২৩ মার্চ, ১৯০০ খ্রীঃ সান্ ফ্রান্সিস্কো শহরে প্রদত্ত।
মানুষকে সর্বপ্রথম যাহা তাহার নিজের অপেক্ষা উচ্চতর শক্তিসমূহের বিষয় চিন্তা করিতে প্ররোচিত করিয়াছিল, উহা ভয় অথবা কৌতূহল, তাহা আমাদিগের আলোচনা করিবার প্রয়োজন নাই। এই ভাবগুলি হইতে মানুষের মনে বিশেষ বিশেষ পূজার প্রবৃত্তি উদ্ভূত হইয়াছিল। মানবেতিহাসে এমন কোন সময় খুঁজিয়া পাওয়া যায় না, যখন কোন না কোন প্রকার পূজার আদর্শ বর্তমান নাই। ইহার কারণ কি? কেন আমরা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর বাহিরে কোন কিছুর উপলব্ধির জন্য এত ব্যাকুল হই? মনোরম প্রভাতের স্পর্শেই হউক অথবা মৃত আত্মার ভয়েই হউক, কেন আমরা অতীন্দ্রিয়ের আবেশ অনুভব করি? … প্রাগৈতিহাসিক যুগে যাইবার প্রয়োজন নাই, কেননা এই ব্যাপারটি দুই হাজার বৎসর আগেও যেমন ছিল, আজও সেইরূপ বর্তমান। আমরা এখানে পরিতৃপ্তি খুঁজিয়া পাই না। যে অবস্থাতেই আমরা থাকি না কেন, প্রচুর ক্ষমতা এবং ধনৈশ্বর্য সত্ত্বেও কিসের যেন একটা অতৃপ্তি আমাদিগকে চঞ্চল করে।
বাসনা অনন্ত। উহার চরিতার্থ কিন্তু খুবই সীমাবদ্ধ। আমাদের চাওয়ার আর শেষ নাই, কিন্তু যাহা চাই তাহা যখন পাইতে যাই, তখনই সঙ্কট উপস্থিত হয়। আদিম মানুষের ক্ষেত্রেও এইরূপ ঘটিত। তাহার আকাঙ্ক্ষা যদিও ছিল স্বল্প, তবু উহা সে মিটাইতে পারিত না। এখন আমাদের শিল্প-বিজ্ঞানের কত উন্নতি ও বৈচিত্র্য হইয়াছে, তথাপি আমাদের চাহিদা দূর হইতেছে না। একদিকে বাসনা পরিপূর্তির উপায়গুলিকে আমরা নিপুণতর করিয়া চলিয়াছি, অপরদিকে বাসনাও ক্রমাগত বৃদ্ধি পাইতেছে।
আদিমতম মানুষ যে-সব জিনিষ নিজে সম্পন্ন করিতে পারিত না, তাহাদের জন্য স্বভাবতই বাহির হইতে সাহায্য চাহিত। … কোন কিছুর আকাঙ্ক্ষা জাগিয়াছে, অথচ উহা পাওয়া যাইতেছে না। অতএব বাহিরের শক্তিসমূহের সহায়তার দিকে তাহাকে তাকাইতে হইত। সে-কালের সেই অজ্ঞ আদিম মানুষ আর বর্তমানের সুসভ্য মানুষ উভয়েই যখন ভগবানের কাছে কোন বাসনা-পরিপূর্তির জন্য মিনতি করিতেছে, তখন উভয়ে একই পর্যায়ে পড়ে। কোন পার্থক্য আছে কি? কেহ কেহ হয়তো বলিবেন, না, বহু পার্থক্য আছে। কিন্তু আমার মনে হয় এই ধারণা ভুল। বস্তুতঃ অনেক সময়েই আমরা সমলক্ষণ ব্যাপারসমূহের মধ্যে মনগড়া প্রভেদ খাড়া করি। আদিম মানুষ ও সভ্য মানুষ একই শক্তির নিকট প্রার্থনা জানাইতেছে। ঐ শক্তিকে তুমি ভগবান্ বা আল্লা বা যিহোবা যাহা খুশী বলিতে পার। মানুষ কিছু চায়, আর নিজের ক্ষমতায় যখন উহা আয়ত্ত করিতে পারে না, তখন কোন একজনের সাহায্য খুঁজে। এই প্রবৃত্তি আদিমকালে যেমন ছিল, এখনও সেইরূপ রহিয়াছে। … আমরা প্রত্যেকেই আদিম বর্বররূপে পৃথিবীতে আসি, ধীরে ধীরে নিজদিগকে সংস্কৃত করি। … নিজেদের হৃদয় অন্বেষণ করিলে এখানে আমরা প্রত্যেকেই এই সত্যটি ধরিতে পারিব। এখনও আমাদের অসহায়তার ভয় কাটে নাই। বড় বড় কথা আমরা বলিতে পারি, দার্শনিক বলিয়া খ্যাতিও লাভ করিতে পারি, কিন্তু জীবনে যখন আঘাত আসে, তখন আমরা দেখিতে পাই, আমরা আমরা কত দুর্বল, আমাদের সাহায্যের কত প্রয়োজন! যত কিছু কুসংস্কার প্রচলিত আছে, আমরা সবগুলিতেই বিশ্বাস করিতে থাকি। অবশ্য এমন কোন কুসংস্কার পৃথিবীতে নাই, যাহার কিছু না কিছু সত্য ভিত্তি আছে। ধরুন আমি যদি সারা মুখ ঢাকিয়া শুধু নাকের ডগাটি দেখাই, তবুও উহা তো আমার মুখেরই একটি অংশ। কুসংস্কার সম্বন্ধেও এইরূপ। একটি বৃহৎ সত্যের ক্ষুদ্র অংশগুলিও তুচ্ছ নয়। দেখুন, মৃত ব্যক্তিকে কবর দেওয়া ব্যাপারটি হইতেই ধর্মের নিম্নতম বিকাশ ঘটিয়াছিল। … প্রথমে মৃতদেহকে কাপড়ে জড়াইয়া ঢিবির ভিতর রাখিয়া দেওয়া হইত। মৃতব্যক্তির আত্মা রাত্রে আসিয়া ঢিবিতে বাস করে—ইহাই ছিল প্রচলিত বিশ্বাস। … তারপর আরম্ভ হইল ভূমিতে মৃতদেহ প্রোথিত করিবার রীতি। … কবরস্থানের দরজায় সহস্রদন্তী এক ভীষণা দেবী দাঁড়াইয়া! … ইহার পর আসিল মৃতদেহ দাহ করিবার প্রথা। ধারণা ছিল চিতাগ্নির শিখা আত্মাকে ঊর্ধ্বলোকে লইয়া যায়। … মিশরবাসীরা মৃতের জন্য খাদ্য এবং জল লইয়া যাইত।
