১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দে অগষ্ট মাসের শেষের দিকে বিবেকানন্দ অধ্যাপক জে. এইচ রাইটের এনিস্কোয়াম গ্রামের বাড়ীতে ছিলেন। নিউ ইংলণ্ডের একটি ছোট্ট শান্ত পল্লীতে স্বামীজীর আবির্ভাব এমন এক বিস্ময় সৃষ্টি করেছিল যে, তিনি এখানে আসামাত্র এই অপরূপ সুন্দর বিরাট-ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষটি কোথা থেকে এসেছেন, তাই নিয়ে পল্লীবাসীদের মধ্যে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে যায়। প্রথমে তাঁরা এই সিদ্ধান্ত করলেন যে, তিনি একজন ভারতীয় ব্রাহ্মণ। কিন্তু ভারতীয় ব্রাহ্মণ সম্পর্কে তাঁদের ধারণার সঙ্গে স্বামীজীর আচার-ব্যবহার কিছুই মিলল না। তখন তাঁকে সঠিক জানবার জন্য এবং তাঁর কথা শোনবার জন্য একদিন রাত্রির আহারের পর সকলে আধ্যাপক রাইটের বাড়ীতে এসে হাজির হলেন। বৈঠকখানায় কথোপকথনরত স্বামীজী তখন মধুর স্বরে বলছিলেনঃ
‘এই সেদিন—মাত্র কয়েকদিন আগেও—চার-শ বছরেরও বেশী হবে না—হঠাৎ তাঁর কণ্ঠস্বর বদলে গেল, তিনি বলতে লাগলেনঃ দুর্গত জাতির উপর তারা কি নিষ্ঠুর ব্যবহার ও অত্যাচারই না করেছে। কিন্তু ঈশ্বরের বিচার তাদের ওপর নিশ্চয়ই একদিন নেমে আসবে। ইংরেজ! মাত্র অল্পকাল আগেও এরা ছিল অসভ্য। এদের গায়ে পোকা কিলবিল করত, আর তারা তাদের গায়ের দুর্গন্ধ ঢেকে রাখত নানা সুগন্ধ দিয়ে। … কি ভয়ঙ্কর অবস্থা! সবেমাত্র বর্বরতার অবস্থা পেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
যাদের সমালোচনা তিনি করছিলেন, তাদের মধ্যে একজন শ্রোতা বলে উঠলেন, ‘এটা একেবারে বাজে কথা। এটা অন্ততঃ পাঁচ-শ বছর আগেকার ব্যাপার।’
আমি কি বলিনি, ‘এই কিছুদিন আগেও? মানুষের আত্মার অনন্তত্বের পরিমাপে কয়েক-শ বছর আর কতটুকু?’ তারপর গলার স্বর পরিবর্তন করে সম্পূর্ণ শান্ত ও যুক্তিপূর্ণ সুরে বললেনঃ তারা একেবারে অসভ্য। উত্তরাঞ্চলের প্রচণ্ড শীত, অভাব অনটন এদের বন্য করে তুলেছে। এরা কেবল পরকে হত্যা করার কথাই ভাবে। … কোথায় তাদের ধর্ম? মুখে তারা পবিত্র ঈশ্বরের নাম নেয়, প্রতিবেশীকে তারা ভালবাসে বলে দাবী করে, খ্রীষ্টের নামে তারা পরকে সভ্য করার কথা বলে। কিন্তু এ-সবই মিথ্যা। ঈশ্বর নয়—ক্ষুধাই এদের সভ্য করে তুলেছে। মানুষের প্রতি ভালবাসার কথা কেবল তাদের মুখে, অন্তরে পাপ আর সর্ব প্রকার হিংসা ছাড়া আর কিছুই নেই। তারা মুখে বলে, ‘ভাই, আমি তোমাকে ভালবাসি,’ কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে গলায় ছুরি চালায়। তাদের হাত রক্তরাঙা।
