১৪. শকুন্তলার মুখের দিকে তাকিয়ে

শকুন্তলার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদুকণ্ঠে কিরীটী এবারে বলে, না, একা আসিনি, আমার সকালের সেই বন্ধুটিও এসেছেন। ওদিককার গোলাপ বাগিচার দিকে গেলেন গোলাপ দেখতে এইমাত্র।

নিজের অনুমানটা যে মিথ্যা নয় বুঝতে পেরে কিরীটী মনে মনে একটু যেন উল্লসিতই হয়। কিন্তু চোখেমুখে তার সে ভাবটা প্রকাশ পায় না।

কিন্তু পরক্ষণেই শকুন্তলার কণ্ঠস্বরে কিরীটীর চিন্তায় ছেদ পড়ে। .

দাঁড়িয়ে কেন মিঃ রায়, জায়গাটা বেশ পরিষ্কার-বসুন না!

কিরীটী আর দ্বিধামাত্রও না করে শকুন্তলার অল্প ব্যবধানে ঘাসের উপরেই বসে পড়ল।

ক্রমশ অস্পষ্ট আলোয় চারিদিক আরও বিষণ্ণ আরও ধূসর হয়ে আসছে যেন তখন।

কিরীটীই অতঃপর একসময় কথা শুরু করে, সারদাবাবুর মৃত্যুতে আপনি শোক পেয়েছেন শকুন্তলা দেবী, তাই না?

উনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। মাত্র আট মাস তার কাছে কাজ করেছি, কিন্তু তার ব্যবহার কখনও ভুলতে পারব না বোধ হয় মিঃ রায় এ জীবনে।

স্বাভাবিক। এক-একজন আছেন যারা খুব সামান্য সময়ের মধ্যেই দূরের জনকে কাছে টেনে নেন। আর তাইতেই নিশ্চয়ই আপনি এ জায়গার মায়া এখনও কাটিয়ে উঠতে পারছেন না।

সত্যিই তাই। কে যেন সর্বক্ষণ এখানে চারপাশ থেকে আঁকড়ে ধরছে আমাকে।

আচ্ছা শকুন্তলা দেবী, সকালে তখন একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করব-করব করে করা হয়ে ওঠেনি!

কি?

সারদাবাবু বেশ সৌখীন প্রকৃতির লোক ছিলেন, তাই না?

কেন বলুন তো? হঠাৎ এ কথা আপনার মনে উদয় হল কেন?

উদয় হল কেন সে কথা নাই বা শুনলেন, কথাটা সত্য কি মিথ্যা সেটাই শুধু জিজ্ঞাসা করছি।

মুহূর্তকাল শকুন্তলা চুপ করে যেন কি ভাবতে থাকে।

অস্পষ্ট আলো-ছায়ায় কিরীটী শকুন্তলার মুখের কোন ভাবান্তর বুঝতে পারে না।

তৎসত্ত্বেও সে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে শকুলার মুখের দিকে।

মৃদুকণ্ঠে শকুন্তলা বলে, আপনার অনুমান সত্যি কি মিথ্যা তা জানি না মিঃ রায়, কারণ এখানে আসা অবধি দু মাস পর্যন্ত যাঁকে অত্যন্ত সংযমী ও কোন বিলাস-ব্যসন যাঁর নেই। বলেই মনে হয়েছিল এবং ব্যবহারেও দেখেছি, সেই লোক বলেন, আসা অবধি দু মাল আপনার অনুমন সন্ত মুখে–

ধীরে ধীরে যেন বদলে গিয়েছিলেন, তাই না? কিরীটাই শকুন্তলার মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নিয়ে শেষ করে।

হ্যাঁ।

কিন্তু তার কোন কারণই আপনি বুঝতে পারেননি?

না।

তাঁর কথায়বার্তায় হাবভাবে কখনও কিছু প্রকাশ হতেও দেখেননি যাতে করে তার ঐ পরিবর্তনটা—কারণ আপনি তো সব সময়ই প্রায় তার কাছে-কাছেই থাকতেন–

না, তবে একটা ব্যাপার ইদানীং মাস দুই থেকে লক্ষ্য করছিলাম—

কি?

