ডেট্রয়েট ফ্রী প্রেস, ২৫ মার্চ, ১৮৯৪
কানন্দ গতরাত্রে ইউনিটেরিয়ান চার্চে-এ ‘ভারতীয় নারী’ সম্বন্ধে বক্তৃতা দেন। তিনি প্রাচীন ভারতের নারীগণের প্রসঙ্গে বলেন যে, শাস্ত্রগ্রন্থসমূহে তাঁহাদিগকে গভীর শ্রদ্ধা দেখান হইয়াছে। অনেক নারী ঋষিত্ব লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহাদের আধ্যাত্মিকতা তখন ছিল খুবই প্রশংসনীয়। প্রাচ্যের নারীগণকে প্রতীচ্যের আদর্শে বিচার করা ঠিক নয়। পাশ্চাত্যে নারী হইলেন পত্নী, প্রাচ্যে তিনি জননী। হিন্দুরা মাতৃভাবের পূজারী। সন্ন্যাসীদের পর্যন্ত গর্ভধারিণী জননীর সম্মুখে ভূমিতে কপাল ঠেকাইয়া সম্মান দেখাইতে হয়। ভারতে পবিত্রতার স্থান খুব উঁচুতে। কানন্দ এখানে যে-সব ভাষণ দিয়াছেন, তাহাদের মধ্যে একটি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। সকলে উহা খুব পছন্দ করিয়াছেন।
ডেট্রয়েট ইভনিং নিউজ, ২৫ মার্চ, ১৮৯৪
গতরাত্রে ইউনিটেরিয়ান চার্চে-এ স্বামী বিবে কানন্দের বক্তৃতার বিষয় ছিল—‘প্রাচীন, মধ্য ও বর্তমান যুগে ভারতীয় নারী’। তিনি বলেন, ভারতবর্ষে নারীকে ভগবানের সাক্ষাৎ প্রকাশ বলিয়া মনে করা হয়। নারীর সমগ্র জীবনে এই একটি চিন্তা তাঁহাকে তৎপর রাখে যে, তিনি মাতা; আদর্শ মাতা হইতে গেলে তাহাকে খুব পবিত্র থাকিতে হইবে। ভারতে কোন জননী কখনও তাহার সন্তানকে ত্যাগ করে নাই। বক্তা বলেন, ইহার বিপরীত প্রমাণ করিবার জন্য তিনি সকলকে আহ্বান করিতেছেন। ভারতের মায়েরা যদি আমেরিকান তরুণীদের মত শরীরের অর্ধেক ভাগ যুবকদের কুদৃষ্টির সামনে খুলিয়া রাখিতে বাধ্য হইত, তাহা হইলে তাহারা মরিয়া যাইত। বক্তা ইচ্ছা করেন যে, ভারতকে তাহার নিজস্ব আদর্শে বিচার করা উচিত, এই দেশের আদর্শে নয়।
ট্রিবিউন, ১ এপ্রিল, ১৮৯৪
স্বামী বিবে কানন্দের ডেট্রয়েটে অবস্থান কালে নানা কথোপকথনে তিনি ভারতীয় নারীগণ সম্পর্কে কতকগুলি প্রশ্নের উত্তর দেন। তিনি যে-সব তথ্য উপস্থাপিত করেন, তাহাতে শ্রোতাদের কৌতূহল উদ্দীপিত হয় এবং ঐ বিষয়ে সর্বসাধারণের জন্য একটি বক্তৃতা দিবার অনুরোধ আসে। কিন্তু তিনি বক্তৃতার সময় কোন স্মারকলিপি না রাখায় ভারতীয় নারী সম্বন্ধে পূর্বে ব্যক্তিগত কথোপকথনের সময় যে-সব বিষয় বলিয়াছিলেন, তাহা ঐ বক্তৃতায় বাদ পড়িয়া গিয়াছিল। ইহাতে তাঁহার বন্ধুবর্গ কিছুটা নিরাশ হন, কিন্তু তাঁহার মহিলা শ্রোতাদের মধ্যে জনৈক তাঁহার অপরাহ্নের কথোপকথনের কিছু প্রসঙ্গ সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন। উহা এখন হইতে সর্বপ্রথম সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য দেওয়া হইতেছেঃ
আকাশচুম্বী হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশে বিস্তীর্ণ সমতলভূমিতে আর্যগণ আসিয়া বসবাস করেন। এখনও পর্যন্ত ভারতে তাঁহাদের বংশধর খাঁটি ব্রাহ্মণ-জাতি বিদ্যমান। পাশ্চাত্য লোকের পক্ষে স্বপ্নেও এই উন্নত মানবগোষ্ঠীর ধারণা করা অসম্ভব। চিন্তায় কাজে এবং আচরণে ইঁহারা অতিশয় শুচি। ইঁহারা এত সাধুপ্রকৃতির যে, একথলি সোনা যদি প্রকাশ্যে পড়িয়া থাকে তো তাঁহাদের কেহ উহা লইবেন না। কুড়ি বৎসর পরেও ঐ থলিটি একই জায়গায় পাওয়া যাইবে। এই ব্রাহ্মণদের শারীরিক গঠনও অতি চমৎকার। কানন্দের নিজের ভাষায়ঃ ‘ক্ষেতে কর্মনিরতা ইঁহাদের একটি কন্যাকে দেখিলে মন বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়, আশ্চর্য হইয়া ভাবিতে হয়—ভগবান্ এমন অপরূপ সৌন্দর্যের প্রতিমা কি করিয়া গড়িলেন!’ এই ব্রাহ্মণদের অবয়ব-সংস্থান সুসম্বদ্ধ, চোখ ও চুল কৃষ্ণবর্ণ এবং গায়ের রঙ—আঙুল ছুঁচবিদ্ধ করিলে উহা হইতে একটি রক্তবিন্দু যদি এক গ্লাস দুধে পড়ে, তাহা হইলে যে রঙ সৃষ্ট হয়, সেই রঙের। অবিমিশ্র বিশুদ্ধ হিন্দু ব্রাহ্মণদের ইহাই বর্ণনা।
হিন্দু নারীর উত্তরাধিকারের আইন-কানুন সম্বন্ধে বক্তা বলেন, বিবাহের সময় স্ত্রী যে যৌতুক পান, উহা সম্পূর্ণ তাঁহার ব্যক্তিগত সম্পত্তি; উহাতে স্বামীর কখনও মালিকানা থাকে না। স্বামীর সম্মতি বিনা আইনতঃ তিনি উহা বিক্রয় বা দান করিতে পারেন। সেইরূপ অন্য সূত্রে, তথা স্বামীর নিকট হইতেও তিনি যে-সকল অর্থাদি পান, উহা তাঁহার নিজস্ব সম্পত্তি, তাঁহার ইচ্ছামত ব্যয় করিতে পারেন।
স্ত্রীলোক বাহিরে নির্ভয়ে বেড়াইয়া থাকেন। চারি পাশের লোকদের উপর তাঁহার পূর্ণ বিশ্বাস আছে বলিয়াই ইহা সম্ভব হয়। হিমালয়ে পর্দাপ্রথা নাই। ওখানে এমন অঞ্চল আছে যেখানে মিশনরীরা কখনও পৌঁছিতে পারেন না। এইসব গ্রাম খুবই দুর্গম। অনেক চড়াই করিয়া এবং পরিশ্রমে ঐ-সকল জায়গায় পৌঁছান যায়। এখানকার অধিবাসীরা কখনও মুসলমান-প্রভাবে আসে নাই। খ্রীষ্টধর্মও ইহাদের নিকট অজানা।