জন্ম নিতে পারে, তা হলে একটি ক্লোনের জন্য মমতার জন্ম হবে না কেন? তবে আমরা নিশ্চিত, তুমি আমাদের সকল মানুষের অস্তিত্বের প্রয়োজনে একটি ক্লোনকে ব্যবহার করার বিষয়টিকে নিশ্চয়ই খোলামন দিয়ে গ্রহণ করবে।

আমরা কিছুদিন আগে জানতে পেরেছি আমাদের ওপর ব্যবহার করার জন্য অবমানবরা একটি মানববিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করতে শুরু করেছে। তাদের যে কোনো মূল্যে নিবৃত্ত করতে হবে। সেজন্য তারা আঘাত করার আগেই আমরা তাদের আঘাত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের ল্যাবরেটরিতে আমরা একটি ভাইরাস তৈরি করেছি, যেটি তাদের পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবে। এই ভাইরাসটির বিশেষত্ব এই যে, সেটি আমাদের আক্রান্ত করতে পারবে না। এই ভাইরাস শুধু অবমানবদের আক্রান্ত করবে। এই ভাইরাসের সংক্রমণের পর অবমানবরা অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে ব্যাকটেরিয়ার মতো অত্যন্ত দ্রুত মৃত্যুবরণ করবে। ভাইরাসটি দিয়ে সঠিকভাবে তাদের আক্রমণ করতে পারলে আগামী আটচল্লিশ ঘণ্টার ভেতরে অবমানব প্রজাতির পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কথা। আমরা অবমানবদের নিশ্চিহ্ন করে পৃথিবীকে একটি নিরাপদ বাসস্থান হিসেবে রেখে যেতে চাই।

পৃথিবীকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ বাসস্থান হিসেবে রাখার জন্য আমরা ক্লোন তিন শ নয়কে ব্যবহার করছি। আমরা তার শরীরের ভেতরে ভাইরাস জন্মানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। তার শরীরটিকে ব্যবহার করে কোটি কোটি ভাইরাসের জন্ম দেওয়া হয়েছে। আজ দুপুরে শরীরের কোষ ভেঙে সেগুলো তার রক্তস্রোতে মিশে গেছে। সেই সময়টিতে খিচুনি দিয়ে তার সমস্ত শরীরে প্রচণ্ড তাপমাত্রার জন্ম হয়েছিল। ক্লোন তিন শ নয় সেই মুহূর্ত থেকে অবমানবদের জন্য একটি ভয়াবহ মারণাস্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়।

কিছুক্ষণ আগে সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে প্রলয়ঙ্করী মারণাস্ত্রটি অতিমানবদের ওপর নিক্ষেপ করা হয়েছে। পদ্ধতিটি খুব সহজ-গ্লাইডারের ককপিটে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার শরীরের গুরুত্বপূর্ণ ধমনিগুলো কেটে দেওয়া। তার শরীরের রক্ত গ্লাইডারের বিশেষ টিউব দিয়ে নিচের বায়ুমণ্ডলে মিশে গেছে। উষ্ণ বায়ুপ্রবাহে সেটি অবমানবদের এলাকায় পৌঁছে যাবে। আটচল্লিশ ঘণ্টার ভেতরে প্রকৃতির সবচেয়ে ভয়ংকর এবং বিপজ্জনক পরীক্ষা অবমানব প্রজন্ম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

রিশি, আমি নিশ্চিত তুমি বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছ। তোমার প্রতি আমাদের জরুরি নির্দেশ, তুমি ক্লোন তিন শ নয়ের মৃতদেহ নিয়ে গ্লাইডারটিকে নির্দিষ্ট স্থানে অবতরণ করাও। গ্লাইডারে রাখা বিকনটি চালু করা হলে তোমাকে উদ্ধার করা হবে।

আমরা আশা করছি ক্লোন তিন শ নয়ের মৃত্যুর বিষয়টিকে তুমি সহজভাবে নেবে। ভাইরাসে ভরা তার রক্ত অবমানবদের এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এ ছাড়া অন্য কোনো সহজ উপায় ছিল না। শুধু মানবদেহেই এই ভাইরাসটি সজীব থাকে এবং বংশবৃদ্ধি করে। তাকে এই প্রক্রিয়ায় হত্যা করা না হলেও আগামী দুই সপ্তাহে তার মৃত্যু ঘটত। এই ভাইরাস আমাদের আক্রান্ত করে না, কিন্তু ক্লোন তিন শ নয়ের দেহের প্রয়োজনীয় প্রত্যেকটি অঙ্গ ভাইরাসের জন্মের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। যে তিন শ নয় নম্বর ক্লোনটি আগামী দু সপ্তাহের মধ্যে মৃত্যুবরণ করত, সেটি এখন মৃত্যুবরণ করেছে। এটাই পার্থক্য।

বিদায় রিশি। তোমাকে উদ্ধার করার জন্য আমরা তোমার সিগন্যালের জন্য অপেক্ষা করব।

খুট করে ভিডিও মনিটরটি বন্ধ হয়ে গেল। নায়ীরা তখনো নিস্পলক দৃষ্টিতে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকে দেখে মনে হয়, তার আশপাশে কী ঘটছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না।

খুব ধীরে ধীরে নায়ীরা পুরো ব্যাপারটি বুঝতে পারে। ভয়ংকর অবমানবদের ভাইরাস দিয়ে হত্যা করার জন্য তাকে পাঠানো হয়েছে, তার রক্তের মধ্যে রয়েছে সেই ভাইরাস। ঘটনাক্রমে সেই ভাইরাস এখনো মুক্ত হয় নি। রিশির প্রাণের বিনিময়ে অবমানবেরা বেঁচে গেছে, কিন্তু সেটি নিশ্চয়ই সাময়িক। বিজ্ঞান কেন্দ্র যখন জানতে পারবে তারা আবার চেষ্টা করবে, সফল না হলে আবার। আজ হোক কাল হোক পৃথিবী থেকে অবমানবদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। পৃথিবী হবে একটি নিরাপদ স্থান।

