ঘরের মধ্যে যেন সহসা বজ্রপাত হল।
সকলেই স্তম্ভিত, নির্বাক।
আরো কিছুক্ষণ পরে—সুরতিয়াকে পুলিস-ভ্যানে তুলে হাজতে পাঠাবার পর চিত্রাঙ্গদা। দেবীর ঘরে বসেই কিরীটী ওদের সকলকে সমস্ত কাহিনী বিবৃত করে।
কিরীটী বলতে থাকে, প্রথম দিনই চিত্রাঙ্গদা দেবী সুধন্যকে নিয়ে তাঁর শয়নঘরে চলে যাবার পর চিত্রাঙ্গদা দেবীর স্বামী জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর ফটোটার দিকে আমার নজর পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার মনের পাতায় ভেসে ওঠে সুধন্যর মুখটা।
দুটো মুখের মধ্যে আশ্চর্য মিল!
তারপরই সুধন্যকে ওইভাবে চিত্রাঙ্গদা দেবীর কাছে বার বার এসে টাকার দাবি করা ও চিত্রাঙ্গদা দেবীর টাকা দেওয়ার ব্যাপারটা মনের মধ্যে আনাগোনা করতে থাকে আমার।
বুঝতে পেরেছিলাম আমি—কোন গূঢ় কারণ না থাকলে চিত্রাঙ্গদা দেবীর মত মানুষ সুধন্যকে টাকা দেয় না। বিশেষ করে যাকে তিনি সবচাইতে বেশী ঘৃণা করতেন।
ভাবতে লাগলাম। কিন্তু কি সে কারণ-কি?
তারপর শুনলাম ভূপৎ সিং ও তার স্ত্রী সুরতিয়ার কথা ও সুরতিয়ার প্রতি জিতেন্দ্র চৌধুরীর আকর্ষণের কথাটা।
সঙ্গে সঙ্গে যেন দুয়ে দুয়ে চার মিলে গেল। সব পরিষ্কার হয়ে গেল।
জয়ন্ত প্রশ্ন করে, কিন্তু ওকে আপনি সন্দেহ করলেন কি করে?
কিরীটী বলে, নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে, আমি বার বার বলেছি সে-রাত্রে বিশেষ কোন পরিচিত জন, যার এ বাড়ির মধ্যে অবাধ গতিবিধি, তাদেরই কেউ একজন চিত্রাঙ্গদা দেবীকে হত্যা করেছে!
হ্যাঁ।
এবারে মনে করে দেখুন, সেরকম এ বাড়িতে কে কে ছিল—ওঁরা চার ভাই ও আপনি ছাড়া আর একজন, সে হচ্ছে ঐ সুরতিয়া—যে রাণীমার একপ্রকার প্রত্যক্ষ সহচরী ছিল সৰ্বক্ষণের। মণীন্দ্রবাবু ও জগন্দ্রীবাবুকে অনায়াসেই বাদ দিয়েছি, কারণ ওই সময় তারা গানের আসরে ছিলেন। অর্থাৎ যে সময় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। শচীন্দ্র ও ফণীন্দ্রবাবুকে পরে জিজ্ঞাসাবাদ করে বাদ দিই সন্দেহের তালিকা থেকে।
তাছাড়া ওঁরা চারজন আর যাই করুন, হত্যা করবার মত নাৰ্ভ বা মনের জোর তাদের কারোরই ছিল না। তাহলে বাকি থাকে দুজন—জয়ন্তবাবু ও সুরতিয়া। এবং ওদের দুজনের মধ্যে সবচাইতে সে-রাত্রে হত্যা করবার সুবিধা কার বেশী ছিল! সেটা ভাবতে গিয়েই মনে পড়ল সুরতিয়ার একটা কথা, কালো কোট পরিহিত যে লোকটিকে সুরতিয়া সিঁড়ি দিয়ে উঠে যেতে দেখেছিল তাকে নাকি তার জয়ন্তবাবু বলে মনে হয়েছিল।
তারপর? জয়ন্তই জিজ্ঞাসা করে।
অসাধারণ বুদ্ধিমতী ও দুঃসাহসিকা ছিল সুরতিয়া। কিন্তু সে একটা মারাত্মক ভুল করে— জয়ন্তবাবুর নাম করে ও কালো কোটের কথা বলে তার উপরে সন্দেহটা ফেলার জন্য। ওই কালো কোটের কথা না বললে, তত শীঘ্র সুরতিয়ার ওপরে গিয়ে সমস্ত সন্দেহ আমার হয়ত পড়ত না। বুঝলাম, কোটটার সঙ্গে রহস্য জড়িয়ে আছে। আর সুরতিয়াও ভেবেছিল, কেটের কথা বললে কোটের অনুসন্ধান আমরা করব, এবং পরে যদি প্রমাণিত হয় কোটটা জয়ন্তবাবুর তাহলে তারই ওপর গিয়ে সকলের সন্দেহ পড়বে। সেই জন্যেই বা সেই উদ্দেশ্যেই সুরতিয়া ওইদিন হয়তো কোনো একসময় জয়ন্তর ঘরে ঢুকে কোটটা চুরি করে নিয়ে এসে গোপনে সিড়ির ঘরে লুকিয়ে রেখে দেয়।
