আমাকে অনুসরণ করে আসুন মিঃ রায়। মদুসূদন সরকার বললেন, আপনারা পথ ঠিক হয়তো চিনতে পারবেন না। আর একটু সাবধানে আসবেন, যা চারিদিকে ঝোপ-ঝাড় বলা যায় না কিছু!
কেন, এখানে সাপ আছে নাকি? কিরীটী প্রশ্ন করে চলতে চলতেই অন্ধকারে।
খুব কি বিচিত্র নাকি কথাটা! মৃদু হেসে মধুসূদন সরকার কথাটা বললেন, চারিদিকে যা বনজঙ্গল করে গিয়েছেন এখানে কাকা, তা আচমকা একটা বাঘ বেরুলেও আশ্চর্য হবে না বোধ হয় কেউ।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, কথাটা কিন্তু একটু অতিশয়োক্তিই হল মধুসূদনবাবু আপনার।
কেন বলুন তো?
তা বৈকি। এরকম জায়গায় সাপই অতর্কিতে ছোবল বসাতে পারে, কিন্তু এখানে বাঘের আসাতে তার রক্তের আভিজাত্যে বাধবে। কিরীটী চলতে চলতেই হেসে জবাব দেয়।
শকুন্তলা আর সুশান্ত কিন্তু নিঃশব্দেই পথ অতিক্রম করছিল।
এবং কিরীটী লক্ষ্য করে তারা যেন পরস্পরের সঙ্গে একটু ঘেঁষাঘেঁষি করেই পথ চলছিল।
বারান্দার গেটের কাছাকাছি এসে সহসা আবার কিরীটী বলে, মিথ্যে বলেননি আপনি মিঃ সরকার। সত্যি আপনি সঙ্গে না থাকলে এমন অবলীলাক্রমে কিন্তু এখানে এসে পৌঁছতে পারতাম না এখন বুঝতে পারছি। তা আপনারও বুঝি শকুন্তলা দেবীর মত কাকার বাগানটা ভাল লেগে গিয়েছে?
ক্ষেপেছেন মশাই! বনজঙ্গল আমার একদম ধাতে সয় না। তাড়াতাড়ি প্রতিবাদ জানিয়ে বলে ওঠেন মধুসূদন সরকার।
কিন্তু আবার অমন নিরিবিলি জায়গাও সময় বিশেষে চট করে পাওয়া যায় না, এও নিশ্চয়ই মানবেন মিঃ সরকার?
অগ্রবর্তী মদুসূদন সরকার ততক্ষণে সিঁড়ির শেষ ধাপটি অতিক্রম করে বাইরের আলোকিত বারান্দায় উঠে দাঁড়িয়েছেন।
বারান্দার আলোয় মধুসূদন সরকার পরমূহুর্তেই কিরীটীর শেষের কথায় চকিতে তার দিকে ফিরে তাকাতেই মুখে প্রতিটি রেখা তাঁর স্পষ্ট দেখতে পায় কিরীটী।
কিন্তু সেও মুহূর্তের জন্য।
কিরীটীর মুখের দিকে পলকের জন্য তাকিয়েই ততক্ষণে মধুসূদন সরকার আবার মুখটা তার দিকে ফিরিয়ে নিয়েছেন।
দুজনে এসে নিচের সুসজ্জিত বৈঠকখানায় মধুসূদন সরকারের নিদের্শেই সোফা অধিকার করে বসল।
মধুসূদন চা দেবার জন্য ভৃত্যকে ডেকে আদেশ দিতে যাচ্ছিলেন কিন্তু শকুন্তলা দেবী তাকে বাধা দিয়ে বললে, আপনি বসুন। আমি দেখছি।
কথাটা বলে উত্তরের আর অপেক্ষা না করে শকুন্তলা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
কিন্তু কি জানি কেন, পরস্পরের আলাপের মধ্যে সহসা একটা ছেদ পড়ে গিয়েছিল।
বাগান থেকে ফিরবার পথে অন্ধকারে যে সহজ কথাবার্তা পরস্পরের মধ্যে চলছিল, সেটা হঠাৎই যেন ফুরিয়ে গিয়েছে।
সোফায় যে যার মুখোমুখি চুপচাপ বসে।
কারও মুখেই কোন কথা নেই।
বাইরের বারান্দায় ঐ সময় ভারী একটা জুতোর মচমচ শব্দ শোনা গেল।
কে যেন আসছে! কিরীটীই প্রথমে কথা বলে।
মধুসূদন সরকার কিরীটীর প্রশ্নের কোন জবাব দেবার পূর্বেই চব্বিশ-পঁচিশ বৎসরের একটি হৃষ্টপুষ্ট সুশ্রী যুবক ঘরে প্রবেশ করল।
এ কি! বিজন, তুমি এ সময়?
