১. আমি খুব ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকালাম

আমি খুব ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকালাম। আমার মাথার কাছে একটি চতুষ্কোণ স্ক্রিন, সেখানে হালকা নীল রংয়ের আলো, এই আলোটি আমার পরিচিত, কিন্তু কোথায় দেখেছি এখন কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। কিছু একটা ঘটছে এবং আমি জানি ব্যাপারটা ঘটবে কিন্তু সেটি কী আমার মনে পড়ছে না। আমি সেটি মনে করার প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে আবার গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়লাম। এক সময় আবার আমার চেতনা ফিরে আসতে থাকে এবং আধো ঘুম আর আধো জাগরণের মাঝামাঝি একটি তরল অবস্থায় আমি ঘুরপাক খেতে থাকি। আমি একরকম জোর করে চোখ খুলে তাকালাম, চতুষ্কোণ স্ক্রিনটিতে একটি নীল গ্রহের ছবি ফুটে উঠেছে। আমি এই গ্রহটিকে চিনি, এর নাম পৃথিবী, ছায়াপথের একটি সাদামাটা নক্ষত্রকে ঘিরে যে গ্রহগুলি ঘুরছে এটি তার তৃতীয় গ্রহ। এই গ্রহে প্রাণের বিকাশ হয়েছিল এবং আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই গ্রহ থেকে এসেছে। আমরা একটি মহাকাশযানে করে এখন আবার এই গ্রহটিতে ফিরে যাচ্ছি।

আমি নীল গ্রহটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ শীত অনুভব করলাম। নিজের অজান্তে দুই হাত বুকের কাছে টেনে আনতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম আমার সারা দেহে কোনো অনুভূতি নেই। আমার মনে পড়ল মহাকাশযানের দীর্ঘ যাত্রার প্রস্তুতি নেয়ার জন্যে আমাকে এবং আমার মতো আরো দশ সহস্র মহাচারীকে শীতল ঘরে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। পৃথিবীর কাছে পৌঁছানোর পর আমাদের জাগিয়ে দেবার কথা। আমরা নিশ্চয়ই গন্তব্য স্থলে পৌঁছে গেছি, তাই আমাদের জাগিয়ে তোলা শুরু হয়েছে।

আমি নিজের ভিতরে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করলাম, ধরমর করে উঠে বসার একটা অমানুষিক ইচ্ছাকে প্রাণপনে নিবৃত্ত করে আমি ক্যাপসুলের ভিতরে। চুপচাপ শুয়ে রইলাম। আমার চারপাশে খুব ধীরে ধীরে এক ধরনের আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে, আমি আমার শরীরে আবার শক্তি ফিরে পেতে শুরু করেছি। দীর্ঘদিন অব্যবহৃত এই শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পুরোপুরি সজীব করার আগে আমাকে এই ক্যাপসুল থেকে বের হতে দেয়া হবে না জেনেও আমি কিছুতেই ভিতরে চুপচাপ শুয়ে থাকতে পারছিলাম না।

শুয়ে থাকতে থাকতে যখন আমি ধৈর্যের প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছেছি ঠিক তখন ক্যাপসুলের ঢাকনাটি সরে গেল। আমি সাথে সাথে ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে এলাম। নিও পলিমারের সূক্ষ্ম একটা আবরণে শরীরকে ঢেকে আমি নগ্ন পদে শীতল মেঝেতে হেঁটে কেন্দ্রীয় ভল্টের বাইরে এসে দাড়ালাম। গোলাকার দরজার কাছে ভাবলেশহীন সুখে একজন মানুষ দাঁড়িয়েছিল, আমাকে দেখে জোর করে মুখে একটা হাসি টেনে এনে বলল, কিহা, শীতল ঘর থেকে তোমার জাগরণ শুভ হোক।

আমি মানুষটার দিকে তাকালাম, এরকম যান্ত্রিক গলায় যে এধরনের একটা। অর্থহীন কথা বলতে পারে সে নিশ্চয়ই মানুষ নয়, সে নিশ্চয়ই একজন রবোট। সে যদি মানুষ নাও হয় তবু তার কথার উত্তরে আমার কিছু একটা বলা উচিৎ কিন্তু আমার অর্থহীন সম্ভাষণ পাল্টা-সম্ভাষণ করার ইচ্ছে করল না। আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা কী পৃথিবীর কাছাকাছি চলে এসেছি?

