ইওরোপীরা যার এত বড়াই করে, সে ‘সভ্যতার উন্নতি’র (Progress of Civilization) মানে কি? তার মানে এই যে, উদ্দেশ্যসিদ্ধি—অনুচিত উপায়কে উচিত করে। চুরি, মিথ্যা এবং ফাঁসি অথবা ষ্টানলি (Stanley) দ্বারা তাঁর সমভিব্যাহারী ক্ষুধার্ত মুসলমান রক্ষীদের—এক গ্রাস অন্ন চুরি করার দরুন চাবকানো, এ-সকলের ঔচিত্য বিধান করে; ‘দূর হও, আমি ওথায় আসতে চাই’-রূপ বিখ্যাত ইওরোপী নীতি, যার দৃষ্টান্ত—যেথায় ইওরোপী-আগমন, সেথাই আদিম জাতির বিনাশ—সেই নীতির ঔচিত্য বিধান করে! এই সভ্যতার অগ্রসরণ লণ্ডন নগরীতে ব্যভিচারকে, পারিতে স্ত্রীপুত্রাদিকে অসহায় অবস্থায় ফেলে পালানোকে এবং আত্মহত্যা করাকে ‘সামান্য দৃষ্টান্ত’ জ্ঞান করে—ইত্যাদি।
এখন ইসলামের প্রথম তিন শতাব্দীব্যাপী ক্ষিপ্র সভ্যতাবিস্তারের সঙ্গে ক্রিশ্চানধর্মের প্রথম তিন শতাব্দীর তুলনা কর। ক্রিশ্চানধর্ম প্রথম তিন শতাব্দীতে জগৎসমক্ষে আপনাকে পরিচিত করতে সমর্থ হয়নি, এবং যখন কনষ্টাণ্টাইন (Constantine)-এর তলওয়ার একে রাজ্যমধ্যে স্থান দিলে, সেদিন থেকে কোন্ কালে ক্রিশ্চানী ধর্ম আধ্যাত্মিক বা সাংসারিক সভ্যতাবিস্তারের কোন্ সাহায্য করেছে? যে ইওরোপী পণ্ডিত প্রথম প্রমাণ করেন যে পৃথিবী সচলা, ক্রিশ্চানধর্ম তাঁর কি পুরস্কার দিয়েছিল? কোন্ বৈজ্ঞানিক কোন্ কালে ক্রিশ্চানী ধর্মের অনুমোদিত? ক্রিশ্চানী সঙ্ঘের সাহিত্য কি দেওয়ানী বা ফৌজদারী বিজ্ঞানের, শিল্প বা পণ্য-কৌশলের অভাব পূরণ করতে পারে? আজ পর্যন্ত ‘চর্চ’ প্রোফেন (ধর্ম ভিন্ন অন্য বিষয়াবলম্বনে লিখিত) সাহিত্য-প্রচারে অনুমতি দেন না। আজ যে মনুষ্যের বিদ্যা এবং বিজ্ঞানে প্রবেশ আছে, তার কি অকপট ক্রিশ্চান হওয়া সম্ভব? নিউ টেষ্টামেণ্ট (Testament)-এ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোন বিজ্ঞান বা শিল্পের প্রশংসা নেই। কিন্তু এমন বিজ্ঞান বা শিল্প নেই যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোরান বা হদিসের বহু বাক্যের দ্বারা অনুমোদিত এবং উৎসাহিত নয়। ইওরোপের সর্বপ্রধান মনীষিগণ—ইওরোপের ভলটেয়ার, ডারউইন, বুকনার, ফ্লমারিয়ঁ, ভিক্টর হুগো-কুল বর্তমানকালে ক্রিশ্চানী দ্বারা কটুভাষিত এবং অভিশপ্ত, অপরদিকে এই সকল পুরুষকে ইসলাম বিবেচনা করেন যে, এই সকল পুরুষ আস্তিক, কেবল ইহাদের পয়গম্বর-বিশ্বাসের অভাব। ধর্মসকলের উন্নতির বাধকত্ব বা সহায়কত্ব বিশেষরূপে পরীক্ষিত হোক; দেখা যাবে ইসলাম যেথায় গিয়েছে, সেথায়ই আদিমনিবাসীদের রক্ষা করেছে। সে-সব জাত সেথায় বর্তমান। তাদের ভাষা, জাতীয়ত্ব আজও বর্তমান।