ইহার পরবর্তী উল্লেখযোগ্য ভাব হইল গোষ্ঠীগত দেবতাদের ধারণা। একটি গোষ্ঠীর উপাস্য হইলেন এক দেবতা, অপর গোষ্ঠীর আরাধ্য অপর একজন দেবতা। য়াহুদী জাতির ঈশ্বর যিহোবা ছিলেন তাহাদের নিজস্ব জাতীয় দেবতা। ইনি অন্যান্য গোষ্ঠীর উপাসিত দেবতাদের সহিত যুদ্ধ করিতেন এবং তাঁহার আশ্রিত জাতির মঙ্গলের জন্য সব কিছু করিতে পারিতেন। তাঁহার আশ্রিত নয়—এমন একটি সমগ্র জাতিকেও যদি তিনি বিনষ্ট করিতেন, তাহাতে বলিবার কিছু ছিল না, তাহা ন্যায্য বলিয়াই বিবেচিত হইত। তিনি কিছু দয়াও অবশ্য দেখাইতেন, কিন্তু সে করুণা একটি ক্ষুদ্র মানবগোষ্ঠীর প্রতিই সীমাবদ্ধ ছিল।
ক্রমশঃ উচ্চতর আদর্শ দেখা দিল। বিজেতা জাতির যিনি অধিপতি, তাঁহাকে সকল দলপতির উপরে স্থান দেওয়া হইল। তিনি হইলেন দেবতাদেরও দেবতা। … পারসীকরা যখন মিশর জয় করে, তখন পারস্যের সম্রাটকে এইরূপ মনে করা হইত। দেব বা মানুষ কেহই তাঁহার সমকক্ষ নয়। এমন কি সম্রাটের দিকে দৃষ্টিপাত করা ছিল প্রাণদণ্ডযোগ্য অপরাধ।
ইহার পর দেখিতে পাই সর্বশক্তিমান্ পরমেশ্বরের ধারণা—যিনি সকল ক্ষমতার আধার, সর্বজ্ঞ এবং বিশ্বজগতের পালয়িতা। তাঁহার আবাসস্থান হইল স্বর্গ। মানুষের তিনিই বিশেষ আরাধ্য, সর্বাপেক্ষা প্রিয়, কেননা মানুষের জন্যই তিনি সব কিছুই সৃষ্টি করিয়াছেন। সারা পৃথিবী মানুষের ভোগের উদ্দেশ্যে সৃষ্ট। সূর্য, চন্দ্র, তারাসমূহ তাহারই জন্য।
এই-সব ধারণা যাহাদের, তাহাদের মন আদিম স্তরে রহিয়াছে, বলিতে হইবে। তাহাদের আদৌ সভ্য ও সংস্কৃত বলা চলে না। উচ্চতর ধর্মসমূ্হের প্রসার হয় গঙ্গা ও ইউফ্রাটিস নদীদ্বয়ের মধ্যবর্তী অঞ্চলে। ভারতবর্ষের বাহিরে স্বর্গবাসী ঈশ্বর-ধারণার অতিরিক্ত ধর্মের আর কোন গভীরতর বিকাশ আমরা দেখিতে পাই না। ভারতের বাহিরে উচ্চতম ঈশ্বরীয় জ্ঞান বলিতে এ পর্যন্ত ইহাই পাওয়া গিয়াছে। ঈশ্বর স্বর্গে বসিয়া আছেন আর বিশ্বাসীরা মৃত্যুর পর তথায় যাইবে। … আমার বিশ্লেষণে ইহাকে মানুষের একটি অত্যন্ত আদিম ধারণা বলা উচিত। আফ্রিকার মাম্বো-জাম্বো আর এই স্বর্গবাসী পিতা—একই কথা। তিনি জগৎকে চালিত করিতেছেন এবং অবশ্য তাঁহার ইচ্ছা সর্বত্র পূর্ণ হইতেছে।
প্রাচীন হিব্রুরা স্বর্গকে গ্রাহ্য করিত না। যীশুখ্রীষ্টকে তাহাদের না মানিবার ইহাই ছিল অন্যতম কারণ, কেননা তিনি মৃত্যুর পর জীবনের কথা বলিতেন। সংস্কৃত ভাষায় স্বর্গ-শব্দের অর্থ এই পৃথিবীর অতীত স্থান। অতএব পৃথিবীর যত কিছু অশুভ সংশোধনের স্থান হইল স্বর্গ। আদিম মানুষ অশুভের পরোয়া করে না। অশুভ কেন থাকিবে, ইহা লইয়া সে প্রশ্ন তুলে না।
… শয়তান শব্দটি পারসীক। … পারসীক এবং হিন্দুরা ধর্মের ক্ষেত্রে একই আর্য জাতির বিশ্বাসসমূহের উত্তরাধিকারী। তাহাদের ভাষাতেও ঐক্য ছিল—তবে এক জাতির ভাষায় ‘শুভ’বাচক শব্দগুলি অপর জাতির ভাষায় ‘অশুভ’ বুঝাইত। ‘দেব’ শব্দটি একটি প্রাচীন সংস্কৃত শব্দ, উহার অর্থ ঈশ্বর। পারসীক ভাষায় উহার অর্থ হইল শয়তান।
পরে মানুষের ধর্মবিষয়ক চিন্তা আরও বিকাশপ্রাপ্ত হইলে নানা জিজ্ঞাসা উপস্থিত হইল। ঈশ্বরকে বলা হইতে লাগিল মঙ্গলময়। পারসীকদের মতে বিশ্বসংসারের অধীশ্বর দুই জন—একজন শুভ, অন্যজন অশুভ। প্রথমে সব কিছুই ছিল সুন্দর—চিরবসন্তযুক্ত মনোরম দেশ, মৃত্যুহীন জীবন, ব্যাধিহীন শরীর। অতঃপর আবির্ভাব হইল অশুভের অধিকর্তার। ইনি ভূমি স্পর্শ করিলেন, সঙ্গে সঙ্গে আসিল ব্যাধি, মৃত্যু আবার মশক, ব্যাঘ্র, সিংহ প্রভৃতি ‘অনিষ্টকারী’ ও হিংস্র জন্তুসমূহ। অতঃপর আর্যগণ পিতৃভূমি পরিত্যাগ করিয়া দক্ষিণ অভিমুখে যাত্রা করেন। প্রাচীন আর্যেরা উত্তর অঞ্চলে বহুকাল ছিলেন। য়াহুদীরা শয়তানের ধারণা পারসীকদের নিকট হইতে পায়। পারসীকরাও শিক্ষা দিত যে, একদিন এই অশুভ ঈশ্বর বিনষ্ট হইবেন। আমাদের কর্তব্য হইল শুভ ঈশ্বরের পক্ষে থাকিয়া অশুভের অধীশ্বরের সহিত এই চিরন্তন সংঘর্ষে ঈশ্বরের শক্তি বৃদ্ধি করা। … সমস্ত পৃথিবী ভস্মীভূত হইবে এবং প্রত্যেকেই একটি নূতন দেহ পাইবে।
