লাইব্রেরী ঘর থেকে বের হয়ে তারই লাগোয়া ঘরটির পর্দা-ফেলা-দরজার সামনে এসে সকলে দাঁড়াল।
চলুন। বৃন্দাবনবাবুই সর্বাগ্রে দরজার পর্দাটা হাত দিয়ে সরিয়ে ওঁদের আহ্বান জানালেন ভিতরে প্রবেশের।
প্রথমে বৃন্দাবনবাবু ও তার পশ্চাতে কিরীটী ও সর্বশেষে সুশান্ত ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করে।
মাঝারি আকারের ঘরটি।
ঝকঝকে মোজেইক টাইলের ঠাণ্ডা মেঝে।
ঘরের একটিমাত্র জানলা খোলা ছিল, তবে জানলার পর্দা টেনে রাখার জন্য ঘরের মধ্যে দিনের বেলাতেও পর্যাপ্ত আলো প্রবেশ করতে পারেনি।
ঘরের একধারে একটি সিংগল খাটের উপরে বেডকভারে ঢাকা শয্যা।
অন্যদিকে একটি প্রমাণসাইজের আরশি-বসানো আলমারি। তার পাশে বড় একটি কালো ট্রাঙ্ক ও তার ওপরে একটি চামড়ার সুটকেস।
ঘরের অন্য কোণে ত্রিপয়ের উপরে সুদৃশ্য একটি টাইমপিস ও তার পাশে কারুকার্যখচিত একটি জয়পুরী ফ্লাওয়ার ভাসে একগুচ্ছ টাটকা বড় বড় ব্ল্যাকপ্রিন্স গোলাপফুল।
ফ্লাওয়ার ভাসটার সামনেই ধূপদানিতে প্রজ্বলিত একটি মোটা ধূপকাঠি।
গোলাপের ও চন্দন ধূপের সুমিষ্ট মিশ্র গন্ধ ঘরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটীকে আকৃষ্ট করেছিল।
আলমারিটার পাশেই আলনায় কয়েকখানি শাড়ি পাট করে রাখা।
ঘরের পশ্চিম কোণে একটি গোল টেবিলের চারপাশে খানতিনেক সোফা। তারই একটায় দরজার দিকে পিছন ফিরে বোধ হয় শকুন্তলা দেবী বসেছিলেন।
কারণ ঘরে ঢুকে তাকে না দেখা গেলেও তার মাথার কালো কেশ কিরীটীর চোখে পড়েছিল।
শকুন্তলা, মিঃ রায় এসেছেন!
বৃন্দাবনবাবুর গলার সাড়া পেয়ে শকুন্তলা উঠে দাঁড়াল সোফা থেকে।
ঈষৎ হরিদ্রাভ গাত্রবর্ণ।
লম্বায় পাঁচ ফুটের একটু বোধ হয় কমই হবে শকুন্তলা।
মুখখানা মঙ্গোলিয়ান টাইপের হলেও এবং ছোট চোখ ও নাকটা একটু চাপা হলেও মুখখানির মধ্যে চমৎকার আলগা একটি শ্ৰী আছে।
পরিধানে জরিপাড় ঈষৎ নীলাভ একটি তাঁতের দামী শাড়ি।
মাথায় পর্যাপ্ত কেশ। এলোমেলো হয়ে রয়েছে।
হাতে দুগাছি করে সোনার চুড়ি।
কানে নীলার টাব।
পায়ে চপ্পল।
না, না—আপনাকে উঠতে হবে না শকুন্তলা দেবী, আপনি বসুন বসুন-কিরীটী তাড়াতাড়ি বলে।
শকুন্তলা দ্বিরুক্তি না করে কিরীটীর অনুরোধে যে সোফাটার উপর বসেছিল, সেই সোফাতেই পুনরায় বসে পড়ল।
তাহলে আপনি কথা বলুন ওঁর সঙ্গে মিঃ রায়। আমি লাইব্রেরী ঘরে আছি। বৃন্দাবন সরকার ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
কিরীটী আর সুশান্ত দুজনে অন্য দুটি খালি সোফায় পাশাপাশি বসল।
আপনাকে বিরক্ত করার জন্য আমি দুঃখিত শকুন্তলা দেবী, তবে বেশীক্ষণ আপনাকে বিরক্ত আমি করব না। দুচারটে কথা আপনাকে আমার জিজ্ঞাস্য আছে মাত্র।
শকুন্তলা কিরীটীর কথায় বারেকের জন্য মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল নিঃশব্দে, পুনরায় নিঃশব্দেই মুখটা নামিয়ে নিল।
আমার পরিচয়টা সর্বাগ্রে আপনাকে বোধ হয় দেওয়া কর্তব্য মিস ত্রিবেদী। কিরীটী বললে।
বৃন্দাবনবাবুর মুখেই শুনলাম, আপনি মিঃ সরকারের হত্যারহস্যের তদন্তের জন্যই এসেছেন!
