১. তুমি কি ফেলুদা

॥ ১ ॥

‘তুমি কি ফেলুদা?’

প্রশ্নটা এল ফেলুদার কোমরের কাছ থেকে। একটি বছর ছয়েকের ছেলে ফেলুদার পাশেই দাঁড়িয়ে মাথাটাকে চিৎ করে তার দিকে চেয়ে আছে। এই সেদিনই একটা বাংলা কাগজে ফেলুদার একটা সাক্ষাৎকার বেরিয়েছে, তার সঙ্গে হাতে চারমিনার নিয়ে একটা ছবি। তার ফলে ফেলুদার চেহারাটা আজকাল রাস্তাঘাটে লোকে ফিল্মস্টারের মতোই চিনে ফেলছে। আমরা এসেছি পার্ক স্ট্রীট আর রাসেল স্ট্রীটের মোড়ে খেলনা আর লাল মাছের দোকান হবি সেন্টারে। সিধু জ্যাঠার সত্তর বছরের জন্মদিনে তাঁকে একটা ভালো দাবার সেট উপহার দিতে চায় ফেলুদা।

ছেলেটির মাথায় আলতো করে হাত রেখে ফেলুদা বলল, ‘ঠিক ধরেছ তুমি।’

‘আমার পাখিটা কে নিয়েছে বলে দিতে পার?’ বেশ একটা চ্যালেঞ্জের সুরে বলল ছেলেটি। ততক্ষণে ফেলুদারই বয়সী এক ভদ্রলোক ব্রাউন কাগজে মোড়া একটা লম্বা প্যাকেট নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এসেছেন, তাঁর মুখে খুশির সঙ্গে একটা অপ্রস্তুতভাব মেশানো।

‘তোমার নিজের নামটাও বলে দাও ফেলুদাকে,’ বললেন ভদ্রলোক।

‘অনিরুদ্ধ হালদার’, গম্ভীর মেজাজে বলল ছেলেটা।

‘ইনি আপনার খুদে ভক্তদের একজন’, বললেন ভদ্রলোক। ‘আপনার সব গল্প ওর মার কাছ থেকে শোনা।’

‘পাখির কথা কী বলছিল?’

‘ও কিছু না’, ভদ্রলোক হালকা হেসে বললেন, ‘পাখি পোষার শখ হয়েছিল, তাই ওকে একটা চন্দনা কিনে দিয়েছিলাম। যেদিন আসে সেদিনই কে খাঁচা থেকে পাখিটা বার করে নিয়ে যায়।’

‘খালি একটা পালক পড়ে আছে’, বলল ফেলুদার খুদে ভক্ত।

‘তাই বুঝি?’

‘রাত্তিরে ছিল পাখিটা, সকালবেলা নেই। রহস্য।’

‘তাই ত মনে হচ্ছে। তা অনিরুদ্ধ হালদার এই রহস্যের ব্যাপারে কিছু করতে পারেন না?’

‘আমি বুঝি গোয়েন্দা? আমি ত ক্লাস টু-তে পড়ি।’

ছেলের বাবা আর বেশিদূর কথা এগোতে দিলেন না।

‘চল অনু। আমাদের আবার নিউ মার্কেট যেতে হবে। তুমি বরং ফেলুদাকে একদিন আমাদের বাড়িতে আসতে বল।’

ছেলে বাবার অনুরোধ চালান করে দিল। এবার ভদ্রলোক একটা কার্ড বের করে ফেলুদার হাতে দিয়ে বললেন, ‘আমার নাম অমিতাভ হালদার।’

ফেলুদা কার্ডটায় একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ‘বারাসতে থাকেন দেখছি।’

‘আপনি হয়ত আমার বাবার নাম শুনে থাকতে পারেন। পার্বতীচরণ হালদার।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। ওঁর লেখা-টেখাও ত পড়েছি। ওঁরই সব নানারকম জিনিসের কালেকশন আছে না?’

