আমরা পাঁচ জন যে ঘরটিতে বসে আছি সেটি বেশ ছোট। ঘরটির দেয়াল কাঠের, দুপাশে বড় বড় জানালা, সেই জানালা দিয়ে বিস্তৃত প্রান্তর দেখা যায়। বাইরে ঝড়ো বাতাস, সেই বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে। ঘরের ভিতরে বসে আমরা বাতাসের শো শো শব্দ শুনতে পাই, কেন জানি না এই শব্দে বুকের মাঝে কেমন জানি এক ধরনের শূন্যতার জন্ম দেয়।
বড় জানালার একটিতে নুবা পা তুলে বসে আছে। বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকে সে তরল গলায় বলল, কী সুন্দর এই জায়গাটা!
হিশান হা হা করে হেসে বলল, তুমি সুন্দর বলছ এই জায়গাটাকে? জেনারেল ইকোয়া শুনলে হার্টফেল করে মারা যাবেন!
য়োমি বলল, বেচারাকে দোষ দিয়ে লাভ কী? আমাদের পাহারা দেবার জন্যে বাইরে এই ঝড়ো বাতাসে কতজন বসে আছে তুমি জান?
নুবা হাত নেড়ে বলল, দরকার কী পাহারা দেবার? আমরা কি ছোট শিশু।
ইগা মাথা নেড়ে বলল, বেচারাদের কোনো উপায় নেই। সংবিধানে লেখা আছে যার কাছে লাল কার্ড রয়েছে তাকে যে–কোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে।
নুবা তার পকেট থেকে লাল কার্ডটি বের করে সেটাকে এক নজর দেখে বলল, এটা নিয়ে তো দেখি মহা যন্ত্রণা হল।
তা বলতে পার। আমি হেসে বললাম, কাল তোমরা যখন আমাকে ছুটি দিলে আমি হাঁটতে বের হয়েছিলাম, সাথে সাথে একটা বিশাল বাই ভার্বাল হাজির! যার বাসায় গিয়েছি চোখের পলকে তার বাসার সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল! সেই বাসার মানুষটি বিয়ে করবে সে জন্যে উপহার
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি।
কীভাবে হয়েছে শুনি?
আমি খুলে বলতে গিয়ে থেমে গেলাম। বললাম, একটা জিনিস লক্ষ করছ? আমরা ইচ্ছে করে অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে কথা বছি আমাদের যে ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলা দরকার সেটা এড়িয়ে যাচ্ছি?
নুবা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, সত্যি। তুমি ঠিকই বলেছ রিকি। ব্যাপারটা এমন মন খারাপ করা যে সেটা নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না।
কিন্তু বলতে হবে।
হ্যাঁ। বলতে হবে।
ইগা য়োমির দিকে তাকিয়ে বলল, য়োমি তুমি আমাদের সবাইকে পুরো ব্যাপারটার একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।
আমি? য়োমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ইগার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি কেন?
দুটি কারণে। প্রথমত, আমি দেখেছি একটি মেয়ে সাধারণত খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে। দ্বিতীয়ত, তুমি শ্যালক্স গ্রুনকে ভালোভাবে বিশ্লেষণ করতে পারবে।
য়োমি তীব্র স্বরে কী একটা বলতে যাচ্ছিল, নুবা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ঠিক আছে আমি বলছি। যদি কিছু ভুল বলি তোমরা শুধরে দিও।
আমি নুবার দিকে খানিকটা হিংসার দৃষ্টিতে তাকালাম। কী সাদাসিধে দেখতে অথচ কী চমৎকার সহজ একটা নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা! ইয়েরিন রিসি নিশ্চয়ই অনেক ভেবেচিন্তে এই দলটিকে দাঁড় করিয়েছেন।
নুবা জানালা থেকে নেমে এসে একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। কয়েক মুহূর্ত নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা তুলে বলল, প্রথমে সবার পক্ষ থেকে রিকিকে ধন্যবাদ নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শ্যালক্স গ্রুনের সাথে দেখা করার জন্যে। রিকি আমাদের খুব মূল্যবান দুটি তথ্য এনে দিয়েছে। দুটি তথ্যই খুব মন খারাপ করা তথ্য, কিন্তু মূল্যবান তাতে সন্দেহ নেই। সত্যি কথা বলতে কী, এই দুটি তথ্য জানার পর আমাদের আর খুঁটিনাটি কিছু জানার নেই।
প্রথম তথ্যটি হচ্ছে শ্যালক্স গ্রুন ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করছে না। সে সত্যিই পুরো পৃথিবী ধ্বংস করতে চায়। কখন করবে সেই সময়টি সে এখনো ঠিক করে নি, কিন্তু সে তার চেষ্টা করবে। রিকির ধারণা ভয়ঙ্কর ভাইরাসের এম্পূলটি সে তার নিজের শরীরের ভিতরে রেখেছে। যতক্ষণ সে বেঁচে থাকবে এম্পূলটি অক্ষত থাকবে। কোনোভাবে তার মৃত্যু হলে সাথে সাথে এম্পুলটি ফেটে লিটুমিনা–৭২ ভাইরাস বের হয়ে পুরো পৃথিবী ধ্বংস করে দেবে।
রিকির ধারণা সত্যি। শ্যালক্স গ্রুনকে স্পর্শ করে তার ত্বকের যে নমুনা সে নিয়ে এসেছে সেটি পরীক্ষা করে বায়োবিজ্ঞানীরা একমত হয়েছেন। সত্যিই তার শরীরে একটি সিলাকিত কার্বনের এম্পুল রয়েছে। রিপোর্টটি ঘরে কোথাও আছে কৌতূহল হলে দেখতে পার।
হিশান আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এটি একটি অসম্ভব দুঃসাহসিক কাজ করেছ।
ইগা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। আমাদের প্রযুক্তি খুব উন্নত নয়। যদি আরো কয়েক শ বছর পরে হত, শ্যালক্স গ্রুনের ত্বকের কোষ ব্যবহার করে আরেকটি শ্যালক্স গ্রুন তৈরি করে তাকে ব্যবহার করা যেত–
নুবা হেসে ফেলে বলল, রক্ষা কর! একটি শ্যালক্স গ্রুন নিয়েই আমরা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি, দুটি হলে কী হবে চিন্তা করতে পার?