আগে আগে ইতিহাস ও ধর্মগ্রন্থই বেশীর ভাগ তাঁকে পড়ে শোনাতে হত আমাকে, কিন্তু ইদানীং প্রায় বৈষ্ণব কাব্য থেকেই কেবল আমাকে পড়ে শোনাতে বলতেন।

তাতেও বোঝেননি ব্যাপারটা? মৃদু হেসে কিরীটী কথা বললে।

কিরীটীর কথায় যেন একটু বিস্মিত হয়েই তাকায় শকুন্তলা কিরীটীর মুখের দিকে, তারপরই হঠাৎ বলে, কি বলছেন আপনি মিঃ রায়! ইজ ইট পসি?

ঠিক তাই শকুন্তলা দেবী। আপনার মত বুদ্ধিমতী মেয়ের আগেই কিন্তু ব্যাপারটা বোঝ উচিত ছিল তার ড্রয়ারের ভিতরকার বিশেষ দ্রব্যগুলো দেখে।

বিশেষ দ্রব্যগুলো?

হ্যাঁ, পাউডার, সেন্ট, কলপ ইত্যাদি-সৌখীন দ্রব্যগুলি নিশ্চয়ই আপনার চোখের দৃষ্টি এড়ায়নি—কারণ আপনি যখন তার ড্রয়ার খুলতেন মধ্যে মধ্যে। আমার তো মনে হয় তার ইদানীং ইনসমনিয়াটা যে বেড়ে গিয়েছিল তারও কারণ ঐ–

শকুন্তলা এবারে আর কোন জবাব দেয় না।

চুপ করেই থাকে।

মানুষের মন এমনিই বিচিত্র বটে শকুন্তলা দেবী! কিরীটী আবার বলতে থাকে, নইলে সারদাবাবুর যে বয়স ছিল সে বয়সে তো অমনটা ঘটা উচিত ছিল না। আর আমার অনুমান যদি ভুল না হয়ে থাকে তো খুব সম্ভব–

কিরীটী তার কথা শেষ করতে পারে না।

তার আগেই যেন চমকে শকুন্তলা প্রদোষের অন্ধকারে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, কি, কি মিঃ রায়?

যা শকুন্তলা দেবী, পঞ্চশরের ঐ অকাল শরক্ষেপই সম্ভবত তার আকস্মিক মৃত্যুর কারণ হয়েছিল।

তার মানে?

মানেটা মনে মনে চিন্তা করে দেখলে আপনিও হয়তো বুঝতে পারবেন, আমার ব্যাখ্যার প্রয়োজন হবে না। তাছাড়া—

কিরীটীর কথাটা শেষ হল না, অদুরে পদশব্দ পাওয়া গেল এবং সুশান্তর গলা শোনা

গেল, মিঃ রায়?

কে! সুশান্তবাবু, আসুন—আমরা এখানে। শকুন্তলা দেবী, সুশান্তবাবু এসেছেন।

শকুন্তলা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। বলে, চলুন ঘরে যাওয়া যাক। বেশ অন্ধকার হয়ে গিয়েছে।

কোথায় ছিলেন এতক্ষণ সুশান্তবাবু? কিরীটী প্রশ্ন করে।

আমার সঙ্গে গল্প করছিলেন। জবাব এল সুশান্তর ঠিক পশ্চাতেই মধুসূদনের কণ্ঠ থেকে অন্ধকারে।

কে, মধুসূদনবাবু! কিরীটী ঘুরে দাঁড়ালো যেন সঙ্গে সঙ্গেই।

কাকার বাগানটা দেখলেন? মদুসূদন আবার প্রশ্ন করলেন একটু এগিয়ে এসে।

হ্যাঁ, দেখলাম। সত্যিই চমৎকার।

কত টাকা যে এর পিছনে ঢেলেছেন কাকা। কিন্তু এখানে আর নয়। চলুন ঘরে যাওয়া যাক।

কিন্তু এখন আর ঘরে যাব না মিঃ সরকার। একবার বিমলবাবুর ওখানে যেতে হবে, কিরীটী বলে।

বেশ তো যাবেনখন। এক কাপ চা খেয়ে যাবেন।

তা মন্দ নয়, চলুন—

সকলেই অন্ধকারেই অগ্রসর হয়।