৩. বিজ্ঞান কেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি

বিজ্ঞান কেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতে দীর্ঘ সময় লেগে গেল। এই মেয়েগুলো একটা গোপন প্রজেক্ট, তাদের সম্পর্কে কোথাও কোনো তথ্য নেই। নিরাপত্তাকর্মীরা যেন কোন সমস্যা না করে সেজন্য বিশেষ অনুমতিপত্রের ব্যবস্থা করতে হল। গোপন ল্যাবরেটরির চার দেয়ালের ভেতরে থাকে বলে মেয়েগুলোর বাইরের জীবন সম্পর্কে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তাই জরুরি কাজে লাগতে পারে সেরকম কিছু জিনিসপত্র একটা ব্যাগে গুছিয়ে নিতে হল। পুরো ব্যাপারটি গোপন তাই তার নিজেকেই একটা গাড়ি করে নিয়ে যেতে হবে, গাড়ির জ্বালানি, নির্দিষ্ট পথে যাওয়ার অনুমতি নেটওয়ার্ক থেকে ডাউনলোড করে নিতে হল। ঠিক কী কাজে এই মেয়েটিকে ব্যবহার করবে জানা নেই, তাই তিশিনা মেয়েটির সকল তথ্য একটা ক্রিস্টালে জমা করে নিল।

পরদিন তিশিনা আবার যখন ল্যাবরেটরির ভারী দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেছে তখন করিডরে সব কয়টি মেয়ে প্রায় জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েগুলো সুন্দর করে। সেজেছে, চুলগুলো পরিপাটি করে বাধা। তাদের জামাকাপড় খুব বেশি নেই, তার মাঝে সবচেয়ে ভালো পোশাকটি তারা পরেছে। দরজার কাছাকাছি একটা ব্যাগ। সেখানে হয়তো দৈনন্দিন প্রয়োজনের জিনিসগুলো রেখেছে।

তিশিনা কয়েক মুহূর্ত মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কে যাবে সেটা কি ঠিক করেছ?

মেয়েগুলো একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি নিচু গলায় বলল, আসলে আমাদের একজনের সঙ্গে আরেকজনের কোনো পার্থক্য নেই। তাই যে কোনো একজন তোমার সঙ্গে যাবে।

কিন্তু সেটি কে?

সেটি আমরা একেবারে শেষ মুহূর্তে ঠিক করব তিশিনা।

এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ে বলল, তোমার যেন সময় নষ্ট না হয় সেজন্য আমরা সবাই পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে আছি।

সামনের মেয়েটি বলল, আমাদের ব্যাগটিও প্রস্তুত করে রেখেছি। তুমি ডাকলেই আমাদের একজন এসে ব্যাগটি তুলে নিয়ে তোমার সঙ্গে বের হয়ে যাবে।

তিশিনা কোমল গলায় বলল, আমি বুঝতে পারছি, মেয়েরা। আমি তোমাদের সঙ্গে থাকলে মনে হয় এটাই করতাম।

আমাদের সবাই একরকম, সবাই একসঙ্গে থাকি, একভাবে কথা বলি, একতাবে ভাবি। এত দিন এভাবে আছি যে, এখন মনে হয় আমরা সবাই মিলে বুঝি একজন মানুষ।

তাই আমাদের একজন যখন আমাদের ছেড়ে চলে যায় তখন আমাদের খুব কষ্ট হয়। আমরা কষ্টের মুহূর্তটাকে যতদূর সম্ভব বিলম্বিত করতে চাই।

তিশিনা মাথা নাড়ল, বলল, আমি বুঝতে পারছি।

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি বলল, যে তোমার সঙ্গে যাবে তার জীবনটি হবে অন্যরকম।

নিশ্চয়ই তার জীবনটি হবে সুন্দর। সুন্দর এবং উত্তেজনাময়।

একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা তাকে স্পর্শ করে রাখতে চাই তিশিনা।

তিশিনা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, সেই শেষ মুহূর্তটা এসে গেছে। তোমাদের একজন এখন এস আমার সঙ্গে।

মেয়েগুলো তখন হাত তুলে একজন আরেকজনকে শক্ত করে ধরে ধরে চোখ বন্ধ করল, তাদের দেখে মনে হয় তারা বুঝি উপাসনা করছে। ঠিক কীভাবে তারা ঠিক করল তিশিনা বুঝতে পারল না। কিন্তু হঠাৎ মাঝামাঝি জায়গা থেকে একজন এগিয়ে এসে তিশিনার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, চল তিশিনা।

তুমি যাবে?

হ্যাঁ। মেয়েটি ব্যাগটি হাতে তুলে নিয়ে বলল, আমি প্রস্তুত।

তিশিনা ভেবেছিল মেয়েটি হয়তো অন্য মেয়েগুলোর কাছ থেকে বিদায় নেবে, কিন্তু সেরকম কিছু করল না। এরা একজনের সঙ্গে আরেকজন মুখে কোনো কথা না বলেই অনেক কিছু বলে দিতে পারে, নিশ্চয়ই সেরকম কিছু একটা হয়েছে। সম্ভবত সেভাবেই সে বিদায় নিয়েছে।

অন্য দশজন মেয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, সামনের মেয়েটি বলল, আমাদের কখনো কোনো নামের প্রয়োজন হয় না, কারণ আমরা সবাই মিলে আসলে একজন মানুষ। কিন্তু যখন কাউকে চলে যেতে হয় তখন তার একটা নামের প্রয়োজন হয়।

অন্য পাশ থেকে আরেকটি মেয়ে বলল, আমরা তাই অনেক ভেবে একটা নাম ঠিক করেছি। নায়ীরা।

নায়ীরা, তোমার সঙ্গে অনেক মানুষের পরিচয় হবে। তারা হবে সুন্দর মনের মানুষ। তাদের ভালবাসা পাবে তুমি।