পারসীকদের ধারণা ছিল মন্দ লোকেরাও একদিন পবিত্রতা লাভ করিবে, তখন তাহাদের আর অশুভ প্রবৃত্তি থাকিবে না। আর্যদের প্রকৃতি ছিল স্নেহমমতাময় ও কবিত্বপ্রবণ। সেজন্য তাহারা অনন্তকাল নরকাগ্নিতে দহনের কথা ভাবিতে পারিত না। মৃত্যুর পর মানুষের নূতন শরীর হইবে। আর মৃত্যু হইবে না। ভারতের বাহিরে ধর্মের ধারণায় ইহাই হইল চরম উৎকর্ষ। উহার সহিত নৈতিক উপদেশও রহিয়াছে। মানুষের কর্তব্য তিনটি বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া—সচ্চিন্তা, সদ্বাক্য এবং সৎকার্য। এই মাত্র। ইহা একটি কার্যকর ও জ্ঞানগর্ভ ধর্ম। ইহার মধ্যে কিছু কবিত্বেরও আবির্ভাব ঘটিয়াছে, কিন্তু কবিত্ব ও চিন্তাধারার উচ্চতর পরিণতি আছে।
ভারতে বেদের প্রাচীনতম অংশে এই শয়তানের ঈষৎ প্রসঙ্গ দেখিতে পাওয়া যায়। তবে তাহার প্রভাব থায়ী নয়, একবার দেখা দিয়াই সে যেন গা ঢাকা দিয়াছে। বেদে অশুভের জনক এই শয়তান যেন একটি প্রহার খাইয়া পলায়ন করিয়াছে। ভারত হইতে শয়তান যখন চলিয়া গেল, তখন পারসীকরা তাহাকে গ্রহণ করিল। আমরা তাহাকে পৃথিবী হইতে একেবারে বিতাড়িত করিবার চেষ্টা করিতেছি। পারসীকদের ধারণা লইয়া আমরা তাহাকে একটি সুসভ্য ভদ্রলোকে পরিণত করিতে চাই। তাহাকে আমরা একটি নব কলেবর দিব। ভারতের শয়তানের ইতিবৃত্ত এইখানে শেষ হইল।
কিন্তু পরমেশ্বরের ধারণা আগাইয়া চলিল। তবে এখানে আর একটি ঘটনা মনে রাখিতে হইবে। ঈশ্বরের ধারণার সঙ্গে সঙ্গে মানবীয় প্রতাপের ধারণাও বাড়িয়া চলিয়া অবশেষে পারস্যসম্রাটের মহামহিমায় গিয়া ঠেকিয়াছিল। কিন্তু অন্যদিকে, তত্ত্ববিদ্যা ও দর্শনের উদ্ভব হইল। মানুষের আভ্যন্তরীণ সত্য—আত্মার ধারণা দেখা দিল এবং উহার ক্রমবিকাশ ঘটিতে লাগিল। ভারতবর্ষের বাহিরে অন্যান্য জাতির ঈশ্বরের ধারণা একটি বস্তুনিষ্ঠ আকারে গিয়া থামিয়াছিল। ভারত এই ধাপ খানিকটা অতিক্রম করিতে তাহাদিগকে সাহায্য করিয়াছিল। এই দেশে (আমেরিকায়) লক্ষ লক্ষ লোক বিশ্বাস করে যে, ঈশ্বরের একটি দেহ আছে। … গোটা সম্প্রদায় এইরূপ বলে। তাহাদের ধারণা, ঈশ্বর সমগ্র জগতের শাসক, কিন্তু একটি বিশেষ স্থান আছে, যেখানে তিনি সশরীরে বাস করিতেছেন। তিনি একটি সিংহাসনের উপর বসিয়া আছেন। সেখানে প্রদীপ জ্বালিয়া দেওয়া হয়, সেই রাজাধিরাজের উদ্দেশ্যে গান গাওয়া হয়—যেমন পৃথিবীর মন্দিরে আমরা করি।
ভারতে কিন্তু উপাসকদের যথেষ্ট কাণ্ডজ্ঞান ছিল। যাহার ফলে তাহারা ঈশ্বরকে কখনও দেহধারী করিয়া তুলে নাই। ভারতে ব্রহ্মের কোন মন্দির দেখিতে পাইবে না। ইহার কারণ এই যে, আত্মার ধারণা ভারতে সর্বদাই বিদ্যমান ছিল। হিব্রুজাতি কখনও আত্মা সম্বন্ধে প্রশ্ন করে নাই। বাইবেলের ‘পুরাতন সমাচারে’ আত্মার কোন কথা পাওয়া যায় না। ‘নূতন সমাচরে’ই উহা প্রথম দেখি। পারসীকরা ছিল আশ্চর্যরকমে করিতকর্মা, যুদ্ধপ্রিয়, বিজেতা জাতি। তাহারা যেন বর্তমান ইংরেজদের প্রাচীন সংস্করণ—প্রতিবেশী জাতিদের সহিত সর্বদা যুদ্ধ করিয়া তাহাদিগকে ধ্বংস করিতেছে। এই ধরনের ব্যাপারে তাহারা এত ব্যস্ত থাকিত যে, আত্মার সম্বন্ধে চিন্তা করিবার তাহাদের ফুরসত ছিল না।
আত্মার প্রাচীনতম ধারণা ছিল এই যে, উহা স্থূলদেহের অভ্যন্তরে একটি সূক্ষ্ম শরীর- বিশেষ। স্থূলদেহ বিনাশ পাইলে সূক্ষ্মদেহের আবির্ভাব ঘটে। মিশরদেশে বিশ্বাস ছিল যে, সূক্ষ্মদেহেরও মৃত্যু আছে। স্থূলদেহের বিকার ঘটিলে সূক্ষ্মদেহেরও বিশ্লেষ হইতে থাকে। এইজন্য মিশরের পিরামিড নির্মিত হইয়াছিল—যাহাতে মৃত ব্যক্তি অমৃতত্ব লাভ করিতে পারে, এই আশায়। পিরামিডে রক্ষিত মৃতদেহকে আরক প্রভৃতির সহায়ে সতেজ রাখিবার চেষ্টা করা হইত।
ভারতবাসীদের মৃতদেহের প্রতি কোন দৃষ্টি নাই। তাহাদের ভাব এইঃ শবটিকে কোথাও লইয়া গিয়া পুড়াইয়া ফেলা যাক। পুত্রকে পিতার মৃতদেহে অগ্নিসংযোগ করিতে হয়।