তা ঠিক।
যাই হোক, যা বলছিলাম, রিকির নিয়ে আসা দ্বিতীয় তথ্যটি বলা যেতে পারে খানিকটা আশাপ্রদ। শ্যালক্স গ্রুন পৃথিবীর কাছে ত্রিনিত্রি রাশিমালা দাবি করেছে। যার অর্থ সে এই মুহূর্তে পৃথিবীকে ধ্বংস করবে না। ত্রিনিত্রি রাশিমালা ব্যবহার করে সে আরো এক শ বছর ভবিষ্যতে পাড়ি দেবে। আমরা যদি তাকে ত্রিনিত্রি রাশিমালা দিই পৃথিবী আরো এক শ বছর সময় পাবে।
হিশান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু সেই এক শ বছর হবে অর্থহীন। শ্যালক্স গ্রুনের কাছে যদি ত্রিনিত্রি রাশিমালা থাকে সে আজ থেকে এক শ বছর পরে এসে পৃথিবীর পুরো প্রযুক্তি নিজের হাতে নিয়ে নেবে। পুরোটা ব্যবহার করবে নিজের স্বার্থে।
হ্যাঁ। নুবা একটা নিশ্বাস ফেলে চুপ করে যায়।
আমরাও চুপ করে বসে রইলাম। আমি জানি আমরা সবাই একটি কথা ভাবছি কিন্তু কেউই মুখ ফুটে কথাটি বলতে পারছি না। য়োমি শেষ পর্যন্ত আর চুপ করে থাকতে পারল না, অধৈর্য হয়ে বলে ফেলল, সবাই চুপ করে আছ কেন? বলে ফেল কেউ একজন।
ঠিক আছে আমি বলছি। আমি উঠে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম, বাতাসের বেগ মনে হয় আরো একটু বেড়েছে। বাইরে গাছের ডালগুলো এখন দাপাদাপি করছে।
ঘরের ভিতরে দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে আমি সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমরা। শ্যালক্স গ্রুনকে ত্রিনিত্রি রাশিমালা দেব। সেটি হবে আসলটির কাছাকাছি কিন্তু আসলটি নয়।
আমি দেখলাম সবাই কেমন যেন শিউরে উঠল। নুবা চাপা গলায় বলল, হায় ঈশ্বর! তুমি পৃথিবীর মানুষকে রক্ষা কর।
ইগা মাথা ঘুরিয়ে নুবার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি নিশ্চয়ই জান ঈশ্বর বলে কিছু নেই।
নুবা মাথা নেড়ে বলল, না আমি জানি না। কিন্তু আমার ভাবতে ভালো লাগে ঈশ্বর বলে একজন খুব ভালবাসা নিয়ে পৃথিবীর মানুষকে রক্ষা করে যাবেন।
ব্যাপারটি তোমার ঈশ্বরের জন্যে আরো সহজ হত যদি তিনি শ্যালক্স গ্রুনের জন্ম না দিতেন!
হিশান হঠাৎ হা হা করে উচ্চৈঃস্বরে হেসে ওঠে! মুবা এক ধরনের আহত দৃষ্টি নিয়ে ইগা এবং হিশানের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি বললাম, তোমরা এখন একজন আরেকজনের পিছনে লেগে সময় নষ্ট কোরো না। আমাদের অনেক কাজ বাকি
ইগা মাথা নাড়ল, আসলে কাজ খুব বেশি বাকি নেই। সবচেয়ে বড় কাজটি ছিল সিদ্ধান্তটি নেয়া, সেটি যখন নেয়া হয়ে গেছে অন্য কাজগুলো সহজ।
কিন্তু সিদ্ধান্তটি কি নেয়া হয়েছে?
