‘স্যাগিন ইভনিং নিউজ’, ২২ মার্চ, ১৮৯৪
গতকল্য সন্ধ্যায় সঙ্গীত একাডেমীতে বহু-আলোচিত হিন্দুসন্ন্যাসী স্বামী বিবে কানন্দ ‘ধর্মের সমন্বয়’ সম্বন্ধে বক্তৃতা দেন। শ্রোতার সংখ্যা বেশী না হইলেও প্রত্যেকেই প্রখর মনোযোগ সহকারে তাঁহার আলোচনা শুনিয়াছেন। বক্তা প্রাচ্য পোষাক পরিয়া আসিয়াছিলেন এবং অত্যন্ত সমাদরে অভ্যর্থিত হন। মাননীয় রোল্যাণ্ড কোনর অমায়িকভাবে বক্তার পরিচয় করাইয়া দেন। ভাষণের প্রথমাংশ বক্তা নিয়োগ করেন ভারতের বিভিন্ন ধর্ম এবং জন্মান্তরবাদের ব্যাখ্যানে। ভারতে ভূমির প্রথম বিজেতা আর্যগণ—খ্রীষ্টানরা যেমন নূতন দেশজয়ের পর করিয়া থাকে, সেইরূপ দেশের তৎকালীন অধিবাসীদিগকে নিশ্চিহ্ন করিবার চেষ্টা করেন নাই। তাঁহারা উদ্যোগী হইয়াছিলেন অমার্জিত সংস্কারের লোকগণকে সুসংস্কৃত করিতে। যে-সব স্বদেশবাসী স্নান করে না বা মৃত জন্তু ভক্ষণ করে, হিন্দুরা তাহাদের উপর বিরক্ত। উত্তর ভারতের অধিবাসী আর্যেরা দক্ষিণাঞ্চলের অনার্যগণের উপর নিজেদের আচার ব্যবহার জোর করিয়া চাপাইবার চেষ্টা করেন নাই, তবে অনার্যেরা আর্যদের অনেক রীতিনীতি ধীরে ধীরে নিজেরাই গ্রহণ করে। ভারতের দক্ষিণতম প্রদেশে বহু শতাব্দী হইতে কিছু কিছু খ্রীষ্টান আছে। স্পেনিয়ার্ডরা সিংহলে খ্রীষ্টধর্ম লইয়া যায়। তাহারা মনে করিত যে, অখ্রীষ্টানদিগকে বধ করিয়া তাহাদের মন্দিরসমূহ ধ্বংস করিবার জন্য তাহারা ঈশ্বর কর্তৃক আদিষ্ট।
বিভিন্ন ধর্ম যদি না থাকিত, তাহা হইলে একটি ধর্মও বাঁচিয়া থাকিতে পারিত না। খ্রীষ্টানদের নিজস্ব ধর্ম চাই। হিন্দুদেরও প্রয়োজন স্বকীয় ধর্মবিশ্বাস বজায় রাখা। যে-সব ধর্মের মূলে কোন শাস্ত্রগ্রন্থ আছে, তাহারা এখনও টিকিয়া আছে। খ্রীষ্টানরা য়াহুদীগণকে খ্রীষ্টধর্মে আনিতে পারে নাই কেন? পারসীকদেরও খ্রীষ্টান করিতে পারে নাই কি কারণে? মুসলমানরাও খ্রীষ্টান হয় না কেন? চীন এবং জাপানে খ্রীষ্টধর্মের প্রভাব নাই কেন? বৌদ্ধধর্ম—যাহাকে প্রথম প্রচারশীল ধর্ম বলিতে পারা যায়—কখনও তরবারির সাহায্যে অপরকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করে নাই, তবুও ইহা খ্রীষ্টধর্ম অপেক্ষা দ্বিগুণ লোককে স্বমতে আনিয়াছে। মুসলমানেরা সর্বাপেক্ষা বেশী বল প্রয়োগ করিলেও তিনটি বড় প্রচারশীল ধর্মের মধ্যে তাহাদের সংখ্যাই সর্বাপেক্ষা কম। মুসলমানদের বিজয়ের দিন শেষ হইয়া গিয়াছে। খ্রীষ্টধর্মাবলম্বী জাতিরা রক্তপাত করিয়া ভূমি দখল করিতেছে, এই খবর আমরা প্রত্যহই পড়ি। কোন্ প্রচারক ইহার প্রতিবাদ করিতেছেন? অত্যন্ত রক্তপিপাসু জাতিরা যে ধর্ম লইয়া এত জয়গান করে, তাহা তো খ্রীষ্টের ধর্ম নয়। য়াহুদী ও আরবগণ খ্রীষ্টধর্মের জনক, কিন্তু ইহারা খ্রীষ্টানদের দ্বারা কতই না নির্যাতিত হইয়াছে। ভারতবর্ষে খ্রীষ্টধর্মের প্রচারকগণকে বেশ যাচাই করিয়া দেখা হইয়াছে, খ্রীষ্টের আদর্শ হইতে তাঁহারা অনেক দূরে।