আগন্তুক যুবকটিকে সম্বোধন করে মধুসূদনই প্রথমে কথা বললেন।
হ্যাঁ–কেন, ছোটমামাই তো আমাকে তাড়াতাড়ি আসবার জন্য চিঠি দিয়েছিলেন।
কে? বৃন্দাবন?
হ্যাঁ, যোধপুরে একটা বড় অর্ডার সাপ্লাইয়ের ব্যাপারে গিয়েছিলাম, সেখান থেকে দিল্লীতে ফিরেই মামা জরুরী চিঠি পেয়ে চলে আসছি।
বলতে বলতে আগন্তুক একটা খালি সোফায় বসে পড়ল। এবং বললে, কিন্তু এ সব কি ব্যাপার?
কিরীটী যুবকটির দিকে তাকিয়ে দেখছিল।
মাথায় কোঁকড়া কোঁকড়া চুল ব্যাক-ব্রাশ করা।
দাড়ি-গোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো।
মুখখানি একটু লম্বাটে ধরনের।
নাকটা উঁচু, চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ।
ধারালো চিবুক।
পরিধানে দামী গরম সুট।
তা ছোটমামা কোথায়? বিজন আবার প্রশ্ন করল।
আজই তো বিকালের ট্রেনে কলকাতায় চলে গেল। তা বৃন্দাবন সব কথা তোমাকে জানিয়েছে নাকি?
হ্যাঁ, বিনু মামার চিঠিতেই সব জানালাম। ব্যাপারটা তাহলে সত্যি সত্যি—মানে ছোট দাদুকে সামবডি হত্যাই করেছে?
তাই তো মনে হচ্ছে।
এমন সময় ভৃত্যের হাতে চায়ের ট্রে নিয়ে শকুন্তলা ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল।
কিন্তু এঁদের তো চিনলাম না! বিজন কিরীটী ও সুশান্তকে লক্ষ্য করে মধুসূদনকেই পুনরায় প্রশ্নটা করে ঐ সময়।
হ্যাঁ, পরিচয় নেই তোমার-ইনি কিরীটী রায়—ওঁর বন্ধু সুশান্তবাবু। আর মিঃ রায়, এই আমার ভাগ্নে মানে দিদির একমাত্র ছেলে বিজন বোস।
পরস্পর পরস্পরকে নমস্কার ও প্রতিনমস্কার জানায়।
অতঃপর সংক্ষেপে কিরীটীর আগমনের হেতুটাও মধুসূদন সরকার বিজনকে জানিয়ে দেন।
শকুন্তলা সকলকে চা পরিবেশন করে।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কিরীটীই একসময় বিজনকে প্রশ্ন করে, আপনি বুঝি দিল্লীতেই থাকেন বিজনবাবু?
য়্যাঁ! না—আমি তো কলকাতাতেই থাকি।
ও! আচ্ছা, ঐ যে কি সব অর্ডার সাপ্লাইয়ের কথা একটু আগে বলছিলেন?
ও, কলকাতায় সিং অ্যাও সিং যে অর্ডার সাপ্লাইয়ের ফার্ম আছে সেখানেই আমি চাকরি করি। তাদেরই কাজে মাঝে মাঝে আমাকে সারা ভারতবর্ষে টহল দিয়ে বেড়াতে হয়।
তা আপনি যে যোধপুর গিয়েছিলেন এবং দিল্লীতে ফিরে যাবেন, বৃন্দাবনবাবু সে কথাটা জানতেন বুঝি?
