১.১৩ তারিণী, মহেশ ও সুবোধ

তারিণী, মহেশ ও সুবোধ ডাঃ সোম ও রাজাবাহাদুর দুজনে মিলে অনেক কষ্টে একপ্রকার যেন জোর করেই নিশানাথকে ঘর থেকে টেনে নিয়ে গেলেন।

নিশানাথ মৃদু অস্পষ্ট আপত্তি জানাতে জানাতে, ওদের সঙ্গে যেতে যেন কতকটা বাধ্যই হলেন। তাঁর মৃদু আপত্তি তখনও শোনা যাচ্ছিল, খুঁজে দেখ বিনু! খুঁজে দেখ! ভিতর থেকে যেমন করে হোক শয়তানটাকে খুঁজে বের কর। খুঁজে দেখ, খুঁজলেই পাবে। সুহাস গেছে, কে বলতে পারে এবার হয়ত তোমারই পালা। অভিশাপ! অভিশাপ! মৃত রত্নেশ্বর মল্লিকের অভিশাপ! দুধকলা দিয়ে তিনি কালসাপ পুষেছিলেন, কেউ থাকবে না! রাবণের বংশের মতই এ একেবারে নির্বংশ হয়ে যাবে রে! মনে করে দেখ রামায়ণে সেই দশাননের খেদোক্তি, এক লক্ষ পুত্র মোর, সোয়া লক্ষ নাতি, কেহ না রহিল মোর বংশে দিতে বাতি।… ক্রমে নিশানাথের কণ্ঠস্বর অস্পষ্ট হতে অস্পষ্টতর হয়ে একসময় আর শোনা গেল না।

ঘরের মধ্যে সব কটি প্রাণীই যেন স্তব্ধ অনড় হয়ে গেছে। উঁচ পতনের শব্দও হয়ত শোনা যাবে। নিশানাথের বিলীয়মান কথার রেশ যেন তখনও বাতাসে ভেসে আসছে করুণ মর্মস্পর্শী।

ঢং ঢং করে রাত্রি তিনটে ঘোষিত হল ঘরের দামী সুদৃশ্য ওয়ালক্লকটায়।

চমকে সুব্রত মুখ তুলে তাকাল। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে রাত্রিশেষের দিকে। ফাল্গুনের ঈষৎ ঠাণ্ডা হাওয়া ভোলা বাতায়নপথে রাত্রিশেষের আভাস জানিয়ে গেল। সহসা সুব্রতর শরীরটা যেন কেমন সিরসির করে ওঠে। বাইরের খোলা আঙিনার ওপরে লাহিড়ীর মৃতদেহটা এখনও তেমনই পড়ে আছে। ডাঃ সোম ও রাঙ্গাবাহাদুর হয়ত নিশানাথকে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করছেন। রায়পুরের প্রাসাদটা যেন একটা রহস্যের খাসমহল হয়ে দাঁড়িয়েছে সত্যি। চারদিকে এর মৃত্যুর বীজ ছড়ানো।

বিকাশ খসখস করে কাগজের ওপরে বর্তমান দুর্ঘটনা সম্পর্কে কি যেন একমনে লিখে চলেছে। হয়ত এদের জবানবন্দি। রাজাবাহাদুরের শয়নকক্ষটা একবার দেখা দরকার। যে লোকটা লাহিড়ীর কাছে চিঠি নিয়ে গিয়েছিল, সে লোকটাই বা কে? কেই বা চিঠি দিতে গিয়েছিল? আর চিঠিতেই বা কি লেখা ছিল?