মানুষটা শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, পৃথিবী?

হ্যাঁ, পৃথিবী।

আমি জানি না।

তুমি কি রবোট?

মানুষটির চোখে এক ধরনের ক্রোধের ছায়া এসে পড়ল। আমার দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, আমি রবোট না মানুষ সেটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। আমাকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সেটি করতে পারছি কী না তাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

আমি নিজের ভিতরে এক ধরনের কৌতুক অনুভব করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, তোমাকে কী দায়িত্ব দেয়া হয়েছে?

আজকে শীতল ঘর থেকে যারা বের হবে তাদের সবার বায়ো নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা। কমিশনের সামনে হাজির করা।

কিসের কমিশন?

সেটা তুমি সময় হলেই দেখবে।

আমি আবার মানুষটার দিকে তাকালাম, এটি নিশ্চয়ই একটি রবোট, মানুষ হলে যে প্রায় এক শতাব্দী শীতল ঘরে ঘুমিয়ে থেকে জেগে উঠেছে তার সাথে এরকম রুক্ষ গলায় কথা বলত না। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, চল। তাহলে, আমাকে নিয়ে যাও, যেখানে তোমার নেবার কথা।

মানুষটি বলল, এস।

আমি তার পিছু পিছু হাঁটতে থাকি। মানুষটি হেঁটে যেতে যেতে অন্যমনস্ক ভাবে তার ঘাড়ে একবার হাত বুলায়। এটি তাহলে রবোট নয়, মানুষ রবোটকে কখনো। তাদের শরীর চুলকাতে হয় না।

বায়ো নিয়ন্ত্রণ ব্যাপারটি যত জটিল হবে ভেবেছিলাম সেটা মোটেও তত জটিল হল না। চতুষ্কোণ একটা দরজার মতো জায়গা দিয়ে আমাকে নগ্ন দেহে হেঁটে যেতে হল, যন্ত্রটি আমার শরীরকে নানা ভাবে স্ক্যান করে আমার সম্পর্কে সম্ভাব্য সবরকম জৈবিক তথ্য মহাকাশযানের মূল তথ্যকেন্দ্রে লিপিবদ্ধ করে ফেলল। পুরো তথ্য বিশ্লেষণ করতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল এবং প্রায় সাথে সাথেই আমার শরীর কয়েক ধরনের প্রতিষেধক দিয়ে পাশের ঘরে পাঠিয়ে দেয়া হল। এখানে আমার মস্তিষ্ককে স্ক্যান করা হল, মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তা পরিমাপ করার এই যন্ত্রটি সত্যিই কাজ করে কী না সে ব্যাপারটা আমার বড় ধরনের সন্দেহ রয়েছে। আমার পরিচিত একজন অসাধারণ প্রতিভাবান গণিতবিদ, ব্যক্তিগত জীবনে যে একটু খাপছাড়া ধরনের প্রতিবার এই মস্তিষ্ক স্ক্যান যন্ত্রের সামনে গবেট হিসাবে প্রমাণিত হয়ে এসেছে। এই যন্ত্রটি অবশ্যি আমার সম্পর্কে খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করেছে বলে মনে হল, কারণ যন্ত্রটির পিছনে যে কমবয়সী সুন্দরী মেয়ে কিংবা রবোটটি বসে রয়েছে সে রিপোর্টটি দেখে চমকে উঠে আমার দিকে তাকাল। আমি তার চোখে একধরনের অবিশ্বাসের ছায়া দেখতে পেলাম। আমার চেহারা খুব সাধারণ, মানুষ নিশ্চয়ই অসাধারণ বুদ্ধিমান মানুষকে অসাধারণ সুদর্শন হিসেবে আবিষ্কার করতে চায়।

