তেরো – কালকেতু উপাখ্যান (২)
কোদলাঘাটের বাঁদিকে যেখানে শ্মশান, তার ওপারে সামনাসামনি কিছু খোলামেলা সাদা খেত, তারপর একটা ছোট্ট বসতি—চাঁইপাড়া। ওরা চাঁই—সম্প্রদায়ের মানুষ। গঙ্গার ধারে ধারে সারা জেলায় ওদের বসতি। দেহাতি হিন্দি অর্থাৎ খোট্টাই বুলি আর বাংলা দুটোই ওদের ভাষা। শাকসবজি ফলমূলের চাষবাস ওদের পেশা। কোনপুরুষে ওরা চলে এসেছিল বিহারের অনুর্বর এলাকা ছেড়ে বাংলাদেশের এই নদীটির অববাহিকায়।
লেডি ডাক্তার স্বর্ণলতা ওদের মন কেড়ে নিয়েছে। গোকর্ণের হাটে সপ্তায় দুদিন ওদের যেতেই হয় সবজি আর আনাজপত্র নিয়ে। স্টেশনধারের বটতলায় একবার জিরিয়ে নেয় যেতে—আসতে। সামনেই তো লেডি ডাক্তারের ডাক্তারখানা। গোরাংবাবুর আমলেও ওরা কেউ ফিরে যাবার পথে ওষুধ নিয়েছে। কিন্তু এখনকার মতো বিশ্বাস ছিল না। গোরাংবাবুর মেয়ে ওদের বিশ্বাস পেয়েছে।
অত চেষ্টা করেও গোরা ফাদার যা পাননি। গোরাকে ওরা যমের প্রতিমূর্তি ভাবে। স্বর্ণ প্রায়ই কল পায়। আসার সময় ঘোড়ার পিঠে একরাশ সবজি ফলমূল বয়ে আনতে হয়। অতসব কে খাবে? কিছু নিয়ে যায় চুপিচুপি চাঁদঘড়ির বউ, জর্জকে পাঠিয়ে দেয়; পাঠিয়ে দেয় ময়রা—বুড়িকেও। তখন ময়রাবুড়ি অন্যমানুষ।
বোশেখ পড়েছে। তখনও বাতাসে নিমফুলের গন্ধ ভাসে চারদিকে। চাঁইপাড়া থেকে বেরোতে বেলা পড়ে এসেছে। ঘাটের ওখানে দহ—অগাধ জল। কিন্তু শ্মশানের সামনে অনেকটা চড়া—একখানে ঘোড়াটার পেট ছোঁয় মাত্র।
পেরিয়ে এসে ঘোড়া থেকে নামে স্বর্ণ। পাড় খানিকটা খাড়া, খানিকটা ঢালু। লাগাম ধরে ঘোড়াটা টানতে টানতে পাড়ে ওঠে। নির্জন শ্মশানবটের ওধারে ইয়াকুব সাধুর ভিটে। ঘোড়ার পিঠে চাপতে গিয়ে একটু চমকায় স্বর্ণলতা। বটতলার দিক থেকে দৌড়ে আসতে দ্যাখে হেরুর ছেলে ডেভিডকে।
ফাদার সাইমনের সঙ্গে মাঝেমাঝে ছেলেটা স্টেশনে আসে, স্বর্ণলতা দেখেছে। কখনও ট্রেনে চেপে দুজনে কোথায় যায়, ফিরে আসে। জর্জের সঙ্গে ফাদার যখন কথাবার্তা বলেন, ছেলেটা স্টেশনের চত্বরে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। স্বর্ণ লাইনের পার থেকে হাত তুলে ডাকলে সে শুধু হাসে, আসে না। স্বর্ণর খুব কৌতূহল হয়। ইচ্ছে করে, কিছুক্ষণ কথা বলে ওর সঙ্গে। কিন্তু ছেলেটি বড্ড লাজুক প্রকৃতির। ওদিকে ফাদারের শাসনও কড়া। কারও সঙ্গে মিশতে দেন না। জর্জ বলেছে, ফাদার ডেভিডকে নিয়ে একটা লম্বাচওড়া স্বপ্ন দেখছেন। জর্জের মুখে আরও শুনেছে স্বর্ণ, ডেভিড প্রায়ই পালিয়ে যায় আর ফাদার তাকে খুঁজে বের করেন—শাস্তিও দেন প্রচণ্ড। সেইজন্য স্বর্ণর খুব ইচ্ছে করে ছেলেটার সঙ্গে কথা বলতে।
আজ এখানে ছেলেটাকে হঠাৎ দৌড়ে আসতে দেখে স্বর্ণ অবাক হল। এতটুকু রাঙা টুকটুকে একটি ছেলে! এখনও ভালো করে দৌড়তেই পারে না। বার দুই আছাড় খেল। তারপর আচমকা সামনে স্বর্ণকে দেখে তার মুখ সাদা হয়ে গেল আতঙ্কে। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সে!
আর, স্বর্ণ তো মা নয়, তবু কী একটা ঘটে যায় তার মনে। সে ব্রাহ্মণ কন্যা, বিধবা। ওই ছেলেটার জন্ম বাউরিমেয়ের কোলে—মুসলমান সাধুর ঘরে কাটিয়েছে কতবছর, তারপর এখন খ্রিস্টানের হাতে পড়েছে। এইসব ব্যাপার স্বর্ণর মনকে একবারের জন্যেও হানা দিতে চেষ্টা করে, সে টের পায়। কিন্তু এতটুকু রাঙা টুকটুকে ছেলেটার ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠা তাকে কী এক অপরিচিত আবেগে মূলসুদ্ধ নাড়া দিতে থাকে।
ঘোড়াটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে গেছে। স্বর্ণ ছেলেটার কাছে এগিয়ে যায়। তার এরকম দৌড়ে আসা আর ভয়ের কারণ খুঁজতে চারদিকে তাকায়। তখন ফাদার সাইমনের মূর্তিটি দেখতে পায়—বেশ খানিকটা দূরে। ফাদারের হাতে ছড়ি। নিশিন্দা ঝোপ পেরিয়ে সাইমন সায়েব হন্তদন্ত হয়ে আসছে।
পলকে সব টের পেয়ে যায় স্বর্ণলতা। ঠোঁট কামড়ে কয়েক মুহূর্ত সেদিক তাকিয়ে থাকে। তারপর ছেলেটাকে দ্যাখে। ছেলেটা উঠে দাঁড়িয়েছে। পাথরের মতো স্থির—স্বর্ণকে সেও দেখছে, দু চোখে ত্রাস। স্বর্ণ তার দু কাঁধে হাত রেখে একটু ঝুঁকে পড়ে। হাসিমুখে বলে, ‘আবার পালিয়ে এসেছ বুঝি?’