তাছাড়া এত রাত্রে লাহিড়ী প্রাসাদের দিকেই বা আসছিল কেন? তবে কি রাজবাড়ি থেকে কেউ তাকে চিঠি লিখে পাঠিয়েছিল। হয়ত তাই। আগাগোড়া সমগ্র ঘটনাটাকে সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলে মনে হচ্ছে যেন লাহিড়ীর হত্যার ব্যাপারটা আগে থেকে একটা প্ল্যানমাফিক ঘটানো হয়েছে, আকস্মিক মোটেই নয়। লাহিড়ীকে চিঠি লিখে বাড়ি থেকে সরিয়ে এনে তারপর হত্যা করা হয়েছে। হয়ত চিঠিটা লাহিড়ীর পকেটে ছিল। হত্যা করবার পর হত্যাকারী নিশ্চয়ই চিঠিটা সরিয়ে ফেলেছে, অন্যতম নির্ভুল প্রমাণ ছিল হয়ত ঐ চিঠিখানাই। বোকার মত সে ফেলেই বা যাবে কেন? হত্যাকারী অত্যন্ত চালাক ও ক্ষিপ্র, সে বিষয়ে কোনো ভুল নেই। হত্যার কোনো সূত্রই সে পিছনে ফেলে যায়নি। নিঃশব্দে সে ধরাছোঁয়ার বাইরে আত্মগোপন করেছে হত্যার পর।

ডাঃ সোম ও রাজাবাহাদুর ঘরে এসে প্রবেশ করলেন।

বিকাশের নোট লেখা বোধ হয় শেষ হয়ে গিয়েছিল, উঠে দাঁড়াল, আসুন রাজাবাহাদুর। এবারে আমি এখানকার অন্যান্য সবাইকে প্রশ্ন করতে চাই।

বেশ তো। করুন কাকে কি জিজ্ঞাসা করতে চান। রাজাবাহাদুর বললেন।

তাহলে আপনি নিজে ও তারিণী, মহেশ ও সুবোধ বাদে সকলকে আপাতত যেতে বলুন। স্টেটের তহশীলদার তারিণী চক্রবর্তী, খাজাঞ্চী মহেশ সামন্ত, সরকার সুবোধ মণ্ডল, সুব্রত, পারিবারিক চিকিৎসক ডাক্তার সোম ও রাজাবাহাদুর বাদে বিকাশবাবুর নির্দেশমত তখন অন্যান্য সকলে ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

আমি এক-একজন করে প্রশ্ন করব, সে বাদে অন্য কেউ আর এখানে থাকবে না। বিকাশ বললে।

প্রথমেই ডাক পড়ল তারিণী চক্রবর্তীর।

বসুন চক্রবর্তী মশাই। আপনিও চিৎকারটা শুনেছিলেন নিশ্চয়?

হ্যাঁ।

আপনি চিৎকারটা যখন শুনতে পান, তখন কোথায় ছিলেন?

বছর প্রায় শেষ হয়ে এল, খাজনাপত্র আদায় হচ্ছে, সেই সব খাতাপত্র লেখা ও দেখাশুনা করছিলাম। এমন সময় হঠাৎ চিৎকার শুনে চমকে উঠি। খাজাঞ্চীঘরের সামনে যে টানা বারান্দা আছে, তার শেষপ্রান্তে দরজা পার হলে তবে প্রাসাদের ভেতরের আঙিনায় যাওয়া যায়। মনে হল যেন অন্দরমহলের দিক থেকেই শব্দটা এসেছে, তাই তাড়াতাড়ি সেই দিকেই ছুটে যাই।

তারপর?

কিন্তু গিয়ে দেখি বহির্মহল থেকে অন্দরমহলে যাবার দরজাটা ভিতরমহলের দিক থেকে বন্ধ।

দরজাটা রাত্রে কি বন্ধই থাকে?

হ্যাঁ। তবে রাত্রে বারোটার পর দরজাটা বন্ধ করা হয়, ভিতরের দিক থেকে। অন্দরমহলের দারোয়ান ছোট্টু সিং রোজ রাত্রে শুতে যাবার আগে দরজা বন্ধ করে দেয়।

কিন্তু চিৎকার যখন আপনি শুনতে পান, রাত্রি তখন বোধ করি এগারোটা হবে, দরজা তখন তো তাহলে বন্ধ থাকার কথা নয়?