বায়ো নিয়ন্ত্রণ ঘর থেকে বের হয়ে আমি একটা ছোট হলঘরে হাজির হলাম। সেখানে আরামদায়ক চেয়ারে জনা বিশেক নানাবয়সের মানুষ গা এলিয়ে বসে আছে। আমি ঘরে ঢুকতেই সবাই ঘুরে আমার দিকে তাকাল এবং মধ্যবয়সী একজন মানুষ সহজ গলায় বলল, এই হচ্ছে কিহ। এখন আমরা কাজ শুরু করে দিতে পারি।

আমি সবাইকে লক্ষ করতে করতে একটা খালি চেয়ারে বসে পড়লাম। চেয়ারগুলি দেখতে যত আরামদায়ক বসতে সেরকম নয়, ইচ্ছে করেই নিশ্চয় এভাবে তৈরি করা হয়েছে। মনে হয় আমাদের জরুরি কোনো তথ্য দেয়া হবে, তাই বেশি আরামে ঠেলে দিতে চায় না, একটু তটস্থ রাখতে চায়। মধ্যবয়সী মানুষটি হেঁটে হেঁটে ঘরের মাঝখানে যেতে যেতে বলল, প্রতিদিন শীতল ঘর থেকে যে সব মানুষকে জাগিয়ে তোলা হচ্ছে তাদের মাঝে যাদের বুদ্ধিমত্তা নিনীষ স্কেলে ছয় এর বেশি তাদেরকে এই ঘরে আনা হয়। মস্তিষ্ক স্ক্যান করার পদ্ধতিটি এখনো পুরোপুরি আয়ত্তে আনা হয় নি। মাঝে মাঝে ভুল করে বুদ্ধিমান মানুষের বুদ্ধিমত্তা নিনীষ স্কেলে ধরা পড়ে না। কিন্তু উল্টোটা কখনো হয় নি। যাদের বুদ্ধিমত্তা নিনীষ স্কেলে ছয়ের বেশি ধরা পড়েছে তারা কখনো নির্বোধ প্রমাণিত হয় নি। কাজেই এই ঘরে তোমরা যারা আছ তারা সবাই নিশ্চিতভাবে অত্যন্ত বুদ্ধিমান–আমার কাজ সে কারণে খুব সহজ।

সামনের দিকে বসে থাকা একজন তরল গলায় বলল, তোমার কাজটা কী?

আমার কাজ তোমাদেরকে তোমাদের পরবর্তী দায়িত্বের জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা। তোমরা সবাই শীতলঘরে ঘুমিয়েছিলে এবং তোমাদের বলা হয়েছিল পৃথিবী নামক গ্রহটার কাছে পৌঁছানোর পর তোমাদের জাগিয়ে তোলা হবে। পৃথিবী এখনো অর্ধশতাব্দী বৎসর দূরে, তোমাদের এখনই জাগিয়ে তোলা হয়েছে, তার পিছনে নিশ্চয়ই একটা কারণ রয়েছে। কারণটা কী?

আমার পাশে বসে থাক ঝকঝকে চেহারার একটা মেয়ে বলল, আমাদের সেটা অনুমান করতে হবে?

না। মধ্যবয়স্ক মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, সেটা তোমাদের অনুমান করতে হবে। এটি গোপন কিছু নয়, কিন্তু তুমি যেহেতু প্রশ্ন করেছ আমার একটু ব্যক্তিগত কৌতূহল হচ্ছে। তুমি কি কিছু অনুমান করছ?

মেয়েটি মাথা নাড়ল। বলল, হ্যাঁ।

আমরা কি সেটা শুনতে পারি?