তারপর তাঁর সুমিষ্ট গলার স্বর গম্ভীর হয়ে এল, তিনি আরও ধীরে বলতে লাগলেনঃ কিন্তু ঈশ্বরের বিচার একদিন তাদের উপরেও নেমে আসবে। প্রভু বলেছেন, ‘প্রতিশোধ নেব আমি, প্রতিফল দেব।’ মহাধ্বংস আসছে। এই পৃথিবীতে তোমাদের খ্রীষ্টানেরা সংখ্যায় কত? সমগ্র পৃথিবীর লোকসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশও নয়। চেয়ে দেখ লক্ষ লক্ষ চীনাদের দিকে, ঈশ্বরের হাতিয়ার হিসাবে তারাই নেবে এর প্রতিশোধ। তারাই তোমাদের উপর আক্রমণ চালাবে। আর একবার চালাবে হুন অভিযান। তারপর একটু মুচকি হেসে বললেন, ‘তারা সমগ্র ইওরোপকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, কোন কিছুরই অস্তিত্ব রাখবে না। নারী, পুরুষ, শিশু—সব ধ্বংস হয়ে যাবে। পৃথিবীতে নেমে আসবে আবার অন্ধকার-যুগ।’ এ-কথা বলার সময় তাঁর গলার স্বর এত বিষণ্ণ হয়েছিল যে, তা অবর্ণনীয়। তারপর হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘আমি—আমি কিছুই গ্রাহ্য করি না। এই ধ্বংসস্তূপ থেকে পৃথিবী আরও ভালভাবে গড়ে উঠবে। কিন্তু মহাধ্বংস আসছে। ঈশ্বরের প্রতিশোধ ও অভিশাপ নেমে আসতে আর দেরী নেই।’
তারা সকলেই প্রশ্ন করলেন, ‘শীগ্গিরই কি সেই অভিশাপ নেমে আসবে?’
‘এক হাজার বছরের মধ্যে ঘটনা ঘটবে।’
বিপদ আসন্ন নয় শুনে তাঁরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
স্বামীজী বলতে লাগলেন, ‘ঈশ্বর এ অন্যায়ের প্রতিশোধ নেবেনই। আপনারা ধর্মের মধ্যে, রাজনীতির মধ্যে হয়তো তা দেখতে পাচ্ছেন না। কিন্তু ইতিহাসের পৃষ্ঠায় এর সন্ধান করতে হবে। বারে বারে এমনই ঘটেছে, ভবিষ্যতেও এমনই ঘটবে। আপনারা যদি জনগণকে অত্যাচার ও পীড়ন করেন, তবে তার জন্য আপনাদের দুঃখভোগ করতেই হবে। চেয়ে দেখুন না ভারতের দিকে, কি করে ঈশ্বর আমাদের কাজের প্রতিশোধ নিচ্ছেন। ভারতের ইতিহাসে দেখা যায়, অতীতে যারা ছিল ধনী মানী, তারা ধন-দৌলত বাড়াবার জন্য দরিদ্রকে নিষ্পেষণ করেছে, তাদের প্রতি অকথ্য অত্যাচার করেছে। দুর্গত জনের কান্না তাদের কানে পৌঁছয়নি। তারা যখন অন্নের জন্য হাহাকার করেছে, ধনীরা তাদের সোনারূপার থালায় অন্নগ্রহণ করেছে। তারপরই ঈশ্বরের প্রতিশোধরূপে এল মুসলমানরা, এদের কেটে কুচি-কুচি করলে। তরবারির জোরে তারা তাদের উপর জয়ী হল। তারপর বহুকাল ও বহু বছর ধরে ভারত বার বার বিজিত হয়েছে এবং সর্বশেষে এসেছে ইংরেজ। যত জাতি ভারতে এসেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হল এই ইংরেজ। ভারতের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাবেন, হিন্দুরা রেখে গেছে অপূর্ব মন্দির, মুসলমানরা সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ। আর ইংরেজরা?