সেটি এখনো নিরাপদ হয় নি, তা হলে কি তার নিজের প্রাণ দিয়ে পৃথিবীকে নিরাপদ করা উচিত? ধারালো একটা চাকু দিয়ে তার হাতের ধমনি কেটে দেওয়া উচিত, যেন তার শরীরের ভেতরে বাস করা কোটি কোটি ভাইরাস কিলবিল করে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে? নায়ীরা তার হাতের দিকে তাকাল, না, সে নিজের হাতের ধমনি কাটতে পারবে না। দু সপ্তাহ পর সে এমনিতেই মারা যাবে জেনেও সে এখন নিজেকে হত্যা করতে পারবে না। যত ভয়ংকরই হোক, মানবপ্রজাতির একটি অপভ্রংশকে সে এভাবে নিঃশেষ করতে পারবে না। সে খুব সাধারণ একটি মেয়ে। একটি প্রজাতিকে পৃথিবী থেকে পুরোপুরি অপসারণ করার মতো এত বড় একটি সিদ্ধান্ত সে নিতে পারবে না। কিছুতেই সে এই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না।

নায়ীরা একটা নিশ্বাস ফেলে ঠিক করল, সে বেঁচে থাকবে। মৃত্যুর আগের মুহূর্তে রিশি তাকে বলেছে, তাকে বেঁচে থাকতে হবে। তার জ্যাকেটের পকেটে কিছু একটা আছে, সেটা তাকে দেখতে হবে। সেটা না দেখে সে মারা যাবে না। কিছুতেই মারা যাবে না।

নায়ীরা একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে সোজা হয়ে বসে। এই গ্লাইডারটাকে এখন সে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, ঠিক যেভাবে ভাসিয়ে নেওয়ার কথা। তারপর এটাকে ঠিক জায়গায় সে নিচে নামিয়ে আনবে, ঠিক যেভাবে নামিয়ে আনার কথা। তারপর সে যাবে টেহলিস শহরের দিকে, ঠিক যেভাবে তার যাওয়ার কথা। হতে পারে সেটি অসম্ভব, কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। তার শরীরে মৃত্যু বাসা বেঁধেছে, তার আর কোনো কিছুতে ভয় পাওয়ার নেই। সে আর কোনো কিছুতে ভয় পাবে না।

.

দীর্ঘ একটি রাত শেষ হয়ে যখন পূর্ব আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে, উঁচু গাছের কচি পাতায় যখন ভোরের সূর্যের সোনালি রোদ স্পর্শ করেছে, তখন অতিকায় একটি ফিনিক্স পাখির মতো ধবধবে সাদা গ্লাইডারটি নিঃশব্দে নিচে নেমে এল। চাকার ওপর ভর করে। সোজা সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে ছুটে গিয়ে একসময় সেটি থেমে যায়।

নায়ীরা তার ককপিট থেকে নিচে নেমে আসে। সে এখন অবমানবের এলাকায়। হয়তো এই মুহূর্তে কোনো একজন অবমানব তার ভয়ংকর বিকৃত চেহারা নিয়ে, তার তিনটি চোখ দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো হাতের সাত আঙুল দিয়ে ধরে রাখা কোনো ভয়ংকর অস্ত্র তার দিকে তাক করে রেখেছে, অদৃশ্য কোনো বুলেট তার মস্তিষ্ককে বিদীর্ণ করে দেবে, নিজের অজান্তে তার শরীরের লক্ষ-কোটি ভাইরাস কিলবিল করে তাদের ধ্বংস করার জন্য ছড়িয়ে পড়বে। নায়ীরা কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল, কোনো বুলেট তার মস্তিষ্ককে বিদীর্ণ করে দিল না, ভয়ংকর অস্ত্র হাতে দুই মাথার কোনো দানবও ছুটে এল না। নায়ীরা তখন পেছনের ককপিটে গিয়ে ভেতরে তাকাল। সিটবেল্টে বাঁধা রিশির মৃতদেহ রক্তশূন্য এবং বিবর্ণ। ঠোঁট দুটো নীল, চোখ আধখোলা। রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে আছে। নায়ীরা ফিসফিস করে বলল, আমি দুঃখিত রিশি। আমি খুব দুঃখিত।

রিশি বলেছিল তার জ্যাকেটের পকেটে কিছু একটা আছে, সে যেন সেটা দেখে। নায়ীরা সাবধানে জ্যাকেটের পকেটে হাত দেয়, সেখানে দুমড়ানো একটা খাম। নায়ীরা খামটি খুলে দেখে ভেতরে খবরের কাগজের এক টুকরো কাগজ। সেখানে ছোট একটা খবর, নায়ীরা ফিসফিস করে সেটা পড়ল।

মহাকাশবিজ্ঞানী নীরা ত্রাতিনা রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে সম্মানিত

কেন্দ্রীয় প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাকাশ গবেষণা বিভাগের বিজ্ঞানী নীরা ত্রাতিনাকে (৪২) সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, নীরা ত্রাতিনা একাধিকবার দুঃসাহসিক মহাকাশ অভিযানে অংশ নিয়েছেন এবং মহাকাশে নিউক্লিয়াসের বিশ্লেষণ সম্পর্কে তার মৌলিক গবেষণা কাজ রয়েছে। যৌবনে মহাকাশে এক দুর্ঘটনায় তার প্রিয় সহকর্মীর মৃত্যুর পর তিনি তার একাকী নিঃসঙ্গ জীবন মহাকাশ গবেষণায় অতিবাহিত করেন।

ছোট খবরটির ওপরে বিজ্ঞানী নীরা ত্রাতিনার একটি ছবি। নায়ীরা নিশ্বাস বন্ধ করে বিজ্ঞানী নীরা ত্রাতিনার ছবির দিকে তাকিয়ে রইল। ছবিটি তার নিজের। তার থেকে একটু বয়স বেশি, কিন্তু মানুষটি যে সে নিজে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তার কালো চুল, তার চোখ, ঠোঁটের কোনায় তার হাসি। রিশি টেবিলের ওপর থেকে একবার তার একটি চুল তুলে নিয়েছিল, সেখান থেকে তার ডিএনএ প্রোফাইল বের করে নিশ্চয়ই নীরা ত্রাতিনাকে খুঁজে বের করেছে।

কী আশ্চর্য! মহাকাশবিজ্ঞানী নীরা ত্রাতিনা কি জানে তার ক্লোন করা হয়েছে? সে কি জানে তার দুঃসাহসী অস্তিত্বকে এখন ল্যাবরেটরিতে গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করা হয়? যদি জানত তা হলে সে কী করত?