অবশ্যি পার। আমার ধারণা সত্যিকার কারণটি যেন আমরা জানতে না পারি সেজন্যে তুমি আমাদের বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে এখন মিথ্যে একটা কারণের কথা বলবে।

মেয়েটার কথা শুনে আমরা সবাই উচ্চঃস্বরে হেসে উঠলাম, মধ্য বয়স্ক মানুষটি হাসল সবচেয়ে জোরে। সে হাসতে হাসতেই বলল, এই মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণের পুরো ব্যাপারটি এত জটিল যে তোমার ধারণা সত্যি হবার পুরোপুরি সম্ভাবনা রয়েছে। তবে আমি তোমাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমি তোমাদের যদি মিথ্যে একটা কারণের কথাও বলি সেটা সত্যি জেনেই বলব। মানুষকে যখন বিভ্রান্ত করার প্রয়োজন হয় তখন রবোটকে ব্যবহার করা হয়। আমি রবোট নই, জলজ্যান্ত মানুষ।

সামনের দিকে বসে থাকা একজন মানুষ বলল, ঠিক আছে, এখন তাহলে কারণটা শোনা যাক।

মধ্যবয়স্ক মানুষটির মুখ একটু গম্ভীর হয়ে আসে। সে কীভাবে কথাটা বলবে সম্ভবত সেটা মনে মনে একটু গুছিয়ে নিয়ে বলল, এই মহাকাশযানটি প্রায় এক শতাব্দী আগে যখন পৃথিবীর দিকে রওনা দিয়েছিল তখন পরিকল্পনা করা হয়েছিল পৃথিবীর কাছাকাছি এসে আমাদের সবাইকে জাগিয়ে তোলা হবে। সে ভাবেই এই অভিযান শুরু হয়েছিল। বেশির ভাগ মহাকাশচারী শীতল ঘরে ঘুমিয়েছিল অল্প কিছু ক্রু পালা করে মহাকাশযানের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছিল। তোমরা নিশ্চয়ই জান মহামতি গ্রাউল যখন এই মহাকাশযানটি তৈরি করেছিলেন তখন সেটিকে সৃষ্ট জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রযুক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছাড়া এটি মহকাশ পারাপার করতে পারে।

আমরা মাথা নাড়লাম, মহাকাশচারী হিসেবে এই মহাকাশযানে পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার জন্যে আমরা যারা স্বেচ্ছায় নাম লিখিয়েছিলাম তাদেরকে নানাভাবে এই তথ্যগুলি অনেকবার দেয়া হয়েছে। এই মহাকাশযানের পরিকল্পনা করেছিলেন গ্রাউল নামের একজন মানুষ, তাকে সবসময় মহামতি গ্রাউল বলা হয়। জনশ্রুতি রয়েছে মহামতি গ্রাউল বিকলাঙ্গ, তার চোখ কান অন্যকোন ইন্দ্রিয় নেই, তিনি সরাসরি সংবেদন জাতীয় যন্ত্র দিয়ে বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি কোথায় থাকেন সেটি কেউ জানে না। তিনি কি বেঁচে আছেন না মারা গেছেন সেটিও কেউ জানে না। মহামতি গ্রাউল নিয়ে যে পরিমাণ রহস্যের জন্ম দেওয়া হয়েছে যে আমার মনে হয় পুরো ব্যাপারটি কাল্পনিক। গ্রাউল নামে কোনো মানুষ কখনো ছিল না। এটি কিছু প্রতিভাবান বিজ্ঞানী এবং কিছু শক্তিশালী কম্পিউটার জাতীয় যন্ত্রের একধরনের সুষম উপস্থাপন।

মধ্যবয়স্ক মানুষটি একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এই অভিযানের প্রথম অংশটুকু ঠিক পরিকল্পনা মাফিক কেটেছে। কিন্তু যখন আমরা পৃথিবীর কাছাকাছি পৌঁছাতে শুরু করেছি হঠাৎ করে অবস্থার পরিবর্তন হল। পৃথিবী থেকে আমাদের কাছে কিছু সংবাদ পৌঁছাত শুরু করল।

আমার পাশে বসে থাকা ঝকঝকে চেহারার মেয়েটি বলল, কী ধরনের সংবাদ?