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি বলল তোমার সঙ্গে রাজপুত্রের মতো কোনো এক সুদর্শন তরুণের পরিচয় হবে। সেই রাজপুত্রের মতো সুদর্শন তরুণের হৃদয়ে থাকবে ভালবাসা। তার ভালবাসায় তোমার জীবন পরিপূর্ণ হবে।

পাশের মেয়েটি বলল, নায়ীরা, তোমার সঙ্গে সম্ভবত আমাদের আর যোগাযোগ হবে না। আমরা সবকিছু কল্পনা করে নেব। তোমার জীবনে আনন্দের কী ঘটছে, উত্তেজনার কী ঘটছে, ভালবাসার কী ঘটছে আমরা সেগুলো কল্পনা করে নেব।

তার পাশের মেয়েটি বলল, আমরা বিদায় কথাটি উচ্চারণ করব না। কারণ আমরা তোমাকে বিদায় দিচ্ছি না। তুমি আমাদের সঙ্গেই আছ। তুমি আমাদের মাঝখানেই আহ নায়ীরা।

সামনের মেয়েটি বলল, আমরাও তোমার মাঝেই থাকব। আমাদের সবাইকে তুমি তোমার মাঝে পাবে। সব সময় পাবে।

নায়ীরা ফিসফিস করে বলল, আমি জানি। তার চোখে পানি টলটল করছে, সে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ দুটো মুছে তিশিনার দিকে তাকাল। তিশিনা তার হাত ধরে বলল, চল, নায়ীরা।

ঘড়ঘড় শব্দ করে পেছনের দরজাটা বন্ধ হয়ে যেতেই নায়ীরা দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তিশিনা নায়ীরার পিঠে হাত রেখে বলল, মন খারাপ করো না নায়ীরা, দেখো, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

আসলে কিছুই ঠিক হবে না, কিন্তু তিশিনার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল যে সত্যিই বুঝি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। নায়ীরা কোনো কথা বলল না, হেঁটে যেতে যেতে একবার পেছন ফিরে তাকাল। গোপন ল্যাবরেটরির ভারী দরজার ওপাশে যাদের সে ফেলে এসেছে তারা ভিন্ন কোনো মানুষ নয়, তারা সবাই সে নিজে। একজন মানুষকে যখন নিজের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যেতে হয় সেই কষ্টটার কথা অন্য কেউ জানে না। পৃথিবীর অন্য কেউ কোনো দিন সেটা বুঝতেও পারবে না।

.

বিজ্ঞান কেন্দ্রের ভেতরে ক্লোন গবেষণা বিভাগের দরজায় দাঁড়িয়ে তিশিনা নায়ীরার হাত স্পর্শ করে বলল, আমাকে এখন যেতে হবে নায়ীরা।

নায়ীরা নিচু গলায় বলল, আমি জানি।

তোমার জন্য অনেক শুভকামনা থাকল।

তোমাকে ধন্যবাদ। আমাদের জন্য তুমি যেটুকু করেছ সেজন্য অনেক ধন্যবাদ।

আমি তোমাদের জন্য কিছু করি নি নায়ীরা।

নায়ীরা ম্লান হেসে বলল, করেছ, তিশিনা। আমরা আসলে মানুষ নই, আমরা মানুষের ক্লোন। কিন্তু তুমি কখনো সেটা আমাদের বুঝতে দাও নি। তুমি সব সময় আমাদের মানুষ হিসেবে সম্মান দেখিয়েছ, মানুষ হিসেবে ভালবেসেছ।

তিশিনা ফিসফিস করে বলল, তোমরা ক্লোন হও আর যা-ই হও, আসলে তো তোমরা মানুষ। একটি কথা জান নায়ীরা?

কী কথা?

যে মহিলার ক্রোমোজম ব্যবহার করে তোমাদের ক্লোন করা হয়েছে সেই মহিলাটি ছিলেন অসম্ভব রূপসী, অসম্ভব বুদ্ধিমতী এবং অসম্ভব তেজস্বী। তার ভেতরে এমন একটি সহজাত নেতৃত্ব ছিল যে, প্রয়োজনে তার চারপাশের সবাই সব সময় তার নেতৃত্ব মেনে নিত। তিনি একজন অসাধারণ মহিলা ছিলেন।

নায়ীরা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, আমি শুনেছি।

তিনি এখন কোথায় আছেন জানি না। তিনি যদি তোমাদের দেখতে পেতেন তা হলে খুব কষ্ট পেতেন। তার মতো একজনের জীবনে অনেক বড় কিছু করার কথা। ক্লোন হয়ে গবেষণা কেন্দ্রে গিনিপিগ হওয়ার কথা নয়।

নায়ীরা মাথা নেড়ে বলল, সেই অসাধারণ মহিলার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ তিশিনা। কারণ তার নিশ্চয়ই অনেক ধৈর্যও ছিল, আমাদেরও অনেক ধৈর্য। আমরা সবকিছু মেনে নিয়ে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারি।

তিশিনা খপ করে নায়ীরার হাত ধরে জ্বলজ্বলে চোখে বলল, আমি কী চাই জান?

কী?

আমি চাই তোমাকে যখন টেহলিস শহরে পাঠাবে তখন সেই অভিযানে একটা বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটুক।

নায়ীরা চোখ বড় করে বলল, সে কী!

হ্যাঁ। সেই দুর্ঘটনায় সবকিছু ওলটপালট হয়ে যাক। তখন তুমি সেখানে নেতৃত্ব দাও, নেতৃত্ব দিয়ে সবকিছু ঠিক করে দাও। বিজ্ঞান কেন্দ্রের সবাই সেটা দেখুক। দেখে হতবাক হয়ে যাক।

নায়ীরা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন ঘরের ভেতর থেকে একজন বের হয়ে এসে বলে, ক্লোন তিন শ নয়, চেকআপ করতে এস।

নায়ীরা একটা নিশ্বাস ফেলে। এখানে তার পরিচয় ক্লোন তিন শ নয় হিসেবে সে তিশিনার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, বিদায় তিশিনা।

তিশিনা ফিসফিস করে বলল, আমি তোমার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব। সব সময় প্রার্থনা করব।

নায়ীরা মাথা ঘুরিয়ে ঘরের ভেতরে তাকাল, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে বলল, আমি প্রস্তুত। কোথায় যেতে হবে?

