১২. ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ

ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ

ঘর থেকে খুব সাবধানে আমি মাথা বের করলাম। দীর্ঘ করিডরে কেউ নেই। আমি হাত দিয়ে জিগিকে ইঙ্গিত করতেই সে আমার পিছু পিছু বের হয়ে এল। ক্রানার সিকিউরিটি কার্ড ব্যবহার করে বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে বের হয়ে এসেছি, কাজেই কোথাও কোনো এলার্ম বেজে ওঠার কথা নয় কিন্তু তবু আমি কান পেতে একটু শোনার চেষ্টা করলাম, চারপাশে এক ধরনের সুনসান নীরবতা।

আমি আর জিগি পাশাপাশি দ্রুত হেঁটে যেতে থাকি। এই কেন্দ্রটি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই, কোথায় যাচ্ছি ভালো করে জানি না তবুও এখান থেকে একটু দ্রুত সরে যেতে হবে। করিডরের অন্য মাথায় পৌঁছানোর আগেই অন্য পাশ থেকে দুটি সাইবর্গ হেঁটে আসতে দেখলাম, তাদের চোখে-মুখে সাইবর্গসুলত এক ধরনের উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি, আমি এবং জিগি মুহূর্তের জন্যে খুব বিপন্ন অনুভব করি কিন্তু সাইবর্গ দুটো আমাদের দুজনকে পাশ কাটিয়ে হেঁটে চলে গেল। ক্রানার সিকিউরিটি কার্ডটি সম্ভবত আমাদেরকে নিরাপদ মানুষ হিসেবে চারপাশে একটি সংকেত পাঠাচ্ছে।

সাইবর্গ দুটি পাশ কাটিয়ে বেশ খানিকটা দূরে সরে আসার পর জিগি তার বুকের মাঝে আটকে থাকা নিশ্বাসটি বের করে দিয়ে বলল, এভাবে হাঁটা উচিত হচ্ছে না, যে কোনো মুহূর্তে ধরা পড়ে যাবে।

হ্যাঁ। আমি মাথা নাড়লাম, চলো কোথাও আগে লুকিয়ে পড়ি।

করিডরের দুই পাশে ছোট ছোট ঘর। কোথায় কী আছে জানা নেই, সিকিউরিটি কার্ডটি থাকার জন্যে সম্ভবত এর কোনো একটিতে আমরা লুকিয়ে পড়তে পারব। আমি সাবধানে একটি ঘর খুলে উঁকি দিলাম, ভেতরে কেউ নেই। আমি আর জিগি সাবধানে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে আবার একটা লম্বা নিশ্বাস ফেললাম। এই ঘরটি ইলেকট্রিক্যাল পাওয়ার এবং ডাটা লাইনের একটা সংযোগ কেন্দ্র বিন্ডিংটির নানা অংশ থেকে নানা ধরনের। তার, ফাইবার এবং ক্যাবল এখানে এসে একত্র হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কান পেতে থাকলে এখানে স্বল্প কম্পনের চাপা একটি গুঞ্জন ধ্বনি শোনা যায়।

আমি মাকড়সার জালের মতো ছড়ানো–ছিটানো তার, ফাইবার এবং ক্যাবল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ঘরের অন্যান্য যন্ত্রপাতি লক্ষ করছিলাম তখন হঠাৎ করে জিগির বিস্ময়ধ্বনি শুনতে পেলাম, ওরে সর্বনাশ!

আমি জিগির দিকে ঘুরে তাকালাম, কী হয়েছে?

জিগি হাত দিয়ে কালো রঙের মোটা একটি ক্যাবল দেখিয়ে বলল, এই দেখ।

এটা কী?

পাওয়ার ক্যাবল। সুপার কন্ডাক্টিং পাওয়ার ক্যাবল, জিগা–ওয়াট২২ পাওয়ার নেওয়ার ব্যবস্থা।

জিগা–ওয়াট? আমি অবাক হয়ে বললাম, কী বলছ তুমি? এই ছোট বিল্ডিঙের মাঝে জিগা–ওয়াট পাওয়ার ক্যাবল?

হ্যাঁ।

কেন?

সেটা আমারও প্রশ্ন। জিগি ভুরু কুঁচকে চিন্তা করার চেষ্টা করে বলল, এটা অসম্ভব। এই বিল্ডিঙের যে পরিমাণ শক্তি দরকার তার জন্যে এত পাওয়ার লাগার কোনো কারণ নেই। তুমি জান সুপার কষ্টিং পাওয়ার ক্যাবল তৈরি করতে কী পরিমাণ যন্ত্রণা?

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, জানি।

শুধুমাত্র লিকুইড হিলিয়াম সাপ্লাই চালু রাখতেই বারোটা বেজে যায়। অন্য ব্যাপার তো ছেড়েই দাও।

তা হলে এটা এখানে কেন আছে?