নায়ীরা কাগজের টুকরোটি পকেটে রেখে সাবধানে রিশির দেহটি মুক্ত করে নিচে নামিয়ে আনে। এই মানুষটির মৃতদেহ একটি সম্মানজনক শেষকৃত্য দাবি রাখে। একজন মানুষের মৃতদেহকে কেমন করে সমাহিত করতে হয় সে জানে না। তবু সে চেষ্টা করবে। মাটিতে গর্ত করে সে রিশিকে সেখানে শুইয়ে দেবে। সমাধির ওপরে একটি পাথর রেখে। সেখানে লিখে দেবে, রিশি : পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ।

নায়ীরা গ্লাইডার থেকে একটা শাবল নিয়ে ছায়াঢাকা একটি সুন্দর জায়গায় মাটি কাটতে থাকে। সে আগে কখনো মাটি কাটে নি, মাটি কাটতে এত কষ্ট সে জানত না। নিঃশব্দে সে শাবল দিয়ে গর্ত করতে থাকে, তাকে খুব সাবধান থাকতে হবে যেন কোনোভাবে শরীরের কোথাও কেটে না যায়। শরীর থেকে যেন এক ফোঁটা রক্তও বের হয়ে না আসে একটি প্রজাতিকে সে ধ্বংস করতে চায় না। সে প্রজাতি যত ভয়ংকর প্রজাতিই হোক।

রিশির দেহটিকে মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়ার আগে নায়ীরা তাকে শেষবারের মতো স্পর্শ করে ফিসফিস করে বলল, রিশি। বিদায়। তুমি কোথায় গিয়েছ আমি জানি না। তবে সেখানে আমি আসছি। দু সপ্তাহের মধ্যেই আছি।

পুরো দেহটি মাটি দিয়ে ঢেকে সে যখন উঠে দাঁড়াচ্ছে ঠিক তখন তার নজরে পড়ল গাছের নিচে এক জোড়া পা। কোনো একজন মানুষ নিঃশব্দে তাকে দেখছে। নায়ীরা খুব ধীরে ধীরে চোখ তুলতে থাকে—পা, দেহ এবং সবশেষে মাথা। নায়ীরা এর আগে অনেকবার অবমানবের বর্ণনা শুনেছে, কিন্তু নিজের চোখে প্রথমবার একজন অবমানব দেখে নায়ীরা আতঙ্কে শিউরে ওঠে। বিকৃত কুঞ্চিত ভয়ংকর একটি মুখমণ্ডল, দুটি চোখ ঠেলে বের হয়ে এসেছে। নাক নেই, সেখানে গলিত একটি গর্ত। ঠোঁটহীন একটি মুখ, ধারালো দাঁতের পেছনে লকলকে লাল জিব। মুখ থেকে আঠালো লালা ঝরছে। তীব্র ক্রুর দৃষ্টিতে কুৎসিত অবমানবটি তার দিকে তাকিয়ে আছে।

নায়ীরা আতঙ্কে চোখ বন্ধ করল। এই ভয়ংকর প্রাণীটির দিকে সে তাকাতে পারবে না। কিছুতেই পারবে না। নারীরা চোখ বন্ধ করে হাঁটু গেড়ে বসে রইল। প্রাণীটি তাকে আঘাত করুক, তাকে হত্যা করুক। সে রিশির পাশে প্রাণ হারিয়ে শুয়ে থাকবে। কিন্তু সে আর চোখ খুলবে না। কিছুতেই চোখ খুলবে না।

তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ?

অবমানবটির কথা শুনে নায়ীরা চমকে ওঠে। ভয়ংকর চেহারার এই প্রাণীটির গলার স্বর ভরাট এবং স্পষ্ট। উচ্চারণ একটু অন্যরকম, কিন্তু কথা বুঝতে কষ্ট হয় না। নায়ীরা দু হাতে মুখ ঢেকে রইল, তার কথা বলার শক্তি নেই।

চোখ তুলে তাকাও মেয়ে।

নায়ীরা ভয়ে ভয়ে চোখ তুলে তাকায়। ভয়ংকর প্রাণীটি তার দিকে এগিয়ে আসে, তারপর গলার কাছে হাত দিয়ে নিজের মুখোশটি খুলে নেয়। মুখোশের নিচে অনিন্দ্যসুন্দর একজন তরুণের মুখ, নীল চোখ, খাড়া নাক, কুচকুচে কালো চুল। তরুণটি একটু এগিয়ে এসে বলল, তুমি কি আমার মুখোশ দেখে ভয় পেয়েছ? আমি দুঃখিত। খুব দুঃখিত।

নায়ীরা কিছুক্ষণ বিস্ফারিত চোখে এই অনিন্দ্যসুন্দর তরুণের দিকে তাকিয়ে রইল। সে ধাতস্থ হতে একটু সময় নেয়। বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি মুখে এই মুখোশটি পরেছিলে কেন?

তরুণটি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে একটু হেসে বলল, এখানে কেউ নেই। আমি একা। মানুষ একা থাকলে অদ্ভুত অনেক কিছু করে। তা ছাড়া

তা ছাড়া কী?