মানুষ দুই প্রকৃতির—দৈব ও আসুর। যাহারা দৈব প্রকৃতির তাহারা নিজদিগকে চৈতন্যময় আত্মা বলিয়া ভাবে। আসুর প্রকৃতির মানুষ মনে করে তাহারা দেহ। ভারতের প্রাচীন দার্শনিকগণ শিক্ষা দিতেন, শরীরের কোন অপরিণামী সত্তা নাই। ‘কোন ব্যক্তি যেমন পুরাতন বস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া নূতন বস্ত্র পরিধান করে, মানবাত্মাও সেইরূপ জীর্ণদেহ ছাড়িয়া দিয়া আর একটি নূতন দেহ গ্রহণ করে।’ আমার ক্ষেত্রে আমার পরিবেষ্টনী ও শিক্ষাদীক্ষা আমাকে ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গীর বিপরীত দিকে লইয়া যাইবার জন্য উন্মুখ ছিল, কেননা আমি সদাই মুসলমান ও খ্রীষ্টানদের সহিত সংশ্লিষ্ট ছিলাম। উহারা দেহের প্রতি অধিক মনোযোগী।
দেহ হইতে আত্মা তো মাত্র একটি ধাপ। ভারতে আত্মার আদর্শের উপর খুব ঝোঁক দেওয়া হইত। ঈশ্বরের ধারণার সহিত আত্মার ধারণা এক হইয়া গিয়াছিল! আত্মার ধারণাকে যদি প্রসারিত করা যায়, তাহা হইলে আমাদিগকে এই সিদ্ধান্তে আসিতেই হইবে যে, আত্মা নাম ও রূপের অতীত। … ভারতীয় শিক্ষা হইল এই যে, আত্মা নাম নিরবয়ব। যাহা কিছুর আকৃতি আছে, তাহা কোন না কোন সময়ে বিনষ্ট হইবে। জড়ভূত ও শক্তির সমবেত কার্য বিনা কোন আকৃতির উদ্ভব হইতে পারে না। আর সকল সংহত বস্তুরই তো বিশ্লেষ অবশ্যম্ভাবী। অতএব তোমার আত্মার যদি নাম ও রূপ স্বীকার কর, তবে আর তুমি অমর নও, তুমি মৃত্যুর অধীন। আত্মা যদি স্থূল দেহের অনুরূপ একটি সূক্ষ্মদেহমাত্র হয়, তাহা হইলে আকৃতিমান্ বলিয়া উহা প্রকৃতির অন্তর্গত এবং প্রকৃতির জন্মমৃত্যুর নিয়মও উহার প্রতি প্রযুক্ত হইবে। … ভারতের ঋষিরা উপলব্ধি করিয়াছেন—আত্মা মন নয়, সূক্ষ্মদেহও নয়।
চিন্তাসমূহ নিয়ন্ত্রিত ও সংযত করা যায়। … মনঃসংযমকে কতদূর লইয়া যাওয়া যায়, ভারতীয় যোগীরা তাহা নির্ণয় করিবার উদ্দেশ্যে সাধনা করিয়াছেন। কঠোর অভ্যাস দ্বারা চিন্তার গতিকে সম্পূর্ণ নিশ্চল করা যায়। মনই যদি মানুষের প্রকৃত স্বরূপ হইত, তাহা হইলে চিন্তার ঊর্ধ্বে মানুষের মৃত্যু ঘটিত। ধ্যানে চিন্তা বিলুপ্ত হয়, মনের উপাদানগুলিও সর্বতোভাবে স্তিমিত হইয়া যায়। রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসও রুদ্ধ হয়, কিন্তু সাধকের তো মৃত্যু হয় না। যদি চিন্তা সমষ্টির উপর তাঁহার জীবন নির্ভর করিত, তাহা হইলে ঐরূপ অবস্থায় তাঁহার দেহ-মন-সংঘাতটির বিনাশই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁহারা দেখিয়াছেন, ঐরূপ ঘটে না। ইহা পরীক্ষিত সত্য। অতএব তাঁহারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছিলেন যে, মন ও মনের চিন্তারাশি প্রকৃত মানুষ নয়। বিচার করিয়াও দেখা গেল যে, মন কখনও মানুষের আত্মা হইতে পারে না।
আমি চলি, চিন্তা করি, কথা বলি। এই-সমস্ত কাজের মধ্যে একটি একতার সূত্র রহিয়াছে। চিন্তা ও কর্মরাশির অসংখ্য বৈচিত্র্য আমরা দেখিতে পাই, কিন্তু সকল বৈচিত্র্যের মধ্যে অনুস্যূত অপরিবর্তনীয় একটি সত্তা বিরাজ করিতেছে। সেই সত্তা কখনও শরীর হইতে পারে না। শরীর তো প্রতি মিনিটে পরিবর্তনশীল। উহা মনও হইতে পারে না, কেননা মনেও তো অজস্র নূতন নূতন চিন্তা সর্বদাই উঠিতেছে। ঐ একত্বের ভিত্তি শরীর-মনের যুগ্ম সংহতি, ইহাও বলা চলে না। শরীর, মন ও সংহতি প্রকৃতির অন্তর্গত এবং প্রকৃতির নিয়মের অধীন। মন যদি মুক্তই হয়, তাহা হইলে সে …
অতএব যিনি প্রকৃত মানুষ, তিনি প্রকৃতির এলাকার মধ্যে নন। ইনি সেই অপরিবর্তনীয় চৈতন্যময় পুরুষ—যাহার দেহ ও মন অবশ্য প্রকৃতির অধীন। ইনি প্রকৃতিকে ব্যবহার করিতেছেন, যেমন তোমরা এই চেয়ারটি, এই কলমটি এবং এই কালিকে ব্যবহার কর। ইনিও সেইরূপ প্রকৃতির সূক্ষ্ম ও স্থূল আকৃতিকে কাজে লাগাইতেছেন। স্থূল আকৃতি হইল দেহ, সূক্ষ্ম আকৃতি মন। ইনি নিজে নিরবয়ব, সর্বপ্রকার আকৃতিহীন। আকারসমূহ প্রকৃতিতে। প্রকৃতির পারে যিনি, তাঁহার স্থূল বা সূক্ষ্ম—কোন আকার থাকিতে পারে না। তিনি নিশ্চয়ই অরূপ। তাঁহাকে সর্বব্যাপীও হইতে হইবে। ইহা হৃদয়ঙ্গম করা প্রয়োজন। টেবিলের উপর এই গ্লাসটির কথা ধর। গ্লাস একটি আকার, টেবিলটিও একটি আকার। ইহারা যখন ভাঙিয়া যায়, তখন গ্লাসত্বের এবং টেবিলত্বের অনেকখানিই চলিয়া যায়।