ডেভিড ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। কিছু বলে না। কাঁদতেও ভুলে গেছে এখন। ভিজে চোখ দুটো নিষ্পলক।
দুহাতে ওকে শূন্যে তুলে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে দ্যায় স্বর্ণ। তারপর নিজে চাপে। অভ্যাসমতো শাড়িটা দুপায়ের দিকে ঠিকঠাক করে নেয়, হাঁটু অব্দি যথারীতি খোলাই থাকে। সে একটু হেসে আঁচল দিয়ে ডেভিডের গলাঅব্দি ঢাকে। তারপর ঘোড়ার পিঠে মৃদু আঘাত করে ডানপায়ের গোড়ালি দিয়ে।
ঘোড়াটা দৌড়তে শুরু করে। গঙ্গার পাড়ে অনেকদূর ঝোপজঙ্গল ভেদ করে ওরা চলতে থাকে। তারপর রাঙামাটি ঝিলের কাছাকাছি গিয়ে সোজা পশ্চিমে চলে। টিলার উত্তর দিকে ঘুরে, স্টেশন এড়িয়ে বাড়ি ফেরে।
তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। স্বর্ণ কী আনল, লক্ষ্য করার মতো আশেপাশে কেউ ছিল না। ঘরের ভিতর বিছানায় ডেভিড শান্তভাবে বসে থাকে; স্বর্ণর মুখ চাপা হাসিতে ঝলমল করে। কৌতুকে চঞ্চল হয়ে থাকে সে। জর্জকে ব্যাপারটা আপাতত জানাচ্ছে না। দেখা যাক, কী গড়ায় শেষঅব্দি।
কিছুক্ষণের মধ্যে স্বর্ণ দ্যাখে, ছেলেটা ভয় কাটিয়ে উঠেছে! নিঃসঙ্কোচে সে স্বর্ণর ঘরের এটাওটা ছুঁয়ে পরখ করে। বারান্দায় স্বর্ণ কুপি জ্বালিয়ে রাঁধছিল। পিঠের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দুজনে পরস্পর তাকায়—কেউ কোনো কথা বলে না।
কতক্ষণ পরে দুজনে খেতে বসে—পাশাপাশি। ওর খাওয়া দেখে তাক লেগে যায় স্বর্ণলতার। হেরুর কথা মনে পড়ে যায়। হেরুর ছেলেও যেন বিপুল ক্ষুধা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে। স্বর্ণ চাপা গলায় বলে, ‘পাদরিবাবা কী খেতে দিত রে তোকে?’
ডেভিড কাঁচুমাচু বলে, ‘রোটি, মীট।’
স্বর্ণ হেসে ওঠে। ….’রোটি কী রে! পাদরিবাবা তাই বলে বুঝি! তুই তো বাউরির ছেলে—রুটি বলবি, বুঝলি? আর মীট কী? মাংস বলবি। কীসের মাংস?’
ডেভিড জানে না।
‘এই ছোঁড়া! তোর জাত গেছে, জানিস? থাক, কাল তোকে গোবর খাইয়ে শুদ্ধ করব।’
ডেভিড এতক্ষণে—কী বোঝে কে জানে, একটু হাসে।
‘ভাগ্যিস হেসেছিল!’….স্বর্ণ বলে। ‘হ্যাঁ রে, তোর সাধুবাবার জন্যে মন খারাপ করে না?’
ডেভিড মাথা দোলায়।
‘তোর বাবা কে ছিল জানিস?’
ডেভিড তাকায়।
‘ধুঃ ছোঁড়া! বাবা কী তাই জানে না। শোন, তোর বাবা মানুষ মারতে পারত। তুই পারবি তো?’
একটু অপেক্ষা করার পর স্বর্ণ ফের বলে, ‘তুই কিস্যু পারবি নারে হাঁদারাম! যা—হাতমুখ ধুয়ে শোগে। ওঠ। না—না, এঁটো কুড়োতে হবে না। তোর পাদরিবাবার শিক্ষা ভুলে যা।’
সে রাতে পাশাপাশি ওরা শুয়ে থাকে। স্বর্ণর ঘুম আসে না। ক্রমশ কী আবেগ তাকে নাড়া দিতে থাকে। তখন সে নিঃশব্দে কাঁদে। কেন কাঁদে, সে বুঝতে পারে না নিজেই। শুধু মনে হয়, পৃথিবীটা এত বড়, আর সে এমন অসহায়!
গোরাংবাবুর মেয়াদ শেষ হয়ে এল। যেকোনো দিন চিঠিতে সুখবর এসে যাবে। কলকাতার জেলেই আছেন। তবে শরীর খুব ভালো যাচ্ছে না। হেরু অমনভাবে মারা পড়াতে গোরাংবাবু নাকি খুশি—হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। লিখেছিলেন, ‘ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। তবে কি না, ওর অমন একটা মৃত্যুই নির্ধারিত ছিল। মৃত্যু নিয়ে খেলা করতে নেই। বেদের ভাগ্য কালসাপের হাতে জিম্বা থাকে।’
মধ্যরাতে চঞ্চল হয়ে ওঠে স্বর্ণ। প্রতিজ্ঞা করেছিল, বাবার অপমানের প্রতিশোধ নেবে। কিন্তু কীভাবে যে বছরগুলো কেটে গেল! কিছুই করা হল না। এদিকে কে প্রকৃত দায়ী, তাও স্পষ্ট হল না। আফতাব দারোগা? নাকি ইংরেজ জজ সায়েব, কিংবা পাদরি সাইমন—নাকি এলাকার মোড়লরা? প্রতিপক্ষ অসংখ্য। স্বর্ণর অত শক্তি তো নেই। নিজের অসহায়তার দুঃখেই কি তাই মাঝে মাঝে তার মুখ শব্দহীন কান্নায় ধুয়ে যায়?….
সকালে সে স্টেশনে গেল জর্জের কাছে। পাদরি ছেলেটার জন্যে কতদূর তোলপাড় করছে, সেই খবর পেতেই। কিন্তু জর্জ নেই—সরকারি স্টেশন—মাস্টার সুধাময় গম্ভীর মুখে খাতা লিখছে। চাঁদঘড়ির বউ বলছিল, ছোটবাবুর বদলির হুকুম হয়েছে অ্যাদ্দিনে। যেতেযেতে আড়চোখে দাড়িগোঁফ আর লম্বা—চুলওয়ালা যুবকটিকে একবার দেখে যায় স্বর্ণ। মনে মনে বলে, ঢঙ। মনের ভিতরটা কী দুঃখময় জ্বালায় ছটফট করতে থাকে।
কোয়ার্টারে জর্জ বন্দুক সাফ করছিল। স্বর্ণকে দেখে সে বলে, ‘দিদি এসো। আজ আমি বাঘ মারবে।’
স্বর্ণ বলে, ‘বাঘ? আবার বেরিয়েছে নাকি?’
‘হাঁ। বেরিয়েসে। পাবলিক খবর দিয়েসে। এ ক্যাটল লিফটার—মানুষ খায় না।’ জর্জ হেসে ওঠে।
‘ও জর্জ, তোমার পাদরিসায়েবের খবর কী?’
‘কেন? সে ঠিক আছে—কী হয়েসে দিদি?’
‘কিছু না—এমনি।’….স্বর্ণ একটু পরে ফের বলে, ‘আচ্ছা জর্জ তোমাদের মহারাজ বদলি হয়ে যাচ্ছেন শুনলাম।’
জর্জ মুখ তোলে কাজ করতে করতে। —’হাঁ—যাবে। জুনমাসে। দিদি, সুঢাবাবু তোমাকে….’ হঠাৎ থেমে যায় সে।
স্বর্ণ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কী আমাকে?’
‘বলব? তুমি রাগ করবে না?’
‘না। বলো।’
‘খুব ভালোবাসে।’…বলে মুখ নামিয়ে বন্দুকের নল মুছতে থাকে জর্জ।
স্বর্ণ হাসে। বলে, ‘তুমিও তো আমাকে ভালোবাস জর্জ।’
অস্ট্রেলিয়ান স্টেশনমাস্টার মুখ তোলে। ভীষণ গম্ভীর মুখ। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে। কিন্তু কিছু বলে না—আবার মুখ নামায়।
স্বর্ণ ডাকে, জর্জ!’
‘বোলো দিদি।’
‘কী হল তোমার?’
‘কিছু না।’
‘তুমি কি রাগ করলে, জর্জ?’
‘না। স্ত্রীলোকের প্রতি আমি রাগ করি না।’
‘জর্জ, কেন তুমি এদেশে জন্মাওনি? তাহলে হয়তো তোমার কথা ভেবে দেখতাম।’ …বলে স্বর্ণ তার কাছাকাছি মেঝেতেই বসে পড়ে। …’অথচ দ্যাখো, চারদিকে আমার নামে কত কলঙ্ক। বাবা ফিরে এলে কতজনে কতকথা শুনিয়ে দেবে ওঁকে। দ্যাখো জর্জ, তবু যেন কলঙ্কে কী সুখ আছে—তুমি কলঙ্ক মানে বোঝোতো সায়েব?’
