১১-১৫. ঐ দিনই রাত্রে

১১.

ঐ দিনই রাত্রে।

কুন্তলা তার ঘরে একটা রকিং চেয়ারে বসেছিল। ঘরের আলো নিভানো অন্ধকার।

খুব শীত পড়েছে। গায়ে একটা শাল জড়িয়ে বসেছিল কুন্তলা।

ভৃত্য এসে দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে ডাকে, দিদিমণি!

কে রে?

আমি। ডাক্তারবাবু এসেছেন।

ডাক্তারবাবু!

আজ্ঞে, নীরেনবাবু।

নীরেনের গলা শোনা গেল, কুন্তলা!

কুন্তলা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে সুইচ টিপে ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে দেয়।

নীরেন এসে ঘরে ঢুকল।

আবার মরোজ হয়ে বসে আছ?

কুন্তলা সোজা হয়ে বসে, কোন কথা বলে না।

তুমি এক কাজ করে কুন্তলা—

নীরেনের মুখের দিকে তাকাল কুন্তলা।

তুমি বরং কিছু দিন তোমার মামার বাড়িতে গিয়ে থেকে এস। এই পরিবেশ থেকে তোমার সরে যাওয়া দরকার, অন্তত কিছুদিনের জন্য, আমার মনে হয়।

কুন্তলা কোন জবাব দেয় না।

নীরেন একটা চেয়ার টেনে নিয়ে কুন্তলার মুখোমুখি বসে।

বাবা-মা চিরকাল কারও বেঁচে থাকে না—

তা নয় নীরেন!

তবে কী?

বাবার মৃত্যু হয়েছে একটা দুর্ঘটনায়, কিছুতেই যেন কথাটা ভুলতে পারছি না!

দুর্ঘটনা বলতে তুমি কি বলতে চাও?

কেন—তুমি কি কিছু শোননি?

কি?

পুলিসের ধারণা তাকে কেউ হত্যা করেছে!

ননসেন্স! কে তাকে হত্যা করতে যাবে বল তো! যত সব কক অ্যান্ড বুল স্টোরি, যেমন পুলিস তেমনি তাদের বুদ্ধি। ইফ আই অ্যাম নট রং, তিনি আত্মহত্যা করেছেন ট্রেনের তলায় ঝাপিয়ে পড়ে।

কিন্তু কেন বাবা আত্মহত্যা করতে যাবেন?

শোন কথা, আত্মহত্যা লোকে করে কেন? কোন কারণ হয়ত তার ছিল।  

তুমি বাবাকে জান না কিন্তু আমি জানি। তার মত ধীর-স্থির প্রকৃতির লোক আত্মহত্যা করতে পারে আমি বিশ্বাসই করি না।

আমাদের জীবনে বিশ্বাসের বাইরেও অনেক সময় অনেক কিছুই ঘটে কুন্তলা।

তা হয়ত ঘটে—তবু–

বেশ তোমার কথাই না হয় মেনে নিলাম, কিন্তু যা হয়ে গিয়েছে তা তো আর ফিরবে না—তখন মিথ্যে ভেবে কি হবে!

সত্যি বাবার জন্য ভারি দুঃখ হয়—হি ওয়াজ সোলোনলি!  

দেখ কুন্তলা, একটা কথা তোমাকে এতদিন আমি বলিনি—কিন্তু আজ তোমার কথাটা শুনে কেন যেন মনে হচ্ছে

কি?

তোমার বাবার বন্ধু ঐ মণীন্দ্র গাঙ্গুলী লোকটা—

কি?

মনে হয় ওর এই ব্যাপারের মধ্যে হাত আছে!

না না, এসব তুমি কি বলছ নীরেন?

ভুলো না, অনেকগুলো টাকা তোমার বাবার কাছে ধরতো লোকটা।

কিন্তু সে টাকার জন্য তো বাবা কোনদিন তাকে তাগাদা দেননি!

দেননি—তাহলেও একদিন তো তাকে শোধ করতেই হবে, এই কড়ারেই তো সে। টাকা ধার নিয়েছিল! তাছাড়া–

কি?

আজ পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ সেন আমার কাছে আসার পর থেকে কেন যেন আমার একটা কথা মনে হচ্ছে

কি কথা?

আমার বড়মামার চিঠির মধ্যে সত্যিই হয়ত কোন গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত ছিল। যদিও এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না—

কি?

বড়মামা কোন টাকাকড়ি নিয়ে আসতে পারেন বর্মা থেকে-ব্যাপারটা অত্যন্ত অ্যাবসার্ড-অসম্ভব যেন মনে হয় এখনও!

.

ঐদিন রাত্রে—সুব্রতর গৃহে।

আহারাদির পর সুব্রত একটা আরামকেদারায় বসে একটা সায়েন্স ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছিল। ভৃত্য এসে বললে, আগরপাড়ার স্টেশন মাস্টার রসময়বাবু দেখা করতে এসেছেন।

সংবাদটা শুনে সুব্রতর চোখের তারা দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তাড়াতাড়ি বলে, যা তাঁকে এখানে এই ঘরে নিয়ে আয়।

সুব্রত গত পরশু আগরপাড়া গিয়ে রসময়বাবুর সঙ্গে আলাপ করে বেশ একটু। ভদ্রলোক সম্পর্কে ইন্টারেস্টই বোধ করেছিল। কৌতুকও ঐসঙ্গে একটু বোধ করেছিল, ভদ্রলোকের মনে ক্রাইম ডিটেকশনের একটা শখ আছে কথায়বার্তায় বুঝতে পেরে।  

আপনার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারছি ডিটেকশনের ব্যাপারে আপনি বেশ ইন্টারেস্টেড। তা আপনি পুলিশ লাইনে গেলেন না কেন বলুন তো? সুব্রত বলেছিল একসময় রসময়কে।

হয়ে উঠল না, বুঝলেন না! রসময় বলেছিল লজ্জার হাসি হেসে।

এ কেসটায় আপনার সাহায্য কিন্তু আমি নেবো।

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। এ তো আমার গর্বের কথা। বলুন না কি করতে হবে, বলুন?

দুটি কাজ করতে হবে। প্রথমত দেখবেন তো, যেখানে মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল তার আশেপাশে কালো রঙের মরক্কো লেদারের একটা ফোলিও ব্যাগ পাওয়া যায় কিনা।

দেখব-নিশ্চয়ই খোঁজ করে দেখব।

আর, ঐদিন মানে দুর্ঘটনার রাত্রে কটন মিল থেকে কোন ওয়াগন গুডস্ ট্রেনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল কিনা—এই খবরটা।

এ আর এমন কি, দিতে পারব খবরটা আপনাকে। গুডস্ ট্রেন সে-রাত্রে গেছে কিনা সে তো আমার ডাইরিতেই আছে। আর কিছু?