আমার সঙ্গে এস।

তিশিনা দরজার কাছে পাড়িয়ে থেকে দেখল, নায়ীরা ধীর এবং অনিশ্চিত পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে। গোলাকার একটা দরজা নিঃশব্দে খুলে গেল, বিজ্ঞান কেন্দ্রের মানুষটির পিছু পিছু নায়ীরা এগিয়ে যায়, দরজাটি আবার বন্ধ হয়ে গেল। তিশিনা তার বুকের ভেতর আটকে থাকা নিশ্বাসটি বের করে নিচু গলায় বলল, হে ঈশ্বর, তুমি এই মেয়েটিকে দয়া করো। সে বড় দুঃখী। দোহাই তোমার।

.

স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো বড় টেবিলে নায়ীরা শুয়ে আছে, তার ওপর একজন বয়স্ক মানুষ ঝুঁকে পড়ে তাকে পরীক্ষা করছে। তার কাছাকাছি আরো দুইজন মানুষ। একজন পুরুষ, অন্যজন মহিলা। বয়স্ক মানুষটি জিব দিয়ে একটা বিস্ময়ের শব্দ করে বলল, এই মেয়েটির দেহ আশ্চর্য রকম নিখুঁত।

মহিলাটি শব্দ করে হেসে বলল, ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হলে তুমিও এরকম নিখুঁত হতে ড. ইলাক।

ড. ইলাক নামের বয়স্ক মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, সেটা তুমি ঠিকই বলেছ।

মহিলাটি বলল, আমার মাঝে মাঝে মনে হয় ক্লোন হিসেবে এরকম নিখুঁত একজন মানব কিংবা মানবী তৈরি করা এক ধরনের অপচয়।

ড. ইলাক বলল, আমরা যে কাজে একে ব্যবহার করব তার জন্য একটি নিখুঁত দেহ দরকার।

নায়ীরা নিঃশব্দে তাদের কথোপকথন শুনছিল, সে সত্যিকারের মানুষ নয়, তার হয়তো নিজে থেকে কোনো কথা বলার নয়, কিন্তু সে তবুও কথা বলল। জিজ্ঞেস করল, আমাকে তোমরা কী কাজে ব্যবহার করবে?

এক মুহূর্তের জন্য ঘরের তিন জন মানুষ একটু থমকে দাঁড়াল। মনে হল তারা একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। ড. ইলাক ইতস্তত করে বলল, তোমার এখন সেটি জানার কথা নয় মেয়ে।

আমার নাম নায়ীরা।

মহিলাটি খনখনে গলায় বলল, তোমার কোনো নামও থাকার কথা নয়।

নায়ীরা একটু চেষ্টা করে তার মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বলল, কিন্তু আমার নাম আছে। আমার মনে হয় নায়ীরা খুব সুন্দর একটি নাম।

ড. ইলাক বলল, নায়ীরা নামটি সুন্দর না অসুন্দর সেটি নিয়ে আলোচনা করার কোনো অর্থ নেই। বিষয়টি তোমাকে নিয়ে। তোমার নিজে থেকে প্রশ্ন করার কথা নয়।

ড. ইলাকের কথা শুনে নায়ীরা শব্দ করে হাসল। ড. ইলাক থতমত খেয়ে বলল, তুমি হাসছ কেন?

তোমার কথা শুনে।

আমার কোন কথাটি হাস্যকর?

নায়ীরা মুখ টিপে হেসে বলল, আমার নিজ থেকে কোনো প্রশ্ন করার কথা নয় সেটি আমার কাছে কৌতুকের মতো মনে হয়।

ড. ইলাক অবাক হয়ে বলল, কেন? কেন কথাটি তোমার কাছে কৌতুকের মতো মনে হয়? তুমি মানুষ নও, তুমি একটি ক্লোন।

কিন্তু আমি এমন একটি মানুষের ক্লোন, যার বুদ্ধিমত্তা সম্ভবত তোমাদের সবার থেকে বেশি। যার প্রতিভা নিশ্চিতভাবে তোমাদের প্রতিভার চেয়ে বেশি।

নায়ীরার কথা শুনে উপস্থিত তিন জন মানুষই কেমন যেন থতমত হয়ে যায়। মহিলাটি খনখনে গলায় বলল, তুমি কেমন করে সেটা জান?

আমি আরো অনেক কিছু জানি। হয়তো সবকিছু আমার জানার কথা নয়, তবু আমি জানি। একজন মানুষ জোর করে নির্বোধ হয়ে থাকতে পারে না।

মহিলাটি খনখনে গলায় আবার কোনো একটা কথা বলতে শুরু করতে চাইছিল কিন্তু ড. ইলাক হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, কে বেশি প্রতিভাবান, কে বেশি বুদ্ধিমতী এসব আলোচনা থাকুক। তোমাকে একটা বিশেষ কাজে আনা হয়েছে, সেই কাজের জন্য তোমাকে যেটুকু জানানোর প্রয়োজন হবে তোমাকে যেটুকু জানানো হবে মেয়ে।

আমার নাম নায়ীরা।

ড. ইলাক কোনো কথা না বলে শরীরের অভ্যন্তরে রক্তনালি ও নার্ভন্তু পরীক্ষা করার যন্ত্রটি নিয়ে নায়ীরার ওপরে ঝুঁকে পড়ল। নায়ীরা মনে মনে ফিসফিস করে নিজেকে বলতে থাকে, আমি নায়ীরা। আমি নায়ীরা, ক্লোন প্রক্রিয়ায় আমার সৃষ্টি করা হতে পারে, কিন্তু আমি মানুষ। আমি শতকরা এক শ ভাগ মানুষ। আমি মানুষ নায়ীরা।

.