অত্যন্ত নিরীহ ধরনের সংবাদ। পৃথিবীর ফসল তোলা হচ্ছে। পানি সরবরাহ করার জন্যে মেরু অঞ্চলের বরফ গলানো হচ্ছে। আয়োনোস্ফিয়ারে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। নূতন ধরনের আন্তঃগ্যালাক্টিক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপিত হচ্ছে এই ধরনের সংবাদ। আপাত দৃষ্টিতে এই সংবাদগুলির মাঝে এতটুকু বৈচিত্র নেই। কিন্তু মহাকাশযানের তথ্য বিশ্লেষণের যে সমস্ত উপায় রয়েছে সেগুলির মাঝে এই

তথ্যগুলি সরবরাহ করে একটি অত্যন্ত বিচিত্র জিনিস আবিষ্কার করা হয়েছে।

মধ্যবয়স্ক মানুষটি ইচ্ছে করে এক মুহূর্তের জন্যে থামল এবং বেশ কয়েকজন এক সাথে জিজ্ঞেস করল, কী জিনিস?

দেখা গেছে সমস্ত পৃথিবী একটা ভয়াবহ গোলযোগের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর মানুষেরা কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না। একে অন্যকে কীভাবে ধ্বংস করবে সেটাই হচ্ছে সবকিছুর মূল উদ্দেশ্য।

পিছনের দিকে বসে থাকা বুড়ো মতো একজন মানুষ বলল, আমি তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না–নিরীহ কিছু সংবাদ থেকে সেটা কেমন করে বোঝা সম্ভব?

আমার পাশে বসে থাকা মেয়েটি মাথা নেড়ে বলল, সম্ভব হতে পারে। যদি দেখা যায় একটি ঘটনা ঘটছে অন্য আরেকটি ঘটনাকে উপলক্ষ্য করে আর সেই ঘটনাগুলি একটি আরেকটাকে সাহায্য না করে ক্ষতি করছে–

মধ্য বয়স্ক মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। যেমন ধরা যাক ফসল কাটার ব্যাপারটি। ঠিক ফসল কাটার সময় যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় আর সেই দুর্যোগটি যদি হয় ইচ্ছাকৃত–তাহলে আমাদের সন্দেহ করার কারণ রয়েছে। এমনিতে আমাদের কাছে সেই তথ্যগুলি অর্থহীন কিন্তু যদি সেগুলি বিশ্লেষণ করা যায় তখন সেগুলি হঠাৎ করে খুব অর্থবহ হয়ে ওঠে।

আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মধ্যবয়স্ক মানুষটির দিকে তাকিয়েছিলাম। হঠাৎ করে আমার মনে হল আমি একটু একটু বুঝতে পারছি সে কী বলতে চাইছে। একটু ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত গলা উচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এই মহাকাশযান যারা নিয়ন্ত্রণ করছে তাদের ধারণা আমরা এই পৃথিবীতে বাস করার অনুপযুক্ত?

মধ্যবয়স্ক মানুষটি আমার প্রশ্ন শুনে খুব অবাক হয়ে গেল, কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার কী ধারণা পৃথিবীতে মানুষেরা যেরকম হানাহানি করেছ আমাদের এই মহাকাশযানে ঠিক সেরকম হানাহানি শুরু করতে হবে, যেন আমরা যখন পৃথিবীতে পৌঁছাব তখন কী করতে হবে আমাদেরকে বলে দিতে হবে না?

মধ্যবয়স্ক মানুষটি আমতা আমতা করে বলল, তুমি কথাগুলি বলেছ খুব রুঢ় ভাবে কিন্তু কথাটি সত্যি। আমি একটু অন্যভাবে বলতে যাচ্ছিলাম।

আমার পাশে যে মেয়েটি বসেছিল সে আমার দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়েছিল, এবারে মধ্যবয়স্ক মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কীভাবে বলতে যাচ্ছিলে?