ক্রিশ্চানধর্ম কোথায় এমন কাজ দেখাতে পারে? স্পেনের আরাব, অষ্ট্রেলিয়ার এবং আমেরিকার আদিমনিবাসীরা কোথায়? ক্রিশ্চানেরা ইওরোপী য়াহুদীদের কি দশা এখন করছে? এক দানসংক্রান্ত কার্যপ্রণালী ছাড়া ইওরোপের আর কোন কার্যপদ্ধতি, গস্পেলের (Gospel) অনুমোদিত নয়—গস্পেলের বিরুদ্ধে সমুত্থিত। ইওরোপে যা কিছু উন্নতি হয়েছে, তার প্রত্যেকটিই ক্রিশ্চানধর্মের বিপক্ষে বিদ্রোহ দ্বারা। আজ যদি ইওরোপে ক্রিশ্চানীর শক্তি থাকত, তাহলে ‘পাস্তের’ (Pasteur) এবং ‘কক’-এর (Koch) ন্যায় বৈজ্ঞানিকসকলকে জীবন্ত পোড়াত এবং ডারউইন-কল্পদের শূলে দিত। বর্তমান ইওরোপে ক্রিশ্চানী আর সভ্যতা—আলাদা জিনিষ। সভ্যতা এখন তার প্রাচীন শত্রু ক্রিশ্চানীর বিনাশের জন্য পাদ্রীকুলের উৎসাদনে এবং তাদের হাত থেকে বিদ্যালয় এবং দাতব্যালয়সকল কেড়ে নিতে কটিবদ্ধ হয়েছে। যদি মূর্খ চাষার দল না থাকত, তাহলে ক্রিশ্চানী তার ঘৃণিত জীবন ক্ষণমাত্র ধারণ করতে সমর্থ হত না এবং সমূলে উৎপাটিত হত; কারণ নগরস্থিত দরিদ্রবর্গ এখনই ক্রিশ্চানী ধর্মের প্রকাশ্য শত্রু! এর সঙ্গে ইসলামের তুলনা কর। মুসলমান-দেশে যাবতীয় পদ্ধতি ইসলাম ধর্মের উপরে সংস্থাপিত এবং ইসলামের ধর্মশিক্ষকেরা সমস্ত রাজকর্মচারীদের বহুপূজিত এবং অন্য ধর্মের শিক্ষকেরাও সম্মানিত।
পাশ্চাত্য দেশে লক্ষী-সরস্বতীর এখন কৃপা একত্রে। শুধু ভোগের জিনিষ সংযোগ হলেই এরা ক্ষান্ত নয়, কিন্তু সকল কাজেই একটু সুচ্ছবি চায়। খাওয়া-দাওয়া ঘর-দোর সমস্তই একটু সুচ্ছবি দেখতে চায়। আমাদের দেশেও ঐ ভাব একদিন ছিল, যখন ধন ছিল! এখন একে দারিদ্র, তার ওপর আমরা ‘ইতোনষ্টস্ততোভ্রষ্টঃ’ হয়ে যাচ্ছি। জাতীয় যে গুণগুলি ছিল, তাও যাচ্ছে—পাশ্চাত্য দেশেরও কিছুই পাচ্ছি না! চলা-বসা কথাবার্তায় একটা সেকেলে কায়দা ছিল, তা উৎসন্ন গেছে, অথচ পাশ্চাত্য কায়দা নেবারও সামর্থ্য নেই। পূজা পাঠ প্রভৃতি যা কিছু ছিল, তা তো আমরা বানের জলে ভাসিয়ে দিচ্ছি, অথচ কালের উপযোগী একটা নূতন রকমের কিছু এখনও হয়ে দাঁড়াচ্ছে না, আমরা এই মধ্যরেখার দুর্দশায় এখন পড়ে।