জর্জ নিঃশব্দে মাথা দোলায়।
‘স্ক্যান্ডাল।’….বলে স্বর্ণ একটু থেকে ওর মুখের ভাব লক্ষ্য করতে থাকে। স্বর্ণর ঠোঁটে চাপা হাসি!
জর্জ একটু করে পরিষ্কার তুলো দিয়ে ট্রিগার ঘষে। বার দুই টেপেও। তারপর মুখ নিচু রেখেই বলে, ‘আমি এদেশের লোক হইলে তুমি আমার কথা ভাবতে, দিদি? কী কথা ভাবতে?’
স্বর্ণ খিলখিল করে হাসে। …’তোমার লিনডা যেকথা ভাবত।’
জর্জ বিকৃতমুখে বলে, ‘আই হেট দ্যাট সিলি ক্যাট!’ তারপর উঠে দাঁড়ায়। বন্দুকটা বাইরে দূরে তাক করে কী দেখে নেয়। দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখে। তারপর ঘরে ঢুকে কার্তুজের বেল্টটা নিয়ে আসে। পরতে থাকে।
স্বর্ণ বলে, ‘এ কী! তুমি এখনই বাঘ মারতে বেরোচ্ছ নাকি?’
‘বেরোবে।’
‘কখনও বাঘ মেরেছ তুমি?’
‘সো হোয়াট?’
‘তুমি যেয়োনা, জর্জ। বরং আমার ঘরে চলো—একটা মজার জিনিস তোমাকে দেখাব! এ বিগ ফান!’
‘এখন বাঘ আমার বিগ ফান আছে।’…বলে জর্জ দরজায় তালা বন্ধ করে।
দুজনে বেরিয়ে আসে। সেই সময় দেখা যায়, চরণ চৌকিদার দৌড়ে আসছে। কাছাকাছি এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘ডাক্তারদিদি! হেরুর ব্যাটা পাদরি বাবার কাছ থেকে পালিয়ে গিয়েছে গো! এ কী কাণ্ড, দেখুনদিকি। সারা পৃথিবী আমি তোলপাড় করছি ইদিকে—কী সব্বোনাশ, কী সব্বোনাশ। ছোঁড়াটাকে আপনি দ্যাখেননি ডাক্তারদিদি? আসেনি ইদিকে?’
‘না।’ কঠোর মুখে স্বর্ণ বলে।
‘পাদরিবাবা আগুন হয়ে আছে গো। আমাকে বলেছিল চোখে—চোখে রাখতে। এটুকুন ফাঁক পেয়েই কেটেছে কাল বিকেলবেলা। কাল থেকে তল্লাটের সকল গাঁয়ে খুঁজছি—পাইনি রেতের বেলা টিশিনি এসেও চাঁদঘড়িদাকে শুধিয়েছি—না, সে দ্যাখেনি। হঠাৎ আজ সকালে খ্যাল হল—ডাক্তোরদিদি তো তল্লাটের অনেক খবর রাখেন—তাই এলাম।’ চরণ বলতে বলতে পিছনে হেঁটে আসে।
জর্জ ভুরু কুঁচকে শুনছিল। এবার বলে, ‘ট্রেনে পালিয়েসে—আমি ভাবছি। হাঁ—ফাদার বলে, সে ট্রেনে চাপতে ভালোবাসে খুব।’
চরণ লাফিয়ে ওঠে। …’হ্যাঁ হ্যাঁ মাস্টার হুজুর! ঠিক বলেছেন। তাই হবে। কিন্তু ইদিকে যে আমার পেরান যায়—যায় অবস্থা। কী করি।’
স্বর্ণ বলে, ‘গাঁজা খেয়ে শুয়ে পড়ো গে চৌকিদার।’
চরণ হলুদ দাঁত বের করে হাসে। …’অগত্যা তাই। পাদরিবাবা দেখে নিক গে। কিন্তু গতিক বড় খারাপ ডাক্তোরদিদি—বুঝলেন? পাদরিবাবা থানাপুলিশ করে বসবেন মনে হচ্ছে। আমার অদ্দিনের চাকরিটা ইবার যাবে গো! ডিউটি বরজায় (বজায়) রাখতে পারিনি—আমার দোষ খণ্ডায় কে?
চরণ সম্ভবত চাঁদঘড়িকে খুঁজতে পেল। জর্জ আর স্বর্ণ স্টেশনচত্বরে এসে দাঁড়ায়। সিগনালযন্ত্রের কাছে সুধাময় দাঁড়িয়ে আছে দেখে স্বর্ণ জর্জকে ফেলে একা হনহন করে নেমে যায় লাইনে। বড়োবড়ো পায়ে লাইন পেরিয়ে চলে যায়।
বাইরে থেকে তালা দিয়ে গিয়েছিল। এখন দ্যাখে, ছেলেটা বাইরের ঘর অর্থাৎ ডিসপেন্সারির জানালা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। স্বর্ণ অস্ফুট চেঁচিয়ে ওঠে—হাত নাড়ে—চোখ টেপে। ছেলেটা নড়ে না। তখন সে তালা খুলে ঢুকে দরজা বন্ধ করে এবং ছেলেটার হাত ধরে টানতে টানতে ভিতরের ঘরে নিয়ে যায়। বকতে গিয়ে হেসে ফেলে। …’হ্যাঁ রে তোকে যে কত করে বলে গেলাম, বাঁচতে চাস, বেরোবিনে! এক্ষুনি যদি চৌকিদারের চোখে পড়তিস, কী হত বুঝেছিস? চৌকিদার তোকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। পেলেই পাদরিবাবার কাছে নিয়ে যাবে। আমি তোকে বাঁচাতে পারব না বাবা, স্পষ্ট বলে দিচ্ছি।’
ডেভিড কী বুঝল কে জানে, একটু হাসল। তারপরই গম্ভীর হয়ে বলে ওঠে সে—’মনাই?’
‘মনাই! সে কি রে? মনাই কী বলছিস?’
ডেভিড অস্ফুট বলে, ‘পাখি কই, আমার পাখি?’
‘তুই পাখি পুষেছিলি বুঝি? বল তো পাখির ইংরেজি কী?’
‘বার্ড।’ চমৎকার ইংরেজিতে জবাব দেয় ছেলেটি। বিশুদ্ধ উচ্চারণ শুনে তাক লেগে যায়।
‘বাঃ আচ্ছা, বল তো—মানুষ ইংলিশ কী?’
‘ম্যা অ্যা—ন!’ টেনে উচ্চারণ করে সে।
‘বাঘ!’
‘টাইগা।’
‘ওরে বাবা! তুই তো বিদ্যের জাহাজ হয়ে গিছিস।’…
ক্রমশ স্বর্ণলতা টের পায়, তার জীবনে কী একটা সুখ বা আনন্দ অথবা উৎসব, একটা মৃদু পরিপূর্ণতা টলটল করে উঠছে। শূন্য ঘর ভরে গেছে। নিঃসঙ্গতা এবং সময়হীনতা জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেছে—এখন ঘরময় কথা, জীবনের উত্তাপ। স্বর্ণ আবিষ্ট হতে থাকে। ছেলেটার সঙ্গে অনর্গল কথা বলে চলে—চাপা গলায়, পাছে কেউ শোনে।
জনাকয় ওষুধ নিতে এসেছিল সেই সকালে। তাদের কেউ কেউ প্রশ্ন করেছে—’কে এসেছে ডাক্তোরদিদি? কথা বলছেন, মনে হল?’
স্বর্ণ বলেছে, ‘আমার এক ভাসুরপো।’
‘গোববহাটির লোকেরা তাহলে আজকাল খোঁজখবর নিচ্ছেন!’
‘হ্যাঁ। তা তো নিচ্ছেন।’
এইভাবে এড়িয়ে বেঁচেছে স্বর্ণ। ভিতরে গিয়ে আবার দুহাতে ছেলেটির দুহাত দোলাতে দোলাতে বলেছে, ‘হুঁ—এবার বল, সাধুবাবার কথা। বটতলায় খেলছিলি—তারপর তারপর—কী হল?’
