কিন্তু যাক সে কথা।
সেই রাত্রির কথায়ই ফিরে আসা যাক।
অন্ধকার ঘর।
কাঁচ করে মৃদু শব্দ হতেই চকিতে কিরীটী ঘুরে দাঁড়ালো।
কিরীটীর ঘরের দরজা ভেজানোই ছিল।
নিঃশব্দে সেই দরজার ভেজানো কপাট দুটো যেন ধীরে ধীরে একটু একটু খুলে যাচ্ছে।
রুদ্ধ নিঃশ্বাসে কিরীটী সেই দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
দরজাটা খুলছে।
একটু একটু করে খুলছে।
তারপরই দীর্ঘ একটা ছায়ামূর্তি ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল অন্ধকারে।
কে?
মিঃ রায় জেগে আছেন? আমি—
আসুন। কিন্তু কি ব্যাপার বৃন্দাবনবাবু, এত রাত্রে? ঘুমোননি?
না মিঃ রায়, ঘুম আসছে না।
দাঁড়িয়ে কেন বৃন্দাবনবাবু, বসুন ঐ চেয়ারটায়।
বৃন্দাবন সরকার কিন্তু বসলেন না। দাঁড়িয়েই রইলেন।
মিঃ রায়! একসময় মৃদুকণ্ঠে ডাকলেন।
বলুন?
আপনি আজ সন্ধ্যার সময় যা বললেন, সত্যিই কি আপনি তাই বিশ্বাস করেন?
কি?
এই বাড়িরই একজন—
আমার ধারণা তাই বৃন্দাবনবাবু। শান্তকণ্ঠে কিরীটী বলে কথাটা।
কিন্তু বিশ্বাস করুন, আপনি মিঃ রায়, আমি–
একটা কথার জবাব দেবেন বৃন্দাবনবাবু?
কি?
শকুন্তলা দেবী সম্পর্কে আপনার সত্যি কি ধারণা?
না-সি-সি ইজ বিয় অল ডাউটস!
কিন্তু একটা কথা কি আপনি জানেন বৃন্দাবনবাবু, বৃদ্ধ বয়সে আপনার কাকা সারদাবাবুর ঐ শকুন্তলার প্রতি তীব্র একটা আকর্ষণ জম্মেছিল?
আমি-আমি তা জানতে পেরেছিলাম মিঃ রায়—
জানতে পেরেছিলেন?
হ্যাঁ।
তাহলে কি আপনারও শকুন্তলার প্রতি মনে মনে–
না, আপনি বিশ্বাস করুন মিঃ রায়—
সেই বিশ্বাসের জোরেই তো বলছি–
এবার আর কোন প্রতিবাদই জানাতে পারেন না বৃন্দাবন সরকার। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন।
রাত অনেক হল, যান এবার ঘুমোবার চেষ্টা করুনগে বৃন্দাবনবাবু।
চোরের মতই যেন মাথা নীচু করে ঘর থেকে অতঃপর বৃন্দাবন সরকার বের হয়ে গেলেন।
অন্ধকারে নিঃশব্দে একবার হাসল কিরীটী।
তারপর আধ ঘণ্টাও অতিবাহিত হয়নি, কিরীটীর ঘরের ভেজানো দরজার কবাট দুটো পুনরায় নিঃশব্দে খুলে গেল।
কে?
আমি—
আসুন মধুসূদনবাবু। ঘুম হল না বুঝি? কিন্তু দাঁড়িয়ে কেন, বসুন।
মধুসূদন চেয়ারটার উপর উপবেশন করলেন।
মিঃ রায়।
বলুন?