নায়ীরা তার ঘরের ছোট জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। বিজ্ঞান কেন্দ্রে আসার পর যখন তার শরীরকে নানা যন্ত্রপাতি দিয়ে বিশ্লেষণ করা না হয় তখন তাকে এই ঘরটির ভেতর থাকতে হয়। ঘরটি অপূর্ব, খুব আরামে থাকার জন্য একটা ঘরে যা যা থাকা প্রয়োজন এখানে তার সবকিছু আছে, কিন্তু তবুও সে হাঁপিয়ে ওঠে। তার খুব সৌভাগ্য যে তাকে একটা ভিডিও স্ক্রিন দেওয়া হয়েছে, সেটি এখানকার মূল তথ্যকেন্দ্রের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া আছে। নায়ীরা নিশ্চিত, তথ্যকেন্দ্রের খুব ছোট এবং অপ্রয়োজনীয় একটি অংশ সে। দেখতে পায়। বিজ্ঞান কেন্দ্রের সত্যিকার তথ্য তার কাছ থেকে সযত্নে আড়াল করে রাখা হয়েছে। যেটুকু দেখতে পায় সেটুকুই সে খুব আগ্রহ নিয়ে দেখে।

দরজায় খুট করে একটি শব্দ হল, নায়ীরা ঘুরে তাকিয়ে দেখে মধ্যবয়স্ক পরিচারিকাটি তার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিতে দিতে বলল, তুমি কিন্তু ঠিক করে খাচ্ছ না।

আমি একা একা খেয়ে অভ্যস্ত নই। নায়ীরা একটু হেসে বলল, তুমি আমার সঙ্গে খাবে?

পরিচারিকাটি হাসল, বলল, উঁহু। নিয়ম নেই।

নায়ীরা মাথা নেড়ে বলল, শুধু নিয়ম আর নিয়ম। এত নিয়ম আমার ভালো লাগে না।

ভালো না লাগলেও মানতে হয়। আজকে খাওয়া শেষ কর। ফলের রসটুকুতে একটা অন্যরকম ঝুঁজ দেওয়া হয়েছে, দেখবে খুব মজার।

দেখব। নিশ্চয়ই দেখব।

খাওয়া শেষ করে প্রস্তুত থেকো। তোমার সঙ্গে আজকে দীর্ঘ সেশন হবে।

চমৎকার। নায়ীরা বলল, এই চার দেয়ালের ভেতর আমি হাঁপিয়ে উঠছি।

পরিচারিকাটি চলে যাওয়ার পর নায়ীরা আবার জানালার কাছে এগিয়ে যায়। তার এখন খেয়ে প্রস্তুত হয়ে নেওয়ার কথা। কিন্তু তার কিছু করার ইচ্ছে করছে না। ঘুরেফিরে তার শুধু তার বোনদের কথা মনে পড়ছে। এগার জন মিলে ছিল তাদের অস্তিত্ব। এখন সে একা। এই নিঃসঙ্গতাটুকু যে কী ভয়ানক সেটা কি কেউ কখনো জানতে পারবে? গভীর বিষাদে নায়ীরার বুকের ভেতরটুকু হাহাকার করতে থাকে।

.

একটি কালো গ্রানাইটের টেবিলের একপাশে নায়ীরা বসেছে, তার সামনে চার জন মানুষ। দুজন পুরুষ, দুজন মহিলা। চার জনের ভেতর শুধু ড. ইলাককে সে আগে দেখেছে, অন্যদের এই প্রথমবার দেখছে। চার জন মানুষ পুরোপুরি ভিন্ন মানুষ, কিন্তু তবু তাদের ভেতরে একটি মিল রয়েছে, মিলটি কী সে ঠিক বুঝতে পারছে না।

কঠিন চেহারার একজন মহিলা কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, ক্লোন তিন শ নয়-

নায়ীরা বাধা দিয়ে বলল, আমার নাম নায়ীরা।  

মহিলাটি কঠিন গলায় বলল, আমাকে কথা শেষ করতে দাও। কিছুক্ষণ নায়ীরার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মহিলাটি একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, তোমাকে কেন এখানে আনা হয়েছে এবং তোমাকে কী দায়িত্ব দেওয়া হবে সে বিষয়টি তোমাকে জানানোর জন্য এখানে আমরা একত্র হয়েছি। আমরা চার জন ভিন্ন ভিন্ন দপ্তরের। আমি বিজ্ঞান কেন্দ্রের প্রধান রুবা। এ ছাড়াও এখানে আছেন সামরিক বাহিনীর কমান্ডার গ্রুশান এবং নিরাপত্তা বাহিনীর মহাপরিচালক জিনা। চিকিৎসা কেন্দ্রের ড. ইলাককে তুমি আগেই দেখেছ। যাই হোক, তুমি নিশ্চয়ই টেহলিস শহঁরের নাম শুনেছ। টেহলিস শহর আমাদের সভ্যতার কেন্দ্রভূমি। আমাদের শিল্প সাহিত্য বিজ্ঞান বা গবেষণা সব টেলিস শহরকেন্দ্রিক। টেলিস শহর এখান থেকে মাত্র দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে। কিন্তু তবু সেটি আমাদের থেকে অনেক দূরে। কারণ টেহলিস শহর আর আমাদের মাঝখানে রয়েছে অবমানবের বসতি।

বিজ্ঞান কেন্দ্রের প্রধান কঠিন চেহারার মহিলা রুবা একটি লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বলল, তুমি নিশ্চয়ই অবমানবের নাম শুনেছ। তারা একসময় চেষ্টা করেছিল পরামানব হতে। মানুষের বিবর্তনকে দ্রুততর করে তারা এমন কিছু ক্ষমতা অর্জন গ্রতে চেয়েছিল, যেটি প্রকৃতি তাদের দিতে রাজি হয় নি। ভয়ংকর সেই পরীক্ষার ফল তারা দিয়েছে নিজেদের পুরো জীবন দিয়ে। তারা বিকলাঙ্গ, অপুষ্ট, অপরিণতবুদ্ধির জটিল একটা প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। তারা অতিমানব বা পরামানব হয় নি। তারা হয়েছে অবমানব। অবমানবের বিভিন্ন রূপ সম্ভবত তোমার একবার দেখা উচিত।

নায়ীরা বলল, আমি দেখেছি।

রুবা একটু অবাক হয়ে বলল, তুমি কোথায় দেখেছ?