ডেভিড অনেকটা সংকোচ কাটিয়ে উঠেছে আস্তে আস্তে। সে কেবল তার মনাই পাখি, সাধুবাবা আর বটতলার কথাই বলতে থাকে। অজস্র অস্পষ্ট শব্দ দিয়ে একটা প্রিয় পরিচিত জগৎকে প্রকাশ করে সে। সেই জগৎ ছেড়ে এসে যে সে অসুখী, তাও জানা যায়।
কিন্তু শেষঅব্দি স্বর্ণ বোঝে, খেলাচ্ছলে একটা অদ্ভুত সমস্যার সৃষ্টি করে বসেছে সে। জানাজানি যে—কোনো মুহূর্তেই হতে পারে। পাদরি সাইমন দৌড়ে আসতে পারে—পুলিশ নিয়েই আসতে পারে। তাছাড়া, স্বর্ণর ডাক এলে তখন একা একা রেখে যেতে ভরসা হয় না। একা থাকতে ছেলেটা ভয় পাবে না এটা ঠিক—শ্মশানমশানে নির্জন ভিটেয় সে পালিত হয়েছে। কিন্তু ছেলেপুলেদের ওই এক দোষ—বেশিক্ষণ ঘরে আটকে থাকতে চাইবে না। জানালা খুলে উঁকি দেবে এবং কারও না কারও নজরে পড়ে যাবে।
তারপর স্বর্ণ আরও ভাবে এবং মনমরা হয়ে পড়ে—একে এমন করে রেখে কী লাভ তার? পাদরি সাইমনের হাত থেকে বাঁচিয়ে কি কোনো পুণ্য অর্জন করতে চায় সে? কিংবা নিতান্ত হেরু বাউরির ছেলে—সেই দায়িত্ববোধ?
স্বর্ণ কিছু বুঝে উঠতে পারে না। অথচ একে হাতছাড়া করতে ইচ্ছে হয় না। ভুলতে পারে না বিকেলের সেই রুদ্ধশ্বাস পলাতক শিশুমূর্তি, সেই ত্রাস আর কান্না, অসহায়তা। অথচ এও তো একজন মানুষ—একটি সুন্দর ছোট্ট মানুষ! যে নির্ভয়ে তার কাছে রয়েছে, আনন্দেও আছে—নিশ্চিন্ত যে, তাকে আবার ভয় এবং দুঃখের দিকে ঠেলে দিতে মন চায় না।
এই ছেলেটি পৃথিবীতে নিতান্ত একা। মা নেই, বাবা নেই। এর মতো দুঃখী আর কে আছে? এক আজব সন্ন্যাসী এর মধ্যে যেন প্রকাশ করতে চেয়েছিল একটি পরিব্যাপ্তির ধর্ম—আকাশের বিশালতা আর স্বাধীনতা। ধর্ম বা শিক্ষাদীক্ষার শেকল এর পায়ে জড়াতে চায়নি সেই ক্ষ্যাপা সাধুটি। সে হয়তো চেয়েছিল, এই বালক মুক্তমানুষ। এবং যে স্বাধীনতায় প্রকৃতির ধারা—বয়ে চলেছে, এই শিশু হবে তার একটি প্রতীক।
খুব আবছাভাবে এইসব ভাবনা মাথায় আসে স্বর্ণর। মন আবেগে তোলপাড় করে। হুলুস্থুল ঝড় বয়ে যায় সারাটি দিন।
দুপুরে ধুলোউড়ির মাঠে ধুলো উড়ছে মেঘের মতো। ঝাঁঝালো বাতাস। উত্তাপ বেড়েছে। চিলের গলা ধকধক করে কাঁপছে। শুকনো তালপাতা অবিশ্রান্ত নড়ছে আর শূন্যতার আওয়াজ তুলছে। আর ঘরের মধ্যে স্বর্ণ একবুক উত্তাপ শীতল স্রোতে ভেসেছে ডুবছে।
ছেলেটি সারা দুপুর ঘুমিয়ে কাটায়। ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে গভীরতর মায়ায় আচ্ছন্ন হতে থাকে স্বর্ণ।
বিকেলে জর্জকে দেখা যায় টলতে টলতে ফিরে আসছে। একটা লাইনের ওপর পা ফেলে ভারসাম্য রেখে হাঁটবার চেষ্টা করে সে ছেড়ে দেয়। কাঠের তক্তায় লম্বা পা বাড়ায়। স্বর্ণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে পায় তাকে।
জর্জ স্টেশনের দিকে ঘোরে না—এদিকে আসে। তারপর স্বর্ণর বারান্দায় ওঠে সরাসরি। ম্লান হাসে—’হল না।’
স্বর্ণ দরজা ছেড়ে নড়ে না। পাছে জর্জ ভিতরে ঢুকে পড়ে। ডেভিড উঠোনে আপনমনে খেলা করছে—এ বাড়ির একান্ত বশীভূত। একটি প্রত্যঙ্গ যেন। এবং স্বর্ণ বলে, ‘বাঘ মারা অতো সোজা নয়, জর্জ। বাঘ কখনও দেখেছ? ছিল অস্ট্রেলিয়ায় বাঘ? অস্ট্রেলিয়ায় ক্যাঙারু থাকে।’
জর্জ রুমালে ঘাম মোছে। বন্দুকটা কাছেই ঠেস দিয়ে রাখে। তারপর বলে, ‘দিদি, চা খাব। খুব ক্লান্ত হয়েসি।’
এবার স্বর্ণর উপায় নাই। একটু সরে বলে, ‘এসো—কিন্তু খবরদার, ঘরের চেয়ার ছাড়া নড়বে না। তুমি বাইরে থেকে আসছ—আমরা তোমাকে কিছু ছুঁতে দেব না এখন। জাত যাবে।’
‘জাত?’ বন্দুকটা নিয়ে প্রশ্ন করে জর্জ।
‘হ্যাঁ—এ আমাদের হিন্দুদের নিয়ম!’
‘তুমি হিন্দু?’ হা—হা—হা— করে হাসে স্টেশনমাস্টার। তারপর আচমকা বন্দুকসুদ্ধ হাতে স্বর্ণর কাঁধ ধরে ফেলে। …’এই আমি টাচ করলাম তোমাকে। হাঁ—এবার মারো, দিদি। আমাকে মারো। এই বন্দুক দিচ্ছি—মারো একটা বুলেট।’
স্বর্ণ স্যাঁৎ করে সরে যায়। সারা শরীর হিম—নীল, পাণ্ডুর।
না, হেরুর ছেলের জন্যে নয়। ম্লেচ্ছ সাহেব তাকে ছুঁল, সেজন্যেও নয়। স্বর্ণ নিজেই জানাল, এই দ্রুত শিহরনের চাবুক এসে পড়া এবং ভিতরের মাংসে গভীরতর নীল দাগগুলো একটা করে ফুটে ওঠার কারণ, প্রচণ্ড এক পুরুষ তাঁকে ছুঁল।
সহকারী স্টেশনমাস্টার তাকে একদা ছুঁয়েছিল—নিছক ছোঁওয়া নয়, চুমু খেয়েছিল—আর অনেক পরে তার মনে হয়েছিল, নিষিদ্ধ আঙুর ফলের মতন টলটলে এই অধরোষ্ঠের পাশে সে এক অসহায় মালিনী! তাই সুখ পায়নি স্বর্ণ, দুঃখ পেয়েছিল। তাই ধুলো থেকে উঠেই ঘোড়া হাঁকিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল রাস্তা থেকে ঘরের দিকে।
আর, একদা তাকে ছুঁয়েছিল এক ছোটলোক হেরু বাউরি। যে—হাতে সে ডাকাতি ও খুন করে—সেই বিশাল ভয়ঙ্কর হাতে। যেন বৃক্ষচ্যুত করতে চেয়েছিল আঁরোয়া জঙ্গলে সঞ্চরমান এক বিচিত্র পরগাছার মতন স্বর্ণলতা নামে লতাকে। সেদিনও দারুণ ত্রাসে দিশেহারা হয়ে পালিয়ে এসেছিল সে।
কিন্তু আজ বড় সাধে যেন মনে হয়, পুরুষত্বের রঙে প্রগাঢ় এই ছোঁয়ার তুলি চকিতে ও দ্রুত মাংস ও হাড়ের ভিতর কিছু কামনার দীর্ঘ দীর্ঘ রেখা এঁকে দিয়েছে। তবু এত পাণ্ডুরতা! সে নীল হতে হতে পাণ্ডুর হল। হরিদবর্ণ শস্যক্ষেত্রের ধারে দাঁড়িয়ে চাষা যেমন নিজেকে অজস্র আকাঙ্ক্ষার ভিড়ে হারিয়ে ফেলে, স্বর্ণলতা নিজেকে হারাল কিছুক্ষণের জন্যে। বুঝতে পারল না—কী আকাঙ্ক্ষা তার শোভন।
আর অস্ফুটস্বরে বলে সে, ‘জর্জ! জর্জ!’