আমি হরিণ কিংবা একটা পাহাড়ি ছাগল শিকার করতে এসেছি।

শিকার? নায়ীরা অবাক হয়ে বলল, আমি জানতাম মানুষ প্রাচীনকালে শিকার করত। এখনো করে?

সুদর্শন তরুণটি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, আমাদের মাঝে মাঝে করতে হয়। তখন আমি এখানে আসি।

ও। আচ্ছা।

শিকার করার সময় আমি এই মুখোশটা মুখে পরে নিই।

কেন?

হরিণ কিংবা পাহাড়ি ছাগলের মতো সুন্দর এক প্রাণীকে হত্যা করতে আমার খুব খারাপ লাগে। তখন আমি মুখে এই মুখোশটা পরে নিয়ে ভান করি যে আমি আমি না। আমি অন্য কেউ। একটা দানব।

নায়ীরা একটু অবাক হয়ে এই বিচিত্র তরুণটির দিকে তাকিয়ে রইল। এই তরুণটি কি অবমানব? অবমানব সম্পর্কে কত ভয়ংকর কথা শুনেছে কিন্তু তরুণটিকে তো মোটেও ভয়ংকর মনে হচ্ছে না। একটু বিচিত্র কিন্তু মোটেও ভয়ংকর নয়।

তরুণটি এক পা থেকে অন্য পায়ে ভর সরিয়ে নিয়ে বলল, তুমি কে? তুমি কোথা থেকে এসেছ?

নায়ীরা একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি তোমার এ প্রশ্নের উত্তর কেমন করে দেব জানি না। কারণ এর কোনো উত্তর নেই। আমি কেউ না। আমার কোনো নাম পর্যন্ত নেই। আমি নিজের জন্য একটা নাম ঠিক করেছি, সেই নামে আমাকে কেউ ডাকে না। একজন ডাকত, তাকে আমি এখানে কবর দিয়েছি।

তরুণটি বিস্মিত হয়ে বলল, এখানে কবর দিয়েছ?

হ্যাঁ।

তরুণটি শিস দেওয়ার মতো এক ধরনের শব্দ করে বলল, আমি দুঃখিত যে তোমার একজন সঙ্গী মারা গেছে। সে কেমন করে মারা গেল?।

নায়ীরা একটু ইতস্তত করে বলল, পুরো বিষয়টি আমি যদি তোমাকে খুলেও বলি তুমি সেটা বিশ্বাস করবে না। আমার কথা থাকুক। তুমি কে?

আমার নাম তিহান।

তিহান?

হ্যাঁ।

আমার নাম নায়ীরা।

তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম নায়ীরা। তরুণটি একটু এগিয়ে এসে হাত মেলানোর জন্য তার হাতটি বাড়িয়ে দেয়।

নায়ীরা কিছুক্ষণ বাড়িয়ে দেওয়া হাতটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমার সঙ্গে হাত মেলানো ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না।

কেন?

কারণ আমার শরীরে ভয়ংকর একটা ভাইরাস আছে। এই ভাইরাস দিয়ে তোমাদের সবাইকে হত্যা করার জন্য আমাকে পাঠানো হয়েছে। তোমাকে স্পর্শ করলে যদি তোমার শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণ হয়?

নায়ীরা ভেবেছিল, তার এ কথা শুনে তিহান নামের এই তরুণটি খুব বিস্মিত হবে। 

কিন্তু তরুণটি বিস্মিত হল না। এগিয়ে দেওয়া হাত সরিয়ে নিয়ে শান্তভাবে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

নায়ীরা জিজ্ঞেস করল, আমার কথা শুনে তুমি অবাক হও নি?

তিহান মাথা নাড়ল, না।

কেন নয়?

কারণ আমরা জানি, এরকম একটা কিছু হবে।

তোমরা জান? নায়ীরা অবাক হয়ে বলল, তোমরা কেমন করে জান?

আমরা জানি পৃথিবীর মানুষ আমাদের অবমানব বলে। তারা আমাদের নিয়ে অনেক রকম পরীক্ষা করে।

তোমাদের নিয়ে অনেক পরীক্ষা করে?

হ্যাঁ। আমার মায়ের কাছে আমরা শুনেছি পৃথিবীর মানুষেরা একসময় আমাদের নিয়ে জেনেটিক এক্সপেরিমেন্ট করেছে। তখন এখানে অনেক বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নিয়েছে। তাদের হাতে সাতটি আঙুল। কপালে বাড়তি চোখ। উত্তরের একটা গ্রামে একটা শিশুর দুটি মাথা ছিল।

এখন সেরকম শিশুর জন্ম হয় না?

না।

কেন?

মনে হয় তারা সেই এক্সপেরিমেন্ট বন্ধ করেছে। এখন আমাদের নিয়ে অন্য এক্সপেরিমেন্ট করে।

কী এক্সপেরিমেন্ট?

আমাদের সব পাওয়ার স্টেশন বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের সবকিছু তখন বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা এখন প্রাচীন মানুষের মতো থাকি। চাষ করি। শিকার করি। গাছের বাকলের পোশাক পরি।

নায়ীরা অবাক হয়ে বলল, ও।

আমার মা বলেন, আমরা আসলে একটা ল্যাবরেটরিতে আছি। আমাদের ওপর এক্সপেরিমেন্ট করে পৃথিবীর মানুষ গবেষণা করে। মানুষের ওপর গবেষণা। সমাজের ওপর গবেষণা।

নায়ীরা কী বলবে বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তিহানের দিকে তাকিয়ে রইল। তিহান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, মাঝে মাঝে হঠাৎ করে ভয়ংকর কোনো রোগ এসে আমাদের ওপর ভর করে। আমাদের অনেক মানুষ তখন মারা যায়। আমার মা বলেছে, পৃথিবীর মানুষ একটা রোগ বের করার জন্য গবেষণা করছে, যে রোগে আমাদের সব মানুষ একসাথে মরে যাবে।

নায়ীরা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে তিহানের দিকে তাকিয়ে রইল। তিহান বলল, আমি যাই।

তুমি কোথায় যাবে?