সবাই নুবার দিকে ঘুরে তাকাল। নুবা একটু অবাক হয়ে বলল, সবাই আমার দিকে তাকাচ্ছ কেন?
ইগা বলল, দুটি কারণে। প্রথম কারণ, তোমার ভিতরে একটি সহজাত নেতৃত্বের ক্ষমতা রয়েছে, আমরা সবাই সেই নেতৃত্ব মেনে নিয়েছি। দ্বিতীয় কারণ, তুমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস কর। এই ধরনের গুরুতর সিদ্ধান্ত নিতে হলে মনে হয় ঈশ্বরের বিশ্বাস করা খারাপ নয়। খানিকটা দায়–দায়িত্ব তাকে দেয়া যায়–
বাজে কথা বোলো না।
ইগা হেসে বলল, আমি কথাটি হালকাভাবে বলেছি, কিন্তু কথাটি সত্যি।
নুবা ঘুরে আমাদের দিকে তাকাল এবং আমরা সবাই মাথা নাড়লাম। ধীরে ধীরে নুবার মুখে এক ধরনের কাঠিন্য এসে যায়। সে দীর্ঘ সময় জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক আছে আমরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছি শ্যালক্স গ্রুনকে সত্যিকারের ত্রিনিত্রি রাশিমালা দেয়া হবে না।
চমৎকার। হিশান উঠে গিয়ে নুবার কাঁধ স্পর্শ করে বলল, এখন আমাদের দায়িত্ব ভাগ করে দাও।
বেশ। নুবা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, শ্যালক্স গ্রুন ত্রিনিত্রি রাশিমালা হাতে পাওয়ার পর সেটি সত্যি কি না পরীক্ষা করে দেখবে। সে কীভাবে সেটি পরীক্ষা করবে সেটা আমাদের আগে থেকে জানতে হবে। সেটা বের করার দায়িত্ব দিচ্ছি রিকি এবং য়োমিকে। তোমাদের আপত্তি আছে?
আমি এবং য়োমি একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম তারপর মাথা নাড়লাম, না আপত্তি নেই।
চমৎকার। যেহেতু আমরা সত্যিকারের ত্রিনিত্রি রাশিমালা দেব না, এবং শ্যালক্স গ্রুন সেটা জানে না–আমরা তার যন্ত্রপাতির মাঝে তার কম্পিউটারের তথ্য ডাটাবেসের মাঝে বড় পরিবর্তন করে দিতে পারব। সেটি কীভাবে করা হবে তার একটা ধারণা করার দায়িত্ব দিচ্ছি ইগা এবং হিশানকে।
ইগা এবং হিশান খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। হিশান মাথা চুলকে বলল, আমি আসলে বিজ্ঞান ভালো জানি না।
জানার প্রয়োজনও নেই। সে ব্যাপারে তোমাদের সাহায্য করবে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীরা।
বেশ। হিশান মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী করবে?
শ্যালক্স গ্রুন যখন ত্রিনিত্রি রাশিমালা পরীক্ষা করে দেখবে সারা পৃথিবীতে তখন একটা প্রলয় কাণ্ড ঘটবে। আমি চেষ্টা করব সেটি যেন সত্যিকারের প্রলয় কাণ্ড না হয়। সেটি যেন দেখায় প্রলয় কাণ্ডের মতো–কিন্তু আসলে যেন প্রলয় কাণ্ড না হয়। ব্যাপারটিতে আমার তোমাদের সাহায্যের দরকার হবে কিন্তু সেটি নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা নয়।
আমরা মাথা নাড়লাম, না কোনো সমস্যা নয়। চমৎকার, এবার তাহলে জেনারেল ইকোয়াকে ডাকা যাক।
নুবা তার লাল কার্ডটি স্পর্শ করতে যাচ্ছিল ঠিক তখন য়োমি বলল, তোমরা সবাই নিশ্চয়ই জান জেনারেল ইকোয়া একজন রবোট?
আমরা মাথা নাড়লাম, জানি।
য়োমি হঠাৎ ঘুরে আমার দিকে তাকাল, রিকি তুমি ঠিক কখন সেটা বুঝতে পেরেছ?
প্রথমদিন যখন দেখা হল, আমাদের লাল কার্ড দেয়া হয়েছে শুনে যখন খুব অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকাল। তার চোখের দিকে তাকাতেই মনে হল কী যেন নেই
তুমি যদি চোখের দিকে না তাকাতে তাহলে কি বলতে পারতে?
না, মনে হয় না। আজকাল এত চমৎকার মানুষের মতো রবোট তৈরি করে যে সেটা বলা খুব কঠিন।
আমি হঠাৎ ঘুরে য়োমির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কেন এটা আমাকে জিজ্ঞেস করলে?
য়োমি চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, না, এমনি জানতে চেয়েছি।
য়োমির গলার স্বরে কিছু একটা ছিল, আমি হঠাও বুঝতে পারলাম সে আমার কাছে থেকে কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে। কী হতে পারে সেটি? কেন সে আমাকে জানতে দিতে চায় না?