না, তবে যদি ছোট্টু সিং আগেই আজ রাত্রে দরজা বন্ধ করে দিয়ে থাকে তো বলতে পারি না, মাঝে মাঝে বারোটার আগেও দরজা বন্ধ করা হয়।

দরজাটা বন্ধ দেখে আপনি কি করলেন?

দরজাটায় জোরে দুচারবার ধাক্কা দিতেই খুলে গেল।

ছোট্ট সিংই খুলে দিয়েছিল বোধ হয়?

না, দরজা যে কে খুলে দিয়েছিল তা আমি জানি না, কারণ দরজা খুলে দেবার পর কাউকেই আমি দেখতে পাইনি ভিতরের দিকে।

আশ্চর্য! ছোট্টু সিংকেও নয়?

না।

ভিতরের দিকে ঢুকে আপনি কি দেখলেন?

প্রথমটা কিছুই দেখতে পাইনি, তারপর ভাল করে দেখতে নজরে পড়ল, কে যেন একজন আঙিনার উপরে পড়ে আছে। ছুটে গেলাম, দেখেই চিনতে পারলাম, আমাদের ম্যানেজারবাবু।

তিনি কি তখনও বেঁচে ছিলেন?

না, মারা গিয়েছিলেন।

আর কেউ সেখানে ছিল সে-সময়?

না, আমিই বোধ হয় প্রথমে মৃতদেহ দেখতে পাই। আমার যাবার পরেই প্রথমে দারোয়ান ছোট্টু সিং, মহেশদা, সুবোধ মণ্ডল, তারপরেই অন্দরমহল থেকে এলেন রাজাবাহাদুর।

তাহলে প্রথমে ভেতরে প্রবেশ করে আর কাউকেই দেখতে পাননি আপনি?

না।

আচ্ছা আপনি যখন খাজাঞ্চীঘরে বসে লেখাপড়ার কাজ করছিলেন, তখন কি কাউকে অন্দরমহলের দিকে যেতে দেখেছিলেন?

না। তাছাড়া তেমন নজর দিইনি, কারণ একটা হিসাবের গরমিল হচ্ছিল আজ কদিন হতে, সেটা নিয়েই আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম।

এ ছাড়া আর আপনার কিছু বলবার নেই চক্রবর্তী মশাই?

না।

আচ্ছা আপনি যেতে পারেন, মহেশবাবুকে পাঠিয়ে দিন।

একটু পরেই মহেশ সামন্ত ঘরে এসে প্রবেশ করল। মোটাসোটা নাদুসনুদুস, গোলগাল চেহারার লোকটি। চোখে রূপোর ফ্রেমের চশমা। ভদ্রলোকের ঘন ঘন কাপড়ের খুঁটে চশমার কাচ পরিষ্কার করা একটা অভ্যাসের মধ্যে যেন দাঁড়িয়ে গেছে।

বসুন, আপনারই নাম মহেশ সামন্ত?

আজ্ঞে হুজুর। মহেশ চশমাটা চোখ হতে নামিয়ে কাপড়ে সেটা ঘষতে লাগেল। মহেশের বয়স যে চল্লিশের কোঠা পার হয়ে গেছে, তা দেখলেই বোঝা যায়। মাথার সামনের দিকে এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে বিস্তীর্ণ একখানি টাক, নাকটা ভোঁতা।

আপনার ঘরটি, মানে বহিমহলে আপনি কোন ঘরে থাকেন?

টানা বারান্দার একেবারে শেষের ঘরটিতে।

আপনি চিৎকার শুনেই বোধ হয় ঘর হতে বের হয়ে যান?