আমার ঘরে একটা ভিডিও স্ক্রিন আছে। সেটা মূল তথ্যকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত। আমি সেখানে দেখেছি।

হাসিখুশি চেহারার একজন মানুষ, যে সম্ভবত সামরিক বাহিনীর কমান্ডার গ্রুশান, হালকা গলায় বলল, চমৎকার। তা হলে আমাদের কাজ অনেক সহজ হয়ে গেল। তুমি নিশ্চয়ই অবমানবের সঙ্গে আমাদের বিরোধের বিষয়টি জান।

হ্যাঁ জানি।

একজন মানুষ যত বড় হয় তত বেশি সে উদারতা দেখাতে পারে। অবমান বড় হতে পারে নি। তাদের ভেতরে উদারতা বা ভালবাসার মতো বড় কোনো গুণ নেই। তাদের সমস্ত শক্তি সমস্ত ক্ষমতা একত্র করেছে আমাদের ধ্বংস করার জন্য। কমান্ডার শান নামের হাসিখুশি মানুষটিকে হঠাৎ কেমন যেন বিষণ্ণ দেখায়, অবমানবরা আমাদের সমান নয়। কোনো দিক দিয়েই আমাদের সমান নয়, কিন্তু তারপরও আমাদের সব সময় সতর্ক থাকতে হয়। আমাদের সীমান্তে সব সময় সশস্ত্র সেনাবাহিনী। আমাদের অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হয় এবং সবচেয়ে দুঃখের কথা, আমরা আমাদের প্রিয় শহর টেলিসে যেতে পারি না। অবমানব আমাদের যেতে দেয় না। যদি কখনো যেতে হয় আমাদের আমরা যাই ভয়ংকর ঝুঁকি নিয়ে।

নায়ীরা একটু সামনে ঝুঁকে পড়ে বলল, আমাকে সেজন্য টেহলিস শহরে পাঠাতে চাইছ? একজন মূল্যবান মানুষের জীবনের ঝুঁকি না নিয়ে মূল্যহীন একজন ক্লোনের জীবনের ঝুঁকি নেওয়া?

দ্বিতীয় মহিলাটি যে সম্ভবত নিরাপত্তা বাহিনীর মহাপরিচালক জিনা স্থির চোখে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি ইচ্ছে করলে ব্যাপারটাকে এভাবেও দেখতে পার।

নায়ীরা জিজ্ঞেস করল, টেহলিস শহরে আমাকে কী নিয়ে যেতে হবে?

জিনা বলল, একটি অত্যন্ত গোপনীয় তথ্য।

সেটি আমি কীভাবে নেব?

তোমার মস্তিষ্কে করে।

নায়ীরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল আমার মস্তিষ্কে করে?

হ্যাঁ। আমরা তোমার মস্তিষ্কে সেটা প্রবেশ করিয়ে দেব। তুমি সেটা জানবে না।

নায়ীরা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। ড. ইলাক মুখে হাসি টেনে বলল, আমরা তোমার দেহ খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেছি। তোমার দেহ নিখুঁত, নীরোগ এবং সুস্থ। তোমার মস্তিষ্ক এই তথ্য নেওয়ার জন্য প্রস্তুত। তুমি তোমার মস্তিষ্কে করে এই তথ্য নিয়ে সুদীর্ঘ যাত্রা শেষ করতে পারবে বলে আমার ধারণা।

নায়ীরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমাকে কি একা টেহলিস শহরে যেতে হবে?

কঠিন চেহারার ক্রানা শব্দ করে হেসে ফেলল এবং হাসির কারণে হঠাৎ করে তার মুখের কাঠিন্য সরে যায়। সে হাসি হাসি মুখে বলে, না। তোমার পক্ষে একা যাওয়া সম্ভব। হবে না। একজন গাইড তোমাকে নিয়ে যাবে।

এই গাইড মানুষটিও কি আমার মতো ক্লোন?

রুবার মুখ থেকে হাসি হঠাৎ সরে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে আগের কাঠিন্যটুকু ফিরে আসে। সে কঠিন মুখে বলে, আমরা তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই। এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে যোগ করে, তোমার কি অন্য কোনো প্রশ্ন আছে?

নায়ীরা মাথা নাড়ল, আছে।

কী প্রশ্ন?

আমি সেই প্রশ্নটি করতে চাইছি না।

কেন?

আমার ধারণা, তোমরা সেই প্রশ্নেরও উত্তর দেবে না।

মহিলাটি কঠিন মুখে বলল, তুমি জিজ্ঞেস করে দেখ।

নায়ীরা একটু হেসে বলল, তোমরা কেন আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলছ?

কয়েক মুহূর্ত ঘরের সবাই চুপ করে থাকে। কঠিন চেহারার রুবা সোজা হয়ে বসে কঠিন গলায় বলল, আমরা তোমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলছি না, মেয়ে।

নায়ীরাও সোজা হয়ে বসে বলল, আমার নাম নায়ীরা।

.