ও, তাহলে বোধ হয় আমার বক্তব্য আমি শুরু করতে পারি?
বলুন, কি জানতে চান?
সহজ সতেজ কণ্ঠস্বর শকুন্তলার।
সারদাবাবুকে নিয়মিত বই পড়ে শোনানো ও তার লেখাপড়ার টুকটাক কাজগুলো করে দেবার জন্যই তো আপনি নিযুক্ত হয়েছিলেন, তাই না? কিরীটী এবার প্রশ্ন শুরু করে।
হ্যাঁ।
আচ্ছা, সারদাবাবুর মেজাজ কি রকম ছিল শকুন্তলা দেবী?
খুব ঠাণ্ডা ও ধীর মেজাজ ছিল তার, কচিৎ কখনো হয়তো রেগে উঠতেন—
নিজের মতের সঙ্গে না মিললেই, এই তো?
হ্যাঁ।
আপনি তো এখানে প্রায় মাস আষ্টেক আছেন, তাই না?
হ্যাঁ।
এই সময়ের মধ্যে বৃন্দাবনবাবু এখানে কি রকম আসা-যাওয়া করতেন?
হপ্তায় দুবার বা মাঝে মাঝে তিনবারও এসেছেন।
এই কমাসে আপনার তার সঙ্গে নিশ্চয়ই বেশ আলাপ হয়েছে! কথাটা বলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিরীটী শকুন্তলার মুখের দিকে তাকায়।
কেন বলুন তো মিঃ রায়? আপনার জিজ্ঞাস্যটা ঠিক কি জানতে পারি কি? পালটা প্রশ্ন করে শকুন্তলা ড়ু উত্তোলিত করে তাকালো কিরীটীর মুখের দিকে সুস্পষ্ট দৃষ্টিতে প্রায় যেন সঙ্গে সঙ্গেই।
না, না-আপনি অন্য রকম কিছু ভাববেন না শকুন্তলা দেবী, বৃন্দাবনবাবু সম্পর্কে আপনার ধারণাটাই জিজ্ঞাস্য শুধু।
ওঃ! তা ভদ্রলোক পারফেক্ট জেটেলম্যান বলেই তো আমার মনে হয়।
আর মধুসূদনবাবু?
কিরীটীর শেষের কথায় চমকে যেন শকুন্তলা দেবী তাকালো তার মুখের দিকে মুহূর্তের জন্য। এবং ক্ষণেকের সেই চমকটা কিরীটীর দৃষ্টিকে তো এড়ায়নিই, সুশান্তর দৃষ্টিকেও ফাকি দিতে পারে না।
কিন্তু সে মুহূর্তের জন্যই। পরক্ষণেই শান্ত স্থির দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, I am sorry! ভদ্রলোকের সঙ্গে বিশেষ কোন আলাপের এখনও কোন সুযোগই আমার হয়নি। কাজেই তার সম্পর্কে কোন কথা আমি বলতে পারবও না।
প্রত্যুত্তরে কিরীটী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।
তারপর আবার তার প্রশ্ন শুরু করে, আপনি শুনলাম অনেক দিন নাকি বর্ষায় ছিলেন, তাই কি শকুন্তলা দেবী?
হ্যাঁ।
বর্মায় কোথায় ছিলেন?
দ্বিতীয়বার তখনি শকুন্তলা আবার কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে শান্তকণ্ঠে প্রশ্ন করল, বর্মায় আপনি গিয়েছেন নাকি কখনও মিঃ রায়?
মৃদু হেসে কিরীটী বলে, হ্যাঁ, সেইজন্য বর্মা দেশের প্রায় সব কিছুই মোটামুটি আমার জানা।
রেঙ্গুনে। মাথাটা নিচু করে শকুন্তলা অতঃপর বললে।
প্রপার রেঙ্গুন শহরেই বরাবর ছিলেন?
হ্যাঁ।
ভাল কথা শকুন্তলা দেবী, সারদাবাবুর যে হার্টের ট্রাবলস ছিল, আপনি তো তা জানতেন?