আজ্ঞে আমি আমার ঘরের মধ্যে বসে আজকের সংবাদপত্রটা পড়ছিলাম, তখন বোধ করি রাত্রি পৌনে এগারোটা আন্দাজ হবে। মনে হল, আমার ঘরের সামনেকার বারান্দা দিয়ে কে যেন দ্রুতপায়ে হেঁটে চলে গেল। ভাবলাম প্রাসাদের কোনো চাকরবাকর হবে। তারই মিনিট পাঁচ-সাত বাদে ওই চিৎকার শুনেই বাইরে এসে দেখি, অন্দরমহলে যাবার দরজাটা তারিণীদা ঠেলছেন। একটু ঠেলাঠেলি করতেই দরজাটা খুলে তারিণীদা ভেতরের দিকে চলে গেলেন।

আপনার ঘর হতে অন্দরমহলে যাবার দরজাটা কতদূর?

তা প্রায় পনের-কুড়ি হাত হবে হুজুর।

আপনিও তখন বুঝি তারিণীবাবুকে অনুসরণ করলেন?

হ্যাঁ। আমার পিছনে পিছনে সুবোধবাবুও এসে গেছেন ততক্ষণে।

সুবোধবাবু কোন ঘরে থাকেন?

আমার দুখানা ঘর আগে।

ভেতরে ঢুকে কি দেখলেন?

দেখলাম তারিণীদা, ছোষ্ট্র সিং ও বাড়ির দুচারজন চাকরবাকর আঙিনায় এসে জড় হয়েছে। ঐ সময় রাজাবাহাদুরও এলেন।

আপনি শুধু চিৎকারটা শোনবার মিনিট পাঁচ-সাত আগে কারও অন্দরের দিকে যাওয়ার . পায়ের শব্দই পেয়েছিলেন, কারও বাইরের দিকে আসার পায়ের শব্দ পাননি?

না।

আচ্ছা যে শব্দটা শুনতে পেয়েছিলেন, নিশ্চয়ই জুতো পায়ে হাঁটার শব্দ; অর্থাৎ যার হাঁটবার শব্দ শুনেছিলেন তার পায়ে জুতো ছিল?

হ্যাঁ।

বেশ মচমচ শব্দ?

আজ্ঞে না, সাধারণ জুতোর শব্দ। তবে—মহেশ ইতস্তত করতে থাকে।

তবে কি? চুপ করলেন কেন, বলুন!

জুতোর সোলে লোহার পেরেকের নাল বসানো থাকলে যেমন শব্দ হয়, অনেকটা সেই রকম শব্দ শুনতে পেয়েছিলাম।

মহেশবাবু, আপনার শ্রবণশক্তির আমি প্রশংসা করি।

মহেশের ঠোঁটের কোণায় বিনীত হাসির একটা স্ফুরণ দেখা দেয়। আবার সে চশমাটি নাকের ওপর হতে নামিয়ে খুব জোরে জোরে কাপড়ের কোঁচায় ঘষতে থাকে ঘন ঘন।

কতদিন আপনি এখানে কাজ করছেন সামন্ত মশাই?

তা আজ প্রায় বিশ বছর হবে।

এঁরা তাহলে আপনার বহুকালের মনিব বলুন?

আজ্ঞে। বড় রাজার পিতাঠাকুর রাজা শ্রীকণ্ঠ মল্লিক বাহাদুরের সময় থেকেই এ বাড়িতে আমি কাজ করছি। কি জানেন দারোগা সাহেব, এ বংশে শনির দৃষ্টি লেগেছে!

কেন, হঠাৎ এ-কথা বলছেন কেন সামন্ত মশায়?

তাছাড়া আর কি বলুন? দেখুন না রাজা শ্রীকণ্ঠ মল্লিক বাহাদুর, অমন মহাপ্রাণ সদাশয় ব্যক্তি, তাঁর কিনা অপঘাতে মৃত্যু হল! তারপর এ-বাড়ির ভাগ্নে সুধীনের বাবা তাঁরও মৃত্যু তো একরকম অপঘাতে। আমাদের বড় রাজাবাহাদুরও, তাঁরও কোথাও কিছু না, হঠাৎ বিকেলের দিকে জলখাবার খাবার পর অসুস্থ হলেন, মাঝরাত্রের দিকে মারা গেলেন, ডাক্তার-বদ্যি কিছুই করতে পারলে না। তারপর সর্বশেষ ধরুন আমাদের ছোট কুমার, ঠিক যেন আচার-ব্যবহারে একেবারে রাজা শ্রীকণ্ঠ মল্লিকের মতই হয়েছিলেন, তা তিনিও অপঘাতে মারা গেলেন। এখন টিমটিম করছেন সবেধন নীলমণি আমাদের এই রাজাবাহাদুর। তা রাজবাড়ির মধ্যে যে ব্যাপার চলছে, ইনিও কতদিন টিকবেন কে জানে! তাই তো বলছিলাম, এসব শনির দৃষ্টি ছাড়া আর কি!