ড. ইলাক নায়ীরার মাথায় গোলাকার একটা হেলমেট বসিয়ে বলল, এটার নাম নিওরোজিনা। এটা তোমার মস্তিষ্কের নিউরনে সিনান্স কানেকশন তৈরি করবে। আমরা যেটাকে স্মৃতি বলি, তোমার মধ্যে সেরকম স্মৃতি তৈরি হবে।

নায়ীরা কোনো কথা না বলে ড. ইলাকের দিকে তাকিয়ে রইল। ড. ইলাক নিওরোজিনা নামের যন্ত্রটির সঙ্গে কয়েকটা তার জুড়ে দিতে দিতে বলল, সাধারণ স্মৃতির সঙ্গে এর একটা পার্থক্য আছে।

কথা শেষ করে ড. ইলাক নায়ীরার দিকে তাকাল। সে আশা করছে নায়ীরা পার্থক্যটুকু জানতে চাইলে সে উত্তর দেবে। নায়ীরা জানতে চাইল না। তার যে জানার কৌতূহল হচ্ছে না তা নয়। কিন্তু সে ঠিক করেছে, নিজে থেকে কোনো প্রশ্ন করবে না।

ড. ইলাক কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, সাধারণ স্মৃতি আমাদের মনে থাকে। কিন্তু এই স্মৃতি নিওরোজিনা দিয়ে তৈরি কৃত্রিম স্মৃতি, এই স্মৃতি কারো মনে থাকে না।

মুখটা ভাবলেশহীন করে রাখবে ঠিক করার পরও নায়ীরা খুক করে হেসে ফেলল। ড. ইলাক বলল, কী হল, হাসছ কেন?

তোমার কথা শুনে। মানুষ যদি একটা জিনিস মনে রাখতে না পারে তা হলে সেটা আবার স্মৃতি হয় কেমন করে?

ড. ইলাক মুখে একটা আলগা গাম্ভীর্য এনে বলল, এটাই হচ্ছে নিওরোজিনার বিশেষত্ব। পুরো স্মৃতিটা থাকে অবচেতন মনে। আরেকটি নিওরোজিনা দিয়ে এই স্মৃতিটা বের করে নিয়ে আসা যায়।

প্রশ্ন করার জন্য ভেতরে ভেতরে উসখুস করতে থাকলেও নায়ীরা চুপ করে রইল। পুরো ব্যাপারটিতে নায়ীরার উৎসাহের অভাব দেখে ড. ইলাকও মনে হয় একটু উৎসাহহীন হয়ে পড়ল। একটু দায়সারাভাবে বলল, আমরা এখানে তোমার মস্তিষ্কে একটা গোপন তথ্য দিয়ে দেব, টেহলিস শহরে সেই তথ্যটি বের করে আনা হবে।

নায়ীরা শান্তভাবে ড. ইলাকের দিকে তাকিয়ে রইল। ড. ইলাক একটু ইতস্তত করে বলল, তথ্যটি হবে অত্যন্ত গোপন। অত্যন্ত গোপন এবং গুরুত্বপূর্ণ। এত বড় একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে তোমাকে ব্যবহার করা হচ্ছে সেটা তোমার জন্য খুব সৌভাগ্যের ব্যাপার।

একেবারে ভাবলেশহীনভাবে চুপচাপ বসে থাকবে ঠিক করে রাখার পরেও নায়ীরা আবার খুকখুক করে হেসে ফেলল। ড. ইলাক একটু অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, তুমি আবার হাসছ। কেন?

তুমি গুছিয়ে মিথ্যা কথা বলতে পার না।

আমি মিথ্যা কথা বলছি না।

তুমি যদি আসলেই সত্য কথা বলছ, তা হলে বুঝতে হবে মানবসভ্যতার উন্নতি না হয়ে তার বড় ধরনের অবনতি হয়েছে। আমি যতদূর জানি, প্রায় শখানেক বছর আগেই গোপনীয় খবর নিখুঁতভাবে পাঠানোর পদ্ধতি আবিষ্কার করা হয়েছে। এই যুগে কেউ যদি কারো মস্তিষ্কে করে অবচেতনভাবে খবর পাঠায়, তা হলে বুঝতে হবে বিজ্ঞান সম্পর্কে তারা বিশেষ কিছু জানে না।

ড. ইলাক শীতল চোখে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, বয়সের তুলনায় তোমার কথাবার্তা বেশ অমার্জিত এবং উদ্ধত।

নায়ীরা বলল, আমি দুঃখিত, ড. ইলাক। আমি একটি ক্লোন। নিজের অন্যান্য ক্লোন ছাড়া আর কাউকে দেখি নি, আর কারো সঙ্গে কথাবার্তা বলি নি। সুন্দর করে, ভদ্রভাবে, মার্জিতভাবে কীভাবে কথা বলতে হয় আমি সেটা কখনো শিখি নি। যখন মনে যেটা আসে সেটাই বলে ফেলি।

সেটাই দেখছি। কিন্তু মেয়ে, তোমাকে বলে রাখি, যখন মনে যেটা আসে সেটা বলার জন্য তুমি বিপদে পড়বে।

ড. ইলাকের কথা শুনে নায়ীরা আবার শব্দ করে হেসে ফেলল। ড. ইলাক ক্রুদ্ধ চোখে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আবার কেন হাসছ?

তোমরা সবাই মিলে নিশ্চয়ই আমাকে মেরে ফেলবে। আমাকে সরাসরি সেটা বলতে পারছ না তাই নিওরোজিনা, অবচেতন স্মৃতি এসব কঠিন কঠিন কথাবার্তা বলছ! তা হলে তুমিই বলো, সত্যিকার বিপদে পড়ার সুযোগটি আমি কখন পাব?

ড. ইলাক নায়ীরার কথার কোনো উত্তর দিল না, নায়ীরাও কোনো কথা না বলে চুপচাপ শুয়ে রইল। হঠাৎ করে সে মাথায় একটা মৃদু কম্পন অনুভব করতে থাকে। তার মনে হতে থাকে বহুদূর থেকে একটা ঘণ্টার শব্দ ভেসে আসছে। শব্দটি মধুর এবং বিষণ্ণ। তার বুকের ভেতর কেমন এক ধরনের নিঃসঙ্গতার জন্ম দেয়। শব্দটি শুনতে শুনতে তার চোখে ঘুম নেমে আসতে থাকে। কী কারণ জানা নেই, নায়ীরার মনে হতে থাকে ঘুম থেকে জেগে। ওঠার পর তার জীবনটি হবে সম্পূর্ণ অন্যরকম।

.