জিগি তার পোশাকের ঝুলে থাকা অংশগুলো ট্রাউজারের ভেতর খুঁজে নিয়ে বলল, চলো বের করে ফেলি।

বের করে ফেলবে?

হ্যাঁ। করিডর দিয়ে হাঁটাহাঁটি করলে এমনিতেই ধরা পড়ার ভয়। তার চাইতে ধরো এই পাওয়ার ক্যাবল ধরে ঝুলতে ঝুলতে যাই।

জিগি ঠাট্টা করছে না সত্যি বলছে বুঝতে আমার একটু দেরি হল–আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম সে ঠাট্টা করছে না সত্যিই বলছে। আমি ইতস্তত করে বললাম, কাজটা খুব সহজ হবে?

মনে হয় না। কিন্তু সেটা কি বিবেচনার একটি বিষয়?

আমি মাথা নাড়লাম, জিগি ঠিকই বলেছে, এটি বিবেচনার বিষয় নয়। গত দুএকদিনে আমরা যা যা করেছি তার তুলনায় এটা বিবেচনার কোনো বিষয়ই নয়।

পাওয়ার ক্যাবলটি মোটা, সাপের মতো এঁকেবেঁকে গিয়েছে, স্পর্শ করলে ক্রায়োজেনিক পাম্পের কম্পন অনুভব করা যায়। আমি আর জিগি ক্যাবলটির ওপর দিয়ে হেঁটে, কখনো এটা ধরে ঝুলে ঝুলে, কখনো সরীসৃপের মতো পিছলে পিছলে অগ্রসর হতে থাকি। মাঝে মাঝে আরো নানা ধরনের তার, ক্যাবল এবং ফাইবার এটার ওপর দিয়ে চলে গিয়েছে। কিছু। কিছু রীতিমতো বিপজ্জনক, খুব সাবধানে অগ্রসর হতে হয়। ক্যাবলটি সোজা এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ করে নিচে নামতে লাগল, জিগি অবাক হয়ে বলল, কী আশ্চর্য! দেখো এটা কত নিচে নেমে গেছে।

আমিও অবাক হয়ে দেখলাম সত্যি সত্যি পাওয়ার ক্যাবলটি প্রায় অতল পাতালে নেমে গিয়েছে। এত প্রচণ্ড শক্তি নিচে কোথায় নেমে গিয়েছে চিন্তা করে এবারে আমরা সত্যি। কৌতূহলী হয়ে উঠি।

ক্যাবলটি বেয়ে বেয়ে নিচে নামা সহজ নয়, হাত ফসকে গেলে নিচে কোথায় গিয়ে পড়ব জানা নেই, কিন্তু এখন আর এত ভাবনাচিন্তার সময় নেই। দুজনে ক্যাবলটি জাপটে ধরে সরসর করে নিচে নামতে থাকি। এদিক দিয়ে কখনো মানুষ যায় না, বাতাসের প্রবাহ অপর্যাপ্ত এবং দূষিত। কিছুক্ষণেই আমরা কালিঝুলি মেখে ধুলায় ধূসরিত হয়ে গেলাম। নিচে নামতে নামতে যখন মনে হচ্ছিল হাতে আর শক্তি নেই আর একমুহূর্তও ঝুলে থাকতে পারব না, তখন দুজনে ঝুপঝুপ করে নিচে নেমে এলাম।

জায়গাটি একটি বড় হলঘরের মতো, চারদিকে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি ছড়ানো। হলঘরের মাঝখানে গোলাকার একটা শক্ত কংক্রিটের ঘর। আমরা যে ক্যাবলটি বেয়ে নেমে এসেছি সেটা এই ঘরের ভেতরে গিয়ে ঢুকেছে, তুলনামূলকভাবে ছোট একটি ঘরের মাঝে এই বিশাল পরিমাণ শক্তি কেমন করে ব্যবহার করা হচ্ছে আমরা বুঝতে পারলাম না।

আমি আর জিগি সাবধানে গোলাকার ঘরটি ঘুরে এলাম, এক পাশে উঁচু টিউবের মতো ছোট একটা করিডর, এর কাছাকাছি একটা লিফট নেমে এসেছে। আমরা যে জায়গাটিতে আছি সেটি মূল অংশের পেছনের সার্ভিস এরিয়া, মানুষজন আসে না। লিফট দিয়ে নেমে এই টিউবের মতো করিডর ধরে লোকজন মাঝখানের গোলাকার অংশটিতে ঢুকতে পারে। লিফট থেকে চাপা গুম গুম শব্দ শুনে বুঝতে পারছি সেটা উপরে উঠছে এবং নিচে নামছে, সম্ভবত লোকজন আসছে এবং যাচ্ছে। আমরা করিডর ধরে হেঁটে একটা দরজা পেলাম, ইচ্ছে করলে এটা খুলে করিডরের ভেতরে যেতে পারি কিন্তু এই মুহূর্তে সেখানে লোকজনের যাতায়াতের শব্দ শোনা যাচ্ছে, কাজেই ভেতরে ঢোকা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

আমরা আবার গোলাকার ঘরটির কাছে ফিরে এলাম, জিগির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী আছে এই ঘরটায়?