‘ওটা বাবার নেশা। ব্যারিস্টারি ছেড়ে এখন ওসবই করেন। সারা পৃথিবী ঘুরেছেন ওই সবের পিছনে। আপনার ত অনেক ব্যাপারে ইয়ে আছে, আমার মনে হয় আপনি দেখলে আনন্দ পাবেন। আদ্যিকালের গ্রামোফোন, মুগল আমলের দাবা বড়ে, ওয়ারেন হেস্টিংসের নস্যির কৌটো, নেপোলিয়নের চিঠি…। তাছাড়া আমাদের বাড়িটাও খুব ইন্টারেস্টিং। দেড়শো বছরের পুরনো। একদিন যদি ফ্রী থাকেন, একটা ফোন করে দিলে—রোববার-টোববার…। আমিই বরং একটা ফোন করব। ডাইরেকটরিতে ত আপনার—?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার নামেই আছে। এই যে।’

ফেলুদাও তার একটা কার্ড ভদ্রলোককে দিয়ে দিল।

কথা হয়ে গেল আমরা এই মাসেই একদিন বারাসত গিয়ে হাজির হব। লালমোহনবাবুর গাড়ি আছে, যাবার কোনো অসুবিধে নেই। এখানে বলে রাখি লালমোহনবাবু বহাল তবিয়তে এবং খোশমেজাজে আছেন, কারণ এই পুজোয় জটায়ুর জায়ান্ট অমনিবাস বেরিয়েছে, তাতে বাছাই করা দশটা সেরা রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস। দাম পঁচিশ টাকা এবং লালমোহনবাবুর ভাষায় ‘সেলিং লাইক হট কচুরিজ।’

সন্ধ্যাবেলা ফেলুদার মুখ শুকনো দেখে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার। ও বলল, ‘খুদে মক্কেলের আর্জিটা মাথায় ঘুরছে রে।’

‘সেই চন্দনার ব্যাপারটা?’

‘খাঁচা থেকে পাখি চুরি যায় শুনেছিস কখনো?’

তা শুনিনি সেটা স্বীকার করতেই হল। —’তুমি কি এর মধ্যেও রহস্যের গন্ধ পাচ্ছ নাকি?’

‘ব্যাপারটা ঠিক দৈনন্দিন ঘটনার মধ্যে পড়ে না। চন্দনা ত আর বার্ড অফ প্যারাডাইজ নয়। এক যদি না কারো নেগলিজেন্সে খাঁচার দরজাটা বন্ধ করতে ভুল হয়ে গিয়ে থাকে।’

‘কিন্তু সেটাত আর জানবার কোনো উপায় নেই।’

‘তা থাকবে না কেন? ওখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেই জানা যায়। আসলে বুঝতে পারছি এ ব্যাপারটা ও-বাড়ির কেউ সিরিয়াসলি নেয়নি। ঘটনাটা যে অস্বাভাবিক সেটা কারুর মাথায় ঢোকেনি। অথচ ছেলের মনটা যে খচ্‌ খচ্‌ করছে সেটা বুঝতে পারছি, না হলে আমায় দেখে ও কথাটা বলত না। অন্তত একবার যদি গিয়ে দেখা যেত…’

‘তা ভদ্রলোক ত বললেনই যেতে।’

‘হ্যাঁ—কিন্তু সেটাও হয়ত আমাকে সামনা সামনি দেখলেন বলে। বাড়ি ফিরে সে কথা আর মনে নাও থাকতে পারে। ছোট ছেলের অনুরোধ বলেই মনে হচ্ছে সেটাকে একেবারে এড়িয়ে যাওয়া ঠিক নয়।’

ক্রিসমাসের যখন আর পাঁচদিন বাকি তখনই এক শনিবারের সকালে এসে গেল অমিতাভবাবুর ফোন। আমি কলটা ফেলুদার ঘরে ট্রানসফার করে বসবার ঘরের মেন টেলিফোনে কান লাগিয়ে শুনলাম।

‘মিঃ মিত্তির?’

‘বলুন কী খবর।’

‘আমার ছেলে ত মাথা খেয়ে ফেলল। কবে আসছেন?’