—স্তূপীকৃত ব্র্যাণ্ডির ভাঙা বোতল—আর কিছু নয়। তবুও ঈশ্বর আমাদের দয়া করেননি, কারণ আমরা অন্যের প্রতি কোন দয়া-মমতা দেখাইনি। আমাদের দেশবাসীরা তাদের নিষ্ঠুরতায় সমগ্র সমাজকে নীচে টেনে এনে নামিয়েছে। তারপর যখন তাদের প্রয়োজন হল জনসাধারণের, তখন জনসাধারণের কোন ক্ষমতা রইল না তাদের সাহায্য করার। ঈশ্বর প্রতিশোধ নেন—মানুষ এ-কথা বিশ্বাস না করলেও ইতিহাসের প্রতিশোধ গ্রহণের অধ্যায়টি সে অবশ্যই অস্বীকার করতে পারবে না। ইতিহাস ইংরেজের কৃতকার্যের প্রতিশোধ নেবেই। আমাদের গ্রামে গ্রামে—দেশে দেশে যখন মানুষ দুর্ভিক্ষে মরছে, তখন ইংরেজরা আমাদের গলায় পা দিয়ে টিপে ধরেছে, আমাদের শেষ রক্তটুকু তারা নিজ-তৃপ্তির জন্য পান করে নিয়েছে, আর আমাদের দেশের কোটি কোটি টাকা তাদের নিজেদের দেশে চালান দিয়েছে। চীনারাই আজ তার প্রতিশোধ নেবে—তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আজ যদি চীনারা জেগে ওঠে ও ইংরেজকে সমুদ্রে ঠেলে ফেলে দেয়, যা তাদের উচিত প্রাপ্য—তাহলে সুবিচারই হবে।
তারপর তাঁর সব কথা বলা হলে তিনি চুপ করে রইলেন। সমবেত জনগণের মধ্যে তাঁর সম্পর্কে চাপা গুঞ্জরন উঠল; তিনি সব শুনলেন, বাইরে থেকে মনে হল যেন কান দিলেন না। উপরের দিকে চেয়ে আস্তে আস্তে বলতে লাগলেন, ‘শিব! শিব!’ ক্ষুদ্র শ্রোতৃমণ্ডলী তাঁর প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোবৃত্তি ও ভাববন্যার প্রবাহে চঞ্চল ও অশান্ত হয়ে পড়েছিলেন, তাঁদের মনে হয়েছিল এই অদ্ভুত লোকটির শান্ত মনোভাবের অন্তরালে যেন আগ্নেয়গিরির গলিত লাভাস্রোতের মত এই ভাবাবেগ ও ভাববন্যা প্রবহমান। সভা ভঙ্গ হল, শ্রোতারা বিক্ষুব্ধ মনে চলে গেলেন।
প্রকৃতপক্ষে এ ছিল সপ্তাহের শেষের একটি দিন। তিনি কয়েকদিনই এখানে ছিলেন।… এখানে যেসব আলাপ-আলোচনা হয়েছে, তিনি বরাবরই সেগুলি ছবির মত নানা দৃষ্টান্ত দিয়ে সুন্দর সুন্দর গল্প উপাখ্যান দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
এই সুন্দর গল্পটিও স্বামীজী কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেনঃ এক নারী তার স্বামীকে তার দুঃখ-কষ্টের জন্য গালাগালি দিত, অন্যের সাফল্য দেখে তাকে গঞ্জনা করত এবং তার দোষত্রুটিগুলির কথা তাকে সবিস্তারে বলত। স্ত্রী বলতঃ ভগবানকে এত বছর সেবা করার পর তোমার ভগবান্ কি তোমার জন্য এই করলেন? এই তার প্রতিদান? স্ত্রীর এই প্রশ্নের উত্তরে স্বামী বললেন, ‘আমি কি ধর্মের ব্যবসা করি? এই পর্বতের দিকে তাকিয়ে দেখ। এ আমার জন্য কি করে, আর আমিই বা তার জন্য কি করেছি? কিন্তু তা হলেও আমি এ পর্বতকে ভালবাসি। আমি সুন্দরকে ভালবাসি বলেই একে (হিমালয়কে) ভালবাসি—আমাকে এভাবেই সৃষ্টি করা হয়েছে। এই আমার প্রকৃতি। ভগবানকে আমি এজন্যই ভালবাসি।’