প্রাক্তন অস্ট্রেলিয়ান হর্সব্রেকারটি হা হা করে হাসে। শুধু বলে, ‘কিক মি—মারো আমাকে!’
স্বর্ণ আলগোছে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। যেন কিছু ঘটেনি নিজের মধ্যে, এভাবে সপ্রতিভ হয়ে পরমুহূর্তে কেড়ে নিয়ে বলে, ‘তুমি বরং বন্দুক ছোঁড়া শেখাও, জর্জ।’
জর্জ সামনের চেয়ারটাতে ধুপ করে বসে পড়ে। …’জল পান করব দিদি।’
স্বর্ণ ঘুরে বন্দুকটা রাখছিল। একবার ভাবে, ওকে ‘জল খাব’ কথাটা শিখিয়ে দেবে। কিন্তু তার চোখ যায় ভিতরের দরজায়। ডেভিড এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে! স্বর্ণ চোখ টেপে। তবু ছোঁড়াটা সরে যায় না। হঠাৎ সে আরও দেখতে পায়, ডেভিডের একটা আঙুল রক্তাক্ত। অমনি পাখির মাটি থেকে ওড়ার মতন ভঙ্গিতে সে পুরো সেই দরজা ঢেকে ওকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। তখন ঘাড় ঘুরিয়ে বড় স্টেশনমাস্টার সব দেখতে পায়। উঠে দাঁড়ায়। অবাক হয়ে বলে, ‘মাই গুডনেস! হি ইজ হেয়ার! দিদি, ডেভিড তোমার এখানে!’
স্বর্ণ জবাব দেয় না। ডেভিডকে নিয়ে সোজা ভিতরের ঘরে চলে যায়।
জর্জ কিন্তু ফের বসে পড়ে। আপন মনে হাসে। পা দুটো দোলায়।
বাঘটা একবার যেন দেখেছিল—মাত্র একপলকের জন্যে। জঙ্গলের ছায়ার মধ্যে ডোরাকাটা শয়তান! …আমি তোমাকে খুন করবই—দ্যাটস এ প্রমিজ—প্রতিজ্ঞা। ইউ আর এ পুওর ক্যাটললিফটার—নিতান্ত গোরুখেকো বাঘ—কিন্তু, দ্যাটস এ প্রমিজ। …গোঁয়ার দুর্ধর্ষ সেই আদিম মানুষটি তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিভ্রম বা হ্যালুসিনেসান দেখতে পায়। ওই বটগাছটার তলায় দিনশেষের ঘন ছায়ার মধ্যে বিদ্যুতের মতন বারবার ঝলসে ওঠে জন্তুটা। মনে হয়, বড় ভয় পেয়ে গেছে জর্জকে। জর্জ হাসে আর মনে মনে বলে, আই মাস্ট কিল ইউ!
অনেক পরে স্বর্ণ চায়ের কাপ নিয়ে আসে। নিঃশব্দে ওর হাতে কাপটা ধরিয়ে দিয়ে দরজার কাছে দাঁড়ায়। জর্জ বলে, ‘ডেভিডকে কোথায় পেলে দিদি?’
‘পালিয়ে এসেছে।’…..স্বর্ণ নিরাসক্ত মুখে জবাব দ্যায়।
জর্জ এত জোরে হাসে যে কাপ থেকে চা পড়ে যায়। ….’ফাদার জানতে পারলে গোলমাল হবে। নিয়ে যাবে ডেভিডকে। তখন—তখন তুমি কী করবে? তুমি স্ত্রীলোক—ফাদার পুলিশ নিয়ে আসবে। তখন—তখন?’
স্বর্ণ গম্ভীর মুখে বলে, ‘আসুক। দেখা যাবে।’
‘তুমি পারবে না, দিদি। ফাদার একজন ইংলিশম্যান আছে। গভর্নমেন্ট তাকে সাহায্য করবে।’
স্বর্ণ আস্তে বলে, ‘তুমি নিশ্চয় কানে তুলে দেবে ফাদারের। তোমার জাতভাই—তোমার ধর্মগুরু।’
জর্জ ঠোঁটে কাপ তুলতে গিয়ে নামায়। বলে, ‘আমি ফাদারকে পসন্দো করছি না দিদি। ফাদারের কাজ আমার ভালো লাগে না। দ্যাট ডেড রিভার—ঝিলটা গভর্নমেন্ট প্রপার্টি আছে। সৈদাবাদ জমিন্দারের প্রপার্টি ছিলো—নীলাম হয়েছিল! তারপর কী গোলমাল হল, গভার্নমেন্ট রাখল—দিল না। দেন—এখন ফাদার বললেন, যে লোক ঝিল থেকে কিছু নেবে—আই মিন, ফিস অর এ্যানি ড্যাম থিং, তাকে খ্রিস্টিয়ান হতে হবে।’
স্বর্ণ নখ খুঁটতে খুঁটতে বলে, ‘শুনেছি।’
‘তো অনেক গোলমাল আছে। আমি কিছু বলি না ফাদারকে। বলা উচিত হয় না’…একটু হেসে জর্জ ফের বলে, ‘তুমি দেখবে—বাঘটা মেরে সুঢাবাবুর মতন বদলি হবো। আই কানট স্টে হেয়ার—থাকবো না। ভালো লাগে না দিদি।’
খুব তাড়াতাড়ি চা গিলে নিয়ে মেঝেয় কাপটা রাখতে যায় সে। স্বর্ণ হাত বাড়িয়ে নেয়। এক মুহূর্তের জন্যে সংস্কার ঝিলিক দিয়েছিল—অভ্যাসে, এবং বরাবর তাই হয়—সে কড়া মনে শাসন করে নিজেকে! তারপর বলে, ‘তুমি এক্ষুনি চলে যাচ্ছ?’
‘হ্যাঁ! তো কী করব? ডিউটি দিতে হবে না? সুঢাবাবু ভাবছে শেষবার তাকে কষ্ট দিচ্ছি।’ বলে জর্জ উঠে দাঁড়ায়।
‘থামো তো! যে আমার স্টেশন, তার রেলগাড়ি—তার ডিউটি! জর্জ তুমি কিছুক্ষণ থাকো। প্লিজ!’
‘কেন দিদি?’
‘তুমি আমাকে দিদি কেন বলো? আমি তোমার চেয়ে বয়সে কত ছোট। বলছি—দিদি বলবে না।’
‘দিদি বলব না? তো কী বলব?’
‘মিস রায় বলবে।’
‘মাই! তোমার হাজব্যান্ড—স্বামী ছিল—মারা গেছে। তুমি বিবাহ করবেনা আর। তোমাকে মিস বলব কেন? বলব না।’
‘না—না! আমাকে তুমি মিস রায় বলবে।’
‘অর্ডার?’
‘হ্যাঁ। আমি তোমার টিচার না?’