‘পাখির কোনো সন্ধান পেলেন?’

‘নাঃ—সে আর পাওয়া যাবে না।’

‘ভয় হয়, আপনার ছেলে যদি ধরে বসে থাকে তার পাখি উদ্ধার করে দেব, তখন সেটা না পাওয়া গেলে ত বেইজ্জতের ব্যাপার হবে।’

‘সে নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। ছেলেকে খানিকটা সময় দিলেই সে খুশি হয়ে যাবে। আসলে আমার বাবার সঙ্গে একবার আপনার আলাপ করিয়ে দিতে চাই। আজ ত আমার ছুটি; আপনি কী করছেন?’

‘তেমন কিছুই না। আজ দশটা নাগাদ হলে হবে?’

‘নিশ্চয়ই।’

শনি রবি দু’দিনই আমাদের বাড়িতে সকাল ন’টায় লালমোহনবাবুর আসাটা একেবারে হান্ড্রেড পারসেন্ট শিওর। ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় আসাটা কলকাতা শহরে আজকাল আর সম্ভব নয়, তবে দশ মিনিট এদিক ওদিকের বেশি হয় না কোনোদিনই। আজও হল না। ঠিক নটা বেজে পাঁচ মিনিটে ঘরে ঢুকে ধপ্‌ করে সোফায় বসে পড়ে বললেন, ‘কালি কলম মন, লেখে তিনজন। মশাই, পুজোর লেখার ধকলের পর শীতকালটা এলে লেখার চিন্তাটা থাউজ্যাণ্ড মাইলস দূরে চলে যায়—কালি কলম খাতার দিকে আর চাইতেই ইচ্ছা করে না।’

লালমোহনবাবু ইদানীং প্রবাদ নিয়ে ভীষণ মেতে উঠেছেন। সাড়ে তিনশো প্রবাদ নাকি উনি মুখস্থ করেছেন। লেখার ফাঁকে ফাঁকে লাগসই প্রবাদ গুঁজে দিতে পারলে সাহিত্যের রস নাকি ঘনীভূত হয়। তিনি অবিশ্যি শুধু লেখায় নয়, কথাতেও যখন তখন প্রবাদ লাগাচ্ছেন। আজ ভদ্রলোকের পরনে ছাই রঙের টেরিলিনের প্যান্ট আর সবুজ সোয়েটার, আর হাতে এক চাঙাড়ি কচুরি। কচুরির কারণ আর কিছুই না—হট কচুরির আজকাল আর তেমন ডিমাণ্ড আছে কিনা ফেলুদার এই প্রশ্নের উত্তরে লালমোহনবাবু বলেন, ‘মশাই, বাগবাজারের মোহন ময়রার দোকানে কচুরির জন্য কিউ দেখলে মনে হবে সেখানে কোনো বোম্বাইমার্কা হিন্দি হিট ছবি চলছে। আপনাকে খাওয়ালে বুঝবেন উপমাটা কত অ্যাপ্রোপ্রিয়েট।’

সঙ্গে এক ফ্লাস্ক জল আর কচুরির চাঙাড়িটা নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। লালমোহনবাবু পার্বতী হালদারের নাম শোনেননি। তবে নেপোলিয়নের চিঠি শুনে ভয়ানক ইমপ্রেস্‌ড হলেন। বললেন ইস্কুলে থাকতে ওঁর হিরো নাকি ছিল নেপোলিয়ন। ‘গ্রেট ম্যান, বোনাপাটি’ কথাটা বার তিনেক চাপা গলায় বললেন যাবার পথে।

ভি আই পি রোডের আগে স্পীড তুলতে পারলেন না লালমোহনবাবুর ড্রাইভার হরিপদবাবু। বারাসতে যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় সাড়ে দশটা।