জিগি মাথা নাড়ল, বলল, জানি না। পরিচিত কিছু নয়, এত ছোট জায়গায় এত শক্তির প্রয়োজন হয় সেরকম কিছু আমার জানা নেই।

আমি ঘুরে চারদিকে তাকালাম, জায়গাটা একটা মঞ্চের পেছনের অংশের মতো– সামনে কী হচ্ছে পেছন থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই।

আমি আর জিগি গোলাকার ঘরটির কাছে এগিয়ে গেলাম। দূর থেকে বোঝা যায় না কিন্তু কাছে এলে দেখা যায় এর দেওয়ালে বিচিত্র এক ধরনের নকশা, পৃথিবীতে কোথাও এরকম নকশা নেই, দেখেই মনে হয় এটি মানুষের হাতে তৈরি নয়। আমি হাত দিয়ে স্পর্শ করতেই নকশাটি একটু সরে গেল, যেন এটি একটি জীবন্ত প্রাণী। আমি চমকে উঠলাম, দেওয়ালটি সরীসৃপের দেহের মতো শীতল। আমি হতচকিত হয়ে জিগির দিকে তাকালাম। জিগি অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে?

আমি এরকম একটা জিনিস পরাবাস্তব জগতে দেখেছি। খ্রাউস বলেছে এটা মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে যোগাযোগের ইন্টারফেস।

নিজের অজান্তেই জিগি দুই পা পেছনে সরে এসে বলল, এটা মহাজাগতিক প্রাণীর ইন্টারফেস?

হ্যাঁ।

তার মানে তার মানে এটা একটা মহাকাশযান?

মহাকাশযান? মাটির তলায়? আমি চারদিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললাম, এটা বের হবে কেমন করে? কোথাও তো বের হবার জায়গা নেই।

নিশ্চয়ই স্পেস টাইম কনটিনিউয়াম ভেদ করে যাবে, নিশ্চয়ই ওয়ার্মহোল তৈরি করে বের হয়ে যাবে। এই জন্যে এত বিশাল শক্তির দরকার। জিগির চোখ উত্তেজনায়। চকচক করতে থাকে, এখন বুঝতে পারছি কেন এই সুপার কন্ডাক্টিং ক্যাবল এখানে এসেছে।

আমি হঠাৎ করে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠলাম, বললাম, মনে আছে খ্রাউস বলেছিল দুজনকে লঞ্চ প্যাডে নিয়ে যাও। নিশ্চয়ই এটাই সেই লঞ্চ প্যাড। এখান থেকেই মহাকাশযান উড়ে যাবে।

কিন্তু কোন দুজন?

আমার মনে হয় রিয়া আর নুরিগা। পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত মানবী আর পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানব।

জিগি মাথা নাড়ল, তারপর বলল, ঠিকই বলেছ, সেজন্যেই এখানে এত কাজকর্ম। হচ্ছে। লোকজন যাচ্ছে আসছে। সবকিছু প্রস্তুত করছে।

আমি একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বললাম, কিন্তু এটা তো কিছুতেই করতে দেওয়া যাবে। পৃথিবীর মানুষকে তো মহাজাগতিক প্রাণীর হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। কিছুতেই না।

তুমি কী করবে?

থামাব।

কীভাবে থামাবে?

আমি জানি না।

জিগি আমার দিকে তাকিয়ে সহৃদয়ভাবে হেসে ফেলল।

আমি এই বিশাল হলঘরটির দিকে তাকালাম, এটি মূল লঞ্চ প্যাডের আড়ালের অংশটুকু এখানে সচরাচর কেউ আসে না। যন্ত্রপাতিগুলো অবিন্যস্তভাবে ছড়ানো আছে। নানা ধরনের তার এবং ফাইবার ঝুলছে, মনিটর থেকে আলো বের হচ্ছে। বড় বড় ধাতব খণ্ড এখানে সেখানে ছড়ানো। ঘরের ঠিক মাঝামাঝি একটা অতিকায় ক্রেন দাঁড়িয়ে আছে, এই লঞ্চ প্যাড বসানোর সময় নিশ্চয়ই এটা ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে মানুষজন আসে না বলে সত্যিকারের আলো নেই, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি এবং মনিটরের আলোতে জায়গাটাতে এক ধরনের আলো–আঁধারি ভাব ছড়িয়ে আছে।

জিগি চারদিকে তাকিয়ে বলল, মহাকাশযানটিকে থামানোর একটি মাত্র উপায়।

সেটি কী?