আমি আমার গ্রামে যাব। গিয়ে সবাইকে বলব আমরা যে শেষ সময়টার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, সেই সময়টা চলে এসেছে।

তোমার কি ভয় করছে তিহান?

না। আমার ভয় করছে না। একটু দুঃখ লাগছে, কিন্তু ভয় করছে না। তিহান কয়েক মুহূর্ত নায়ীরার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, বিদায়। তারপর হাতের মুখোশটা সে মাথায়। পরে নিল। মুহূর্তে তাকে দেখাতে লাগল একটা ভয়ংকর দানবের মতো। তিহান ঘুরে দাঁড়াল, তারপর পাথরে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটতে ব্রু করল। নায়ীরা হঠাৎ দাঁড়িয়ে বলল, তিহান দাঁড়াও। শোন।

তিহান তার ভয়ংকর মুখ নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়, কী হল?

আমি কি তোমার সঙ্গে যেতে পারি?

কোথায়?

তোমাদের গ্রামে।

কেন?

তোমার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে।

তিহান কয়েক সেকেন্ড কিছু একটা চিন্তা করল। তারপর মুখ থেকে ভয়ংকর মুখোশটা খুলে বলল, এস।

তুমি এক সেকেন্ড অপেক্ষা কর। আমি একটা জিনিস নিয়ে নিই।

কী জিনিস?

একটা বিকন। এটা চালু করলে বিজ্ঞান কেন্দ্র থেকে উদ্ধার করতে আসবে।

কাকে উদ্ধার করতে আসবে?

আমাকে না। রিশিকে। যাকে আমি এখানে কবর দিয়েছি।

তিহান কোনো কথা বলল না। নিঃশব্দে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে রইল। নায়ীরা গ্লাইডারের ড্রয়ার খুলে ঘোট ইলেকট্রনিক বিকনটা খুঁজে বের করে নিজের পকেটে নিয়ে নেয়। তারপর তিহানের কাছে এসে বলল, চল যাই।

চল।

তিহান, শুধু একটা বিষয়ে খুব সাবধান।

সেটা কী?

আমার রক্তে কিলবিল করছে এমন একটা ভাইরাস যেটা আমাকে এত সহজে হত্যা। করতে পারবে না, কিন্তু তোমাদের আটচল্লিশ ঘণ্টার ভেতরে শেষ করে দেবে। কাজেই খুব সাবধান, যেন কোনোভাবে আমার শরীর কেটে রক্ত বের হয়ে না যায়। তা হলে কিন্তু সর্বনাশ হয়ে যাবে।

তিহান কোনো কথা না বলে একটু হাসার চেষ্টা করল। নায়ীরা জিজ্ঞেস করল, তুমি হাসছ কেন?

কারণ কোনো কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না। পৃথিবীর মানুষ তোমাকে দিয়ে যদি আমাদের শেষ করতে না পারে, তা হলে আরেকজনকে পাঠাবে। তাকে দিয়ে সম্ভব না হলে আরেকজনকে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে, কাজেই এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। আজ হোক কাল হোক, আমরা সবাই শেষ হয়ে যাব নায়ীরা।

নায়ীরা কিছুক্ষণ তিহানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি দুঃখিত তিহান।

তোমার দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই।

আমি জানি না, এটা থেকে সান্ত্বনা পাওয়ার কোনো যুক্তি আছে কিনা আমার শরীরকে ভাইরাস তৈরির জন্য ব্যবহার করেছে বলে আমার আয়ু আর মাত্র দুই সপ্তাহ।

আমি দুঃখিত নায়ীরা।

তোমারও দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই তিহান।

কথাটি হাসির কথা নয় কিন্তু কেন জানি দুজনেই একসাথে একটু হেসে ফেলল।

বনের ভেতর দিয়ে নায়ীরা তিহানের সঙ্গে সঙ্গে হেঁটে যেতে থাকে। দুই পাশে গাছে বুনো ফুল, বাতাসে ফুলের গন্ধ। পাখি ডাকছে, কাঠবিড়ালী গাছে ছুটোছুটি করছে। নায়ীরা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। তার এখনো বিশ্বাস হয় না প্রকৃতির এত কাছাকাছি যে মানুষগুলো বেঁচে আছে, কী আশ্চর্য নিষ্ঠুরতায় তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে।

বুনো পথ শেষ হয়ে হঠাৎ একটা খোলা প্রান্তর শুরু হয়ে গেল। লম্বা ঘাসের ভেতর দিয়ে দুজন হেঁটে যায়। প্রান্তরের শেষে একটা নদী। একটা গাছের নিচে ছোট একটা নৌকা বাঁধা। একটা গাছের ভেতরটুকু খোদাই করে নৌকাটি তৈরি করা হয়েছে। দুজন কষ্ট করে বসতে পারে। তিহান নৌকাটা খুলে নায়ীরাকে বলল, ওঠ।

নায়ীরা নদীর স্বচ্ছ পানিতে পা ভিজিয়ে নৌকায় উঠে বসে। তিহান নৌকাটাকে মাঝনদীর দিকে ধাক্কা দিয়ে লাফ দিয়ে উঠে বসল। নদীর স্রোতে নৌকাটা তরতর করে। এগোতে থাকে, তিহান বৈঠাটাকে হালের মতো ধরে রেখেছে। তিহান হাত দিয়ে নদীর পানি তুলে এক চুমুক খেয়ে বলল, সোতের টানে যাচ্ছি, দেখতে দেখতে পৌঁছে যাব।

তোমার গ্রাম এখান থেকে কত দূর?