অমিতাভবাবুদের বাড়িটা মেন রোডের উপরেই, তবে গাছপালায় ঘেরা বলে আসল বাড়িটা রাস্তা থেকে চোখে পড়ে না। গেট দিয়ে ঢুকে নুড়ি ফেলা রাস্তায় খানিকটা গিয়ে তবে থামওয়ালা দালানটা দেখা যায়। একেবারে সাহেবী ঢং-এর বাড়ি, বয়সের ছাপ যতটা থাকার কথা ততটা নেই; মনে হয় বছরখানেকের মধ্যেই অন্তত সামনের অংশটায় চুণকাম ও রিপেয়ার দুই-ই হয়েছে। বাড়ির সামনে একটা বাঁধানো পুকুরের চারিপাশে সুপুরিগাছের সারি।

অমিতাভবাবু নিচেই অপেক্ষা করছিলেন আমাদের জন্য, ফেলুদা লালমোহনবাবুর সঙ্গে আলাপ করানোতে বললেন, ‘আমি নিজে আপনার লেখা পড়িনি বটে, তবে আমার স্ত্রী রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজের ভীষণ ভক্ত।’

আমরা শ্বেতপাথরের সিঁড়ি দিয়ে, দোতলায় উঠলাম। পার্বতীবাবুর কালেকশনের জিনিস নাকি সবই দোতলায়।

‘বাবার আগে আমার পুত্রের সঙ্গে দেখাটা সেরে নিন’, বললেন অমিতাভবাবু। ‘বাবার কাছে এখন লোক আছে। উনি বাইরের লোকের সঙ্গে দেখাসাক্ষাতগুলো সকালেই করেন।’

‘অ্যাদ্দুরেও লোক এসে উৎপাত করে?’

‘বাবার মতো কিছু কালেক্টর আছেন, তাঁরা প্রায়ই আসেন। তাছাড়া সম্প্রতি বাবা একজন সেক্রেটারির জন্য কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। তার জন্য কিছু লোক দেখা করতে আসছে।’

‘ওনার সেক্রেটারি নেই?’

‘আছে, তবে তিনি দিল্লী চলে যাচ্ছেন সামনের সপ্তাহে একটা ভালো কাজ পেয়ে। লোকটি বেশ কাজের ছিল। আসলে সেক্রেটারির ব্যাপারে বাবার লাক্‌টাই খারাপ। গত দশ বছরে চারটি সেক্রেটারি এল গেল। একটি ত বছরখানেক কাজ করার পর মেনিনজাইটিসে মারা গেলেন। আরেকটি কথা নেই বার্তা নেই, সাইবাবার ভক্ত হয়ে বিবাগী হয়ে গেলেন। এখন যে ভদ্রলোকটির সঙ্গে বাবা কথা বলছেন, তাকে সাত বছর আগে তাড়িয়ে দেন। সেও ছিল সেক্রেটারি।’

‘কেন, তাড়ান কেন?’

‘ভদ্রলোক কাজ খুব ভালোই করতেন, তবে অসম্ভব কুসংস্কারী। বাবা সেটা একেবারে সহ্য করতে পারতেন না। একবার ঈজিপ্ট থেকে একটা জেড পাথরের মূর্তি আনার পর কলকাতায় এসে বাবার অসুখ করে। সাধনবাবু বাবাকে সিরিয়াসলি বলেন যে, মূর্তিটি যে দেবীর, তাঁর অভিশাপ পড়েছে বাবার ওপর। এই এক কথাতেই বাবা তাঁকে একরকম ঘাড় ধরে বার করে দেন।’

‘এই সাধনবাবু যদি আবার এসে থাকেন তাহলে তাঁকে খুবই অপটিমিস্টিক বলতে হবে, এবং আপনার বাবাকে অত্যন্ত ক্ষমাশীল বলতে হয়।’

‘আসলে লোকটাকে তাড়িয়ে দেবার পর বাবার একটু অনুশোচনা হয়েছিল। কারণ ভদ্রলোকের অবস্থা মোটেই ভালো ছিল না। আর বাবা ওঁকে সার্টিফিকেটও দেননি।’