এ কি হল মিঃ রায়! সত্যি আমার মত হতভাগ্য বুঝি এ জগতে আর কেউ নেই। দীর্ঘ দশ বছর পরে কত আশা নিয়েই না ঘরে ফিরেছিলাম, কিন্তু কোথা থেকে কি সব হয়ে গেল! ঐ বিজন-দিদি যখন মারা যায় ওর বয়স মাত্র আট কি দশ-ওকে আমিই বুকেপিঠে করে মানুষ করেছি। বাড়িতে ফিরে ও বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে শুনে ভেবেছিলাম আবার ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আসব। নিজে বিয়ে-থা করিনি, ও আমার সন্তানের মতই ছিল—কথাগুলো বলতে বলতে মধুসূদন সরকারের গলাটা ভারী হয়ে আসে, চোখের কোল দুটো অশ্রুতে সজল হয়ে ওঠে।
কি করবেন বলুন মধুসূদনবাবু, যা হবার হয়ে গিয়েছে।
না, না মিঃ রায়, এখনও আমি ভাবতেই পারছি না, বিজন নেই—হি ইজ ডেড, এ যেন এখনও স্বপ্নের মতই বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে। এখানে আর একটি মুহূর্ত আমি টিকতে পারছি না মিঃ রায়, অনুগ্রহ করে আমাকে এখান থেকে কাল সকালেই যাবার অনুমতি দিন। আর নয়—আমি আবার সেই মগের মুল্লুকেই ফিরে যাব। এখানে থাকলে সত্যিই বলছি পাগল হয়ে যাব।
কিন্তু যাকে আপনি প্রাণের চাইতেও ভালবাসতেন, তাকে যে এমনি করে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করলে, তাকে এত সহজে নিষ্কৃতি দেবেন?
দেবো না নিশ্চয়ই-এবং জানতে পারলে তাকে আমি গলা টিপে শেষ করতাম। উত্তেজনায় মধুসূদনের কণ্ঠস্বরটা কাঁপতে থাকে।
আর আপনার অনুরোধেই এই হত্যা-রহস্যের তদন্তের ভার আমি হাতে নিয়েছি। এক্ষেত্রে আপনিই যদি চলে যান তো আমার এখানে থাকার অর্থই হয় না মধুসূদনবাবু।
কিন্তু মিঃ রায়
শুনুন মিঃ সরকার, আমি মনে মনে একটা প্ল্যান করেছি, আর প্ল্যানটা যদি আমার সাকসেসফুল হয় তো দু-একদিনের মধ্যেই এ রহস্যের একটা হয়তো কিনারা করতে পারব বলে আশা করি।
কি প্ল্যান মিঃ রায়?
বসুন আপনি, আমি বলছি।
কিন্তু আপনি কি সত্যিই কাউকে এ ব্যাপারে সন্দেহ করেছেন মিঃ রায়?
অনুমান মাত্র। অনুমান অবিশ্যি ভুল হতে পারে, তাই আপনার সাহায্য নিয়ে আমার অনুমান সত্যি কি মিথ্যা যাচাই করে দেখতে চাই মিঃ সরকার একটিবার!
বেশ, বলুন। আমি আপনাকে সাধ্যমত আমার সাহায্য করতে প্রস্তুত আছি।
তারপর দুজনে বসে এক ঘণ্টা ধরে নানা আলোচনা করল।
আলোচনা-শেষে কিরীটী বললে, বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই আমার প্ল্যানটা?
