[১৯০০ খ্রীঃ জুন মাসে নিউ ইয়র্ক বেদান্ত সোসাইটিতে প্রদত্ত একটি বক্তৃতার স্মারকলিপি।]
ভারতে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক মতবাদ—হয় ঐক্যের একটি মূল ভাব অথবা দ্বৈতভাব থেকে বিকাশ লাভ করেছে।
মতবাদগুলি সবই বেদান্তের অন্তর্গত এবং বেদান্তের সাহায্যে ব্যাখ্যাত। তাদের শেষ সার কথা হল ঐক্যের শিক্ষা। যাঁকে আমরা বহুরূপে দেখছি, তিনিই ঈশ্বর। বস্তুজাত পৃথিবী এবং বহুবিধ ইন্দ্রিয়জাত জ্ঞান আমরা অনুভব করি, তবু মাত্র একটি সত্তাই বিদ্যমান।
এই-সমস্ত বিভিন্ন নাম কেবল সেই ‘এক’-এর প্রকাশের মাত্রাগত পার্থক্যকে দেখিয়ে দেয়। আজ যে কীট, কাল সে দেবতা। এই যে-সকল স্বাতন্ত্র্যকে আমরা এত ভালবাসি, সে-সবই এক অনন্ত সত্তার অংশমাত্র, এবং সেগুলির ভেদ কেবল প্রকাশের মাত্রায়। সেই অনন্ত সত্যকে জানাই মুক্তিলাভ।
উপাসনার প্রণালী সম্পর্কে আমাদের যতই বিভ্রান্তি ঘটুক না কেন, বস্তুতঃ মুক্তির জন্যই আমাদের সকল চেষ্টা। আমরা সুখও চাই না, দুঃখও চাই না; চাই মুক্তি। এই একটি লক্ষ্যের মধ্যেই আছে মানুষের সকল অতৃপ্ত তৃষ্ণার মূল রহস্য। হিন্দুও বলে, বৌদ্ধও বলে—মানুষের তৃষ্ণা হল অধিক ও অধিকতরকে পাবার জন্য একটি জ্বলন্ত অপূরণীয় আকাঙ্ক্ষা।
তোমরা আমেরিকানরা সর্বদা আরও সুখ আর সম্ভোগের সন্ধান করছ। এ-কথা সত্য যে, বাইরে তোমরা পরিতৃপ্ত হবে না, কিন্তু ভিতরে—গভীরে তোমরা যা খুঁজছ, তা হল মুক্তি।
এই বাসনার বিশালতা বস্তুতঃ মানুষের নিজের অনন্তত্বের লক্ষণ। যেহেতু মানুষ অনন্ত, তাই বাসনা এবং বাসনাপূর্তি অনন্ত আকার ধারণ করলেই সে পরিতৃপ্ত হতে পারে।
তাহলে কোন্ বস্তু মানুষকে তৃপ্ত করতে পারে? কাঞ্চন নয়, সম্ভোগ নয়, সৌন্দর্য নয়। শুধু এক অনন্তই তাকে পরিতৃপ্ত করতে পারে, এবং সেই অনন্ত সে নিজেই। এ-কথা যখন সে উপলব্ধি করে, কেবল তখনই মুক্তি আসে।
‘এই বাঁশিটি তার রন্ধ্ররূপী সকল ইন্দ্রিয়, সকল চেতনা, অনুভূতি ও সঙ্গীত নিয়ে শুধু একটি রাগিণীই গাইছে। যে-বন থেকে তাকে ছেদন করা হয়েছিল, সেখানেই ফিরে যাবার সে প্রত্যাশী।’
‘—নিজেকে উদ্ধার কর নিজের দ্বারা,
নিজেকে ডুবতে দিও না কখনও,
কারণ তুমিই তোমার পরম বন্ধু,
আবার তুমিই তোমার পরম শত্রু।’
অনন্তকে সাহায্য করতে পারে কে? অন্ধকারের মধ্য দিয়ে যে হাতখানা তোমার কাছে আসছে, তাকেও তোমার নিজেরই হাত হতে হবে।
ভীতি ও বাসনা—এই দুটি কারণই এ-সবের মূলে। কে তাদের সৃষ্টি করে? আমরা নিজেরাই। আমাদের জীবন যেন স্বপ্ন থেকে স্বপ্নান্তরে যাত্রা। অনন্ত স্বপ্নের স্রষ্টা মানুষ সীমাবদ্ধ স্বপ্ন দেখে চলেছে!
আহা! বাইরের কোন বস্তুই যে নিত্য বস্তু নয়—এ যে কী অপূর্ব আশীর্বাদ! এই আপেক্ষিক জগতে কিছুই চিরন্তন নয়—এ-কথা শুনে যাদের বুক কেঁপে ওঠে, তারা ঐ কথাগুলির অর্থ জানে না।
আমি যেন অনন্ত নীলাকাশ। আমার উপর দিয়ে এই নানা রঙের মেঘ ভেসে চলে যায়, কখনও বা এক মুহূর্ত থাকে, তারপর অদৃশ্য হয়ে যায়। আমি সেই চিরন্তন নীলই থেকে যাই। আমি সব কিছুর সাক্ষী, সেই চিরন্তন সাক্ষী। আমি দেখি বলেই প্রকৃতি আছে। আমি না দেখলে প্রকৃতি থাকে না। আমাদের কেহই কিছু দেখতে বা কিছু বলতে পারতাম না, যদি এই অনন্ত ঐক্য এক মুহূর্তের জন্যও ভেঙে যেত।