হ্যাঁ। ঐ দেশবন্ধু কলোনীতে যে রেস্তোরাঁটা আছে, নাম যার পান্থ-নিবাস, তার অধিকারী ঐ ঋষিবাবুর কাছ থেকে খোঁজ নেবেন সে-রাত্রে সন্ধ্যা ছটা থেকে রাত নটা পর্যন্ত কারা কারা সেদিন তার রেস্তোরাঁয় কফি-চা পান করতে গিয়েছিল।

ঋষির সঙ্গে আলাপ আছে। সেও একটি রহস্য-উপন্যাস গল্পের পোকা। মধ্যে মধ্যে সে আমার কাছে বই নিতে আসে, তার কাছেই খবরটা পেয়ে যাব। রসময় তার জবাব দেয়।

সুব্রত বুঝতে পারে, রসময় নিশ্চয়ই কোন খবর সংগ্রহ করে এনেছে, নচেৎ এই শীতের রাত্রে ছুটে আসত না এতদূরে!

রসময় এসে ঢুকল। হাতে একটা ছোট ফোলিও ব্যাগ।

আসুন—আসুন রসময়বাবু, আসুন।

রসময় বসল।

তারপর কি খাবেন বলুন? চা কফি–

না, না। সে-সবের কিছু প্রয়োজন নেই।

বিলক্ষণ, তাই কি হয়! কফিই আনানো যাক।

সুব্রত ভৃত্যকে ডেকে দু কাপ কফির নির্দেশ দিল।

তারপর, এনি নিউজ? কিছু খবর আছে?

আছে।

ফোলিওটা পেয়েছেন নাকি?

নিশ্চয়ই, এই দেখুন।

সুটকেস থেকে একটা কালো মরক্কো লেদারের দামী ফোলিও ব্যাগ রসময় বের করে দিল। ব্যগটা নোংরা হয়ে গিয়েছে।

ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখল সুব্রত ফোলিও ব্যাগটা।

এম. এন. রায় নামটা সোনার জলে মনোগ্রাম করা আছে ফোলিও ব্যাগের গায়ে।

সুব্রত ব্যাগটা খুলে ফেলল।

ব্যাগের ভিতরে কিছু টাকা পাওয়া গেল। নোট-শপাঁচেকের হবে। একশো টাকা ও দশ টাকা পাঁচ টাকার নোট।

কিছু টাইপ করা কাগজপত্র।

সব কিছু ঘাঁটা—এলোমেলো যেন ভিতরটা।

সুব্রত ব্যাগটা ধীরে ধীরে আবার বন্ধ করে রাখল।

এই ব্যাগটাই খুঁজছিলেন তো স্যার?

হ্যাঁ।

পেলেন?

কি?

যা খুঁজছিলেন? রসময়ের কণ্ঠে আগ্রহ ও উত্তেজনা।

সুব্রত মৃদু হেসে বলে, ব্যাগটাই আমি খুঁজছিলাম রসময়বাবু, অন্য কিছু নয়।

ভৃত্য কফি নিয়ে এল ঐসময়।

কফি পান করবার পর রসময় বলে, সে-রাত্রে এগারোটায় গোয়ালন্দর দিকে একটা গুডস্ ট্রেন গেছে স্যার। এবং সেই ট্রেনে রূপশ্রী কটন মিল থেকে সাতটা ওয়াগন গেছে।

কখন সেগুলো গুডস ট্রেনের সঙ্গে অ্যাটাচড় করা হয়?

রাত আটটার পর। একটা ইঞ্জিন গিয়ে মিল ইয়ার্ড থেকে ওয়াগনগুলো টেনে এনে মেল ট্রেনের সঙ্গে অ্যাটাচ করে দেয়।

হুঁ, তাহলে ঐ সময়ই–। অন্যমনস্ক ও কতকটা যেন আত্মগতভাবে কথাটা বলে সুব্রত।

কি স্যার?

না, কিছু না।

আরও একটা খবর আছে স্যার।

কি বলুন তো?

 সে-রাত্রে সন্ধ্যার সময়, মানে ছটা নাগাদ মিঃ গাঙ্গুলী রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলেন।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। এবং রাত আটটা পর্যন্ত সেখানে ছিলেন।

সত্যি!

হ্যাঁ স্যার, ঋষি বললে। আর একটা জিনিস পেয়েছি স্যার ঐ ব্যাগ খুঁজতে খুঁজতে রেল লাইনের উপরে।

কি?

রসময় এবারে একটা ইংরাজী এস অক্ষরের মত অনেকটা দেখতে লোহার হুক যা সাধারণত ঘরে ফ্যান টাঙাবার জন্য প্রয়োজন হয়, সঙ্গে একখণ্ড দড়ি-বাঁধা— সুটকেস থেকে বের করল।

দেখুন এটা—দেখুন এতে রক্ত শুকিয়ে আছে।

সুব্রত পরীক্ষা করে দেখল রসময়ের কথাটা মিথ্যা নয়। সত্যিই দড়িটার গায়ে রক্তের দাগ। সুব্রতর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

সে বলে, ধন্যবাদ, ধন্যবাদ রসময়বাবু। এতক্ষণে ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হল, মৃতের চোখ-মুখ-মাথা কেন অমন করে থেতলে গিয়েছে!

.

১২.