উ, কি শয়তানী! মণীন্দ্ৰ বলে।
শয়তানির চাইতেও সে রাণীমার উইল বদলের কথা শুনে যে মরিয়া হয়ে উঠেছিলকারণ সে বুঝতে পেরেছিল। আপনাদের কারো জন্যই নয়—ঐ সুরতিয়ার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যই তিনি পূর্বের উইল বদলাতে মনস্থ করেছিলেন—যে উইলে হয় তা ঐ সুরতিয়ার চাপে পড়েই বাধ্য হয়ে একদিন তাকে উইলের মধ্যে সুধন্যর একটা ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। তার লজ্জার গোপন কীটা ঐ সুধন্য—যে লজ্জা চিরদিন তার মনের মধ্যে গোপন রক্তক্ষয় করিয়েছে।
সুরতিয়া অস্থির হয়ে উঠলো। হয়ত রাণীমাকে সে নিরস্ত করবারও চেষ্টা করেছে, তারপর, কিন্তু পারেনি—তখনই হয়ত মনে মনে রাণীমাকে সে হত্যার সংকল্প নেয় এবং সুযোগও এসে গেল তার অপ্রত্যাশিত ভাবে ঐ উৎসবের রাত্রেই।
অন্যান্য রাত্রের মত রাণীমা যে শেষ পর্যন্ত উৎসবে না উপস্থিত থেকে রাত দশটা নাগাদ ফিরে আসবেন তা সে জানত ও প্রস্তুত হয়েই ছিল—হলও তাই। রাণীমা রাত সোয়া দশটা নাগাদ যখন ফিরে এলেন—সুরতিয়া তখন দরজার আড়ালে ছোরা হাতে ওৎ পেতে আছে। রাণীমা যেই ঘরে ঢুকেছেন, সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে রাণীমাকে ছোরা মারে সুরতিয়া।
জয়ন্ত প্রশ্ন করে, তাহলে গণেশ কার সঙ্গে দেখা করে কথা বলল?
গণেশ ভয়ে মিথ্যে কথা বলেছে। আন্দেী সে রাণীমার সঙ্গে দেখা করেনি। ঘরের ভিতর থেকেই সুরতিয়াই রাণীমার গলার স্বর নকল করে জয়ন্তকে ডেকে আনতে বলে আমার ধারণা। তাই না গণেশ? তুমি ঘরে ঢুকেছিলে কি?
আঙ্কে না, বাবু।
কিরীটী আবার শুরু করে, গণেশ চলে যাবার পরই ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে সুরতিয়া বাগানে চলে যায়, রাণীমাকে হত্যা করে গোপন সিঁড়িপথ দিয়ে নীচে নেমে গিয়ে গণেশকে ডেকে দিয়ে আবার গোপন সিঁড়িপথ ধরেই তাড়াতাড়ি সুরতিয়া ফিরে এসেছিল, গণেশ রাণীমার ঘরের সামনে পৌঁছবার আগেই—আমার ঘর দিয়ে।
জয়ন্তবাবুকে কাল সন্ধ্যায়ই সব কথা আমি খুলে বলি। এবং এও বলি, সুরতিয়া এখন পালাবার চেষ্টা করছে এবং করবেই। কিন্তু পুলিসের জন্য সে পারছে না পালাতে। জয়ন্তবাবুকে বলে দিই, সুরতিয়ার সঙ্গে গিয়ে প্রেমের অভিনয় করে তাকে বলবেন সুরতিয়াকে তিনি ভালবাসেন—পুলিস তাকে সন্দেহ করছে—তারা পালাবে। সুরতিয়া হাতে স্বৰ্গ পেল-রাজী হয়ে গেল। জয়ন্তবাবুর অভিনয়মত সুরতিয়া প্রস্তুত হয়েই ছিল—কথা ছিল রাস্ত বারোটায় এসে জয়ন্তবাবু ঘরের দরজায় টোকা দেবেন। তিনবার।
সুরতিয়া টোপটা সহজেই গিলে ফেলে। তার পরের ব্যাপারও সবই আপনারা জানেন।
জয়ন্ত এবারে প্রশ্ন করে, কিন্তু সুরতিয়া যে আমার কোটটা ব্যবহার করেছিল, জানলে কি করে?
কোটের কলারে একটা স্ত্রীলোকের চুল লেগেছিল, সেই চুলে ছিল সুরতিয়ার মাথার তেলের গন্ধ। একটা উগ্র তেল সুরতিয়া ব্যবহার করত। গন্ধটাতেই আমি ধরতে পারি ব্যাপারটা।
কিরীটী থামল।
কিন্তু সুধন্য কোথায়?
বাড়িতে এত কাণ্ড-সে কি জানতে পারেনি?
গণেশকে খোঁজ নিতে পাঠাল কিরীটী।
একটু পরে গণেশ এসে বলল, সুধন্য ঘুমোচ্ছে।
কিরীটী মৃদু হাসল।