[বেলুড় মঠে তদীয় সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মচারী শিষ্যগণের নিকট কথাপ্রসঙ্গে বলেনঃ]
সন্ন্যাসীদের কার্যে যথা, মঠ ও মণ্ডলী-পরিচালনা, জনসমাজে ধর্মপ্রচার ও অনুষ্ঠানপ্রণালীর প্রবর্তন, ত্যাগ ও ধর্মমতামত-সম্বন্ধীয় স্বাধীন চিন্তার সীমানিরূপণ ইত্যাদিতে সংসারী ব্যক্তির কোন মতামত দেওয়ার অধিকার থাকা উচিত নহে। সন্ন্যাসী ধনী লোকের সঙ্গে কোন সম্বন্ধ রাখবে না—তার কাজ গরীবকে নিয়ে। সন্ন্যাসীর কর্তব্য পরম যত্নের সহিত প্রাণপণে গরীবদের সেবা করা আর এরূপ সেবা করতে পারলে পরমানন্দ অনুভব করা। আমাদের দেশের সকল সন্ন্যাসি-সম্প্রদায়ের ভিতর ধনী লোকের তোষামোদ করা এবং তাদের উপর বিশেষভাবে নির্ভর করার ভাব প্রবেশ করাতে সেগুলি উৎসন্ন যেতে বসেছে। যথার্থ সন্ন্যাসী যিনি, তাঁর কায়মনোবাক্যে এটা ত্যাগ করা উচিত। এভাবে ধনী লোকের পেছনে ঘোরা বেশ্যারই উপযুক্ত, সংসারত্যাগীর পক্ষে নয়। কাম-কাঞ্চনত্যাগীই ছিল শ্রীরামকৃষ্ণদেবের মূলমন্ত্র, সুতরাং ঘোর কাম-কাঞ্চনে মগ্ন ব্যক্তি কি করে তাঁর শিষ্য বা ভক্তরূপে পরিগণিত হতে পারে? তিনি ভগবতীর নিকট প্রার্থনা করতেন, ‘মা, কথা কইবার জন্যে আমার কাছে এমন একজন লোক এনে দে, যার ভেতর কাম-কাঞ্চনের লেশমাত্র নেই, সংসারী লোকের সঙ্গে কথা কয়ে কয়ে আমার মুখ জ্বলে গেল।’ তিনি আরও বলতেন, ‘সংসারী এবং অপবিত্র লোকের স্পর্শ আমি সহ্য করতে পারি না।’ তিনি ‘ত্যাগীর বাদশা’ ছিলেন—সংসারী লোক কখনও তাঁকে প্রচার করতে পারে না। সংসারী গৃহস্থ লোক কখনও সম্পূর্ণ অকপট হতে পারে না, কারণ তার কিছু না কিছু স্বার্থপর উদ্দেশ্য থাকবেই। ভগবান্ স্বয়ং যদি গৃহস্থরূপে অবতীর্ণ হন, আমি তাঁকে কখনও অকপট বলে বিশ্বাস করতে পারি না। গৃহস্থলোক যদি কোন ধর্মসম্প্রদায়ের নেতা হয়, তবে সে ধর্মের নামে নিজেরই স্বার্থসিদ্ধি করতে থাকে, আর তার ফল এই হয় যে, সম্প্রদায়টি একেবারে আগাগোড়া গলদে পূর্ণ হয়ে যায়। গৃহস্থগণ যে-সকল ধর্মান্দোলনের নেতা হয়েছেন, সবগুলিরই ঐ এক দশা হয়েছে। ত্যাগ ব্যতীত ধর্ম দাঁড়াতেই পারে না।
এই সময়ে একজন সন্ন্যাসী শিষ্য জিজ্ঞাসা করলেন, ‘স্বামীজী, ঠিক ঠিক কাঞ্চন ত্যাগ কাহাকে বলা যায়?’ স্বামীজী হেসে বললেনঃ হাঁ, তোর প্রশ্নের উদ্দেশ্য বুঝেছি। সংসার ত্যাগ করে এসেই আমার এবং মঠের টাকাকড়ি রাখবার ভার তোর ওপর পড়েছে কিনা, তাই তোর মনে এই সন্দেহ হয়েছে। এখন এর মধ্যে বুঝতে হবে এইটুকু যে, উপায় আর উদ্দেশ্য। বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্য-সাধনের জন্যে বিশেষ বিশেষ উপায় অবলম্বিত হয়ে থাকে। অনেক সময়ে দেখা যায়, উদ্দেশ্য একই, কিন্তু তার জন্য বিভিন্ন দেশকালপাত্রে বিভিন্ন উপায় অবলম্বিত হচ্ছে। সন্ন্যাসীর উদ্দেশ্য—নিজের মুক্তিসাধন এবং জগতের হিত করা—‘আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ।’ আর ঐ উদ্দেশ্য-সাধনের প্রধান উপায়—কাম-কাঞ্চনত্যাগ। কিন্তু এটি বিশেষভাবে স্মরণ রাখতে হবে যে, ‘ত্যাগ’ অর্থে মনের আসক্তি-ত্যাগ—সর্বপ্রকার স্বার্থের ভাব ত্যাগ। নইলে আমি অপরের নিকট টাকা গচ্ছিত রাখলাম—হাতে টাকা ছুঁলাম না, কিন্তু টাকা দ্বারা যে-সব সুবিধে হয়, সব ভোগ করতে লাগলাম—তাকে কি আর ত্যাগ বলা যায়? যে সময়ে গৃহস্থেরা মনু ও অন্যান্য স্মৃতিকারগণের উপদেশ মেনে সন্ন্যাসী অতিথিদের জন্য তাদের খাদ্যের কিয়দংশ পৃথক্ করে রেখে দিতেন, সে-সন্ন্যাসীর পক্ষে কাছে পয়সা-কড়ি কিছু না রেখে ভিক্ষাবৃত্তি দ্বারা জীবনধারণ করলে কাঞ্চনত্যাগের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হত। এখন কিন্তু কাল-ধর্মে গৃহস্থের সে ভাব বড়ই কম—বিশেষতঃ বাঙলাদেশে তো মাধুকরী ভিক্ষের প্রথাই নেই। এখন মাধুকরী ভিক্ষের ওপর নির্ভর করে থাকবার চেষ্টা করলে অনর্থক শক্তিক্ষয়ই হবে,৩কিছু লাভ হবে না। ভিক্ষের বিধান কেবল সন্ন্যাসীর পূর্বোক্ত উদ্দেশ্যদ্বয়ের সিদ্ধির জন্য, কিন্তু ঐ উপায়ে এখন আর সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না। সুতরাং এ অবস্থায় যদি কোন সন্ন্যাসী নিজের জীবনযাত্রার উপযোগী মাত্র অর্থ সংগ্রহ করে যে উদ্দেশ্যে তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেছেন, তার সিদ্ধির জন্যে সমুদয় শক্তি প্রয়োগ করেন, তা হলে তাতে সন্ন্যাসধর্মের মূল উদ্দেশ্যের বিপরীতাচরণ হয় না। অনেক সময় লোকে অজ্ঞতাবশতঃ উপায়কেই উদ্দেশ্য করে তোলে। দু-একটা দৃষ্টান্ত ভেবে দেখ। অনেক লোকের জীবনের উদ্দেশ্য—ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ। তার উপায়রূপে সে টাকা রোজগার করতে আরম্ভ করে। কিন্তু এখানেও উদ্দেশ্য ভুলে উপায়ের প্রতি এতদূর আসক্ত হয় যে, টাকা-সঞ্চয়ই করতে থাকে, তা ব্যয় করে যে ভোগ করবে, তার ক্ষমতা পর্যন্ত তার থাকে না। আরও দেখ, কাপড়-চোপড় কাচবার উদ্দেশ্য—শুচি ও শুদ্ধ হওয়া। কিন্তু আমরা অনেক সময়ে কাপড়-চোপড় শুধু একবার জলে ফেলে নিংড়িয়ে নিলেই শুচি হলাম মনে করি। এই-সব জায়গায় আমরা উপায়কে উদ্দেশ্যের আসনে বসিয়ে গোলমাল করে ফেলি। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য কখনই ভুল করা উচিত নয়।