পরের দিন সকাল।

মৃণাল সেনকে ফোন করে সুব্রত ডেকে এনেছিল তার বাড়িতে।

দুজনের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল। সামনে কফির পেয়ালা।

সুব্রত বলছিল, এখন তো স্পষ্টই বুঝতে পারছেন মিঃ সেন, সে-রাত্রে ব্যাপারটা কি ঘটেছিল। হত্যাকারী কৌশলে ঐ টাইপ করা চিঠির সাহায্যে মিঃ রায়কে অকুস্থলে টেনে নিয়ে যায় বিশেষ কোন কারণে এবং তারপর তার কাজ হাসিল হওয়ার পর সে তাকে হত্যা করে এবং সমস্ত ব্যাপারটাই পূর্বপরিকল্পিত–

আপনার তাই মনে হয়? মৃণাল সেন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় সুব্রতর মুখের দিকে।

হ্যাঁ।

সুব্রত অতঃপর বলতে লাগল, প্রথমত হত্যাকারী জানত মিঃ গাঙ্গুলী তার বন্ধু, তাকে চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠালে তিনি যাবেনই-তাই সে চিঠি পাঠিয়েছে এবং ডাকে।

পাঠিয়ে লোক-মারফত পাঠিয়েছে যাতে করে ব্যাপারটা মিঃ রায় মনে করেন জরুরী।

একটু থেমে বলে আবার, দ্বিতীয়ত সে আরও জানত মিঃ রায় রাত্রে আগরপাড়া গেলে তার গাড়িতে যাবেন না—ট্রেনেই যাবেন। তৃতীয়ত হত্যাকারী এমন একটা দিন বেছে নিয়েছিল যেদিন শনিবার, ডেলি প্যাসেঞ্জারের ভিড় চারটের পর আর থাকবে না–—এবং শীতের সময় ও পরের দিন ছুটি বলে রাস্তায় ঐ সময়টা লোক-চলাচলও বেশি থাকবে না। চতুর্থত সে জানত মিঃ রায়কে রিকশায় করেই দেশবন্ধু কলোনীতে যেতে হবে—হেঁটে অতটা পথ তিনি যাবেন না।

এরপর মনে মনে সমস্ত ব্যাপারটা বিশ্লেষণ করে দেখুন প্রধান জায়গা থেকে আগরপাড়ার কলোনটা বিচ্ছিন্ন। কাজেই ওদিকটা আরও নির্জন হবে। তারপর শনিবার ও শীতের রাত বলে ঐ জায়গাটায় মানুষের চলাচল একপ্রকার ছিল না বললেই চলে সেদিন ঐসময় এবং সেই কারণেই ঐ সময় হত্যাকারীর তাকে গুলি করে ক্লোজ রেঞ্জ থেকে হত্যা করা খুব একটা ডিফিকাল্ট ব্যাপার কিছু ছিল না।

পঞ্চম : সে ঠিক করেছিল ব্যাপারটাকে একটা আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনায় দাঁড় করাতে পারলে সব দিক দিয়েই তার পক্ষে সুবিধা হবে।

একটু থেমে আবার সুব্রত বলে, তাই সে মিঃ রায়কে হত্যা করবার পর ঐ হুকটার সঙ্গে মিঃ রায়ের গ্রেট কোটটা বিঁধিয়ে ওটা রূপশ্রী কটন মিলের বাইরে যে লোডেড ওয়াগনগুলো ছিল তার একটার সঙ্গে বেঁধে দেয়।

ওয়াগনগুলো তারপর যখন এঞ্জিন টেনে নিয়ে যায়, সেই সময় মৃতদেহ লাইনস্লিপার ও পাথরের ওপর দিয়ে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে যায় এবং ঐভাবে হেঁচড়ে হেঁচড়ে যাওয়ায় হয়ত একসময় দড়িটা ছিঁড়ে লাইনের উপরই পড়ে যায়—যার ফলে মুখটা অমন ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়-নচেৎ গুলি লেগে ওভাবে থেতলে যেতে পারে না মুখটা অমন করে মৃতদেহের।

ঐভাবে মৃতদেহের মুখটা বিকৃত করার পিছনে হয়ত আরও একটা অভিসন্ধি হত্যাকারীর ছিল। চট করে মৃতদেহ যাতে কেউ আইডেন্টিফাই না করতে পারে এবং সে কারণেই হয়ত ফোলিও ব্যাগটাও দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু এত করেও হত্যাকারী দুটো ভুল করেছে-যা স্বাভাবিক ক্ষেত্রে সাধারণত হত্যার ব্যাপারে হয়ে থাকেই–

কি রকম?

প্রথমত হত্যাকারী ঐ টাইপ করা চিঠি পাঠিয়ে এবং দ্বিতীয়ত মিঃ রায়ের জামার পকেট থেকে তার পার্সটা নিতে ভুল করে। পার্সটা না পেলে হয়ত এত সহজে আমরা এতখানি এগুতে পারতাম না, এখনও হয়ত অন্ধকারেই আমাদের ঘুরে ঘুরে মরতে

সুব্রত একটু থেমে আবার বলতে লাগল, এবার দেখা যাক খুনী বা হত্যাকারী এক্ষেত্রে কে হতে পারে! যেভাবে মিঃ রায় নিহত হয়েছেন তাতে মনে হয় হত্যাকারী বাইরের কেউ তার অপরিচিত তৃতীয় ব্যক্তি নয়। যারা মিঃ রায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে

পরিচিত ছিল তাদেরই মধ্যে একজন কেউ।

সেকথা বলতে গেলে তো অনেকেই সন্দেহের তালিকায় এসে পড়েন! মৃণাল সেন মৃদুকণ্ঠে বলে।

নিশ্চয়ই। ছোট ভাই সুরেন্দ্র, দুই ছেলে সৌরীন্দ্র ও ভবেন্দ্র, ম্যানেজার মিঃ মুখার্জী, বন্ধু মিঃ মণীন্দ্র গাঙ্গুলী প্রত্যেকেই। কিন্তু

কি? মৃণাল সেন সুব্রতর মুখের দিকে তাকাল সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে।  

হত্যাকারীকে বিচার করতে হবে-মোটিভ প্রোবাবলিটি ও চা সব দিক দিয়েই। প্রথম দেখা যাক—প্রোবাবলিটির দিক থেকে কাকে কাকে ওদের মধ্যে সন্দেহ করা যায় বা যেতে পারে।

একটু থেমে সুব্রত বলতে লাগল, মিঃ রায়ের মৃত্যুতে যাদের নাম করলেন ওরা সকলেই জানত ওদের মধ্যে যে কেউই লাভবান হবে। এখন দেখা যাক কে কোথায় হত্যার সময় ছিল—বড় ছেলে সৌরীন্দ্র অকুস্থান থেকে দুর্ঘটনার সময় অনেক দূরে ছিল–কাজেই তাকে আপাতত বাদ দেওয়া যেতে পারে সন্দেহের তালিকা থেকে, যদিও বাপের সঙ্গে তারও বনিবনা ছিল না, বাপের মৃত্যুতে সে লাভবান হত