আত্মার কোন রূপ নাই বলিয়া কোন নামও নাই। ইনি যেমন এই গ্লাসটির মধ্যে ঢুকিবেন না, সেইরূপ স্বর্গেও যাইবেন না, নরকেও নয়। যে আধারে ইনি বর্তমান, সেই আধারের রূপ ইনি গ্রহণ করেন। আত্মা যদি দেশে (space) না থাকেন, তাহা হইলে দুইটি বিকল্প সম্ভবপর। হয় তিনি দেশে অনুস্যূত অথবা দেশ তাঁহাতেই অবস্থিত। তোমার দেহ দেশে অবস্থান করিতেছে বলিয়া তোমার একটি আকার অবশ্যই প্রয়োজন। দেশ আমাদিগকে সীমাবদ্ধ করে, আমাদিগকে যেন বাঁধিয়া ফেলে এবং আমাদিগের উপর একটি আকৃতি চাপাইয়া দেয়। পক্ষান্তরে তুমি যদি দেশে অবস্থান না কর তো দেশ তোমাতেই বিদ্যমান। সকল স্বর্গ, সকল পৃথিবী সেই চৈতন্যময় পুরুষে অবস্থিত।
ঈশ্বর সম্বন্ধেও এইরূপ হইতে বাধ্য। ঈশ্বর সর্বত্র বিদ্যমান। ‘হস্ত না থাকিলেও তিনি সমস্ত বস্তু ধারণ করেন, পদবিহীন হইলেও তিনি সর্বত্র বিচরণ করেন।’ … তিনি নিরাকার, মৃত্যুহীন, অনন্ত। ঈশ্বরের এইরূপ ধারণা বিকাশপ্রাপ্ত হইল। … তিনি সকল আত্মার অধীশ্বর, যেমন আমার আত্মা আমার এই দেহের অধিপতি। আমার আত্মা যদি দেহ ছাড়িয়া যান, তাহা হইলে দেহ এক মুহূর্তও বাঁচিতে পারে না। সেইরূপ পরমাত্মা যদি আমার আত্মা হইতে বিযুক্ত হন, আত্মার অস্তিত্ব সম্ভবপর নয়। তিনি বিশ্বভুবনের স্রষ্টা, আবার যাহা কিছু ধ্বংস হইতেছে, তাহারও সংহর্তা তিনিই। জীবন তাঁহার ছায়া, মৃত্যুও তাঁহার ছায়া।
প্রাচীন ভারতের দার্শনিকগণ মনে করিতেন, এই কলুষিত পৃথিবী মানুষের সমাদরের যোগ্য নয়। কি ভাল, কি মন্দ—কিছুই এখানে চিরস্থায়ী নয়।
আমি পূর্বে বলিয়াছি, শয়তান ভারতে বেশী সুযোগ পায় নাই। ইহার কারণ কি? কারণ এই যে, ধর্মচিন্তায় ভারতবাসী খুব সাহসী ছিল। তাহারা ধর্মের ক্ষেত্রে অবোধ শিশুর ন্যায় আচরণ করিতে চায় নাই। শিশুদের বৈশিষ্ট্য তোমরা লক্ষ্য করিয়াছ কি? তাহারা সর্বদাই অপরের উপর দোষ চাপাইতে চায়। শিশুমন ভুল করিলে অন্য কাহাকেও দোষী করিতে তৎপর। একদিকে আমরা চেঁচাই—‘আমাকে ইহা দাও, উহা দাও।’ অন্যদিকে বলি—‘আমি ইহা করি নাই। শয়তান আমাকে প্রলোভিত করিয়াছিল। সে-ই ইহার জন্য দায়ী।’ ইহাই মানুষের ইতিহাস—দুর্বল মানবজাতির ইতিবৃত্ত!
মন্দ আসিল কেন? জগৎ একটি জঘন্য নোংরা গর্তের মত কেন? আমরাই ঐরূপ করিয়াছি। অন্য কেহ দোষী নয়। আমরাই আগুনে হাত দিয়াছি বলিয়া হাত পুড়িয়া গিয়াছে। ভগবান্ আমাদিগকে আশীর্বাদ করুন। মানুষ যাহা পাইবার যোগ্য, তাহাই পায়। ভগবান্ তো করুণাময়। আমরা যদি তাঁহার নিকট প্রার্থনা করি, তিনি আমাদিগকে নিশ্চয়ই সাহায্য করেন। তিনি তো নিজেকে আমাদের মধ্যে বিলাইয়া দিতে প্রস্তুত।
ইহাই ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গী। ভারতবাসীর প্রকৃতি কাব্য-ঘেঁষা। কাব্যের জন্য তাহারা পাগল। তাহাদের দর্শনও কাব্য। যে দর্শনের কথা বলিতেছি, উহা একটি কবিতা। সংস্কৃত ভাষায় যাহা কিছু উচ্চচিন্তা, সবই কবিতায় লেখা। তত্ত্ববিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা—সবই কাব্য।
হাঁ, আমরাই দায়ী। আমরা দুঃখ পাই কেন? বলিতে পার, ‘আমি জন্মিয়াছি দুঃখী দরিদ্রের ঘরে। সারা জীবন কি কঠোর সংগ্রাম করিয়াছি, তাহা বেশ জানি।’ দার্শনিকেরা ইহার উত্তরে বলিবেনঃ হাঁ, এই দুঃখভোগের জন্য তুমিই দায়ী। যে দুঃখ ও দারিদ্র্যের কথা বলিলে, উহা কি অকারণ ঘটিয়াছে বলিতে চাও? তুমি তো যুক্তিবাদী। তোমার জীবনের ঘটনাসমূহের কারণ-পরম্পরা রহিয়াছে। উহার কেন্দ্র তুমিই। তুমিই সর্বক্ষণ তোমার জীবন নিয়ন্ত্রিত করিতেছ। … স্বীয় জীবনের ছাঁচ তোমারই গড়া। তোমার জীবন-গতির জন্য তুমি নিজেই দায়ী। কাহাকেও দোষ দিও না, কোন শয়তানকে আসামী খাড়া করিও না। তাহাতে তোমারই শাস্তির মাত্রা বাড়িবে।