বাড়িটা বাইরে থেকে বিলিতি ধাঁচের হলেও, ভিতরটা বাংলা জমিদারী বাড়ির মতোই। মাঝখানের নাটমন্দিরকে ঘিরে দোতলার বারান্দার এক পাশে সারি সারি ঘর। বৈঠকখানা, আর পার্বতীচরণের স্টাডি বা কাজের ঘর সামনের দিকে, আর ভিতর দিকে সব শোবার ঘর। ফেলুদার খুদে মক্কেল বারান্দায় তার ঘরের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা সেই দিকে এগিয়ে যাব, এমন সময় জুতোর শব্দ শুনে বৈঠকখানার দিকে চেয়ে দেখি নীল কোট পরা হাতে ব্রীফকেসওয়ালা একজন লোক গটগটিয়ে ঘরটা পেরিয়ে সিঁড়ির দিকে চলে গেল। অমিতাভবাবু বললেন, ‘এই সেই প্রাক্তন সেক্রেটারি সাধনবাবু। ভদ্রলোককে খুব প্রসন্ন বলে মনে হল না।’

‘এই যে আমার পাখির খাঁচা’, ফেলুদা তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বলল অনিরুদ্ধ।

‘আমি ত সেটাই দেখতে এলাম।’

খাঁচাটা একটা হুক থেকে ঝুলছে বারান্দায় রেলিং-এর উপরে। ঝকঝকে ভাবটা দেখে বোঝা যায় খাঁচাটাও কেনা হয়েছিল পাখির সঙ্গেই। ফেলুদা সেটার দিকে এগিয়ে গেল। দরজাটা এখনো খোলাই রয়েছে।

‘আপনার বাড়ির কোনো চাকরের পাখিতে অ্যালার্জি আছে বলে জানেন?’

অমিতাভবাবু হেসে উঠলেন।

‘সেটা ভাববার ত কোনো কারণ দেখি না। আমাদের বাড়ির কোনো চাকরই কুড়ি বছরের কম পুরনো নয়। তাছাড়া এক কালে এ বাড়িতে একসঙ্গে দুটো গ্রে প্যারট ছিল। বাবা নিজেই এনেছিলেন। অনেকদিন ছিল, তারপর মারা যায়।’

‘এই ব্যাপারটা লক্ষ করেছেন কি?’

ফেলুদা বেশ কিছুক্ষণ হাত দিয়ে খাঁচাটাকে নেড়ে চেড়ে প্রশ্নটা করল।

অমিতাভবাবুর সঙ্গে আমরা দুজনও এগিয়ে গেলাম।

ফেলুদা খাঁচার দরজাটার একটা অংশে আঙুল দিয়ে দেখাল।

‘ছোট্ট একটা লালের ছোপ বলে মনে হচ্ছে?’ বললেন অমিতাভবাবু। তার মানে কি—?’

‘যা ভাবছেন তাই। ব্লাড।’

‘চন্দনা মার্ডার?’ বলে উঠলেন লালমোহনবাবু।

ফেলুদা খাঁচার দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বলল, ‘পাখির রক্ত না মানুষের রক্ত সেটা কেমিক্যাল অ্যানালিসিস না করে বোঝা যাবে না। তবে একটা স্ট্রাগ্‌ল হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অবিশ্যি সেটা তেমন অস্বাভাবিক কিছু নয়। এটা বোঝাই যাচ্ছে যে খাঁচার দরজা খোলা রাখার জন্য পাখি পালায়নি; দরজা খুলে পাখিকে বার করে নেওয়া হয়েছে। আপনারা কোত্থেকে কিনেছিলেন পাখিটা?’

‘নিউ মার্কেট’, বলে উঠল অনিরুদ্ধ।

অমিতাভবাবু বললেন, ‘নিউ মার্কেটের তিনকড়িবাবুর পাখির দোকান খুব পুরনো দোকান। আমাদের জানা শোনা অনেকেই ওখান থেকে পাখি কিনেছে।’

অনিরুদ্ধর ইচ্ছা ছিল তার নতুন কেনা খেলনাগুলো আমাদের দেখায়, বিশেষ করে মেশিনগানটা, কিন্তু অমিতাভবাবু বললেন, ‘এঁরা আবার তোমার কাছে আসবেন। তখন তোমার খেলনা দেখবেন, তোমার মা-র সঙ্গে আলাপ করবেন, চা খাবেন—সব হবে। আগে দাদুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই, কেমন?’