দ্বিতীয়ত, ছোট ছেলে ভবেন্দ্ৰ। দুর্ঘটনার মাত্র কয়েকদিন আগে তাকে কলকাতায় দেখা গিয়েছিল। বাপের সঙ্গে তর্কাতর্কি হয়। বাপকে সে শাসিয়ে যায়—শুধু তাই নয়, সে একজন আর্মির লোক, আর্মির ৩৮ রিভালভারও তার কাছে থাকা সম্ভব। মোটিভ তো তার ছিলই, উপরন্তু চান্সও ছিল প্রচুর।

ছোট ভাই সুরেন্দ্র–

হ্যাঁ, ছোট ভাই সুরেন্দ্র। দুর্ঘটনার রাত্রে সে সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত। বাড়িতেই ছিল। তারপর এক বন্ধু এসে তাকে তাসের আড্ডায় টেনে নিয়ে যায়। সেখানে রাত দুটো পর্যন্ত তাস খেলেছে। অতএব তার ক্ষেত্রে প্রোবাবলিটি একেবারে nil। মোটিভ থাকলেও চান্সের কথা তো আসেই না

মিঃ গাঙ্গুলী? মৃণাল প্রশ্ন করে এবারে।

হ্যাঁ, মিঃ গাঙ্গুলীর কথাটা বিশেষ করে জানতে হবে—কারণ তাঁর সময়ের এলিবাইটা এখনও প্রমাণ হয়নি—মোটিভ অবশ্য ছিল—চান্স তো খুবই বেশি ছিল।

বিশেষ করে ঐ টাকার ব্যাপারটা–

হ্যাঁ-সেটা আমি ভাবছি। তারপর ধরুন মিঃ মুখার্জ। তিনি প্রথমত উইলের ব্যাপারটা সব জানতেন এবং দ্বিতীয়ত মিঃ রায়ের মৃত্যুতে তিনি বিশেষ ভাবে লাভবান হবেন। সবচাইতে বড় কথা ঐদিনকার মিঃ মুখার্জীর গতিবিধি সম্পর্কেও আমরা সঠিক কোন প্রমাণ যোগাড় করতে পারিনি আজ পর্যন্ত।

আমার কিন্তু মনে হচ্ছে, আপনি আমার সঙ্গে একমত হবেন কিনা জানি না, ঐ বন্ধু মিঃ গাঙ্গুলীই মিঃ রায়ের হত্যাকারী। মৃণাল সেন বলে।

সুব্রত কোন জবাব দেয় না। মৃদু হাসে।

.

১৩.

ময়না তদন্ত করে জানতে পারা গেল মৃত্যুর কারণ রিভলভারের গুলি-গুলিটা তার ব্রেন ম্যাটারের মধ্যে ইমপ্যাকটেড হয়েছিল-বেস্ অফ দি স্কাল ভেদ করে থ্যালামাসে গিয়ে পৌঁছেছিল এবং মৃত্যু তাতেই হয়েছে।

সেনের ধারণা, মহেন্দ্রনাথ রায়ের মৃত্যুর কারণ অ্যাক্সিডেন্ট বা আত্মহত্যা কোনটাই নয়—তাকে হত্যা করা হয়েছে রিভলভারের গুলির সাহায্যে।

.

দিন দুই পরে।

শীতের ধোঁয়া যেন কলকাতা শহরের পথে একটা শ্বাসরোধকারী পর্দা টেনে দিয়েছে।

সুব্রত এসে তার গাড়ি থেকে নামল মিঃ রায়ের গড়িয়াহাটার বাড়ির পোর্টিকোর সামনে।

বেল বাজাতেই বেয়ারা এসে দরজা খুলে দিল।

কাকে চাই?

মিস রায় আছেন?

হ্যাঁ।

তাকে আমার সেলাম দাও, বল সুব্রতবাবু এসেছেন।

বসুন এসে ভেতরে। আমি খবর দিচ্ছি।

বেয়ারা সুব্রতকে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে ভিতরে চলে গেল খবর দিতে।

হঠাৎ জুতোর একটা শব্দ শুনে সুব্রত মুখ তুলে তাকায়—ডাঃ নীরেন সান্যাল।

মিঃ রায়, না? নীরেন সান্যাল বলে।

হ্যাঁ, নমস্কার।

কুন্তলার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন বুঝি? সে আসছে। তারপর আপনাদের ইনভেসটিগেশন কতদূর এগুলো?

একটা ব্যাপার বোঝা যাচ্ছে—মার্ডার!

বলেন কি?

হ্যাঁ, পোস্টমর্টেমে ব্রেনে বুলেট পাওয়া গিয়েছে। রিয়েলি?

হ্যাঁ।

স্যাড! আচ্ছা মিঃ রায়, চলি। গুডনাইট।

গুডনাইট।

ডাঃ নীরেন সান্যাল চলে গেল।

একটু পরেই কুন্তলা এসে ঘরে ঢুকল। সমস্ত চোখেমুখে একটা ক্লান্তি যেন ব্যাপ্ত হয়ে আছে। চুল বোধ হয় বাঁধেনি আজ কুন্তলা। রুক্ষ তৈলহীন ভ্রমরকৃষ্ণ কেশদাম পিঠের উপর ছড়িয়ে আছে। পরনে কালো ভেলভেটপাড় একটা শাড়ি ও সাদা ব্লাউজ। পায়ে চপ্পল।

নমস্কার, আপনাকে আজ আবার একটু বিরক্ত করতে এলাম কুন্তলা দেবী!

না না, বিরক্তির কি আছে!

কুন্তলা সামনের একটা সোফায় উপবেশন করল।

পুলিস বলছে, মানে তাদের মতে এটা একটা হত্যা—মানে মার্ডার কেস। সুব্রত বলে।

না না, এ আপনি কি বলছেন সুব্রতবাবু?

হ্যাঁ, ব্রেন ম্যাটারে গুলি পাওয়া গিয়েছে-রিভলভারের গুলি।

এ-এ যে আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না! বাবাকে হত্যা করবে কে, আর—আর কেনই বা হত্যা করবে?

আচ্ছা মিস্ রায়-রিসেন্টলি আপনার ছোড়দা কি কলকাতায় এসেছিলেন?

না–না তো!

ঠিক জানেন?

হ্যাঁ, তবে—

তবে?

মাসখানেক আগে ছোড়দার একটা চিঠি আমি পেয়েছিলাম।

চিঠি!

হ্যাঁ।

কি লিখেছিলেন তাতে তিনি?