এক ব্যক্তিকে মৃত্যুর পর ঈশ্বরের বিচার-সভায় হাজির করা হইল। ঈশ্বর তাহার শাস্তি ঠিক করিলেন—ত্রিশ ঘা বেত। অপর এক ব্যক্তি যে পৃথিবীতে নিজে কিছু উপলব্ধি না করিয়া ধর্মোপদেশ দিত, মৃত্যুর পর ঈশ্বরের বিচার-সভায় নীত হইলে ঈশ্বর হুকুম দিলেন—ইহার নিজের পাপের জন্য ত্রিশ ঘা বেত এবং অপরকে ভুল উপদেশ দিয়াছে বলিয়া আরও পনর ঘা বেত। ধর্মোপদেশ দেওয়ার এই বিপদ। আমার ভাগ্যে কি আছে, আমি জানি না। আমি তো পৃথিবীর সর্বত্র ধর্ম-বক্তৃতা করিয়া বেড়াই। যত লোক আমার উপদেশ শুনিয়াছে, প্রত্যেকের জন্য যদি আমাকে পনর ঘা বেত খাইতে হয়, তবে তো সমূহ বিপদ!২
আমাদিগকে এই ভাবটি বুঝিতে হইবে—ঈশ্বরের মায়া দৈবী। উহা তাঁহার ক্রিয়াশক্তি। শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলিয়াছেন, ‘আমার এই দৈবী মায়া দুরতিক্রমণীয়া। কিন্তু যাহারা আমার শরণ লয়, তাহারা মায়াকে অতিক্রম করিতে পারে।’ আমরা দেখিতে পাই যে, নিজেদের চেষ্টায় এই মায়ার মহাসমুদ্র পার হওয়া অত্যন্ত কঠিন; একপ্রকার অসম্ভব। সেই পুরাতন মুরগী ও ডিমের প্রশ্ন—কোন্টি আগে? যে-কোন কর্ম কর, উহা ফল প্রসব করিবে। কর্মটি কারণ, ফলটি হইল কার্য। কিন্তু ফলটি আবার তোমাকে নূতন কর্মে প্রবৃত্ত করে। এখানে ফলটি হইল কারণ, নূতন কর্মটি হইল কার্য। এইভাবে কার্য-কারণ-পরম্পরা চলিতে থাকে। একবার গতি আরম্ভ হইলে উহার আর বিরতি ঘটে না। ভাল বা মন্দ কোন কাজ করিলে উহার ক্রিয়া শুরু হইয়া যাইবে। উহা থামাইবার উপায় নাই। অতএব এই কর্মবন্ধন হইতে নিষ্কৃতি পাওয়া অতি কঠিন। কার্য-কারণের নিয়ম অপেক্ষা অধিকতর শক্তিশালী যদি কেহ থাকেন এবং তিনি যদি আমাদের উপর প্রসন্ন হন, তাহা হইলে তিনি আমাদিগকে কর্মচক্রের বাহিরে টানিয়া আনিতে পারেন।
আমরা বলি, এইরূপ একজন আছেন। তিনি ঈশ্বর—অসীম করুণাময়। তিনি আছেন বলিয়াই আমাদের মুক্তি সম্ভব। নিজের ইচ্ছাতে কি তুমি মুক্ত হইতে পার? ‘ঈশ্বর-কৃপায় মুক্তি’—এই মতবাদের অন্তর্নিহিত দর্শন বুঝিতে পারিতেছ কি? তোমরা পাশ্চাত্যবাসীরা খুব নিপুণ-বুদ্ধি—কিন্তু যখন তোমরা দার্শনিক তত্ত্বের ব্যাখ্যা করিতে বস, তখন সবই বড় জটিল করিয়া তোল। মুক্তি অর্থে যদি প্রকৃতির বাহিরে যাওয়া বুঝায়, তাহা হইলে কর্ম দ্বারা তোমরা কি করিয়া মুক্তিলাভ করিবে? মুক্তির অর্থ ঈশ্বরে অবস্থান। ইহা তখনই সম্ভব, যখন তুমি নিজের আত্মার প্রকৃত স্বরূপ চিনিতে পার—যে আত্মা প্রকৃতি ও তাহার যাবতীয় বিকার হইতে পৃথক্। এই আত্মাই ঈশ্বর—বিশ্বপ্রকৃতি এবং জীবনসমূহের মধ্যে ওতপ্রোত।
আমার ব্যষ্টি আত্মার সহিত আমার শরীরের যে সম্পর্ক, পরমাত্মার সহিত ব্যষ্টি আত্মাসমূহেরও সেই প্রকার সম্বন্ধ। আমরা ব্যষ্টিরা হইলাম পরমাত্মার দেহ। ঈশ্বর, আত্মা ও প্রকৃতি—তিনই এক। কিন্তু আমরা দেখিয়াছি, কার্য-কারণের নিয়ম প্রকৃতির প্রতিটি অংশে পরিব্যাপ্ত। প্রকৃতির ফাঁসে একবার আটকাইয়া পড়িলে আর বাহির হইয়া আসা যায় না। কার্য-কারণের নিয়মে একবার বদ্ধ হইলে সম্ভাব্য পরিত্রাণ তোমাদের অনুষ্ঠিত সৎকর্ম দ্বারা হইবার নয়। জগতের প্রত্যেকটি মাছির জন্য তোমরা হাসপাতাল নির্মাণ করিতে পার …এরূপ সৎকর্ম কখনই তোমাদিগকে মুক্তি দিবে না। এই-সব লোকহিতকর কীর্তিকলাপ গড়ে আবার ভাঙে। মুক্তিলাভ সম্ভবপর যদি এমন কেহ থাকেন যিনি কখনও প্রকৃতিতে বাঁধা পড়েন নাই, যিনি প্রকৃতির অধীশ্বর। প্রকৃতি তাঁহাকে অভিভূত করিতে পারে না, তিনিই প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রিত করেন। নিয়ম তাঁহাকে চালিত করে না, তাঁহারই ইচ্ছায় নিয়ম চালু হয়। … তিনি নিত্য বর্তমান, তাঁহার করুণার অন্ত নাই। যে মুহূর্তে তুমি তাঁহাকে ঠিক ঠিক খুঁজিবে, সেই মুহূর্তেই তিনি তোমাকে মুক্ত করিবেন। কেননা তিনিই যে তোমার প্রকৃত স্বরূপ।
কেন পরমাত্মা আমাদিগকে উদ্ধার করেন নাই? আমরা তাঁহাকে চাই নাই বলিয়া। আমরা তাঁহাকে ছাড়া অন্য সব কিছু চাই। তাঁহার জন্য যখনই প্রগাঢ় ব্যাকুলতা জাগিবে, তখনই তাঁহাকে দেখিতে পাইব। আমরা ভগবানকে বলি, ‘প্রভু, আমাকে একটি সুন্দর বাড়ী দাও, আমাকে স্বাস্থ্য দাও, এই বিপদটি কাটাইয়া দাও’ ইত্যাদি। মানুষ যখন তাঁহাকে ছাড়া আর কিছুই চায় না, তখনই তিনি দেখা দেন। একটি ভক্তের প্রার্থনাঃ