নায়ীরার যখন ঘুম ভাঙল তখন সে খুব ক্লান্ত। শুনতে পেল কেউ একজন বলল, চোখ খুলে তাকাও মেয়ে।

নায়ীরার মুখের ওপর একজন নার্স ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার এখন কেমন লাগছে?

নার্সটির মুখে একটা মাস্ক লাগানো, সেই মাস্কটির দিকে তাকিয়ে থেকে নারীরা জিজ্ঞেস করল, তুমি মুখে মাস্ক পরে আছ কেন? আমার কি কোনো অসুখ হয়েছে? আমার শরীরে কি কোনো সংক্রামক জীবাণু আছে?

নার্সটি কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল, ইতস্তত করে বলল, আমরা যখনই কাউকে দেখতে আসি মুখে মাস্ক পরে থাকি। এটা আমাদের অভ্যাস।

কথাটি সত্যি নয়, কিন্তু নায়ীরা সেটা নিয়ে কথা বলার উৎসাহ খুঁজে পেল না। নার্সটি তার মুখ থেকে মাস্কটি না খুলেই আবার জিজ্ঞেস করল, তোমার এখন কেমন লাগছে?

নায়ীরা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমার খুব দুর্বল লাগছে।

নার্সটি বলল, সেটাই স্বাভাবিক।

নায়ীরার জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে হল, মস্তিষ্কে স্মৃতি জন্ম দেওয়া হলে শরীর কেন দুর্বল হবে? শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন না করেই সে চোখ বুজে শুয়ে রইল। নার্সটি বলল, আমি তোমার শরীরে একটা বলকারক ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমি শক্তি খুঁজে পাবে।

নার্সটি নায়ীরার ডান হাতের শিরায় একটি সুচ ঢুকিয়ে একটা বলকারক তরলের প্যাকেট ঝুলিয়ে দেয়। ফোঁটা ফোঁটা করে সেটা তার শরীরে প্রবেশ করতে থাকে এবং খুব ধীরে ধীরে এক ধরনের কোমল আরামের অনুভূতি নায়ীরার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

নায়ীরা নিঃশব্দে তার বিছানায় শুয়ে রইল। তাকে ঘিরে লোকজন যাচ্ছে, আসছে, কথা বলছে, যন্ত্রপাতি দিয়ে তাকে পরীক্ষা করছে, কিন্তু কোনো কিছু নিয়েই সে কৌতূহলী হতে পারছে না। কেউ একজন তার হাত স্পর্শ করে তাকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করল, চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে ড. ইলাক। নায়ীরা স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। ড. ইলাক বলল, তোমার এখন কেমন লাগছে মেয়ে?

আমার একটু দুর্বল লাগছে।

সেটা খুবই স্বাভাবিক।

তোমরা কি আমার অবচেতন মনে তথ্যটি প্রবেশ করাতে পেরেছ?

ড. ইলাককে মুহূর্তের জন্য একটু বিব্রত দেখায়, কিন্তু সে দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলে হ্যাঁ, পেরেছি।

আমি কি কোনোভাবে সেই তথ্যটি সচেতনভাবে জানতে পারব?

ড. ইলাক জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, না, পারবে না। কিছুতেই পারবে না।

ড. ইলাক, আমি যতটুকু জানি যে মানুষের মস্তিষ্ক অত্যন্ত রহস্যময়, বিজ্ঞানীরা কখনো সেটা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি। এমন কি হতে পারে না হঠাৎ করে আমি সেটা জেনে গেলাম। স্বপ্নের ভেতরে কিংবা কোনোভাবে সম্মোহিত হয়ে?

ড. ইলাক জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, না, এটা হতে পারে না। নিওরোজিনা দিয়ে তোমার মাথায় তথ্যটি ঢোকানো হয়েছে। শুধু আরেকটি নিওরোজিনা দিয়েই সেই তথ্য বের করা সম্ভব। অন্য কোনোভাবে সম্ভব নয়।

নায়ীরা কিছুক্ষণ ড. ইলাকের চোখের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে একটু হেসে আবার চোখ বন্ধ করল। একজন মানুষ যখন মিথ্যে কথা বলে নায়ীরা সেটা বুঝতে পারে। এটি কি তার বিশেষ একটি ক্ষমতা, নাকি সবার জন্যই এটি সত্যি-সে জানে না। জীবনের পুরোটাই সে তার অন্য ক্লোনদের সঙ্গে কাটিয়েছে। মাত্র গত কয়েক দিন হল সে প্রথমবার অপরিচিত মানুষদের দেখছে, তাদের সঙ্গে কথা বলছে। এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে সে আবিষ্কার করছে যে, অনেকেই তাকে সত্যি কথা বলছে না। হতে পারে সত্যি কথাটি তার জন্য ভালো নয়, কিন্তু সে তো সত্যিকারের মানুষ নয়, সে একটি তুচ্ছ ক্লোন। তার ভালো মন্দে পৃথিবীর কী আসে যায়? ল্যাবরেটরিতে একটা গিনিপিগকে নিয়ে ভয়ংকর একটা এক্সপেরিমেন্ট করার সময় বিজ্ঞানীরা একটুও ইতস্তত করে না, তার বেলায় কেন করবে? এই প্রশ্নের উত্তরটি কি সে খুঁজে পাবে?

চব্বিশ ঘণ্টার ভেতরই নায়ীরা তার শক্তি ফিরে পেল। কতটুকু তার নিজের আর কতটুকু নানা ধরনের ওষুধপত্রের ফল, সেটা সে জানে না। সেটা নিয়ে সে মাথাও ঘামাচ্ছে। তাকে টেলিস শহরে একটি দুর্গম অভিযানে পাঠানো হবে। কত তাড়াতাড়ি সেই অভিযানটুকু শুরু করতে পারবে সেটাই এখন তার একমাত্র ধ্যানধারণা। চার দেয়ালে ঘেরা এই বিজ্ঞান কেন্দ্র, বিজ্ঞান কেন্দ্রের কিছু মিথ্যেবাদী মানুষকে তার আর ভালো লাগছে না। তার সঙ্গে একজন গাইড থাকবে। সেই গাইডটি কেমন মানুষ হবে? দীর্ঘ সময় সেই মানুষটির সঙ্গে সে থাকবে, এই মানুষটি যদি একজন খাঁটি মানুষ না হয় তা হলে সেটা কি খুব দুঃখের একটি ব্যাপার হবে না?