এই জিগা–ওয়াট সুপার কন্ডাক্টিং পাওয়ার ক্যাবলটি কেটে ফেলা, যেন মহাকাশযানটি তার প্রয়োজনীয় শক্তি না পায়।

আমি জোর করে হাসার চেষ্টা করে বললাম, তোমার ছোট চাকুটা দিয়ে এই সুপার কন্ডাষ্টিং পাওয়ার ক্যাবলটি কাটতে পারবে বলে তো মনে হয় না।

না। জিগি মাথা নাড়ল, তুমি যে হাতের ধমনিটা কাটতে পেরেছিলে সেটাই বেশি।

আমি হলঘরটার চারদিকে তাকালাম, বললাম, এই ক্যাবলটা কাটার মতো সেরকম বড় আর ধারালো কোনো যন্ত্রপাতি এই ঘরে নেই?

থাকলেও লাভ নেই। ক্যাবলটা কাটলেই তারা বুঝতে পারবে সাথে সাথে তোমাকে ধরে ফেলবে।

আমি ক্যাবলটার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ চমকে উঠে জিগির দিকে তাকালাম, জিগি অবাক হয়ে বলল, কী হল?

ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ!

মানে?

আমরা ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ ব্যবহার করে মহাকাশযান আটকে দিতে পারি!

ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ? তুমি নিশ্চয়ই জান ইলেকট্রনিক্স যে পর্যায়ে গিয়েছে তাতে গত হাজার বছরে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণটি ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় নি।

কিন্তু তাই বলে সমীকরণটি তো মিথ্যা হয়ে যায় নি।

তা যায় নি। কিন্তু তুমি কীভাবে এটা ব্যবহার করতে চাইছ?

খুব সহজ। এই ক্যাবলটা দিয়ে জিগা–ওয়াট শক্তি প্রবাহিত হবে এবং দেখাই যাচ্ছে সেটা বৈদ্যুতিক শক্তি। কাজেই এই ক্যাবলটাকে যদি আমরা একটা কয়েলের মতো পেঁচিয়ে তার মাঝখানে ফেরো ম্যাগনেট বসিয়ে রাখতে পারি তা হলে এটা একটা ইন্ডাক্টরের মতো কাজ করবে। তার মানে বুঝেছ?

জিগির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, বুঝেছি। স্পেস টাইম কন্টিনিউয়াম ভেদ করার জন্যে একমুহূর্তের মাঝে অচিন্তনীয় পরিমাণ বিদ্যুৎ প্রবাহ হবে, সেই প্রবল প্রবাহ হঠাৎ করে ইন্ডাক্টরে আটকা পড়ে যাবে–যার অর্থ মহাকাশযানটি তার প্রয়োজনীয় বৈদ্যুতিক শক্তি পাবে। না!

হ্যাঁ। আমি মাথা নেড়ে বললাম, আমি নিশ্চিত শক্তির প্রয়োজনে একটু হেরফের হলেই এটা কাজ করবে না।

আমিও নিশ্চিত।

তা হলে কাজ শুরু করে দেওয়া যাক। দেখি ক্যাবলটাকে টেনে কতটুকু প্যাচাতে পারি।

দাঁড়াও। জিগি হঠাৎ আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল, আমরা কাজটা আরো সুচারুভাবে করতে পারি।

কীভাবে?

যদি হিসাব করে নিই কী পরিমাণ ক্যাবলকে কতটুকু প্যাচাতে হবে, মাঝখানে কতটুকু ফেরো ম্যাগনেট রাখতে হবে, পাশে কতখানি রাখতে হবে, ক্যাপাসিটেন্স কত–

কীভাবে হিসাব করবে?

জিগি দাঁত বের করে হেসে বলল, আমাদের একটা নিউরাল কম্পিউটার আছে। মনে নেই?

আমি চমকে উঠলাম, বললাম, তুমি আবার আমার মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে চাইছ?

অবশ্যই! তা না হলে আমি নিউরাল কম্পিউটার কোথায় পাব?

অসম্ভব। আমি মুখ শক্ত করে বললাম, কখনোই নয়। তা ছাড়া তুমি সেই ইন্টারফেস আর সকেট কোথায় পাবে?

