১১. ময়না তদন্তের রিপোর্ট

ময়না তদন্তের রিপোর্ট

টেবিলের ওপর সুব্রতর আনীত তীরটা পড়েছিল। শঙ্কর সেটা টেবিলের ওপর থেকে হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়ে দেখতে লাগল।

তীরটা ছুঁড়ে কোনো এক হতভাগ্যের life-এর ওপর নাকি attempt করা হয়েছিল? কে attempt করল? কার life-এর ওপরেই বা attempt করল? কেনই বা attempt করল? আশ্চর্য!

সহসা একসময় সুব্রত চোখ খুলে সামনের দিকে তাকিয়ে শঙ্করের হাতে তীরটা দেখতে পেয়ে চমকে বলে উঠল, আরে সর্বনাশ! করছেন কী? তারপর কী একটা বিপরীত কাণ্ড ঘটিয়ে বসবেন! রাখুন রাখুন, তীরটা রেখে দিন। কে জানে কী ভয়ঙ্কর বিষ তীরের ফলায় মাখানো আছে!

শঙ্কর একপ্রকার থতমত খেয়ে তীরটা টেবিলের ওপরে নামিয়ে রাখল।

এমন সময় ভৃত্য গরম চায়ের কাপ হাতে ঘরে ঢুকে কাপটা টেবিলের ওপরে সুব্রতর সামনে নামিয়ে রেখে নিঃশব্দে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। সুব্রত ধূমায়িত চায়ের কাপটা তুলে চুমুক দিল।

আঃ! একটা আরামের নিঃশ্বাস ছেড়ে সুব্রত শঙ্করের মুখের দিকে তাকাল। ওই যে তীরটা দেখছেন শঙ্করবাবু, একটু আগে কোনো এক অদৃশ্য আততায়ী ওটা ছুঁড়ে আমাকে ভবপারাবারে পাঠাতে চেয়েছিল!

বলেন কি? শঙ্কর চমকে উঠল।

আর বলি কি! খুব বরাত, এযাত্রা বেঁচে যাওয়া গেছে। শুধু একবার নয়, দুবার তীর ছুঁড়ে আমার জীবনসংশয় ঘটানোর সাধু প্রচেষ্টা করেছিল।

তারপর?

আতঙ্কে শঙ্করের সর্বশরীর তখন রোমাঞ্চিত।

তারপর আর কী! দুটোর একটা attempt-ও successful হয়নি—প্রমাণ এখনও শ্রীমান সুব্রত রায় আপনার চোখের সামনেই স্ব-শরীরে বর্তমান।

তা যেন হল—কিন্তু এ যে ব্যাপার ভয়ানক হয়ে দাঁড়াচ্ছে ক্রমে সুব্রতবাবু! শেষকালে কি এলোপাথাড়ি হাতের সামনে যাকে পাবে তাকেই মারবে!

মারতে পারুক ছাই না পারুক সাধু প্রচেষ্টার অভাব হবে না, এ-কথা কিন্তু হলফ করে বলতে পারি মিঃ সেন। সুব্রত বললে।

কিন্তু এভাবে একদল ভয়ঙ্কর অদৃশ্য খুনেদের সঙ্গে কারবার করাও তো বিপজ্জনক। মুখোমুখি এসে দাঁড়লেও না হয় এদের শক্তি পরীক্ষা করা যেত, কিন্তু এ যে গরিলা যুদ্ধের মত।

মেঘনাদ যিনি তিনি হয়তো সামনাসামনি দাঁড়িয়েই কল টিপছেন; আর কতকগুলো পুতুলকে কোমরে দড়ি বেঁধে যখন যেমন যেদিকে নাচাচ্ছেন তেমনি নাচছে; সুব্রত বলে।

কিন্তু মেঘনাদটি কে? শঙ্কর সুব্রতর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে।

আরে মশাই, সেটাই যদি জানা যাবে তবে এত হাঙ্গামাই বা আমাদের পোহাতে হবে কেন? সুব্রত হাসতে হাসতে জবাব দিল।

তারপর সহসা হাসি থামিয়ে যথাসম্ভব গম্ভীর হয়ে সুব্রত বললে, আজ আবার একটি হতভাগ্য প্রাণ নিতে এসে প্রাণ দিয়েছে।

সে কি!

হ্যাঁ। বেচারা আমাকে মারতে এসে নিজে প্রাণ দিয়েছে; সুব্রত বললে।

বলেন কী! তা কেমন করে জানলেন?