আপনাদের বর্তমান রাজাবাহাদুর লোকটি কেমন?

হুজুর মনিব। আমরা সাধারণ কর্মচারী মাত্র, ছোটর মুখে বড়র কথা শোভা পায় না। তা ইনিও সদাশয়, মহানুভব বৈকি।

আচ্ছা এবারে আপনি যেতে পারেন। মণ্ডল মশাইকে দয়া করে একটিবারের জন্য এ ঘরে পাঠিয়ে দেবেন।

সুবোধ মণ্ডল একটু পরেই এসে ঘরে প্রবেশ করল।

আসুন মণ্ডল মশাই, বসুন।

সুবোধ মণ্ডল লোকটি যেমন ঢ্যাঙা তেমনি রোগা। নাকটা উঁচলল, মুখটা সরু। দুগালের হনু দুটি চামড়া ভেদ করে বিশ্রীভাবে সজাগ হয়ে উঠেছে। উপরের পাটির সামনের প্রথম চারটি দাঁত উঁচু ও মোটা। লোকটা প্রস্থের অনুপাতে দৈর্ঘ্যে এত বেশী লম্বা যে, চলবার সময় মনে হয় যেন একটু সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে কুঁজো হয়ে চলেছে। তার চলবার ধরন দেখে বোঝা যায়, লোকটার চলাটাও বিচিত্র—ঠিক যেন খরগোশের মত অতি ক্ষিপ্রগতিতে চলতে অভ্যস্ত ও পটু।

আমায় ডেকেছেন স্যার?

হ্যাঁ, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, বসুন!

বলুন না স্যার কি বলতে চান, দাঁড়িয়েই তো বেশ আছি, বসলে আমার কষ্ট হয়।

কেন?

সারাটা জীবনই তো, ওর নাম কি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই গেল—তা ওর নাম কি, মনে করুন, ঐ দাঁড়ানোটাই অভ্যাস হয়ে গেছে—তাছাড়া বয়স তত কম হল না, কোমরে একটু বাতেরও মত ধরেছে আজকাল, একটা বিড়ি খেতে পারি স্যার? অনেকক্ষণ ধোঁয়া না খেতে পেয়ে, ওর নাম কি, পেট যেন কেঁপে উঠেছে।

নিশ্চয় নিশ্চয়—খান না।

সুবোধ পকেট হতে একটা বিড়ি বের করে তাতে দিয়াশলাই জ্বালিয়ে অগ্নিসংযোগ করল। চোঁ চোঁ করে একটা তীব্র টান দিয়ে, একরাশ কটু ধোঁয়া ছেড়ে বললে, আঃ! এবারে ওর নাম কি, করুন স্যার কি জিজ্ঞাসা করতে চান!

আপনিও বোধ হয় প্রাসাদের বাইরেই থাকেন?

আজ্ঞে ওর নাম কি, সকলেই যখন বাইরে থাকেন, বাজার সরকার আমি…ঐ তারিণী খুড়োর ঘরটাতেই আমি থাকি।

চিৎকারটা আপনিও তাহলে শুনতে পেয়েছিলেন? আর এও হয়তো জানতে পেরেছেন, তারিণীবাবু কখন ঘর থেকে বের হয়ে যান? .