তিহান মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, এখন আমাদের কাছে এই প্রশ্নগুলোর কোনো অর্থ নেই। একসময় আমরা মিটার-কিলোমিটার ব্যবহার করেছি। এখন আর প্রয়োজন হয় না। দূরত্ব হচ্ছে কাছে কিংবা দূরে। ঘণ্টা-মিনিট-সেকেন্ড বলেও আমাদের কিছু নেই। সময় এখন হচ্ছে সকাল-দুপুর আর সন্ধ্যা!

নায়ীরা আর কোনো কথা বলে না। দেখতে দেখতে নৌকাটা বুনো অঞ্চল পার হয়ে লোকালয়ের কাছাকাছি আসতে থাকে। নদীর পাশে হঠাৎ করে একটা-দুটো গ্রাম দেখা যায়। মাটির ঘর, ঘাসের ছাদ। নদীর তীরে উদোম গায়ে শিশুরা খেলছে। শক্ত-সমর্থ নারীরা শস্য বাছাই করছে। পুরুষ মানুষেরা মাঠে কাজ করছে। দেখে মনে হয় কয়েক হাজার বছর আগের একটা দৃশ্য। আধুনিক সভ্যতার কোনো চিহ্ন নেই। কিন্তু পুরো দৃশ্যটাতে এক ধরনের আশ্চর্য কোমল শান্তির ছাপ খুব স্পষ্ট। নায়ীরা সেদিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ একটু বিভ্রান্ত হয়ে যায়, পৃথিবীর সভ্যতা সত্যিই কি ঠিকভাবে অগ্রসর হচ্ছে?

তিহান যখন তার গ্রামে পৌঁছল, তখন সূর্য ঢলে পড়ে বিকেল হয়ে এসেছে। নদীর ঘাটে নৌকাটা বেঁধে তিহান নদীর তীরে নেমে এল। স্বচ্ছ নদীর পানিতে পা ভিজিয়ে নায়ীরাও নেমে আসে। গ্রামের ছোট ছোট শিশুরা নদীর ঘাটে ভিড় করেছে, তাদের সঙ্গে সঙ্গে আরো কিছু নারী-পুরুষ এগিয়ে এসেছে। এখানকার মানুষের সঙ্গে নায়ীরার চেহারা আর পোশাকের পার্থক্যটুকু খুব স্পষ্ট।

নৌকা থেকে নেমে তিহান সোজা হেঁটে যেতে থাকে। আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন তাকে নিচু স্বরে কিছু একটা জিজ্ঞেস করল, তিহান তাদের কারো প্রশ্নের উত্তর দিল না। নায়ীরা চারপাশে তাকায়, ঘোট ঘোট শিশু, কিশোর-কিশোরী আর নানা বয়সের পুরুষ ও রমণী তাকে ঘিরে রেখেছে। তার শরীরের এক ফোঁটা রক্ত এদের সবাইকে হত্যা করে ফেলতে পারে! এর চেয়ে বড় নিষ্ঠুরতা, এর চেয়ে বড় পরিহাস আর কী হতে পারে?

একটা বড় খালি উঠোনের চারপাশে ছোট ছোট কয়েকটা মাটির ঘর। তিহান তার একটার সামনে দাঁড়িয়ে ডাকল, মা।।

কয়েক মুহূর্ত পর ভেতর থেকে মধ্যবয়সী একজন মহিলা বের হয়ে আসে। মাথায় কাঁচা-পাকা চুল, মুখে বয়সের বলিরেখা, রোদে পোড়া বাদামি চেহারা, শরীরে হাতে বোনা মোটা ধূসর কাপড়ের পোশাক। মহিলাটি ঘর থেকে বের হয়ে নায়ীরাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। একবার তিহানের দিকে, আরেকবার নায়ীরার দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল, তুমি কে, মেয়ে?

নায়ীরা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। ধূসর বিবর্ণ কাপড়ে ঢাকা মধ্যবয়স্ক এই মহিলাটির চোখ দুটোর দৃষ্টি কী তীব্র। মনে হয় তার শরীর ভেদ করে চলে যাচ্ছে। মহিলাটি আবার জিজ্ঞেস করল, কে তুমি?

নায়ীরা কী বলবে বুঝতে পারল না। তিহান বলল, মা, তুমি যার কথা সব সময় বলল, এই মেয়েটি সেই মেয়ে।

মহিলাটি কেমন যেন চমকে উঠে ঘুরে নায়ীরার দিকে তাকায়। তীব্র স্বরে বলল, তুমি কেন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছ?

নায়ীরা ভাঙা গলায় বলল, আমি একা আর পারছি না। আমার কারো সঙ্গে কথা বলতে হবে। আমাকে তুমি ফিরিয়ে দিও না।

তুমি কী বলতে চাও?

নায়ীরা ক্লান্ত গলায় বলল, আমি কি তোমার সঙ্গে একা একা কথা বলতে পারি? 

মহিলাটি কিছুক্ষণ নায়ীরার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তুমি নিশ্চয়ই ক্ষুধার্ত। তুমি বস, তোমাকে আগে আমি কিছু খেতে দিই।

মহিলাটি ঘরের ভেতর থেকে ঘাসে বোনা একটি কার্পেট এনে বিছিয়ে দিয়ে বলল, বস।

নায়ীরা মাটির ঘরে দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে। সত্যিই সে ক্লান্ত। সত্যিই সে ক্ষুধার্ত। শুধু একজন মা হয়তো সন্তানের মতো কাউকে দেখে সেটা বুঝতে পারে। অন্যেরা পারে না। তার মা নেই। তার কখনো মা ছিল না। নীরা ত্রাতিনা নামে বিখ্যাত একজন বিজ্ঞানীর শরীরের একটি কোষ নিয়ে ল্যাবরেটরিতে তাকে ক্লোন করা হয়েছিল। একজন মানুষের শরীরের একটা কোষ নিয়ে যদি কাউকে ক্লোন করা হয় তা হলে কি তাকে মা বলা যায়? একজন মানুষের মা থাকা নিশ্চয়ই খুব বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। নিশ্চয়ই খুব মধুর অভিজ্ঞতা।

তিহানের মা মাটির একটা বাটিতে করে গরম সুপ নিয়ে আসে। সেই গরম সুপে চুমুক দিয়ে নায়ীরা মধ্যবয়স্ক মহিলাকে জিজ্ঞেস করল, আমি তোমাকে কী বলে সম্বোধন করব?