কুন্তলা একটু যেন চুপ করে থাকে, একটু যেন ইতস্তত করে, তারপর মৃদু কণ্ঠে বলে, ছোড়দা কিছু টাকার জন্য আমাকে লিখেছিল।

টাকা।

হ্যাঁ, বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা চেয়ে তাকে যদি পাঠাতে পারি তাই লিখেছিল।

কেন টাকার দরকার সে সম্পর্কে কিছু লিখেছিলেন চিঠিতে আপনাকে?

না—তবে ছোড়দা চিরদিনই একটু বেশি খরচে—একটু বেহিসাবী—হয়ত কিছু ধারদেনা হয়েছিল!

তা আপনি আপনার বাবাকে কথাটা বলেছিলেন?

হ্যাঁ।

কি বললেন তিনি?

গালাগালি করলেন। টাকা দেননি।

আপনি সে-কথা আপনার ছোড়দাকে জানিয়েছিলেন?

হ্যাঁ।

তারপর তার আর কোন চিঠি পাননি?

না। কিন্তু কেন—কেন এত কথা আপনি তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছেন সুব্রতবাবু?

কুন্তলার স্বরে গভীর উৎকণ্ঠা প্রকাশ পায়।

কুন্তলা দেবী, আপনি বোধ হয় জানেন না একটা কথা—

কি—কি জানি না?

আপনার ছোড়দা কিছুদিন আগে কলকাতায় এসেছিলেন!

হঠাৎ যেন চমকে ওঠে কুন্তলা। বলে, কে আপনাকে একথা বলল?

মিঃ মুখার্জী।

মুখার্জী কাকা?

হ্যাঁ। এবং তিনি আপনার বাবার সঙ্গে গিয়ে অফিসে দেখাও করেন।

কুন্তলার মুখ যেন রক্তহীন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে তখন।

কুন্তলা দেবী!

সাড়া নেই।

মিস রায়!

অ্যাঁ! কুন্তলা মুখ তুলে তাকাল সুব্রতর দিকে।

আপনার সঙ্গেও তিনি দেখা করেছিলেন, তাই না?

হ্যাঁ।

তিনি কদিনের ছুটি নিয়ে এসেছিলেন, কবে কার্যস্থলে ফিরে যান, জানেন কিছু?

দুদিনের ছুটি নিয়ে এসেছিল—

কিন্তু এসেছিলেন কেন? টাকার জন্যে নিশ্চয়ই?

হ্যাঁ।

টাকাটার খুব প্রয়োজন ছিল, তাই না?

হ্যাঁ।

কত টাকা?

প্রায় হাজার টাকা।

টাকাটার যোগাড় হয়েছিল কি?

বোধ হয় সবটা নয়।

সবটা নয় মানে?

আমি আমার জমানো টাকা থেকে শ’তিনেক টাকা ছোড়দাকে দিয়েছিলাম।

আর একটা কথা, আপনার ছোড়দা মিলিটারি ইউনিফর্মে এসেছিলেন কি?

হ্যাঁ।

সঙ্গে রিভলভার ছিল?

হ্যাঁ। কিন্তু কি-কি-কি আপনি বলতে চান মিঃ রায়?

কিছু না। আচ্ছা এবারে আমি উঠব মিস রায়!

এবং কুন্তলা কিছু বলবার আগেই ঘর থেকে বের হয়ে এসে সোজা গাড়িতে স্টার্ট দিল সুব্রত।

.

১৪.

সুব্রত গৃহে ফিরে দেখল মৃণাল সেন তার অপেক্ষায় বসে আছে।

মিঃ সেন! কি খবর—কতক্ষণ?

তা প্রায় আধ ঘণ্টাটাক হবে। মৃণাল সেন বলে।

চা দিয়েছে আপনাকে?

দিতে চেয়েছিল আপনার চাকর কিন্তু আমিই না করেছি।

সুব্রত ভৃত্যকে ডাক দিল।

ভৃত্য আসতেই তাকে দু কাপ চায়ের কথা বললে।

তারপর সোফার উপরে গা ঢেলে দিয়ে বসতে বসতে বললে, কাল থেকে আবার শীতটা কেমন জাঁকিয়ে পড়েছে মিঃ সেন! তারপর বলুন, খবর কি? আপনার মত কাজের মানুষ যখন আমার জন্য বসে আছেন, বুঝতে পারছি মিঃ রায়ের হত্যার ব্যাপারে আরও কিছু জানতে পেরেছেন।

আপনি বলছিলেন না—আর্মি হেড কোয়ার্টারে সৌরীন্দ্র ও ভবেন্দ্রর রিসেন্ট মুভমেন্টের পার্টিকুলারস্ সম্পর্কে জানবার জন্য টেলিগ্রাম করতে!

আপনি তো করেছিলেন! খবর এসেছে কিছু?

হ্যাঁ। একটু আগে আই. জির কাছে ১৪তম আর্মি হেড কোয়ার্টার থেকে সংবাদ এসেছে ওদের দুজনেরই সম্পর্কে। সেই সংবাদ জানতে পেরেই আপনাকে বলতে এসেছি।

বলুন!

হেড কোয়ার্টার জানাচ্ছে, ক্যাপ্টেন সৌরীন্দ্র রায় বর্তমান পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সঙ্গে আজ প্রায় দুমাস হল আরাকান ফ্রন্টেই আছেন। ইতিমধ্যে তিনি কোন ছুটিও নেননি বা ঐ ইউনিট থেকে অন্যত্র ট্রান্সফারও হননি।

আর ভবেন্দ্র?

সুবেদার ভবেন্দ্র রায় একজন নন-কমিশন্ড অফিসার-ক্লার্ক। ওর ওখানকার মেসে প্রচুর ধার-দেনা। অত্যধিক মদ্যপান করে। ইতিমধ্যে একদিন নাকি কোন এক ইউনিটের ডিনার খেতে গিয়েছিল কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে, সেখানে তার রিভালভারটি খোয়া যায়।

তারপর?

ব্যাপারটার একটা কোর্ট অফ এনকোয়ারি বসেছে।

বাট হোয়াট অ্যাবাউট হিজ রিসেন্ট মুভমেন্ট?

সেটাই বলছি। গত ১৫ই ডিসেম্বর অর্থাৎ এখানকার দুর্ঘটনার দশদিন আগে সে দশদিনের ক্যাজুয়াল লিভ নিয়ে নাকি কলকাতায় এসেছে। এবং আজ পর্যন্ত সে ফিরে যায়নি।

ফিরে যায়নি? এখনও কাজে জয়েন করেনি?

না।

অতঃপর সুব্রত মনে হল অন্যমনস্ক ভাবে যেন কি ভাবছে।

মৃণাল সেন সুব্রতর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, কি ভাবছেন সুব্রতবাবু?