‘রাইট, রাইট! ঠিক আছে। মিস রায় বলব।’ সকৌতুকে মাথা দোলায় জর্জ।
‘তুমি কিছুক্ষণ বসো, জর্জ। কথা আছে।’
জর্জ ফের বসে পড়ে। বলে, ‘কী কথা আছে, বলো।’
স্বর্ণ কাপটা জানলার ধারে রাখে। সেখানেই একটু হেলান দিয়ে বসে। বাইরেটা দেখে নেয়। সন্ধ্যার ধূসরতা ঘনিয়েছে চারদিকে। কী একটা গাড়ি আসার মৃদু আওয়াজ শোনা যাচ্ছে দক্ষিণে ডাউন সিগনালের দিক থেকে। নির্জনতা এখন এইসব সময়ে শূন্যতার মতন লাগে। বটতলায় ময়রাবুড়ির দোকানে আলো জ্বলে উঠল। দুজন চাষাভুষো মানুষ সেখান থেকে এইমাত্র গ্রামের দিকে চলে গেল চাপা গলায় কথা বলতে বলতে। বাতাস এলোমেলো বইছে। তালগাছের পাতাগুলো অস্পষ্ট খড়খড় শব্দ তুলেছে। টেলিগ্রাফের তারে বসে আছে কয়েকটা পাখি—ছবির পাখির মতন। দেখতে দেখতে গাড়িটা এসে পড়ে। সব নির্জনতা চুরমার হয়ে যায়। প্রচণ্ড নির্ঘোষে স্থাবর জঙ্গম আলোড়িত হতে থাকে কিছুক্ষণ। বিরক্তিকর শব্দটা যতক্ষণ না মিলিয়ে যায়, স্বর্ণ চুপ করে থাকে। তারপর কথা বলতে গিয়ে দেখে, জর্জ এতক্ষণ তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। ….’জর্জ’! স্বর্ণ ডাকে।
‘কী কথা বলবে, মিস রয়?’ কৌতুকের অভ্যস্ত স্বাদ জর্জের কণ্ঠস্বরে। ‘মিস রয়! এ ফানি নেম! ইউরোপিয়ান!’
‘জর্জ, তুমি তো খ্রিস্টান। পুনর্জন্ম কী জানো? রিবার্থ বলে আমাদের একটা কথা আছে, শুনেছ?’
‘খুব—খুব চমৎকার কথা। শুনেছি। জানি। র্যাদার আই ফ্যান্সি—আমার মনে হয়, ওয়ান্স আই ওয়াজ হেয়ার—ইন দিস প্লেস! এখানে আমি আগেও এসেছিলাম। তখন আমি কিন্তু ব্রাহ্মিন ছিলাম তোমার মতোন। হ্যাঁ—পিওর ব্রাহ্মিন। বিশ্বাস করো।’….জর্জ হু হু করে বলে যায়। …’তুমি কিন্তু তখন কে ছিলে, বলব? এ প্রিন্সেস অফ দ্যাট হিস্টোরিক প্লেস—কর্ণ সুবর্ণ। ইওর লুক—চোখ দুইটি, তোমার কথাবার্তা—এভারিথিং প্রুভস দা ফ্যাক্ট।’
স্বর্ণ বলে, ‘জোক করোনা, জর্জ। আমার মন ভালো নেই।’
‘কেন ভালো নেই? ফাদার অ্যান্ড দ্যাট পুওর বয় ডেভিড—ইজ ইট দা প্রব্লেম?’
‘হয়তো’। বলে স্বর্ণ কী ভাবতে থাকে।
‘ডেভিড তো ফাদারের কাছে ভালো ছিল! এডুকেশান পেত—’
‘কিন্তু ও তো থাকতে চায়না ওখানে। পালিয়ে আসে’।
‘হাঁ, দ্যাটস ট্রু—সত্যি কথা।’
‘আমি শুধু একটা কথা ভাবছি—ওকে দূরে কোথাও রাখতে পারলে ভালো হত।’
জর্জ কিছু বলে না। বন্দুক দেখতে থাকে।
স্বর্ণ একটু ঝুঁকে আসে। …’জর্জ, তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট ভদ্রলোক কবে যাচ্ছেন এখান থেকে?’
‘ফার্স্ট জুন। কেন?’
‘কোথায় যাচ্ছেন?’
‘অনেক দূরে—পূর্ণিয়া ডিসট্রিক্টে। তিনপাহাড়ি স্টেশন। প্রমোশন পেয়ে এস এম হয়ে যাচ্ছে সুঢাবাবু। বাট দা স্টেশন ইজ—ছোট—অনেক ছোট। এ ব্র্যাঞ্চ লাইন।’
স্বর্ণ হিসেব করে বলে—’আর মাত্র দিন পাঁচেক পরে। জর্জ, তুমি আমার হয়ে ওকে একবার বলবে? ছেলেটাকে যদি নিয়ে গিয়ে রাখে! আমি জানি ও ফাদারের এক নম্বর শত্রু। তাই বিশ্বাস হয় ওর অমত হবে না। একা মানুষ। ব্রহ্মচারী!’
‘হোয়াট?’
‘ব্রহ্মচারী—স্ত্রীলোক দেখলে ভয়ে পালায়।’ ….স্বর্ণ একটু হাসে।
জর্জ কিন্তু গম্ভীর হয়ে মাথা দোলায়। …’ইন্ডিয়া ইজ এ ভেরি ভেরি মিসটিরিয়াস কানট্রি! সো মেনি আনন্যাচারল থিংস! ব্রমোসারি।’
‘হ্যাঁ, ব্রহ্মচারী। সন্ন্যাসী; তা জর্জ, ও কি এই অনাথ ছেলেটার দায়িত্ব নিতে পারবে না? লেখাপড়া—ইচ্ছে হলে শেখাবে। কিন্তু আমি চাই, তোমাদের ফাদারের হাত থেকে ও বাঁচুক।’
‘খ্রিস্টিয়ান হওয়া কি অপরাধ বলছ মিস রায়?’
‘না। তুমিও তো খ্রিস্টান জর্জ।’
‘তবে কেন?’
‘আমার ইচ্ছা—আর কিছু বলতে পারব না তোমাকে।’
‘নো এক্সপ্লানেশন?’
‘হ্যাঁ।’
‘বেশ কথা। বলছি এখন।’
‘এই পাঁচটা দিন আমি ওকে আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেদের হাতে পায়ে ধরেও লুকিয়ে রাখতে রাজি করাব। তারপর…’
চাঁদঘড়ি খালাসি সেই সময় রেললাইনের ধার ঝেঁকে চেঁচিয়ে ডেকেছে—’ডাক্তারদিদি, ডাক্তারদিদি! বড়সায়েব আছে নাকি ওখানে? তার এসেছে।’
জর্জ শুনতে পেয়ে বন্দুক হাতে বেরিয়ে যায়। বলে যায়, ‘বলব সুঢাবাবুকে। তুমি আমার সঙ্গে দেখা করবে পরে—হ্যাঁ, আজ রাতে। দুইটি ঘণ্টা পরে। চলি গুড বাই।’….