তারপর স্বামীজী এক রাজার কাহিনী বললেন। এক রাজা জনৈক সাধুকে কিছু দান করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সাধু তাঁর প্রস্তাব প্রথমে প্রত্যাখান করেন। প্রাসাদে এসে রাজা তাঁর দান গ্রহণের জন্য সাধু্কে আবার বিশেষ পীড়াপীড়ি করতে থাকেন এবং সনির্বন্ধ অনুরোধ জানালেন। কিন্তু রাজবাড়ীতে এসে সাধু দেখলেন, রাজা ধন-সম্পদ ও শক্তিবৃদ্ধির জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছেন, ভিক্ষা চাইছেন। সাধু কিছুক্ষণ তাঁর এই প্রার্থনা অবাক হয়ে শুনলেন, তারপর তাঁর মাদুরটি গুটিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলেন। রাজা চোখ বুঁজে প্রার্থনা করছিলেন। প্রার্থনার পর চোখ খোলা-মাত্র দেখলেন যে, সাধু চলে যাচ্ছেন। রাজা প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন? আপনি তো আমার দান গ্রহণ করলেন না?’ সাধু উত্তরে বললেন, ‘আমি ভিক্ষুকের কাছে দান নেব?’
ধর্মই সকলকে রক্ষা করতে পারে এবং খ্রীষ্টানধর্মে সকলকে রক্ষা করার শক্তি আছে—কোন ব্যক্তি এরূপ মন্তব্য করলে স্বামীজী তাঁর বড় বড় চোখ দুটি মেলে বললেন, ‘খ্রীষ্টানধর্মে যদি রক্ষা করার শক্তি থাকত, তবে এই ধর্ম কেন ইথিওপিয়া ও আবিসিনিয়ার লোকদের রক্ষা করতে পারল না?’
স্বামীজীর মুখে প্রায় এই কথাটি শোনা যেতঃ কোন সন্ন্যাসীর প্রতি ইংরেজরা এ-রকম করতে সাহস পাবে না। কোন কোন সময়ে তিনি তাঁর আকুল মনের এই ইচ্ছাও প্রকাশ করতেন ও বলতেন, ‘ইংরেজ আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মেরে ফেলুক। তাহলে আমার মৃত্যুই হবে তাদের ধ্বংসের সূত্রপাত।’ তারপর হাসির ঝিলিক লাগিয়ে বলতেন, ‘আমার মৃত্যু-সংবাদ সমগ্র দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়বে।’
সিপাহী বিদ্রোহে ঝাঁসির রাণীই ছিলেন তাঁর কাছে সবচেয়ে বীর নারী। তিনি রণক্ষেত্রে নিজেই সৈন্য পরিচালনা করেছিলেন। বিদ্রোহীদের অনেকেই পরে আত্মগোপন করার উদ্দেশ্যে সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। সাধুদের মধ্যে যে ভয়ঙ্কর রকমের জেদী মনোভাব দেখা যায়, এই হল তার অন্যতম ইতিহাস। এই বিদ্রোহীদেরই একজন তার চার-চারটি সন্তানকে হারিয়েছিল, শান্ত সুস্থির ভাবে তার সেই হারান সন্তানদের কথা বলত, কিন্তু ঝাঁসির রাণীর কথা উঠলেই তিনি আর চোখের জল রাখতে পারতেন না, দরদর ধারায় বুক ভেসে যেত। তিনি বলতেন, রাণী তো মানবী নন, দেবী। সৈন্যদল যখন পরাজিত হল, রাণী তখন তলোয়ার নিয়ে পুরুষের মত যুদ্ধ করতে করতে মৃত্যুবরণ করলেন। এই সিপাহী বিদ্রোহের অন্য দিকের কাহিনী অদ্ভুত মনে হয়। এর যে অন্য দিক্ আছে, তা আপনারা ভাবতেই পারবেন না। কোন হিন্দু সিপাহী যে কোন নারীকে হত্যা করতে পারে না, সে-বিষয়ে আপনারা নিশ্চিত থাকতে পারেন।