টেহলিস শহরে অভিযানের জন্য তাকে নিশ্চয়ই প্রস্তুত করা হবে। নায়ীরা খানিকটা আগ্রহ নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু সেরকম কিছু হল না। যে মহিলাটিকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তার নাম জানা। ক্ৰানা মধ্যবয়স্ক হাসিখুশি মহিলা। নায়ীরার সঙ্গে তার আলাপ-আলোচনা পুরোটাই হল অবমান নিয়ে। বারবার নায়ীরাকে মনে করিয়ে দিল, অবমানব কিন্তু মানুষ নয়। তারা মানুষ থেকে গড়ে ওঠা একটি ভয়ংকর প্রাণী। তাদের ভেতরে স্নেহ-মমতা নেই, ভালবাসা নেই।

নায়ীরা একটু আপত্তি করে বলল, কিন্তু তাদের নিজেদের জন্যও কি স্নেহ-মমতা নেই? একটা পশুও তো তার সন্তানকে বুক আগলে লালন করে?

ক্ৰানা মাথা নেড়ে বলল, সেটা ছিল প্রকৃতির নিয়ম। অবমানবরা প্রকৃতিকে অস্বীকার করেছে। তারা নিজেদের মধ্যে বিবর্তন ঘটিয়েছে, সেই বিবর্তনটি তাদের ভয়ংকর একটা। প্রাণী করে তুলেছে।

কী রকম ভয়ংকর?

তারা দেখতেও ভয়ংকর। আমি শুনেছি, একটা বিশেষ প্রজাতির দেহ থেকে দুটি মাথা গড়ে উঠেছে।

নায়ীরা শিউরে উঠে জিজ্ঞেস করল, দুটি মাথা?

হ্যাঁ। হাতকে আরো কার্যক্ষম করার জন্য সেখানে পাঁচটির বদলে সাতটি করে আঙুল। অনেকের তৃতীয় একটি চোখ রয়েছে।

তৃতীয় চোখ? নায়ীরা অবাক হয়ে বলল, সেটি কোথায়?

কপালের ওপরে। তৃতীয় চোখটি আমাদের চোখের মতো নয়, সেটি সব সময় খোলা থাকে। সেই চোখের পাতি পড়ে না।

নায়ীরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কী ভয়ংকর!

হ্যাঁ। শারীরিকভাবে ভয়ংকর, কিন্তু সেটা সত্যিকারের ভয় নয়। তারা ভয়ংকর, কারণ তাদের চিন্তাভাবনা ভয়ংকর। মস্তিষ্ককে তারা অন্যভাবে ব্যবহার করতে শিখেছে। কৃত্রিমভাবে নিউরনের সংখ্যা বাড়িয়ে নিয়েছে। তাদের ভেতরে নতুন নতুন অনুভূতির জন্ম নিয়েছে।

নতুন অনুভূতি?

হ্যাঁ, নতুন অনুভূতি, যার কথা আমরা জানি না।

নায়ীরা একটু চিন্তা করে বলল, সেই অনুভূতিগুলো কী ধরনের?

ক্ৰানা গম্ভীর মুখে বলল, আমার মনে হয় না কোনোদিন সেগুলোর কথা আমরা জানতে পারব। যেমন ধর, কষ্ট করে আনন্দ পাওয়া কিংবা যন্ত্রণার ভেতরে সুখের অনুভূতি।

অবমানবদের এ ধরনের অনুভূতি আছে?

হ্যাঁ, আছে। তারা মাঝে মাঝে দল বেঁধে নিজেদের যন্ত্রণা দেয়। তাদের বিকৃত এক ধরনের মানসিকতা রয়েছে।

নায়ীরা অবাক হয়ে বলল, কী আশ্চর্য!

অবমানব সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি নায়ীরাকে সাধারণ কিছু বিষয়ে শিখিয়ে-পড়িয়ে নেওয়া হল–দৈনন্দিন অসুখবিসুখ হলে কী করতে হবে, কী ওষুধপত্র খেতে হবে এই ধরনের গুরুত্বহীন বিষয়। খুব ঠাণ্ডা বা খুব গরম অবস্থায় পড়ে গেলে নিজেকে রক্ষা করার জন্য নায়ীরাকে কিছু বিশেষ পোশাক দেওয়া হল। নারীরা সবচেয়ে আনন্দ পেল এক জোড়া নাইট ভিশন গগলস দেখে, এটি চোখে দিলে অন্ধকারে পরিষ্কার দেখা যায়। সে ভেবেছিল, তাকে হয়তো আত্মরক্ষার জন্য কোনো একটি অস্ত্রচালনা শেখাবে, কিন্তু বিজ্ঞান কেন্দ্রের সেরকম কোনো পরিকল্পনা আছে বলে মনে হল না।

রাতে ঘুমানোর সময় নায়ীরা নিজের হাতের ওপর হাত বোলাতে গিয়ে হঠাৎ বাম হাতে একটু সুচ ফোঁটানোর মতো ব্যথা অনুভব করে। তার ডান হাতে বলকারক ওষুধের সিরিঞ্জ লাগানো হয়েছিল কিন্তু বাম হাতে কিছু করা হয় নি। বাম হাতে ছোট লাল বিন্দুটির দিকে তাকিয়ে থেকে নায়ীরা ছোট একটা নিশ্বাস ফেলে। নিওরোজিনা দিয়ে যখন তাকে অচেতন করে রেখেছিল তখন এই ছোট লাল বিন্দুটি দিয়ে তার শরীরে কোনো কিছু ঢোকানো হয়েছে। কী হতে পারে সেটি?

তার কাছে সেটি গোপন করে রাখা হচ্ছে কেন?