হতভাগ্যের মৃতদেহ এখনও শালবনের মধ্যে পড়ে আছে।

পুলিসে একটা খবর দেওয়া তো তবে দরকার। শঙ্কর বললে।

তা দরকার বইকি। পুলিস জাতটা বড় সুবিধের নয়। আগে থেকে সংবাদ একটা দিয়ে রাখাই আমার মতে ভাল, কেননা নয় কে হয় ও হয় কে নয় করতে তাদের জোড়া আর কেউ নেই।

কিন্তু এত রাত্রে কাকে থানায় পাঠানো যায় বলুন তো? বাস তো সেই রাত দেড়টায়। ধারে-কাছে তো থানা নেই; সেই একদম কাতরাসগড়, নয় তেতঁলিয়া হল্টে। তাছাড়া ব্যাপার ক্রমে যা দাঁড়াচ্ছে, কোনো চেষ্টাকেই যেন আর বিশ্বাস করা যায় না।

কিন্তু থানায় লোক পাঠাতে আর হল না, ভৃত্য এসে সংবাদ দিলে থানার দারোগাবাবুর কাছ থেকে একজন লোক এসেছে, সুব্রতবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চায়।

আমার সঙ্গে? সুব্রত উঠে দাঁড়াল।

বাইরে এসে দেখলে একজন চৌকিদার অপেক্ষা করছে।

তুমি? সুব্রত প্রশ্ন করলে।

আজ্ঞে, দারোগাবাবু আপনার নামে একটা চিঠি দিয়েছেন।

একটা মোটা মুখবন্ধ On his Majestys Service খাম লোকটা সুব্রতর দিকে এগিয়ে ধরল।

সুব্রত খামটা হাতে করে ঘরে ঢুকতেই শঙ্কর বললে, কী ব্যাপার সুব্রতবাবু?

দারোগাবাবু একটা চিঠি পাঠিয়েছেন। ভাল কথা, দেখুন তো লোকটা চলে গেল নাকি?

কেন?

তাড়াতাড়ি চাকরটাকে জিজ্ঞাসা করুন।

এই ঝুমন! শঙ্কর ডাকল।

বাবু! ঝুমন দরজার ওপরে এসে দাঁড়াল।

চৌকিদার কি চলে গেছে?

আজ্ঞে না। চুটিয়া খাচ্ছে।

তাকে একটু দাঁড়াতে বল্।

ঝুমন চলে গেল।

ব্যাপার কি? শঙ্কর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে সুব্রতর মুখের দিকে তাকাল।

এই লোকটার হাতেই দারোগাবাবুকে শালবনের খুন সম্পর্কে একটা খবর দিয়ে দিন না। তাহলে আর লোক পাঠাতে হয় না।

ঠিক বলেছেন।

শঙ্কর তাড়াতাড়ি একটা চিঠির কাগজে সংক্ষেপে শালবনের খুন সম্পর্কে যতটা সুব্রতর কাছে শুনেছিল লিখে চৌকিদারের হাতে দিয়ে দিল দারোগাবাবুকে গিয়ে দেবার জন্য।

চৌকিদার চলে গেল।

সুব্রত খামটা খুলে দেখলে গোটা তিন-চার পুলিশ মর্গের রিপোর্ট ও তার সঙ্গে ছোট্ট একটা চিরকুট।

সুব্রতবাবু, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাঠালাম। কাজ হয়ে গেলে যত তাড়াতাড়ি পারেন ফেরত দিলে সুখী হব। আর দয়া করে কিরীটীবাবু এলে একটা সংবাদ দেবেন। কতদূর এগুলো?

নমস্কার।

কিসের চিঠি সুব্রতবাবু? শঙ্কর প্রশ্ন করল।

এখানে ইতিপূর্বে যেসব ম্যানেজার মারা গেছেন তাঁদের ময়না তদন্তের রিপোর্ট।

ঠাকুর এসে বললে, খাবার প্রস্তুত।

দুজনে উঠে পড়লো।

.

খাওয়াদাওয়ার পর সুব্রত মাথার ধারে একটা টুলের ওপরে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে কম্বলে গা ঢেকে শুয়ে পড়ল।

তারপর আলোর সামনে রিপোটগুলো খুলে এক এক করে পড়তে লাগল।

মৃত্যুর কারণ প্রত্যেকবারই এক; প্রত্যেকরই শরীরে তীব্র বিষের ক্রিয়ায় রক্ত জমাট বেঁধে মৃত্যু হয়েছে এবং প্রত্যেকেরই গলার পিছনদিকে যে ক্ষত পাওয়া গেছে, সেখানকার টিসু পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সেখানকার টিসুতেই সেই বিষ ছিল। সিভিল সার্জনের মতে সেই ক্ষতই বিষ প্রবেশের পথ।…তাহলে বোঝা যাচ্ছে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট থেকে যে, নিছক গলা টিপেই খুনগুলো করা হয়নি। ময়নাতন্তের রিপোটের সঙ্গে Chemical Examinar-দের কোনো report নেই। তাহলে জানা যেত কী ধরনের বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল। তবে এটুকু বেশ স্পষ্ট বোঝা যায়, বিষ অত্যন্ত তীব্র শ্রেণীর।

কিন্তু প্রত্যেক মৃত ব্যাক্তির গলার পিছনদিকে যে চারটি করে কালো কালো ছিদ্র বা ক্ষত পাওয়া গেছে, সেগুলোর তাৎপর্য কি? কি ভাবে সেগুলো হল? কেনই বা হল? সুব্রত চিন্তামগ্ন হয়ে পড়ল।