‘হে প্রভু, ধনী ব্যক্তির স্বর্ণ রৌপ্যের এবং অন্যান্য সম্পত্তির উপর যেমন প্রীতি, তোমার প্রতি আমার সেইরূপই ভালবাসা যেন জাগে। আমি পৃথিবী বা স্বর্গের সুখ চাই না, রূপ-যৌবন চাই না, বিদ্যা-গৌরব চাই না। মুক্তিও চাই না। বার বার যদি নরকে যাইতে হয়, তাহাতেও আমার ভয় নাই। কিন্তু আমার কাম্য শুধু একটি বস্তু—তোমাকে ভালবাসা—ভালবাসার জন্যই ভালবাসা—যাহার নিকট স্বর্গ অতি তুচ্ছ।’
মানুষ যাহা চায়, তাহাই পায়। যদি সর্বদা শরীরের ধ্যান কর, পুনরায় শরীর ধারণ করিতে হইবে। এই শরীরটি গেলে আবার একটি আসিবে, একটির পর একটি শরীর-পরিগ্রহ চলিতে থাকিবে। জড়ভূতকে ভালবাসিলে জড়ভূতেই আবদ্ধ হইয়া থাকিতে হইবে। প্রথমে আসে পশুজন্ম। একটি কুকুরকে যখন হাড় কামড়াইতে দেখি, তখন বলি, ‘ভগবান্, আমাদিগকে রক্ষা করুন—যেন কুকুর-জন্ম না হয়!’ অত্যন্ত দেহাসক্তির পরিণাম কুকুর বিড়াল হইয়া জন্মান। আরও যদি অবনত হও, তাহা হইলে খনিজ প্রস্তরাদি হইবে—শুধু জড়পিণ্ড, আর কিছু নয়।
অপর অনেক ব্যক্তি আছেন, যাঁহারা কোন আপস করিতে যাইবেন না। সত্যকে ধরিয়াই মুক্তিপথে যাওয়া যায়। ইহা হইল আর একটি মূলমন্ত্র। …
মানুষ যখন শয়তানকে লাথি মারিয়া দূর করিয়া দিল, তখনই তাহার যথার্থ আধ্যাত্মিক উন্নতি শুরু হইল। সে সাহসের সহিত খাড়া হইয়া দাঁড়াইল এবং সংসারের দুঃখকষ্টের দায়িত্ব নিজেরই স্কন্ধে লইল। পক্ষান্তরে যখনই সে ভূত-ভবিষ্যতের দিকে তাকাইয়াছে এবং কার্য-কারণের নিয়ম লইয়া মাথা ঘামাইয়াছে, তখনই তাহাকে নতজানু হইয়া কাঁদিয়া বলিতে হইয়াছে, ‘প্রভু, আমাকে বাঁচাও। তুমিই তো আমাদের স্রষ্টা ও পিতা, আমাদের পরম বন্ধু।’ ইহা কাব্য, তবে আমার মনে হয়, খুব উৎকৃষ্ট কাব্য নয়। ইহা যেন অনন্তকে রূপায়িত করা। প্রত্যেক ভাষায় এইরূপ অসীমকে রূপায়িত করিবার নিদর্শন আছে। কিন্তু এই অনন্ত যথার্থ অনন্ত নন—ইহা আমাদের ইন্দ্রিয়-স্পৃষ্ট অনন্ত—আমাদের মাংসপেশী-বিধৃত অনন্ত। …
‘তাঁহাকে সূর্য প্রকাশ করিতে পারে না, চন্দ্র বা তারকারাজি বা বিদ্যুৎও নয়।’৩ ইহা অনন্তের আর একপ্রকার চিত্রণ—নিষেধাত্মক ভাষায়। … উপনিষদের অধ্যাত্মবাদে অনন্তকে এইভাবে চরম বর্ণনা করা হইয়াছে। বেদান্ত পৃথিবীর শুধু শ্রেষ্ঠ দর্শনই নয়, ইহা শ্রেষ্ঠ কাব্যও বটে। …
এখন ভাল করিয়া লক্ষ্য করিও, বেদের প্রথম ও দ্বিতীয় অংশের মধ্যে পার্থক্য হইল এইঃ প্রথম ভাগের বিষয়বস্তু ইন্দ্রিয়বেদ্য জগৎ। বহির্জগতের আনন্ত্য, প্রকৃতি ও প্রকৃতির অধিকর্তা—ইহা লইয়াই বেদের প্রথম ভাগের ধর্মকর্ম। দ্বিতীয় ভাগ অর্থাৎ বেদান্তের অন্বেষ্টব্য ভিন্ন। এখানে মানব-মনীষা ঐ-সকলকে ছাড়াইয়া গিয়া অভিনব আলোকের সন্ধান পাইয়াছে। দেশগত আনন্ত্যে সে তৃপ্তি পায় নাই। উপনিষদের ঘোষণাঃ ‘স্বতঃবর্তমান পরমাত্মা মানুষের ইন্দ্রিয়নিচয়কে বহির্মুখ করিয়া গড়িয়াছেন। যাহাদের দৃষ্টি বাহিরে, তাহারা আন্তর সত্যের সন্ধান পায় না। তবে এমন কেহ কেহ আছেন, যাঁহারা সত্যকে জানিবার ইচ্ছায় নিজেদের দৃষ্টি ভিতরের দিকে ফিরাইয়া দিয়া অন্তরের অন্তরে প্রত্যাগাত্মার মহিমা উপলব্ধি করিয়াছেন।’৪
আত্মার আনন্ত্য দেশগত আনন্ত্য নয়, এই আনন্ত্যই যথার্থ আনন্ত্য—উহা দেশ ও কালের ঊর্ধ্বে। … পাশ্চাত্য এই দেশকালাতীত অধ্যাত্মজগতের সন্ধান পায় নাই। …তাহাদের মন বহিঃপ্রকৃতি এবং উহার অধীশ্বরের দিকেই নিয়োজিত। আপন অন্তরে তাকাইয়া হারান সত্যকে খুঁজিয়া বাহির কর। এই সংসার-স্বপ্ন হইতে মন কি দেবতাদের সহায়তা বিনা জাগিয়া উঠিতে পারে? একবার যদি সংসারের চাকা ঘুরিতে আরম্ভ করে, তাহা হইলে কৃপাময় পরমপিতা আমাদিগকে উহা হইতে বাহির করিয়া না আনিলে আমাদের উপায় নাই।
তবে করুণাময় ভগবানের নিকট গেলেও উহা চরম মুক্তি হইবে না। দাসত্ব দাসত্বই।সোনার শিকলও লোহার শিকলের ন্যায়ই বিপজ্জনক। নিষ্কৃতির পথ আছে কি?