বক্তা বলেন, তিনি রূঢ় হইতে চান না, তবে অপরের চোখে খ্রীষ্টানদের কিরূপ দেখায়, তাহাই তিনি উল্লেখ করিতেছেন; যে-সব মিশনরী নরকের জ্বলন্ত গহ্বরের কথা প্রচার করেন, তাঁহাদিগকে লোকে সন্ত্রাসের সহিত দেখিয়া থাকে। মুসলমানরা ভারতে তরবারি-ঝনৎকারে আক্রমণের উপর আক্রমণ-প্রবাহ চালাইয়া আসিয়াছে। কিন্তু আজ তাহারা কোথায়? সব ধর্মই চূড়ান্ত দৃষ্টিতে যাহা দেখিতে পায়, তাহা হইল একটি চৈতন্যসত্তা। কোন ধর্মই ইহার পর আর কিছু শিক্ষা দিতে পারে না। প্রত্যেক ধর্মেই একটি মুখ্য সত্য আছে, আর কতকগুলি গৌণ ভাব উহাকে আচ্ছাদন করিয়া থাকে। যেন একটি মণি—একটি পেটিকার মধ্যে রাখা আছে। মুখ্য সত্যটি হইল মণি, গৌণ ভাবগুলি পেটিকা স্বরূপ। য়াহুদীর শাস্ত্রকে মানিলাম বা হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থকে—ইহা গৌণ ব্যাপার।
পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটিলে ধর্মের মূল সত্যের আধারটিও বদলায়, কিন্তু মূল সত্যটি অপরিবর্তিত রহিয়া যায়। প্রত্যেক ধর্মসম্প্রদায়ের যাঁহারা শিক্ষিত ব্যক্তি, তাঁহারা ধর্মের মূল সত্যকে ধরিয়া থাকেন। শুক্তির বাহিরের খোলাটি দেখিতে সুন্দর নয়, তবে ঐ খোলার ভিতর তো মুক্তা রহিয়াছে। পৃথিবীর সমুদয় জনসংখ্যার একটি অল্প অংশ মাত্র খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করিবার আগেই ঐ ধর্ম বহু মতবাদে বিভক্ত হইয়া পড়িবে। এইরূপই প্রকৃতির নিয়ম। পৃথিবীর নানা ধর্ম লইয়া যে একটি মহান্ ঐকতান বাদ্য চলিতেছে, উহার মধ্যে শুধু একটি যন্ত্রকে স্বীকার করিতে চাও কেন? সমগ্র বাদ্যটিকেই চলিতে দাও। বক্তা বিশেষ জোড় দিয়া বলেন পবিত্র হও, কুসংস্কার ছাড়িয়া দিয়া প্রকৃতির আশ্চর্য সমন্বয় দেখিবার চেষ্টা কর। কুসংস্কারই ধর্মকে ছাপাইয়া গোল বাধায়। সব ধর্মই ভাল, কেননা মূল সত্য সর্বত্রই এক। প্রত্যেক মানুষ তাহার ব্যক্তিত্বের পূর্ণ ব্যবহার করুক, কিন্তু ইহাও মনে রাখিতে হইবে যে, সকল পৃথক্ ব্যক্তিকে লইয়া একটি সুসমঞ্জস সমষ্টি গঠিত হয়। এই আশ্চর্য সামঞ্জস্যের অবস্থা ইতঃপূর্বেই রহিয়াছে। প্রত্যেকটি ধর্মমত সম্পূর্ণ ধর্মসৌধটির গঠনে কিছু না কিছু যোগ করিয়াছে।
বক্তা তাঁহার ভাষণে বরাবর তাঁহার স্বদেশের ধর্মসমূহকে সমর্থন করিয়া যান। তিনি বলেন, রোম্যান ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের যাবতীয় রীতিনীতি যে বৌদ্ধদের গ্রন্থ হইতে গৃহীত, ইহা প্রমাণিত হইয়াছে। নৈতিকতার উচ্চমান এবং পবিত্র জীবনের যে আদর্শ বুদ্ধের উপদেশ হইতে পাওয়া যায়, বক্তা কিছুক্ষণ তাহার বর্ণনা করেন; তবে তিনি বলেন যে, ব্যক্তি-ঈশ্বরে বিশ্বাস-সম্পর্কে বৌদ্ধধর্মে অজ্ঞেয়বাদই প্রবল। বুদ্ধের শিক্ষার প্রধান কথা হইল—‘সৎ হও, নীতিপরায়ণ হও, পূর্ণতা লাভ কর।’