আগেরটা যেখান থেকে পেয়েছিলাম।

আগেরটা কোথা থেকে পেয়েছিলে? আমি ভেবেছিলাম তুমি নিজে তৈরি করেছ।

জিগি মাথা নাড়ল, আমি তৈরি করি নি–জুড়ে দিয়েছিলাম। মূল জিনিসটা পেয়েছিলাম একটা সাইবর্গের কপোট্রন থেকে। আমি নিশ্চিত আমরা ঠিক মেটাকোড বলে একটা সাইবর্গ ধরে আনতে পারব।

আমি হতবাক হয়ে জিগির দিকে তাকিয়ে রইলাম, সে কি সত্যি বলছে নাকি কৌতুক করছে বুঝতে পারছিলাম না–জিগির মুখে অবিশ্যি কৌতুকের কোনো চিহ্ন নেই। আমি কয়েকবার চেষ্টা করে বললাম, তুমি সত্যিই বলছ?

হ্যাঁ, সত্যিই বলছি। এস তোমার সিকিউরিটি কার্ডটি নিয়ে।

খুব সাবধানে করিডরের দরজা অল্প একটু ফাঁক করে আমরা ভেতরে তাকালাম। দূরে গোলাকার মহাকাশযানটিকে দেখা যাচ্ছে, তার সামনে এক ধরনের ব্যস্ততা। অন্য পাশে লিফট থেকে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি নামিয়ে আনা হচ্ছে। করিডর দিয়ে সাইবর্গরা হেঁটে যাচ্ছে–কোনো একটি বিশেষ কারণে এখানে কোনো মানুষ নেই।

আমরা হাইব্রিড দুই টাইপের দুটি সাইবর্গকে দেখতে পেয়ে দরজা ফাঁক করে হাতছানি দিয়ে ডাকলাম। সাইবর্গ দুটো কোনো রকম সন্দেহ না করে আমাদের দিকে এগিয়ে এল– ক্রানার সিকিউরিটি কার্ডটি ম্যাজিকের মতো কাজ করছে।

আমরা তাদের হলঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। একটি সাইবর্গ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কে? কেন আমাদের ডেকেছ?

জিগি হাত নেড়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু আমি সময় নষ্ট না করে সরাসরি মেটাকোডটি বললাম, কালো গহ্বরে এনিফর্মের নৃত্য।

আমার কথাটিতে ম্যাজিকের মতো কাজ হল, হঠাৎ করে দুটি সাইবর্গই পাথরের মতো স্থির হয়ে যায়, তাদের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসে এবং কপোট্রনের কোনো একটা অংশ থেকে একটা লাল আলো জ্বলে এক ধরনের ভোঁতা শব্দ করতে থাকে। জিগি সাইবর্গের কাছাকাছি গিয়ে তার মাথায় লাগানো নানা যন্ত্রপাতির ভেতরে কিছু একটা ধরে টানাটানি করতেই একটা অংশ খুলে আসে–সাইবর্গটির প্রকৃত মাথাটি বের হয়ে আসে, এটি চুলহীন ছোট প্রায় অপুষ্ট একটি মাথা। সাইবর্গটির কপোট্রনের নিয়ন্ত্রণ খুলে নেওয়ায় সেটি অসহায় হয়ে পড়ে, আমাদের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাঁটু ভেঙে নিচে পড়ে বিকারগ্রস্তের মতো কাঁপতে শুরু করে।

আমি কাছে গিয়ে সাইবর্গটিকে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করলাম। নরম গলায় বললাম, তোমার কোনো ভয় নেই। আমরা তোমার কোনো ক্ষতি করব না।

মাথা থেকে কপোট্রন খুলে নেওয়া অসহায় এবং আতঙ্কিত সাইবর্গটি হামাগুড়ি দিয়ে হলঘরের এক কোনায় পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। যন্ত্র দিয়ে তাকে চালিয়ে নেওয়া হয়, এই যন্ত্রের সহায়তাটুকু সরিয়ে নেওয়া হলে এটি একটি শিশু থেকেও অসহায়। ভীত একটি পশুর মতো সাইবর্গটি বড় একটি ধাতব চৌকোনা বাক্সের পেছনে নিজেকে লুকিয়ে ফেলল।

আমি এবারে দ্বিতীয় সাইবর্গটির দিকে তাকালাম এটি আমাদের প্রয়োজন নেই কিন্তু সম্ভবত তার কপোট্রন ইন্টারফেস খুলে রাখাটাই সবার জন্যে নিরাপদ। জিগি এগিয়ে তার মাথা থেকে ইন্টারফেসটি খুলে নেয়–এই সাইবর্গের প্রতিক্রিয়া হল আগেরটি থেকেও ভয়ংকর। সেটি মাথা কুটে আকুল হয়ে কাঁদতে শুরু করল। আমি অনেক কষ্টে তাকে শান্ত করে আগের সাইবর্গটির পাশে বসিয়ে দিলাম। দুজন পর মতো জড়াজড়ি করে চৌকোনা বাক্সটির পেছনে মাথা নিচু করে লুকিয়ে রইল। মানুষের মস্তিষ্কের বড় ধরনের ক্ষতি করে দিয়ে তার সাথে যন্ত্রকে জুড়ে দিয়ে ব্যবহার করার এই অমানবিক প্রক্রিয়াটি একটি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।