ভাবছি তাহলে ভবেন্দ্র নিশ্চয়ই এখনও কলকাতায়ই আছে, আর—

আর কি?

তার বোন কুন্তলা দেবী নিশ্চয় তার খবর জানে! শুনুন, একটা কাজ অবিলম্বে করতে হবে।

কি, বলুন?

প্লেন ড্রেসে একজন সি. আই. ডি-কে মিঃ রায়ের গড়িয়াহাটার বাড়ির ওয়াচে রাখুন। সে কেবল বাড়িটার প্রতিই নজর রাখবে না, কুন্তলা দেবীর মুভমেন্টসের উপর নজর রাখবে।

বেশ, আমি এখুনিই ফিরে গিয়েই ব্যবস্থা করছি।

আগরপাড়া সলিটারি কর্নারের উপরে নজর রেখেছেন তো?

হ্যাঁ। আজ বিকেল পর্যন্ত খবর হচ্ছে, গত দুদিন বাড়ি থেকে বেরই হননি মিঃ গাঙ্গুলী।

সুব্রত যেন আবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। সে যেন কি ভাবছে।

আজ তাহলে আমি উঠি সুব্রতবাবু!

আসুন।

অতঃপর মৃণাল সেন বিদায় নেয়।

সুব্রত উঠে গিয়ে ফোনে ভবেন্দ্রকে ডাকল।

ভৃত্য ফোন ধরেছিল। সে বললে, ভবেন্দ্র বাড়িতে নেই।

দিদিমণি নেই?

আছে—তাকে দেবো?

না, থাক।

ভবেন্দ্ৰ কলকাতাতেই আছে। আর এও ঠিক, কুন্তলা জানে সে কোথায়! কিন্তু কেন, ছুটি শেষ হওয়া সত্ত্বেও ভবেন্দ্ৰ কেন এখনও ফিরে গেল না চাকরি স্থলে?

ডেজার্টার হলে আর্মির লোকের কোর্টমার্শাল হয়, শাস্তি হয়, তা কি সে জানে না?

নিশ্চয়ই জানে। তবে ফিরে যায়নি কেন?

কুন্তলা তার ঐ ছোড়দাকে মনে হয় একটু বেশিই ভালবাসে। ঐ ছোড়দার উপরে তার একটা দুর্বলতাও আছে।

কুন্তলা চেহারাটা সুব্রতর মনের পাতায় যেন ভেসে ওঠে।

বিষণ্ণ মুখ। রুক্ষ কেশভার। কপাল ও চোখ দুটি ভারি সুন্দর; যেন কপালের উপরে কয়েকগাছি চূর্ণ কুন্তল এসে পড়েছে।

কুন্তলা নামটি ভারি মিষ্টি কিন্তু ডাকতেও ভাল লাগে।

সুব্রত হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফিরে পায়। বিরক্ত হয়ে ওঠে নিজের উপরেই। এসব কি ভাবছে সে? আবোল-তাবোল কি এসব চিন্তা সে করছে?

ঘড়ির দিকে তাকাল সুব্রত।

রাত সাড়ে দশটা।

সুব্রত উঠে পড়ল। ভৃত্যকে খাবার দিতে বলল।

.

পরের দিন।

রাত্রি তখন প্রায় দশটা হবে। সেরাত্রেও বাইরে প্রচণ্ড শীত। হাড় পর্যন্ত যেন কাপিয়ে তোলে।

টেলিফোন বেজে উঠল।

সুব্রত টেলিফোন ধরে কার সঙ্গে যেন কথা বলল।

ইয়েস স্যার, একটা মিস্টিরিয়াস লোক পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢুকেছে পিছন দিক দিয়ে—বোধ হয় পাঁচ-সাত মিনিট হবে!

কিপ এ ক্লোজ ওয়াচ-আমি আসছি। হ্যাঁ, মৃণাল সেনকে খবর দিয়েছ? তাকে ফোন করেছ?

হ্যাঁ স্যার, ফোন করেছিলাম কিন্তু তিনি অফিসে নেই।

সুব্রত টেলিফোন রেখে দিল।

পনেরো থেকে ষোল মিনিটের মধ্যেই সুব্রত ঝড়ের বেগে যেন গাড়ি চালিয়ে গড়িয়াহাটায় মিঃ রায়ের বাড়ির সামনে এসে পড়ল।

কমল নামে যে যুবকটি বাড়ির পাহারায় ছিল সে ছুটে আসে।

এনি ফারদার নিউজ, কমল?

না স্যার।

এখনো বাড়িতেই আছে লোকটা তাহলে?

হ্যাঁ স্যার।

ঠিক আছে। আমি ভিতরে যাচ্ছি। যে পথ দিয়ে ও ভিতরে ঢুকছে সেখানেই তুমি দাঁড়িয়ে থাকো। ও নিশ্চয়ই ঐ পথ দিয়েই ফিরে যাবে। ইউ মাস্ট স্টপ হিম। আর কেউ তোমার সঙ্গে নেই?

না স্যার—তবে এখুনি আমার রিলিফ শিবনাথ আসবে।

ঠিক আছে, আমি না ফিরে আসা পর্যন্ত তুমি থেকো।

ঠিক আছে স্যার।

সুব্রত অতঃপর রাস্তায় গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে গেটের দিকে এগিয়ে গেল। গেট বন্ধ ছিল।

দারোয়ানকে ডাকতেই সে সাড়া দেয়, কৌন?

দারোয়ানজী, গেট খুলিয়ে!

দারোয়ান এগিয়ে এল। সুব্রতকে সে চিনতে পারে, সাব, আপ!

হ্যাঁ, গেটটা খোল। ছোটবাবু কোঠিমে হ্যায় না?

জী নেহি তো, উননে বাহার গিয়ে।

দারোয়ান গেট খুলে দিল। সুব্রত ভিতরে প্রবেশ করে।

উপরের একটা ঘরে আলো জ্বলছে।

ভবেন্দ্রর এ সময় থাকার কথা নয়, ব্রত ভাল করেই জানে। সে এ সময়টা তাস খেলতে যায়—তাই গিয়েছে। কিন্তু বাড়ির মধ্যে ঢোকা যায় কেমন করে?

