‘ক্রিটিক’, ৭ অক্টোবর, ১৮৯৩
ধর্ম-মহাসভার একটি পরিণাম এই যে, উহা একটি বিশেষ সত্যের প্রতি আমাদের চোখ খুলিয়া দিয়াছিল। ঐ সত্যটি হইল এইঃ প্রাচীন ধর্মমতসমূহের অন্তর্নিহিত দর্শনে বর্তমান মানুষের উপযোগী অনেক চমৎকার শিক্ষণীয় বিষয় রহিয়াছে। একবার যখন ইহা আমরা পরিষ্কাররূপে বুঝিতে পারিলাম, তখন ঐ-সকল ধর্ম-ব্যাখ্যাতাগণের প্রতি আমাদের ঔৎসুক্য বাড়িয়া চলিল এবং স্বভাবসুলভ অনুসন্ধিৎসা লইয়া আমরা তাঁহাদিগকে বুঝিতে তৎপর হইলাম। ধর্ম-মহাসভা শেষ হইলে উপযুক্ত সত্যটি হৃদয়ঙ্গম করা সহজ হইয়াছিল সিউআমি বিবেকানন্দের বক্তৃতা এবং প্রসঙ্গগুলির মাধ্যমে। বিবেকানন্দ এখন এই শহরে (চিকাগো) রহিয়াছেন। তাঁহার এই দেশে আসিবার মূল উদ্দেশ্য ছিল—তাঁহার স্বদেশবাসী হিন্দুগণের মধ্যে নূতন নূতন শ্রমশিল্প আরম্ভ করিতে আমেরিকানগণকে প্ররোচিত করা। কিন্তু বর্তমানে সাময়িকভাবে তিনি ঐ পরিকল্পনা ত্যাগ করিয়াছেন, কেননা তিনি দেখিতেছেন, আমেরিকান জাতি পৃথিবীতে সর্বাপেক্ষা বদান্য বলিয়া এই দেশে বহু লোক নানা উদ্দেশ্যে সাহায্যের জন্য আসিতেছে। আমেরিকায় এবং ভারতে দরিদ্রদের আপেক্ষিক অবস্থার কথা জিজ্ঞাসা করিলে বিবেকানন্দ জবাব দিলেন, আমেরিকায় যাহাদিগকে গরীব বলা হয়, তাহারা ভারতে গেলে রাজার হালে থাকিতে পারিবে। তিনি চিকাগোর নিকৃষ্ট পাড়া ঘুরিয়া দেখিয়াছেন। তাহাতে তাঁহার উক্ত সিদ্ধান্তই পাকা হইয়াছে। আমেরিকার অর্থনৈতিক মান দেখিয়া তিনি খুশী।
যদিও বিবেকানন্দ উচ্চ ব্রাহ্মণকুলে জন্মিয়াছিলেন, তথাপি সন্ন্যাসিসঙ্ঘে যোগদান করিবার জন্য তিনি কুলমর্যাদা ত্যাগ করিয়াছেন। সন্ন্যাসীকে স্বেচ্ছায় জাতির সব অভিমান বিসর্জন দিতে হয়। বিবেকানন্দের আকৃতিতে তাঁহার আভিজাত্য সুচিহ্নিত। তাঁহার মার্জিত রুচি, বাগ্মিতা এবং মনোমুগ্ধকর ব্যক্তিত্ব আমাদিগকে হিন্দু সংস্কৃতি সম্বন্ধে নূতন ধারণা দিয়াছে। তাঁহার প্রতি লোকে স্বতই একটি আকর্ষণ অনুভব করে। তাঁহার মুখশ্রীতে এমন একটি কমনীয়তা, বুদ্ধিমত্তা ও জীবন্তভাব আছে যে, উহা তাঁহার গৈরিক পোষাক এবং গভীর সুমিষ্ট কণ্ঠস্বরের সহিত মিলিয়া মানুষের মনকে অবিলম্বে তাঁহার প্রতি অনুকূল করে। এই জন্য ইহা মোটেই আশ্চর্য নয় যে, অনেক সাহিত্য-সভা তাঁহাকে বক্তৃতার জন্য আহ্বান করিয়াছে এবং বহু গীর্জাতেও তিনি ধর্মালোচনা করিয়াছেন। ইহার ফলে বুদ্ধের জীবন এবং বিবেকানন্দের ধর্মমত আমাদের নিকট সুপরিচিত হইয়া উঠিয়াছে। তিনি কোন স্মারকলিপি ছাড়াই বক্তৃতা দেন, তথ্য এবং সিদ্ধান্ত এমন নিপুণভাবে ন্যস্ত করেন যে, তাঁহার আন্তরিকতায় দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে। তাঁহার বলিবার উদ্দীপনা মাঝে মাঝে এত বাড়িয়া যায় যে, শ্রোতারা মাতিয়া উঠে। বিবেকানন্দ একজন যোগ্যতম জেসুইট ধর্মযাজকের মতই পণ্ডিত ও সংস্কৃতিমান্। তাঁহার মনের গঠনেও জেসুইটদের খানিকটা ধাঁচ যেন আছে। তাঁহার কথোপকথনে ছোট ছোট ব্যঙ্গোক্তিগুলি ছুরির মত ধারাল হইলেও এত সূক্ষ্ম যে, তাঁহার অনেক শ্রোতাই উহা ধরিতে পারে না। তথাপি তাঁহার সৌজন্যের কখনও অভাব হয় না। তিনি আমাদের রীতিনীতির এমন কোন সাক্ষাৎ সমালোচনা কখনও করেন না, যাহাতে উহা কটু শোনায়। বর্তমানে তিনি আমাদিগকে তাঁহার বৈদান্তিক ধর্ম ও দার্শনিকগণের বাণী সম্বন্ধে শিক্ষা দিতেছেন। বিবেকানন্দের মতে অজ্ঞান জনগণের জন্য মূর্তিপূজার প্রয়োজন রহিয়াছে; তবে তিনি আশা করেন, এমন সময় আসিবে যখন আমরা সাকার উপাসনা এবং পূজা অতিক্রম করিয়া বিশ্বপ্রকৃতিতে ভগবানের সত্তা অনুভব করিব, মানুষের মধ্যে দেবত্বের উপলব্ধি করিতে পারিব। বুদ্ধ দেহত্যগ করিবার আগে যেমন বলিয়াছিলেন, বিবেকানন্দও সেইরূপ বলেন—‘তোমার নিজের মুক্তি তুমি নিজেই সম্পাদন কর। আমি তোমাকে কোন সাহায্য করিতে পারি না। কেহই পারে না। নিজেই নিজেকে সাহায্য কর।’
লুসি মনরো