আমি বলতে চাইছিলাম যে আমরা যে গ্রহ থেকে এসেছি সেই গ্রহে একটা নূতন ধরনের সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। যে কারণেই হোক আমাদের গ্রহে একজন মানুষ অন্য মানুষকে অনেক বেশি বিশ্বাস করে, আমরা একে অন্যের উপরে অনেক বেশি নির্ভরশীল। আমরা যখন পৃথিবীতে পৌঁছাব পৃথিবীর সমাজ ব্যবস্থায় নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারব না। অপরিচিত অবস্থার সাথে যুদ্ধ করে আমাদের সমস্ত শক্তি নিঃশেষিত হয়ে যাবে–

আমি মধ্যবয়স্ক মানুষটির দিকে তাকিয়ে নিজের ভিতরে এক ধরনের ক্রোধ অনুভব করতে থাকি। এই মানুষটি যে কথাগুলি বলছে সেগুলি অর্থহীন কথা, কখনো কাউকে বিভ্রান্ত করতে হলে এই ধরনের কথা বলতে হয়। কেন সে আমাদের বিভ্রান্ত করতে চাইছে? আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলাম, সে সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, আমরা যে সমাজ-ব্যবস্থা থেকে এসেছি সেখানে কোনো নেতৃত্ব নেই। আমাদের কার কী দায়িত্ব নিখুতভাবে ব্যাখ্যা করা আছে–সবাই নিজের দায়িত্ব পালন করে যাই এবং পুরো সমাজ ব্যবস্থা এগিয়ে যায়। এই মুহূর্তে যে পৃথিবী আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে সেখানে সমাজ-ব্যবস্থা অন্যরকম। সেখানে সমস্যার জন্ম হলে একজনকে নেতৃত্ব নিয়ে তার সমাধান করতে হয়। আমাদের পৃথিবীতে যাবার আগে সেটা শিখতে হবে।

আমি শীতল গলায় বললাম, সেটা আমরা কীভাবে শিখব?

মধ্যবয়স্ক মানুষটিকে কেমন যেন অসহায় দেখায়, সে একধরনের ক্লান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, খুব সহজে। এই মহাকাশযানের যে নিয়ন্ত্রণটুকু ছিল সেটা সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

কী বললে?

হ্যাঁ। এই বিশাল মহাকাশযান, এর দশ হাজার অধিবাসী প্রায় আঠাইশটি ভিন্ন ভিন্ন স্তর, বায়ুমণ্ডল পরিশোধণের ব্যবস্থা, কৃত্রিম মহাকর্ষ বল, জৈবিক বিভাগ, শক্তি সঞ্চয়, যোগাযোগ ব্যবস্থা সবকিছু এখন আলাদা আলাদাভাবে কাজ করছে। কিন্তু এর যে সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণটুকু ছিল সেটা প্রায় দশ বছর আগে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এই মহাকাশযানটি, এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে মহাকাশের ভেতর দিয়ে বিশাল একটা উপগ্রহের মতো ছুটে যাচ্ছে। আমাদের এখন এর নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। দশ হাজার মানুষের জন্যে সেটি প্রায় এক শতাব্দীর কাজ। আমাদের এত সময় নেই। আমাদের সেটা অর্ধ শতাব্দীর মাঝে শেষ করতে হবে। সেটি করার একটি মাত্র উপায়

মধ্যবয়স্ক মানুষটি হঠাৎ করে চুপ করে গেল, সে আশা করছিল আমরা কিছু বলব, কিন্তু আমরা কেউ কিছু বললাম না। মানুষটি কয়েকমুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, আমাদের সেটি করার একমাত্র উপায় হচ্ছে নিজেদের মাঝে এক ধরনের নেতৃত্ব সৃষ্টি করে কাজ শুরু করা। সেজন্যে শীতল ঘর থেকে সবাইকে জাগিয়ে তোলা শুরু হয়েছে।

আমি অনেক কষ্ট করে এতক্ষন নিজেকে শান্ত করে রেখেছিলাম এবারে আর পারলাম না। উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ক্রোধকে গোপন করার এতটুকু চেষ্টা না করে বললাম, তুমি কে আমি জানি না। কেন তুমি এখানে এসেছ তাও আমি জানি না কিন্তু আমার কাছে থেকে শুনে রাখ, আমি তোমার একটা কথাও বিশ্বাস করি না। তুমি কার নির্দেশে এইসব বলছ আমি জানি না, আমার জানার এতটুকু ইচ্ছেও নেই। আমি শীতল ঘরে ফিরে যাচ্ছি, পৃথিবীতে পৌঁছানোর আগে তুমি যদি আবার আমাকে জাগিয়ে তোলো আমি পরিস্কার ভাবে বলে দিচ্ছি সেটা তোমার জন্যে ভাল হবে না।