না, তুমি বদ্ধ নও। কেহই কোন কালে বদ্ধ ছিল না। আত্মা সংসারের অতীত। আত্মাই সব। তুমিই সেই এক। দুই নাই। ঈশ্বর হইলেন মায়ার পর্দায় তোমারই প্রতিবিম্ব। আত্মাই প্রকৃত ঈশ্বর। মানুষ যাঁহাকে অজ্ঞানবশে পূজা করে, তিনি আত্মারই প্রতিবিম্ব। স্বর্গবাসী পিতাকে ভগবান্ বলা হয়। কিন্তু ভগবানের ভগবত্তা কিসে? তিনি তোমার নিজেরই প্রতিবিম্ব বলিয়া সর্বদা যে তুমি ভগবানকে দেখিতেছ, ইহা বুঝিতে পারিলে কি? তোমার যত বিকাশ ঘটে, সেই প্রতিবিম্বও তত স্পষ্টতর হইতে থাকে।
‘একই বৃক্ষে দুইটি সুন্দর পাখী৫ বসিয়া আছে। উপরের পাখীটি হইল স্থির, শান্ত, গম্ভীর। নীচেরটি কিন্তু সদা চঞ্চল—মিষ্ট ও তিক্ত ফল খাইয়া কখনও সুখী, কখনও দুঃখী।—জীবাত্মারূপী নীচের পাখীটি যখন পরমাত্মারূপী উপরের পাখীটিকে নিজের স্বরূপ বলিয়া বুঝিতে পারে, তখনই তাহার দুঃখের অবসান হয়।’
… ‘ঈশ্বর’ বলিও না; ‘তুমি’ বলিও না; বল ‘আমি’। দ্বৈতবাদের ভাষা হইল—‘হে ঈশ্বর, তুমি আমার পিতা।’ অদ্বৈতের ভাষা হইলঃ ‘আত্মা’ আমার নিজের অপেক্ষাও প্রিয়। অন্তরতম সত্যের কোন নাম আমি দিব না। নিকটতম শব্দ যদি কিছু থাকে, তাহা ‘আমি’। …
‘ঈশ্বরই সত্য। জগৎ স্বপ্নমাত্র। ধন্য আমি যে, আমি এই মুহূর্তে জানিতেছি—আমি চিরকালই মুক্ত ছিলাম, চিরকালই মুক্ত থাকিব। আমি যে পূজা করিতেছি, আমিই উহার লক্ষ্য। প্রকৃতি বা অজ্ঞান কোন কিছুই আমাকে অভিভূত করে নাই। প্রকৃতি আমা হইতে তিরোহিত, দেবতারা আমা হইতে তিরোহিত, পূজা … কুসংস্কার সবই আমা হইতে তিরোহিত। আমি আমাকে জানিতেছি। আমিই সেই অনন্ত। ইনি অমুক ভদ্রলোক, ইনি অমুক মহিলা; দায়িত্ব, সুখ, দুঃখ প্রভৃতি সব বুদ্ধিই লয় পাইয়াছে। আমিই সেই ভূমা। আমার মৃত্যু কি সম্ভবপর, অথবা জন্ম? কাহাকে আমি ভয় করিব? আমিই সেই এক। আমি কি নিজেকে ভয় করিব? অপর কে আছে, যাহা হইতে ত্রাস জন্মিবে? একমাত্র সত্তা আমিই। অপর কিছু নাই। আমিই সব।’
চাই শুধু নিজের চিরমুক্ত স্বরূপের স্মৃতি। কর্ম-সম্পাদ্য মুক্তি খুঁজিও না। ঐ মুক্তি কখনও পাওয়া যায় না। তুমি যে বরাবরই মুক্ত রহিয়াছ।
আবৃত্তি করিয়া চল—‘মুক্তোঽহম্’। যদি পরমুহূর্তে মোহ আসে এবং বলিতে হয় ‘আমি বদ্ধ’—তাহাতেও পিছাইও না। এই গোটা সম্মোহনটিকেই দূর করিয়া দাও।
এই তত্ত্ব প্রথমে শুনিতে হয়। শুনিয়া দিনের পর দিন উহা চিন্তা করিতে থাক। অহোরাত্র মন এই ভাবনা দ্বারা পরিপূর্ণ রাখ।
‘আমিই ঐ পরম সত্য। আমিই বিশ্বের অধিপতি। মোহ কখনও ছিল না।’ মনের সকল শক্তি দিয়া এইভাবে ধ্যান করিতে থাক, যত দিন না বাস্তবিক প্রত্যক্ষ কর যে, এই দেওয়ালগুলি, গৃহগুলি, চারিদিকের সব কিছু গলিয়া যাইতেছে, শরীর হইতে আরম্ভ করিয়া যাবতীয় বিষয় অদৃশ্য হইতেছে। ‘একাকী আমি দাঁড়াইয়া থাকিব। আমি সেই এক।’ চেষ্টা করিয়া চল। ভাবনা কিসের? আমরা চাই মুক্তি; অলৌকিক শক্তি আমাদের কাম্য নয়। সকল পৃথিবী আমরা ত্যাগ করিলাম; সকল স্বর্গ, সকল নরক আমরা তুচ্ছ করিলাম। অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা, এই ঐশ্বর্য, অমুক বিভূতি—এ-সকল লইয়া আমি কি মাথা ঘামাইব? মন বশীভূত হইল কি না হইল—তাহাতেই বা আমার কি আসে যায়? মন যদি দৌড়াইতে চায়, দৌড়াক। আমি তো মন নই, সে যথা রুচি চলুক।
সৎ অসৎ দুয়েরই উপর সূর্য সমভাবে কিরণ দেয়। কাহারও চোখের দোষের জন্য সূর্যের কি কোন হানি হয়? ‘সোঽহম্’। মন যাহা কিছু করে, তাহা আমাকে স্পর্শ করে না। অপরিচ্ছন্ন স্থানে সূর্যের আলোক পড়িলে সূর্য তো তাহা দ্বারা অপবিত্র হয় না। আমি সৎস্বরূপ।
ইহাই হইল অদ্বৈত-দর্শনের ধর্ম। ইহা কঠিন। কিন্তু সাধন করিয়া চল। সকল কুসংস্কার দূর করিয়া দাও। গুরু বা শাস্ত্র বা দেবতা বিদায় হউন। মন্দির, পুরোহিত, প্রতিমা, অবতার—এমন কি ঈশ্বরকে পর্যন্ত বিদায় দাও। ঈশ্বর বলিয়া যদি কেহ থাকেন, সে ঈশ্বর আমিই। সত্যান্বেষী দার্শনিকগণ, উত্তিষ্ঠত। অভীঃ। ঈশ্বর ও জগৎরূপ কুসংস্কারের কথা বলিও না। ‘সত্যমেব জয়তে।’ আর ইহাই সত্য। আমিই অনন্ত।
ধর্মের কুসংস্কারসমূহ অসার কল্পনামাত্র …। এই সমাজ—এই যে আমি তোমাদিগকে সম্মুখে দেখিতেছি, তোমাদের সহিত কথা বলিতেছি—এ সবই মিথ্যা প্রতীতি। এ সবই ত্যাগ করিতে হইবে। ভাবিয়া দেখ, তত্ত্বজ্ঞ দার্শনিক হইতে গেলে কি প্রয়োজন হয়! এই সাধনপ্রণালীকে জ্ঞানযোগ বলে—জ্ঞান বিচারের পথ। অন্যান্য পথ সহজ ও মন্থর … কিন্তু জ্ঞানপথে প্রচণ্ড মনের বল আবশ্যক। দুর্বল ব্যক্তির জন্য ইহা নয়। তোমার বলা চাইঃ
‘আমি আত্মা—নিত্যমুক্ত; আমার কখনও বন্ধন ছিল না। কাল আমাতে বিদ্যমান, আমি কালে নই। আমারই মনে ঈশ্বরের জন্ম। যাঁহাকে পিতা ঈশ্বর অথবা বিশ্বস্রষ্টা ঈশ্বর বলা হয়, তিনি আমারই মানস-সৃষ্ট।’
তোমরা যদি নিজেদের দার্শনিক বল তো কাজে উহা দেখাও। এই পরম সত্যের অনুধ্যান ও আলোচনা কর। পরস্পর পরস্পরকে এই পথে সাহায্য কর এবং সকল প্রকার কুসংস্কার বর্জন কর।