ভবিষ্যৎ বাঙলাদেশ এখনও পায়ের উপর দাঁড়ায়নি। বিশেষ দুর্দশা হয়েছে শিল্পের। সেকেলে বুড়ীরা ঘরদোর আলপনা দিত, দেওয়ালে চিত্রবিচিত্র করত। বাহার করে কলাপাতা কাটত, খাওয়া-দাওয়া নানাপ্রকার শিল্পচাতুরীতে সাজাত, সে সব চুলোয় গেছে বা যাচ্ছে শীঘ্র শীঘ্র!! নূতন অবশ্য শিখতে হবে, করতে হবে, কিন্তু তা বলে কি পুরানোগুলো জলে ভাসিয়ে দিয়ে না কি? নূতন তো শিখেছ কচুপোড়া, খালি বাক্যিচচ্চড়ি!! কাজের বিদ্যা কি শিখেছ? এখনও দূর পাড়াগাঁয়ে পুরানো কাঠের কাজ, ইঁটের কাজ দেখে এস গে। কলকেতার ছুতোর এক জোড়া দোর পর্যন্ত গড়তে পারে না! দোর কি আগড় বোঝবার যো নেই!!! কেবল ছুতোরগিরির মধ্যে আছে বিলিতী যন্ত্র কেনা!! এই অবস্থা সর্ববিষয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের যা ছিল, তা তো সব যাচ্ছে; অথচ বিদেশী শেখবার মধ্যে বাকী-যন্ত্রণা মাত্র!! খালি পুঁথি পড়ছ আর পুঁথি পড়ছ! আমাদের বাঙালী আর বিলেতে আইরিশ, এ দুটো এক ধাতের জাত। খালি বকাবকি করছে। বক্তৃতায় এ দু-জাত বেজায় পটু। কাজের—এক পয়সাও নয়, বাড়ার ভাগ দিনরাত পরস্পরে খেয়োখেয়ি করে মরছে!!!
পরিষ্কার সাজান-গোজান এ দেশের (পাশ্চাত্যে) এমন অভ্যাস যে, অতি গরীব পর্যন্তরও ও-বিষয়ে নজর। আর নজর কাজেই হতে হয়—পরিষ্কার কাপড়-চোপড় না হলে তাকে যে কেউ কাজ-কর্মই দেবে না। চাকর-চাকরানী, রাঁধুনী সব ধপধপে কাপড়—দিবারাত্র। ঘরদোর ঝেড়েঝুড়ে, ঘষেমেজে ফিটফাট। এদের প্রধান শায়েস্তা এই যে, যেখানে সেখানে যা তা কখনও ফেলবে না! রান্নাঘর ঝকঝকে—কুটনো-ফুটনো যা ফেলবার তা একটা পাত্রে ফেলছে, তারপর সেখান হতে দূরে নিয়ে গিয়ে ফেলবে। উঠানেও ফেলে না। রাস্তায়ও ফেলে না।
যাদের ধন আছে তাদের বাড়ীঘর তো দেখবার জিনিষ—দিনরাত সব ঝকঝক! তার ওপর নানাপ্রকার দেশবিদেশের শিল্পদ্রব্য সংগ্রহ করেছে! আমাদের এখন ওদের মত শিল্প-সংগ্রহে কাজ নেই, কিন্তু যেগুলো উৎসন্ন যাচ্ছে, সেগুলোকে একটু যত্ন করতে হবে, না—না? ওদের মত চিত্র বা ভাস্কর্য-বিদ্যা হতে আমাদের এখনও ঢের দেরী! ও দুটো কাজে আমরা চিরকালই অপুট। আমাদের ঠাকুরদেবতা সব দেখ না, জগন্নাথেই মালুম!! বড্ড জোর ওদের (ইওরোপীয়দের)। নকল করে একটা আধটা রবিবর্মা দাঁড়ায়!! তাদের চেয়ে দিশী চালচিত্রি-করা পোটো ভাল—তাদের কাজে তবু ঝকঝকে রঙ আছে। ওসব রবিবর্মা-ফর্মা চিত্রি দেখলে লজ্জায় মাথা কাটা যায়!! বরং জয়পুরে সোনালী চিত্রি, আর দুর্গাঠাকুরের চালচিত্রি প্রভৃতি আছে ভাল। ইওরোপী ভাস্কর্য চিত্র প্রভৃতির কথা বারান্তরে উদাহরণ সহিত বলবার রইল। সে এক প্রকাণ্ড বিষয়।