রাত নটার ডাউন লোকাল চলে গেলে চাঁদ উঠেছে রাঙামাটির মাথায়। ক্ষয়ের চাঁদ। জ্যোৎস্না ঠিক আলো নয়, একটা রহস্য। প্রকৃতি এখন নিজে দরজা খুলছে মনে হয়। কতক্ষণ জর্জের অপেক্ষা করে স্বর্ণ বেরিয়ে আসে। ছেলেটা ঘুমোয়নি হয়তো তখনও। আঙুল কেটে ফেলেছিল অনেকটা—টনটন করছে বলেছে! ঘরে পিদিম জ্বলছে। বেরিয়ে এসে ছেলেটার জন্য মায়ায় বত্রিশ নাড়ি পাক খায় স্বর্ণর—কিছুক্ষণের জন্যে। ছেলেটার সঙ্গে তার জীবনের এত মিল! উদ্দেশ্যহীনতার মিল, সুখ—দুঃখের মিল, ইচ্ছা অনিচ্ছার মিল।
লাইনের ধারে দাঁড়িয়ে কিছু সময় চাঁদ দেখে সে। স্টেশনের ভিতরে আলো জ্বলছে—কে বসে আছে জর্জ না সুধাময়, চেনা যায় না। অস্পষ্ট একটা মূর্তি।
হ্যাঁ, প্রকৃতি আজ রাতে নিজের দরজা হাট করে খুলে দিয়েছে। তার ঘরের মধ্যে আরেক স্টেশনঘর, আলোছায়ায় আঁকা আরেক মানুষ—চেনা মানুষদের প্রতিবিম্ব, যাদের কখনও জানা যায়নি। জর্জ যেতে বলেছিল, নাকি নিজেই যাচ্ছে, বুঝতে পারে না বিধবা স্ত্রীলোকটি। তার খালি মনে হয় নিজেও এই পারিপার্শ্বিকের প্রত্যঙ্গ—প্রকৃতির মস্তিষ্ক থেকে আদেশ এলে তার মুভমেন্ট সম্ভব। নতুবা, দূরের জংশনে বিকল ট্রেনের প্রতীক্ষায় থাকা যাত্রীর মতন দাঁড়িয়ে তার পায়ের তলায় ঘাস গজাবে।
যেন প্রকৃতিই ডাকে। স্বর্ণ পা বাড়ায়। প্রথম পদক্ষেপে জড়তা এবং কী শীতল লাগে এই লৌহবর্ম। দ্বিতীয় পদক্ষেপে নিচের কঠিন বস্তুরাজি গলে যায় সহসা। যেন স্রোতকে সোজা পার হয়ে যায় স্বর্ণ। চাঁদ স্পটলাইটের মতন তার মুখের ভাব স্পষ্ট করতে থাকে। নাসারন্ধ্রে স্পন্দন দৃশ্যমান হয়। চোখ দুটো চকচক করে। এবং অবশেষে পরিপূর্ণ আদিমতা ফোটে।
স্টেশনঘর জিভ বের করে হাঁফাতে থাকে তাকে দেখে। হাঁটু দুমড়ে এক প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী তার জন্যে অপেক্ষা করছিল এতক্ষণ। কতক্ষণ পরে বড় একটা প্রশ্বাস ফেলে স্বর্ণ। তারপর ঘরে ঢুকে চাপা গলায় ডাকে, ‘ছোটবাবু!’
ছোটবাবু সুধাময় সাঁৎ করে ঘুরে যায়। দাড়িগোঁফ সন্ন্যেসীচুল নিয়ে তার তরুণ মুখমণ্ডল তারপর স্লেটে আঁকা মতন স্থির হয়। স্বর্ণ তার খুব কাছে গেলেও সেই স্থিরতা ঘোচে না।
স্বর্ণ তার পাশে টেবিলে পাছা ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। বলে, ‘জর্জ তোমাকে কিছু বলেনি ছোটবাবু?’
একবার সুধাময় একটু স্পন্দিত হয়। ….’স্বর্ণ! হুঁ, আমি—আমি কী বলব ঠিক ভেবে পাচ্ছিনে। সব ওলট—পালট হয়ে যাচ্ছে। একটা ভুল বোঝাবুঝি…বিশেষ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। তাহলেও…হ্যাঁ, জর্জ আমাকে বলেছে তোমার অদ্ভুত কীর্তির কথা। ছেলেটাকে নিতে আমার আপত্তি ছিল না, স্বর্ণ। ওকে আমি নিতুম। বস্তুত, ছেলেটা ঈশ্বরের সন্তান হয়েই দাঁড়িয়েছে।…খিকখিক করে হাসে সে। এবং তারপর এক পরামাশ্চর্য ব্যাপার ঘটতে থাকে। সে মুখে এবং মনে দুইপ্রকার বাক্য একইসঙ্গে এবং তেমনি বিস্ময়কর দক্ষতায় উচ্চারণ করে চলে। …..
মনে মনে : ‘ছেনাল বেশ্যা মাগি! ম্লেচ্ছ কেরেস্তান নিয়ে অহরহ ঢলাঢলি করছিস—তাকেই বলগে না! ভাত দেবার বেলায় আমি,…(অশ্লীল) আসুক তোর বাবা। সব খুলে লিখে পাঠাব তিনপাহাড়ি থেকে বেনামি চিঠিতে। গলায় দড়ি জোটে না খানকি কাঁহাকা! হেরু বাউরির ব্যাটার জন্যে নেউ (স্নেহ) উথলে উঠছে। কেন উঠেছে আমি কি বুঝিনা ভাবছিস? এখনও ঘর খুঁজলে কাঁড়িকাঁড়ি ডাকাতির বামাল বেরোবে। আমি জানি? ওরে আমার ইয়ে! ফি—হপ্তায় পাঁঠা জর্জটিকে নিয়ে কাটোয়া—কলকাতা করছিস কীজন্যে, সব জানি। স্বর্ণকারের দোকানে না যেয়ে থাকিস তো আমার নামে কুকুর পুষে দোব। নাকি আলিপুরে জেলে বাপকে দেখতে যায়! ওরে বাবা—সোহাগী! হুঃ…এই শালা ইংরেজরাজত্ব না হলে দেখে নিতুম জর্জব্যাটাকে!’
মুখে : ‘তবে কী, দেখ স্বর্ণ—আমার দিকটাও বিবেচনা করার আছে। বিয়ে করিনি—কিন্তু ফ্যামিলি আছে দেশে। বাবা—মা ভাই—বোন নিয়ে অনেকগুলো পেট। ইংরেজের রাজত্ব। পাদরিটা যদি কোনোগতিকে জানতে পারে যে আমার কাছে ওর বামাল রয়েছে, বুঝতেই পারছ, আমার পরিণতি কী হবে! চাকরি তো যাবেই…জেল খাটিয়ে ছাড়বে। ওর খ্রিস্টিয়ান হেমের একটি অনাথ বালক চুরি করার চার্জে কিডন্যাপিং কেসে ফেলবে। তার শাস্তি মৃত্যু অথবা যাবজ্জীবন। না—আমি ভীতু নই, স্বর্ণ। তুমি তো জানো, কী ঝুঁকি নিয়ে পাদরির লাঞ্ছনা করেছি—তুমি না শাসালে ওর খোড়ো চার্চে আগুনও জ্বালিয়ে দিতুম। পাদরিটাকে আমি ঘৃণা করি। অবশ্য সবই তোমার দিকে তাকিয়ে—তা অনুভব নিশ্চয় করো তুমি! অথচ স্বর্ণ, আমি সত্যি এব্যাপারে বড় অসহায়। আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে তোমার অনুরোধ রাখতে পারছি না বলে। কিন্তু কী করব? এটা ইংরাজ রাজত্ব।’
ঠিক বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের চরিত্রের মতন কথা বলে সহকারী স্টেশনমাস্টার। স্বর্ণ বঙ্কিমচন্দ্র পড়েছে। তার বাবা সাহিত্যানুরাগী মানুষ আজীবন। এবং স্বর্ণও এসব কারণে মনে ও মুখে সুধাময়ের মতনই দুরকম কথা বলে। কিন্তু কথাগুলো স্পষ্ট। মনে বলে—’তুমি আসলে একটি কিম্ভূত নপুংসক ছোটবাবু। এই আমি যদি এখুনি তোমাকে জড়িয়ে ধরি এবং অশ্লীলতম প্রস্তাব করি, তুমি ভিরমি খাবে। তোমার সাধ প্রচুর, সাধ্য একতিল নেই। আর তা থাকলেও, স্বর্ণলতার শরীর তোমার জন্য নয়। আমি শেষবার পরীক্ষা করতে চেয়েছিলুম যে তোমাকে সত্যি ঘৃণা করি নাকি। করি ছোটবাবু। কারণ, একটা চমৎকার স্বপ্ন তৈরি হবার মুখে তুমি তা নষ্ট করে ফেলেছিলে। তুমি যে আমার যোগ্য নও, ধরা পড়েছিল স্পষ্ট হয়ে।’ এবং সে মুখে সংক্ষিপ্ত বাক্য উচ্চারণ করে, ‘হ্যাঁ—তোমার সমস্যা আছে। দেখি, কী করা যায়!’
