নবাব সাহেব সেই পদশব্দে দরজার দিকে তাকালেন।
কিরীটী চিনতে পারে এ সেই বোরখা-পরিহিতা নারীমূর্তি যে কিছুক্ষণ আগে আলো জ্বেলে দিয়ে ঐ ঘর থেকে চলে গিয়েছিল। বোরখা-পরিহিতা নারী ট্রে হাতে নবাব সাহেবের সামনে এসে দাঁড়াল।
রূপার ট্রের উপরে একটা দামী ইটালীয়ান কাট-গ্লাসের গ্লাস—তার মধ্যে অর্ধেকটা সোনালী রঙের তরল পদার্থ টলটল করছে। নবাব সাহেব ডান হাতটা বাড়িয়ে গ্লাসটা তুলে নিলেন—একেবারে সোজা ওষ্ঠের সামনে। তারপর এক চুমুকে সমস্তটুকুতরল পদার্থ নিঃশেষে পান করে গ্লাসটা ট্রের উপরে নামিয়ে রাখলেন।
কিরীটী তখন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল বোরখা-পরিহিতা নারীর দুটি সুডৌল গৌর কোমল অনাবৃত বাহুর দিকে। অমন সুঠাম পেলব বাহু সচরাচর বড় একটা নজরে পড়ে না। চাঁপার কলির মত যেন সরু সরু আঙুল—মেহেদী রঙে রাঙানো হাতের পাতা ও আঙুল।
বোরখার দুটি ছিদ্রপথে দুজোড়া কালো চোখ দেখা যায় স্পষ্ট।
কিরীটীর দৃষ্টির সঙ্গে যেন মিলিত হলো মুহূর্তের জন্য তারপরইবোরখা-পরিহিতা নারীমূর্তি ধীর শান্ত পায়ে ঘর ছেড়ে নিঃশব্দে চলে গেল পর্দার অন্তরালে ট্রে-টা হাতে।
কিরীটী ঘুরে তাকাল নবাব সাহেবের দিকে।
প্রশ্ন করল, নবাব সাহেব—ও কি আপনার দাসী?
য়্যাঁ—
বলছিলাম ঐ মেয়েটি কে–বাড়ির দাসী?
দাসীনা না না–হ্যাঁ, মানে দাসী–না ঠিক তা নয়—
তবে মেয়েটি কে?
মেহের—মেহেরুন্নিসা—আসলে কি জানেন—ওকে আমার এ্যাটেনডেন্টও বলতে পারেন। ইদানীং ও এখানে আসবার পর থেকে আমাকে দেখাশোনা সবই ও করে।
খুব বেশী দিন বোধ হয় এখানে উনি আসেননি? কারণ কুলসম ও মোতির কাছে ওর সম্পর্কে কিছু শুনলাম না।
কিরীটী নবাব সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে আবার।
না, না—ও তো সব সময় এখানে থাকে না—মধ্যে মধ্যে আসে। এবারে কয়েকদিন আগে এসেছে আর যায়নি বুঝলেন কিনা যেতে দিই নি মেয়েটা আমার habits কখন কি দরকার না দরকার এসব বুঝে ফেলেছে। ও চলে গেলে আমার ভারী অসুবিধা হয়।
তা তো হবারই কথা—কিরীটী মৃদু হেসে বলে।
হ্যাঁ—মেহের ভারী বুদ্ধিমতী চালাক-চতুর—
আপনার সঙ্গে ওর কোনরকম আত্মীয়তা আছে?
আত্মীয়তা—না, না—সে রকম কিছু নেই–তবে–
তবে?
এই সামান্য পরিচয় আর কি!
কিরীটী মৃদু হাসলো।
হাসিটা এত মৃদু—এত ক্ষণস্থায়ী যে কারো নজরে পড়ে না।
নবাব সাহেব!—কিরীটী পুনরায় প্রশ্ন করে।
বলুন—
ছোট বেগম সাহেবা অর্থাৎ–জাহানারা বেগমের মৃত্যুর ব্যাপারে আপনি কাউকে সন্দেহ করেন?
সন্দেহ—
হ্যাঁ–কারণ আমাদের মনে হচ্ছে—
কি—কি মনে হচ্ছে?
এই বাড়ির মধ্যে কেউ তাঁকে হত্যা করেছে। বাইরের কেউ নয়।
বাড়ির মধ্যে কেউ! কি বলছেন আপনি? কে তাকে হত্যা করবে, কেনই বা করবে?
তা জানি না, তবে আমাদের ধারণা তাই। কিরীটী বলে শান্ত কণ্ঠে।
না না—তা কি করে হবে?
আচ্ছা, আপনার ভাগ্নে নাসির হোসেন সাহেব—
নাসির!
হ্যাঁ—তাঁর সঙ্গে জাহানারা বেগমের সম্পর্কটা কেমন ছিল বলে আপনার মনে হয়?
অবিশ্যি জাহানের সঙ্গে নাসিরের এ বাড়ির মধ্যে সব চাইতে বেশী ভাব ও হৃদ্যতা ছিল, কিন্তু তাই বলে-না না, সে রকম কিছু থাকলে—
আপনি টের পেতেন—স্বাভাবিক। আচ্ছা, নাসির হোসেন সাহেবকে তাঁর সিনেমার ব্যাপারে যে বেগম সাহেবা মধ্যে মধ্যে ওঁকে অর্থসাহায্য করতেন আপনি তা জানেন?
কি—কি বললেন? জাহান নাসিরকে সাহায্য করতটাকা দিত তার সিনেমার ব্যাপারে!
আমার তাই মনে হয়।
অর্থসাহায্য করত জাহান—অথচ ঘুণাক্ষরে আমি তা জানতে পারিনি!
কথা বলতে বলতে মনে হলো যেন নবাব সাহেব রীতিমত উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন।
কিরীটী নবাব সাহেবের মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
নবার সাহেব বলতে থাকেন, শয়তান—একটা শয়তান—দুমুখো সাপ—দুদিক দিয়ে শুষেছে।