জিগি ইন্টারফেসটি খুলে সেখান থেকে কিছু তার বের করে আনে, যন্ত্রের নানা অংশে টেপাটিপি করে কিছু একটা পরীক্ষা করে বলল, জিনিসটা খুব উঁচুদরের হল না, কিন্তু কাজ করবে।

আমি শঙ্কিত হয়ে বললাম, উঁচুদরের হল না বলতে তুমি কী বোঝাতে চাইছ?

তথ্য আদান–প্রদানের ব্যাপারটা তোমার নিজেকেই করতে হবে।

তার মানে কী?

তুমি নিজেই বুঝবে। জিগি আমাকে ডাকল, এস। কাছে এস।

আমি জিগির কাছে এগিয়ে গেলাম। জিগি আমাকে একটা বড় যন্ত্রাংশের ওপর বসিয়ে দিল। আমার হাতে কিছু যন্ত্রপাতি ধরিয়ে দিয়ে সে আমার মাথার পেছনে গিয়ে কিছু একটা করতে থাকে, হঠাৎ করে মনে হল আমার মাথার ভেতরে একটা বিস্ফোরণ ঘটল, চোখের সামনে বিচিত্র ধরনের আলোর বিচ্ছুরণ হতে থাকে, আমি কানের পাশে লক্ষকোটি ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনতে থাকি। আমার সমস্ত শরীর পরিপূর্ণ অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাঁপতে শুরু করে, মনে হয় কেউ আমাকে গলিত সীসার মাঝে ছুঁড়ে দিয়েছে।

কতক্ষণ এরকম ছিল জানি না, হঠাৎ মনে হল আমার সমস্ত শরীর হালকা হয়ে গেছে, আমি বাতাসের মাঝে ভাসছি। মনে হল বহু দূর থেকে কেউ একজন আমাকে ডাকছে, আমি কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম। গলার স্বরটি জিগির, সে আমাকে চোখ খুলে তাকাতে বলছে।

আমি চোখ খুলে তাকালাম, মনে হল সমস্ত জগৎটাকে একটা ছোট ফোকাল লেংথের লেন্স দিয়ে দেখছি, চোখের সামনে সবকিছু নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘুরছে। আমি জিগিকে দেখতে পেলাম, সে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আমাকে দুই হাত দিয়ে ধরে রেখেছে। সে ভয় পাওয়া গলায় বলল, ত্রাতুল, তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ? তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ?

আমি অনেক কষ্ট করে বললাম, পাচ্ছি।

চমৎকার। যা ভয় পেয়েছিলাম!

জিগি কেন ভয় পেয়েছিল কেন জানি সেটা জানার কৌতূহল হল না। কারণ হঠাৎ করে আমার মনে হতে লাগল খুব সহজেই পঞ্চম মাত্রার সমীকরণের একটা সমাধান বের করা যেতে পারে। সমীকরণের রাশিমালাগুলো যখন মস্তিষ্কে প্রায় সাজিয়ে ফেলেছি তখন শুনতে পেলাম জিগি জিজ্ঞেস করছে, দশমিকের পর পাইয়ের পঞ্চাশ নম্বর অংকটি কত?

কেন?

জানতে চাইছি–দেখি বলতে পারি কি না।

আমাকে হিসাব করে বলতে হল। রামানুজনের একটি সিরিজ ব্যবহার করে মস্তিষ্কের মাঝে হিসাব করে বললাম, শূন্য।

তার পরেরটি?

পাঁচ।

তার পরেরটি?

আট। আমি জিগির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ঠিক হয়েছে?

কেমন করে বলব? আমি কি পাইয়ের মান কয়েক শ ঘর পর্যন্ত মুখস্থ করে রেখেছি নাকি?

তা হলে?

দেখছি তোমার মস্তিষ্ক হিসাব করার জন্যে প্রস্তুত হয়েছে কি না।

আমি কিছু না বলে আবার আমার পাঁচ মাত্রার সমীকরণ দিয়ে যেতে চাইলাম কিন্তু জিগি বাধা দিল, সে জিজ্ঞেস করল, এখান থেকে লঞ্চ প্যাডটা দেখতে পাচ্ছ?