তারপর সে সরে আসে। চলে আসবার জন্য পা বাড়ায়। তখন সুধাময় তাকে ডাকে—”স্বর্ণ, শোন।”
স্বর্ণ দাঁড়ায়।
‘বলছিলুম কী, হেরুর ছেলে নিয়ে তোমার ঝামেলা করা উচিত হয় না। কী দরকার?’
স্বর্ণ কেমন হাসে শুধু।
‘পাদরিটা শয়তান। তুমি স্ত্রীলোক—মাথার ওপর কেউ নেই। তাই বলছি…’
স্বর্ণ ঘোরে। পা বাড়ায়।
সুধাময় উঠে আসে। পিছনে পিছনে এসে বারান্দায় দাঁড়ায়। …’আশ্চর্য! একটা স্বপ্ন—সুন্দর স্বপ্ন। তাছাড়া কী? তুমি হঠাৎ আবার আসবে—আমার সঙ্গে কথা বলবে—ভাবিনি! উঃ, কী বিচিত্র মানুষের এই জীবন!’
স্বর্ণ বারান্দা ঘুরে স্টেশন কোয়ার্টারের দিকে এগিয়ে প্রথম পা জ্যোৎস্নায় পড়ামাত্র বলে, ‘তুমি নাকি সন্ন্যাসী হয়ে যাচ্ছ? অবশ্য গৃহী সন্ন্যাসী। তাদের স্ত্রীলোকের প্রতি টান থাকবে না—তারা ছেলেপুলের বাপ হবে না, তা আমি বলছি না।’
তার হাসির শব্দ ছিটকে এসে আঘাত করে সন্ন্যাসীমনা প্রেমিকের—কিংবা প্রেমিকমনা সন্ন্যাসীর—অথবা শুধুই এক দুর্বলচেতা তরুণ সহকারী স্টেশনমাস্টারের মুখে। সে দাঁড়িয়ে থাকে ছায়ার মধ্যে। মনে মনে বলে, ‘আরে যা যা খানকি কাঁহেকা!’ …
জর্জ খেতে বসেছে তখন। প্রকাণ্ড দুটো বানরুটিতে জেলি মাখাচ্ছে আর কামড়াচ্ছে। একডজন কলা রয়েছে, কাগজে জড়ানো আপেল আছে অনেকগুলো। টিনের কৌটোয় শুকনো মাংস আছে। কাটোয়া থেকে তার দুবেলা খাবার আসে। ইউরোপিয়ান ক্যানটিনে ব্যবস্থা করা আছে। সময়মতো নামিয়ে দিয়ে যায় স্টেশন ক্যাটারিং কোম্পানির লোকেরা। স্বর্ণকে দেখে সে ইশারায় বসতে বলে।
যতক্ষণ তার খাওয়া না হয় কোনো কথা বলে না সে। একসময় স্বর্ণ জিগ্যেস করে, ‘তুমি গোরুর মাংস খাও না, জর্জ?’
জর্জ স্টেশনের সুপ্রসিদ্ধ ইঁদারার জল খাওয়ার পর মুখ মুছে তার জবাব দেয়। হেসে বলে, ‘আমি হিন্দু নয়। ইন্ডিয়ান ব্রাহ্মিন না আছে মিস রয়।’
‘ওই কৌটো থেকে কী খেলে? মাংস না? কীসের?’
‘পর্ক। শুয়োর।’
‘সুধাবাবুর কাছ থেকে এলুম। সে পারবে না বলল।’
জর্জ সিগ্রেট ধরিয়ে খাবার টেবিলেই বসে পড়ে বলে, ‘হাঁ। বলেছিল আমাকে। সে কাওয়ার্ড—ভয় পাইল। তো—আমি বলছি, ছেলেটা রিটার্ন দাও।’
স্বর্ণ ঠোঁট কামড়ে বলে, ‘না।’
‘কোথায় রাখিবে তাকে?’
‘আমার মাথায়।’….বলে স্বর্ণ হঠাৎ উঠে পড়ে। দরজার দিকে পা বাড়ায়। তার বুকের ভিতরে হু হু করে কীসের আগুন জ্বলে যেতে থাকে।
আর জর্জ চকিতে দরজা আটকায়। …’কী হল তোমার?’
আলগোছে ওর বিশাল বাহুটা সরিয়ে দিয়ে স্বর্ণ বলে, ‘ছাড়ো, যেতে দাও।’
বাহু সরে। কিন্তু জর্জ বলে, ‘কেন? আমি কি অপরাধ করল? কেন যাবে?’ ‘আমি যদি যেতে না দিব তোমাকে? কী করবে? পারবে? আমাকে মারবে?’
‘অসভ্যতা করো না জর্জ।’
চোয়াড় অস্ট্রেলিয়ান এতদিন পরে নির্ভুল স্পষ্ট উচ্চারণ করে—’স্বর্ণলতা! প্লিজ—আমার কথা আছে। যাবে না।’
‘তুমি মদ খেয়েছ জর্জ। তোমার মুখে মদের গন্ধ।’
‘দ্যাটস রাইট। ঠিক কথা। কিন্তু তুমি যাবে না—কথা আছে। সেইজন্য তোমাকে আমি আসতে বলেছিল। তুমি বসো।’
‘তোমার ঘরে বসে কিছু শুনব না—কাল দিনের বেলা আমার ঘরে যাবে।’
‘ডু ইউ ইনভাইট মি? নিমন্ত্রণ করল?’
‘হ্যাঁ। আমাকে যেতে দাও।’
জর্জ হাঁফাতে হাঁফাতে বলে—’আমি এক ডেড ম্যান—মরা লোক, স্বর্ণলতা! জাস্ট এ ঘোস্ট ইজ ক্যারিং দা বডি অফ অ্যান আননোন ম্যান। আই ক্যান্ট—ক্যান্ট আইডেন্টিফাই দা ড্যাম থিং। আইম ইন দা হেল অফ এ মেস!’
‘জর্জ, জর্জ! তুমি কী চাও আমার কাছে?’
‘জার্স্ট স্ট্রাইক মি! হাঁ—আমারে মারো মিস রয়, স্ট্রাইক দা সান অফ এ বিচ। কিক দা বাস্টার্ড!’
‘জর্জ! মাতলামি করো না। আমি চেঁচিয়ে লোক ডাকব বলে দিচ্ছি।’
‘জাস্ট সি দা ফান! আমি একদিন সুঢাবাবুকে জিজ্ঞাসা করল—আমি হিন্দু হইতে ইচ্ছা করি। তো সে বলল—নো—নেভার স্যার। কেহ হিন্দু হইতে পারে না। এ হিন্দু ইজ বরন!’
‘কেন তুমি হিন্দু হতে চাও জর্জ? আমার জন্যে?’
‘ইউ আর উইপিং! কাঁদল কেন? হোয়াট হ্যাপনড?’
স্বর্ণ হু হু করে কেঁদে উঠল। দুহাতে মুখ ঢেকে বলল, ‘আমাকে যেতে দাও!’
বিস্মিত অস্ট্রেলিয়ান একটু সরে বলল, ‘আমি অ্যাপলজি চাইল। তুমি যাও।’
দ্রুত ছুটে যেতে—যেতে স্বর্ণ ইন্দারার কাছে একজন মানুষের সঙ্গে ধাক্কা খেল। মানুষটা সহকারী স্টেশনমাস্টার। সে দেখল এক অলীক উপদ্রব সাদা শরীর নিয়ে ছায়ায় মিশে গেল।