এই গ্রামে সবাই আমাকে ফুলী-মা বলে ডাকে। এই গ্রামে সবাই আমার সন্তানের মতো।

আমিও তোমাকে ফুলী-মা বলে ডাকব?

ডাক।

আমি একজন ক্লোন। আমার কোনো মা ছিল না। আমি যদি কখনো কাউকে মা ডাকি সেটা হবে একটা মিথ্যাচার।

এসব নিয়ে মাথা ঘামিও না। এটি শুধু একটি সম্বোধন। ফুলী-মা একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তুমি বলো, তুমি কেন আমার কাছে এসেছ।

আমি তোমাদের সবার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি।

তুমি কেন আমাদের কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছ?

তিহানের কথা থেকে তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ আমার রক্তের ভেতরে রয়েছে তোমাদের সবাইকে হত্যা করার জন্য এক ভয়ংকর ভাইরাস।

ফুলী-মা কোনো কথা না বলে স্থিরদৃষ্টিতে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে রইল। নায়ীরা বলল, গত রাতে আকাশে আমার হাতের ধমনি কেটে তোমাদের ওপর এই ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়ার কথা ছিল। ঘটনাক্রমে সেটি ঘটে নি।

ফুলী-মা বলল, আজ হোক, কাল হোক সেটা ঘটবে। পৃথিবীর মানুষ সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তোমাকে দিয়ে যদি না পারে তা হলে তারা অন্য কাউকে দিয়ে আমাদের সবাইকে হত্যা করবে।

নায়ীরা বলল, আমাকে তুমি সেটা বুঝিয়ে দেবে?

তুমি কী বুঝতে চাও মেয়ে?

কেমন করে এটা হতে পারে?

আমি ছোট থাকতে যখন ইতিহাস পড়েছি তখন দেখেছি, অসংখ্যবার পৃথিবীতে এ ঘটনা ঘটেছে। মানুষ নিজেদের মধ্যে বিভাজন ঘটিয়েছে, তারপর শক্তিমান মানুষ দুর্বল মানুষকে হত্যা করেছে।

নায়ীরা বলল, কিন্তু কেন মানুষের বিভাজন হবে? আমি কেন ক্লোন, অন্যেরা কেন মানুষ? আমরা সবাই কেন মানুষ না? তোমরা কেন অবমানব, অন্যেরা কেন মানব? সবাই কেন মানব না?

মহিলা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, এই আলোচনা থাক মেয়ে। আমরা জানতাম, মৃত্যু আসছে। চারপাশে পাহাড়, এক পাশে নদী, বিশাল এই এলাকায় আমরা আটকা পড়া কিছু মানব। পৃথিবীর মানুষের ভাষায় অবমানব! ভালোই হল, তুমি সঙ্গে করে মৃত্যুকে নিয়ে এসেছ। কখন সেই ভয়ংকর সময় আসবে এখন আমাদের সেটা নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আমরা ভেবেচিন্তে আমাদের সময় ঠিক করে নেব।

না। নায়ীরা মাথা নাড়ল, না, ফুলী-মা, সেটা হতে পারে না।

কী হতে পারে না?

এভাবে তোমাদের সবার মৃত্যু হতে পারে না।

নায়ীরা, তুমি কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না।

শোন ফুলী-মা, পৃথিবীর মানুষ তোমাদের কথা জানে না। যেটুকু জানে ভুলভাবে জানে, বিকৃতভাবে জানে। আমি তাদের ভুল ভাঙাতে চাই, সত্যি কথা জানাতে চাই।

নায়ীরার কথা শুনে ফুলী-মা শব্দ করে হেসে উঠল। বলল, তুমি কি ভেবেছ আমরা তার চেষ্টা করি নি? কতবার চেষ্টা করেছি। আমাদের কত তরুণ-তরুণী টেহলিস শহরে যেতে চেষ্টা করেছে। কতবার সেই পাহাড় অতিক্রম করতে চেয়েছে। প্রতিবার তাদের ধরে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। কেউ যেতে পারে নি। পৃথিবীর মানুষকে বোঝানো হয়েছে। আমরা অবমানব। আমরা ভয়ংকর প্রাণী। আমরা নিষ্ঠুর, আমরা হিংস্র, আমরা খুনি!

আমরা কি তাই বলে হাল ছেড়ে দেব? পৃথিবীর মানুষকে আমরা আর সত্যি কথা জানাতে চেষ্টা করব না?

কীভাবে চেষ্টা করবে?

নায়ীরা পকেট থেকে ছোট ইলেকট্রনিক বিকনটা বের করে দেখাল, এই যে দেখছ, এটা একটা ইলেকট্রনিক বিকন। এর সুইচটা অন করলে বিজ্ঞান কেন্দ্র থেকে কেউ আসবে উদ্ধার করতে। নিশ্চয়ই একটা হেলিকপ্টারে আসবে। তুমি এই গ্রামে তোমার সন্তানদের দিয়ে সেই হেলিকপ্টারটি দখল করিয়ে দিতে পারবে?

যদি দিই, তখন তুমি কী করবে?

আমি সেটা নিয়ে টেহলিস শহরে উড়ে যাব।

গিয়ে তুমি কী করবে?