মধ্যবয়স্ক মানুষটি হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিল, সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না যে কেউ এভাবে তার সাথে কথা বলতে পারে। বার কয়েক চেষ্টা করে সে আবার কিছু একটা বলতে শুরু করল কিন্তু আমার আর শোনার ইচ্ছে হল না, লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম।

বাইরে দাঁড়িয়ে আমি কয়েকবার জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলাম। শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ানো গেলে নাকী রাগ কমে আসে। এত তাড়াতাড়ি এভাবে রেগে গেলাম কেন কে জানে। মানুষটি মিথ্যে কথা বলছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু তার জন্যে সে নিশ্চয়ই দায়ী নয়। আমি দেয়ালে হেলান দিয়ে বাইরে তাকালাম, যতদূর চোখ যায় একটা ধু ধু প্রান্তরের মতো, এর পুরোটা মানুষের তৈরী এখনো আমার বিশ্বাস হয় না।

আমি সামনে নেমে যাচ্ছিলাম ঠিক তখন পিছন থেকে একজন আমাকে ডাকল, কিহা!

আমি ঘুরে তাকালাম, আমার পাশে বসে থাকা ঝকঝকে চেহারার মেয়েটি আমার দিকে ছুটে আসছে। কাছে এস আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, আমার নাম লেন। তুমি সত্যি শীতল ঘরে ঘুমাতে যাচ্ছ?

আমি মেয়েটা দিকে তাকালাম, কী চমৎকার চেহারা মেয়েটির, যে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ার মেয়েটার চেহারা ডিজাইন করেছে তার রুচিবোধের তুলনা হয় না।

আমি বললাম, হ্যাঁ, আমি সত্যিই শীতল ঘরে ঘুমাতে যাচ্ছি।

তুমি ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতে চাও না?

না।

কেন?

কারণ আমি জানি এই মহাকাশযান বিশাল একটা প্রজেক্ট। যে কোনো মূল্যে এটাকে সমাপ্ত করা হবে–আমি সাহায্য করি আর নাই করি। এই মুহূর্তে পুরো ব্যাপারটির মাঝে বড় ধরনের ষড়যন্ত্র রয়েছে। বড় ধরনের নোংরামি। আমার নোংরামি ভাল লাগেনা। আমার ধারণা ছিল কয়েক হাজার বছর আগে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়াররা আমাদের ভেতর থেকে সব নোংরামো সরিয়ে নিয়েছে।

লেন খিলখিল করে হেসে ফেলল, বলল, তুমি একেবারে ছেলেমানুষ! তুমি সত্যিই বিশ্বাস কর জিনেটিক ইঞ্জিনিয়াররা ভাল মানুষ তৈরি করছে?

আমি লেনের দিকে তাকিয়ে বললাম, তারা যে ভাল চেহারার মানুষ তৈরি করছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই!

চেহারা তৈরি করা সহজ! আমি আমার জিনেটিক প্রোফাইল ঘেঁটে দেখেছি। তাদের হিসেব অনুযায়ী আমি খুব উন্নত ধরনের মানুষ। কিন্তু তুমি শুনলে অবাক হয়ে যাবে আমার মাঝে মাঝে কী জঘন্য ধরনের কাজ করার ইচ্ছে করে!

যেরকম?

মেয়েটি মাথা নাড়ল, সেগুলি তোমাকে বলা যাবে না! তুমি শুনলে আমাকে নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে ধরিয়ে দেবে।

অন্যায় কাজ করার ইচ্ছে করা আর অন্যায় করা এক জিনিস নয়। ফ্যান্টাসি গ্রহণযোগ্য জিনিস।

লেন হাত নেড়ে বলল, সেটা নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করতে পারব, এখন কাজের কথা বলা যাক। তুমি সত্যিই শীতল ঘরে যেতে চাইছ?