পাচ্ছি।

আয়তনটা অনুমান কর। কী দিয়ে তৈরি হতে পারে আন্দাজ করে ক্যাপাসিটেন্টটা বের কর।

আমি হিসাব করে বের করে বললাম, বেশ খানিকটা অনিশ্চয়তা আছে।

থাকুক। জিগি আমার মাথাটা ঘুরিয়ে সুপার, কন্ডাক্টিং পাওয়ার ক্যাবলটা দেখিয়ে বলল, এখন হিসাব করে বের কর ক্যাবলটা কেমন করে প্যাচাতে হবে, এর মাঝখানে কী ধরনের ফেরো ম্যাগনেট ব্যবহার করবে।

আমি হাত তুলে জিগিকে থামিয়ে দিলাম, হঠাৎ করে পুরো সমস্যাটা আমার কাছে একেবারে পানির মতো সহজ মনে হতে লাগল। আমি মস্তিষ্কের মাঝে ক্যাবলটা প্যাচানো শুরু করতেই শুধু যে চৌম্বকীয় ক্ষেত্রটা দেখতে শুরু করলাম তা নয়, সময়ের সাথে পরিবর্তনের হারটাও স্পষ্ট হয়ে উঠল। ঘরের মাঝে ছড়ানো–ছিটানো নানা লোহা এবং ইস্পাতের যন্ত্রগুলো মাঝখানে নিয়ে আসা হলে চৌম্বক ক্ষেত্রটা কত গুণ বেড়ে যাবে সেটাও হিসাব করে ফেললাম। শুধু তাই নয়, ঠিক কোথায় একটা মাঝারি আকারের লোহার পাত বসালে সেটা ছুটে এসে ক্যাবলটাকে আঘাত করে ভেতরের ক্রায়োজেনিক পাম্পটাকে অচল করে দিতে পারে সেটাও আমি অনুমান করে নিলাম। ঠিক কতক্ষণ সময়ে তরল হিলিয়াম বাষ্পীভূত হয়ে ঘরটার মাঝে একটা উচ্চচাপের সৃষ্টি করবে কিংবা কতটুকু অংশে সুপার কন্ডাক্টিভিটি নষ্ট হয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহের কারণে ক্যাবল উত্তপ্ত হয়ে আগুন ধরে যাবে এই ধরনের নানা বিষয় আমার মস্তিষ্কের মাঝে খেলা করতে লাগল।

জিগি আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল, এবারে তাগাদা দিয়ে বলল, বলো।

কী বলব?

হিসাব করে কী করলে?

সবকিছু বের করেছি।

আমাকে বলো।

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, কেন তোমাকে বলব। আমার সব মনে আছে।

সেই জন্যেই বলছি। তোমার মস্তিষ্কটি এখন একটা নিউরাল কম্পিউটার, তুমি এখন সবকিছু মনে রাখতে পারছ। একটানে যখন ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেস খুলে ফেলব, তখন কিছুই তোমার মনে থাকবে না।

আমার কাছে ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হল, এই সহজ জিনিসগুলো আমার মনে থাকবে কেন? জিগি আমার ওপর ঝুঁকে পড়ে বলল, দেরি করছ কেন? বলো। যদি না বলে তা হলে কিন্তু মহাবিপদ হয়ে যাবে।

পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে হাস্যকর এবং ছেলেমানুষি মনে হচ্ছিল কিন্তু তবুও আমি জিগিকে বলতে শুরু করলাম। জিগি দ্রুত সেগুলো লিখে নিতে রু করে।

আমি বুঝতে পারছিলাম আমি ঠিক প্রকৃতিস্থ নই, চোখের সামনে সবকিছুই কেমন জানি দুলছে, জিনিসগুলোর আকার–আকৃতিও ঠিক নেই। সবকিছুকেই কেমন জানি তুচ্ছ এবং অর্থহীন বলে মনে হতে থাকে। না চাইলেও মাথার ভেতরে জটিল সমীকরণ চলে আসতে থাকে এবং অবিশ্বাস্য দ্রুততায় আমি সেগুলো সমাধান করতে থাকি।

জিগি আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলল, সে কী বলেছে আমি সেটাকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে দ্রুত একটা চুয়াল্লিশ মাত্রার ম্যাট্রিক্স ওল্টানো শুরু করলাম। আমি টের পেলাম জিগি আমার মাথার পেছনে হাত দিয়েছে, কিছু একটা ধরে যাচকা টান দিতেই মাথার ভেতরে। একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হল, মুহূর্তের জন্যে চোখের সামনে জগৎসংসার অন্ধকার হয়ে গেল।

আমি যখন জ্ঞান ফিরে পেলাম তখন জিগি আমার ওপরে ঝুঁকে আতঙ্কিত মুখে আমাকে ডাকছে। আমি চোখ খুলে তাকাতেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠল, বলল, এন্ড্রোমিডার দোহাই! তা হলে চোখ খুলে তাকিয়েছ।

আমি চোখ এবং কপালে এক ধরনের ভোঁতা ব্যথা অনুভব করতে থাকি, কিন্তু সেটাকে উপেক্ষা করে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলাম। জিগি আমাকে ধরে সাবধানে দাঁড় করিয়ে দাঁত বের করে হেসে বলল, চমৎকার! নিউরাল কম্পিউটারকে টার্বো মোডে চলানো যায় কি না। তাও পরীক্ষা করে দেখে ফেললাম!