আমি সবকিছু বলব।

ফুলী-মা আবার শব্দ করে হাসল। বলল, তুমি টেহলিস শহরে উড়ে যেতে পারবে কিনা আমি জানি না। যদি যেতেও পার, সেখানে কেউ তোমার কথা বিশ্বাস করবে না। সত্যি কথা বলতে কি, কেউ তোমার কথা শুনতেও রাজি হবে না।

হবে।

না, নায়ীরা। পৃথিবী খুব চমৎকার একটা জায়গা। কিন্তু তুমি যদি পৃথিবীতে ভুল সময়ে ভুল জায়গায় থাক, তা হলে এই পৃথিবীর থেকে কঠিন জায়গা আর কিছু হতে পারে না। ফুলী-মা একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, আমরা এখন ভুল সময়ে ভুল জায়গায় আছি। এখন তুমি একজন মানুষকেও তোমার কথা বিশ্বাস করাতে পারবে না।

পারব। পৃথিবীর সব মানুষ আমাকে অবিশ্বাস করলেও একজন কখনো আমাকে অবিশ্বাস করবে না।

সে কে?

তার নাম নীরা ত্রাতিনা।

কেন সে তোমার কথা অবিশ্বাস করবে না?

কারণ আমি তার ক্লোন।

নায়ীরা ব্যাকুল চোখে ফুলী-মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি আমাকে সাহায্য করবে? আমার জন্য নয়, তোমার সন্তানদের জন্য। করবে?

ফুলী-মা আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, ঠিক আছে, নায়ীরা। আমি তোমাকে সাহায্য করব।

.

নায়ীরা একটা উঁচু বেদির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তার সামনে প্রায় জনপঞ্চাশেক নারী-পুরুষ। তিহানের মা-যাকে গ্রামের সবাই ফুলী-মা ডাকে, সবাইকে এখানে একত্র হতে বলেছে। তিহানের মা এই গ্রামের সবারই মা, তার কথা কেউ কখনো ফেলতে পারে না। গ্রামের সবাই দেখেছে বিচিত্র পোশাকের কমবয়সী একটা মেয়ে এখানে এসেছে। কেন এসেছে তারা কেউ জানে না। পৃথিবী থেকে আগেও কখনো কখনো কোনো মানুষ এখানে এসেছে, কিন্তু সেটি কখনো তাদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনে নি। রূপসী এই মেয়েটিও নিশ্চয়ই তাদের জন্য কোনো সৌভাগ্য বয়ে আনে নি, তাদের জন্য নিশ্চয়ই এক ভয়াবহ বিপদ বয়ে এনেছে। সেটি কত বড় বিপদ সেটাই তারা এখন জানতে চায়। যারা দাঁড়িয়ে আছে তারা চাপা গলায় নিজেদের ভেতর কথা বলছে, নায়ীরা হাত তুলতেই সবাই থেমে গেল।

নায়ীরা বলল, আমার নাম নায়ীরা। আসলে এটি আমার সত্যিকারের নাম না। আমার সত্যিকারের নাম নেই। আমি একটি ক্লোন। কোনো ক্লোনকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না, তাই ক্লোনদের কোনো নাম থাকে না। পৃথিবীর মানুষ আমাকে কোনো নাম ধরে ডাকে না। আমাকে একটা নম্বর দিয়ে ডাকে। আমার নম্বর তিন শ নয়।

নায়ীরা সবার দিকে একনজর তাকিয়ে বলল, পৃথিবীর মানুষ যেরকম আমাকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে না, ঠিক সেরকম তোমাদেরও মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে না। তোমাদের তারা বলে অবমানব। পৃথিবীর সাধারণ মানুষকে তারা বুঝিয়েছে তোমরা সত্যিকারের মানুষ নও। তোমরা হিংস্র, তোমরা খুনি, তোমরা অপরিণত বুদ্ধির মানুষ। তারা বলে, তোমরা তাদের ধ্বংস করার জন্য মানববিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করেছ। তাই তোমাদের হত্যা। করতে হবে। তোমরা পৃথিবীর মানুষকে হত্যা করার আগে তারা তোমাদের হত্যা করবে।

তোমাদের হত্যা করার জন্য তারা আমাকে পাঠিয়েছে। আমার শরীরের ভেতরে আছে। একটি ভয়ংকর ভাইরাস। আমার রক্তে সেই ভাইরাস কিলবিল করছে। তারা আমাকে কেটে সেই রক্ত তোমাদের ওপর ছিটিয়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু সেটা ঘটে নি। আমি এখনো বেঁচে আছি এবং তোমরাও এখনো বেঁচে আছ। পৃথিবীর সেই অল্প কয়জন খারাপ মানুষ যখন সেটি জানবে, তারা আবার কাউকে পাঠাবে। সে যদি ব্যর্থ হয় তখন আবার কাউকে পাঠাবে। এখন তোমাদের বেঁচে থাকার একটিমাত্র উপায়।

কাঁপা গলায় একটি কিশোরী জানতে চাইল, কী উপায়?

নায়ীরা পকেট থেকে ছোট ইলেকট্রনিক বিকনটি বের করে সবাইকে দেখিয়ে বলল, এই যে আমার কাছে একটা ইলেকট্রনিক বিকন। অন করা মাত্রই এটা থেকে একটা সিগন্যাল বের হবে, তখন একটা হেলিকপ্টার আসবে উদ্ধার কাজে। সেই হেলিকপ্টারটি তোমাদের দখল করে দিতে হবে।

উপস্থিত নারী-পুরুষ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল, কেউ একটি কথাও বলল না। নায়ীরা বলল, সেই হেলিকপ্টার নিয়ে আমি যাব টেহলিস শহরে, পৃথিবীর মানুষকে সত্য কথাটি বলতে। আমি যদি তাদের বলতে পারি, তা হলে তোমরা বাচবে। যদি না পারি, তোমরা পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তোমরা বলো, তোমরা কি একটিবার শেষ চেষ্টা না করে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে চাও?

উপস্থিত সবাই মাথা নাড়ল, না, চাই না।

তা হলে আমাকে সবাই সাহায্য কর। এস, সবাই মিলে একটা পরিকল্পনা করি।

নায়ীরাকে ঘিরে সবাই কাছাকাছি এগিয়ে এল।