তুমি দ্বিতীয়বার প্রশ্নটা করলে। ব্যাপার কী?

আমি তোমার সাথে একমত যে আমাদের সাহায্য ছাড়াই এই মহাকাশযান পৃথিবীতে পৌঁছে যাবে। যারা এটা নিয়ন্ত্রণ করছে এটা তাদের দায়িত্ব। কিন্তু এই যে নেতৃত্বের ব্যাপারটা–

আমি অবাক হয়ে লেনের দিকে তাকালাম, নেতৃত্বের কোনো ব্যাপারটা?

লেন মনে হল একটু লজ্জা পেয়ে গেল। একটু ইতস্তত করে বলল, এই যে নেতৃত্বের কথা বলছে সেটা নিয়ে আমার খুব কৌতূহল। আমার খুব জানার ইচ্ছে যে মানুষ যদি খুব উচ্চাকাক্ষী হয় তাহলে সত্যিই কি স্বার্থপর হয়ে যায়? নিজের সিদ্ধান্ত সেটা ভাল হোক আর খারাপ হোক অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়? অন্যেরাও

সেটা মুখ বুজে মেনে নেয়?

আমি মাথা নাড়ালাম, নিশ্চয়ই তাই হয় লেন।

এখানেও কি তাই হচ্ছে?

আমার মনে হয় হচ্ছে। গত দশ বছর থেকে এখানে মানুষকে শীতল ঘর থেকে জাগিয়ে তোলা হচ্ছে। তাদেরকে বলা হচ্ছে নেতৃত্ব দিতে। কাজেই আমি নিশ্চিত এই মহাকাশযানটা এখন ছোট ছোট অংশে ভাগ হয়ে গেছে। প্রত্যেকটা অংশে একজন করে নেতা রয়েছে। তারা সবাই আরো বড় অংশের নেতৃত্বের জন্যে যুদ্ধ করছে।

যুদ্ধ?

হ্যাঁ। হয়তো সত্যিকার অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ নয়। কৌশল দিয়ে যুদ্ধ। ছল চাতুরী দিয়ে যুদ্ধ। কিন্তু যুদ্ধ নিশ্চয়ই হচ্ছে।

লেনের চোখ চকচক করতে থাকে। সে একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, আমি ব্যাপারটা দেখতে চাই।

আমার মনে হয় ব্যাপারটা কুৎসিত। প্রাচীন কালে মানুষের নেতৃত্বের প্রয়োজন। ছিল। মানুষ যত উন্নত হয়েছে নেতৃত্বের প্রয়োজন তত কমে এসেছে। এখন আসলে নেতৃত্বের কোনো প্রয়োজন নেই।

কিন্তু এই মহাকাশযানে তো নেতৃত্বের প্রয়োজন তৈরি করা হয়েছে।

এটা কৃত্রিম। আমার ধারণা কেউ একজন আমাদের নিয়ে একটা পরীক্ষা করছে। ভয়ংকর একটা পরীক্ষা।

লেন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি দেখতে চাই পরীক্ষা কেমন ভাবে করা হয়। কেমন জানি একটা কৌতূহল। হয়তো দূষিত কৌতূহল, কিন্তু কৌতূহল।

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, কৌতূহল কখনো দূষিত হয় না লেন। কৌতূহল অনাবশ্যক হতে পারে, কিন্তু দূষিত নয়।

লেন আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার কোনো কৌতূহল নেই?

আমি মাথা নাড়লাম, না। নেই। আমি শীতল ঘরে গিয়ে আবার ঘুমিয়ে যেতে চাই। শান্ত নিরুপদ্রব ঘুম। আমি জেগে উঠতে চাই পৃথিবীতে। আমার জীবনীশক্তি আমি এই মহাকাশযানে অপচয় করতে চাই না। আমি সেটা পৃথিবীর জন্যে বাঁচিয়ে রাখতে চাই।

লেন কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি প্রথমবার লক্ষ করলাম তার চোখ দুটি আশ্চর্য রকম নীল–ঠিক পৃথিবীর মতো।