ড্রইংরুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। দরজা বন্ধ।

একটু ইতস্তত করে সুব্রত। যেন মুহূর্তকাল কি ভাবে। তারপর বেল বাজায় একবার।

ভিতরে ডিং-ডিং মিউজিক শোনা যায়।

সুব্রত রুদ্ধ নিশ্বাসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। এক-একটা সেকেন্ড যেন একএকটা ঘণ্টা বলে মনে হয়।

কলিংবেল আর একবার কিন্তু বাজাতে হল না। বেয়ারা দরজা খুলে দিল।

ছোটবাবু-ভবেন্দ্রবাবু বাড়িতে আছেন?

না তো!

কখন বের হলেন?

প্রায় ঘণ্টা দুই হবে।

আশ্চর্য, আমাকে এ সময় আসতে বলেছিলেন!

আসতে বলেছিলেন!

হ্যাঁ, বোধ হয় এসে যাবেন এখুনি। আমি বরং একটু বসি। সুব্রত বলে।

ভৃত্য কোন কথা বলে না।

দিদিমণি আছে?

হ্যাঁ।

কি করছেন? দিদিমণির শরীরটা সকাল থেকে খারাপ—শুয়ে আছেন।

হুঁ। আচ্ছা তুমি যাও, আমি বসছি।

বেয়ারা আর কথা বলল না। সুব্রত তার অপরিচিত নয়।

দু-চারদিন এখানে এসেছে—একজন পুলিস অফিসারও প্রথমবার সঙ্গে ছিল। সেদিন তো দিদিমণির সঙ্গে অনেকক্ষণ বসে কথাও বলে গেল।

বেয়ারার মনে কোন সন্দেহ জাগে না।

.

১৫.

বেয়ারা চলে গেল।

তার পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেলে সুব্রত উঠে দাঁড়াল।

দোতলায় একটি ঘরেই মাত্র আলো জ্বলতে দেখেছে সুব্রত গেট দিয়ে ভিতরে ঢোকবার সময়। নিশ্চয়ই ঐ ঘরটাই কুন্তলার। দক্ষিণ দিকের ঘরটা।

পা টিপে টিপে সুব্রত ড্রইংরুম থেকে বেরুল।

একটা হলঘর। এক পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গিয়েছে। হলঘরটা অন্ধকার। সিঁড়িতে একটা আলো জ্বলছে স্বল্পশক্তির। চওড়া চওড়া সিঁড়ি ধাপে ধাপে উপরে উঠে গিয়েছে।

সুব্রত সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায়!

দোতলার বারান্দা। টানা বারান্দা। টিমটিমে একটা আলো জ্বলছে বারান্দায়। আলোছায়ার একটা রহস্য যেন।

দক্ষিণদিককার ঘরটায় আলো জ্বলছিল—দেখেছে সুব্রত। সেই দিকেই পা টিপে টিপে এগিয়ে যায়।

কাচের শার্সি দিয়ে ঘরের ভিতরকার আলোর আভাস পাওয়া যায়। কিন্তু জানালায় পর্দা থাকায় ভিতরের কিছু নজরে পড়ে না।

দরজা-দরজার সামনে এসে দাঁড়াল সুব্রত। মৃদু ঠেলা দিতেই দরজা খুলে গেল। ভিতরে তাকাল সুব্রত। কুন্তলা পিছন ফিরে দরজার দিকে দাঁড়িয়ে আছে।

আর একটা টেবিলে প্লেটে খাবার—কে একজন টুলের উপরে বসে গোগ্রাসে খেয়ে যাচ্ছে।

লোকটার বয়স বেশি হবে না। সাতাশ-আটাশ বলেই মনে হয়। পরনে একটা পায়জামা ও পাঞ্জাবি, তার উপরে একটা আলোয়ান জড়ানো। একমুখ দাড়ি।

খেতে খেতে একসময় লোকটা বলে, না এমন করে পারছি না কুন্তী।

ইউনিটে তুমি ফিরে যাচ্ছ না কেন?

উপায় নেই। উপায় থাকলে কি যেতাম না!

কিন্তু এভাবে পালিয়ে পালিয়েই বা কতদিন বেড়াবে?

কুন্তলা দেবী!

কে?

চমকে দুজনেই ফিরে তাকায়। যুগপৎ কুন্তলা ও ভবেন্দ্র।

ভবেন্দ্র ততক্ষণে উঠ দাঁড়িয়েছে।

হু-হু ইজ হি? ভবেন্দ্ৰ জিজ্ঞাসা করে বোনকে।

এ কি আপনি-আপনি উপরে এ ঘরে। কুন্তলার স্বরে বিরক্তিটা যেন বেশ স্পষ্টই।

আই অ্যাম ভেরি সরি, অত্যন্ত দুঃখিত মিস রায়। কিন্তু এ ছাড়া আর উপায় ছিল না।

উপায় ছিল না মানে? আপনি না বলে কয়ে—

বললাম তো, অত্যন্ত দুঃখিত-ক্ষমা চাইছি।

ভবেন্দ্র আবার প্রশ্ন করে, বাট হু ইজ দিস জেনটেলম্যান, কুন্তী?

সুব্রত বলে, তাছাড়া আপনি হয়ত জানেন না, ফোনে ওঁর এখানে আসবার সংবাদ পেয়েই আমি এখানে এসেছি!

ফোনে সংবাদ পেয়েছেন?

হ্যাঁ। যারা সর্বক্ষণ এ বাড়ি পাহারা দিচ্ছে তারাই আমাকে ও ইন্সপেক্টার মিঃ সেনকে সংবাদটা দিয়েছে—উনি এখানে এসেছেন।

হঠাৎ কুন্তলার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়।

মুখের উপরে ক্ষণপূর্বে যে বিরক্তির মেঘটা দেখা দিয়েছিল, তার যেন অবশিষ্ট মাত্রও থাকে না। বরং একটা ভয় একটা উদ্বেগের ছায়া যেন মুখের উপরে ভেসে উঠেছে।

সুব্রত ভবেন্দ্রকে দেখিয়ে বলে, উনি আর এখন পুলিশের অজান্তে এখান থেকে বেরুতে পারবেন না মিস রায়!

কিন্তু কেন—কেন পুলিস ওর গতিবিধির উপরে নজর রেখেছে? একটা চাপা আর্তনাদের মতই যেন প্রশ্নটা কুন্তলার কণ্ঠ থেকে বের হয়ে আসে।

সেটা আপনার ছোড়দাকেই জিজ্ঞাসা করুন না মিস রায়! সুব্রত শান্ত কণ্ঠে বলে।

ভবেন্দ্র একেবারে চুপ।

সে তখনও ঠিক ব্যাপারটা যেন বুঝে উঠতে পারছে না—কে লোকটা। পুলিসের কোন লোক বলে তো মনে হচ্ছে না। সোজা একেবারে বিনা এত্তেলায় অন্দরে চলে এসেছে এবং তার বোনের সঙ্গে যে ভাবে কথা বলছে তাতে করে মনে হচ্ছে পরস্পরের। সঙ্গে ওদের পরিচয়ও আছে।

সুব্রত আবার বলে, তাহলে সেদিন আপনি আমার কাছে সত্যি কথাটা বলেননি মিসেস রায়!