হুঁ, বুঝেছি। কিন্তু—
আর কিন্তু নয় মিঃ সরকার-রাত প্রায় শেষ হয়ে এল, এবার শুতে যান।
মধুসূদন সরকার নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
পরের দিন প্রত্যুষে।
বেলা তখন প্রায় সাতটা হবে। সকলেই এসে গতরাত্রের মত উপরের লাইব্রেরী ঘরে জমায়েত হয়েছেন।
সকলের চোখ-মুখ দেখলেই বোঝা যায়, গতরাত্রে কারও চোখেই ঘুম ছিল না।
সকলের চোখ-মুখেই নিদ্রাহীন রাত্রি ও গত সন্ধ্যার দুর্ঘটনার উদ্বেগটা যেন স্পষ্ট হয়ে রয়েছে তখনও।
নিদারুণ উদ্বেগ, অশান্তি ও দুশ্চিন্তার মধ্যে যে সকলের রাত কেটেছে, কিরীটীর বুঝতে সেটা আদৌ কষ্ট হয় না সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে।
কারও মুখেই কোন কথা নেই। সকলেই যেন বোবা।
আজ অবিশ্যি সকলের মধ্যে শকুন্তলা দেবীও ছিল। কারণ কিরীটীর ইচ্ছাতেই তাকেও লাইব্রেরী ঘরে আসতে হয়েছিল।
সমস্ত ঘরের মধ্যে যেন একটা থমথমে বিষণ্ণ ভাব।
একসময় ভৃত্য গোকুলই গত সন্ধ্যার মত চায়ের ট্রেতে করে চা নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল। এবং গত সন্ধ্যার মতই দ্বিতীয়বার গিয়ে আবার গোকুল বাকি চায়ের কাপগুলো নিয়ে এল। তারপর প্রত্যেকের হাতে চায়ের কাপ তুলে দেওয়া হল।
চায়ের কাপ সকলেই হাতে নিল বটে, কিন্তু কিরীটী লক্ষ্য করলে, কারুরই যেন চায়ের কাপে চুমুক দিতে তেমন কোন আগ্রহই নেই আজ।
পুতুলের মতই যেন যে যার চায়ের কাপ হাতে বসে আছেন।
কিরীটী আরাম করে নিজের হস্তধৃত চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে মৃদুকণ্ঠে বললে, কি হল, সব চুপচাপ বসে কেন? চা খান! ভয় নেইনির্ভয়ে খান। কেউ যদি গতকাল চায়ের কাপে বিষ দিয়ে থাকে, আজ নিশ্চয়ই আবার সাহস পাবে না। তাছাড়া যিনিই গত সন্ধ্যায় বিজনবাবুর চায়ের কাপে বিষ দিয়ে থাকুন না কেন, আমার কাছে তিনি ধরা পড়ে গিয়েছেন।
সকলে যাঁরা ঘরের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, যেন চমকেই কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন ঐ কথার সঙ্গে সঙ্গে।
হ্যাঁ, আজ তাকে আমি চোখে-চোখেই রেখেছি। অতএব নির্ভয়ে সকলে চা পান করুন।
বৃন্দাবনবাবুই অতঃপর সর্বপ্রথম চায়ের কাপে চুমুক দিলেন।
তারপর ডাঃ অধিকারী। একে একে তারপর সকলেই যে যার চায়ের কাপে চুমুক দিলেন।
সর্বশেষে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন মধুসূদন সরকার।
এবং দুই চুমুক চা পান করবার পরই ঠিক গত সন্ধ্যার মতই অব্যক্ত একটা যন্ত্রণায় মুখ-চোখ বিকৃত করে মধুসূদন সরকার চেয়ারের উপর ঢলে পড়লেন সঙ্গে সঙ্গে।
তার হাত থেকে চায়ের কাপটা মেঝেতে পড়ে গেল।
সর্বাগ্রে বৃন্দাবন সরকারই চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে শঙ্কাজড়িত ব্যাকুলকণ্ঠে বলে উঠলেন, কি-কি হল?
ডাঃ অধিকারী বললেন, সর্বনাশ! আবার পয়েজন নাকি?
ঘরের আর সকলেই নির্বাক। আর প্রত্যেকের হাতেই তখন ধরা রয়েছে যাক যাঁর চায়ের কাপটি।
কিরীটী তার চায়ের কাপটা একপাশে নামিয়ে মধুসূদনবাবুর কাতরোক্তি শোনার সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়িয়েছিল, এবারে সে এগিয়ে এসে হতবাক বিমূঢ় সকলের দিকে বারেকের জন্য দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে নিঃশব্দে মধুসূদন সরকারকে স্পর্শ করে মৃদুকণ্ঠে বললে, হি ইজ ডেড!