কী দেখলে?

যায়।

দোহাই তোমার–  আমি আমার মাথা দুই হাতে চেপে ধরে বললাম, ভবিষ্যতে আর কখনো এই পরীক্ষা করে দেখবে না।

জিগি মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে দেখব না। শুধু গাণিতিক অংশটুকু উজ্জীবিত করা যায় বলে শুনেছিলাম–আজকে পরীক্ষা করে দেখলাম! সত্যিই যায়! জিগির অজান্তেই তার মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

জিগির ধারণা সত্যি–খানিকক্ষণ আগে আমি কী হিসাব করেছিলাম, তার কিছু মনে নেই। জিগি লিখে রাখা হিসাবটুকু দেখে ক্যাবল সাজাতে থাকে। শক্ত মোটা ক্যাবল নাড়তে প্রায় মত্ত হস্তীর শক্তির প্রয়োজন, দুজনের একেবারে কালো ঘাম ছুটে গেল। নির্দিষ্ট ব্যাসার্ধের কয়েল করে তার মাঝখানে বিভিন্ন লোহার যন্ত্রপাতি এনে রাখা হল। কোনটা কোথায় রাখা হবে আমি একেবারে নিখুঁতভাবে বলে দিয়েছি। পুরোটুকু সাজিয়ে যখন শেষ করেছি তখন আমরা দুজনই ঘেমে–নেয়ে গিয়েছি।

দুজনে দেওয়ালে হেলান দিয়ে মুখ হাঁ করে নিশ্বাস নিতে থাকি। জিগি আমার পিঠে থাবা দিয়ে বলল, চমৎকার! দেখি এখন মহাজাগতিক প্রাণী কেমন করে পৃথিবীর মানুষ নিয়ে পালিয়ে যায়!

আগেই এত উচ্ছ্বসিত হয়ো না জিগি। এখনো অনেক কাজ বাকি।

জিগিকে সেটা নিয়ে খুব বিচলিত্ত দেখা গেল না। এরকম সময়ে আমরা আমাদের পেছনে একটু শব্দ শুনতে পেলাম তাকিয়ে দেখি সাইবর্গ দুটো গুটিসুটি মেরে আমাদের পেছনে এসে বসেছে। তাদের চোখে একই সাথে এক ধরনের কৌতূহল এবং আতঙ্ক। আমাদেরকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে।

আমি তাদের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সাইবর্গ দুটি আমার হাসি দেখে বিন্দুমাত্র আশ্বস্ত হল না, বরং এক ধরনের ভীতি তাদের ভেতর কাজ করল। উবু হয়ে অনেকটা পশুর মতো দুই হাত এবং এক পায়ে ভর দিয়ে আবার চৌকোনা একটা যন্ত্রের পেছনে লুকিয়ে গেল। জিগি হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, মাথায় কপোট্রনের ইন্টারফেসটা লাগানো পর্যন্ত এরকমই থাকবে। কী একটা বাজে ব্যাপার।

মাথায় লাগিয়ে ছেড়ে দেওয়া যায় না?

নাহ্ আমরা ধরা পড়ে যেতে পারি। জিগি মাথা নাড়ল এবং হঠাৎ করে ঘুরে আমার দিকে তাকাল, একটা কাজ করলে কেমন হয়?

কী?

এই সাইবর্গ দুজনের কপোট্রনিক ইন্টারফেসটা যদি আমরা দুজন মাথায় পরে বের হয়ে যাই–তা হলে কেউ আমাদের সন্দেহ করবে না।

আমি ভুরু কুঁচকে জিগির দিকে তাকালাম, কী বললে?

আমরা দুজন মাথায় এই বাইবর্গের ইন্টারফেসটা পরে সাইবর্গ সেজে বের হয়ে যেতে পারি। বাইরে গিয়ে দেখতে পারি কী হচ্ছে।

কিন্তু ওরা বুঝে ফেলবে না?

না। সাইবর্গের মতো হাঁটব, চেষ্টা করব কোনো কথা না বলতে, আর যদি বলতেই হয় তা হলে সাইবর্গদের মতো কথা বলব।

আইডিয়াটা খারাপ না। এই হলঘরের ভেতরে এখন আর দেখার কিছুই নেই। করিডর ধরে হেঁটে গিয়ে মহাকাশযানটিকে হয়তো দেখতে পারি। আমি জিগির দিকে তাকিয়ে বললাম, চলো তা হলে।