জানতাম।
মধ্যে মধ্যে তিনি ইনসমনিয়ার জন্য আবার ঘুমের ঔষধ খেতেন, তাও আপনি জানতেন?
জানতাম।
আচ্ছা যে রাত্রে সারদাবাবু মারা যান, সেরাত্রে কখন আপনার সঙ্গে সারদাবাবুর শেষ দেখা হয় ও তার সঙ্গে আপনার শেষ কথাবার্তা হয়?
ঠিক মনে নেই, তবে রাত প্রায় সাড়ে নটা পর্যন্ত আমরা লাইব্রেরী ঘরেই ছিলাম। ওঁকে আমি বই পড়ে শোনাচ্ছিলাম। ঐসময় বৃন্দাবনবাবু ওঁর সঙ্গে কি জরুরী কথাবার্তা বলতে আসায় আমাকে ছুটি দিয়ে ওঁরা মিঃ সরকারের ঘরের দিকেই যান।
তাদের মধ্যে তাহলে সেরাত্রে কি ধরনের কথাবার্তা হয়, আপনি কিছুই জানেন না? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
না।
কিন্তু আমি যতদূর শুনেছি, আপনি নাকি ঐ রাত্রেই রাত এগারোটা নাগাদ আবার সারদাবাবুর ঘরে গিয়েছিলেন, কথাটা কি সত্যি?
হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। ঐ সময় তিনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন আবার তার ঘরে।
অত রাত্রে?
হ্যাঁ, লুমিনলের ফাইলটা খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তাই ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
আপনি বুঝি মধ্যে মধ্যে তাকে ঔষধপত্রও দিতেন?
দিতাম।
হুঁ, তারপর আপনি কি করলেন?
ঔষধের ফাইলটা খুঁজে দিয়ে যখন চলে আসছি আমাকে বললেন, দশরথকে এক কাপ চা তাকে দিয়ে যেতে বলবার জন্য।
বলেছিলেন আপনি সেকথা দশরথকে?
হুঁ–আমি বলিনি, তবে গোকুলকে দিয়ে বলে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।
আচ্ছা সে সময় সারদাবাবুর মুড আপনার কি রকম লেগেছিল?
কেন, হি ওয়াজ পারফেক্টলি অল রাইট, নাথিং অ্যাবনরমাল আই ফাউণ্ড দেয়ার!
আই সি! আচ্ছা শকুন্তলা দেবী, এ বাড়িতে সারদাবাবুর মৃত্যুর কয়েক দিন আগে কেতু নামে কে একজন লোককে কাজে বহাল করা হয়েছিল এবং যার আজ পর্যন্ত সেইদিন সকাল থেকে কোন সন্ধানই আর পাওয়া যায়নি, কথাটা জানেন বোধ হয়?
জানি। একটু যেন ভেবে সময় নিয়ে ধীরে কথাটা উচ্চারণ করল শকুন্তলা।
লোকটার চেহারা নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে?
য়্যাঁ! একটু যেন চমকেই ওঠে শকুন্তলা, তারপর সেই ভাবটা সামলে নিয়ে বলে, হ্যাঁ, তা মনে আছে বৈকি।
লোকটাকে আবার দেখলে বা তার কোন ফটো দেখলে চিনতে পারবেন আশা করি।
বোধ হয় পারব। কারণ তার চেহারা বেশ ঢ্যাঙা ছিল এবং বাঁ পা-টা ডিফেকটিভ থাকার দরুণ সামান্য একটু পা-টা টেনে কুঁজো হয়ে লোকটা চলত লক্ষ্য করেছিলাম।
আর একটি কথা শকুন্তলা দেবী, আপনি বোধ হয় এখন কিছুদিন এখানেই থাকবেন, তাই না?
তা ঠিক এখনো কিছু বলতে পারছি না। তারপর একটু থেমে বললে, ওরা যদি আমাকে রাখেন তো থাকতেও পারি।
সেরকম কোন কথা আজ পর্যন্ত-মানে বৃন্দাবনবাবুর সঙ্গে আপনার হয়নি?
না।
আচ্ছা, আর আপনাকে বিরক্ত করব না, উঠি-নমস্কার। কথাটা বলে ঘুরে তাকালো কিরীটী সুশান্তর দিকে এবং বললে, চলুন সুশান্তবাবু!
চলুন। সুশান্তও উঠে দাঁড়ায়।