না। ছোটমামা আমার ফার্মের ঠিকানায় চিঠি দিয়েছিলেন, তারাই চিঠিটা আমাকে রিডাইরেক্ট করে দেয় দিল্লীর ঠিকানায়, তারা জানত যে যোধপুর থেকে আমি দিল্লীতেই আবার ফিরব।
সহসা ঐ সময় মধুসূদন সরকার সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ান এবং বলেন, এক্সকিউজ মি মিঃ রায় ফর এ ফিউ মিনিটস!
মধুসূদন ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
মধুসূদন উঠে চলে যেতে কিরীটী বিজনবাবুর দিকে তাকিয়ে সহসা আবার প্রশ্ন করে, আপনি তাহলে আপনার মামা বৃন্দাবনবাবুর চিঠিতেই আপনার দাদুর মৃত্যুর সংবাদটা প্রথম জানতে পারেন বিজনবাবু?
হ্যাঁ, আমি তো চিঠি পেয়ে একেবারে ন যযৌ ন তস্ত্রেী!
তা তো হবারই কথা। তা চিঠিতে তিনি কি লিখেছিলেন?
লিখেছেন তার আকস্মিক মৃত্যুর কথা, তারপর আরও লিখেছেন, পুলিসের এবং তারও ধারণা নাকি দাদুর মৃত্যুটা স্বাভাবিক বা আত্মহত্যা নয়, তীব্র নিকোটিন বিষ-প্রয়োগে তাকে হত্যা করা হয়েছে। কথাটা বলেই বিজনবাবু সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে এবারে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে বললে, আপনারও কি ধারণা তাই মিঃ রায়?
হ্যাঁ। শুধু তাকেই নয়, দশরথকেও সেই বিষ-প্রয়োগেই হত্যা করা হয়েছে বলেই আমার ধারণা বিজনবাবু। শাস্তকণ্ঠে কিরীটী কথাগুলো বললে।
দশরথ। দশরথও মারা গেছে নাকি? বিজন চমকে প্রশ্ন করে পরক্ষণেই।
হ্যাঁ।
কবে?
গতকাল সকালে।
কয়েকটা মুহূর্ত অতঃপর স্তব্ধ হয়ে রইল বিজন, তারপর কেমন যেন অসহায় দৃষ্টিতে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে বলল, ব্যাপারটা এখনও যেন কেমন আমার শুনে অবধি অবিশ্বাস্য বলেই মনে হচ্ছে মিঃ রায়, মামারবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক আমার না থাকলেও ঐ ছোটদাদুর স্নেহ থেকে কোনদিনই আমি বঞ্চিত হইনি। খুব ছোটবেলায় মাকে ও বাবাকে হারিয়ে ঐ দাদুর কাছেই মানুষ হয়েছিলাম একপ্রকার বলতে গেলে আমি। নিজের দাদুকে দেখিনি কখনও, কিন্তু নিজের দাদুও যে আমাকে আমার ঐ ছোটদাদুর চাইতে বেশী স্নেহ করতে পারতেন বলে আমার মনে হয় না।
কিছু যদি মনে করেন বিজনবাবু তো একটা কথা জিজ্ঞাসা করতাম। সহসা কিরীটী বাধা দিল বিজনবাবুকে।
বলুন।
মামারবাড়ি ছেড়েছেন আপনি কতদিন?
তা খুব বেশী দিন নয়, কলকাতা থেকে দাদু এখানে চলে আসার বছরখানেক আগেই।
হঠাৎ মামারবাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন যে?
উত্তরে নিঃশব্দে বিজন মাথাটা নিচু করল।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, থাক বলতে হবে না–
, জানতে চেয়েছেন যখন বলছি। মামীমা—মানে ছোটমামার স্ত্রীর ব্যবহারটা—
বুঝতে পেরেছি। থাক আর কিছু বলতে হবে না। কিন্তু সে মামীমাও তো শুনেছি মারা গিয়েছেন। তা ছাড়া ছোট মামা নিশ্চয়ই আপনাকে ভালবাসতেন।
মিথ্যে বলব না, তা বাসতেন। কিন্তু—
আচ্ছা আপনার ছোট মামীমা কতদিন হবে গত হয়েছেন?
আমি মামারবাড়ি ছেড়ে চলে আসার মাসখানেক পরেই।
হুঁ। আচ্ছা তারপর আপনি ফিরে যাননি কেন? মামীমার জন্যই যখন—
বা, তা আর হয়ে ওঠেনি।