তা পেরেছিলাম বৈকি। তবে ওর নাম কি, জানি না খুড়ো কখন ঘর হতে বের হয়ে যান। মানে টের পাইনি।

কেন, সে সময় আপনি কি করছিলেন? মানে, জেগে না ঘুমিয়ে?

বোধ হয় ওর নাম কি, ঘুমিয়েই ছিলাম।

বোধ হয় ঘুমিয়ে ছিলেন, এ কথার মানে?

আজ্ঞে, ওর নাম কি, রাজবাড়ির বাজার সরকার আমি, আমার যে কখন জাগরণ কখন নিদ্রা আমি নিজেই টের পাই না। তবে ওর নাম কি, কেমন করে বলি বলুন স্যার, আমি ঘুমিয়েই ছিলাম না জেগেই ছিলাম। কারণ ঘুমোলেও আমাদের জেগে থাকতে হয়, জাগা অবস্থাতেই ঘুমিয়ে নিতে হয়। এই দেখুন না স্যার, ওর নাম কি, আজ প্রায় পনের বছর একাদিক্রমে এই রাজবাড়িতে বাজার সরকারের কাজ করে আসছি, শরীরটা ক্রমে শণের দড়ির মত পাকিয়ে যাচ্ছে, তবু ওর নাম কি, পনের বছর আগেকার সুবোধ, একান্ত সুবোধ বালকটির মত বাজার সরকারের পদেই রয়ে গেল। আমার ছোট্‌ঠাকুদা বলেন, সুবোধ আমাদের সেই সুবোধই আছে। কুড়ি টাকায় ঢুকেছিলাম, এখন সাকুল্যে পচিশে গিয়ে ঠেকেছে। তা ওর নাম কি, করছি কি বলুন!

বিকাশ বুঝতে পেরেছিল, লোকটা একটু বেশীই কথা বলে, এবং মনে মনে খুশি নয়। ক্রমাগত বাজার সরকারের পদে একাদিক্রমে পনের বৎসর তোষামোদ ও মিথ্যার কারবার করে করে, এখন যা বলে তার হয়তো মোল আনাই মিথ্যে। এক্ষেত্রে এ লোকটাকে বেশী ঘাঁটিয়েও বিশেষ কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। তাই সে তাড়াতাড়ি সুবোধকে বিদায় দিল।

রাত্রিও প্রায় শেষ হয়ে এল। পূর্বাকাশে রাত্রিশেষের বিলীয়মান আবছা অন্ধকারের পর্দা ভেদ করে অস্পষ্ট আলোর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

এর পর রাজাবাহাদুরের সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে, লাশ স্থানীয় হাসপাতালের ময়নাঘরে ময়না-তদন্তের জন্য পাঠাবার ব্যবস্থা করে, সেদিনকার মত বিকাশ রাজবাটী থেকে বিদায় নিল।

ফেরবার পথে বিকাশ ও সুব্রত একসঙ্গেই পথ অতিক্রম করছিল। সুব্রত বললে, চলুন বিকাশবাবু, রাত্রি প্রায় ভোর হয়ে এল, আমার ওখানে এক কাপ চা খেয়ে যাবেন। এবং চা খেতে খেতে জবানবন্দিতে কি জানতে পারলেন তা শোনা যাবে।

বেশ চলুন, বকবক করে করে গলাটাও শুকিয়ে গেছে, এক কাপ চা এ সময় তো দেবতার আশীবাদ! জবানবন্দিতে বিশেষ কিছু জানা গেছে বলে তো আমার মনে হয় না। সবই টুকে এনেছি, পড়ে দেখুন যদি কিছুর সন্ধান পান।

দুজনে এসে সুব্রতর বাসায় উপস্থিত হল। থাকোহরিকে ডেকে চায়ের ব্যবস্থা করতে বলে সুব্রত বিকাশকে নিয়ে বারান্দায় দুটো চেয়ার পেতে বসল। রাত্রিশেষের বিলীয়মান তরল অন্ধকারে চারিদিক কেমন যেন স্বপ্নাতুর মনে হয়।