সত্যি কথা বলিনি! কুন্তলা প্রশ্নটা করে সুব্রতর মুখের দিকে তাকাল।

তাই নয় কি! আপনি জানতেন আপনার ছোড়দা কলকাতাতেই আছেন!

কুন্তলা একেবারে যেন চুপ এবারে। সুব্রত আবার প্রশ্ন করে, কি, জানতেন না মিস রায়?

কুন্তলা মাথা নিচু করে।

এবার সুব্রত ভবেন্দ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, আপনি নিশ্চয় জানেন ভবেন্দ্রবাবু, আপনি আর্মির আইনে একজন ডেজার্টার এবং ডেজার্টারদের মিলিটারি আইনে কোর্টমার্সাল হয়।

ভবেন্দ্ৰ যেন পাথর।

তাছাড়া আপনার মাথায় তো একটা কোর্ট মার্সাল ঝুলছে আপনার রিভলভারটা হারানোর জন্য!

রিভলভার? হঠাৎ কুন্তলা চমকে ওঠে।

হ্যাঁ। জিজ্ঞাসা করুন না আপনার ভাইকে! সুব্রত বলে।

ছোড়দা—

কুন্তলার কথা শেষ হল না—ভবেন্দ্র বললে, হ্যাঁ, হারিয়েছে।

কোথায় হারালো—কি করে হারালো?

কুন্তলা যেন কতকটা চাপা আর্তনাদের সঙ্গে কথাগুলো উচ্চারণ করে।

জানি না—আমি কিছু জানি না। ভবেন্দ্র হঠাৎ বলে ওঠে, তারপর সুব্রতর দিকে তাকায়, চলুন আমাকে কোথায় নিয়ে যাবেন আপনি, চলুন।

ছোড়দা?

কুন্তলা চেঁচিয়ে ডাকে আর্ত গলায়।

ভবেন্দ্র বলে, ফেড আপ-আই অ্যাম ফেড আপ—এভাবে কুকুরের মত পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে আর পারছি না।

সুব্রত হাসল।

না ভবেনবাবু, আপনি একটু ভুল করেছেন—পুলিশ আপনাকে একজন ডেজার্টার হিসেবে খুঁজে বেড়াচ্ছে ঠিকই এবং মিলিটারিও খুজছে, কিন্তু আমি–

সুব্রতকে বাধা দিয়ে ভবেন্দ্র বলে, জানি, জানি—আপনি পুলিসের গোয়েন্দা!

না, তাও আমি নই। পুলিসের বা মিলিটারির লোক আমি নই—আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, আপনাকে আমি সম্পূর্ণ অন্য কারণে কয়েকটা প্রশ্ন করবার জন্যেই এসেছি।

প্রশ্ন?

হ্যাঁ, গত ২৩শে ডিসেম্বর সকাল আটটা থেকে রাত্রি এগারোটা পর্যন্ত কোথায় ছিলেন আপনি?

কোথায় ছিলাম? ভবেন্দ্ৰ তাকাল সুব্রতর মুখের দিকে।

হ্যাঁ, বলুন, কোথায় ছিলেন আপনি?

মানে আমি–

মিঃ রায়, আমি সেই রাত্রের কথাই বলছি যে রাত্রে আগড়পাড়ায় আপনার বাবা রিভলভারের গুলিতে নিহত হন।

হোয়াট? বাবা রিভলবারের গুলিতে নিহত হয়েছেন?

একটা যেন আর্ত চিৎকারের সঙ্গে প্রশ্নটা বের হয়ে আসে ভবেন্দ্রর কণ্ঠ থেকে।

হ্যাঁ, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট তাই বলছে-বুলেটও তার ব্রেন ম্যাটারের মধ্যে ইমপ্যাকটেড় হয়ে ছিল-পাওয়া গিয়েছে এবং এক্সপার্টের মত হচ্ছে—গুলিটা ছোড়া হয়েছিল একটা ৩৮ আর্মি রিভলভার থেকে।

নো নো-ইউ মিন–

হ্যাঁ, আপনি একজন মিলিটারির লোক এবং সেই কারণেই ঐ ধরনের একটা রিভলভার আপনার কাছে থাকা সম্ভব বলেই প্রশ্নটা করছি। বলুন-দুর্ঘটনার দিন আপনি সকাল আটটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত কোথায় ছিলেন?

সুব্রতবাবু। কুন্তলা যেন কি বলবার চেষ্টা করে।

তাকে বাধা দিয়ে সুব্রত বলে, ওঁকে বলতে দিন মিস রায়, কোথায় উনি ঐ সময়টা ছিলেন সেদিন!

আমার-আমার এক বন্ধুর বাড়িতে।

বন্ধুর বাড়িতে! কোথায়?

সুব্রত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল ভবেন্দ্রর মুখের দিকে।

দমদম সিঁথিতে—

সকাল আটটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত?

না, বিকেলবেলা শ্যামবাজারে এসেছিলাম সন্ধ্যার শোতে সিনেমা দেখতে একবার।

কেউ এর সাক্ষী আছে?

সাক্ষী? না-সাক্ষী আবার থাকবে কি!

আপনার সেদিনকার সন্ধ্যার শোতে সিনেমা দেখার ব্যাপারে কেউ সাক্ষী থাকলে হয়ত ভাল হত মিঃ রায়! আচ্ছা মিস রায়, আমি চলি—অসময়ে এভাবে আপনাদের এসে বিরক্ত করবার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত।

কিন্তু ছোড়দাকুন্তলা তার কথাটা শেষ করতে পারে না।

সুব্রত বলে, উনি যেতে পারেন—আজকের মত ওঁকে কেউ আটকাবে না। তবে ওঁর প্রতি আমার একটা বিশেষ অনুরোধ, উনি যত শীঘ্র পারেন বেরিলিতে ওঁর ইউনিটে ফিরে যান। আচ্ছা চলি-নমস্কার।

সুব্রত ঘর থেকে বের হয়ে গেল।