আমরা পার্বতীবাবুর স্টাডির উদ্দেশে রওনা দিলাম।

কিন্তু দাদুর সঙ্গে আর আলাপ হল না। লালমোহনবাবু পরে বলেছিলেন, এক-একটা ঘটনার শক্‌-এর এফেক্ট নাকি সারা জীবন থাকে। এটা সেইরকম একটা ঘটনা।

বৈঠকখানায় ঢুকেই বুঝেছিলাম চারিদিকে দেখবার জিনিস গিজগিজ করছে। সে সব দেখার সময় ঢের আছে মনে করে আমরা এগিয়ে গেলাম ঘরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে পরদা দেওয়া স্টাডির দরজার দিকে।

‘আসুন’ বলে অমিতাভবাবু গিয়ে ঢুকলেন ঘরের মধ্যে। আর ঢোকামাত্র এক অস্ফুট চীৎকার দিয়ে উঠলেন—

‘বাবা!’

ফেলুদার অমিতাভবাবুকে দু’হাত দিয়ে ধরতে হল, কারণ ভদ্রলোক প্রায় পড়েই যাচ্ছিলেন।

ততক্ষণে আমরা দুজনেও ঘরে ঢুকেছি।

বিরাট মেহগনি টেবিলের পিছনে একটা রিভলভিং চেয়ারে বসে আছেন পার্বতীচরণ হালদার। তাঁর মাথাটা চিৎ, দুটো পাথরের মত চোখ চেয়ে আছে সিলিং-এর দিকে, হাত দুটো ঝুলে রয়েছে চেয়ারের দুটো হাতলের পাশে।

ফেলুদা এক দৌড়ে চলে গেছে ভদ্রলোকের পাশে। নাড়ীটা দেখার জন্য হাতটা বাড়িয়ে আমাদের দিকে ফিরে বলল, ‘তোরা দৌড়ে গিয়ে ওই সাধন লোকটাকে আটকা… দারোয়ানকে বল। দরকার হলে বাইরে রাস্তায় দ্যাখ্‌—’

আমার সঙ্গে সঙ্গে লালমোহনবাবুও ছুট দিলেন। মন বলছিল দশ মিনিট চলে গেছে, সে লোককে আর পাওয়া যাবে না—বিশেষ করে যদি সে খুন করে থাকে।

সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে প্রায় কোলিশন হয়েছিল। পরে জেনেছিলাম উনি পার্বতীচরণের বর্তমান সেক্রেটারি হৃষিকেশবাবু। দুজন অচেনা লোককে এইভাবে তড়িঘড়ি নামতে দেখে তিনি কী ভাবলেন সেটা আর তখন ভাবার সময় ছিল না।

বাইরে কেউ নেই, রাস্তায়ও না, কারুর থাকার কথাও নয়। যেটা সবচেয়ে অদ্ভুত লাগল সেটা হল এই যে দারোয়ান জোর গলায় বলল গত দশ মিনিটের মধ্যে কেউ গেট দিয়ে বাইরে যায়নি। বাবুর কাছে লোক আসবে বলে সে সকাল থেকে ডিউটিতে রয়েছে, তার ভুল হতেই পারে না।

‘চলো বাগানের দিকটা দেখি’, বললেন লালমোহনবাবু, ‘হয়ত কোথাও ঘাপটি মেরে আছে।’

তাই করলাম। দক্ষিণের পুকুরের ধার, পশ্চিমের গোলাপ বাগান, কম্পাউণ্ড ওয়ালের পাশটা, চাকরদের ঘরের আশেপাশে, কোথাও বাদ দিলাম না। পাঁচিল টপকানোও সহজ নয়, কারণ প্রায় আট ফুট উঁচু।

হাল ছাড়তে হল।

সাধনবাবু উধাও।